অধ্যায় সতেরো – প্রথম একেশ্বরবাদী

অধ্যায় সতেরো –  ভচবন প্রথম একেশ্বরবাদী 

খ্রিষ্টপূর্ব ২১৬৬ সালের কিছুদিন পরে আব্রাম উর শহর ছেড়ে পশ্চিমের সেমাইটদের ভূমিতে চলে যান; আর এদিকে নব্য-সুমেরীয় সাম্রাজ্য আরও শক্তিশালী হতে থাকে। 

যখন সুমেরীয়রা গুতিয়ানদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে আছে তখন টেরাহ নামের উর শহরের একজন বাসিন্দা তার চাকরবাকর, গবাদি পশু, স্ত্রী-পুত্র ও তাদের পরিবারকে সাথে নিয়ে পশ্চিমদিকে রওনা হলেন। এই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন টেরাহর নিঃসন্তান পুত্র আব্রাম ও তার স্ত্রী সারাই। 

টেরাহ সম্ভবত সুমেরীয় ছিলেন না, তিনি আক্কাদীয় কিংবা সংশ্লিষ্ট কোনো একটি গোত্রের মানুষ ছিলেন। তিনি তার পূর্বসূরিদের খোঁজ করতে গিয়ে বাইবেলে বর্ণিত সেমাইটদের পূর্বপুরুষ শেমদের সঙ্গে নিজের যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছিলেন। নারাম সিনের শাসনামলে জন্ম নেওয়া টেরাহ তার জীবদ্দশায় কখনও উরকে শান্তিপূর্ণ অবস্থানে দেখেননি; তার জীবনের পুরো সময়জুড়েই চলছিল গুতিয়ানদের আক্রমণ। তার শৈশবে উর শহর আক্কাদীয়দের গ্রাস থেকে মুক্তিলাভ করতে সমর্থ হয় এবং তিনি তিন সন্তানের পিতা হতে হতে সর্বশেষ আক্কাদীয় রাজা তার সিংহাসনের জন্য লড়াই করছেন প্রাণপণে। এর কিছুদিন পরে গুতিয়ানরা আগাদে শহরকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায় এবং উত্তরাঞ্চলে ইচ্ছেমতো বিচরণ করে বেড়াতে থাকে। 

উত্তুহেগাল তার বাহিনী নিয়ে উর দখল করে নেন কিন্তু অল্পদিন পরেই তার জামাতার কাছে তিনি রাজ্যের দখল হারিয়ে ফেলেন। এরকম অস্থিতিশীল অবস্থা থেকে সরে আসার সংকল্প নিয়ে টেরাহ এবং তার পরিবার শহর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। জেনেসিসের বর্ণনা অনুযায়ী, তারা পশ্চিমে ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত ‘কানান’ শহরের দিকে অগ্রসর হন, যা ছিল বর্বর গুতিয়ান, প্রতিহিংসাপরায়ণ এলামাইট এবং উচ্চাভিলাষী সুমেরীয়দের থেকে যোজন যোজন দূরে। 

তার এই যাত্রার একটি ধর্মীয় ব্যাখ্যা পাওয়া যায় জেনেসিসের দ্বাদশ অধ্যায়ে, যেখানে বলা হয়েছে যে আব্রাম সৃষ্টিকর্তার ডাক শুনতে পেয়েছিলেন। এটি কোনো সুমেরীয় কিংবা আক্কাদীয় দেবতা নয় বরং এটি ছিল ‘ওয়াইএইচডব্লিউএইচ’ (সৃষ্টিকর্তার নিজেকে দেওয়া ধাঁধামূলক নাম)-এর ডাক ি 

সবকিছু পর্যালোচনা করে ধারণা করা যায় যে এটি আব্রামের জন্য একটি নতুন ধারণা ছিল। টেরাহ এবং তার ছেলেরা সম্ভবত চন্দ্রদেবতা সিন ও তার কন্যা ইনান্নার পূজারি ছিলেন, কারণ উর-এর সকল বাসিন্দা কাগজেকলমে হলেও এই দুই রক্ষক দেবতা ও দেবীর উপাসনা করতেন। এ ছাড়া তাদের পারিবারিক নামেও খুঁজে পাওয়া যায় আক্কাদীয় ও সুমেরীয় মন্দিরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের চিহ্ন। 

টেরাহর নিজের নামের সাথে চন্দ্রদেবতা সিনের নামের আত্মীয়তা রয়েছে। আব্রামের স্ত্রী সারাই তার সৎ বোনও ছিলেন। টেরাহর আরেকজন কন্যার নাম রাখা হয়েছিল দেবতা সিনের স্ত্রী দেবী নিনগালের সাথে মিলিয়ে। 

একইভাবে টেরাহর নাতনি মিলকাহর নাম রাখা হয়েছিল সিনের কন্যা মালকাতুর সাথে মিলিয়ে। তবে আব্রামের নিজের নামকে কোনো দেবদেবীর সাথে মেলানো যায় না; এটির মানে হচ্ছে ‘গৌরবান্বিত পিতা’। আমরা ধরে নিতে পারি যে আব্রাম ও সারাই দুজনের নামের সাথেই চাঁদের উপাসনা করার যোগসূত্র রয়েছে, কেননা আমরা গল্পের পরের অংশে জানতে পারি যে পরবর্তীতে ‘ওয়াইএইচডব্লিউএইচ’ তাদের দুজনেরই নতুন নাম প্রদান করেন। 

তাদের নতুন নামকরণ হয় আব্রাহাম ও সারাহ; নতুন ধ্বনি ‘আহ’ (আব্রাম থেকে আব্রাহাম এবং সারাই থেকে সারাহ)-এর সংযুক্তির মাধ্যমে। এই নতুন নামকরণের মাধ্যমে তারা উর-এর মালিকানা থেকে মুক্তি পেয়ে জেনেসিসে বর্ণিত সৃষ্টিকর্তার তত্ত্বাবধানে চলে এলেন। 

নতুন প্রতিপালকের কাছে এসে আব্রাম একইসাথে একটি প্রতিশ্রুতি এবং একটি নির্দেশ পেলেন। তাকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলো যে তাকে একটি গোটা জাতির নেতা বানানো হবে। এই নেতৃত্ব পাওয়ার জন্য তাকে তার নিজের দেশ ও জনগোষ্ঠী ত্যাগ করতে হবে (উর শহর এবং আক্কাদীয়, সুমেরীয় ও সেমাইটদের সমন্বয়ে গঠিত জনগোষ্ঠী) এবং তার প্রদর্শিত পশ্চিমের কানান শহরে চলে যেতে হবে। 

অনেক জাতি দাবি করেছেন যে তাদের কোনো এক পূর্বপুরুষ প্রতিপালকের কাছ থেকে সরাসরি অনুগ্রহ পেয়েছেন। কিন্তু এটাই লিপিবদ্ধ ইতিহাসে এই ধরনের প্রথম ঘটনা। আব্রাম তার চারপাশে থাকা সেমাইটদের থেকে খুব একটি ভিন্ন ছিলেন না এমনকি তার সাথে কানান শহরের লোকজনেরও তেমন একটা পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু দৈব অনুগ্রহ প্রাপ্তির কল্যাণে তিনি বিশেষ একজন মানুষে পরিণত হন এবং অন্যদের থেকে আলাদা হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করেন। একইসাথে আব্রামের প্রতিপালক বহু-ঈশ্বরবাদ থেকে একেশ্বরবাদের দিকে নিয়ে যান সেমাইটদের। তিনিই হলেন প্রথম একেশ্বরবাদী। 

সরাসরি পশ্চিমদিকে রওনা দিলে আব্রামের দলটিকে মরুভূমির মধ্য দিয়ে যেতে হতো; তাই তারা উত্তর-পশ্চিমদিকের ইউফ্রেটিসের তীরের সাথের সহজতর পথটি বেছে নিয়েছিলেন। এই পথে চলতে থাকলে তারা এক সময় ভূমধ্যসাগরের উত্তর প্রান্তে পৌঁছে যেতেন; কিন্তু তারা বিলিখ নদী (ইউফ্রেটিসের একটি শাখা) পর্যন্তই পৌঁছে ভুলবশত পশ্চিমদিকে না গিয়ে পূর্বদিকে হাঁটতে শুরু করেন এবং ছোটো শহর হারানে পৌঁছে যান। সেখানেই তারা জনবসতি স্থাপন করে বসবাস করতে শুরু করেন। হারান ছিল একটি ব্যস্ত বাণিজ্যপথের মাঝে অবস্থিত, যেটি উর-এর মতোই চন্দ্র-উপাসক অধ্যুষিত একটি শহর ছিল। এই কারণেই সম্ভবত টেরাহ এবং তার দলের কাছে শহরটিকে আপন মনে হয়েছিল। তার অনেক বয়স হয়েছিল এবং হারানে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন একটি শান্তির নীড়। 

ততদিনে দক্ষিণে উর-নাম্মু তার শ্বশুরের সিংহাসন দখল করে নিয়েছেন এবং রাজত্বকে বিস্তৃত করে ‘নব্য-সুমেরীয়’ শাসনের গোড়াপত্তন করে ফেলেছেন। তবে একেবারেই উত্তর প্রান্তে অবস্থিত হারান পর্যন্ত তিনি পৌঁছাতে পারেননি কখনোই। খ্রিষ্টপূর্ব ২০৯৪ সালের দিকে প্রায় ১৮ বছরের শাসনামল শেষে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিয়ে রচিত কাব্যে তাকে একজন ‘জ্ঞানী ও বিশ্বস্ত মেষপালক’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছিল। রাজা হিসেবে তিনি সুমেরকে তার পূর্বের শানশওকতের অবস্থায় নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন; তার কীর্তি তাকে পরকালে গিলগামেশের সাথে সিংহাসন ভাগাভাগি করে নেওয়ার মতো পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। 

উর-নাম্মুর ছেলে শুলগি তার স্থলাভিষিক্ত হন। এই ঘটনার প্রায় চার থেকে পাঁচ বছর পর আব্রাম হারান ত্যাগ করেন। তিনি তার প্রতিপালকের কাছ থেকে প্রতিশ্রুত ভূমির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। উত্তর-পশ্চিমদিকে যাত্রা শুরু করে তিনি এক পর্যায়ে জর্ডান নদীর পশ্চিমে অবস্থিত দুটি সমুদ্রের মাঝে যোগসূত্র স্থাপনাকারী (গ্যালিলি সি এবং ডেড সি) শেচেম শহরে এসে পৌঁছান। 

আব্রাম লক্ষ করলেন যে শহরটি কানানাইট নামক জনগোষ্ঠী দ্বারা পরিপূর্ণ। তিনি আবারও তার প্রতিপালকের কাছে প্রার্থনা করলেন কোনো এক ধরনের নিশ্চয়তা বা প্রমাণের জন্য যে তিনিই এই ভূমির অধিকর্তা। 

কানান নামের ভূখণ্ডটি পরবর্তীতে ইসরায়েল নামে পরিচিত হয়। রোমানদের কাছে এটি প্যালেস্টাইন এবং ক্রুসেডারদের কাছে ‘দ্য লেভান্ত’ নামে পরিচিত ছিল। কানানাইট শব্দটির প্রাচীনতম ব্যবহারটি খুঁজে পাওয়া যায় জিমরি লিমের প্রাচীরে ঘেরা শহর মারিতে; একটি পাথরের ট্যাবলেটে। খ্রিষ্টপূর্ব ১৭৭৫ সালের একটি ঘটনাকে সেখানে বর্ণনা করা হয়েছে যেখানে জর্ডান নদী থেকে আসা কিছু যাযাবর দস্যুর ব্যাপারে তথ্য রয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব ২০৯০ সালে আব্রামকে প্রতিশ্রুত ভূখণ্ডটির কোনো নাম ছিল না, কারণ সেটির কোনো জাতিগত পরিচয় বা রাজনৈতিক অস্তিত্ব ছিল না। 

ভূমধ্যসাগরের পূর্বদিকের তীরে অবস্থিত ভূখণ্ডে যেসব মানুষ বসবাস করতেন তারা ছিলেন ‘পশ্চিমা সেমাইট’। আমরা প্রথম অধ্যায়ে তাদের নিকট আত্মীয়দের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম যখন সুমেরীয় শহরগুলো তৈরি হওয়ার পর সেমাইট ও সুমেরীয়দের মাঝে মেলামেশা বেড়েছিল। তবে মেসোপটেমীয় সমতলভূমিতে থিতু না হয়ে এই পশ্চিমা সেমাইটরা আরও দূরে চলে গিয়েছিলেন। যখন তাদের আত্মীয়রা সুমেরীয়দেরকে চাষবাস শেখাচ্ছিল, তারা থেমে না থেকে নদীর তীর ধরে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের নিজস্ব শহর তৈরি করতে থাকে। 

এই এলাকা থেকে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেওয়া প্রথম উল্লেখযোগ্য মানুষটি হচ্ছেন আব্রাম। পশ্চিমা সেমাইটদের কোনো ঐক্যবদ্ধ কৃষ্টি না থাকায় তাদের ব্যাপারে আমরা তেমন কিছুই জানতে পারিনি। তাদের বানানো শহরগুলোর ধ্বংসস্তূপ থেকে যা জানা গিয়েছে তা-ই আমাদের পাথেয়। খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০০ সালের মাঝে এই এলাকার সমগ্র অংশ দখল করে নিয়েছিলেন কৃষকরা তাদের গৃহপালিত ছাগল ও ভেড়া সহযোগে। এখানে অবস্থিত উত্তরের কাটাল হুয়ুক এবং ডেড সি-র কাছে অবস্থিত জেরিকো নামক শহর দুটিকে বিশ্বের প্রাচীনতম শহরের মর্যাদা দেওয়া যায় অনায়াসে। 

জেরিকো শহরটিকে খুব সহজেই আলাদা করা যায়। পশ্চিমা সেমাইটদের বেশির ভাগ বাসস্থানেই ছিল না কোনো ধরনের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কিন্তু সেই যুগেই অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব ৬৮০০ সালে জেরিকোর বাসিন্দারা অবাক করে দেওয়ার মতো একটি সুবিশাল প্রতিরক্ষা প্রাচীর তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। 

প্রাচীরের এক কোনায় একটি পঁয়ত্রিশ ফুট উঁচু গোলাকার মিনার তৈরি করা হয়েছিল যাতে রক্ষীরা দূর থেকে চারপাশের ভূখণ্ডের উপর নজর রাখতে পারেন সহজে। 

তবে জেরিকো শহরের বাসিন্দারা কোনো ধরনের শত্রুর ভয়ে এত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বানিয়েছিলেন তা পরিষ্কার নয়। এটি সত্য যে শহরটি মিঠাপানির উৎসের খুবই কাছাকাছি ছিল এবং এটিও সত্য যে জর্ডান নদী খুব বেশি দূরে ছিল না। প্রকৃতপক্ষে আক্রমণের হুমকি না থাকলেও জেরিকোবাসীরা সকল ধরনের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করে দাঁতে দাঁত চেপে অজানা শত্রুর অপেক্ষায় থেকেছে অবিরত। 

আব্রামের আগমনের আগেই পশ্চিমের সেমাইট শহরগুলো তাদের নিজ নিজ বাণিজ্যপথ তৈরি করে নিয়েছিল—যার বেশির ভাগই ছিল মিশরের সাথে সংযুক্ত। তীরের অর্ধেক পরিমাণ এলাকা পেরোলে খুঁজে পাওয়া যায় বিব্লোস শহরটিকে, যা আক্কাদীয়দের কাছে গুবলা এবং সেমাইটদের কাছে গেবাল নামে পরিচিত ছিল। বিরোসবাসীরা তাদের সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত মিশরে সিডার গাছের গুঁড়ি সরবরাহ করে; যার বিনিময়ে তারা দামি কাপড় এবং দুষ্প্রাপ্য ধাতব পদার্থ আমদানি করত। উত্তরের শহর এবলার ভেতর দিয়ে যেসব ক্যারাভান যেত, তাদেরকে কর দিতে হতো। একইসাথে জর্ডানের উপত্যকা এবং শারনের সমতলভূমির মাঝে অবস্থিত শহর মেগিদ্দো ক্রমবর্ধনশীল ছিল, অন্তত খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ সাল পর্যন্ত। 

শেচেম শহরের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে আমাদের? সেখানে আব্রাম প্রথমবারের মতো তার প্রতিপালকের কাছে তার প্রতিশ্রুত ভূখণ্ডের স্বপক্ষে প্রমাণ চেয়েছিলেন। সেই শহরটিও বেশ উন্নতি লাভ করেছিল, কেননা সেখানে ছিল একটি প্রাচীন কূপ যেটির পানি কখনও শুকাত না। প্রথমে আসা পশ্চিমা সেমাইটদের সাথে আরও অনেক অধিবাসীর সংযোগ ঘটেছিল ততদিনে, যারা মূলত উত্তর ও দক্ষিণ থেকে এসেছিলেন। এদের মাঝে উল্লেখযোগ্য ছিল এমোরাইটগণ; যারা যাযাবর প্রকৃতির হওয়া সত্ত্বেও তাদের ছিল নিজস্ব একটি সেমাইট ভাষা। তারা সম্ভবত আরব দ্বীপপুঞ্জ থেকে এসেছিলেন। 

স্বভাবতই আব্রাম সন্দিহান হয়ে পড়েছিলেন, এই ভেবে যে কীভাবে তিনি এই জোড়াতালি দেওয়া দেশের মালিক কিংবা শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। তবে এই ব্যাপারে খুব বেশি চিন্তা করার অবকাশ তিনি পাননি। প্রতিশ্রুত ভূমিতে আগমন করার ঠিক পাঁচ বছর পর তিনি সেখান থেকে বিদায় নেন। 

তিনি একা ছিলেন না। প্রত্নতাত্ত্বিক নথি থেকে জানা যায় যে খ্রিষ্টপূর্ব ২৪০০ থেকে ২০০০ সালের মাঝে কোনো এক সময়ে পশ্চিমা সেমাইটদের কৃষ্টিতে একটি বড়ো ধরনের পরিবর্তন আসে। এর আগে পর্যন্ত তারা ক্রমশ নগরায়ণে দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন কিন্তু উল্লিখিত সময়ে তারা পুনরায় যাযাবর জীবনে ফিরে যান এবং বেশ কিছু শহর সাময়িকভাবে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। অত্যধিক বীজ বপন এবং খরার কারণে নদীনালা শুকিয়ে গিয়েছিল এবং জমির উর্বরতাও কমে গিয়েছিল। বড়ো বড়ো জনগোষ্ঠী এসব পানির উৎসের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতেন। তারা বাধ্য হন পানির নতুন উৎসের খোঁজে ছড়িয়ে পড়তে। এর সাথে যোগ হয় দক্ষিণের আদি-রাজত্বের পতন। এই মর্মান্তিক ঘটনার ফলস্বরূপ পশ্চিমা সেমাইটরা একইসাথে ফসল ফলানোর উর্বর জমি এবং তাদের সবচেয়ে ধনী ও মূল বাণিজ্যিক অংশীদার উভয়কেই হারিয়ে ফেলেন। 

পুরানো রাজত্বের গোলযোগ উত্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রতিক্রিয়াস্বরূপ আব্রাম দক্ষিণে চলে যান। 

জেনেসিস ১২ : ১০-এ বলা হয়েছে, ‘সেই সময় খরা চলছিল। খরার তীব্রতার কারণে আব্রাম দক্ষিণে মিশরে চলে যেতে বাধ্য হয়।’ মিশরে পানির অভাব ছিল না এবং সাময়িকভাবে হলেও তা বসবাসস্থল হিসেবে অধিকতর স্থিতিশিল ছিল। 

কাণ্ডজ্ঞানহীন সপ্তম রাজবংশের পরে এলো অষ্টম রাজবংশ। তারা কিছুটা স্থিতিশিলতা দেখাতে পারলেও তাদের তেমন কোনো অর্জন নেই—২৭ জন রাজা এবং ১৪৬ বছরের শাসনকাল থাকা সত্ত্বেও এই রাজবংশের একজন ফারাওর নামও ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়নি। 

খ্রিষ্টপূর্ব ২১৬০ সালের দিকে হেরাক্লিওপোলিস শহর থেকে আখতয় নামক একজন অভিজাত বংশের ক্ষমতাশালী ব্যক্তি তার ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিদীপ্ত মিত্রতা ও শক্তিমত্তার কল্যাণে সমগ্র মিশরকে তার দখলে নিয়ে আসতে সমর্থ হন। 

পরবর্তী একশ বছর ধরে আখতয় এবং তার বংশধররা মিশরের সমগ্র অঞ্চলকে গৌরবের সাথে শাসন করে যান এবং সমর্থ হন দেশটিকে তার ঐতিহাসিক সুদিনে ফিরিয়ে নিতে। আখতয়ের বংশধরদের মাঝে রয়েছে মানেথোর বর্ণীত নবম ও দশম রাজবংশ এবং সতেরোজন রাজা। তবে এই দীর্ঘ সময়ে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ থেমে ছিল না এবং থেমে ছিল না পশ্চিমের সেমাইট শত্রুদের নিরন্তর আক্রমণ। সেমাইটরা ছোটো ছোটো যাযাবর দলের মাধ্যমে বারবার নীল নদের বদ্বীপসংলগ্ন এলাকাগুলোতে হামলা চালাতে থাকে। এই হামলাগুলো প্রতিরোধ করতে মিশরের রাজবংশের অপারগতার কারণেই তারা এই সুযোগগুলো পাচ্ছিল। 

ঐতিহাসিক নথি অনুযায়ী, আব্রাম তার স্ত্রী, চাকরবাকর এবং গবাদি পশুগুলোকে নিয়ে খ্রিষ্টপূর্ব ২০৮৫ সালে মিশরে আগমন করেন। এই সময়টি দশম রাজবংশের তৃতীয় আখতয়ের শাসনামল ছিল। এই ফারাও রাজা পশ্চিমের সেমাইট হামলাকারীদের ব্যাপারে বলেন : ‘সেমাইটরা একেবারে জঘন্য প্রকৃতির। তারা যেখানে যায় সেখানেই মন্দ ভাগ্য নিয়ে আসে। তাদের দেশে নেই পানি এবং তাদের দেহ ঝোপঝাড়ে আচ্ছাদিত থাকে। তারা কখনও এক স্থানে বেশিক্ষণ থাকে না বরং লোভলালসায় তাড়িত হয়ে হেঁটে বেড়ায় এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে। তারা হচ্ছে নদীর তীরের কুমিরের মতো—রাস্তা দিয়ে একাকী হেঁটে যাওয়া প্রাণীদেরকে ছিনিয়ে নেওয়াই তাদের কাজ।’ 

সম্ভবত এই কারণেই আব্রাম মিশরে এসে ঘোষণা করেন যে সারাই তার স্ত্রী নয়, বোন। জেনেসিসে বর্ণিত আছে যে মিশরে যাত্রাপথে আব্রাম সারাইর দিকে তাকালেন এবং ভাবলেন ‘সে অপরূপ সুন্দরী। মিশরের ফারাও আমাকে হত্যা করার নির্দেশ দেবে, যাতে সে সারাইকে পেতে পারে।’ এই বর্ণনা থেকে আমরা ধরে নিতে পারি যে সেমাইটরাও মিশরীয়দের ব্যাপারে খুব একটা ভালো মনোভাব পোষণ করতেন না। 

আব্রামের ভয়টি সত্যে পরিণত হলো। তৎকালীন ফারাও-যিনি ছিলেন দশম রাজবংশের একজন নামহীন, খ্যাতিহীন রাজা—প্রথম দেখাতেই সারাইকে পছন্দ করলেন এবং নিজের করে নিলেন। তিনি আব্রামকে ধন্যবাদ জানালেন তার বোনকে মিশরে নিয়ে আসার জন্য এবং বিভিন্ন ধরনের উপহার দিলেন। আব্রাম উপহার হিসেবে পেলেন মিশরীয় ভেড়া, গরু, গাধা, উট এবং ভৃত্য। তবে ফারাওর এই আচরণের পরিণতি শুভ ছিল না। ফারাওর হারেমে সারাইর উপস্থিতি এক ধরনের দৈব অভিশাপ নিয়ে আসে সবার উপর- ফারাওসহ তার রাজপ্রাসাদের সকল সদস্য ‘নেহ-গা’ নামক এক ধরনের অসুখে আক্রান্ত হন। 

শব্দটির ইংরেজি অনুবাদ প্লেগ (মহামারি)। নেহ-গার কারণে সারা শরীরে দগদগে ঘা হয়েছিল ফারাওর। এর ফলস্বরূপ সারাইসহ সকল নারীর প্রতিই তিনি আগ্রহ হারান। 

জেনেসিসের বাকি গল্পগুলো থেকে এটি কিছুটা ভিন্নধর্মী ও বৈচিত্র্যময়। আরও দৈব অভিশাপের ভয়ে ফারাও রাজা আব্রামকে হত্যা করতে রাজি হলেন না; কিন্তু তা সত্ত্বেও আব্রাম সেখান থেকে পালিয়ে গেলেন এবং কানান শহরে ফিরে গেলেন। তিনি শেচেম থেকে বেশ খানিকটা দক্ষিণে অবস্থিত হেবরন শহরে থিতু হলেন। ততদিনে এটি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে যে আব্রামের তথাকথিত ‘জাতির পিতা’ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। 

নিঃসন্তান অবস্থায় তাদের দিন কাটতে লাগল এবং এক সময় সারাইর সন্তান ধারণের বয়স পেরিয়ে গেল। 

খোদার কাছ থেকে সেই বার্তাটি পাওয়ার প্রায় বিশ বছর পরে আব্রাম একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন : তিনি সারাইর ব্যক্তিগত ভৃত্য হাগারকে অনানুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করলেন আর সারাইকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে হাগারের গর্ভে জন্ম নেওয়া সন্তানরা তাদের সন্তান (আব্রাম ও সারাই) হিসেবেই বেড়ে উঠবে। 

সুমেরীয় শহরগুলোতে এই ধরনের আচার প্রচলিত ছিল। এই ব্যাপারে নুজি ট্যাবলেটে বিস্তারিত বলা আছে। তবে তা আব্রামের ক্ষেত্রে কাজ করেনি। খোদার নির্দেশ সুষ্পষ্ট ছিল এবং তা এককভাবে আব্রামের জন্য প্রযোজ্য ছিল না—নতুন জাতির অধিপতি হতে হলে আব্রাম আর সারাইকে একত্রে থাকতে হবে। 

আব্রাম নতুন জাতির রাজা হবেন আর তার রানি হতে হবে সারাইকেই; অন্য কোনো সন্তান জন্মদানে সক্ষম ও ইচ্ছুক নারী হলেই হবে না। প্রতিপালক যেমন এক এবং অদ্বিতীয় তেমনই নতুন জাতিরও একজনই পিতা ও মাতা থাকতে হবে। অন্য যে-কোনো দেবতা বা প্রতিপালকের চেয়ে জেনেসিসের খোদা ছিলেন ভিন্ন ধরনের। তিনি প্রকৃতির সাথে সংযুক্ত ছিলেন কিন্তু প্রকৃতি তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত না। নতুন দেশ ও জাতি পূর্বের সকল মানবগোষ্ঠী থেকে ভিন্ন হতো, কারণ এটি তৈরি হয়েছিল একেশ্বরবাদকে ভিত্তি করে। এই প্রতিশ্রুতিটি দেওয়া হয়েছিল আব্রাম ও সারাই উভয়কেই—এই ভাগ্য শুধু আব্রামের জন্য লিখিত হয়নি। 

এক্ষেত্রে দশম রাজবংশের কোনো ফারাও কিংবা জনৈকা মিশরীয় গৃহপরিচারিকার অবদান কাম্য নয়; যেমনটি কাম্য নয় দেবতা এনলিল কিংবা ইশতারের বাড়িয়ে দেওয়া সাহায্যের হাত। 

হাগারকে বিয়ে করার পরপরই ঈশ্বর পুনরায় আব্রামকে তার প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দেন এবং তার নাম পালটে আব্রাহাম করে দেন; যার মাধ্যমে এই মানুষটি এবং তার বংশধরদের উপর তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। 

এর অল্পদিন পরেই আবারও ‘আব্রাহাম’ (আব্রাম নয়) -এর সাথে আরেকজন কু-দৃষ্টিসম্পন্ন রাজার মোলাকাত হয়। এবারের রাজাটি ছিলেন গেরার শহরের শাসক। হেবরনের দক্ষিণদিকে এবং কানান ও মিশরের মাঝখানে নেগাভ নামক জায়গায় এই শহরটির অবস্থান ছিল। আগের মতো, দুর্ভাগ্যের শিকার না হওয়ার জন্য আব্রাহাম পুনরায় দাবি করলেন যে সারাহ (সারাই থেকে রূপান্তরিত) তার বোন। তবে এবারও দুঃখজনকভাবে সারাহকে রাজকীয় হারেমে ধরে নিয়ে যাওয়া হলো। 

স্বভাবতই এই ঘটনার পর রাজপ্রাসাদের সকল নারী বন্ধ্যা হয়ে গেলেন এবং তাদের বন্ধ্যাত্বের অবসান তখনই ঘটল যখন সারাহকে ফিরিয়ে দেওয়া হলো। কথিত আছে যে রাজা আবিমেলেখ-কেও বাধা দেওয়া হয়েছিল ‘তাকে স্পর্শ করা থেকে’; যা থেকে আমরা ধারণা করতে পারি যে শুধু প্রাসাদের নারীরাই সাময়িকভাবে ‘ক্ষমতা’ হারাননি। পুনরায়, এই গল্পে আমরা দেখতে পাই প্রতিপালকের প্রতিশ্রুত মানবগোষ্ঠীর সদস্যদের প্রতি বিশেষ কৃপার নিদর্শন। 

জেনেসিস লেখা হয়েছিল বর্ণিত ঘটনাগুলো ঘটার অনেকদিন পরে, যাকে ইংরেজিতে ‘এনাক্রোনিস্টিক’ ধরণের লেখা বলা হয়ে থাকে। এনাক্রোনিস্টিক লেখার ক্ষেত্রে একটি ধারাকে অনুসরণ করা হয়ে থাকে। ইতিহাস অনুযায়ী সঠিক নামের পরিবর্তে পাঠকপ্রিয় নামগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে এই ধরনের লেখায়। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে ‘চালদিসের উর’-এর গল্প; যেখানে পারস্য উপসাগরীয় ভূখণ্ডের অধিপতির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এটি যে সময়ের গল্প সে সময়ে সে অঞ্চলের লোকেরা ‘চালদিয়ান’ নামে পরিচিত ছিলেন না, তারা সে পরিচয় পান আরও বহু বছর পরে, যখন এসিরিয়া শাসন করছিলেন আশুরনাসিরপাল দ্বিতীয় (খ্রিষ্টপূর্ব ৮৮৪/৮৮৩ থেকে ৮৫৯-এর মাঝের সময়টায়)। সেখানে আরও লেখা হয়েছে যে আব্রাম ‘এমোরাইটস’ আবিমেলেখ-এর সাথে দেখা করেছিলেন এবং সেখানে গেরার-এর রাজাকে একজন ফিলিস্তিনি হিসেবে দাবি করা হয়েছে। 

এই নামগুলো আরও অনেক বছর পরের রাজনৈতিক পরিচয়ের ফল, যা ধীরে ধীরে বিকশিত হয় পশ্চিমের সেমাইট গোত্রদের রাজত্ব বাড়ানোর লড়াইয়ের হাত ধরে। 

তবে ঘটনাগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে এনাক্রোনিস্টিক স্টাইলে লেখা হলেও তা থেকে শুধু ব্যক্তি আব্রাহামের রক্ত আর মিশরীয় রক্তের পার্থক্যই নয় বরং আব্রাহামের গোত্র ও আবিমেলেখ-এর গোত্রের মধ্যকার পার্থক্যটি দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়। প্রথমবারের মতো আমরা নিশ্চিত হলাম যে পশ্চিমা সেমাইটরা ভিন্ন গোত্রের সদস্য ছিলেন। 

সুমের অঞ্চলের মানুষদের মূল পরিচয় কখনোই সেই অঞ্চলের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিল না; অর্থাৎ তারা নিজেদেরকে ‘সুমেরীয়’ মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করত না বরং তারা উর-এর নাগরিক, লাগাশের নাগরিক, উরুকের নাগরিক হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিতেন এবং নিজ ধর্ম অনুযায়ী বিভিন্ন দেবদেবীর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতেন। তবে এই ধারার পরিবর্তন আসে সার্গনের আক্কাদীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর, যেখানে সুমেরীয় ও আক্কাদীয়রা পাশাপাশি বসবাস করতে শুরু করেন। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একই রাজনৈতিক সীমারেখার মাঝে আমরা দেখতে পাই দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন জনগোষ্ঠীকে ‘সার্গনের প্রজা’ হিসেবে ঐক্যবদ্ধ হতে। গুতিয়ানদের আক্রমণে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়; এই দুই জনগোষ্ঠী মিলেমিশেই তাদের মোকাবিলা করেন। 

কিছুটা উদ্দেশ্যবিহীনভাবে পশ্চিমদিকে যাত্রা করছিলেন আব্রাহাম। তার মুখের ভাষা পশ্চিমা সেমাইটদের মতো ছিল, যে কারণে যাত্রাপথে মানুষের সাথে কথাবার্তা বলতে তার কোনো সমস্যা হচ্ছিল না। আবিমেলেখ-এর মতো নিজেকে ‘পশ্চিমা সেমাইট’ হিসেবে চিহ্নিত না করে তিনি স্বেচ্ছায় স্বতন্ত্র একটি পরিচয় বেছে নিয়েছিলেন। 

অবশেষে খোদার প্রতিশ্রুতি রক্ষা হলো এবং আইজ্যাক জন্মগ্রহণ করলে-নতুন জাতিটির সৃষ্টি হলো। তাদের শরীরে একটি বিশেষ চিহ্ন এঁকে দিলেন সৃষ্টিকর্তা। তিনি আব্রাহামকে আদেশ দিলেন তার সন্তানদের, নিজের এবং সমগ্র পরিবারের সদস্যদের খতনা করতে। 

ধারণা করা হয় যে এই চিহ্নটি দেওয়া হয়েছে চরম মুহূর্তের স্মারক হিসেবে, যাতে তারা অন্য জাতিদের সাথে কোনোরূপ রক্তীয় সম্পর্ক তৈরি না করে। পরবর্তীকালে আব্রাহাম যখন পুত্রবধূর সন্ধানে গেলেন তখন তার চারপাশে থাকা পশ্চিমা সেমাইটদের কন্যাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে অনীহা প্রকাশ করেন; বরং তিনি তার এক ভৃত্যকে পাঠিয়েছিলেন সুদূর উত্তর-পশ্চিম মেসোপটেমিয়াতে। ভৃত্যের সাথে হারান শহর থেকে তার রক্ত-সম্পর্কের আত্মীয় রেবেকাহকে আনিয়েছিলেন। রেবেকাহ ছিলেন তার নাতি কিংবা নাতনির কন্যা। 

এভাবেই পুরানো একটি জাতি থেকে সম্পূর্ণ নতুন একটি জাতির অভ্যুদয় ঘটে। হাগারের পুত্রও ছিল ভিন্ন ধরনের। আব্রাহামের অনুমতিসাপেক্ষে সারাই অন্তঃসত্ত্বা হাগারকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। হাগার মিশরমুখী দক্ষিণের রাস্তা ধরে আগাতে লাগলেন। হেবরন থেকে শুরু করে বিরশেবা হয়ে এই রাস্তাটি মিশর অবধি গিয়েছে-হাগার বাড়ি ফিরছিলেন। 

কিন্তু আব্রাহামের সন্তানকে এত সহজে মিশরের ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ পরিবেশে ফিরিয়ে নেওয়া যায়নি। জেনেসিসের বর্ণনা অনুযায়ী, মিশর যাওয়ার পথে হাগারের সাথে প্রতিপালকের প্রতিনিধির দেখা হয় যিনি তাকেও এক ধরনের প্রতিশ্রুতি দেন। সারাইকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির মতোই, হাগারের সন্তানরাও একটি সুবিশাল জাতিতে পরিণত হবে—এটাই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। 

ঘটনাচক্রে হাগার আবারও ফিরে আসে আব্রাহামের গৃহস্থালির সদস্য হিসেবে। তার সন্তান জন্ম নেওয়ার পর তার নাম রাখা হয় ইসমায়েল এবং সেও আব্রাহামের সন্তান হিসেবেই বড়ো হতে থাকে। সমগ্র আরব জাতি নিজেদেরকে তার বংশধর হিসেবেই বিবেচনা করে থাকে। কুরআন শরিফের বর্ণনা অনুযায়ী, আব্রাম বা ইব্রাহিম (আরবদের অনুসরণ করা বানান) হচ্ছেন প্রথম ব্যক্তি যিনি আল্লাহর উপাসনা করেন, যিনি এক ও অদ্বিতীয় উপাস্য-চাঁদ, তারা কিংবা সূর্যের পরিবর্তে। 

বড়ো হওয়ার পর ইসমায়েল ইব্রাহিমের সাথে আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত মক্কা শহরে গেলেন এবং দুজনে মিলে কাবা শরিফ তৈরি করলেন- আল্লাহর উপাসনা করার জন্য তৈরি প্রথম ঘর। কুরআনে কাবা শরিফ নিয়ে বলা হয়েছে—’তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, কাবা শরিফের দিকে মুখ ফেরাও।’ 

টেরাহ ও তার পরিবার যে নব্য- সুমেরীয় সাম্রাজ্য থেকে পালিয়েছিলেন সেখানে ততদিনে সকল অভ্যন্তরীণ গোলযোগ স্তিমিত হয়ে গিয়েছে। 

উচ্চাভিলাষী উর-নাম্মুর ছেলে শুলগি তখন উর-এর সিংহাসন দখল করে আছেন। প্রায় বিশ বছর ক্ষমতায় থাকার পর তিনি তার সাম্রাজ্যকে ঢেলে সাজানোর কাজে হাত দিলেন। প্রথমেই তিনি বের হলেন নতুন কিছু এলাকা দখলের উদ্দেশ্যে। শুলগি উত্তরের ছোটো দুটি শহর আসসুর ও নিনেভেহ দখল করে নিলেন এবং টাইগ্রিস নদীর ওপার থেকে এলামাইটদের দখলে থাকা সুসাকে অবমুক্ত করে নিজের সাম্রাজ্যের অংশ করে নিলেন। তবে তিনি এলামাইটদের উত্তরের উচ্চ ভূমি পর্যন্ত কখনও অগ্রসর হননি। সেখানে এলামাইট রাজারা দীর্ঘদিন ধরে রাজত্ব করে আসছিলেন; তাদের রাজবংশের নাম ছিল শিমাশ। তারা তাদের সার্বভৌমত্ব ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। 

যুদ্ধ শেষ করে শুলগি বসলেন আলোচনার টেবিলে। তিনি বিভিন্ন ছোটো ছোটো রাজ্যের অধিকর্তা ও যোদ্ধা-নেতাদের সাথে চুক্তি সম্পাদন করলেন এবং নিজের তিন কন্যাকে বিবাহ দিলেন এলামাইট রাজ্যে অবস্থিত রাজাদের কাছে। তিনি তার বর্ধনশীল সাম্রাজ্যকে বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত করলেন এবং সেখানে গভর্নর নিয়োগ করলেন যারা তার অধীনে কাজ করতেন। এটি এমন একটি সাম্রাজ্য ছিল যার চাবিকাঠি ছিল আইনকানুন ও চুক্তির শর্তসমূহ, যা দেশবাসী মানতে বাধ্য ছিলেন। তিনি শুধু সৈন্যসামন্তের জোরেই তাদের শাসক ছিলেন না বরং তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন দেবতাদের দ্বারা এবং তিনি তাদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন আশীর্বাদ।- 

‘দেবমাতা নিনতু আপনার পরিচর্যা করেছিলেন 
এনলিল আপনার মস্তককে সমুন্নত করেছেন
নিনলিল আপনাকে ভালোবেসেছেন 
শুলগি, উর-এর রাজা’ 

তিনি ছিলেন দেবী ইনান্নার প্রিয়তম যিনি মূলত শুলগির যৌনক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে তার ভালোবাসায় সিক্ত করেছিলেন- 

‘যেহেতু সে আমার চুল এলোমেলো করে দিয়েছিল
যেহেতু সে বিছানায় সুন্দর সুন্দর শব্দ আউড়েছিল
আমি তার জন্য একটি সৌভাগ্যের ব্যবস্থা করে দিয়েছি’ 

তিনি একইসাথে চন্দ্রদেবী নান্নারও প্রিয়তম ছিলেন। তিনি তার স্বর্গীয় রক্ষাকর্তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশস্বরূপ উর শহরের দীর্ঘতম জিগারুতটি নির্মাণ করিয়েছিলেন, যেটি ছিল নব্য- সুমেরীয় সভ্যতার পক্ষ থেকে মিশরের পিরামিডের সমতুল্য একটি কাজ। এই সুবিশাল উপাসনালয়টির নাম সুমেরীয় ভাষায় ছিল : ‘এমন একটি বাড়ি যার মূলভিত্তিটি ভীতি দ্বারা আচ্ছাদিত।’ 

শুলগি দেবতাদের নির্দেশ অনুযায়ী রাজ্য শাসন করতে গিয়ে নতুন নতুন আইনকানুনের প্রচলন করেছিলেন। এই আইনগুলো কিছুটা ছন্নছাড়া ধরনের ছিল কিন্তু এগুলোকেই মানব ইতিহাসের প্রথম লিখিত সংবিধান হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। এই আইনগুলোতে বর্ণিত হয়েছিল অপরাধের সংজ্ঞা এবং তার জন্য উপযুক্ত শাস্তি সম্পর্কে। 

শুলগি উর-এর রাজত্ব করতে লাগলেন প্রবল প্রতাপে আর ওদিকে আব্রাহামকে নিরন্তর সংগ্রাম করে যেতে হচ্ছিল তার পরিবারকে সুরক্ষিত রাখার জন্য। কানান শহরে বসবাস করার জন্য সময়টা উপযুক্ত ছিল না। এই সময়টিতে জেরিকো শহরের প্রাচীরকে প্রায় সতেরোবার ধ্বংস করা হয়েছিল এবং প্রতিবারই সেটিকে পুনর্নির্মাণ করা হয় নিষ্ঠার সাথে। 

আব্রাহাম একটি নয় বরং দু-দুটি জাতির পিতা ছিলেন। তার উভয় সন্তানই সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ পেলেন; যৌনাঙ্গের চামড়া অপসারণের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারা জর্ডান নদীর ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের রুক্ষ ভূমিসমূহের দখল নেওয়ার জন্য যুদ্ধরত অন্য সেমাইটদের থেকে নিজেদেরকে আলাদা করে তুলতে সমর্থ হলেন। তবে এই পার্থক্য তাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো বাড়তি সুবিধা এনে দেয়নি। 

আইজ্যাকের জন্মের প্রায় ত্রিশ বছর পরে সারাহ মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তখনও তাদের গোত্রের নিজস্ব ভূমির আয়তন খুবই অপ্রতুল ছিল। এই কারণে আব্রাহাম বাধ্য হয়ে একজন নিকটবর্তী পশ্চিমা সেমাইট জমিদারের কাছ থেকে একটি গুহা ক্রয় করেছিলেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *