৩. কনফারেন্স রুমে

WTN-এর কনফারেন্স রুমে তখন ড্যানা আর ম্যাট বেকারের আলোচনা চলছিল। ড্যানা বলল,–র‍্যালফ বেঞ্জামিন বলছিল তার ছেলের সঙ্গে দেখা করবার জন্য ফ্রান্সে গিয়েছিল। একদিন হোটেল রুম থেকে তার ব্রিফকেসটা উধাও হয়ে যায়। পরের দিন আবার সেটা পাওয়া যায়। কিন্তু পাসপোর্টটা উধাও। এর থেকে বোঝা যায় যে লোকটা সেটা চুরি করেছিল সেই বেঞ্জামিনের পরিচয় দেখিয়ে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করেছিল পল উইনথ্রপের দুর্ঘটনার একমাত্র সাক্ষী সে। আসলে সেই পলকে খুন করেছিল।–

ম্যাট বলল,–ড্যানা, ঐ ব্যাপারে পুলিশকে জানানোর এটাই উপযুক্ত সময়। তোমার অনুমান সঠিক হলে আমরা এমন একজন লোকের সন্ধান করব যে ছটি খুন করছে। তোমাকে আমি তার সপ্তম শিকার হতে দিতে চাই না। ড্যানা বলে,–আমি এখনই পুলিশকে জড়াতে চাই না। আমার কাছে তো কোন প্রমাণ নেই।–

–তোমার পরবর্তী পদক্ষেপ কী?

–জুলি উইনথ্রপের জীবনে কী ঘটেছিল তা বার করা।

অপারেশন সফল। র‍্যাচেল ধীরে ধীরে চোখ মেলল। জেফ এর দিকে তাকিয়ে ঝাপসা চোখে বলল,–আমি আমার শরীরের মূল্যবান সম্পদ হারিয়ে ফেললাম। আমি এখন নারী নই। পুরুষের ভালবাসা আর আমি পাব না।–

র‍্যাচেল, তোমার বুক দেখে আমি তোমায় বিয়ে করিনি। তোমার একটু ছোঁয়া, একটু উষ্ণতা পাবার জন্য তোমায় বিয়ে করেছি।–

–আমার ইচ্ছে–.. র‍্যাচেল ওর বুকের দিকে তাকাতে গিয়ে সংকুচিত হয়ে উঠল। –এখন এসব কথা থাক র‍্যাচেল।– জেফ বলল। –কিন্তু…– জেফ এর একটা হাত আঁকড়ে ধরে র‍্যাচেল বলল, আমি এখন একলা থাকতে পারব না। তুমি আমায় ছেড়ে যেও না।–কিন্তু র‍্যাচেল আমার যে…– একজন নার্স এসে জেফকে তাগাদা দিল। জেফ-এর হাত ছাড়তে চাইল না র‍্যাচেল। আমাকে ছেড়ে তুমি যেও না।–আমি আবার ফিরে আসব।–

সেদিন সন্ধ্যায় ড্যানার সেলফোন বেজে উঠল। জেফ-এর ফোন, তার কণ্ঠস্বর শুনে ড্যানা রোমাঞ্চ বোধ করল। জেফ বলল,–কেমন আছ?–ভালই। র‍্যাচেল কেমন আছে?– অপারেশন তো ভালই হয়েছে, কিন্তু ও এখন হতাশায় ভুগছে। ভাবছে ও ফুরিয়ে গেছে।–

–কিন্তু একটি মেয়ের স্তন দিয়ে সৌন্দর্য বিচার করা হয় না এটা ওকে বুঝতে হবে।–কিন্তু ড্যানা র‍্যাচেল তো মডেল। পনেরো বছর বয়স থেকেই ও পুরুষদের চোখে দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে। ওর কেমোথেরাপি চিকিৎসারও দরকার আছে। তাই ভাবছি আরও কিছুদিন ওর কাছে থেকে যাব। তোমাকে মিস করছি।–আমিও, তোমার খ্রিস্টমাস উপহার রেখে দিয়েছি।–

–তোমার তদন্তের কি খবর?–

–কিছু কাজ বাকি আছে।–ঠিক আছে। তোমার সেলফোনের সুইচটা অন রেখ। তোমায় কিছু অশালীন গোপন কথা বলব।– ড্যানা হাসল,–ঠিকতো?–হ্যাঁ, ঠিক। নিজের যত্ন নিও।–তুমিও নিও।–

রান্নাঘরে গিয়ে দেখল ফেনাল খেতে খেতে মিসেস ড্যালির রান্নার প্রশংসা করছে। অথচ কয়েকদিন আগেও খারাপ রান্নার মিথ্যে অজুহাত দিয়ে ফেনাল না খেয়ে উঠে গেছে। ড্যানা খাবার টেবিলের সামনে বসে ফেনালের হাত ধরে বলল,–আমাকে আবার বাইরে যেতে হবে ফেনাল।–বেশ তো– কেমন যেন ঈর্ষাকাতর শোনায় ফেনালের গলা। মিসেস ড্যালি জানতে চাইল সে কোথায় যাচ্ছে? –আলাস্কায়।–ওখানকার ধূসর রঙের উল্লুকদের ওপর নজর রাখবেন।–

ওয়াশিংটন থেকে আলাস্কার জুনেউ বিমানবন্দরে পৌঁছতে নয় ঘণ্টা সময় লাগল। কার রেন্টাল কাউন্টারের দিকে এগোল ড্যানা। –আমার নাম মিস ইভান্স। আমি…—

হ্যাঁ। আপনার জন্য ল্যান্ড রোভার রেখে দিয়েছি। স্টনা টেম। সই করুন এখানে।– ক্লার্ক তার হাতে গাড়ির চাবিটা দিতেই ড্যানা বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে দশ নম্বর স্টলে এসে দাঁড়াল। একটা লোক সাদা রঙের টেলপাইপে কাজ করছিল। বলল,–টেলপাইপটা আলগা হয়ে গিয়েছিল, তাই ঠিক করে দিলাম।–

–ধন্যবাদ।– লোকটা দেখল সে গাড়ি চালিয়ে চলে গেল। একটা সরকারি বিল্ডিং-এর বেসমেন্ট-এ একটি লোক কম্পিউটারে একটা ডিজিটাল ম্যাপের ওপর দৃষ্টি ফেলে রেখেছিল। সে একটা সাদা ল্যান্ডরোভারকে ডান দিকে মোড় নিতে দেখল। তারপরেই সে বলল,–স্টার হিলের দিকে গেল।–

ড্যানার কাছে জুনেউ শহরটা বিরাট মনে হলেও আসলে শহরটা খুবই ছোট। শহরের কেন্দ্রবিন্দু ওয়াটার ফ্রন্টে একটা জনপ্রিয় হোটেলে সে উঠল। হোটেলের ডেস্কম্যান বলল এখন স্কীহং-এর মরশুম চলছে। স্কী-শপ থেকে পেয়ে যাবেন স্কী। ড্যানা স্কী শপে গেল। দোকানের ক্লার্কটি উৎসাহিত হয়ে তাকে স্কী দেখাতে লাগল। কিন্তু ড্যানার মধ্যে কোন উৎসাহ না দেখে নিরাশ হয়ে গেল। ড্যানা বলল,–আমি কিছু খবরের জন্য এসেছিলাম। জুলি উইনথ্রপ কি এখান থেকে স্কী কিনেছিলেন?—

দোকানদার গভীরভাবে ড্যানাকে নিরীক্ষণ করে বলল,–হ্যাঁ, ভোলান্ট টাই পাওয়ারের স্কী বেশি পছন্দ করতেন তিনি। ঈগলক্রেস্টে সেদিন একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়।–

–মিস উইনথ্রপ কি ভাল স্কীয়ার ছিলেন?

–সবচেয়ে ভাল। উনি অনেক পুরস্কারও পেয়েছিলেন?

–উনি কি একা এসেছিলেন?–একাই তো আসতেন। ঐ দুঘর্টনা যেন অবিশ্বাস্য।–

ওয়াটার ফ্রন্টে ড্যানার হোটেল থেকে দুটো ব্লক পরেই জুনেউ পুলিশ ডিপার্টমেন্ট। অফিসের সব আসবাবপত্রের রং নীল। কার্পেটও নীল। ড্যানা ঢুকতেই একজন ইউনিফর্ম : পরিহিত অফিসার বললেন,–আমি কি আপনাকে সাহায্য করতে পারি?–

–জুলি উইনথ্রপের মৃত্যুর ব্যাপারে আমি কিছু খবর জানতে চাই।

— লোকটি ভুরু কুঁচকে বলল,–আপনি যার খোঁজ করছেন তার নাম ব্রস বাওলার। সী ডগ রেস্কিউ-এর প্রধান। উপরতলায় তার অফিস। এখন সে হোয়াফের হ্যাঁঙ্গারে। সেটা দুটো ব্লক পরে মেরিনওয়ের ওপরে।–ধন্যবাদ।– হোয়াফের হ্যাঁঙ্গার একটা ভিড়ে ঠাসা রেস্তোরাঁ। ড্যানা হোস্টেসের কাছে ব্রুস বাওয়ারের খোঁজ চাইল। –ঐ তো সামনের টেবিলে।–

ব্রুস চল্লিশোর্ধ বয়সের সুদর্শন পুরুষ।

ড্যানা তার কাছে গিয়ে বলল–আপনিই তো মিঃ বাওলার?–হা।–আমি ড্যানা ইভান্স। জুলি উইনথ্রপের মৃত্যুর ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।–

–বেশ। আপনার মধ্যাহ্নভোজ সারা হয়ে গেছে?–

–না।–একসঙ্গে খাই না আমরা?–বেশ।– ড্যানা খাবারের অর্ডার দিল। বলল,–জুলির মৃত্যু যে দুর্ঘটনা নয় এমনটি ভাববার কি কোন কারণ আছে?– মানে তিনি আত্মহত্যা করেছেন?– না, আমার মনে হয় তাকে খুন করা হয়েছে।–

ব্রুস বলল,–এ হতেই পারে না। এটা একটা দুর্ঘটনা।–

–ঠিক আছে। সেদিন কী ঘটেছিল?–

–এখানে তিন ধরনের ঢালু জায়গা আছে। প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য মাস্কেজ ডলি ভার্ডেন এবং সোরোফ। সবচেয়ে কঠিন হল সুইস বক্স, মাদার লোড, সানড্যান্স। টাফ হল ইনসেন। প্রুস সংকীর্ণ ঢালুপথ, হ্যাং টেন, তারপর রয়েছে ভয়ংকর ঢালু পথ, সেটাই সবচেয়ে কঠিন।– আর জুলি সেটাই করছিলেন। তার মানে তিনি একজন দক্ষ স্কীয়ার ছিলেন?–

–অবশ্যই। সেজন্যই প্রতি বৃহস্পতিবার বিকেল চারটে থেকে নটা পর্যন্ত নৈশ স্কইং করার ব্যবস্থা ছিল। সবাই ফিরে এলেও জুলি ফেরেনি। আমরা তার খোঁজ করতে গিয়ে ঢালু জায়গার একেবারে নীচে তার মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখি। একটা গাছের উপর তিনি আছড়ে পড়েন এবং সঙ্গে সঙ্গেই তার মৃত্যু হয়।–

মানে দুর্ঘটনার সময় তিনি একাই ছিলেন?–

–হ্যাঁ, স্কীইং করার চারপাশে বেড়া দেওয়া ছিল। যারা তা এড়িয়ে স্কীইং করে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়েই তা করে। জুলিও তাই করেছিল।–

–মিঃ বাওলার, কোন স্কীয়ার হরিয়ে গেলে তার খোঁজ করার পদ্ধতিটা কী রকম?–

–আমরা চিরুনি তল্লাশি শুরু করি। প্রথমে নিখোঁজ ব্যক্তির বন্ধু, আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করি, বার-রেস্তোরাঁয় খবর নিই, তারপর অনুসন্ধানকারীদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে স্কী স্পটের বিভিন্ন জায়গায় পাঠাবার ব্যবস্থা করি। দুশো তিরিশ একরেরও বেশি। আমরা হেলিকপ্টারও ব্যবহার করি। কারণ বনে জঙ্গলে কেউ হারিয়ে গেলে হেলিকপ্টার থেকে তাকে দেখা যেতে পারে। ড্যানা বলল,–জুলি উইনথ্রপ তো ঈগলক্রেস্টের একেবারে উপরে কীইং করত?–

ব্রুস সায় দেয়। ড্যানা জানতে চায়, তার মৃতদেহ কী করে পেলেন আপনারা?–

–আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর মেডে তাকে প্রথম দেখে। এই জাতীয় কুকুর বাতাসে মৃত বা মৃতার গন্ধ শুঁকে তা সে যতই দুর্গম হোল্ক না কেন পৌঁছে যায়। তারপরে অ্যাম্বুলেন্সের লোকেরা তার মৃতদেহ বার্টলেট রিজিওন্যাল হসপিটালে নিয়ে যায়।–

–দুর্ঘটনা কীভাবে ঘটল?–

–তিনি একজন চটপটে ফিটফাট অবন্ধুসুলভ দৈত্যের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। দৃশ্যটা খুব ভাল নয়।– ড্যানা বলল, ঈগলক্রেস্টের সর্বোচ্চ শিখরটা আমাকে দেখাবার ব্যবস্থা করতে পারেন?–

–নিশ্চয়ই। মধ্যাহ্নভোজের পরে আমি নিয়ে যাব।–

জীপে করে তারা পাহাড়ের তলায় একটা দোতলার লজে এসে পৌঁছাল। ব্রুস বলল, আমরা এখানেই অনুসন্ধান কাজের ছক তৈরির জন্য মিলিত হয়েছিলাম। আমরা সবাই ঈগলক্রেস্টের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে গিয়েছিলাম। সেখানে পৌঁছতেই একটি পরিচিত লোক ব্রুসকে সম্ভাষণ জানাল। –কেউ কি হারিয়ে গেছে ব্রুস?–

–না, আমার এক বান্ধবী মিস ড্যানা ইভান্সকে জায়গাটা দেখাতে এনেছি।–

ড্যানা চারপাশটা দেখতে দেখতে ভাবল স্কীইং করার আগে জুলি কি ঈগল ক্রেস্টের উচ্চ শিখরে গিয়েছিল। আর কেউ কি তাকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিল?

তারপর ড্যানা নীচের দিকে তাকিয়েই কেঁপে উঠল। ড্যানাকে নিয়ে নিচে নেমে এল ব্রুস।

হোটেলে ফিরতেই একজন লোক দরজায় নক করল। হ্যালো, মিস ইভান্স, আমি নিকোলাস ভেরডান। জুনেউ এম্পায়ার নিউজপেপারে অফিস থেকে আসছি। আমরা জুলি উইনথ্রপের মৃত্যুর ব্যাপারে একটা কাহিনী তৈরি করতে চাই। সে ব্যাপারে জানতে চাই। আপনি তো এই কেসের তদন্ত করছেন।

ড্যানা সতর্ক হল–না, আমি তদন্ত করছি না। সারা বিশ্বের স্কীইং-এর উপর আমরা একটা প্রদর্শনী করতে চাই। এই জায়গাটায় তাই দেখতে এসেছি।– লোকটি একটু অবিশ্বাসের সঙ্গে বলল,–তাই বুঝি?–।

সে চলে যেতেই ড্যানা জুনেউ এম্পায়ারকে ফোন করল। –আমি সাংবাদিক নিকোলাস ভেরডানের সঙ্গে কথা বলতে চাই।–

–ওই নামে আমাদের কোন সাংবাদিক নেই।

–তাই বুঝি।

 জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল ড্যানা। এক্ষুনি এখান থেকে চলে যেতে হবে। ব্রুস বাওলার কে ফোন করতেই সে তাকে কোজিলগ-বেড-অ্যান্ড-ব্রেকফাস্ট ইন-এ একটা খালি ঘরের সন্ধান দিল। ক্লার্ক তাকে ম্যাপ ফেলে কোজিলগ দেখিয়েছিল।

সরকারি বিল্ডিং-এর বেসমেন্টে সেই লোকটা কম্পিউটারের ডিজিটাল ম্যাপের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল-এটি হল নগরের কেন্দ্রস্থল, সে এখন পশ্চিমের দিকে এগিয়ে চলেছে।

কোজিলগ নগরের কেন্দ্রস্থল থেকে আধঘণ্টার পথ। ড্যানা বেল টিপতেই বছর তিরিশের সুন্দরী এক মহিলা দরজা খুলল। ড্যানা বলল,–আপনার স্বামী বললেন এখানে একটা ঘর খালি আছে।–

–অবশ্যই আছে। আসুন ভেতরে আসুন।

–আমি জুডি। এখানকার সব রান্নাবান্না আমিই করি।

–চমৎকার।–

জুডি ড্যানাকে তার ঘরটা দেখিয়ে দিল। পরিষ্কার ঘর। ড্যানার পছন্দ হয়ে গেল। আর এক দম্পতি ছিল সেখানে। তারা ড্যানাকে চিনতে পারল না। ড্যানা ভাবল ভালই হল।

মধ্যাহ্নভোজের পর ড্যানা গাড়ি চালিয়ে সাহেবের ক্লিফ হাউস বার-এ গিয়ে ঢুকল। সোনালি চুলের বারটেন্ডার বলল,–স্কীইং করার পক্ষে খুব সুন্দর আবহাওয়া।–কিন্তু এটা খুব বিপজ্জনক খেলা। আমার বন্ধু জুলি উইনথ্রপ স্কী করতে গিয়ে মারা গেছেন।–

–বেচারি এক দুর্ঘটনায়—

কিন্তু দুর্ঘটনা ছিল না। খুন ছিল।

–সে কী, খুন হতেই পারে না।–

 কিছুক্ষণ পরে প্রসটেক্টর হোটেলের বারটেন্ডারের সঙ্গে ড্যানা কথা বলছিল।

–স্কীইং-এর পক্ষে খুব চমংকার আবহাওয়া।–

ড্যানা বলল–কিন্তু বিপজ্জনকও বটে। আমার বন্ধু জুলি উইনথ্রপ স্কীইং করতে গিয়ে নিহত হয়।–

–আমি ওঁকে পছন্দ করতাম। উনি অহংকারী ছিলেন না।

স্কীইং করতে করতে ড্যানা টারমিগান মাউন্টের একেবারে শিখরে চলে গিয়েছে। ঠান্ডা ঝোড়ো বাতাস তার গায়ে বিঁধছে। নীচের দিকে তাকিয়ে তিনি ফিরে যাবার কথা ভাবছিলেন। কে যেন তাকে পেছন থেকে ঠেলা দিল। তখনই গাছে ধাক্কা খাবার ঠিক আগে চেঁচিয়ে ওঠে সে…স্বপ্নটা এই অবধি দেখেই ড্যানার ঘুম ভেঙে যায়। সে কাঁপতে থাকে। ভাবে জুলিকেও কী কেউ এভাবেই ঠেলে দিয়েছিল?

ইলিয়ট ক্রমওয়েল অধৈর্য হয়ে উঠলেন। –জেফ কনর্নাস কবে ফিরে আসবে? ওকে আমাদের খুব দরকার।–খুব শিগগিরই ফিরে আসবে।–

আলাস্কা থেকে ফিরে খ্রিস্টমাসের দিন ফেনালকে সঙ্গে নিয়ে ড্যানা হাডসনদের বাড়িতে পৌঁছলে সিজার তাকে স্বাগত জানাল। মিস্টার এবং মিসেস হাডসন ড্রইংরুমে ছিলেন।

পামেলা হাডসন বললেন,–এই শুভদিনে তোমাদের দেখে আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে। ফেনালের হাতটাও চমৎকার হয়েছে।–

মিঃ হাডসন বললেন,–অভিনন্দন ফেনাল।–

ধন্যবাদ মিঃ হাডসন।– রজার হাডসন এবার ড্যানাকে বললেন,–অন্য অতিথিরা আসার আগেই আমি একটা খবর দিতে চাই আপনাকে। আমি আপনাকে বলেছিলাম টেলর উইনথ্রপ বলেছিলেন জনগণের জীবন থেকে অবসর নিতে চাই। কিন্তু এখন শুনছি উইনথ্রপই প্রেসিডেন্টকে চাপ দিয়েছিলেন তাকে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত হিসাবে নিয়োগ করার জন্য।–

কিন্তু কেন তিনি এমন করতে গেলেন?–

ড্যানা সেই পার্টি উপভোগ করলেও জেফ-এর কথা বার বার মনে হতে লাগল।

বেশ কিছুদিন পর ড্যানা আবার এগারোটার খবর সম্প্রচার করার জন্য স্টুডিওয় ক্যামেরাম্যানের মুখোমুখি হল। তার সহকারী ভাষ্যকার রিচার্ড মেলটন তার সঙ্গে নিরিবিলিতে বসতে চায়। সে বলে ইলিয়ট ক্রমওয়েল ড্যানার ঘন ঘন দেশের বাইরে যাওয়া পছন্দ করেন না। ড্যানার মাথায় তখন উইনথ্রপ পরিবারের সদস্যদের আকস্মিক মৃত্যুকে ঘিরে চিন্তা।

খবর পড়ার পর ড্যানা স্টুডিও থেকে বেরিয়ে সোজা অফিসে চলে এল। কমপিউটারের সুইচ অন করে সরাসরি ইন্টারনেটে এল। টেলর উইনথ্রপ সম্বন্ধে তথ্য ঘেঁটে সে তার অনুসন্ধান কাজ আবার চালাতে শুরু করে দিল। একটি ওয়েবসাইটে ফরাসি সরকারের অফিসার মার্শেল ফ্যালকন সম্বন্ধে কিছু তথ্য পাওয়া গেল। NATO-র রাষ্ট্রদূত ছিলেন তিনি। তিনি টেলর উইনথ্রপের সঙ্গে একটা বাণিজ্য চুক্তি সম্বন্ধে আলোচনা চালাচ্ছিলেন। কিন্তু মাঝপথে ফ্যালকন সরকারি পদ ছেড়ে দেন। কিন্তু কেন?

ড্যানা পরদিন খুব সকালে তার অফিসে চলে এসে ইন্টারনেটের ওপর মনোনিবেশ করল। দুটি বিষয় তার নজরে এল। প্রথমটি, ইতালির বাণিজ্যমন্ত্রী ভিনসেন্ট ম্যানসিসনো টেলর উইনগ্রুপের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির আলোচনার সময় অস্বাভাবিকভাবে পদত্যাগ করল। তার সহকারী আইভভা ভেল তার পদগ্রহণ করেন।

দ্বিতীয় বিষয় হল ব্রুসেলসে NATO-র বিশেষ পরামর্শদাতা চেয়েছিলেন টেলর উইনথ্রপকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে তার জায়গায় আমেরিকা অন্য কাউকে পাঠাক।

টেলর উইনথ্রপ রাষ্ট্রদূতের পদ ছেড়ে দিলেন। মার্শেল ফ্যালকন এবং ভিনসেন্ট ম্যানসিনো পদত্যাগ করলেন। এই তিনটি ঘটনাই কি পরস্পরের সঙ্গে জড়িত?

ড্যানা এরপর রোমে ইতালিয় নেটওয়ার্কের ডোমিনিক রোমানোকে ফোন করল। বলল সে রোমে যাচ্ছে। রোমানো তাকে স্বাগত জানাল।

ড্যানা এরপর জিন সোনভিলেকে ফোন করল। সে সেলসে রু ডেস চ্যাপেলিয়ার্সে NATOর প্রেস হেডকোয়ার্টারে কাজ করে। ড্যানা তার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে বলল।

এরপর, অলিভিয়ার ফোন এল। ম্যাট বেকার ড্যানাকে ডাকছেন।

ড্যানা একটু পরে ম্যাটের অফিসের দিকে রওনা হল।

ম্যাট বললেন,–গতকাল রাত্রে আমি একটা কাহিনী শুনেছি। যা একটা কু হয়ে উঠতে পারে। একজন লোক–নাম ডিয়েটার জ্যান্ডার। ডুসেলডরফের লোক। টেলর উইনথ্রপের সঙ্গে তার ব্যবসা ছিল। তাদের মধ্যে অত্যন্ত ঝগড়া হয় এবং জ্যান্ডার টেলরকে খুনের হুমকি দেয়। তাই মনে হয় এই ব্যাপারটা বিস্তারিত জানা উচিত।–অবশ্যই। আমি চেষ্টা করছি।–

রাস্তায় নেমে ড্যানার হঠাৎ জ্যাক স্টোন এবং FRA-র কথা মনে পড়ে গেল। জ্যাক স্টোনকে সে ব্যক্তিগত সেলফোনে ফোন করল। –আমি ড্যানা ইভান্স বলছি।–বলুন, কী দরকার?– ডুসেলডরফের জ্যান্ডার নামে একটি লোকের ব্যাপারে আমি কিছু খবর জানার চেষ্টা করছি।–তাকে আমরা খুব ভাল করেই জানি। টেলর এবং ডিয়েটার জ্যান্ডার একটা ব্যবসায় দুজনে পার্টনার ছিলেন। স্টক হেরফের করার জন্য জ্যান্ডারের জেল হয়। জেলে থাকাকালীন তার বাড়িতে আগুন লেগে তার স্ত্রী এবং তিন সন্তান মারা যায়। এজন্য। জ্যান্ডার টেলর উইনথ্রপকেই দায়ী করেছিল।–সে কি এখনও জেলে?–না, গতবছর সে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে।–ধন্যবাদ।– ড্যানা ভাবল এখন সে ডুসেলডরফে যাবে।

ডুসেলডরফ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ট্যাক্সির লাইন পড়ে গেছে। ড্যানা ট্যাক্সি নিয়ে ব্রেইডেনপচার হফে গিয়ে পৌঁছাল। পুরনো হলেও সেটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হোটেল। ডেস্কের পেছনে বসে থাকা ক্লার্ক সহাস্যে ড্যানাকে স্বাগত জানাল।

ড্যানা রেজিস্টারে সই করে ওপরতলায় তার ঘরে চলে গেল। আধঘণ্টা পরে সে কেবল নেটওয়ার্কে ফোন করল। ড্যানা বলল,–স্টিফান আমি এখানে এসে পৌঁছেছি।–আমার যে বিশ্বাসই হচ্ছে না-নৈশভোজ সারবে আমার সঙ্গে?–নিশ্চয়ই?–তাহলে রাত আটটায় ইম স্কিফসেনে যাব।–

ড্যানা পোশাক বদলে তৈরি হচ্ছিল এমন সময় তার সেলফোনটা বেজে উঠল। জেফ এর ফোন। –তুমি এখন কোথায় আছ?–ডুসেলডরফে। এই শহরটা জার্মানিতে। তদন্তের কাজ প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে। র‍্যাচেল, কেমন আছে?–কেমোথরাপি খুব যন্ত্রণাদায়ক চিকিৎসা পদ্ধতি। ও খুব কাহিল হয়ে পড়েছে।–

–ও কী তাহলে– ড্যানা কথাটা শেষ করে না।

–এখনই বলা সম্ভব নয়। নিরাময় হতেও পারে।

–জেফ ওকে বোলো আমি ওর জন্য চিন্তিত।

–বলবো। সুইট হার্ট। আমি তোমায় ভালবাসি।

–আমিও তোমায় ভালবাসি, জেফ। বিদায়।–

ডুসেলডরফে ইম স্কিফসেন খুব সুন্দর রেস্তোরাঁ। স্টিফান জুয়েলার ড্যানাকে দেখেই। হাসল। –তুমি এখানে ড্যানা?–

–আমার এক জনের সঙ্গে দেখা করার কথা। ডিয়েটার জ্যান্ডার। তুমি তাকে জান?–

–সবাই তার নাম শুনেছে। একটা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে। পার্টনারের সঙ্গে প্রতারণা করতে গিয়ে ধরা পড়ে এবং জেল হয়। তার অবশ্য দাবি সে নির্দোষ।–

–সত্যিই কি সে নির্দোষ ছিল?

–টেলর উইনথ্রপ তার বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ করেন বলে তার দাবি। টেলর উইনথ্রপ একটা দস্তার খনিতে তাকে পার্টনার হিসাবে নেবার প্রস্তাব দেয় যার মূল্য বেশ কয়েক বিলিয়ন ডলার। উইনথ্রপ তাকে অগ্রণীর ভূমিকায় ব্যবহার করে এবং কয়েক মিলিয়ন ডলার দামের স্টক জ্যান্ডার বিক্রি করে দেয়। উইনথ্রপ আগাম বিক্রির সব টাকাটা নিজের কাছে রেখে দেয় এবং জ্যান্ডার সর্বসান্ত হয়ে যায়। কারণ খনিতে একেবারেই দস্তা ছিল না। জুরি অবশ্য এই কাহিনী বিশ্বাস করেনি। কারণ টেলর উইনথ্রপ দেবতুল্য ব্যক্তি ছিলেন। তা তোমার এ ব্যাপারে আগ্রহ কেন?–আসলে আমরা এক বন্ধু জ্যান্ডারের ওপর নজর রাখতে বলেছে।–

নৈশভোজ সেরে তারা রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এল। ড্যানাকে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে স্টিফান বলল,–এখানে মার্গারেট স্টেইফ নামে এক মহিলা পশমের তৈরি খেলনা ভাল্লুক আবিষ্কার করেছিলেন। এরা পরস্পরকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে। তুমি যখন ডিয়েটার জ্যান্ডারের সঙ্গে মিলিত হবে তখন সাবধান হোয়ো। সে কিন্তু রক্তমাংসের ভাল্লুক।–

ডুসেলডরফের বাইরে বাণিজ্য কেন্দ্রে জ্যান্ডার ইলেকট্রনিক্স ইন্টারন্যাশনালের বিরাট বিল্ডিং।

ড্যানা রিসেপশনিস্টকে বলল,–মিঃ জ্যান্ডারের সঙ্গে দেখা করব।–আগে থেকে। অ্যাপয়ন্টমেন্ট না থাকলে দেখা করা সম্ভব নয়।– ড্যানা ডেস্ক থেকে সরে এল। একদল কর্মচারী এলিভেটরের দিকে যাচ্ছিল। তাদের সঙ্গে এলিভেটরে উঠে পড়ল ড্যানা।

এলিভেটর চলতে শুরু করতেই বলল,–মিঃ জ্যান্ডারের অফিসটা কোন্ ফ্লোরে ভুলে গেছি।–

–ফোর্থ ফ্লোরে।– ।

–ধন্যবাদ।– ফোর্থ ফ্লোরে নেমে ডেস্কের পিছনে একজন তরুণীর সামনে গিয়ে ড্যানা বলল,–আমি ডিয়েটার জ্যান্ডারের সঙ্গে দেখা করব। আমেরিকায় একটা জাতীয় দূরদর্শনে তার এবং তার পরিবার সম্বন্ধে কিছু খবর সম্প্রচার করতে যাচ্ছি। তাই আমি এ ব্যাপারে তার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই।–

সেক্রেটারি তাকে নিরীক্ষণ করে প্রাইভেট চিহ্নিত একটা ঘরে প্রবেশ করল। দেওয়ালে জ্যান্ডার ইলেকট্রনিক্স ফ্যাক্টরির কয়েকটা ছবি ঝুলতে দেখল। আমেরিকা, ফ্রান্স, ইতালি তে তাদের কারখানা ছড়িয়ে আছে। সে সব দেশে উইনথ্রপ পরিবারের সদস্যরা খুন হয়েছিলেন। মিনিট খানেক পরে সেক্রেটারী এসে বলল,–মিঃ জ্যান্ডার আপনার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হয়েছেন।–ধন্যবাদ।– একটা সুদৃশ্য ডেস্কের পিছনে বিরাট চেহারার মানুষ বসে ছিলেন। প্রায় ষাট বছর বয়স। চোখ দুটো বাদামী। তিনি ড্যানাকে বললেন,–সারাজোভায় আপনি করেসপন্ডেন্ট ছিলেন নাকি?–হ্যাঁ।–আমার সঙ্গে আপনার কিসের দরকার বুঝলাম না।–

–আমি টেলর উইনথ্রপের ব্যাপারে জানতে চাই।–

মুহূর্তে জ্যান্ডারের মুখের ভাব বদলে গেল। –কী জানতে চান?–মিঃ জ্যান্ডার, আমার বিশ্বাস টেলর উইনথ্রপ আর তার পরিবার খুন হয়েছিলেন।–

–আপনার এখনই এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত।

–তার সঙ্গে আপনার ব্যবসা ছিল তাই না।

–কোন কথা নয়। চলে যান।–

–কিন্তু এ ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা করলে আপনার ভালই হবে। আমি সতোর পথেই চলব।

দীর্ঘসময় মুখ বুজে জ্যান্ডার তিক্তস্বরে মুখ খুলল। –টেলর উইনথ্রপ একজন ধূর্ত প্রতারক ছিল। আমাকে জেলে পাঠিয়ে সে আমার স্ত্রী ও সন্তানদের খুন করে। কিন্তু ওকে খুন আমি করিনি বা করাইনি।

জ্যান্ডারের অফিস থেকে বেরিয়েই ড্যানা ম্যাট বেকারকে ফোন করল। সব ঘটনা শুনে ম্যাট বলল,–দেখলে তো, কেমন মিলে যাচ্ছে।–আপনার কথাগুলো শুনতে ভালই। কিন্তু কোন প্রমাণ তো আমরা পাইনি। কাল আমি রোমে যাচ্ছি। দুএকদিনের মধ্যে বাড়ি ফিরব।–নিজের প্রতি যত্ন নিও।–ধন্যবাদ।–

রোম একটা আধুনিক মেট্রোপলিস যার মহিমা সুগন্ধি ফুলের মত প্রচারিত হয়ে আসছে। এ শহরে এক একটা দিনের এক একরকম সুন্দর দৃশ্য। ড্যানা বারো বছর বয়সে এই শহর ছেড়ে সে বাবা, মায়ের সঙ্গে চলে গিয়েছিল। এখন সেই সুখের স্মৃতিগুলো তার মনে পড়ছে।

পিয়াজো নাড়োনোর কাছে হোটেল সিসেরোনিতে এসে উঠল। হোটেল ম্যানেজার তাকে স্বাগত জানাল। –আপনার জন্য একটা চমৎকার সুইট রাখা আছে।–

ইতালি খুব সুন্দর বন্ধুভাবাপন্ন দেশ। ড্যানা তার প্রাক্তন প্রতিবেশি ডরোথি এবং হাওয়ার্ড হোয়ারটনের কথাও ভাবল। অপারেটরকে ইটালিয়নে রিপ্রিস্টিনো কর্পোরেশনের লাইনটা দিতে বলল। ফোনের লাইন পেয়ে ড্যানা বলল,–আমি হাওয়ার্ড হোয়ারটনের সঙ্গে কথা বলতে চাই।–

–দুঃখিত। এই নামে কেউ নেই।–

এরপর ড্যানা ইতালিয় টেলিভিশনের অ্যাঙ্করম্যান ডোমিনিক রোমানোর সঙ্গে যোগাযোগ করল। –ডোমিনিক আমি ড্যানা।–আমি খুব খুশি। কখন আমরা দেখা করব?–

–তুমিই বলো।

–তুমি কোথায় উঠেছ?

–হোটেল সিসেরোনিতে।–

–ঠিক আছে। একটা ট্যাক্সিতে করে টলায় চলে এস। এখানকার ভিয়া ডেলা লুপা রেস্তোরাঁয়।

টওলায় ভিয়া ডেলা লুপা রোমের অত্যন্ত প্রসিদ্ধ রেস্তোরাঁ। ড্যানা সেখানে পৌঁছে দেখল ডোমিনিক এসে গেছে।

–কী করছ ড্যানা?–আমি ভিনসেন্ট ম্যানসিনোর সঙ্গে দেখা করতে চাই।–ডোমিনিকের মুখের ভাব বদলে গেল।–

–কেন?–এটা তদন্তের একটা অঙ্গ। ম্যানসিনোর ব্যাপারে তুমি যা জানো আমাকে বলল।–

–ম্যানসিনো ছিল বাণিজ্য মন্ত্রী। তিনি মাফিয়া ছিলেন। তাঁর হাতে সর্বদা একটা বিরাট ছড়ি থাকত। তিনি কেন যে এই পেশাটা ছেড়ে দিলেন কেউ জানে না।–

ড্যানা বলল,–ম্যানসিনো মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেবার আগে একটা সরকারি ব্যবসার ব্যাপারে টেলর উইনথ্রপের সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছিল।–

হ্যাঁ। তবে উইনথ্রপ এই বাণিজ্য চুক্তির ব্যাপারে অন্য কারো সঙ্গে আলোচনা সেরে ফেলে।–

–কতদিন টেলর উইনথ্রপ রোমে ছিলেন?–

–প্রায় মাস দুয়েক। ম্যানসিনো আর উইনথ্রপ মদের টেবিলে অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যায়। কিছু একটা গোলমাল হয়ে যায়।–

–কী?–

–ম্যানসিনোর একমাত্র কন্যাসন্তান পিয়া নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এর ফলে ওঁর স্ত্রী স্নায়ু দুর্বলতায় ভুগছেন।–

–ওঁর মেয়েকে কি অপহরণ করা হয়েছিল?–

–না। তবে তার খবর কেউ জানে না। সে রীতিমত সুন্দরী ছিল।

–ম্যানসিনোর স্ত্রী এখন কোথায়?

–স্যানিটারিয়ামে।

–সেটা কোথায়?–

–জানি না, আর তুমিও জানার চেষ্টা কোর না। ম্যানসিনো থেকে সর্তক থাকো। লোকটা সুবিধের নয়। তার কথা ভুলে যাও।–

–ধন্যবাদ ডোমিনিক।

ভিনসেন্ট ম্যানসিনোর অফিস ভিয়া সারজোনায় একটা আধুনিক বিল্ডিং-এ।

রিসেপশনিস্ট অ্যাপয়েন্টমেন্ট না থাকায় তাকে যেতে দিল না। –আমি টেলর উইনথ্রপের ব্যাপারে এসেছি।– রিসেপশনিস্ট তাকে নিরীক্ষণ করে ফোন করল ম্যানসিনোকে। তারপরে বলল,–আপনি সেকেন্ড ফ্লোরে চলে যান। সেখানে আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য কেউ থাকবেন।–

ভিনসেন্ট ম্যানসিনোর ষাট বছর বয়স হবে। মাঝারি চেহারা, চওড়া বুক, পাতলা ঠোঁট, চুল সব সাদা হয়ে গেছে। হিমশীতল চোখ, ড্যানা ঘরে ঢুকতেই কর্কশ কন্ঠে সে বলল,–আপনি টেলর উইনথ্রপের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছেন।–

–হ্যাঁ।

–বলার কিছু নেই। আগুনে পুড়ে তার স্ত্রীসহ সে মারা গেছে।

–বসতে পারি?

–হ্যাঁ, হ্যাঁ নিশ্চয়ই।–

–আপনাদের দুই দেশের সরকারের মধ্যে একটা বাণিজ্য চুক্তির জন্য আপনি এবং টেলর উইনথ্রপ আলোচনা চালাচ্ছিলেন। আর এভাবে আপনাদের দুজনের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।–

–খুব অল্প সময়ের জন্য।–

–এ কি আপনার মেয়ে?– ডেস্কের ওপর রাখা ফোটোর দিকে চকিতে একবার তাকিয়ে দেখে নিয়ে ড্যানা বলল।

–হ্যাঁ।–সে এখন কোথায়?– কিছুক্ষণ তাকে নিরীক্ষণ করে সে বলল আবেগরুদ্ধ স্বরে

 আপনার আমেরিকান বন্ধু টেলর উইনথ্রপ আমার কুমারী মেয়েকে গভবর্তী করে দিয়েছিল। ওর তখন ষোল বছর বয়স। লোক জানাজানি হবার ভয়ে টেলর তাকে গর্ভপাত করাবার জন্য কসাইয়ের কাছে পাঠিয়ে ছিল, সে তার গর্ভাশয় কেটে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল।–

চোখে জলে ভরে আসে ভিনসেন্টের। –সে আমার ছেলেমেয়ে, নাতি নাতনিদেরও ধ্বংস করেছিল। এখন তাকে সপরিবারে সেই পাপের বেতন দিতে হল। আমার মেয়ে এখন কনভেন্টে। তাকে আমি কখনও দেখতে যাব না।–

ড্যানা চুপ করে রইল। একটা কথাও বলতে পারল না। ভাবল তাহলে টেলর সম্পর্কে দুজনের মনোভাব জানা গেল। মার্শেল ফ্যালকন এখনও বাকি।

NATO-র অফিস বিল্ডিং লিওপোল্ডে। ছাদে বেলজিয়াম ফ্ল্যাগ উড়ছিল। ড্যানা নিশ্চিত আমেরিকান প্রতিনিধি হিসেবে NATO-র পদটা অবসর নেবার আগেই টেলর উইনথ্রপ কেন যে ত্যাগ করেছিলেন এ ব্যাপারে খবর সে পাবে। কিন্তু NATO-র অফিসে কোন সুবিধে করতে পারল না। সে তখন রুডেস চ্যাপেলিয়ার্সে NATO-র প্রেস হেডকোয়ার্টারে গেল আর সেখানেই জিন সোমভিলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সে অভিবাদন জানিয়ে বলল,–ড্যানা, ব্রুসেলসে কী জন্যে এলে?–

–আমি একটা কাহিনীর ওপর কাজ করছি। তাই কিছু খবর দরকার। একসময় টেলর উইনথ্রপ NATO-র আমেরিকার পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করতেন তো?–

–হ্যাঁ। চমৎকার লোক ছিলেন তিনি।

–তিনি ব্রুসেলসে তার কাজটা অবসর নেবার আগেই ছেড়ে দেন কেন?

— জিন বলল,–এখানে যে কাজের জন্য তিনি আসেন তা অনেক আগেই শেষ করে ফেলেন।–

–এখানে তিনি কাজ করার সময় তার সম্বন্ধে কোন কুৎসা কি রটেছিল?

— না। আমি শুনেছি উইনথ্রপের সঙ্গে আর একজনের মতবিরোধ হয়।

–এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে পরে আমাকে জানিও।

— পরদিন ড্যানা জিন সোমভিলকে ফোন করল–নতুন কিছু খবর পেলে?

–আমি দুঃখিত। কোন খবর নেই।

–যাই হোক, ধন্যবাদ।

–তোমার, এই ট্রিপটা নষ্ট হল।–

–NATOর ফরাসি রাষ্ট্রদূত মার্শে ফ্যালকন অপ্রত্যাশিতভাবে পদত্যাগ করে ফ্রান্সে ফিরে গেছেন কেন?–

মার্শেল ফ্যালকনের ছেলে গাড়ি চাপা পড়ে নিহত হয়।

–তাকে ধরা গেছে?–

–হ্যাঁ, সে নিজেই পুলিশ স্টেশনে এসে ধরা দেয়। সে টেলর উইনথ্রপের গাড়ির চালক। তার নাম অ্যান্টনিও পার্সিকো।–

ড্যানার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। –পার্সিকো এখন কেথায়?

–সেন্ট গিলেস জেলখানায়।–

ড্যানা আগেই সেই জেলখানায় পার্সিকোর সাক্ষাৎকার নেওয়ার অনুমতি নিয়ে রেখেছিল। সাক্ষাৎকার কক্ষে পৌঁছে সে দেখল ছোটখাটো চেহারার পাণ্ডুর মুখের লোক। খুশিতে সে বলে উঠল,–ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। আপনি আমাকে এখান থেকে মুক্ত করে নিয়ে যাবেন তো?–

ড্যানা দুঃখিত হয়ে তাকে বলল,–আমি বোধহয় তা করতে পারি না।

–তাহলে কেন এসেছেন?–

–গ্যাব্রিয়েল-এর মৃত্যুর ব্যাপারে জানতে এসেছি।–এব্যাপারে আমি কিছু বলব না। কারণ আমি নির্দোষ।–

–কিন্তু আদালতে আপনি যে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন?—

–আমি মিথ্যে বলেছি। কারণ এ জন্য আমাকে টাকা দেওয়া হয়েছে।–

–সত্যি কথাটা অনুগ্রহ করে বলুন।–

–গ্যাব্রিয়েলকে গাড়ি চাপা দিয়েছিল উইনথ্রপ। এক শুক্রবার রাতে ঘটনা ঘটে। সেই উইকএন্ডে লন্ডনে গিয়েছিলেন তার স্ত্রী। মিঃ উইনথ্রপ একা নাইটক্লাবে গিয়ে মাতাল অবস্থায় ফিরছিলেন। তিনি ফিরে আমাকে বলেন একজন যুবককে তিনি গাড়ি চাপা দিয়েছেন। কিন্তু তিনি ভয় পাচ্ছিলেন যে ঐ ঘটনাটা যদি কেউ দেখে থাকে এবং গাড়ির নম্বর পুলিশকে দেয় তবে তাকে গ্রেফতার করবে পুলিশ। আর এর ফলে রাশিয়ান প্ল্যানটা ভেস্তে যাবে।–

রাশিয়ান প্ল্যান মানে?– ।

তিনি ঐ রকমই বলতেন। আমি এ ব্যাপারে আর কিছু জানি না। ফোনে তাকে কথাটা বলতে শুনেছি।–

কী বলতে শুনেছেন?– একটু ভেবে পার্সিকো বলে,–সমস্ত টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো একটা জায়গায় একত্রিত হয়েছে। যাইহোক আমাকে টাকা দেবার লোভ দেখিয়ে তিনি বলেন, আমি গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলের পিছনে বসেছিলাম বলে পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি দিলে তিনি এক মিলিয়ন ডলার দেবেন আমাকে। আমি জেলে থাকাকালীন আমার পরিবারের পুরো দায়িত্ব নেবেন।–

দাঁতে দাঁত চেপে পার্সিকো বলে,–আমি তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে কি ভুলই যে করেছি। তিনি এখন মৃত আর আমাকে জেলেই পচে মরতে হবে।–

–আপনি কাউকে এসব কথা বলেছেন?–

হ্যাঁ। টেলর উইনথ্রপের মৃত্যুর খবর শুনেই আমি পুলিশকে সব বলেছি। পুলিশ হেসে উড়িয়ে দেয়।–

–মিঃ ফ্যালকনকে কখনও বলেছেন?–

–হ্যাঁ। উনি বললেন টেলর উইনথ্রপের পরিবারের বাকি সদস্যরা যেন টেলরের সঙ্গে জাহান্নামে মিলিত হয়।–

ড্যানা ভাবল এবার মার্শেল ফ্যালকনের সঙ্গে প্যারিসে দেখা করতে হবে।

প্যারিসে এলে ওর জাদু অনুভব করতেই হবে। এ শহর প্রেমিক প্রেমিকাদের। এখানে এসে জেফ-এর জন্য বেদনা অনুভব করল ড্যানা।

হোটেল প্লাজা অ্যাথেনি থেকে জিন পল হাবার্টকে ফোন করল ড্যানা মেট্রো সিক্স টেলিভিশনে।

–তুমি তার সম্বন্ধে আমায় কিছু বলতে পারো?–

–তিনি সেইরকম যাঁকে তোমরা আমেরিকানরা বড় ভাল সময়ের লোক বল। ওঁর নিজের একটা ওষুধ কোম্পানি আছে। ফরাসি প্রধানমন্ত্রী তাকে ন্যাটোয় রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়েছিলেন।–

কিন্তু সেই পদ ছেড়ে দেন কেন?–

–ব্রুসেলসে এক মাতাল গাড়ি চালক তার ছেলেকে চাপা দিয়ে হত্যা করে। তার স্ত্রী স্নায়ু দুর্বলতায় পঙ্গু হয়ে যান। যাইহোক তুমি যদি তার সম্বন্ধে লিখতে চাও তবে খুব সাবধানে লিখবে। তিনি এখন প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠেছেন।–

মার্শেল ফ্যালকনের অফিসে ঢুকতেই তিনি বললেন,–আমি আপনার কাজের ভক্ত বলেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয়েছি।–

–ধন্যবাদ।– ড্যানা জিজ্ঞেস করল–আমি কি আপনার ছেলের ব্যাপারে কিছু জানতে পারি?–চমৎকার ছেলে ছিল। যে তাকে গাড়ি চাপা দিয়েছিল সে একজন পেশাদার চালক।–

ড্যানা অবাক চোখে মার্শেল ফ্যালকনের অভিনয় দেখল কারণ পার্সিকো তাকে জানিয়ে দিয়েছিল যে উইনথ্রপই তার ছেলের হত্যাকারী।

–মিঃ ফ্যালকন, আপনার NATOয় থাকার সময় টেলর উইনথ্রপ ছিলেন সেখানে।– ড্যানা দেখল ফ্যালকনের মুখে কোন ভাবান্তর হল না। –মিঃ ফ্যালকন আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাই।–

কিন্তু সে তো এখন ছুটিতে।

ড্যানা বুঝল তিনি স্ত্রীর প্রসঙ্গটাও এড়াতে চাইছেন। ধরে নেওয়া যায় এখানে তিনি কোন বিপদের আশঙ্কায় জেনেও না জানবার ভান করছেন।

ড্যানা হোটেল প্লাজা অ্যাথেনি থেকে ম্যাটকে ফোন করে।

–ড্যানা তুমি কখন ফিরছ?–

–আমাকে এখন স্রেফ একটা জায়গায় যেতে হবে, ব্রুসেলসে। টেলর উইনথ্রপের গাড়ির চালক আমাকে বলেছে, উইনথ্রপ এমন একটা গোপন রাশিয়ান প্ল্যানের কথা বলেছিল যা তিনি বাধাপ্রাপ্ত হতে দিতে চাননি। তাই মস্কোয় কিছু পরিচিতজনের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই।–কিন্তু ক্রমওয়েল চাইছেন যত শিগগির পারো তুমি স্টুডিওয় ফিরে এসো। মস্কোয় আমাদের সংবাদ প্রতিনিধি টিম ড্রিউ রয়েছে। তোমাকে সে সাহায্য করতে পারে।–

–ধন্যবাদ। তবে দুএক দিনের বেশি রাশিয়ায় থাকব না।

— এরপর ড্যানা রজার হাডসনকে ফোন করল। –আমি আপনার সাহায্য পেতে চাই।–

–বলুন।–মস্কোয় যাচ্ছি। সেখানে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত এডওয়ার্ড হার্ডির সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই। আপনি বোধহয় তাকে চেনেন। আমি এখন প্যারিসে রয়েছি।–আমি তাকে ফোন করে বলে দিচ্ছি আপনার সঙ্গে দেখা করতে।–ধন্যবাদ রজার।–

নিউ ইয়ার্স ইভ। ড্যানা দুঃখিত হয়ে ভাবল এই দিনটায় তাদের বিয়ে হবে বলে স্থির ছিল। গায়ে কোট চাপিয়ে ড্যানা রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। জিন পল হাবার্ট তার পরিবারের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য প্যারিস ছেড়ে চলে গেছে। প্যারিসের মত রাস্তায় একা চলা অনর্থক। জেফ আর র‍্যাচেলের কথা মনে পড়ল তার। তারা কি প্রেম প্রেম খেলা করেছে? জেফ  কি আজকের রাতটার কথা ভুলে গেছে!

কাঁদতে কাঁদতে কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল তা জানে না।

.

সাবেনা এয়ারলাইন্সের বিমানে মস্কোয় পৌঁছতে সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লাগল। বিমানে বসে ড্যানা অ্যান্টনিও পার্সিকোর কথাগুলোই ভাবছিল। রাশিয়ার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শেরেমেটিয়েভো ট্যুরিস্টদের ভিড়ে ঠাসা। সেই ভিড়ের মধ্যে থেকে সন্দেহভাজন একজন লোককে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার বুকটা শুকিয়ে গেল। তাহলে তারা জেনে গেছে যে আমি এখানে আসছি। দেওয়ালের ফাটলে একটা সরু তার বেরিয়ে থাকতে দেখল। টেনে দেখল তাতে একটা মাইক্রোট্রান্সমিটার সংযুক্ত করা ছিল। ড্যানা তারটা ছিঁড়ে ফেলে দুমড়ে দিল পা দিয়ে।

একটা নির্জন ল্যাবরেটরি রুমে মানচিত্রে সঙ্কেত চিহ্নিতকরণ হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। –ড্যানা,– ডাক শুনে তাকিয়ে দেখে WNT-র মস্কোর সংবাদদাতা দাঁড়িয়ে আছে। –আমি টিম ড্রিউ। ট্রাফিকের জন্য একটু দেরি হয়ে গেল। আমি দুঃখিত।– ট্রিম ড্রিউ-এর বয়স প্রায় চল্লিশ, লাল চুল, হাড়ি মুখ। –তুমি নাকি এখানে কদিনের জন্য এসেছ?–হ্যাঁ,– মস্কোয় গাড়ি চালানো অনেকটা জিভাগো-র দৃশ্যের মত। বরফে ঢাকা শহর। তাদের সামনে রেডস্কোয়ার এবং ক্রেমলিন। ক্রেমলিনের অবস্থান পাহাড়ের ওপরে, নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে মস্কোভা নদী। যেতে যেতে টিম ড্রিউ মস্কো শহরের বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছিল, ড্যানা ভাবছিল অ্যান্টনিও পার্সিকো যদি মিথ্যে বলে থাকে। রাশিয়ান প্ল্যানের ব্যাপারটাই বা কী? তাও কি মিথ্যে? কিন্তু তা হলে মস্কোয় আসার জন্য টেলর আগ্রহী হবেন কেন? স্রেফ রাষ্ট্রদূত হবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করাটা তার মত ব্যস্ত মানুষের কাছে অর্থহীন।

টিম ড্রিউ বর্ণনা করে যাচ্ছিল–আইভান, স্টালিন, লেলিন, ক্রুশ্চেভ এদের সবার হেডকোয়ার্টার ছিল মস্কোতেই।

হোটেলে ড্যানাকে পৌঁছে দিয়ে টিম ড্রিউ জিজ্ঞেস করল,–তোমাকে নৈশভোজে নিয়ে যাব যদি তোমার কাজ না থাকে।–

–ধন্যবাদ।– সেবাক্টোপোল হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে সে ঘর বুক রাখার কথা জানাল। লোকটা অনিচ্ছার সঙ্গে তার হাতে চাবি তুলে দিল। ঘরে ঢুকে আমেরিকান অ্যামব্যাসিতে ফোন করল।

–আমি ড্যানা ইভান্স। রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলতে পারি?

–কী ব্যাপারে?

–ব্যক্তিগত।–

–এক মিনিট।–

তিরিশ সেকেন্ড পরে রাষ্ট্রদূত হার্ডিকে লাইনে পাওয়া গেল। –মিস ইভান্স, মস্কোয় স্বাগত জানাই। রজার হাডসন আমাকে বলেছেন আপনাকে সাহায্য করতে।–

–আমি কি আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারি?

–নিশ্চয়ই। কাল সকাল দশটায় যদি আসেন।

–চমৎকার।–

১৯২৩ নোভিনস্কি বুলভার্ডে একটা পুরনন বিল্ডিংয়ে আমেরিকান অ্যামব্যাসি। নিরাপত্তার বেড়া ডিঙিয়ে সেখানে পৌঁছতেই ডেস্কের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি বলল,–আপনার জন্য রাষ্ট্রদূত অপেক্ষা করছেন।–

–সুপ্রভাত।– রাষ্ট্রদূত এডওয়ার্ড হার্ডি তাকে সম্ভাষণ জানালেন। ড্যানা বলল,–সুপ্রভাত। আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য ধন্যবাদ।–খোলাখুলিভাবেই বলছি মিস ইভান্স, আমার আশঙ্কা, এই দেশ পতনের মুখে। এ দেশটাকে এখন অপরাধীরা চালাচ্ছে।–এ আপনি কী বলছেন?

— ড্যুমা অর্থাৎ পার্লামেন্টের কোন সদস্য অপরাধ করলে তাকে অভিযুক্ত করা যাবে না। ফলে যারা দাগি আসামি তারা নির্বাচনে কারচুপি করে পার্লামেন্ট ভরিয়ে তুলছে। পার্লামেন্ট এখন অপরাধীদের জায়গা।–

ড্যানা বলল–অবিশ্বাস্য।–বলুন, কি করতে পারি আপনার জন্য?–টেলর উইনথ্রপের সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।– হার্ডি বললেন,–এটা গ্রিক ট্র্যাজেডির মত, তাই না।–

–হ্যাঁ।– আনা বলল। ড্যানার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকালেন হার্ডি–সারা বিশ্ব যে কাহিনী শুনেছে তার সম্বন্ধে আর কি বলার থাকতে পারে?– ড্যানা বলল,–আমি ব্যক্তিগত দিক থেকে বলতে চাই। টেলর উইনথ্রপ কিরকম লোক ছিলেন, এখানে তার কোন বন্ধুবান্ধব ছিল কিনা, কোন শত্রু ছিল কিনা।–না, প্রত্যেকেই টেলরকে ভালবাসত।–

–আপনি কিছুদিন তার সঙ্গে কাজ করে এটা কি বুঝেছিলেন যে অন্য কোন ব্যাপারে মানে সরকারি কিংবা ব্যবসায়িক কোন দিক দিয়ে তার কোন শত্রু ছিল কিনা।–আমি ঠিক জানি না। তবে আমার সেক্রেটারি লী হপকিন্স-এর সঙ্গে কথা বলতে পারেন। তিনি একসময় টেলর উইনথ্রপেরও সেক্রেটারি ছিলেন।– হার্ডি ড্যানাকে সাবধানে থাকতে বললেন। ধন্যবাদ জানিয়ে ড্যানা উঠে এল। পাঁচ মিনিট পরে লী হপকিন্স-এর সঙ্গে ড্যানাকে কথা বলতে দেখা গেল–কতদিন আপনি টেলরের সঙ্গে কাজ করেছেন?–দেড় বছর।–তিনি কি কোন শত্রু সৃষ্টি করেছিলেন?–আমি জানি না, তবে টেলর উইনথ্রপের ব্যাপারে খারাপ কিছু লিখবেন বলে যদি মনে করে থাকেন, তবে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে আপনি ভুল লোকের কাছে এসেছেন।–

ড্যানা মস্কো দূতাবাসে কর্মরত আরও পাঁচজন লোকের সঙ্গে কথা বলল। তাদের সবারই মত–টেলর উইনথ্রপ খুব ভাল লোক ছিলেন। হার্ডির সঙ্গে দেখা করতেই তিনি বললেন,–আপনার চাহিদা মত কিছু পেলেন?–না।–মনে হয় না পাবেন। তাই বলছি জোর করে আর মাটি খুঁড়তে যাবেন না। বরং চলে যান।–তাই করব।– তবে ড্যানার কোন ইচ্ছে নেই চলে যাবার।

ভি. আই. পি ন্যাশনাল ক্লাব একটা প্রাইভেট রেস্টুরেন্ট-কাম-ক্যাসিনো। সেখানে টিম। ড্যানার জন্য অপেক্ষা করছিল। তাকে স্বাগত জানাল টিম ড্রিউ। নৈশভোজ খুবই সুস্বাদু। ড্যানা খাবারের খুব প্রশংসা করল। এরপর টিম ড্রিউকে জিজ্ঞাসা করল, এখানে বেঁচে থাকার ধরনটা কী রকম?—

এটা আগ্নেয়গিরির কাছে দাঁড়িয়ে থেকে বিস্ফোরণের জন্য অপেক্ষা করা। কখন যে সেটা ঘটতে যাচ্ছে তা জানা যাবে না। যারা ক্ষমতায় আছে দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা চুরি করে নিচ্ছে। আর আমজনতা না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে। কী যে ঘটবে তা ঈশ্বরই জানেন। তবে এখানকার সংস্কৃতি অনবদ্য। বলশোই থিয়েটার, পুশকিন মিউজিয়াম, মহান হারমিটেজ, রাশিয়ান ব্যালে, মস্কো সার্কাস সব এখানে আছে। বই প্রকাশেও রাশিয়া শীর্ষে। আমেরিকান নাগরিকদের চেয়ে রাশিয়ার নাগরিকরা তিনগুণ বেশি বই পড়ে।–

ড্যানা বলল,–ভুল বই পড়ে হয়ত।–

–হতে পারে। তবে পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের মধ্যে কোনটাই এখন কার্যকারী ভূমিকা নিতে পারছে না।–

এর পর তিনি ড্যানাকে বললেন,–তুমি হতাশ হচ্ছো কেন—

না, টিম, তুমি কি টেলর উইনথ্রপকে চিনতে?

–আমি বেশ কবার তার ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম।

–আমি বলছি যে কিছু বড় প্রজেক্টের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন তা কি তুমি জানো?–

–তিনি তো আমাদের রাষ্ট্রদূত ছিলেন তাই বিভিন্ন বড় প্রজেক্টের সঙ্গে তার যুক্ত থাকাই স্বাভাবিক।–

আমি বলতে চাইছি একটু জটিল কথা। মানে এখানে এমন কেউ আছে তার সঙ্গে যার যোগাযোগ ছিল?–

–আমার মনে হয় তার কিছু রাশিয়ান কাউন্টার পার্ট ছিল। তুমি তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারো।–

ড্যানা সম্মতি জানাল।

রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এসে টিম ড্রিউ বলল,–এখানে অপরাধের ঘটনা যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে তোমার নিরাপত্তার খাতিরে একটা আগ্নেয়াস্ত্র রাখা দরকার। ড্যানার আপত্তি সত্ত্বেও একটা বন্দুক কিনে দিল টিম।

ড্যানাকে নিয়ে এরপর টিম বিলাসবহুল নাইটক্লাবে গেল। সেখানকার পরিবেশ দেখে ড্যানা বলল,–এখানে বোধহয় আর্থিক সমস্যা নেই।–না, আর্থিক সমস্যা এখানেও আছে। তবে সরকার তা জানতে দেয় না। লোকচক্ষুর আড়াল করে রেখেছে। তাই ভিখারিদের শহরের বাইরে নির্জন জায়গায় নির্বাসন দেওয়া হয়েছে।–

–এটা তো একটা প্রতারণা।

–হ্যাঁ, কিন্তু কমিউনিস্ট দেশে সবই সম্ভব।

— রাত দুটোয় ড্যানা হোটেলে ফিরল।