তিমি

তিমি

(১৩৪৯/১৯৪২)

আধুনিক প্রাণীদের মধ্যে তিমি সব চেয়ে বড়। এই জন্তুটি মহাকায়, কিন্তু সাধারণত ক্ষুদ্রভোজী, ছোট ছোট মাছ শামুক ইত্যাদি খেয়েই জীবনধারণ করে। পুরাণে আর একরকম জলজন্তুর উল্লেখ আছে–তিমিংগিল, যারা এত বড় যে তিমিকে গিলে খায়। পৌরাণিক কল্পনা এখানেই নিরস্ত হয় নি, তিমিংগিলেরও ভক্ষক আছে, যার নাম তিমিংগিলগিল। ততোধিক গিলগিলান্ত নামধারী জন্তুরও উল্লেখ আছে। পুরাণকর্তাদের প্রাণীবৃত্তান্ত যতই অদ্ভুত হোক, তারা মাৎস্যন্যায় বা power politics বুঝতেন।

জন্তুর মধ্যে যেমন তিমি, দেশের মধ্যে তেমন আফ্রিকা ভারত চীন ইন্ডোচীন প্রভৃতি। এসব দেশ আকারে বৃহৎ, কিন্তু ক্ষুদ্রভোজী অর্থাৎ অল্পে তুষ্ট। এদের অল্পাধিক পরিমাণে কবলিত করে যারা সাম্রাজ্য স্থাপন করেছে। তারা তিমিংগিল জাতীয়; যেমন ব্রিটেন ফ্রান্স হল্যান্ড ইটালি জাপান। এইরকম পরদেশগ্রাস বহু যুগ থেকে চলে আসছে, অবশ্য কালক্রমে গ্রস্ত আর গ্রাসকের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সেকালের তিমিংগিলরা সরলস্বভাব ছিল, তারা বিনা বাক্যব্যয়ে গিলত, কোনও সাধু সংকল্পের দোহাই দিত না। রোমান হুন তুর্ক মোগল প্রভৃতি বিজেতারা এই প্রকৃতির। এই গ্রাসননীতি প্রাচীন ভারতেও কিছু কিছু ছিল, শরৎকাল পড়লেই পরাক্রান্ত রাজারা খামকা দিগবিজয়ে বার হতেন। কিন্তু তাঁদের অধিকাংশের দৌড় ছিল সংকীর্ণ, আশেপাশের গোটাকতক রাজ্য করায়ত্ত করেই নিজেকে সসাগরা ধরার অধীশ্বর ঘোষণা করতেন।

আধুনিক তিমিংগিলদের চক্ষুলজ্জা আছে, তারা স্বজাতির সমালোচনাকে কিঞ্চিৎ ভয় করে। তাই শ্বেতজাতির বোঝা, সভ্যতার বিস্তার, অনুন্নত দেশের উন্নতি, শান্তি ও সুনিয়ম প্রভৃতি বড় বড় কথা শোনা যায়। এই সব নীতিবাক্যে তিমিংগিলদের আত্মপ্রসাদ বজায় থাকে, তাদের মধ্যে যারা একটু সন্দিগ্ধ তারাও বেশী আপত্তি তুলতে পারে না। এই ধর্মধ্বজী তিমিংগিল সম্প্রদায়ের আধিপত্য এতদিন অবাধে চলছিল, কিন্তু সম্প্রতি একশ্রেণীর নবতর জীব গোলযোগ বাধিয়েছে, এরা তিমিংগিলগিল, যথা জার্মনি ও জাপান। এরা ভাবে পৃথিবীতে যত তিমি আছে সবই তো তিমিংগিলদের কবলে, আমরা খাব কি? অতএব প্রচণ্ড মুখব্যাদান করে তিমিংগিলদেরই গ্রাস করতে হবে। তাতে প্রথমটা যতই কষ্ট হোক অবশেষে যা পাওয়া যাবে তা একেবারে তৈরি সাম্রাজ্য, অন্যের চর্বিত খাদ্যের পুনশ্চর্বণ দরকার হবে না, মুখে পুরলেই পুষ্টিলাভ হবে। জার্মনি চায় সমস্ত ইওরোপ, জাপান চায় সমস্ত পূর্ব এশিয়া–পশ্চিম এশিয়া কার ভক্ষ্য হবে তা এখনও নির্ধারিত হয় নি। অবশ্য এর পর দুই গিলগিলের মধ্যেও বিবাদ বাধতে পারে। বিজয়ী জার্মনি যদি ফ্রান্স আর হল্যান্ড কবলস্থ করেই রাখে তবে এই দুই রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ইন্ডোচীন জাভা প্রভৃতি জাপানকে খোশমেজাজে ছেড়ে দেবে না। যদি এশিয়ার ঐশ্বর্য না মেলে তবে এমন মরণপণ যুদ্ধের সার্থকতা কি? বোধ হয় জার্মানি মনে করে যে ব্রিটেন আর আমেরিকাকে জব্দ করার পর জাপানকে সাবাড় করা অতি সহজ কাজ। সম্প্রতি একজন ব্রিটিশ জাঁদরেল বলেছেন, জাপানীরা বানর মাত্র। জার্মনিও মনে মনে তাই বলে! অবশেষে হয়তো কণ্টকেনৈব কণ্টকম্ উৎপাটিত হবে। ইটালি বেচারা উভয়সংকটে পড়েছে। সেও গিলগিল হতে চেয়েছিল, কিন্তু এখন তার গিলত্বও যেতে বসেছে। জার্মানি যদি জেতে আর দু একটা হাড় দয়া করে দেয় তবেই তার মুখরক্ষা হবে।

তিমিংগিলগিলদের চক্ষুলজ্জা নেই, কিন্তু তাদের ব্রত আরও মহৎ। জার্মনি বলে–সমগ্র পৃথিবী অতিমানব আর্যজাতির (অর্থাৎ তার নিজের) শাসনে আসবে এই হচ্ছে বিধাতার বিধান। জাপান একটু মোলায়েম সুরে বলে–হে এশিয়ার নির্যাতিত জাতিবৃন্দ, আমাদের পতাকাতলে এসে আমাদের সঙ্গে সমান সমৃদ্ধি লাভ কর।

মিত্রপক্ষীয় রাষ্ট্রনেতাদের যুদ্ধোত্তর সংকল্প কি তা স্পষ্ট করে ব্যক্ত হয় নি। ভারতবর্ষে আমেরিকার কোনও প্রত্যক্ষ স্বার্থ নেই। এদেশের সংবাদপত্রে আমেরিকান প্রেসিডেন্টের যে বাণী ঘোষিত হয়েছে তাতে চতুর্বিধ আশ্বাস আছে–বাক্য ও ধর্মের স্বাধীনতা, অভাব ও ভয় থেকে মুক্তি। কিন্তু যে স্বাধীনতা সকলের মূল তার উল্লেখ নেই। অস্পষ্ট উক্তির একটা কারণ-সংকল্পই স্থির হয় নি। আর একটা কারণ–এই সংকটকালে নিজের আন্তরিক অভিপ্রায় প্রকাশ করলে বন্ধুবর্গ চটতে পারে অথবা পরাধীন প্রজারা চঞ্চল হতে পারে। তথাপি ব্রিটেন আর আমেরিকার দুচারজন উচ্চাদর্শবাদী মাঝে মাঝে উদার কথা বলে ফেলেছেন, যথা–কোনও দেশ পরাধীন থাকবে না, স্বভাবজাত সম্পদে কোনও রাষ্ট্রের একচেটে অধিকার থাকবে না, সমগ্র মানবজাতির হিতসাধনই একমাত্র লক্ষ্য, জাপানী সহসমৃদ্ধি নয়, সর্বৰ্জাতিক সহসমৃদ্ধি।

উত্তম সংকল্প। কিন্তু জগতে ধর্মরাজ্যস্থাপনের ভার যাঁরা নেবেন, তাদের কার্যক্রম কি? অপ্রতিহত ক্ষমতা হাতে পেলে তাদের মতিগতি কি হবে বলা যায় না। ধরা যাক তাঁরা নিষ্কাম, সমদর্শী, সর্বলোকহিতৈষী, তথাপি মানুষের বর্তমান অভিজ্ঞতা আর সাধারণ বুদ্ধির বশেই তাঁরা চলবেন এবং ভুলও করবেন। তাদের পন্থা কল্পনা করে দেখা যেতে পারে।

তাদের প্রথম করণীয় হবে–পৃথিবীর সমস্ত জাতিকে নিজের সুবুদ্ধি দান করা। সম্রাট অশোক সিরিয়া ইজিপ্ট গ্রীস প্রভৃতি দেশবাসীর হিতার্থে ধর্মপ্রচারক পাঠিয়েছিলেন। এই প্রচারের অন্তরালে কোনও দুরভিসন্ধি ছিল না। অশোকের দূতরা বিদেশে রাজ্যস্থাপন করে নি, নিগৃহীতও হয় নি। অনেক ইওরোপীয় রাষ্ট্র থেকেও পররাজ্যে প্রচারক গেছে, কিন্তু বহু স্থলে পরিণাম অন্যরকম হয়েছে। Germany acquired the province of Shantung in China by having the good fortune to have two missionaries murdered there. (Bertrand Russel)। অশোক শুধু ধর্ম প্রচারের চেষ্টা করেছিলেন, সে জন্য বাধা পান নি। কিন্তু বিশ্বরাষ্ট্রসংস্কারকদের উদ্দেশ্য সমস্ত দেশের আর্থিক ও রাজনীতিক উন্নতিসাধন, সুতরাং স্বার্থের সংঘাত হবে এবং বাধা ঘটবে। সদুপদেশ বা propaganda-ই প্রকৃষ্ট পন্থা, কিন্তু যেখানে তা খাটবে না সেখানে প্রহারই সনাতন উপায়, কারণ লোকের মত পরিবর্তনের জন্য অনন্তকাল অপেক্ষা করা চলবে না। প্রহার অবশ্য নিষ্কামভাবে সর্বজনহিতার্থে দেওয়া হবে, যেমন বাপ দুষ্ট ছেলেকে দেয়। তার পর কি হবে তা রাজনীতিক নেতাদের আধুনিক উক্তি থেকে আন্দাজ করা যেতে পারে, যথা–দুরন্ত জাতির সংযমন, নাবালক জাতির শিক্ষক ও রক্ষক নিয়োগ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, যুদ্ধোপকরণের সংকোচ, প্রাকৃতিক সম্পদের ন্যায্য বিভাগ, নূতন অর্থনীতিক ব্যবস্থা ইত্যাদি।

সব দেশ সমান নয়, সব মানুষও সমান নয়। এই অসমঞ্জস দূর করার উপায়–সর্বদেশের ঐশ্বর্য সর্বমানবের ভোগযোগ্য করা এবং সর্ব জাতিকে সমান শিক্ষিত করা। কিন্তু প্রথম উপায়টি সাধ্য হলেও দ্বিতীয়টি সহজ নয়। সকলের জ্ঞানার্জনক্ষমতা সমান না হতে পারে, হলেও শিক্ষাকালের বিলক্ষণ তারতম্য হতে পারে। কোনও ধনী লোকের যদি পাঁচটি ছেলে থাকে তবে সমান সুযোগ পেলেও সকলে কৃতী হয় না। বাপ যত দিন বেঁচে থাকেন ততদিন অপক্ষপাতে সকলকে সুখে রাখতে পারেন, কিন্তু তার অবর্তমানে অকৃতীরা কষ্ট পায়। অতএব বাপের বেঁচে থাকা দরকার। কিন্তু সমস্ত মানবজাতির পিতৃস্থানীয় কে হবে? যাঁরা সংস্কার আরম্ভ করবেন তাঁরা চিরকাল বাঁচবেন না, কোনও দলের দীর্ঘপ্রভুত্বও লোকে সইবে না। মনু প্রজাপতি, রাজচক্রবর্তী, ডিটেটার, অ্যারিস্টোক্রাসি, অলিগার্কি, প্রভৃতি সমস্তই এখন অচল। ডিমোক্র্যাসির উপর এখনও সাধারণের আস্থা আছে, কিন্তু কার্যত দেখা যায় যে জনকতক স্বার্থপর ধূর্ত লোকেই সকল দেশের রাষ্ট্রসভায় প্রবল হয়। এই দোষের প্রতিকার হবে যদি নির্বাচকমণ্ডল (অর্থাৎ জগতের বহু লোক) সাধু ও জ্ঞানবান হয়। শিক্ষার প্রসার হলে জ্ঞান বাড়বে, কিন্তু সাধুতা? এখানেই প্রবল বাধা।

সম্প্রতি Geoffrey Bourne একটি বই লিখেছেন-Return to Reason। এই বহুপ্রশংসিত বইটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে–ডাক্তার উকিল প্রভৃতির মতন পার্লামেন্টের সদস্যকেও আগে উপযুক্ত শিক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে, শুধু বাগ্মী আর দলবিশেষের প্রতিনিধি হলে চলবে না। কিন্তু কেবল বিদ্যাশিক্ষায় সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধি দূর হয় না, সাধুতাও আসে না।

সংঘবদ্ধ চেষ্টায় এবং বিজ্ঞানবলে বহু দেশ সমৃদ্ধ হয়েছে, সভ্যতা বেড়েছে, রোগ কমেছে। কিন্তু এসবের তুলনায় মানুষের চারিত্রিক উন্নতি যা হয়েছে তা নগণ্য। যেটুকু হয়েছে তা প্রাকৃতিক নিয়মে মন্থর অভিব্যক্তির ফলে, এবং পুণ্যাত্মা কবি ও সাহিত্যিকগণের প্রভাবে, রাষ্ট্রের বা বিজ্ঞানীর নিয়ন্ত্রিত চেষ্টায় হয়নি। বিজ্ঞানের প্রেরণা এসেছে মুখ্যত মানুষের স্বাভাবিক কৌতূহল থেকে এবং গৌণত ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা থেকে। অথচ যে স্বার্থ সর্বাপেক্ষা ব্যাপক তা বিজ্ঞান কর্তৃক উপেক্ষিত হয়েছে। চরিত্রতত্ত্ব বিজ্ঞানের বহির্ভূত নয়। ব্যক্তির চরিত্র শোধিত না হলে সমষ্টির পরম স্বার্থজ্ঞান আসবে না, নিষ্কলুষ প্রজাতন্ত্র তথা বিশ্বরাষ্ট্রব্যবস্থাও হবে না। সাম্রাজ্যবাদীরা মাঝে মাঝে enlightened self-interest-এর কথা বলেন, তার মানে–অধীন প্রজাকে বেশী শোষণ না করে এবং প্রতিপক্ষকে লাভের কিছু অংশ দিয়ে সুদীর্ঘকাল নিজের স্বার্থ বজায় রাখা। এরকম ক্ষুদ্র কুটিল নীতিতে জাতিবিরোধ দূর হয় না। সমস্ত মানবজাতির মঙ্গলামঙ্গল একসঙ্গে জড়িত–এই উজ্জ্বলা স্বার্থবুদ্ধির প্রসার না হলে সব ব্যবস্থাই পণ্ড হবে।