প্রার্থনা

প্রার্থনা

(১৩৫০/১৯৪৩)

রাম চাকরির জন্য দরখাস্ত পাঠিয়েছে। রামের মা তার মাথায় একটি টাকা ঠেকিয়ে মনে মনে মা কালীর কাছে মানত জানিয়ে টাকাটি বাক্সে তুলে রাখলেন। এই মানত যদি ভাষায় বিস্তারিত করা যায় তবে এইরকম দাঁড়ায়।–হে মা কালী, চাকরিটি আমার রামকে দিও। ছেলের বিয়ে দিয়েছি, এখন রোজগার না করলে চলবে কেন। মা, আমি শুধু হাতে তোমার কাছে আসিনি, এই দেখ একটি টাকা নজর দিচ্ছি। আমার ছেলে প্রথম মাইনে পেলেই তা থেকে যা পারি খরচ করে তোমার পুজো দেব, এই টাকাটি তারই বায়না।

সম্ভবত রামের মায়ের মনের কথা শুধু এইটুকু, কিন্তু যদি সাবধানে জেরা করা হয় তবে তার অন্তরের গহন প্রদেশ থেকে আরও কিছু বার হবে। এই জেরা আপনার আমার সাধ্য নয়, কারণ রামের মা ধর্মশীলা, ঠাকুর দেবতার ব্যাপারে কোনও আজগবী প্রশ্ন করলেই তিনি ক্ষেপে উঠবেন। তাঁকে জেরা করতে পারেন কেবল একজন, স্বয়ং মা কালী। দেবীকৃত প্রশ্নের অর্থ বোঝবার শক্তি হয়তো রামের মায়ের নেই, তিনি ঘাবড়ে গিয়ে বলতে পারেন–মা, আমি মুখখু মানুষ, কি বলছ কিছুই বুঝছি না, অপরাধ নিও না। ধরে নেওয়া যাক যে মা কালী নাছোড়বান্দা, তিনি রামের মায়ের বোধগম্য ভাষায় জেরা করছেন এবং আমাদের বোধগম্য ভাষায় তা প্রকাশ করছেন।–

হ্যাঁগা রামের মা, ওই যে টাকাটা ছেলের মাথায় ঠেকিয়ে তুলে রাখলে, ওটা কার জন্যে?

তোমারই জন্যে মা। শুধু একটি টাকা নয়, চাকরিটি হলে আরও অনেক কিছু দেব।

চাকরি যদি না হয় তা হলেও টাকাটা আমায় দেবে তো?

তা কি আর দিতে পারি মা, গরিব মানুষ। চাকরিটি হলে গায়ে লাগবে না।

ও, আমাকে লোভ দেখাবার জন্যে টাকাটা বার করেছ?

সেকি কথা মা! এই যে দরখাস্ত করা ইস্তক রোজ মন্দিরে গিয়ে শ্রীচরণে পাঁচটি করে পঞ্চমুখী জবাফুল দিচ্ছি তা তো আর ফেরত নেব না।

চাকরি না হলেও রোজ ফুল দিয়ে যাবে?

তা কোত্থেকে দেব মা, পাঁচটি ফুল দু পয়সা।

ও, এই ফুলগুলো আমাকে ঘুষ দিচ্ছ?

ঘুষ বলতে নেই মা, বল পুজো।

আচ্ছা রামের মা, শুনেছ বোধ হয় যে এই চাকরিটার জন্য দু হাজার দরখাস্ত পড়েছে। তোমাদের তো কিছু বিষয় সম্পত্তি আছে, যেমন করে তোক। চলে যাচ্ছে। কিন্তু রামের চেয়ে গরিব উমেদার অনেক আছে, তাদের কেউ যদি চাকরিটি পায় তবে খুশী হও না?

এ যে ছিষ্টিছাড়া কথা মা। থাকলই বা গরিব উমেদার, আমার ছেলে আগে না যেদো মেধো আগে?

আচ্ছা, ওই যে চৌধুরীরা আছে, মস্ত বড়লোক, তাদের মেজো ছেলে হারু যদি চাকরিটা পায় তো কেমন হয়? তার মা এর মধ্যেই ঘটা করে আমার পুজো দিয়েছে।

তা হেরোকে চাকরি দেবে বইকি মা, তারা যে বড়লোক, তোমাকে অনেক ঘুষ খাইয়েছে।

অর্থাৎ তোমার ঘুষ খেয়ে যদি আর সবাইকে ফাঁকি দিই তাতে তুমি খুশী হবে, আর যদি অন্যের ঘুষ খেয়ে তোমাকে ফাঁকি দিই তবে চটবে। আচ্ছা, এত লোক যখন উমেদার, আর অনেকেই আমার কাছে মানত করেছে, তখন চাকরিটা কাকে দেওয়া যায় বল তো? একচোখা হয়ে রামকেই দিতে বল নাকি?

তাই বলছি মা।

কিন্তু সকলেই তো একচোখা হতে বলছে, কার দিকে চোখ দেব?

অত শত জানি না মা, যা ভাল বোঝ কর।

তাই তো চিরকাল করি।

.

চারুবালা শিক্ষিত মহিলা, রামের মায়ের মতন তার অন্ধ সংস্কার নেই। তিনি আগে ভগবানের খোঁজখবর নিতেন না, কিন্তু সম্প্রতি বিপদে পড়ে প্রার্থনা করছেন।–ভগবান, আমার স্বামীকে রোগমুক্ত কর। লোকটা আমাকে অনেক জ্বালিয়েছে, কিন্তু এখন আর আমার কোন রাগ নেই, সে সেরে উঠুক–শুধু এইটুকুই চাই। যদি মরে যায় তবে আমার সর্বনাশ হবে, ছেলেমেয়েরা খাবে কি? গয়না বাড়ি জিনিসপত্র সব বেচে ফেলতে হবে। দয়াময়, আমি অন্যায় আবদার করছি না, কাকেও বঞ্চিত করে নিজের ভাল চাচ্ছি না। শুধু আমার স্বামীকে সারিয়ে দাও, তাতে বিশ্বসংসারের কোনও ক্ষতি হবে না।

এবারেও সওয়াল-জবাব আমরা কল্পনা করতে পারি।–

আচ্ছা চারুবালা, তুমি কি করে জানলে যে তোমার স্বামী বেঁচে উঠলে কারও ক্ষতি হবে না? সে মরলেই তার চাকরিটা যোগেন ঘোষাল পাবে, বেচারা অনেক কাল আশায় আশায় আছে। আর তোমাদের এই বাড়িটার উপর চৌধুরীদের নজর আছে, তোমরা নিরুপায় হলেই তারা সস্তায় কিনে নেবে।

ভগবান, এমন সাংঘাতিক কথা বলতে তোমার মুখে বাধল না?

কিছুমাত্র না। তুমি এই যে রেশমী শাড়িটা পরে আছ তার জন্য কতগুলো পোকার প্রাণ গেছে জান?

পোকার আবার প্রাণ! লক্ষ পোকার প্রাণের চেয়ে আমার একটু সাধ। আহ্লাদ কি বড় নয়?

নিশ্চয়ই বড়। আমার সাধ আহ্লাদও কোটি কোটি মানুষের প্রাণের চেয়ে বড়।

পোকা মরলে আমার একটি চমৎকার শাড়ি হয়। মানুষ মরলে তোমার কি লাভ হয় শুনি?

তোমার তা বোঝবার শক্তি নেই। পোকা কি শাড়ির মর্ম বোঝে?

কি নিষ্ঠুর! লোকে তোমাকে দয়াময় বলে কেন?

তুমিও তো একটু আগে দয়াময় বলে ডাকছিলে, তোমার স্বামীর যদি মৃত্যু হয় তা হলেও দয়াময় বলে ডাকবে। হয়তো আশা কর যে বার বার দয়াময় বললে সত্যিই আমার দয়া হবে।

.

সংকটে পড়লে অধিকাংশ লোকের দৈবের উপর নির্ভর বাড়ে। অশিক্ষিত জন কবচ মাদুলি হোম স্বস্ত্যয়ন প্রভৃতির শরণ নেয়, শিক্ষিত জন ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে। সাধারণের ধারণা মাদুলি স্বস্ত্যয়নের মতন প্রার্থনারও শক্তি আছে। হোমিওপ্যাথিভক্তরা বলে থাকেন, যদি ঠিক মতন ওষুধ পড়ে তবে রোগ সারতেই হবে। প্রার্থনাবাদীরা বলেন, যদি ডাকার মতন ডাকতে পার তবে ভগবানকে সাড়া দিতেই হবে। বিশ্বাসের সঙ্গে লজিক বা স্ট্যাটিস্টিসের সম্পর্ক নেই। যে বিশ্বাসী সে আশা করে যে তার ওষুধ বা প্রার্থনাটি লাগসই হতেও পারে।

যে উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য তুকতাক অথবা প্রার্থনা করা হয় তা ন্যায্য কি অন্যায্য ভাববার দরকার হয় না। সেকালে ডাকাতরা যাত্রার আগে কালীপূজা করত। উচ্চাটন মারণ প্রভৃতি অভিচারের চলন এখনও আছে। যারা বিপক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মকদ্দমা আনে তারাও দেবতার কাছে মানত করে। যে ছাত্র পরীক্ষায় প্রথম হতে চায়, যে তোক দুহাজার উমেদারকে নিরাশ করে চাকরিটি বাগাতে চায়, যে মেয়ে প্রতিযোগিনীদের হারিয়ে দিয়ে সদ্য আগত আই সি এসকে গাঁথতে চায়, তাদেরও অনেকে প্রার্থনা করে বা দৈবশক্তির শরণ নেয়। এরা কেউ মন্দ লোক নয়; রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি–এই প্রার্থনা সাধারণ মানুষের পক্ষে খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এমন ধারণা কারও নেই যে ভগবান ন্যায়বিচার করবেন, যোগ্যতম ব্যক্তিকেই করুণা করবেন। অধর্মের জয় আর ধর্মের পরাজয় যখন প্রত্যহ ঘটতে দেখা যাচ্ছে তখন ন্যায় অন্যায়ের চিন্তা না করে স্বার্থসিদ্ধির জন্য ভগবানকে ধরতে দোষ কি? যদি মাদুলি বা স্বস্ত্যয়ন বা প্রার্থনার মাহাত্ম্য থাকে তবে উদ্দেশ্য ভাল কি মন্দ তা ভাববার দরকার নেই।

সাধারণত ব্যক্তিগত প্রয়োজনেই দৈবসাহায্য চাওয়া হয়, কিন্তু বিপদ যখন দেশব্যাপী হয় তখন লোকে সমবেতভাবে দেবতাকে প্রসন্ন করবার চেষ্টা করে। প্লেগ বসন্ত প্রভৃতি মহামারীর সময় হোমগ নগরসংকীর্তন, মন্দিরাদিতে বিশেষ উপাসনা প্রভৃতির ব্যবস্থা করা হয়। গভর্নমেন্ট এসব ব্যাপারে নির্লিপ্ত থাকেন, কিন্তু বর্তমান যুদ্ধের মহাভয়ে গভর্নমেন্টেরও নাস্তিক্য দূর হয়েছে। মাঝে মাঝে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সকল প্রজার উপর হুকুম আসে অমুক দিনে সকলে মিলে নিজ নিজ ধর্ম অনুসারে ঈশ্বরের সাহায্য প্রার্থনা কর। সম্ভবত গভর্নমেন্টের কর্ণধারগণ বিশ্বাস করেন যে ভগবান এত লোকের অনুরোধ ঠেলতে পারবেন না, অথবা মনে করেন যে ভগবানের দয়া না হলেও প্রজার মনে কতকটা ভরসা আসবে।

আমাদের দেশে অল্পসল্প পাষণ্ড আছে, কিন্তু তারা সংযত, বেশী কথা বলতে সাহস করে না। বিলাত সর্ববিষয়ে স্বাধীন দেশ, সেজন্য সেখানকার পাষণ্ডদের মুখের বাঁধন নেই। সেখানে গির্জায় গির্জায় যুদ্ধজয়ের জন্য নিয়মিত প্রার্থনা ছাড়াও সরকারী হুকুমে বিশেষ বিশেষ দিনে বড়রকম উপাসনা হয়। বিলাতী পাষণ্ডরা বলে–এ বড় আশ্চর্য কথা, যখনই বিশেষ উপাসনার ব্যবস্থা হয় তখনই বোমাবর্ষণ বাড়ে, আর যে গীর্জায় বেশী উপাসনা হয় বেছে বেছে তাতেই বোমা পড়ে। আমাদের পাদ্রীরা ভগবানের কাছে শত্রুপক্ষের নামে অনেক লাগাচ্ছেন, আর আমরা যে নির্দোষ, অনিচ্ছায় যুদ্ধে নেমেছি, একথাও বার বার বলছেন। কিন্তু শত্রুপক্ষের পাদ্রীরাও তো ঠিক এইরকম বলছে, আমাদের দুতিনশ বৎসরের অপকর্মের ফর্দ ভগবানকে শুনিয়ে শুনিয়ে তার কান ভারী করছে। ভগবান কার কথা শুনবেন?

বিলাতের যাজকসম্প্রদায় খুব সতর্ক। তারা বোঝেন যে তাদের অনেক যজমান এখন স্বজাতির সমালোচনা করে এবং স্পষ্ট কথা বলে, সুতরাং ভগবানের কাছে এই বাঁধাধরা মামুলী মন্ত্রে প্রার্থনা করা আর চলবে না।–’Save and deliver us, we humbly beseech Thee, from the hands of our enemies; abate their pride, asauage their malice, and confound their devices; that we, being armed with Thy defence, may be preserved evermore from all perils, to glorify Thee, who art the giver of all victory।‘ সুন্দর রচনা, কিন্তু সরল আর নিষ্পাপ না হলে কি এমন প্রার্থনা করা চলে?

সম্প্রতি আর্কবিশপ অভ ক্যান্টারবেরি এক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘আমরা এ প্রার্থনা করব না–ঈশ্বর, আমাদের অভীষ্ট সিদ্ধ কর; শুধু বলব–তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক। আমাদের প্রার্থনা সমস্ত জগতের হিতার্থ, ঈশ্বরের উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্যই তা করব, নিজের ইচ্ছাপূরণের জন্য নয়।

পাষণ্ডরা এতেও ঠাণ্ডা হয় না। বলে–ঈশ্বর তোমাদের তোয়াক্কা রাখেন না, তোমরা প্রার্থনা কর আর না কর, উদ্দেশ্যসিদ্ধি হবেই।

পাদ্রীদের কাছে যুক্তি আশা করা বৃথা, তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে শাসনতন্ত্রের সঙ্গে জড়িত, সুতরাং আবশ্যক মত তাদের কূটনীতি আশ্রয় করতে হয়। তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হোক–এই প্রার্থনা অতি পুরাতন, বহু দেশের ভক্ত আর জ্ঞানী বহু ভাষায় এই বাক্য বলেছেন। কিন্তু সাধারণ প্রয়োগে এর মূল অভিপ্রায় লুপ্ত হয়েছে।

সামান্য লোকে (মায় বেতুনভু যাজক) যখন এই বাক্যটি বলে তখন জানাতে চায় যে ভগবানের ইচ্ছাই তার ইচ্ছা। হিন্দুর অনেক ক্রিয়াকর্মে কর্মফল বাক্যত শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ করা হয়। কিন্তু স্বার্থকামনা সর্বত্রই উহ্য থাকে। আশ্রিত জন যখন ক্ষমতাশালী প্রভুকে তুষ্ট করে কাজ উদ্ধার করতে চায় তখন বলে–হুঁজুরের উপর কথা বলবার আমি কে? হুজুর সবই বোঝেন, সব খবর রাখেন, এই গরিবের অবস্থাটা ভাল রকমই জানেন। আপনার দ্বারা কি অবিচার হতে পারে? যা হুকুম করবেন মাথা পেতে নেব। আমাদের কথক-ঠাকুররাও দরবারী ভাষা জানেন, তাঁরা বিপন্ন প্রহ্লাদকে দিয়ে বলান–আমি মরি তাহে ক্ষতি নাহি হে, তোমার দয়াময় নামে যে কলঙ্ক হবে! ভগবানকে যখন বলা হয়–তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হোক, তখন সাধারণ প্রার্থীর মনে এই গূঢ় কামনা থাকে–ভগবান আমার ইচ্ছা অনুসারেই কাজ করুন।

এই প্রার্থনাবাক্য যাদের মুখ থেকে প্রথমে বেরিয়েছিল তাদের কোন প্রচ্ছন্ন অভিপ্রায় ছিল না। নিষ্কাম ভক্ত এবং জ্ঞানী এখনও বলেন তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হোক। এই বাক্যে কিছু রূপক আছে, বক্তার বিশ্বাস অনুসারে তার বিভিন্ন ব্যাখ্যা হতে পারে। কিন্তু রূপকের আবরণ ভেদ করলে শুধু এই অর্থই পাওয়া যায়- আমি অভিষ্টসাধন বা বিপদদ্বারণের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। আমার সফলতা বা বিফলতা দৈবাধীন অর্থাৎ অজ্ঞাতপূর্ব, যা ঘটবে তাই ঈশ্বরের ইচ্ছা বা বিধাতার বিধান বা নিয়তি। সেই নিয়তি মেনে নেবার এবং সইবার শক্তি আমার আসুক। তার জন্যই প্রার্থনা করছি, অর্থাৎ উদ্বুদ্ধ হবার জন্য বার বার নিজেকেই বলছি– হে আমার আত্মা, ক্ষুদ্রতা পরিহার কর, সুখদুঃখে লাভালাভে জয়জয়ে অবিচলিত থাক, বিশ্বাত্মার যে সর্বব্যাপী সমদৃষ্টি তা তোমাতে সঞ্চারিত হোক।