কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৩৫৭/১৯৫০)

প্রায় সাতাশ বৎসর পূর্বে ভারতবর্ষ-পত্রিকায় দেবীমাহাত্ম্য নামে একটি গল্প পড়েছিলাম। লেখকের নাম ছিল না। রচনাটি অসাধারণ, পরিহাস ও করুণার আশ্চর্য সমন্বয়, ভাষার ভঙ্গীও নূতন, তখনকার কোনও লেখকের সঙ্গে মিল নেই। সাহিত্যগগনে নবোদিত জ্যোতিষ্কের কথা মাঝে মাঝে শোনা যায়। অকস্মাৎ আবির্ভূত এই অজ্ঞাতপূর্ব শক্তিমান লেখকের পরিচয় জানতে অনেকেরই আগ্রহ হল। পত্রিকা-সম্পাদক জলধর সেন মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানালেন–লেখক কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, চীন দেশের ফেরত, কাশীতে বা পূর্ণিয়ায় বাস করেন, রাজকার্য থেকে অবসর নিয়ে সাহিত্যচর্চা করছেন। তিনি পূর্বেও ছদ্মনামে অল্পস্বল্প লিখতেন, এখন পরিণত বয়সে গল্প লেখা আরম্ভ করেছেন। তার নবপ্রকাশিত গল্পটি পড়ে অনেকেই মুগ্ধ হয়েছেন এবং আরও চাই আরও চাই বলে আবদার করছেন।

কিছু দিন পরে কোষ্ঠির ফলাফল ক্রমশ প্রকাশিত হতে লাগল। এই ভ্রমণকাহিনীতে বর্ণিত নরনারী সকলেই অসাধারণ, কিন্তু কেউ অস্বাভাবিক নয়, পিকউইক-চরিত্রাবলীর সঙ্গে তাদের তুলনা করা চলে। তার পর ক্রমে ক্রমে তার অনেক লেখা প্রকাশিত হল। বাংলায় হাস্যরসের বহু রচয়িতা পূর্বেও ছিলেন পরেও হয়েছেন। কেদারনাথের আবির্ভাবে সকলেই বুঝলেন যে হাস্যের সহিত শান্ত ও করুণ রসের মিলনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নেই। ইংরেজীতে যাকে বলে milk of human kindness, সেই করুণার ক্ষীরধারাই তাঁর রচনাকে বিশিষ্টতা দিয়েছে।

১৩৩৪ কিংবা ১৩৩৫ সালে দিল্লিতে যে প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন হয়, কেদারনাথ তার এক শাখার সভাপতি হন। শ্রীযুক্ত অমল হোম সেই অধিবেশন থেকে ফিরে এলে তার কাছে শুনলাম, কেদারনাথের প্রবন্ধ পেনশনের পরে শুনে শ্রোতারা আনন্দে উৎফুল্ল হয়েছিলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, তাকে কিরকম দেখলেন? অমলবাবু উত্তর দিলেন, ভদ্রলোক যেন পাকা আমটি। কিছুকাল পরে কেদারনাথের সঙ্গে কয়েকবার আলাপের এবং তাঁর প্রীতিলাভের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সংস্কৃত সাহিত্যে পুরুষের বর্ণনায় সৌম্য শব্দটির বহু প্রয়োগ দেখা যায়, এখন বাংলাতেও খুব চলে। আমাদের দেশে সুদর্শন সাহিত্যিকের সংখ্যা বেশী নয়, কিন্তু কেদারনাথকে দেখেই মনে হয়েছিল–হ্যাঁ, এইরকম পুরুষকেই সৌম্য বলা সার্থক।

যাঁরা শুধুই লেখক, অর্থাৎ রাজনীতিক বা ব্যবসাদার নন, সাধারণে তাদের নির্বিবাদ শান্ত ভালমানুষ মনে করে। মৎস্যজাতিও নিরীহ, কিন্তু সুবিধা পেলে পরস্পরকে কামড়াতে ছাড়ে না। অখ্যাত না হলে সাহিত্যিককেও মাঝে মাঝে স্বজাতির দংশন সইতে হয়। জলধর সেন জলধর দাদা নামে খ্যাত ছিলেন, তার অন্য উপাধি ছিল অজাতশত্রু। কিন্তু তিনিও আক্রমণ থেকে নিস্তার পান নি। কেদারনাথের সৌভাগ্য এই যে তিনি আমরণ যথার্থ অজাতশত্রু ছিলেন। অনেক লেখকের রচনায় বিশেষ ভঙ্গী বা মুদ্রাদোষ থাকে, সকলের তা ভাল লাগে না। কেদারনাথের পদ্ধতিরও সমালোচনা হয়েছে, কিন্তু তাকে বিদ্রূপ করবার সাহস কারও হয় নি।

আমরা এক যশস্বী লেখক ও জনপ্রিয় সৎপুরুষকে হারিয়েছি, কিন্তু চিরস্থায়ী সম্পদ রূপে তাঁর রচনা তিনি আমাদের দান করে গেছেন। কেদারনাথ লিখে গেছেন, তার দুই আন্তরিক কামনা পূর্ণ হয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শনলাভ, বন্ধুত্বলাভ রবীন্দ্রের। অধিকন্তু, ছিল যাহা আশাতীত, স্বাধীনতা,…তারও দেখা পেলাম আজ। তিনি পূর্ণকাম হয়ে মহাযাত্রা করেছেন, এই আমাদের সান্ত্বনা।