• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Book । বাংলা লাইব্রেরি

Read Bengali Books Online @ FREE

  • লেখক
  • অনুবাদ
  • সেবা
  • PDF
  • Bookmarks

লেখক

অনুবাদ

সেবা

কৌতুক

লিরিক

ডিকশনারি

PDF

Bookmarks

০১-৫. গল্প শুরুর আগে

লাইব্রেরি » অনুবাদ সাহিত্য » সিডনি সেলডন রচনাসমগ্র » ইফ টুমরো কামস » ০১-৫. গল্প শুরুর আগে

ইফ টুমরো কামস
আগামীকালের অন্ধকারে

গল্প শুরুর আগে

ট্রেসি এক সুন্দরী রমণী।

অনেক বছর কেটে গেছে তার রুদ্ধ কারার অন্তরালে। যৌন-বুভুক্ষু সমকামী মেয়ে কয়েদিদের অত্যাচার নষ্ট করেছে তার গর্ভের জ্বণ।

জননী হবার স্বপ্ন সফল হয়নি। কিন্তু কী তার অপরাধ? কুখ্যাত মাফিয়া চক্রের শিকার হতে হয়েছিল তাকে। ভালোবেসেছিল সে অভিজাত পরিবারের প্রেমিক চার্লসকে। বিপদের সময়ে চার্লস মুখ ফিরিয়ে থেকেছে। অস্বীকার করেছে প্রেমের ফসল অবৈধ সন্তানের পিতৃত্ব। শেষ পর্যন্ত ট্রেসি একদিন শপথ নিল–একবার মুক্তি পেলে পৃথিবীর সকলের বিরুদ্ধে শুরু করবে তার শেষ না হওয়া লড়াই। যাদের জন্য তার যৌবন প্রহর এভাবে কেটে গেল অন্ধকার বিবরে, তাদের কাউকে সে ছাড়বে না।

একে একে সকলকে পাঠাবে মৃত্যুর সেই নরকে যেখান থেকে কেউ আর কোনোদিন ফিরে আসতে পারে না।

কিন্তু কী ভাবে?

সমকালের অন্যতম জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকের দুরন্ত লেখনীতে সমৃদ্ধ এক অসহায়া রমণীর প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার–হাড় হিম করা কাহিনী।

.

১.

নিউ অর্লিয়েন্স। বৃহস্পতিবার, ২০শে ফেব্রুয়ারি। রাত এগারোটা।

আমাদের গল্প এবার শুরু হবে, পটভূমি প্রস্তুত, আমরা দেখতে পাচ্ছি শ্রীমতী ডরিস হুইটনিকে। এই একটু আগে উনি একে একে ওনার সব পোশাক খুলে ফেলেছেন। টকটকে লাল রঙের একটা রাত পোশাকে থরথর করে কাঁপছে ওনার স্পর্ধিত যৌবন।

চোখ বুলিয়ে দিলেন চারপাশে। সর্বত্র পরিশীলিত হাতের ছাপ। গত তিরিশটা বছর এই চার দেওয়ালের মধ্যেই কেটে গেছে শ্রীমতী ডরিস হুইটনির। তিরিশ বছর? তার মানে? তিরিশটি বসন্ত।

খাটের পাশে রাখা ছোট্ট টেবিলের ড্রয়ারটি খুললেন। সাবধানে বের করলেন একটি রিভলবার। সমস্ত অঙ্গে তার মৃত্যুর হিম-শীতলতা।

রিভলবারটা রাখলেন টেলিফোনের পাশে। ফিলাডেলফিয়ার টেলিফোন নম্বরটা দেখে নিলেন। ডায়াল করলেন। অনেক দূর থেকে কার কণ্ঠস্বর শোনা গেল। ইথার তরঙ্গে ভাসতে ভাসতে কে কথা বলছে–হ্যালো।

–ট্রেসি, কিছুক্ষণের নীরবতা, তোর গলার স্বরটা শুনতে ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছিল।

–খুব চমকে উঠেছিলাম। জানো মা, এই মুহূর্তে তোমার কথাই ভাবছিলাম।

–আমি কি তোকে ঘুম থেকে জাগালাম?

–না, পড়ছিলাম। এবার শুতে যাব। চার্লস আর আমি ডিনার খেতে বাইরে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ বরফবৃষ্টি। ওখানকার আবহাওয়া কেমন?

ডরিস হুইটনি মনে মনে বললেন, হায় ভগবান, আমরা এখন এসব অপ্রাসঙ্গিক গল্প করছি? ওকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবর বলতে হবে। কিন্তু বলতে পারছি কই?

–মা, ফোন ছাড়া নিতো?

জানলা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে চকিতে তাকালেন ডরিস। বৃষ্টি পড়ছে। তারপর ভাবলেন হিচককের লেখা কাহিনীর মতো অতি নাটকীয় একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। রহস্য রোমান্সের সব কটি উপাদান থরে থরে সাজানো আছে।

–কীসের শব্দ হল মা? টেলিফোনের ওপাশে কার উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর।

–বাজ পড়ল।

ডরিস আর কোনো কথা বলতে পারছেন না। কেবলই মনে হচ্ছে তারও মনের আকাশেই এখন এমনই বিদ্যুৎ চমকের ঘনঘটা।

–বাজ পড়ল, ইচ্ছে করে কথাটাকে আবার বললেন উনি, জানতে চাইলেন, ফিলাডেলফিয়ার কথা বল।

–সত্যি করে বলব মা? নিজেকে মনে হচ্ছে রূপকথার এক রানি। কাল রাতে চার্লসের মা, বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।

কিছুক্ষণের নীরবতা। তারপর হঠাৎ কলকলিয়ে ওঠে মেয়ের কণ্ঠস্বর।

–বুঝতেই পারছো, কাল কী আলোচনা হবে আমাদের, তুমিতো জানো না মা, কী বিরাট প্রতিষ্ঠান ওদের। সেই তুলনায় আমি তো অতি নগণ্য।

মেয়ের কথা শেষ না হতে মা বললেন–ও নিয়ে চিন্তা করিস না, ওরা সকলে তোকে, ভালোবাসে।

–চার্লস তো বলেছে, এ নিয়ে বেশী ভাবনা চিন্তা না করতে। ও আমাকে জীবন দিয়ে ভালোবাসে। আমার কী ইচ্ছে করছে জানো? ইচ্ছে করছে এখুনি তোমার সাথে চার্লসের আলাপ করিয়ে দিই। প্রথম আলাপেই তুমি বুঝতে পারবে, চার্লস অন্য পাঁচটা ছেলের থেকে একেবারে আলাদা।

–তোর কথা শুনে আমি তাই বিশ্বাস করছি।

ডরিস ভাবলেন, চার্লসের সঙ্গে এ জীবনে আর তার দেখা হবে না। নাতি-নাতনি নিয়ে ভর-ভরন্ত সংসারের কত্রী হওয়ার স্বপ্ন চিরদিনের মতো নিভে গেছে। কিন্তু নিজের কথা ভেবে লাভ কী?

–কেমন আছিস বল?

–কেমন আছি, সে কি আর বলতে হবে? তোমার খবর কী?

–আর থাকা, ডাক্তার রাসের শব্দগুলো মনে পড়ল–চমৎকার স্বাস্থ্য আপনার মিসেস হুইটনি। মনে হচ্ছে, হাসতে হাসতে একশো বছর পার করে দেবেন।

–ভালো আছি ট্রেসি। এই তো তোর সঙ্গে কথা বলছি।

–পুরুষ বন্ধু জুটল নাকি? নাকি সন্ধ্যেবেলা একা একাই টেলিভিশনে শোপ অপেরা দেখে কাটাচ্ছো?

ট্রেসির গলাতে এবার একটু ঠাট্টার সুর। মার সঙ্গে এ নিয়ে সে মাঝে মধ্যেই ইয়ারকি করে।

পাঁচ বছর আগে ট্রেসির বাবা মারা গেছেন। তারপর থেকে নিজেকে কেমন যেন গুটিয়ে নিয়েছেন ডরিস হুইটনি।

–না, সে গুড়ে বালি। পুরুষ বন্ধু জোটেনি। এসব কথা বাদ দে। চাকরি করতে কেমন লাগছে?

–খুবই ভালো লাগছে মা, বিয়ের পরেও চাকরি করব, চার্লস মত দিয়েছে।

–বাঃ, খুব ভলো লাগল শুনে।

–দেখতেই তো পারছো চার্লস কত বোঝদার। বাইরে আবার বাজের শব্দ। গুডবাই মাই ডার্লিং, বলে ডরিস হুইটনি রিসিভারটা রাখার চেষ্টা করলেন।

ওপাশে তখনো ট্রেসির গলা–বিয়ের সময় দেখা হবে মা। আমি আর চার্লস বিয়ের তারিখ ঠিক করে তোমাকে জানাব।

–ঠিক আছে, এখন ছাড়ছি। ডরিস হুইটনি রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন।

তারপর? রিভলবারের নলটা রগে ঠেকালেন।

চোখ বন্ধ করলেন। কোনো কিছু ভাবার চেষ্টা করলেন না। মুহূর্তের মধ্যে গরম সীসার বুলেট এসে আহত এবং রক্তাক্ত করল তাকে।

.

২.

ফিলাডেলফিয়া, শুক্রবার, ২১শে ফেব্রুয়ারি, সকাল আটটা।

ট্রেসি হুইটনি তার ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে ফুটপাথে এসে দাঁড়িয়েছে। অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। সে এখন অফিস যাচ্ছে। চেস্টনাট স্ট্রিট ধরে পূর্বদিকে। ওখানকার একটি ব্যাঙ্কে সে কাজ করে। গাঢ় হলুদ রঙের বর্ষাতি গায়ে লাগিয়েছে। বয়স কত হবে? চব্বিশ পার হয়ে সবেমাত্র পঁচিশে পড়েছে। অর্থাৎ তার যৌবন এখন উথলে উঠেছে।

মুখে বুদ্ধির ছাপ আছে। ঠোঁটে আছে বাসনার ইশারা। চোখের তারা অদ্ভুত শেওলা সবুজ, যখন-তখন চোখের রং পালটাতে পারে সে, অর্থাৎ সে এক জীবন্ত বহুরূপী।

মা বলতেন–শোন ট্রেসি, তোকে আমি ঠিক মতো চিনতে পারি না। তোর মধ্যে রামধনুর সাতটা রঙের ছটা আছে তুই তা জানিস কি?

আজ ট্রেসি দারুণ আনন্দে আছে। একটু জোরে গুনগুনিয়ে গান গাইছে। এতটা খুশী কেন? জীবনসাথী পেয়েছে, এটা কী কম আনন্দের কথা?

ব্যাঙ্কের কাছে পৌঁছলো। ঘড়িতে দেখল আটটা বেজে কুড়ি মিনিট। আরো দশ মিনিট বাদে ফিলাডেলফিয়ার ট্রাস্ট অ্যান্ড ফাইডিলিটি ব্যাঙ্কের দরজা খুলবে।

ব্যাঙ্কের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ক্লারেন্স ডেসমন্ড বাইরের অ্যালার্মের সুইচটা অফ করছিলেন। এবার ভেতরে ঢুকলেন।

প্রত্যেকটা ঘর, বাথরুম খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন। এটা তার বরাবরের অভ্যেস। কেউ লুকিয়ে আছে কিনা দেখলেন। তিনি নিশ্চিন্ত হবার পর ব্যঙ্কের কর্মচারীরা ভেতরে প্রবেশের ছাড়পত্র পাবে।

কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে আটটায় ব্যাঙ্কের হলঘরে ট্রেসি ঢুকে পড়ল। সকাল থেকেই অল্পবিস্তর বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এ বৃষ্টি যে কত আনন্দের একমাত্র ট্রেসি তার খবর জানে। ও কেবল ট্রান্সফার ডিপার্টমেন্টের ইনচার্জ ছিল। এখন কমপিউটারের সাহায্যে খুব তাড়াতাড়ি কাজগুলো করতে পারছে। এই কাজটা ওর খুব মনের মতো।

ব্যাঙ্কের একটি আলোচনা চক্রে চার্লস স্ট্যানহোপের সঙ্গে ট্রেসির আলাপ হয়েছিল। ওই সেমিনারের বিষয় বস্তু ছিল অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। চার্লস অতিথি বক্তা হিসাবে এসেছিল। চার্লসের ঠাকুরদা একটা অর্থ বিনিয়োগ করার ব্যবসা ফেঁদেছিলেন। ওই কোম্পানীর সাথে ট্রেসির ব্যাঙ্কের লেনদেন হত। চার্লসের বক্তৃতার পর ট্রেসি সোজাসুজি কয়েকটি বিষয়ের ওপর বিতর্ক করতে চাইল। চার্লস প্রথমে ব্যাপারটা হালকাভাবে নিয়েছিল। এমন সুন্দরী মেয়ের মুখ থেকে ভালো কিছু শোনার আশা করেনি সে। কিন্তু ট্রেসির ধারালো যুক্তিগুলো তার মনকে একেবারে পালটে দেয়। কম বয়সী সুন্দরী যুবতী হলে কী হবে, ট্রেসির মাথাটা যে খুব পরিষ্কার, চার্লস বুঝতে পেরেছিল। ডিনার খাওয়া পর্যন্ত আলোচনা গড়িয়ে গেল।

তৃতীয় চার্লস স্ট্যানহোপ পাত্র হিসাবে ফিলাডেলফিয়ার সেরা শিকার। ট্রেসি ওকে দেখে প্রথম দিকে মুগ্ধ হয়েছিল। বয়স পঁয়ত্রিশ। উচ্চতা পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি। ইতিমধ্যে চুল একটু পাতলা হতে শুরু করেছে। কথাবার্তায় পন্ডিতি ভাব আছে। সবসময় নতুন কিছু ভাবার চেষ্টা করে। ফিলাডেলফিয়ার প্রাচীনতম ধনী পরিবারের মধ্যে স্ট্যানহোপরা অন্যতম।

চার্লস বলল–আমার বাবার স্থির বিশ্বাস, হাসপাতাল থেকে ওকে অন্য কোনো ছেলে গছিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

–সে কী? একদিন অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় দুজনের মধ্যে এই কথোপকথন হয়েছিল।

চার্লস বলেছিল–বংশের ধারার সঙ্গে আমার কোনো মিল নেই। আমি টাকা পয়সা কামানোটাকে জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য বলে মনে করি না। এই কথাটা আমার বাবাকে বলে দিও না কিন্তু!

চার্লসের এই সরলতা ট্রেসিকে মুগ্ধ করেছিল। এমন একটা পুরুষের সঙ্গে বিয়ে হলে কেমন হয়, প্রথম দর্শনেই হয়তো ট্রেসি মনে মনে ভেবেছিল তাকে?

ট্রেসির বাবা সারা জীবন ধরে পরিশ্রম করেছেন। তিনিও একটা ছোটো খাটো ব্যবসা গড়ে তুলেছেন। কিন্তু স্ট্যানহোপদের প্রভাব প্রতিপত্তির তুলনায় তারা কিছুই নয়। স্ট্যানহোপ আর হুইটনি পরিবার কোনো দিন মিশবে না। শেষ অব্দি ট্রেসি ভাবল, না, একদিনের আলাপে এতটা স্বপ্ন দেখা বোধহয় উচিত নয়। কোনো একজন পুরুষ তো আমাকে ডিনারে নেমতন্ন করতেই পারে, তাতে আমি অন্য কিছু খুঁজব কেন।

চার্লসের কথা কানে এল–আশা করি কাল আমার সঙ্গে ডিনার খাবার মত সময় থাকবে তোমার হাতে?

ফিলাডেলফিয়াতে যে দেখার মতো সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে, ট্রেসি এতদিন তার খবর রাখেনি। প্রতি শনিবার চার্লস আর ট্রেসিকে একসঙ্গে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল। কখনন তারা অর্কেস্ট্রা শুনছে, কখনো বা ঘুরে ঘুরে বাজার করছে, কখনো ওয়েসাইড পাবে ঢুকে পড়ছে। কখনো যাচ্ছে কাফেওয়লে। মিউজিয়ামের নিপ্রাণ বস্তুগুলো যেন কিছু বলতে চাইছে–চার্লসের হাতে হাত রেখে ট্রেসির তাই মনে হয়েছিল।

তাদের মধ্যে তখনো ছেলেমানুষি ঠাট্টা ইয়ারকি বজায় ছিল। একজন অন্যজনের খুঁত ধরতে ছিল সচেষ্ট। একবার ডিনারে আসতে ট্রেসির পনেরো মিনিট দেরী হয়ে গিয়েছিল। চার্লস ভীষণ রেগে গেল। বকাবকির চোটে সন্ধ্যেটা হয়ে গেল মাটি।

দেহ সম্পর্কে ট্রেসির অভিজ্ঞতা ছিল খুবই সামান্য। কিন্তু কেবলই তার মনে হয়েছে। চার্লস বোধহয় এবার আরো নিবিড়ভাবে তাকে পেতে চাইছে। একবার ট্রেসি বেশী সাহস করে সামান্য অভিনবত্ব আনতে গিয়েছিল তার আচরণে, চার্লস খুব অবাক হয়ে যায় তার এই অভাবিত ব্যবহারে।

পেটে বাচ্চা এসে যাওয়াটা আকস্মিক ব্যাপার। ট্রেসির মনে সন্দেহ ছিল। চার্লস বিয়ের কথা তুলছে না, আবার বাচ্চা এসে যাওয়ার জন্য চার্লসকে বিয়ে করতে হচ্ছে–এটা ভাবতে গিয়ে ট্রেসির মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। একবার ভেবেছিল ওই ভূণটাকে নষ্ট করে দেবে।

একদিন সন্ধ্যেবেলা ট্রেসি মনস্থির করল ডিনার খাওয়ার পর কথাটা চার্লসকে বলবে। উত্তেজনায় মাংসটা পুড়িয়ে ফেলল। আধপোড়া মাংস চার্লসের সামনে রেখে বলল–একটা কথা তোমাকে না বলে পারছি না চার্লস। আমি কিন্তু মা হতে চলেছি।

ট্রেসি ভেবেছিল, এই কথা শুনে চার্লস আনন্দে হৈ-হৈ করে উঠবে। ট্রেসিকে শূন্যে তুলে দুপাক ঘোরাবে। কিন্তু চার্লসের মুখটা থমথমে গম্ভীর। অনেকক্ষণ চুপ করেছিল সে, কিছুক্ষণ বাদে কেটে কেটে উম্মরণ করল–ঠিক আছে, আমরা বিয়ে করব।

বুক থেকে পাষাণ ভার নেমে গেল ট্রেসির। চার্লসের নীরবতা তাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। সে ভেবেছিল, চার্লস বোধহয় ছেলেটির পিতৃত্ব অস্বীকার করবে। যেমন অন্য বখাটে ছেলেরা করে থাকে।

ট্রেসি বলল–আমি চাই না যে, তুমি এটা মনে করো বাধ্য হয়ে আমাকে বিয়ে করছে।

ট্রেসি তো নীচের তলাতে থাকে। চার্লসকে কীভাবে মনের ভাব বুঝিয়ে বলবে, সে বুঝতে পারে না।

চার্লস বলল, আমি তোমাকে এখনই বিয়ে করতে চাই ট্রেসি। তুমি আমার একটা ছোট্ট সুন্দর সোনা বউ হবে।

তারপর বলল–অবশ্য মা-বাবা একটু অবাক হবেন।

একথা বলে ট্রেসিকে গম্ভীর চুম্বন দিল চার্লস।

–কেন আশ্চর্য হবেন? ট্রেসি জানতে চাইল।

–আমার এই ব্যাপারটা তুমি ঠিক মতো বুঝতে পারছে না, ট্রেসি। স্ট্যানহোপরা সব সময়ে নীল রক্তের মেয়েকে পছন্দ করে। এটা কিন্তু আমার মুখের কথা নয়, আমার মা-বাবা এই কথা বিশ্বাস করেন।

–তাহলে কি ওঁরা তোমার জন্য পাত্রী বেছে রেখেছেন?

চার্স ট্রেসিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল–তাতে কিছুই যাবে-আসবে না সোনা। আমি যাকে নির্বাচন করব, সে-ই হবে আমার ছোট্ট বউ। আগামী শুক্রবার তুমি আমার মা বাবার সঙ্গে ডিনার খাবে, কেমন? রাজী তো?  

নটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি, ফেলে আসা দিনগুলির স্মৃতি এখন ট্রেসির মনের আকাশে শরতের মেঘ হয়ে উড়ে চলেছে। ঠোঁটের কোণে একটা ছোট্ট হাসি এল। একজন কাস্টমারকে আসতে দেখে হাসিটাকে পুরে ফেলল সে মুখের ভেতর। ভাবল আর পাঁচ মিনিট পর থেকে ভিড় শুরু হবে।

নিজের ঘর থেকে ট্রেসি বাইরের সবকিছু দেখতে পাচ্ছে। কাস্টমারদের লাইন পড়ে গেছে। এ পাশে হল ঘরে ছটা টেবিলে স্লিপগুলো গুছিয়ে রাখা হয়েছে।

ব্যাঙ্কের নিয়মিত কাস্টমারদের জমা দেওয়া স্লিপগুলোর তলায় এক-এক করে চুম্বক লাগান। সেখানে কোড নাম্বার দেওয়া কমপিউটার স্বয়ংক্রিয়বারে প্রত্যেকটি অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করে নেয়। খুচরো খদ্দেরদের জন্যে আছে সাধারণ স্লিপ। এখানে সবকিছুই কঠিন। কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে দিয়ে পরিচালিত হয়। ট্রেসিকে খুব একটা পরিশ্রম করতে হয় না। তবুও সব দিকে সতর্ক নজর তার।

নটা থেকে ব্যাঙ্কের কাজকর্ম শুরু হয়ে গেল। তারপর কয়েকটি ঘন্টা কীভাবে কেটে গেল ট্রেসি জানে না।

লাঞ্চের সময় চুল বাঁধতে যাবে, শহরের সবথেকে বড়ো হেয়ার ড্রেসারকে আগে থেকেই বলে রেখেছে। খরচ হয়তো একটু বেশীই হবে, তা হোক না। আজই সে প্রথম হবু শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে ডিনার খাবে, চেহারাতে একটা চেকনাই তো আনতেই হবে।

দুপুর একটা বাজল, বর্ষাতি নিয়ে বেরোতে যাবে। ট্রেসির ডাক পড়ল ক্লারেন্স ডেসমন্ডের  খাস কামরাতে। আবহাওয়া নিয়ে দু-চারটে বাজে কথা বলার পর ডেসমন্ড বললেন–চার্লস স্ট্যানহোপের সঙ্গে তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে–আমি কি ঠিক শুনেছি?

ট্রেসি আশ্চর্য হয়ে বলল–এ খবর আপনি কোথা থেকে পেলেন স্যার? আমরা তো কাউকে জানায়নি।

ডেসমন্ড হাসলেন-স্ট্যানহোপদের সবকিছুই একটা বিশেষ খবর। তবে তোমার জন্যে আমি খুশী হয়েছি। আশা করি হানিমুনের পর তুমি আবার ব্যাঙ্কের কাজে ফিরে আসবে।

–এ ব্যাপারে চার্লসের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।

ডেসমন্ড খুব খুশী, স্ট্যানহোপ অ্যান্ড সনস্ বিশাল কোম্পানী। তাদের একটা বড়ো ধরনের অ্যাকাউন্ট যদি এই ব্যাঙ্কে আসে, তাহলে খুবই লাভ হবে এটা ডেসমন্ড জানেন।

–আর একটা কথা, তুমি যদি বিয়ের পর ফিরে আসো, তাহলে কথা দিচ্ছি তোমার পদোন্নতি হবে এবং তুমি আরো বেশী মাইনে পাবে।

ট্রেসি নিজের আনন্দ চেপে রাখতে না পেরে বলল–অশেষ ধন্যবাদ, স্যার।

অহঙ্কারে সে বোধহয় মাটিতে পা দিতে পারছে না। সে ভাবল, স্বয়ং ঈশ্বর বোধহয়। তাকে স্বর্গের রানি করার ষড়যন্ত্র করেছে।

ইটন হার্ডস স্কোয়ারে বিরাট বাড়ি স্ট্যানহোপদের। এত বড়ো শহরে স্ট্যানহোপদের মতো এত বড়ো সুন্দর বাড়ি আর একটি নেই। কতদিন এই বাড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে ট্রেসি পথ হেঁটে গেছে। সে ভাবতেও পারেনি, কোনদিন ওই সিংহদরজা পার হয়ে ভেতরে প্রবেশের ছাড়পত্র সে পাবে।

একটু নার্ভাস লাগছে। আজ আসবার আগে চার-চারবার পোশাক পাল্টেছে। শেষে |||||||||| ধূসর রঙের স্কার্ট আর সাদা সিল্কের ব্লাউজ পরেছে। গলায় সোনার একটা সরু চেন। গত

বছর বড়োদিনে মা পাঠিয়েছিলেন।

উর্দি পরা খানসামা দরজা খুলে দিয়ে বাও করে বলল–গুড ইভিনিং মিস হুইটনি।

খানসামা আমার নাম জানে দেখছি, একটু চঞ্চল হয়ে উঠল ট্রেসির মন।

বিরাট হল ঘর পার হয়ে সে লাইব্রেরি ঘরে এল। চার্লসের মা-বাবা বসে আছেন।

সিনিয়ার চার্লস স্ট্যানহোপ দারুণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এক পুরুষ। ষাটের ঘর পার হয়েছেন কয়েক বছর আগে। সাফল্যের চিহ্ন আঁকা আছে শরীরের সর্বত্র। হঠাৎ দেখলে মনে হয় চার্লস বুঝি বসে আছে। দুজনের চেহারায় অদ্ভুত মিল।

চার্লসের মায়ের চেহারা দেখার মতো। একটু বেঁটে আর মোটাসোটা। ট্রেসির সন্তানের ঠাকুরমা হিসাবে দারুণ মানাবে ওঁকে।

মিসেস স্ট্যানহোপ হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন–খুব ভালো লাগছে তুমি এসেছ বলে। আমরা তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ একা কথা বলব। তোমার আপত্তি নেই তো?

ভাবী শাশুড়িমায়ের মুখে এই কথা শুনে ট্রেসির বুকটা ধড়ফড় করছে। তবু সে আমতা আমতা করে বলল–আপত্তি কেন থাকবে? আমি তো কথা বলতেই এসেছি।

চার্লসের বাবা এই প্রথম কথা বললেন–বসো ট্রেসি।

–হ্যাঁ স্যার।

মুখোমুখি বসল ট্রেসি। ভাবল, এবার বোধহয় তার বিচার শুরু হবে। নিজের মায়ের কথাগুলো মনে পড়ে গেল–ভগবান এমন কিছু তোমাকে কখনোই দেবেন না, যার যোগ্য তুমি নও। তাই ধীর স্থির চিত্তে সবকিছুকে গ্রহণ করবে।

–তাহলে, মিস্টার স্ট্যানহোপের গলাতে কোনো খাদ ছিল না, তুমি আর চার্লস পরস্পরকে ভালোবাস। তাই তো? তোমরা একে অন্যকে বিয়ে করতে চাও। আমি ঠিক বলছি তো?

–হ্যাঁ।

–তোমাদের পরিচয় তো দীর্ঘদিনের নয়। মিসেস স্ট্যানহোপ বললেন।

–তা ঠিক, তবে ভালোবাসার মতো দীর্ঘ সময় আমরা পেয়েছি।

–ভালোবাসা? মিস্টার স্ট্যানহোপ বিড়বিড় করতে থাকলেন।

–তোমাকে সোজাসুজি বলছি, এই বিয়ের খবরটা আমাদের কাছে একটা আঘাতের মতো এসেছে। আশা করি, চার্লস তোমাকে নিশ্চয়ই শার্লটের কথা বলেছে?

একটু থেমে ট্রেসির মুখের ভাবান্তরটা দেখলেন মিসেস স্ট্যানহোপ। আবার গড়গড়িয়ে বলতে শুধু করলেন, চার্লস আর শার্ট, দুজন দুজনকে ছোটোবেলা থেকে চেনে। সকলেই জানে, ওরা একদিন বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হবে।

শার্লটের কথা আর নতুন করে শুনতে চাইছে না ট্রেসি। শার্লট সম্পর্কে সব খবর সে জানে। কাছেই থাকে শার্লটরা। সে ধনী পরিবারে মেয়ে, সামাজিক মর্যাদা চার্লসদের মতোই।

–তোমার বাড়ির কথা বলো, মিস্টার স্ট্যানহোপ বললেন। এবার ট্রেসির মাথা ঘুরতে শুরু করেছে। কী করবে সে বুঝতে পারছে না। মনে হল, এক গ্লাস জল খেলে বোধহয় ভালো হত।

–কোথায় জন্মেছো তুমি?

–লুইসিয়ানাতে। বাবা একজন মেকানিক ছিলেন। শেষেরটা হয়তো না বললেও চলত। বাবাকে ভীষণ শ্রদ্ধা করে ট্রেসি।

–মেকানিক?

–হ্যাঁ, নিজের কারখানা খুলেছিলেন নিউ অর্লিয়েন্সে। পরে ব্যবসাটা খুবই বড়ো হয়েছিল। পাঁচ বছর আগে বাবা মারা যান। মা ওই ব্যবসাটা দেখাশোনা করছেন।

–কী তৈরী হয় ওই কারখানাতে?

–এগজস্ট পাইপ আর গাড়ির অন্যান্য পার্টস। ট্রেসি বেশ বুঝতে পারল, তার মুখ থেকে ছুটে আসা এই শব্দগুলো স্ট্যানহোপ দম্পতিকে মোটেই খুশী করতে পারেনি। তারা চোখাচোখি করলেন।

ট্রেসির উত্তেজনা তখন বাড়ছে। আর কতক্ষণ ধরে এই জেরা চলবে কে জানে? চার্লস কোথায়?

এবার সেই আসল প্রশ্ন–মিস্টার স্ট্যানহোপ নিস্পৃহ গলায় জানতে চাইলেন–চার্লস বলছিল, তুমি নাকি মা হতে চলেছো? সত্যি?

ট্রেসির তখন মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। কেবলই মনে হচ্ছিল পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেলে বোধহয় ভালো হত।

–বুঝি না আজকের দিনেও কেন যে…

কথা শেষ করলেন না মিসেস স্ট্যানহোপ।

চার্লস এসে গেল–এই যে কেমন কাটছে তোমাদের?

চার্লসকে দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল ট্রেসি। তাড়াতাড়ি চার্লসের কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল। আঃ, চার্লস কত ভালো, ভাগ্যিস মা-বাবার মতো হয়নি।

ডিনারটি ছিল খুবই ভালো কিন্তু ট্রেসির মুখে কোনো কিছুই ভালো লাগছিল না। নানা বিষয় নিয়ে খুচরো আলোচনা হচ্ছিল। পৃথিবীর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, ব্যাঙ্কিং ব্যবসার উন্নতি ইত্যাদি।

টেবিলের তলায় হাত বাড়িয়ে দিল চার্লস। ট্রেসির হাত ধরল। ওই হাতের স্পর্শে মনের সব দুর্বলতা কেটে গেল বেচারী ট্রেসির।

–আমি আর ট্রেসি ভাবছি, বিয়ের আয়োজনটা সংক্ষেপে সেরে নেব। পরে না হয় বড়ো করে–

চার্লসের কথা থামিয়ে দিয়ে মিসেস স্ট্যানহোপ বললেন–বাজে বকো না, আমাদের পরিবারে এসব কাজ কি লুকিয়ে চুরিয়ে সারা যায়? এক গাদা আত্মীয় বন্ধু আসবে, পাড়া প্রতিবেশীদের বলতে হবে। আমার মতে এখন থেকে নেমতন্নের চিঠি বিলি করা উচিত।

–হনিমুন করতে যাবে কোথায় ঠিক করেছো? সিনিয়ার স্ট্যানহোপ জানতে চাইলেন।

–ওটা আমাদের একান্ত ব্যক্তিগত খবর, বাবা, তোমায় বলব কেন? মুচকি হেসে চার্লস বলল। ডিনার শেষ হতে হতে মাঝরাত গড়িয়ে গিয়েছিল। চার্লস গাড়িতে ট্রেসিকে ফেয়ারমন্ড পার্কে পৌঁছে দিল। বলল, সন্ধ্যেটা আশা করি তোমার খারাপ কাটেনি ট্রেসি। মা-বাবা মাঝে মধ্যে একটু মেজাজী হয়ে থাকেন। কিছু মনে করো না, কেমন! তুমি এসে সব কিছু মানিয়ে নিতে পারবে তো?

–না-না, দারুণ ভালো লোক ওঁরা। মনের দুঃখ মনে চেপে ট্রেসি কোনোরকমে বলল। ট্রেসি মনে মনে চাইছিল, চার্লস একবার তার ঘরে আসুক। সন্ধ্যাটা দারুণ উত্তেজনার মধ্যে কেটে গেছে। তার তৃষিত মন যেন চার্লসের আদর চাইছে। কিন্তু আলতোভাবে আদর করে চার্লস চলে গেল। কাল সকাল হতে না হতেই তাকে ব্যবসার কাজে ব্যস্ত হতে হবে।

নিজের ঘরে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল ট্রেসি। ভীষণ ক্লান্ত আর অবসন্ন সে। ভাবল সে, এখনই ঘুমের অতলে তলিয়ে যাবে কিনা? হঠাৎ ফায়ার বিগ্রেডের গাড়ির ঘন্টার তীব্র শব্দে তার সমস্ত আচ্ছন্নভাব কেটে গেল। শব্দটা হয়েই চলেছে। শেষপর্যন্ত ট্রেসি বুঝতে পারল, এটা টেলিফোনের আওয়াজ। বিছানার পাশেই ঘড়ি, রাত কত? দুটো বেজে গেছে কি? ভীষণ ভয় পেয়ে গেল সে। চার্লসের কিছু হয়নি তো? রিসিভারটা তুলে নিল, কঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বরে জানতে চাইল–হ্যালো?

দূর থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে–আপনি কি ট্রেসি হুইটনি?

উত্তর দেবে কি দেবে না ভাবছিল ট্রেসি, শেস পর্যন্ত বলল–আপনি কে বলছেন?

অনেক সময় মাঝরাতে চ্যাংরা ছেলেরা ইয়ারকি করে। ট্রেসি ভাবল হয়তো তেমন কোন ইভ-টিজার।

ওপাশ থেকে কে যেন ভারী গলায় বলে উঠলেন–নিউ অর্লিয়েন্স পুলিশ ডিপার্টমেন্টের লেফটেনান্ট মিলার বলছি, আপনি কি ট্রেসি হুইটনি কথা বলছেন?

–হ্যাঁ, বুকের মধ্যে ঘন ঘন হাতুড়ি পেটার শব্দ।

–আমাকে মাপ করবেন, আপনার জন্য একটা দুঃখের খবর আছে।

–দুঃখের খবর? ট্রেসি টেলিফোনটাকে শক্ত করে ধরল। হারানো সাহস ফিরে পাবার চেষ্টা করল।

–খবরটা আপনার মায়ের সম্বন্ধে।

–মার কি কোনো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে?

–মিস হুইটনি, তিনি মারা গেছেন।

–না, ট্রেসির আর্তনাদ রাতের বাতাসকে ভারী করল। ট্রেসি ভাবল, নানা, বদমাইসি করে কেউ বোধহয় তাকে ভয় দেখাতে চাইছে। মা তো ঠিকই আছে, এই তো সেদিন বলল, আমি তোকে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি ট্রেসি।

–খবরটা এভাবে দিতে হচ্ছে বলে আশা করি আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।

তার মানে এটা সত্যি খবর? কোনো দুঃস্বপ্ন নয়। ট্রেসির মাথা ঘুছে। লেফটেনান্ট মিলারের গলা তখনো শোনা যাচ্ছে টেলিফোনের মধ্যে–হ্যালো? মিস হুইটনি? হ্যালো? হ্যালো–হ্যালো!

ট্রেসি রিসিভারটা রেখে দিয়েছে। ভাবছিল, কী করবে এখন? মায়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে তার। মা নেই, এটাকে ভাবতেই পারছে না। ছোটোবেলা থেকে যখন যা হয়েছে, মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে সব কথা বলেছে ট্রেসি। ট্রেসির বাবা মারা যাবার পর অনেকে চেয়েছিল, ব্যবসাটাকে কিনে নিতে। কিন্তু পরলোকগত স্বামীর স্মৃতি বলে মা সেটাকে আঁকড়ে ধরেছিল। এমন কী ডরিস হুইটনিকে যে টাকা অফার দেওয়া হয়েছিল, সেটা নিলে উনি সারা জীবন পায়ের ওপর পা রেখে বসে থাকতে পারতেন।

–মাগো, তুমি আর কোনোদিন চার্লসকে দেখতে পাবে না। নাতি দেখাও তোমার হয়ে উঠল না।

ট্রেসি তখন অঝোরে কাঁদছে।

রাত সাড়ে তিনটে, ট্রেসি একবার ভাবল, চার্লসকে ফোন করবে! অসময়ে তার ঘুম ভাঙানো উচিত হবে কি? শেষ পর্যন্ত মনটাকে শান্ত করতে বাধ্য হল সে। নিউ অর্লিয়েন্স থেকে না হয় ফোন করবে। লেফটেনান্ট মিলার বলেছেন–এখানে পৌঁছে ট্যাক্সি ধরে পুলিশ। হেড কোয়ার্টারে চলে আসবেন। কিন্তু? পুলিশ হেড কোয়ার্টার কেন? তবে? তবে কি?

নাঃ, বাকিটুকু আর ভাবতে পারল না বেচারী ট্রেসি!

.

নিউ অর্লিয়েন্স এয়ারপোর্ট। স্যুটকেসটা হাতে নিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে লাউঞ্জের বাইরে বেরিয়ে এল ট্রেসি। এখনই তাকে একটা ট্যাক্সি ধরতে হবে। ঠিকানাটা মুখস্থ হয়ে গিয়েছে, ৭১৫, সাউথ ব্রড স্ট্রিট।

ড্রাইভার দ্রুত ট্যাক্সি চালাচ্ছে শহরে এখন মেলার পরিবেশ। দূর থেকে অনেক মানুষের চিৎকার হৈ-চৈ হট্টগোেল শোনা যাচ্ছে। উৎসবের বাজনা বাজছে।

কিছুটা যাবার পর ড্রাইভার গাড়ি থামাতে বাধ্য হল।

ট্রেসি সামনে তাকাল। মুখোশ পরা হাজার হাজার মানুষ। কেউ সেজেছে ড্রাগনের বেশে, কেউবা হয়েছে কুমির, কেউবা দেবতা। উন্মত্তের মতো তারা সবাই নাচছে।

–ওরা এসে আমার গাড়ি উল্টে দেবে ম্যাডাম। আপনি এখানেই নামুন। শুরু হয়ে গেছে মারদিগ্রাস।

ট্রেসির হঠাৎ মনে পড়ল, হ্যাঁ, তাই তো, ফেব্রুয়ারি মাসেই তো মারদিগ্রাস উৎসব হয়। ট্যাক্সি থেকে সে নেমে দাঁড়াল। উন্মত্ত জনস্রোত যেন ওকে লুফে নিল। একজন ওর স্যুটকেসটাকে কেড়ে নিল। একজন ওকে জাপটে ধরল। অন্য একজন ওকে কোলে করে বয়ে নিয়ে চলল উল্টো দিকে। অসহায় ট্রেসি তখন অঝোর ঝরে কাঁদছে। কিন্তু সেদিকে কারো ভূক্ষেপ নেই। বহুক্ষণ বাদে ওই উন্মুক্ত জনতার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারল ট্রেসি। কোনো রকমে পৌঁছলো পুলিশের কোয়ার্টারে।

লেফটেনান্ট মিলারের বয়স হয়েছে। জীবনের অনেক চড়াই উতরাই অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। নিজের ভূমিকাতে অভিনয় করতে কষ্ট হচ্ছে তার। তবু বললেন–দুঃখিত, এয়ারপোর্ট যেতে পারিনি। সমস্ত শহরটা আজ যেন ক্ষেপে গেছে। আপনার মার জিনিসপত্র খুঁজতে গিয়ে শুধু আপনার ঠিকানাটাই পেয়েছিলাম।

উল্টোদিকের চেয়ারে বসে থাকা ট্রেসি নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছে। কেটে কেটে কয়েকটি শব্দ সে ভাসিয়ে দিল বাতাসে। বলললেফটেনান্ট, দয়া করে বলবেন কি আমার মার কী হয়েছিল?

–উনি আত্মহত্যা করেছেন। ট্রেসির সমস্ত শরীর দিয়ে একটা বরফ-শীতল স্রোত বয়ে গেল।

–না, হতে পারে না। মা কেন আত্মহত্যা করবেন? তার তো সবই ছিল?

–আপনাকে লেখা ওঁর একটা চিঠি আছে।

চিঠি সম্পর্কে আপাতত ট্রেসির কোনো কৌতূহল নেই। সে অন্তত একবার মায়ের মৃতদেহটা দেখবে। তার জন্য ওই মর্গে ঢুকতে হবে। পৃথিবীর সর্বত্র মর্গের মধ্যে একটা হিমশীতল বিষণ্ণতার ছোঁয়া থাকে। সেখানে ঢুকলে মৃত্যুর স্পর্শ পাওয়া যায়।

নাঃ, এখান থেকে ট্রেসি পালিয়ে যাবে। সে তো মায়ের মৃত্যু দেখবে বলে আসেনি। টেলিফোনের ব্যাপারটা বোধহয় একটা দুঃস্বপ্ন কোনো বাজে বখাটে ছেলের খুনসুটি মাত্র।

তা হলে ট্রেসি কেন এখানে এসেছে?

মাথার ভেতর অনেক প্রশ্নের মিছিল। ট্রেসির মাথা ঘুরছে, সে বুঝতে পারছে না, এখন কী করা দরকার।

শেষ পর্যন্ত সম্মোহিতের মতো সে মর্গে গিয়েছিল। মায়ের ঘুমন্ত মুখে চুমু এঁকে দিয়েছিল। অঝোর কান্নার আবেগ চাপতে না পেরে শুধু বলেছিল, মা-মা, তুমি কেন একাজ করতে গেলে?

এই সেই চিঠি-আমার আদরের ট্রেসি।

আমাকে ক্ষমা করো তুমি, জীবনের চলার পথে আমি হেরে গেছি। তোমার বোঝা হয়ে আমি থাকতে পারব না। তোমাকে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি বলেই বোধহয় এই

পথটা আমি বেছে নিলাম। ইতি তোমার মা।

আঃ, ঠান্ডা মৃতদেহটার মতো চিঠির প্রতিটি শব্দ একই রকম নিপ্রাণ এবং উত্তাপবিহীন।

মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে। এবার যেতে হবে নিজেদের বাড়িতে। দূর থেকে মারদিগ্রাস উৎসবের হুল্লোড় শোনা যাচ্ছে। এই সবই ট্রেসির কাছে এখন অর্থহীন।

হুইটনিদের বাড়িটা ভিক্টোরিয়া প্যাটার্নের। নিউ অর্লিয়েন্সের বেশীর ভাগ বাড়ির মতো এটাও কাঠের তৈরী। তবে চারপাশে অনেকটা জায়গা আছে।

এই বাড়িতেই ট্রেসির সোনালী শৈশবের দিনগুলি কেটে গেছে। কেটে গেছে তার দুরন্ত দুর্বার কৈশোরের রোমাঞ্চিত প্রহর।

অবশ্য শেষ কবছর ও বাইরে বাইরে কাটাচ্ছে। বাড়ির সামনে গিয়ে ট্যাক্সি ছেড়ে দিল। একী? নিউ অর্লিয়েন্স রিয়ালিটি কোম্পানী বিক্রির জন্য নোটিশ ঝুলিয়ে দিয়েছে কেন? জীবন চলে গেলেও ট্রেসি কখনো এই বাড়ি বিক্রি করবে না।

গেট খুলে বাড়ির সদরে দাঁড়াল। চাবি তার কাছে আছে। যখন ও ক্লাস সেভেনে পড়ে, তখন ওকে একটা চাবি উপহার দেওয়া হয়েছিল। সেই থেকে মাদুলির মতো সর্বক্ষণ চাবিটা ওর গলার হারের সঙ্গে বুকের মধ্যে ঝোলে।

ঘরের ভেতর ঢুকে চমকে উঠল ট্রেসি। কোথাও কোনো ফার্নিচার নেই কেন? বিরাট শূন্যতা তাকে খাওয়ার জন্য ছুটে আসছে। দোতলার যে শোবার ঘরটাতে তার শৈশব এবং যৌবনের অনেকটা প্রহর কেটে গেছে–সেটার অবস্থাও একই রকম? তা কী করে সম্ভব?

বাইরে কে যেন ঘন্টা বাজাল। সম্মোহিতের মতো ধীরে ধীরে নীচে নেমে এল ট্রেসি।

দরজা খুলে দিল। দেখল অটো স্মিট দাঁড়িয়ে আছেন। হুইটনি কোম্পানীর ফোরম্যান। রোগা লম্বা, বিয়ার খেয়ে খেয়ে ভুঁড়ি বাগিয়েছেন। চুলে পাক ধরে গেছে।

–ট্রেসি, গলাতে স্পষ্ট জার্মান টান, খবরটা এইমাত্র পেলাম, আমার যে কী দুঃখ হচ্ছে ট্রেসি, আমি ভাষায় বোঝাতে পারব না।

তাকে দেখে ট্রেসি হারানো সাহস কিছুটা ফিরে পেল। অটোর হাত দুটো চেপে ধরে বলল–আপনাকে দেখে খুবই ভালো লাগছে। আপনি কি ভেতরে আসবেন?

ফাঁকা ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে কুণ্ঠিতভাবে ট্রেসি বলল–বসার একটা চেয়ারও নেই।

–তাতে কী হয়েছে। এসো, নীচেই বসি।

কার্পেটের ওপর দুজনে বসে পড়ল। গভীর ব্যথায় দুজনেই কোনো কথা বলতে পারছে না। অটো স্মিট হল ট্রেসির বাবার কোম্পানীর এক বহু পুরোনো কর্মচারী।

–কী যে হয়ে গেল, কিছুই বুঝতে পারছি না। পুলিশ বলছে, মা নাকি আত্মহত্যা করেছে; কিন্তু আপনি তো জানেন এর কোনো কারণ থাকতে পারে না। আচ্ছা, আমার মায়ের কি কোনো গোপন অসুখ ছিল?

–না-না, তা নয়। ঠিক তা নয়। অটো অন্যদিকে মুখ ফেরালেন। হয়তো কোনো কিছু জানেন তিনি। এখন বলতে পারছেন না।

–সত্যি বলুন তো, কারণটা কি আপনার জানা আছে? এই প্রথম ট্রেসি জিজ্ঞাসু দুটি দৃষ্টি মেলে ধরল অটোর চোখের ওপর।

একদৃষ্টিতে ট্রেসির মুখের দিকে তাকিয়ে অটো বললেন–ইদানিং যা ঘটেছিল, মা সেটা তোমাকে জানাতে চাননি। তুমি শুনলে অযথা দুঃখ পেতে।

ট্রেসির ভুরু দুটি কুঁচকে উঠেছে–আমার দুশ্চিন্তা? ব্যাপারটা খুলে বলুন তো?

অটো একটু চঞ্চল হয়ে উঠলেন–জো রোমানো নামে কাউকে তুমি চেনো কি?

–জো রোমানো? স্মৃতির সমুদ্রে তোলপাড়, না, চিনতে পারছি না তো।

–ছমাস আগে রোমানো তোমার মায়ের সাথে যোগাযোগ করেছিল। সে ওই কোম্পানীটা কিনতে চায়। প্রথমে মা রাজী হননি। সে দশ গুণ দাম দেয়। শেষ পর্যন্ত মা জোর প্রস্তাব মেনে নেন। হঠাৎ তোমাকে এই সুখবরটা দেবেন বলে তোমার মা ঠিক করেছিলেন। আমিও খুব খুশী হয়েছিলাম তোমার মায়ের এই খুশীতে। গত তিন বছর ধরে আমি চাকরি থেকে রিটায়ার করার কথা চিন্তা করেছিলাম। তোমার মায়ের কাছে বারবার প্রস্তাব করেছিলাম। প্রথমে ওই রোমানো সামান্য কিছু টাকা দিয়েছিল। বাকি টাকা গত মাসে পাবার কথা ছিল।

এত শত ব্যাপার ট্রেসি কিছুই জানে না। হঠাৎ মৃতা মায়ের ওপর অভিমান হল তার। ট্রেসি বলল–তারপর? তারপর কী হল?

–কোম্পানী দখল নেবার পর পুরোনো সব কর্মচারীদের ছাঁটাই করে দেওয়া হল। নিজেদের লোক নিয়ে এল রোমানো। কোম্পানীর জিনিসপত্র বেচে দেবার হিড়িক পড়ে গেল। যন্ত্রপাতি ধারে কিনে এনে সেগুলোও বেচে দেওয়া হল। লোক তখনো জানে এই কোম্পানী তোমার মায়ের। তাই ধারে জিনিসপত্র দিতে আপত্তি করেনি। কিছুদিন বাদে পাওনাদাররা টাকার জন্য তাগাদা শুরু করে। তোমার মা রোমানোর কাছে ছুটে গেলেন। সে তখন পরিষ্কার জানিয়ে দিল কোম্পানী কেনার কোনো ইচ্ছে তার নেই। ক্ষতি যা হবার তা হয়েই গেছে। কোম্পানী দেনার দায়ে দেউলিয়া। তোমার মায়ের ওপর পাঁচ লাখ ডলারের ধারের বোঝ। তোমার মা কোম্পানীকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাকেও দেউলিয়া ঘোষণা করা হল। পাওনাদাররা সব কিছু নিয়ে গেছে। এমন কী তোমার মায়ের গাড়িটাও ওরা নিয়ে গেছে।

আর শুনতে পারছে না ট্রেসি। আমার মাকে এত কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে? ওঃ ভগবান, অস্ফুটভাবে কোনোরকমে সে আর্তনাদ করে উঠল।

–আরো শোনো ট্রেসি, সরকারী উকিল তোমার মাকে নোটিশ দিয়েছেন। জালিয়াতি করার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। এই মামলায় উনি নিশ্চিত পরাস্ত হতেন। অর্থাৎ ওনার জেল হত। মনে হয়, এইজন্যই বোধহয় তোমার মা…

ট্রেসির সমস্ত সত্তা তখন রাগে ফুলে উঠেছে–মা সত্যি কথাটা লেখেনি কেন কে জানে? যে লোকটা মায়ের এই বিপদের জন্য দায়ী তার নামটা তো অন্তত একবার পুলিশের কাছে জানানো উচিত ছিল।

বৃদ্ধ ফোরম্যান হতাশায় মাথা নেড়ে বললেন–জো রোমানো অ্যান্টনি ওয়সেক্তির ডান হাত। এই ওয়সেত্তি লোকটা গোটা নিউ অর্লিয়েন্স চালায়। কদিন আগে আমি জানতে পেরেছি। আরো কয়েকটা কোম্পানীর সঙ্গে রোমানো একই ধরনের শয়তানি করেছে। ওর বিরুদ্ধে তোমার মা হয়তো মামলা করতে পারতেন, কিন্তু তাতে অনেক টাকা-পয়সা লাগত। বছরের পর বছর কেস চলত। এসব তোমার মা সহ্য করতে পারতেন না।

মা, আমাকে একবারের জন্যও বলেনি কেন? ট্রেসির গলায় গভীর আক্ষেপের সুর।

–তোমার মা ছিলেন খুবই অহঙ্কারী মহিলা। তাছাড়া এসব খবর শুনে তুমি কী বা করতে পারতে?

–এই জো রোমানোর সঙ্গে আমি দেখা করতে চাই এখনই, কোথায় তাকে পাব, আপনি বলতে পারেন?

–ওর কথা ভুলে যাও ট্রেসি। লোকটা দারুণ প্রতিপত্তিশালী। অন্ধকার জগতের বাদশা।

–ও কোথায় থাকে? ট্রেসির গলায় তখন বুঝি আগুন ঝরছে।

–জ্যাকসন স্কোয়ারের কাছে ওর একটা বিরাট প্রাসাদ আছে। ট্রেসি, আমি তোমাকে ছোটোবেলা থেকে দেখছি। বিশ্বাস করো ওর সঙ্গে দেখা করে কোনো লাভ হবে না।

ট্রেসির কানে তখন কোনো কথা ঢুকছে না। বিজাতীয় ঘৃণা তাকে পাগল করে তুলেছে। মনে মনে ও প্রতিজ্ঞা করল, আমার মাকে এইভাবে হত্যা করার জন্য জো রোমানোকে। শাস্তি পেতেই হবে।

.

৩.

কিছুটা সময় দরকার। চিন্তা করতে হবে পরিষ্কার ভাবে। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা তৈরী করতে হবে। ট্রেসি ম্যাগাজিন স্ট্রীটের একটা হোটেলে উঠল। ফোন করল ফিলাডেলফিয়ার ব্যাঙ্কে। ক্লারেন্স ডেসমন্ডকে জানাল অফিসে যেতে কয়েকদিন দেরী হবে। তাই ছুটি চাই। বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বললেন না ডেসমন্ড। তারপর ট্রেসি ফোন করল চালর্সকে।

–আরে তুমি কোথায় ট্রেসি? মা সকাল থেকে তোমায় টেলিফোন করছে, দুপুরে তোমার সঙ্গে লাঞ্চ খাবে। বিয়ের ব্যাপারে অনেক কাজ আছে।

–চার্লস, আমি দুঃখিত তোমাকে না বলে চলে আসত বাধ্য হয়েছি। আমি এখন নিউ অর্লিয়েন্স থেকে কথা বলছি।

–কোথা থেকে? চার্লস যেন আকাশ থেকে পড়ল, নিউ অর্লিয়েন্স? সেখানে কী। করছো?

–আমার মা…মারা গেছেন, অতি কষ্টে এই কটি শব্দ বের হল ট্রেসির গলা থেকে।

সঙ্গে সঙ্গে চার্লসের কণ্ঠস্বর পাল্টে গেল। চার্লস বলল–আমি ভীষণ দুঃখিত ট্রেসি, নিশ্চয়ই হঠাৎ মারা গেছেন। খুব একটা বয়স হয়নি তো। তুমি ঠিক আছে তো?

মা যে আত্মহত্যা করেছে, এই দুঃসংবাদটা ট্রেসি বলতে পারল না। তাছাড়া এটা তাদের ব্যক্তিগত সমস্যা। চার্লসকে এর মধ্যে জড়িয়ে কী লাভ?

–আমি ঠিক আছি, আমার জন্য বেশী চিন্তা করো না কেমন?

–আমার যাওয়ার দরকার হলে সঙ্গে সঙ্গে বলবে। কোনোরম সঙ্কোচ করো না কিন্তু।

–দরকার নেই, আমি একাই পারব। কাল মাকে কবর দেওয়া হবে। সোমবার ফিলাডেলফিয়াতে ফিরে যাচ্ছি।

ফোনটা নামিয়ে রাখল ট্রেসি। চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। মাথার মধ্যে তার শুধু একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। জো রোমানোকে চরম শাস্তি দিতে হবে।

বিকেল হবার পর হোটেল থেকে বেরোল ট্রেসি, ক্যানান রোড ধরে সামান্য হাঁটল। একটা বন্দুকের দোকানে ঢুকল।

সেলসম্যান হাত কচলাতে কচলাতে বেরিয়ে এল–বলুন, কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি ম্যাডাম?

তোতলাতে থাকে ট্রেসি–আ-আমি একটা বন্দুক চাই। ।

দু-একটা কথা বলার পর দোকানদার বুঝে গেল, ট্রেসি একেবারে আনাড়ি। দেড়শো ডলার নিয়ে একটা পয়েন্ট বত্রিশ ক্যালিবারের রিভলবার ট্রেসির হাতে তুলে দিল। সঙ্গে একবাক্স গুলি ফ্রি দিল। প্রশ্ন করল–আপনি চালাতে জানেন তো?

ট্রেসি বন্দুক চালাতে জানে না। অবশ্য সে সুনিশ্চিত যে, চলাবার কোনো দরকার পড়বে না। ও ভয় দেখাবার জন্য এটা কিনছে। তবু ওপরে এমন একটা ভাব দেখাল যেন, এইসব ব্যাপার তার হাতের পুতুল। লোকটা বেশ ধূর্ত, তাহলে কীভাবে গুলি ভরতে হয় দেখে নিন।

লোকটা কয়েকটা গুলি ভরল।

এরপর রেজিস্টারে নাম ঠিকানা দিয়ে সই করতে হল। পুলিশের জন্য এইসব করতে হয়। তখনই ট্রেসির মনে হল জো রোমানোকে ভয় দেখানো বেআইনি কাজ।

-নাম?

–স্মিট জোয়ান।

–ঠিকানা?

–ডাউম্যান রোড, ৩০/২০ ডাউম্যান রোড।

মাথা নেড়ে লোকটা বলল, ৩০/২০ বলে কোনো নম্বর হতে পারে না ম্যাডাম। ওটা নদীর মাঝখানে পড়বে। আচ্ছা, আমি ৫০/২০ লিখে নিচ্ছি।

সেলসম্যান ভীষণ চালাক। তার দোকানে এমন অনেক উটকো খদ্দেরের ভিড় হয়। সে পরিষ্কার বুঝতে পারল, ট্রেসি বানিয়ে বানিয়ে নাম ঠিকানা বলছে।

ট্রেসি দোকান থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরল। জ্যাকসন স্কোয়ার জায়গাটা অভিজাতদের পাড়া। সেন্ট লুই ক্যাথিড্রাল মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার দুধারে সুন্দর সুন্দর গাছের সারি। এখানে এলে মনে হয় পৃথিবীর কোথাও কোনো দুঃখের ঘটনা ঘটেনি!

সন্ধ্যের অন্ধকার ঘনীভূত না হওয়া পর্যন্ত ট্রেসি অপেক্ষা করতে থাকে। জো রোমানোর বাড়িটা ভালোভাবে লক্ষ্য করে। এবার কী কী করতে হবে ভেবে নিল। জো রোমানোর সঙ্গে দেখা হলে সব আলোচনা করে ওর কাছ থেকে লিখে নিতে হবে, মা নির্দোষ। যদি সহজে লিখে না দেয়, তাহলে রিভলবার দেখিয়ে ভয় দেখাবে। রোমানোর লেখা চিঠিখানা লেফটেনান্ট মিলারের কাছে পেশ করতে হবে। মায়ের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকবে না। পরবর্তী কাজ হল জো রোমাননকে গ্রেপ্তার করে জেলে পোরা। চার্লস সঙ্গে থাকলে বেশ ভালো হত। কিন্তু ওই রিভলবারটা ট্রেসির মনকে এখন সাহসী করে তুলেছে।

এবার কাজ শুরু করতে হবে। দৃঢ় পায়ে হাঁটতে লাগল সে। দরজার পাশে লাগানো কলিং বেলের বোতামটা টিপল। শব্দ হচ্ছে, কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না কেন?

দরজাটা একটু বাদে খুলে গেল, ট্রেসি ভেবেছিল শয়তানের মতো কেউ বেরিয়ে আসবে। কিন্তু কী আশ্চর্য, সুন্দর শান্ত সৌম্য চেহারার এক ভদ্রলোক। এক নজরে দেখলে মনে হয় উনি বোধহয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক।

–বলুন, আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?

কথার স্বরে নম্রতা ঝরে পড়ছে।

–আপনার নাম কি জোসেফ রোমানো?

–হ্যাঁ, কী করতে পারি বলুন?

–আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে মিস্টার রোমানো।

রোমানো ট্রেসির পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল। তারপর বলল, ঠিক আছে, ভেতরে আসুন।

ট্রেসি ভেতরে ঢুকল। দামী আসবাবপত্রে সাজানো ড্রয়িংরুম। ট্রেসি ভাবল, এসব কেনা হয়েছে আমার মায়ের রক্তমাখা টাকায়।

আধখাওয়া মদের গ্লাসটা হাতে তুলে রোমানো জিজ্ঞাসা করল–তুমি কী খাবে বলো।

–কিছু না।

চোখে কৌতূহল।–তাহলে বলে,ফেলো তোমার কী দরকার মিস….

–মিস ট্রেসি হুইটনি। আমি ডরিস হুইটনির মেয়ে।

একটু যেন দ্বিধাগ্রস্ত মনে হল রোমানোকে। তারপর ঠিক হয়ে গেল সে।

–ও হ্যাঁ, তোমার মার কথা শুনেছি, খুবই খারাপ লাগছে তার মৃত্যুর খবরটা শুনে। উনি যে খামোখা কেন আত্মহত্যা করতে গেলেন!

রোমানোর কণ্ঠস্বরে বিনয় এবং শোক একসঙ্গে ঝরে পড়ছে।

ট্রেসি ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে পড়ছে। তুমি তুমি আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী, আর এখন এমন অমায়িকভাব করছো, যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানো না।

মিস্টার রোমানো, সরকারী উকিলের ধারণা, আমার মা জোচ্চুরি করেছেন। কিন্তু একমাত্র আপনি জানেন যে, এই অভিযোগটা ঠিক নয়। আমার মাকে আপনি এই কলঙ্ক থেকে মুক্ত করুন। মেয়ে হিসাবে এটাই আমার একমাত্র আবেদন।

ট্রেসির কথা শুনে রোমানোর মুখের কোনো পরিবর্তন হল না। সে বলল–মারদিগ্রাস উৎসবের সময়ে আমি ব্যবসা সংক্রান্ত কোনো আলাপ আলোচনা করতে চাই না। আমাদের ধর্মে এব্যাপারে নিষেধ আছে। যদি ইচ্ছা হয়, তা হলে একটু ড্রিঙ্ক করতে পারো। দেখবে মনের ভাবটা তরতাজা হয়ে উঠছে।

পেছন ফিরে অন্য গ্লাসে মদ ঢালতে লাগল রোমানো।

রোমানো যে প্রসঙ্গটা পাল্টাতে চাইছে, বুদ্ধিমতী ট্রেসি তা বুঝতে পেরেছে। এবার তা হলে তাকে চরম পথটাই গ্রহণ করতে হবে। সে হ্যান্ডব্যাগ থেকে রিভলবারটা বের করল। রোমানোর দিকে তুলে ধরে বলল–কীসে আমার ভালো লাগবে, তা এখুনি আমি আপনাকে বোঝাতে চাইছি। রোমানো, আমার মার সঙ্গে আপনি যে শয়তানি করেছেন, সেই সম্পর্কে একটা লিখিত স্বীকারোক্তি আমার দরকার।

রোমানো ঘুরে দাঁড়াল। রিভলবারটা দেখে শান্তভাবে বলল–এটা খেলা করার জিনিস নয়। এটা সরিয়ে রাখো মিস হুইটনি। : যা বলছি, তা না করলে আমি কিন্তু গুলি চালাব। একটা কাগজে আপনাকে লিখে দিতে হবে, কীভাবে আপনি ষড়যন্ত্র করে মার কোম্পানীকে দেউলিয়া পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন আর আমার মাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছেন।

রোমানো এবার ট্রেসির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল, তারপর বলল, বুঝেছি, কিন্তু যদি আমি লিখে না দিই, তাহলে কী হবে?

–তাহলে আপনাকে মরতে হবে। ট্রেসি বুঝতে পারছে, তার হাতের মধ্যে ধরা। রিভলবারটা তখন থরথর করে কাঁপছে।

–তোমাকে দেখে খুনী বলে মনে হচ্ছে না মিস হুইটনি কথা বলতে বলতে এক পা এক-পা করে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে রোমানো। খুবই আন্তরিকভাবে বলছে–তোমার মায়ের মৃত্যুর ব্যাপারে আমার কোনো হাত ছিল না। তুমি বিশ্বাস করো…হঠাৎ হাতের মদের গ্লাসটা ছুঁড়ে দিল ট্রেসির মুখে, চোখ জ্বালা করে উঠল ট্রেসির। কোনো কিছু বোঝার আগেই এক ধাক্কায় ওর হাত থেকে রিভলবারটা কে যেন ছিনিয়ে নিয়েছে।

–তোমার গুণী মা আমার কাছে এমন একটা কথা লুকিয়ে গিয়েছিল…দুহাতে ট্রেসিকে চেপে ধরে দেওয়ালের সাথে পিষে দিয়ে রোমানো বলল, এমন একটা রসালো যুবতী মেয়ে আছে তার?

ট্রেসি আপ্রাণ চেষ্টা করেও নিজেকে ছাড়াতে পারছে না, চোখ জ্বালা করছে, সামনে কোনো কিছু দেখতে পারছে না সে। বুকের ভেতর একটা চাপা কান্না তখন পাক খেয়ে ক্রমশ ওপরে উঠছে।

–তোমার বেশ তেজ আছে দেখছি, তোমার মতো সাহসী মেয়েদেরই আমি বেশী পছন্দ করি, তুমি জানো কি? সত্যিকারের উত্তেজনা খুঁজতে এসেছিলে খুকুমণি? এবার এসো, কাকে উত্তেজনা বলে তা তোমাকে বুঝিয়ে দেব।

বলতে বলতে একটানে ট্রেসির ব্লাউজটা ছিঁড়ে ফেলল রোমানো।

ট্রেসি তখন সম্পূর্ণ অসহায়–ছেড়ে দিন, আমাকে ছেড়ে দিন।

হা-হা করে হেসে উঠেছে রোমানো–একটু আনন্দ দিয়ে তারপর ছেড়ে দেব।

চোখ টিপে সে বলল–তবে ওই আনন্দ পাবার পর তুমি আমার সঙ্গ ছাড়তে চাইবে না বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

রোমানো ট্রেসিকে ততক্ষণে মেঝের ওপর হয়ে দিয়েছে। তার ভারী শক্ত শরীরটা ক্রমশ ট্রেসির শরীরের ওপর চেপে বসছে। ট্রসি ছটফট করছে, হঠাৎ তার হাতে ঠেকল রিভলবারটা।

তারপর কী হল ট্রেসি জানে না। গুলির শব্দে রোমানোর শরীরটা শিথিল হয়ে এল। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল অশ্রাব্য খিস্তি কুত্তি কোথাকার, নরকের কুত্তি, তুই শেষ পর্যন্ত আমাকে গুলি করলি…

টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল ট্রেসি। আবছা দৃষ্টি নিয়ে বাথরুমে ঢুকল। চোখ ভালো করে ধুয়ে ফেলল। আয়নায় দৃষ্টি পড়তে সে চমকে উঠল-হায়, এইমাত্র ও একটা লোক খুন করেছে।

জো রোমানো চিৎ হয়ে পড়ে আছে। সাদা কার্পেটের ওপর দিয়ে রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে।

ট্রেসি মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল–দুঃখিত, আমি সত্যি সত্যি এই কাজটা করতে চাইনি। হাসপাতাল…সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেল টেলিফোনের কাছে–৪২১, জ্যাকসন স্কোয়ারে একজন গুরুতরভাবে আহত, শীগগির অ্যাম্বুলেন্স পাঠান। পালাবার আগে ট্রেসি স্বগতোক্তির : মতো বলে গেল-অ্যাম্বুলেন্সে খবর দিয়েছি, এর মধ্যে লোকটা যেন মরে না যায়।

দৌড়লে লোকে সন্দেহ করবে, তাই কোটটা দিয়ে শরীরটা ভালোভাবে ঢেকে। ধীর পায়ে হেঁটে গেল।

–ট্যাক্সি, এয়ারপোর্ট যাবট্যাক্সিতে উঠে বসেছে ট্রেসি। দূর থেকে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন কানে এল।

ট্যাক্সি ছুটছে, ট্রেসি ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছে, অ্যাম্বুলেন্স যেন ঠিক সময়ে পৌঁছে যায়। যদি রোমানো মরে যায়? তাহলে তো ট্রেসি একজন খুনী হয়ে যাবে। রিভলবারটা পড়ে আছে, হাতের ছাপ লেগে আছে। ও হাজার বার বললেও পুলিশ বিশ্বাস করবে না যে, ধর্ষণের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য ট্রেসিকে গুলি করতে হয়েছে।

তা হলে? নিউ অর্লিয়েন্স থেকে এখনই পালাতে হবে।

ড্রাইভারটা অনেক কথা বলছে। কিন্তু একটা বর্ণও ট্রেসির কানে ঢুকছে না। কী বোকার মতো কাজ করেছে সে। জোর করে রোমানোর কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা কি এতই সহজ? কেন যে ফোরম্যানের কথা আমি শুনলাম না! চার্লসকেইবা কী বলব?

ট্রেসি এয়ারপোর্টে পৌঁছলো। আজ সকালেই সে এখানে নেমেছিল। সকাল থেকে রাতের মধ্যে এতগুলো ঘটনা ঘটে গেল তার জীবন নাটকে?

কাউন্টারে গিয়ে ফিলাডেলফিয়ার একটা টিকিট কিনল। একটি মাত্র সিট ছিল। ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। মিনিট কুড়ি বাদে প্লেন ছাড়বে। টারমিনাসের দিকে এগিয়ে গেল ট্রেসি। হঠাৎ দুজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তার। তারা ট্রেসির দুপাশে দাঁড়াল, বলল, আপনি ট্রেসি হুইটনি?

বোকার মতো ঘাড় নাড়ল ট্রেসি–হ্যাঁ।

–আপনাকে গ্রেপ্তার করা হল…  

সিনেমার পর্দায় যেমন একটির পর একটি ঘটনা ঘটে যায়, ঠিক সেইভাবেই ট্রেসির জীবনে ঘটনাগুলি ঘটতে থাকল। হাতে হাতকড়া লাগিয়ে ট্রেসিকে তোলা হল পুলিশ ভ্যানে।

থানাতে তখন প্রচণ্ড ভিড়, বেশ্যা, দেহ ব্যবসায়িনী, তাদের দালাল, ওদের পাশ কাটিয়ে ট্রেসিকে দাঁড় করানো হল একটি টেবিলের সামনে। একজন সার্জেন্ট মাথা নীচু করে কী যেন লিখছিল।

–হুইটনি মেয়েটাকে ধরে এনেছি স্যার, পালাচ্ছিল, এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ছুটতে হয়েছে আমাদের।

–আমি কিন্তু…ট্রেসির কথা বলা শেষ হল না, সার্জেন্ট বলল, হাতকড়া খুলে দাও। ট্রেসি ইতিমধ্যেই ব্যাপারটার সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। বলছে সে, ব্যাপারটা.একটা অ্যাকসিডেন্ট। আমি খুন করতে চাইনি। লোকটা আমাকে উন্মত্তের মতো ধর্ষণ করতে চেয়েছিল। বাকি কথাটুকু সে আর শেষ করতে পারে না।

–তোমার নাম ট্রেসি হুইটনি?

–হ্যাঁ, আমি…

ট্রেসি অনেক কিছু বলার চেষ্টা করল।

–ওকে গারদে পুরে দাও।

–দাঁড়ান এক মিনিট, একজনকে ডাকতে চাই আমি। একটা ফোন করার অধিকার তো আমার আছে।

–ওঃ সবই জানো দেখছি, সার্জেন্ট চিৎকার করে বলল, এর আগে কবার জেল খেটেছ?

–একবারও না।

–একটা ফোন করতে পারবে, সময় তিন মিনিট। নম্বর বলল। ট্রেসির মাথা তখন ঘুরছে। চার্লসের নম্বরটা কিছুতেই মনে পড়ছে না। অনেক কষ্টে • মনে পড়ল। ফোন বেজে যাচ্ছে, কেউ ধরল না। ট্রেসির মনে পড়ল, এই সময় চার্লস ফোনটা কেটে রাখে। পাছে কেউ বিরক্ত করে।

ফোন করা হল না, অথচ ভীষণ দরকার ছিল।

–শেষ হয়েছে ফোন করা?

–হ্যাঁ, ফোনটা নামিয়ে রাখল ট্রেসি। ওকে অন্য একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। আঙুলের ছাপ নেওয়া হল। বলা হল, কালকে তাকে কোর্টে পেশ করা হবে।

গরাদ দেওয়া একটা সেলের মধ্যে ট্রেসিকে পুরে দেওয়া হল।

রাত যেন আর কাটতে চাইছে না। চোখে ঘুম নেই। চার্লসের সঙ্গে যোগাযোগ করা ভীষণ দরকার। চার্লসকে সবকথা না জানানো পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হতে পারছে না সে।

সকাল ছটা বাজল। সামান্য কফি আর খাবার দিয়ে গেল একজন। কোনো কিছু খাবার মতো মানসিকতা নেই ট্রেসির।

নটার সময় মেট্রন এসে তালা খুলল। বলল, যাবার সময় হয়েছে।

–আমি একটা ফোন করতে চাই। ট্রেসি মরিয়া হয়ে বলল।

–ওসব পরে হবে। জজ তোমার জন্য বসে থাকবেন না। তাছাড়া এই জজটা ভীষণ বদমাইস স্বভাবের।

এ বারান্দা ও বারান্দা করে মেট্রন তাকে আদালতে পৌঁছে দিল। জজটা বেশ বয়স্ক। মুখ আর হাত বেশী মাত্রায় নাচছে। সামনে দাঁড়িয়ে সরকারী উকিল এড টপার। চল্লিশ বছর বয়স হয়েছে, মাথায় কাঁচাপাকা চুল, চোখের কালো তারায় সবসময় ধূর্ততা খেলা করছে।

বেলিফ ঘোষণা করল–সরকার বনাম ট্রেসি হুইটনি, জজ সামনে রাখা কাগজপত্রে মুখ ডোবালেন।

এই সময় ট্রেসি চিৎকার করে বলল–ইয়োর অনার, খুন করার ব্যাপার এটা নয়, লোকটা আমাকে ধর্ষণ করতে চেয়েছিল। ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম, হঠাৎ গুলি বেরিয়ে গেছে।

সরকারী উকিল মাঝপথে বাধা দিলেন ইয়োর অনার, আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট করে কী লাভ? এই মেয়েটি মিস্টার রোমানোর বাড়িতে অবৈধভাবে ঢুকে ছিল। সঙ্গে ছিল রিভলবার। তারপর প্রায় পাঁচ লাখ ডলার দামের বিখ্যাত শিল্পী রেনোয়ার একটা ছবি চুরি করে পালাবার চেষ্টা করে। মিস্টার রোমানো ওকে বাধা দিতে এসেছিলেন। মেয়েটি তাকে ঠান্ডা মাথায় গুলি করে পালিয়ে যায়।

–এসব কী যা-তা বলছেন? ট্রেসি হতভম্ব হয়ে গেছে। কিন্তু কেউ ট্রেসির কথা শুনল না। সরকারী উকিল বলে চললেন–যে রিভলবার দিয়ে মিস্টার রোমানোকে খুন করার চেষ্টা করা হয়েছিল, সেটা আমরা হাতে পেয়েছি। তার গায়ের আঙুলের ছাপের সঙ্গে এই মেয়েটির আঙুলের ছাপ মিলে গেছে।

খুন করার চেষ্টা করা হয়েছিল…তার মানে মিস্টার রোমানো মরে যায়নি…তার মানে আমি খুনী নই?

–মূল্যবান ছবিটি ও অন্য কোথাও সরিয়ে দিয়েছে। আমাদের আশঙ্কা সেটা বোধহয় বিদেশে চলে গেছে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে আমরা প্রার্থনা করছি, ট্রেসিকে পাঁচ লক্ষ ডলারের জামিন মঞ্জুর করা হোক। জজ ট্রেসির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন-তোমার কেননা উকিল আছে কি?

কথাগুলো ট্রেসির কানে ঢুকছে না।

জজ আরো চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–তোমার কোনো অ্যাটর্নি আছে কি?

ট্রেসি মাথা নেড়ে বলল–না, আমি…উনি যা বললেন তার একটি কথাও ঠিক নয়..আমি ডাকাতি…

–অ্যাটর্নি লাগাবার মতো টাকা পয়সা আছে তোমার? ব্যাঙ্কে টাকা আছে, চার্লসকে বললেও টাকা পাওয়া যাবে, কিন্তু ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল–আমার, না ইয়োর অনার, না, নেই। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না কেন

ট্রেসি তোতলাতে শুরু করেছে। জজ বললেন–আদালত তোমার জন্য একজন অ্যাটর্নি দেবে। ইতিমধ্যে যদি পাঁচ লাখ ডলারের জামিন না দিতে পারো, তবে জেল হাজতে থাকবে। পরের মামলা…

–একমিনিট, কোথায় যেন ভুল হয়ে গেছে, আমি চোর-ডাকাত নই…

কেউ ট্রেসির কথা শুনল না। টেনে হিঁচড়ে তাকে আদালত থেকে প্রিজন ভ্যানে তোলা হল।

ট্রেসির জন্য আদালতের পক্ষ থেকে একজন অ্যাটর্নিকে নিযুক্ত করা হয়েছিল। তার নাম পেরী পোপ। তিরিশের কোটার শেষের দিকে বয়স। চালাক-চতুর চেহারা, চোখে মুখে সহানুভূতির স্পর্শ। পেরী পোপকে খুবই পছন্দ হল ট্রেসির। ট্রেসির মনে হল, পেরী পোপের কাছে সে জীবনের সব সত্যি কথা উজাড় করে বলবে।

সেলের মধ্যে ঢুকে, লোহার খাটের ওপর বসল পেরী। বলল, শহরে আসার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে এত হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছেন দেখছি। তবে ভাগ্য ভালোই বলতে হবে আপনার, আনাড়ির মতো গুলি চালিয়েছেন বলে রোমানো প্রাণে মরেনি। কথা বলতে বলতে পকেট থেকে পাইপ বের করে পেরী বলল, আপত্তি নেই তো?

না। পাইপে তামাক ভরতে ভরতে পেরী বলতে শুরু করে–আপনাকে দেখে কিন্তু দাগী অপরাধী বলে মনে হচ্ছে না।

–বিশ্বাস করুন আমি খুনী নই।

–আগে আমাকে বোঝান, তবে বিশ্বাস করব। প্রথম থেকে সব কথা বলুন।

ট্রেসি ধীরে ধীরে সব কথা বলল। পেরী পোপ একমনে শেষ কথাটা পর্যন্ত মন দিয়ে শুনল। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলল–ব্যাটা বেজম্মা কোথাকার।

–ওরা কী বলছিল, আমি একবর্ণও বুঝতে পারিনি। ছবির কথা কেন উঠছে জানি ।

–খুব সোজা ব্যাপার। জো রোমানো যেভাবে আপনার মাকে জালে ফাঁসিয়েছিল, সেভাবে আপনাকেও ফাঁসানোর চেষ্টা হচ্ছে।

–ব্যাপারটা কিন্তু এখনো আমার কাছে পরিষ্কার নয়।

–বুঝিয়ে বলছি, পেরী পোপ শুরু করল, রেনোয়ার ওই বিখ্যাত ছবিটা রোমানো নিজেই কোথাও লুকিয়ে ফেলেছে। ইনসিওরেন্স কোম্পানীর কাছ থেকে পাঁচ লাখ ডলার ও ঠিক আদায় করবে। ইনসিওরেন্স কোম্পানী আপনার পেছনে লাগবে ছবিটা উদ্ধার করার জন্য। গোলমাল কমলে রোমানো ছবিটা বিক্রি করে আরো পাঁচ লাখ ডলার পেয়ে যাবে। সবটাই হল আপনার বোকামির ফলে। আচ্ছা, আপনি কীভাবে ভাবলেন যে, রিভলবার দেখিয়ে রোমানোর মতো একটা লোকের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করবেন?

–মার মৃত্যুর খবর পেয়ে আমার মাথাটা কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল। তখন আমি সব কিছু ভুলে গিয়েছিলাম। আচ্ছা, এখন তো তদন্ত হবে।

পাইপটা নিভে গিয়েছিল। অবার ধরিয়ে নিয়ে পেরী পোপ প্রশ্ন করল–কীভাবে ওর বাড়িতে ঢুকেছিলেন?

–সদরে দাঁড়িয়ে কলিং বেলের বোতাম টিপেছিলাম। মিস্টার রোমানো নিজেই দরজা খুলে দিয়েছিলেন।

–রোমানো কিন্তু অন্য গল্প বলেছে। বাড়ির পেছন দিকের জানলা ভেঙে আপনি ঢুকেছেন। ও পুলিশকে বলেছে, ছবিটা নিয়ে আপনি যখন পালাচ্ছিলেন, তখন ধরতে গিয়ে গুলি খেয়েছে আর আপনি গুলি চালিয়ে পালিয়ে যান।

–এটা তো মিথ্যে কথা।

–কথাটা মিথ্যে, কিন্তু বাড়িটা তার এবং রিভলবারটা আপনার। আপনি কি জানেন, আপনি কার সঙ্গে লাগতে গেছেন?

ট্রেসি মাথা নাড়ল।

–তাহলে আসল কথাটা শুনে রাখুন মিস হুইটনি, এই শহরটা পুরোপুরি ওয়সেত্তির মুঠোর মধ্যে আছে। অ্যান্টনি ওয়সেত্তি যদি অনুমতি না দেন তা হলে এই শহরে কিছু হতে পারে না। এখানে বাড়ি করতে চাইলেও ওনার অনুমতি নিতে হবে। মেয়েমানুষের ব্যবসা করতে চাইলে প্রতি শনিবার ওনার হাতে টাকা পৌঁছে দিতে হবে। গাঁজা-চরসের গোপন চালান দিতে হলে ওয়সেত্তির সঙ্গে দেখা করুন। প্রথমে জো রোমানো ছিল ওর এক নম্বর শত্রু। এখন হয়েছে ডান হাত।

ট্রেসি অবাক হয়ে শুনছিল, আর ভাবছিল, সত্যি কেমন একটা বোকার মতো কাজ হয়ে গেল।

উকিলটা বলতে থাকে আর আপনি বোকার মতো ওর সঙ্গে লাগতে গেলেন? ট্রেসি ক্লান্তভাবে প্রশ্ন করল–আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করছেন?

–হ্যাঁ, করছি।

–তাহলে আপনি কি আমায় কোনো সাহায্য করতে পারবেন?

কারোর ওপর আর বিশ্বাস রাখতে পারছে না ট্রেসি। ব্যাকুল হয়ে সে এই কথা জানতে চাইল।

ধীরে ধীরে পেরী পোপ বলতে শুরু করে আমি চেষ্টা করে দেখব। ওই লোকগুলোকে জেলে ভরা খুব একটা সহজ কাজ নয়। বিচার যদি আপনার হয়, তা হলে ওরা আপনাকে চারপাশ থেকে এমনভাবে আক্রমণ করবে যে, আপনি কোনোদিন আলোর মুখ দেখতে পাবেন না।

যদি আমার বিচার হয় মানে? ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে ট্রেসি। পেরী পোপ পায়চারি করতে করতে বলতে শুরু করল–আমি চাই না, জুরী দিয়ে আপনার বিচার হোক। জুরীর সদস্যদের ওরা কিনে নেবে। একজন মাত্র জজ আছেন, যাঁকে ওয়সেত্তি এখনো কিনতে পারেনি। তার নাম হেনরি লরেন্স। যদি আপনার মামলাটা হেনরি লরেন্স-এর আদালতে ফেলতে পারি, তাহলে আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারব। আমার মতো উনিও মনে-প্রাণে ওয়সেত্তি এবং জো রোমানোকে ঘেন্না করেন। এখন আমার প্রথম কাজ হল ওই জজ সাহেবের সঙ্গে দেখা করা।

পেরী পোপের সাহায্যে ট্রেসি চালর্সকে ফোন করল। ধরল চার্লসের সেক্রেটারি হ্যারিয়েট।

–কে মিস হুইটনি? আঃ, বাঁচালেন, মিস্টার স্ট্যানহোপ আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। বিয়ের ব্যাপারে দিন এখনই ঠিক করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপনি ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করুন।

–হ্যারিয়েট, আমি একটু চার্লসের সঙ্গে কথা বলব।

–দুঃখিত, মিস্টার স্ট্যানহোপ একটু আগে হার্ডসরোল চলে গেছেন। আপনার নম্বরটা দিন, উনি কাল ফিরবেন, আমি বলব আপনাকে যোগাযোগ করতে।

জেলখানার ফোন নম্বর দেওয়া যায় না। ধীরে ধীরে ফোনটা নামিয়ে রাখার আগে ক্লান্ত ট্রেসি বলল, ঠিক আছে, আমিই ফোন করব।

আগামীকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সেদিন বিকেলের দিকে একটা ভালো ঘরে ট্রেসিকে পাঠানো হল। কে যেন ফুল পাঠিয়েছে, সঙ্গে কার্ড, লেখা আছে–মাথা উঁচু করে থাকুন। শয়তানদের উচিত শিক্ষা দিতেই হবে–পেরী পোপ।

পরদিন সকালে পেরী পোপের মুখে স্মিত হাসির চিহ্ন দেখে ট্রেসি বুঝতে পারল, ভালো খবর এসেছে।

পোপ বলল–আমাদের ভাগ্য ভালো। এইমাত্র জজ লরেন্স আর সরকারী উকিলের কাছ থেকে আসছি। জজ রাজী হয়েছেন। সরকারী উকিলটা প্রথমে খুব চিৎকার করছিল। পরে ওকেও রাজী করিয়েছি। তবে একটা শর্ত আছে। জজ সাহেবকে আপনার সব কথা বলেছি। উনি বলেছেন, আপনি অপরাধ স্বীকার করবেন।

ট্রেসি চমকে উঠে বলল–সে কী, আমাকে অপরাধ স্বীকার করতে হবে?

–আগে সবটা শুনুন, অপরাধ স্বীকার করলে মামলা চালানোর খরচ সরকারকে করতে হবে না। জজ সাহেব রোমানোকে হাড়ে হাড়ে চেনেন। আপনি যে ছবিটা চুরি করেননি, সেটা তিনি বিশ্বাস করেছেন।

–কিন্তু অপরাধ স্বীকার করলে আমার কী হবে?

–জজ সাহেব আপনাকে তিন মাসের জেল দেবেন।

–জেল…

–উত্তেজিত হবেন না। কারাদণ্ড দেবেন ঠিকই, তবে সঙ্গে সঙ্গে সেটা মুকুব করে দিয়ে তিন মাসের জন্য রাজ্যের বাইরে থাকতে বলবেন।

–তাহলে আমার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ থেকে যাবে?

–যদি বিচার চলে তাহলে চুরি আর খুন করার অপরাধে আপনাকে দশ বছরের জেল খাটতে হবে।

–দশ বছর? ট্রেসি আর ভাবতে পারছিল না।

–সিদ্ধান্তটা কিন্তু আপনাকে নিতে হবে। আমি শুধু উপদেশ দিতে পারি। দৈব সাহায্য করেছে বলেই এই মামলা আমার হাতে এসেছে। ওঁরা আমার কাছ থেকে হা অথবা না শোনার জন্য অপেক্ষা করে আছেন। যদি আপনি এই শর্তে রাজী না হন, তবে অন্য অ্যাটর্নি পাবেন।

–না, ট্রেসি বুঝতে পারছে, পোপের থেকে ভালো উকিল সে আর পাবে না কিন্তু এই ব্যাপারে একবার চার্লসের সঙ্গে কথা বললে ভালো হত। উত্তরটা এখন দিতে হবে। ভাগ্য ভালো থাকলে তিন মাসের মধ্যে সব ঝঞ্ঝাট মিটে যাবে।

–এই শর্তে আমি রাজী আছি। ট্রেসি কোনোরকমে বলল।

পেরী পোপ ঘাড় নেড়ে বলল–বুদ্ধিমতী মহিলা।

পরদিন কোর্টে যাবার আগে ট্রেসিকে কোনোরকম ফোন করতে দেওয়া হল না। সরকারী। উকিল এড টপার একদিকে, অন্য দিকে পেরী। বিচারকের আসনে জজ হেনরি বসে আছেন। দূর থেকে দেখে ট্রেসি বুঝতে পারল, তার চেহারাটি ভারী সুন্দর এবং সুভদ্র।

–আদালতকে জানানো হয়েছে যে আপনি আপনার অপরাধ স্বীকার করেছেন, কথাটা কি ঠিক?

–হ্যাঁ, ইয়োর অনার।

–এতে সব পক্ষের সম্মতি আছে তো?

পেরী পোপ বলল–হ্যাঁ, হুজুর।

–সরকারী পক্ষ রাজী, সরকারী উকিল বললেন।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন জজ। তারপর তিনি রায় দেওয়া শুরু করলেন–আমাদের মহান দেশের বর্তমান অবনতির অন্যতম কারণ হল এই যে, সর্বত্র নরকের কীটরা ছড়িয়ে পড়েছে। আইনকে তার ব্যঙ্গ করে। দেশের কোথাও কোথাও তারা অন্যায়ভাবে অপরাধীদের প্রশ্রয় দেয়। আমাদের লুইসিনিয়াতে আমরা এসব করতে দেব না। চুরি করতে গিয়ে কেউ যদি খুনের চেষ্টা করে, তবে তার উপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিত।

জজের বক্তব্যের সুর ট্রেসির বুকের ভেতর কাপন ধরিয়ে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত সব ঠিক মতো হবে তো? পেরী পোপ জজের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে।

–আসামী স্বীকার করেছে সে এই শহরের এক গণ্যমান্য এবং জনসেবক ভদ্রলোকের বাড়িতে ঢুকেছিল মূল্যবান ছবি চুরি করতে। ধরা পড়ার ভয়ে ওই ভদ্রলোককে গুলি করে খুন করার চেষ্টা করে।

জজ সাহেবের কণ্ঠস্বর ক্রমশ কঠোর হতে শুরু করেছে।

–এই আদালত দেখতে চায়, আসামী ওই ছবি বিক্রির টাকা যেন ভোগ করতে না। পারে। অন্তত পনেরো বছর তাকে কারাগারে থাকতেই হবে। পনেরো বছর সে দক্ষিণ লুইসেনিয়ার নারী চরিত্র সংশোধনি কারাগারে থাকবে।

বিচারকের রায় দান শেষ হয়েছে। এবার কোর্টের কাজ বন্ধ হবে। ট্রেসির মনে হল, সমস্ত কোর্ট ঘরের মধ্যে বুঝি একটির পর একটি বিস্ফোরণ ঘটে চলেছে। জজ ভুল করে অন্য কিছু করে ফেলেছেন। সে সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে পেরী পোপের দিকে তাকাল। পেরী পোপ অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে কাগজপত্র গোছাতে ব্যস্ত। জজ সাহেব উঠে দাঁড়িয়েছেন। আর্দালি চিৎকার করছে। বেলিফ এসে ট্রেসির হাতটা চেপে ধরল। কর্কশ কণ্ঠস্বরে বলল–চলো।

–না, ট্রেসি আহত আর্তনাদে তার হৃদয়ের আবেগ প্রকাশ করতে চায়, শুনুন, কোথাও একটা ভুল হয়ে গেছে। আমি এই কাজটা করিনি।

ট্রেসি কান্নার মধ্যে ভেঙে পড়তে চাইছে। কিন্তু ইতিমধ্যে বেলিফের হাতটা সাঁড়াশির মতো তার হাত চেপে ধরেছে। ট্রেসিকে আরো একবার বোকা বানানো হয়েছে। উদগত কান্নাটাকে চেপে রাখার চেষ্টা করল সে। সে বেশ বুঝতে পারল, মায়ের পরে এবার মেয়ের বোকা সাজার পালা।

.

৪.

সমস্ত খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ছবিসহ ট্রেসি হুইটনির ওই মুখরোচক গল্প ছাপা হয়েছে। টেলিভিশনের রিপোর্টাররা ট্রেসিকে ঘেঁকে ধরার চেষ্টা করছে। জো রোমানো শহরের একজন নামকরা লোক। এক সুন্দরী তাকে খুন করার চেষ্টা করেছে। অতএব সংবাদ শিকারীদের কাছে এখন ট্রেসিই তো হয়ে উঠবে প্রধান আকর্ষণ, এতে আর অবাক হবার কী আছে?

ট্রেসি ভাবল চর্লসই একমাত্র আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়াতে পারে। পরদিন বিকেল বেলা চালর্সকে ফোন করার অনুমতি দেওয়া হল। ফোন ধরল সেক্রেটারী হ্যারিয়েট। শেষ পর্যন্ত চালর্সকে ডেকে দিল সে।

–চালর্স…উত্তেজনায় ট্রেসির গলা তখন বুজে এসেছে।

–কে ট্রেসি? ট্রেসি কথা বলছ?

কণ্ঠস্বরের মধ্যে একটা হিম শীতল নীরবতা।

–হ্যাঁ চার্লস, ভীষণভাবে তোমার সঙ্গে যোগাযযাগ করতে চাইছি।

–আমার তো মাথা খারাপ হয়ে যাবার মতো অবস্থা। চার্লস কোনোরকমে বলে। এখানকার খবরের কাগজগুলোর প্রথম পাতায় তোমার ছবি বেরিয়েছে। তোমার সম্পর্কে মিথ্যে খবর লিখেছে, আমি একটাও বিশ্বাস করতে পারছি না।

–একটা কথাও সত্যি নয় চার্লস।

–তুমি আমাকে ফোন করছে না কেন?

–চেষ্টা করেছিলাম, পাইনি।

–এখন তুমি কৈাথায় আছো?

–আমি নিউ অর্লিয়েন্স জেলে আছি। বিনা দোষে ওরা আমাকে জেলে পুরেছে। চার্লস… ট্রেসি আর কথা বলতে পারছে না। হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল সে।

–শান্ত হও। শোনো, কাগজ বলছে, তুমি নাকি একটা লোককে গুলি করেছিলে। কথাটা কি সত্যি?

–গুলি আমি করেছি ঠিকই। কিন্তু—

–তাহলে কথাটা সত্যি। চার্লসের একটা দীর্ঘশ্বাস বোধ হয় ট্রেসি শুনতে পেল।

–যেভাবে পড়েছে, সেটা কিন্তু সত্যি নয়। আমি তোমাকে বুঝিয়ে বলব।

–ট্রেসি, ছবি চুরি করা আর খুন করা–তোমার বিরুদ্ধে এই দুটো মারাত্মক অভিযোগ আনা হয়েছিল এবং দুভার্গ্যক্রমে তুমি দুটো অভিযোগ স্বীকার করেছে।

–হ্যাঁ চার্লস, কিন্তু এই জন্য…

–হ্যায়, তোমার এত টাকার দরকার ছিল, আমাকে একবার বলতে পারলে না। তার বদলে একজনকে খুন করতে গেলে …না, আমি এটা বিশ্বাস করছি না। কিন্তু সত্যটাকে তো মানতেই হবে। আমার মা-বাবাও প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিল না। এখন হয়তো সব কিছু তাদের বিশ্বাস করতে হবে। এখানকার খবরের কাগজে বড়ো বড়ো হেড লাইনে তোমার সব খবর ছাপা হয়েছে। এই প্রথম স্ট্যানহোপ পরিবারের গায়ে কলঙ্কের ছাপ পড়ল। আর এর জন্য ট্রেসি তোমাকেই দায়ী করব।

চার্লসের গলা ক্রমশ গম্ভীর হয়ে উঠেছে। ট্রেসি দুঃখিত আর লজ্জিত। চার্লসকে এভাবে বিপদে ফেলা তার মোটেই উচিত হয়নি। কিন্তু মুহূর্তের অসাবধানতার পরিণতি যে এত মারাত্মক হতে পারে ট্রেসি তা কী করে বুঝবে? তবুও সে বলল চার্লস, লক্ষ্মীটি, তুমি কি আমার কাছে একবারের জন্যও আসবে না?

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর চার্লস বলল–না, তুমি সব দোষ স্বীকার করে ফেলেছে। তোমার সঙ্গে এখন আমরা আর নিজেদের জড়াতে চাইছি না। এখন মনে হচ্ছে, তোমার সঙ্গে দেখা না হলেই বোধহয় ভালো হত।

প্রতিটি শব্দ বিষ–তীরের মতো ট্রেসিকে আক্রমণ করছে। তার পায়ের তলা থেকে মাটি ক্রমশ সরে যাচ্ছে। সে বোধহয় একটা গভীর বিবরের বাসিন্দা হয়ে যাবে। তবুও মরিয়া প্রয়াসে সে জানতে চায়–তাহলে এই বাচ্চাটার কী হবে?

ওপাশের কণ্ঠস্বরের মধ্যে এখন কৌতুকের আভাস–সে তুমি যা ভালো বুঝবে তাই করবে। ওই বাচ্চা তোমার, আমি দুঃখিত ট্রেসি, তোমাকে এভাবে আঘাত করার জন্য।

ফোনটা কেটে গেল। পেছন থেকে একটা কয়েদী ঘ্যাড়ঘেড়ে গলায় বলে উঠল–তোমার হয়ে গেলে ফোনটা ছেড়ে দাও। আমি আমার উকিলকে একবার ফোন করব।

মেট্রন সেলে ঢোকবার সময় জানিয়ে দিয়ে গেলেন। আগামীকাল সকাল পাঁচটার সময় যেতে হবে।

কে যেন একজন ট্রেসির সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। কে হতে পারে? অটো স্মিথ? এই ক ঘণ্টায় সে বুঝি আরো একটু বুড়ো হয়ে গেছে।

ট্রেসির দিকে তাকিয়ে সজল চোখে সে বলল–আমি তোমার কাছে শুধু এইটুকু বলতে এসেছি যে, আমি এবং আমার স্ত্রী–দুজনেই এই ঘটনায় খুব দুঃখ পেয়েছি। আমরা দুজনে বিশ্বাস করতে পারি না, তুমি এই কাজ করতে পারো।

ট্রেসি মনে মনে বলল–আঃ, চার্লস কেন এই কথাগুলো উচ্চারণ করল না?

–আগামীকাল তোমার মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া। আমি কথা দিচ্ছি, সেখানে আমি উপস্থিত থাকব। আমার স্ত্রীও থাকবে।

–আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ, ট্রেসি মনে মনে বলল, কাল আমাদের দুজনকেই কবর দেওয়া হবে–একজন মৃত এবং অন্যজন জীবিত।

সমস্ত রাত কেটে গেল ট্রেসির। বারবার চার্লসের কথাগুলো মনে পড়ছিল তার। জীবনে এভাবে সে বোধহয় কখনো অপমানিত হয়নি। হায় ঈশ্বর, চার্লসের কাছে সব কথা গুছিয়ে বলার সামান্যতম সুযোগটুকুও পেল না সে!

ওই পেটের বাচ্চাটার কী হবে? বাচ্চা জন্মাবার পর সরকার পক্ষ মা আর ছেলেকে আলাদা করে দেয়। অবশ্য এমন মাকে না চেনাই ভালো। ট্রেসি কাঁদতে লাগলো।

সকাল পাঁচটার সময় মেট্রন এলেন। সঙ্গে একজন পুরুষ কনস্টেবল। হুকুমটা চিৎকার করে পড়ে শোনানো হল–ট্রেসিকে দক্ষিণ লুইসিনিয়ার মেয়েদের জেলখানায় যেতে হবে।

লম্বা বারান্দা দিয়ে ট্রেসি হাঁটতে থাকল। দুপাশে কয়েদীরা নানাভাবে তাকে সম্ভাষণ করছে।

একজন বলল–আহা, এমন সুন্দর চেহারা, কী লাভ হল ছবি চুরি করতে গিয়ে…

–ছবিটা কোথায় লুকিয়ে রেখেছো, একবার বলবে নাকি সোনামনি। আধাআধি বখরা হবে।  

–যদি তোমাকে বড়ো বাড়িতে নিয়ে যায় তবে আর্নেস্টাইন লিটল চ্যাপের খোঁজ করো। সে তোমাকে সাহায্য করতে পারে।

টেলিফোনের পাশ দিয়ে যাবার সময় ট্রেসি মনের অজান্তে বলে ফেলল–বিদায় চার্লস, সত্যিই তো, আর কখনো বোধহয় চার্লসের সঙ্গে তার দেখা হবে না। একটা সুন্দর স্বপ্নের পরিসমাপ্তি কীভাবে ঘটে গেল।

উঠোনে একটা হলদে রঙের কয়েদী গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। তার ভেতর পাঁচ-ছজন আগে থেকেই বসে আছে। যেখানে ওদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেখানে ছোটো ছোটো খাঁচার ভেতর বন্দী হয়ে থাকতে হবে। ওখানকার জীবনযাত্রা নাকি দুঃসহ। ওরা কি তারই মতো দুর্ভাগ্যের শিকার। নাকি সত্যিকারের অপরাধী?

দুপাশে খোলা প্রান্তর, সবুজের সীমাহীন সমারোহ, আকাশে নীলের খেলা, কিন্তু সেদিকে তাকাবার মতো মন নেই ট্রেসির। নিজেকে ভীষণভাবে একা এবং নিঃসঙ্গ বলে মনে হল তার।

ছোট্টবেলার কথা মনে পড়ে গেল, ট্রেসি তখন খুবই ছোটো। মা-বাবার সঙ্গে সমুদ্রে। স্নান করতে গিয়েছে। বাবার কাঁধ থেকে নামতেই চাইছে না। বাবা বলেছিল–ছেলেমানুষি করো না ট্রেসি, ঝপাং করে ট্রেসিকে জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। এখনো চোখ বন্ধ করলে সেই হাবুডুবু খাওয়া মুহূর্ত ভেসে ওঠে। তখন থেকে ট্রেসিকে একা একা লড়াই করতে হয়েছে।

ফিলাডেলফিয়ার ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়ে গিয়েছিল বান্ধবী অ্যানি মাহোলেরের তদবিরে। সেখানে চার্লসের সঙ্গে দেখা হল। তারপরের ঘটনাগুলো, না, ঠিকমতো সাজাতে পারছে না।

কনস্টেবলের কর্কশ কণ্ঠস্বরে সম্বিত ফিরে এল ট্রেসির কী হয়েছে মেমসাহেব, কথাটা কি আমার কানে যাচ্ছে না? রুলের এক গুঁতো দিতে হবে নাকি?

ভ্যান দাঁড়িয়ে। সবাই নেমে গেছে। কী আশ্চর্য, ট্রেসি এতক্ষণ এখানে একা বসে আছে? গার্ড চেঁচাল, পোঁছে গেছি।

নরকে, আপন মনে বলে ফিক করে হেসে ফেলল ট্রেসি। কী আশ্চর্য, দুঃখের এই। সজল মুহূর্তেও মানুষ তাহলে হাসতে পারে?

.

৫.

নতুন আসা কয়েদীদের মেট্রন উপদেশ দিচ্ছেন, মহিলার চেহারা গাঁট্টাগোট্টা। মুখের ভাব পাথরের মতো। দেখলেই মনে হয়, উনি কখনো হাসেননি, চুল ধূসর সাদা রং করানো। উনি বললেন–তোমাদের এখানে অনেকদিন থাকতে হবে। বাইরের জগতের কথা একেবারে ভুলে যাবে। এখানে সব কিছু নির্দিষ্ট নিয়মনীতিতে বাঁধা। নিয়ম ভাঙলে মুশকিল। কাকে কীভাবে শায়েস্তা করতে হবে সব আমার জানা আছে।

কথা বলতে বলতে একবার ট্রেসির দিকে তাকালেন মেট্রন। আগে তোমার ডাক্তারি পরীক্ষা হবে। তারপর চান করানো হবে। এসব চুকে গেলে তুমি কোন্ সেলে থাকবে, তা ঠিক করা হবে। কাল সকাল থেকে কাজ পাবে। ঠিক আছে?

ফ্যাকাশে মুখের একটি মেয়ে বোধহয় কিছু বলতে চাইছে। সে বলল–মাফ করবেন, দয়া করে…

মেট্রন ঘুরে দাঁড়ালেন। চোখে কর্কশ চাউনি ফুটে উঠল। মুখের কথায় খিস্তির তুবড়ি দিয়ে বললেন,–চুপ কর হারামজাদি ছুঁড়ি, নিজের থেকে একটা কথাও বলবি না। সব কটা মাগীর সম্পর্কে একই কথা। কেউ যদি কিছু বলার চেষ্টা করে তাহলে পেছনে এই রুলের গুঁতো ঢুকিয়ে দেব।

ভাষা এবং কথার সুর ট্রেসি ভাবতেই পারছে না, এই কুত্তিগুলিকে নিয়ে যা, দুজন মহিলা পাহাড়াদারকে নির্দেশ দিয়ে মেট্রন চলে গেলেন।

কয়েদীদের নিয়ে যাওয়া হল সাদা টালি বসানো একটা লম্বা ঘরে। টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন মাঝবয়েসী মোটা-সোটা একজন ভদ্রলোক। তিনি বোধহয় সকলের ডাক্তারি পরীক্ষা করবেন।

কয়েদীদের লাইনে দাঁড় করানো হল। ভদ্রলোক বললেন আমি ডাঃ গ্লাসকো। তোমরা সবাই কাপড়-জামা খুলে ল্যাংটো হয়ে দাঁড়াও।

কী করতে হবে বুঝতে না পেরে মেয়ে কয়েদীরা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।

একজন বলল–কতটা খুলতে হবে?

এবার দাঁত মুখ খিঁচিয়ে উঠলেন ডাঃ গ্লাসকো। তিনি বললেন–ল্যাংটো বলতে কী বোঝায়, তা কি আবার শেখাতে হবে?

কেউবা উদাসীনের মতো পোশাক খুলতে লাগল। কেউ রাগে গড়গড় করতে করতে সায়ার গিঁটে হাত দিল। কেউ তখন খুব বেশী সাহসী হয়ে উঠেছে।

লাইনের প্রথম মহিলাকে ডাক্তার টেবিলের ওপর শুয়ে পড়তে বললেন। তারপর একটা যন্ত্র তার দুপায়ের ফাঁকে ঢুকিয়ে দিলেন নির্মমভাবে। প্রশ্ন করলেন–খারাপ লোগ আছে নাকি? বলো তো খুকুমনি? না হলে যন্ত্রটা আরো ভেতরে ঢুকিয়ে দেব। তখন হ্যাঁ কেঁ করতে পারবে না।

মহিলা বলল–না।

–আছে কিনা তা শীগগিরই ধরা পড়বে। দ্বিতীয় মহিলাটিকেও ওই এক যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করা হবে। কী অদ্ভুত এখানকার নিয়মনীতি। স্বাস্থ্যরক্ষার কোনো বিধি মানা হয় না।

ট্রেসি চিৎকার করে বলল–যন্ত্রটা একবার ডেটল দিয়ে ধুয়ে নিন স্যার।

ডাক্তার গ্লাসকো নিষ্ঠুর ভাবে হাসলেন। সেই হাসির মধ্যে ফুটে উঠল নির্মমতার চিহ্ন।  তিনি বললেন, তোমার এসব স্বাস্থ্য রক্ষার বিধি জ্ঞান ভালোভাবে জানা আছে দেখছি। মানুষ খুন করতে পারো আর ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়? যাও, তুমি লাইনের একেবারে শেষে গিয়ে দাঁড়াও।

উলঙ্গ ট্রেসি হেঁটে চলেছে। চারপাশে আরো ল্যাংটো মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে। এমন একটা দৃশ্য যে কোনোদিন তাকে দেখতে হবে, সে সেটা স্বপ্নেও ভাবেনি। সে একেবারে লাইনের শেষ প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াল। দাঁতে দাঁত চেপে সব অপমান এখন সহ্য করতে হবে। মলদ্বারে আঙুল পুরে ডাক্তার দেখতে চাইলেন, সেখানে জোর করে কেউ কোকেন কিংবা গাঁজার পুরিয়া ভরে রেখেছে কিনা। তখন প্রায় বমি পেয়ে গিয়েছিল ট্রেসির। সঙ্গে সঙ্গে সে শুনতে পেল অদ্ভুত মন্তব্য। মেট্রন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছিলেন। তিনি চিৎকার করে বললেন, বমি করলে তোকে দিয়েই সেই বমি সাফ করাব। চেটে চেটে তোর বমিটা খেতে হবে নিজেকে।

ওখান থেকে ছাড়া পেয়ে সকলে বাথরুমে গেল। অনেকগুলো শাওয়ার আছে। প্রত্যেককে শ্যাম্পু করে চান করতে হল। এবার ওদের পাঠানো হল পোশাকের ঘরে। প্রত্যেককে দেওয়া হল ধূসর রঙের কয়েদীর পোশাক। দুটো জুতো, দুটো নাইট গাউন আর দুটো ব্রেসিয়ার। চুল আঁচড়াবার জন্যে একটা করে ব্রাশ দেওয়া হল। এবার কয়েদীদের পোশাক পরে তারা গেল পাশের ঘরে। সেখানে সকলের আলাদা ফটো তোলা হল। আঙুলের ছাপ নেওয়া হল। ট্রেসির মনে হল, এখন থেকে সে আর কোনো নামে পরিচিত হবে না, তার নামের পাশে একটা নম্বর পড়ে গেছে। তখনই হঠাৎ মৃত মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। মর্গে শোয়ানো মায়ের পায়ের তলায় লোহার চাকতিতে একটা নম্বর ঝুলছিল। তার মানে সে আর মা দুজনেই এখন মানবীসত্তা থেকে নম্বরে পৌঁছে গেছে!

একজন গার্ড এসে ট্রেসির নাম ধরে ডাকল। তাকে বলল–ওয়ার্ডেন তোমাকে ডাকছেন।

কথাটা কানে যেতেই ট্রেসির মন আনন্দে নেচে উঠেছে। নিশ্চয়ই চার্লস এর মধ্যে এখানে এসেছে। প্রায় হাওয়ায় উড়তে উড়তে সে এল ওয়ার্ডেনের কাছে। আঃ, চার্লসের রাগ পড়ে গেছে। আমি যে অপরাধী নই, এই খবরটা সবাই জানতে পেরেছে, তা হলে আমি কি মুক্তি পাব?

লম্বা বারান্দা দিয়ে সে তখন উড়তে উড়তে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে, হঠাৎ ছ ফুট লম্বা একটা নারীদৈত্যের সঙ্গে ধাক্কা লাগল তার। ট্রেসিকে বুকের মাঝে জাপটে ধরে সেই বিশাল আকারের মহিলা ট্রেসির গার্ডকে বলল–এই চিড়িয়াটাকে কোথায় পেলে? একে আমার সঙ্গে রাখছো না কেন?

মহিলাটির কথায় সুইডিশ টান সুস্পষ্ট। তার বিকট চেহারা দেখে ট্রেসি আহত আর্তনাদ করার চেষ্টা করে।

–না বার্থা, ওকে অন্য সেলে দেওয়া হবে।

বার্থা নামের মহিলাটি ইতিমধ্যেই ট্রেসির শরীরের এখানে সেখানে চোরাগোপ্তা হাতের আক্রমণ চালাতে শুরু করেছে। ট্রেসি ছিটকে সরে দাঁড়াল। ঘেন্নায় তার বমি পাচ্ছে।

মহিলা বলল ঠিক আছে, ঠিক আছে ছুকড়ি। বার্থা তোর সঙ্গে পরে দেখা করবে। অনেক সময় আছে। তুই তো আজ বাদে কাল ডানা মেলে আকাশে উড়তে পারবি না।

ওয়ার্ডেন জজ ব্র্যানিগান তার অফিসে বসে এক গাদা কাগজপত্র দেখছিলেন। বয়স চুয়াল্লিশ কিংবা পঁয়তাল্লিশ বছর হবে। বেশ সৌম্য শান্ত চেহারা।

পাঁচ বছর আগে নানা আদর্শকে সম্বল করে এখানে এসেছিলেন ব্রানিগান। কিছুদিনের মধ্যে বুঝতে পেরেছিলেন, নামে সংশোধনাগার হলে কী হবে, কারা চরিত্র সংশোধনের বিন্দু মাত্র সুযোগ সুবিধা এখানে নেই। বরং যেটুকু চারিত্রিক সততা অবশিষ্ট থাকে, চার দেওয়ালের মধ্যে এলে তাও ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। যখন এখান থেকে কেউ ছাড়া পেয়ে বাইরের পৃথিবীতে বেরোয়, তখন সে সত্যি সত্যি নির্মম এক হত্যাকারীতে পরিণত হয়। অর্থাৎ সমস্ত সেল তার মান্ধাতা আমলের নিয়মনীতিতেই চলবে। আগে একটা সেলে দুজন করে রাখা হত। এখন চার থেকে ছজন পর্যন্ত কয়েদীকে ছাগল ঠাসার মতো ঠেসে দেওয়া হয়।

ওয়ার্ডেন কয়েদীর পোশাক পরা ট্রেসিকে ভালো করে লক্ষ্য করতে লাগলেন–আহা, কী নিষ্পাপ মুখখানা। কাগজে ট্রেসির সব কথাই শুনেছেন ব্র্যানিগান। এই ধরনের প্রথম অপরাধেও পনেরো বছরের শাস্তি! না, ব্যাপারটার মধ্যে বাড়াবাড়ি আছে বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য যেখানে জোসেফ রোমানো যুক্ত, সেখানে হয়তো এমনটি ঘটা অস্বাভাবিক নয়। ওয়ার্ডেন রোমানোকে হাড়ে হাড়ে চেনেন। ট্রেসির সাজার মেয়াদ দেখে তিনি অবাক হয়েছেন। কিন্তু মুখ ফুটে আপত্তি জানাবেন কী করে?

–বসো, তোমার কাগজ পত্র দেখছিলাম।

ট্রেসির মনে হল, চার্লস নিশ্চয়ই সব কথা বলেছে।

ভদ্রলোক বলে চললেন–দেখতে পাচ্ছি, তুমি বেশ কিছুদিন এখানে থাকবে। তোমাকে তো পনেরো বছরের জেল দেওয়া হয়েছে।

ট্রেসি এসব কথা শুনে ঘাবড়ে গেল। স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবটা মিলছে না কেন? বোকার মতো সে প্রশ্ন করল–স্যার, একটা কথা জানতে চাইব, যদি আপনি কিছু মনে না করেন। আপনার সঙ্গে চার্লসের কথা হয়নি?

–চার্লস? সে আবার কে? ওয়ার্ডেন বোকার মতো তাকালেন।

ট্রেসি দুঃখের সাগরে ডুবে বলল দেখুন স্যার, আমি নির্দোষ। এর আগে সব কয়েদীদের মুখ থেকে একই কথা ওয়ার্ডেনকে শুনতে হয়েছে।

–আদালত তোমাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। আমি তোমাকে একটাই উপদেশ দিতে পারি, জীবনের এই দুঃখজনক অধ্যায়টাকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নাও। পনেরো বছর কম নয়, জেলে কিন্তু কোনো ঘড়ি থাকে না। এখানে শুধু ক্যালেন্ডার থাকে।

পনেরো বছর আমি নিশ্চয়ই এখানে থাকব না। তার আগে মরে যাব, কিন্তু পেটের ছেলে? তার কী হবে? সেই মুহূর্তে চার্লসকে ভীষণ ভীষণ ঘেন্না করতে ইচ্ছে হল ট্রেসির।

–তোমার যদি তেমন কোনো অসুবিধা হয়, ওয়ান ব্র্যানিগান বলতে থাকলেন, তাহলে আমাকে জানাবে।

মুখে আশ্বাস দিলেও ব্র্যানিগান জানেন, তার হাত পা বাঁধা, তিনি তো আর সেলের মধ্যে ঢুকে ব্যবস্থা করতে পারবেন না। মেয়েটি সুন্দরী এবং যুবতী। প্রত্যেকটা সেলে একটা করে যৌন বুভুক্ষু নারী কয়েদী আছে। এমন সুন্দরী মেয়ে দেখলে সমকামিতার চূড়ান্ত করবে। এমন একটাও সেল নেই, যেখানে মেয়েটা নিরাপদে থাকতে পারে। ওয়ার্ডেন এইসব ধর্ষণের নানা ঘটনা নিজের কানে শুনেছেন। চান করার ঘরে, বাথরুমে বারান্দায়, সর্বত্র ঘটে চলেছে সমকামিতার ঘটনা। হাতে-নাতে কাউকে ধরা যায় না। ধর্ষিতারা কেউ অভিযোগ করতে সাহস পায় না। তাদের চুপ করে থাকতে হয়, না হলে প্রচণ্ড মারের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে।

–ভালোভাবে থাকলে বারো বছরে ছাড়া পেয়ে যাবে। ওয়ার্ডেন ব্র্যানিগানের এই কথা শুনে ট্রেসি চিৎকার করে বলতে থাকে, না-না, বারোবছর…অতদিন আমি বাঁচব না।

গার্ড ছুটে এসে ট্রেসিকে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল। তার দিকে অসহায়ের চোখে তাকিয়ে থাকলেন ওয়ার্ডেন ব্র্যানিগান। কতবার তিনি ভাবেন, এই চাকরি আর করবেন না। কিন্তু বাড়িতে গিয়েই তার মন পাল্টে যায়। পেটের টান বড়ো টান, তার জন্য মানুষ কত কী করে, আর এ তো বসে বসে মিথ্যে আশ্বাস বাক্য বলা।

এ বারান্দা সে বারান্দা করে নানা কয়েদীদের সেলের পাশ দিয়ে ট্রেসিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সাদা চামড়ার মানুষ ছাড়াও নিগ্রো, চীনা বন্দিনী ছিল অনেক। সেখান থেকে নানা ধরনের মন্তব্য ভেসে আসছিল। কিন্তু কিছু কথার অর্থ সে একেবারে বুঝতে পারছে না।

কে যেন তাকে দেখে হো হো করে হেসে উঠল। কে বলল, আহা, প্রথম রাত।

পাশের ঘর থেকে কেউ বাকিটা বলে দিল–ফরাসী সঙ্গী।

তৃতীয় জনের কণ্ঠে তখন বেসুরো গান সুর হয়ে বেজেছে–তাজা প্রাণ।

…অঙ্গে অঙ্গ…

শেষ পর্যন্ত ট্রেসি বুঝতে পারল, ওরা সকলে একটি কথাকে বারবার বলতে চাইছে। তা হল টাটকা তাজা মাংস…

« পূর্ববর্তী:
পরবর্তী: »
০৬-১০. জেলখানার সি ব্লকে »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি – জোক্স – লিরিক – রেসিপি – কামসূত্র – হেলথ – PDF

Return to top