অধ্যায় পাঁচ – লৌহযুগ

অধ্যায় পাঁচ – লৌহযুগ 

সিন্ধু নদের উপত্যকায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০২ সালে উত্তর থেকে আসা যাযাবররা শহর বানিয়ে বসবাস করতে শুরু করে। 

সেই বছরগুলোতে, যখন কিশের রাজা ইউফ্রেটিস নদীর মধ্য দিয়ে যাতায়াতকারী জাহাজগুলো থেকে খাজনা আদায় করছিলেন এবং যখন মেমফিস শহরের সাদা প্রাচীর মিশরের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল, তখন প্রাচীন তৃতীয় বৃহত্তর সভ্যতাটি একটি নদীর তীরবর্তী সমতলভূমিতে কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রামের সন্নিবেশ মাত্র। ভারতবর্ষে আরও ছয় হাজার বছরের মাঝেও কোনো বড়ো শহর কিংবা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়নি। 

সিন্ধু নদের তীরে যারা বসতি স্থাপন করেছিলেন তারা শহুরে অধিবাসী ছিলেন না এমনকি তারা সুমেরীয়দের মতো কোনো তালিকাও সংরক্ষণ করেননি। তারা তাদের নেতাদের চেহারাকে মূর্তির মাঝে খোদাই করেননি কিংবা তাদের সাফল্যের বার্তাগুলোকে কোনো পাথরের ট্যাবলেটে লিপিবদ্ধ করেননি। এসকল কারণে ভারতবর্ষের প্রথম কয়েক শতক সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুবই সীমাবদ্ধ। 

আমরা চাইলে ভারতীয় পুরাণের দ্বারস্থ হতে পারি এ-সংক্রান্ত সূত্র খুঁজে পাওয়ার জন্য। যদিও সেগুলো অনেক দেরিতে লেখা হয়েছিল (প্রথম আবাস সৃষ্টির হাজার হাজার বছর পরে, শত বছর নয়), তবুও ধরে নেওয়া যায় যে সেখানে অনেক আগের ঐতিহ্য সম্পর্কে বলা আছে। কিন্তু সেই বর্ণনাতেও শুধু একজন রাজা এবং একটিমাত্র দিনকে আলাদা করে চেনা যায়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০২ সালে বিজ্ঞ রাজা মানু ‘বর্তমান যুগ’ শুরু করেন এবং তার সেই যুগের এখনও চার লাখ বছর বাকি রয়েছে। 

খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০২ সালের অনেক আগেই মেষপালক ও যাযাবররা ভারতবর্ষে আসে। তারা মধ্য এশিয়া থেকে এখনকার খাইবার পাস (যা উত্তরের পাহাড়ি এলাকার মাঝে অবস্থিত একটি গিরিখাত) পেরিয়ে ভারতে এসে পৌঁছায়। কিছু মানুষ সরাসরি হিমালয় পর্বত পেরিয়ে এসেছিল। পরবর্তীতে খুঁজে পাওয়া প্রাচীন কিছু দেহাবশেষ এটাই প্রমাণ করে যে এই রাস্তাটি যথেষ্ট পরিমাণে বিপদসংকুল ছিল—এখনের মতোই। 

তারা পর্বতের অপরপাশে উষ্ণতা ও পানি দুটোই খুঁজে পেয়েছিল। 

হিমালয় পর্বতমালা তুষারপাতের জন্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করত, যে কারণে শীতকালেও তাপমাত্রা পঞ্চাশ ডিগ্রি ফারেনহাইটের নিচে নামত না। গ্রীষ্মকালে সূর্যের প্রখর আলোতে ভারতের গ্রামাঞ্চলে গনগনে তাপের সৃষ্টি হতো। কিন্তু দুইটি বড়ো বড়ো নদীর কারণে উপমহাদেশে মরুভূমির মতো অনুর্বরতা কখনোই তৈরি হয়নি। 

মানচিত্র-৫ : প্রাচীন ভারত 
মানচিত্র-৫ : প্রাচীন ভারত 

গলন্ত তুষার আর বরফ পর্বত থেকে নেমে এসে সিন্ধু নদের সাথে মিশে যেত এবং এই সম্মিলিত জলধারা উত্তর-পশ্চিমদিক থেকে ভারতের মধ্য দিয়ে গিয়ে আরব সাগরে পতিত হতো। একই পাহাড় থেকে গঙ্গা নদীরও উৎপত্তি এবং তা হিমালয়ের ঢাল থেকে নেমে এসে পূর্বে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরে মিশে যেত। 

মেসোপটেমিয়া এবং মিশরে প্রথম শস্যের ফলনের প্রায় দুই হাজার বছর পরে সিন্ধু নদের ঠিক পশ্চিমপাশে অবস্থিত পাহাড়ি এলাকায় উত্তর থেকে আসা যাযাবররা ঘর বেঁধেছিল। এই জায়গাটির বর্তমান নাম বালুচিস্তান। সিন্ধু নদের ঊর্ধ্ব ও নিম্নভাগে ছোটো ছোটো বেশ কিছু গ্রাম ছড়িয়ে পড়েছিল। উপরের ভাগটি পাঁচটি শাখায় বিভক্ত হয়ে পাঞ্জাব (পাঞ্জ-আব; অর্থাৎ পাঁচ নদী) হিসেবে পরিচিত হয়েছিল। গঙ্গার পাড়েও কিছু গ্রামের গোড়াপত্তন হয়েছিল। 

ভারতের দক্ষিণে প্রাপ্ত কিছু যন্ত্রপাতি দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় যে কিছু সাহসী মানুষ আফ্রিকা থেকে জলপথে ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম তীরে এসে পৌঁছেছিল এবং সেখানেই আবাস গেড়েছিল। 

কিন্তু এই তিনটি এলাকা—-দক্ষিণ, পূর্ব এবং উত্তর-পশ্চিমের মাঝে ছিল সুবিশাল প্রাকৃতিক প্রাচীর। হাজার হাজার মাইলব্যাপী সমতলভূমি এবং দুটি বৃহৎ পর্বতমালা—বিন্ধ্যা ও সাতপুরা —উত্তর থেকে দক্ষিণের মানুষদের আলাদা করে রেখেছিল, যার ইতিহাস আমরা আরও পরে জানতে পারি। আবহাওয়া উষ্ণতর হতে থাকে এবং তিনশ মাইলব্যাপী একটি মরুভূমি জন্ম নেয় গঙ্গার উপত্যকা এবং উত্তর-পশ্চিমের বসতিগুলোর মাঝে। 

ভারতের ইতিহাসের একদম শুরু থেকেই এই তিন এলাকার মানুষ একে অপরের দূরত্বে থেকে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে থাকে। 

সিন্ধুর তীরবর্তী গ্রামগুলো সবার আগে শহরে রূপান্তরিত হয়।

সিন্ধু নদীর উপত্যকায় প্রাচীনতম বাড়িগুলো তৈরি হয়েছিল নদীর পার্শ্ববর্তী সমতলভূমিতে। এই বাড়িগুলো বন্যার পানির সর্বোচ্চ উচ্চতা থেকেও উঁচুতে অবস্থিত ছিল এবং তারা নদী থেকে প্রায় মাইলখানেক দূরে অবস্থিত ছিল। 

তবে কাদার তৈরি ইটগুলো নদীর পানিতে গলে যেত এবং শস্যগুলোও পানিতে ভেসে যেত। সিন্ধু উপত্যকার বাসিন্দাদের প্রাথমিক উপলব্ধি ছিল মিশরীয় কিংবা সুমেরীয়দের মতোই—পানি একইসাথে জীবন ও মৃত্যুর প্রতীক। 

সেখান থেকেই আমরা ভারতের প্রথম রাজার কাহিনিতে আসতে পারি। মানুর আগে, পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী, ছয়জন প্রায়-স্বর্গীয় রাজা ভারতে রাজত্ব করেছিলেন। প্রত্যেকের নামের সাথেই মানুর ভালো নাম ‘ভবিষ্যৎ’ যুক্ত ছিল এবং প্রত্যেকেই এক মন্বন্তরজুড়ে রাজত্ব করেছিলেন, যা চল্লিশ লক্ষ বছরের চেয়ে বেশি। 

এখানে আমরা ইতিহাস নয় বরং পুরাণের জগতে বিচরণ করছি; কিন্তু ঐতিহ্যগতভাবে আমরা বলতে পারি যে পুরাণের সাথে ইতিহাসের সংযুক্তি ঘটেছিল সপ্তম মানুর আমলে। এই মানু, যাকে মাঝে মাঝে শুধুই ‘মানু’ কিংবা তার পুরো নাম ‘মানু ভবিষ্যৎ’ বলে অভিহিত করা হয়, একদিন নদীর ধারে বসে হাত ধুচ্ছিলেন। তখন একটি ছোটো মাছ এসে তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে-বড়ো এবং শক্তিশালী মাছদের কাছ থেকে, যারা নদীর ঐতিহ্য অনুযায়ী দুর্বলের উপর বারবার আঘাত হানত। মানু দয়াশীল হয়েছিলেন এবং মাছটিকে বাঁচিয়েছিলেন। 

মানচিত্র-৬ : প্রাচীন ভারতের বাণিজ্য পথ 
মানচিত্র-৬ : প্রাচীন ভারতের বাণিজ্য পথ 

অন্যের খাদ্যে পরিণত হওয়ার বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে ছোটো মাছটি এই দয়ার প্রতিদান দেয় মানুকে—একটি আসন্ন বন্যার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে, যে বন্যা স্বর্গসমূহ এবং পৃথিবী উভয়কেই গ্রাস করে ফেলবে। প্রস্তুতি হিসেবে মানু একটি কাঠের জাহাজ তৈরি করেন এবং সাতজন জ্ঞানী ঋষিকে সাথে নেন। বন্যার প্রকোপ কমে আসার পর মানু দূর উত্তরের পর্বতমালার কাছাকাছি এলাকায় তার জাহাজের নোঙর ফেলেন এবং সেখানে অবতরণ করে (লিখিত ইতিহাস অনুযায়ী) ভারতবর্ষের প্রথম রাজা হিসেবে আবির্ভূত হন। সেই সাতজন ঋষি সপ্তর্ষিমণ্ডলের সাতটি তারায় পরিণত হন। বছরটি ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০২। 

ভারতের ইতিহাসকে পুনর্গঠনকল্পে নিম্নের বর্ণনাটিতে সত্যের চেয়ে ধোঁয়াশার প্রভাব বেশি। ঐতিহাসিক রাজা হিসেবে ‘মানু ভবিষ্যৎ’ চরিত্রটির গ্রহণযোগ্যতা মিশরের স্করপিয়ন রাজার চেয়েও কম ছিল; যদিও ধারণা করা হয় যে একই শতাব্দীতে তাদের আবির্ভাব ঘটেছিল এবং আশ্চর্যজনকভাবে, দুই সহস্র বছর পরে গবেষকদের করা হিসেব অনুযায়ী, দুজনেই একই বছরে রাজা হয়েছিলেন (৩১০২)। সেই সময় থেকেই কথায় বর্ণিত ইতিহাসকে আনুষ্ঠানিকভাবে লিপিবদ্ধ করা শুরু হয়। এই বছরটি ভারতের বিভিন্ন ইতিহাস বর্ণনায় খুঁজে পাওয়া যায়। জন কিয়েই লিখেছিলেন, ‘এটাই ভারতের ইতিহাসের প্রথম বিশ্বাসযোগ্য তারিখ। এবং এটির সুনির্দিষ্টতার কারণেই এই তারিখটি শ্রদ্ধার দাবিদার।’ 

তবে খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০২-এর ব্যাপারে একটি ঘটনাই নিশ্চিতভাবে বলা যায়, যেটা হচ্ছে, সেই সময়ে সিন্ধু উপত্যকার গ্রামগুলো শহরে রূপান্তরিত হতে শুরু করেছিল। সেখানে তখন দোতলা দালান উঠতে দেখা গিয়েছিল এবং সেখানকার বাসিন্দারা চাকার মাধ্যমে বড়ো বড়ো পাত্র পরিবহণ করা শুরু করেছিল। এ ছাড়া তারা তামার তৈরি যন্ত্রপাতি ব্যবহার শুরু করে, যার মাধ্যমে তারা জঙ্গল কেটে সাফ করে এবং চুল্লিতে কাদামাটি পোড়ানো শুরু করে। চুল্লিতে পুড়িয়ে তৈরি করা ইট সূর্যালোকে শুকানো ইটের চেয়ে বেশি মজবুত ছিল এবং তা বন্যার পানির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বেশি টেকসই ছিল। ৩১০২ সালের পরে পানি আর আগের মতো ধ্বংসাত্মক থাকতে পারেনি। 

যেসব বাড়িতে উচ্চবিত্তরা থাকতেন সেগুলোর ধ্বংসাবশেষ থেকে উত্তর মেসোপটেমিয়ার সমতলভূমি থেকে নিয়ে আসা নীলকান্তমণি ও নীলা পাথর পাওয়া গিয়েছে। শহরের বাসিন্দারা তাদের উপত্যকা থেকে বের হয়ে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মাধ্যমে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়েছিল। তারা কিশের রাজার কাছে এবং নিপপুর ও উর শহরে মূল্যবান পাথর সরবরাহ করতেন। 

সিন্ধু নদের তীরবর্তী শহরগুলোর ক্রমশ উন্নতি হয় এবং তাদের সীমানার বিস্তার ঘটতে থাকলেও ভারতীয় পুরাণে তাদের উন্নতি নয় বরং অবনতির কথা বলা আছে। বন্যার পানিতে আগের যুগের সকল চিহ্ন মুছে গিয়েছিল আর শহুরে যুগকে কলিযুগ বলা হতো কিংবা লৌহযুগ। এই সময় সত্যবাদিতা, সহমর্মিতা, দানশীলতা ও ধর্মভীরুতা আগের তুলনায় চার ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছিল। পবিত্র গ্রন্থগুলোতে লেখা আছে যে লৌহযুগে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তি আত্মসাৎ করা শুরু করেন; এই বলে যে সেটা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ক্রোক করা হচ্ছে। শক্তিশালী মানুষরা দুর্বলদের সহায়সম্পত্তি দখল করে নিচ্ছিলেন। উচ্চবিত্তরা তাদের জমিজমা এবং গবাদি পশুর মায়া ত্যাগ করে সারাদিন কাটাতে লাগলেন তাদের ধনসম্পত্তি রক্ষার কাজে। যারা আগে স্বাধীন মানব ছিল এবং জানত কীভাবে এই পৃথিবীর বিভিন্ন রসদ ব্যবহার করে ভালোভাবে বেঁচে থাকা যায়, তারাই সব ভুলে গিয়ে তাদের জাগতিক সম্পত্তির দাসে রূপান্তরিত হলো। 

এসব ভয়ানক সতর্কবাণী অনেক পরে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল, যা থেকে বোঝা যায় যে এই চিন্তাগুলো মানসিকভাবে পরিপক্ক একটি সমাজ থেকে এসেছে—এমন একটি সমাজ যেখানে ততদিনে অকর্মণ্য আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রচলন হয়ে গিয়েছে, যার একমাত্র কাজ ছিল জাতীয় কোষাগার খালি করা। কিন্তু গল্প-লেখকদের ভাষ্য অনুযায়ী সময়টা ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৩১০২ সাল; যে বছর গ্রামগুলো শহরে রূপান্তরিত হতে শুরু করেছিল। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *