অধ্যায় সাতাশ – আহমোস হিকসোসদের বহিষ্কার করলেন

অধ্যায় সাতাশ – আহমোস হিকসোসদের বহিষ্কার করলেন 

শরে থেবিসের ফারাও রাজা খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৭০ থেকে ১৫৪৬ সালের মধ্যে হিকসোসদের পরাজিত করেন। 

থেবিসের ফারাও রাজা সিকুইনেরে হিকসোসদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তার বড়ো ছেলে কাহমোস সিংহাসনে বসেন। তখনও হিকসোসদের সবচেয়ে বেশি বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকা রাজা আপেপি প্ৰথম ক্ষমতাসীন ছিলেন। কাহমোস তার পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হলেন। 

কিন্তু তার এই পরিকল্পনায় বাদ সাধল রূঢ় বাস্তবতা। থেবেস রাজত্ব উত্তরের একটি বৈরী-রাষ্ট্র এবং দক্ষিণে সেই রাষ্ট্রের আরেকটি মিত্র রাষ্ট্রের মাঝে স্যান্ডউইচের মতো লুকিয়ে ছিল। এই ঘটনাপ্রবাহের অল্পদিন আগে নুবিয়ার মিশরীয় গভর্নররা কেন্দ্রীয় শাসন থেকে নিজেদের আলাদা করে নেন। নুবিয়ার স্থানীয় বাসিন্দারা সেই অঞ্চলের সব বড়ো সরকারি পদগুলো দখল করে নিয়েছিলেন এবং বহু বছর ধরে তারা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মতো করেই নিজেদের পরিচালনা করছিলেন। হিকসোসের পঞ্চদশ রাজবংশের শাসকরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ না করে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। সেই কারণে থেবেস থেকে আক্রমণ এলে নুবিয়ানরা হিকসোসের সাহায্যে এগিয়ে এলেন এবং কাহমোসকে দুদিক থেকে আসা প্রতিরোধের মোকাবিলা করতে হলো। 

তবে থেবিস রাজ্যের কাহমোসও ব্যাপারটি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। যখন তিনি নীল নদের তীর ধরে তার সৈন্যবাহিনীকে উত্তরের দিকে পাঠালেন, একইসঙ্গে তিনি দক্ষিণের বিভিন্ন অংশে গুপ্তচর পাঠালেন। তিনি আশাবাদী ছিলেন যে নুবিয়ান মিত্ররা হিকসোসদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলে তিনি অগ্রিম সংবাদ পাবেন। 

কাহমোসের নিজের ভাষায়, তার এই কৌশল অসাধারণ ফলাফল আনে। হিকসোসদের অন্যতম প্রধান উপাস্য সূর্যদেবতা আমুনের উদ্দেশ্যে নির্মিত একটি শিলালিপিতে কাহমোস দাবি করেন যে তিনি আভারিস পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চলটি দখল করে নিয়েছিলেন। তিনি আরও দাবি করেন, তাকে এবং তার বাহিনীকে অগ্রসর হতে দেখে তারা ভয় পেয়ে শিশু গিরগিটির মতো লুকিয়ে গিয়েছিল এবং প্রাচীরের ফুটো দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারছিল। ইতোমধ্যে তার গুপ্তচররা হিকসোসদের নুবিয়া অভিমুখী বার্তাবাহককে ধরে ফেলতে সক্ষম হয়। তার কাছে যে চিঠি ছিল তার বিষয়বস্তু কাহমোসের নথিতে সংরক্ষিত আছে এভাবে : ‘কাহমোস আমাদের উভয়ের ভূমিকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ হিকসোস রাজা তার নুবিয়ান মিত্রকে বলেন, ‘উত্তরে আসুন, নির্ভয়েই আসুন। সে ইতোমধ্যে আমার এলাকায় চলে এসেছে। আপনি না আসা পর্যন্ত আমি তাকে ব্যস্ত রাখব। তারপর আমি আর আপনি দুজনে মিলে মিশরের শহরগুলো ভাগ করে নেব নিজেদের মধ্যে ‘ 

এই চিঠি আটকাতে পেরে মিশরীয়রা অনেক গর্ববোধ করেছিলেন। কাহমোস বলেন, ‘আমি চিঠিটি আবারও আপেপির কাছে ফেরত নিয়ে যেতে বাধ্য করেছিলাম যাতে আমার আসন্ন বিজয় তার হৃদয়ে আঘাত হানে এবং তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে দেয়। 

তারপর তিনি থেবেস অভিমুখে যাত্রা করেন এবং পুরোটা পথ তার জয়ধ্বনিতে ভরে ওঠে। তিনি থেবেসে পৌঁছানোর সাথে সাথে নীল নদে প্লাবন এলো। 

এই বর্ণনা থেকে এটুকু স্পষ্ট যে কাহমোস সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাইছিলেন যে তিনিই মিশরের অবিসংবাদিত ও বৈধ শাসক। নীল নদের প্লাবনের বিষয়টি আমরা আগেও শুনেছি; ইতিহাস আমাদের জানায় যে মিশরের শাসকদের উপযোগিতার সঙ্গে নদীর প্রবাহ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তবে তার এই বাগাড়ম্বরপূর্ণ দাবি দেখে সন্দেহ হয় যে আসলেই কি কাহমোসের বিজয় এতটা নিরঙ্কুশ ছিল? খুব সম্ভব তিনি হিকসোসদের ভীতি প্রদর্শন করতে পেরেছিলেন কিন্তু পুরো বর্ণনাটি সঠিক হলে তিনি কেন আরও দূর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে উত্তরের শহরগুলো পুনর্দখল করলেন না? নিদেনপক্ষে তার উচিত ছিল মেমফিস শহরটি দখল করে নেওয়ার চেষ্টা করা, কারণ সেটি ছিল হিকসোসদের ক্ষমতার দ্বিতীয় বৃহত্তম কেন্দ্রবিন্দু। এই শহর থেকে হিকসোসরা রাজ্যের দক্ষিণ প্রান্তের দিকে নজর রাখতেন। সমগ্র রাজ্যের উপর এককভাবে কড়া নজর রাখার জন্য আভারিস একটু বেশিই উত্তরদিকে ছিল। 

তবে কাহমোস কোনোটিই করেননি। এ থেকে অনুমান করে নেওয়া যায় যে আভারিসের বিরুদ্ধে আক্রমণটি একটি সফল হামলা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কাহমোস এই বিজয় থেকে আর কোনো ধরনের ফায়দা লুটতে পারেননি। মাত্র তিন বছরের সংক্ষিপ্ত রাজত্ব শেষে সেই বছরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। খুব সম্ভব তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হয়েছিলেন যার ফলে তার মৃত্যু হয়। তার কোনো পুত্রসম্ভ ান না থাকায় ভাই আহমোস শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনি তখনও অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন এবং তার মা আহহোটেপ প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্য শাসন করেন। 

কাহমোসের মৃত্যুর প্রায় কাছাকাছি সময়ে আভারিসের দীর্ঘজীবী রাজা আপেপি প্রথমও মৃত্যুবরণ করেন। আপেপির প্রয়াণের পর হিকসোসের শাসনভার গ্রহণ করেন একজন কম ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও অজনপ্রিয় রাজা। তার ব্যাপারে তেমন কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায় না এমনকি ইতিহাস লেখকরা তার নাম নিয়েও দ্বিধান্বিত। উত্তরের এই ভঙ্গুর অবস্থার সুযোগ নেন রানি আহহোটেপ। তিনি তার পুত্রের অভিযানের ফায়দা নেওয়ার জন্য নিজেও যুদ্ধযাত্রা করেন। শিলালিপিগুলোতে আহহোটেপের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এভাবে : ‘তিনি তার সৈন্যদের দেখভাল করেছেন, উচ্চ মিশরকে শান্ত করেছেন এবং বিদ্রোহীদের দমন করেছেন।’ তাকে একটি সুসজ্জিত কুড়াল ও তিনটি পদকসহ কবর দেওয়া হয়েছিল। মিশরীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী এই ধরনের বিন্যাস বীরত্বের প্রতীক। 

অবশেষে যখন আহমোস মিশরের শাসনভার দখল করলেন, তিনি আহহোটেপের কারণে পাওয়া সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে আভারিস পর্যন্ত যুদ্ধযাত্রা করতে সমর্থ হন। তার রাজত্বের বিশ বছরের মাথায় তিনি আভারিসের দক্ষিণে অবস্থিত হেলিওপলিস ও পূর্ব সীমান্তের জারু দুর্গটি দখল করে নিতে সমর্থ হন। দক্ষিণ ও পূর্বের এই শক্তিশালী অঞ্চলগুলো দখল করার মাধ্যমে আহমোস আভারিসের উপর দ্বিমুখী আক্রমণ চালানোর জন্য প্রস্তুত হলেন। 

ইতিহাসবিদ মানেথো যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ের বর্ণনা দেন জোসেফাস বইয়ের পাতায় : ‘হিকসোসরা আভারিসের চতুর্দিকে প্রাচীর তৈরি করল, যেটি ছিল খুবই মজবুত। এটি তারা করেছিল নিজেদের সকল ধনসম্পত্তি ও সকল শিকারযোগ্য পশুকে একটি দুর্ভেদ্য স্থানে আটকে রাখার উদ্দেশ্যে। কিন্তু আহমোস প্রাচীর চূর্ণ করে তাদেরকে পরাজিত করার চেষ্টা চালালেন। তিনি চারশো আশিজন সৈন্য নিয়ে তাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেললেন। যখন আহমোস প্রাচীর ধ্বংস করতে উদ্যত হলেন তখন তারা একটি চুক্তিতে আসলেন। হিকসোসরা মিশর ছেড়ে তাদের পছন্দমতো যে-কোনো জায়গায় চলে যাবেন; তাদের কোনো ধরনের ক্ষতি করা হবে না। এই চুক্তির পর প্রায় ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষ তাদের পরিবারের সদস্যসহ সেখান থেকে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলে যান।’ 

তবে মানেথোর এই বর্ণনা বাস্তবতাবর্জিত বলেই বোধ হয়। মিশরীয়দের বর্ণনায় অনেক বেশি রক্তপাতের কথা বলা হয়েছে। 

আহমোসের সেনাবাহিনী প্রধানের নামও কোনো এক বিচিত্র কারণে আহমোসই ছিল। তার কবরের লেখায় আভারিসের কমপক্ষে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সহিংস যুদ্ধের কথা বলা আছে। তিনি গর্বের সঙ্গে বলেন, ‘আমি সেখানে যুদ্ধ করেছি এবং একটি হাত কেটে নিয়ে এসেছি।’ সেই যুগে মিশরীয় লেখকরা বিচ্ছিন্ন করে আনা হাতের মাধ্যমে শত্রুশিবিরের হতাহতের সংখ্যা নির্ধারণ করতেন। তিনি যোগ করেন, ‘যখন আমি রাজার প্রতিনিধির কাছে এই ঘটনার বর্ণনা দিই তখন আমাকে একটি সম্মানসূচক পদক দেওয়া হয়।’ 

মিশরীয়দের বিভিন্ন শিলালিপিতে এই ঘটনার বর্ণনায় যুদ্ধজাহাজ, যুদ্ধ এবং হিকসোসদের হাতে আটক অসংখ্য দাস দেখা যায়। ধ্বংসাবশেষ দেখে আমরা বুঝতে পারি যে আভারিসে ব্যাপক লুটপাট চালানো হয়েছিল। হিকসোসদের প্রাসাদকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং পরবর্তীতে ফারাও আহমোস সেই প্রাসাদের উপর আরেকটি নতুন দালান তৈরি করেন। 

হিকসোসদের দখলদারিত্বের সকল নিদর্শন এতটাই নিখুঁতভাবে ধ্বংস করা হয়েছিল যে নিম্ন মিশরে তাদের রাজত্বের বিবরণ তৈরি করাই দুষ্কর হয়ে দাঁড়ায়। তবে যে যা-ই বলুক, শহরের ধ্বংসাবশেষে এমন কোনো প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি যে আভারিসে কোনো ধরনের গণহত্যার (যেটি বড়ো আকারে যুদ্ধের চূড়ান্ত ফলাফল হিসেবে খুবই সাধারণ একটি বিষয়) ঘটনা ঘটেছিল। 

এমনকি পরবর্তী ৫০ বছরের দাসদের তালিকায় খুব বেশি সেমিটিক নাম খুঁজে পাওয়া যায়নি, যার অর্থ হচ্ছে খুব বেশি হিকসোস সম্প্রদায়ের সদস্যকে দাসত্বের পরিণতি বরণ করতে হয়নি। সার্বিক বিবেচনায় ব্যাপারটি এমনও হতে পারে যে মিশর থেকে হিকসোসদের গণনির্বাসন বিশেষ করে বেসামরিক ব্যক্তিদের দলে দলে চলে যাওয়াই হয়তো মিশরে তাদের আধিপত্যের অবসান ঘটিয়েছিল। 

আমরা অবশ্যই জানি যে আভারিসের আত্মসমর্পণের পর ফারাও আহমোস আরও উত্তরদিকে অগ্রসর হয়ে কানানে পৌঁছান। তিনি অবশেষে গাজার কাছাকাছি শারুহেনে এসে থামেন। 

সেখান থেকে জেনারেল আহমোস (ফারাও নন) আরেকটি সফল যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। হয়তো আভারিস থেকে পালিয়ে আসা হিকসোসদের উপর এটি ছিল আরেকটি ধারাবাহিক আক্রমণ। তারা পালিয়ে গিয়ে আরেকটি দুর্গে আশ্রয় নেন; কিন্তু আহমোস চাননি তারা মিশরের ধারেকাছে কোনো জায়গায় বসে আবারও শক্তি সঞ্চয় করুক। হিকসোসদের কথা বাদ দিলেও শারুহেন মিশরের জন্য হুমকির মতোই ছিল। এখানে খনন করে দেখা গেছে যে সেটি পশ্চিমা সেমাইটদের রাজত্বে পরিণত হয়েছিল। এটিই ছিল কানানের দক্ষিণে সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। শারুহেন দখল করায় মিশর আবারও আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল এবং একইসঙ্গে কানানের দক্ষিণ অংশকে মিশরের একটি প্রজাতন্ত্রেও রূপান্তরিত করেছিল। 

জেনারেল আহমোসের কবরের লেখা অনুযায়ী, শারুহেনের যুদ্ধের স্থায়িত্বকাল ছিল ৬ বছর। যদি এটি সত্য হয়ে থাকে তা হলে সম্ভবত ফারাও আহমোস তার জেনারেলের কাছে যুদ্ধের দায়িত্ব দিয়ে রাজ্য পরিচালনার ব্যাপারগুলোর দেখভাল করতে মেমফিসে ফিরে গিয়েছিলেন; কারণ তিনি আভারিস দখলের অল্প কিছুদিন পরেই দেহত্যাগ করেন। 

আহমোসকে নিম্ন মিশরের দখল ফিরে পেতে ২০ বছর সময় লেগেছিল। মানেথো ও জোসেফাস উভয়ই তাকে ২৫ বছর রাজত্ব করার কৃতিত্ব দিয়েছেন। তিনি মিশরের রাজা হওয়ার আনন্দ বেশিদিন উপভোগ করতে পারেননি। কিন্তু যেহেতু তিনি মিশরকে আবারও একীভূত করেছিলেন এবং স্থানীয় মিশরীয়দের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন; মানেথো তাকেই অষ্টাদশ রাজবংশের প্রথম রাজা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। 

এই একীভূতকরণের মাধ্যমে মিশর উন্নয়ন, শান্তি ও সমৃদ্ধির এক নতুন যুগে প্রবেশ করে এবং সঙ্গে শিল্প ও সাহিত্যকে পাথেয় হিসেবে নিয়ে নতুন রাজত্বের গোড়াপত্তন করে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *