ভাষার বিশুদ্ধি

ভাষার বিশুদ্ধি

(১৩৫০/১৯৪৩)

মৃতভাষা যদি দৈবগতিকে জীবিত সমাজের সাহিত্যিক ভাষায় পরিণত হয় তবে তাতে নিয়মের বন্ধন সহজেই পড়ে। প্রাচীন লেখকদের রীতি এবং তদনুসারে সংকলিত ব্যাকরণ আর অভিধানের শাসন এরকম ভাষাকে নিয়ন্ত্রিত করে, বেশী বিকার ঘটতে দেয় না। এমন ভাষা কেবল পণ্ডিতদের ভিতরেই চলতে পারে এবং অশুদ্ধির ভয়ে লেখকগণকে সর্বদা সতর্ক থাকতে হয়। জনসাধারণ সে ভাষার কৌশল বোঝে না, সেজন্য তাতে হস্তক্ষেপ করে বিকৃত করে না; জীবন্ত প্রাকৃত ভাষাতেই তাদের স্কুল প্রয়োজন সিদ্ধ হয়। খ্রষ্টীয় যুগের আদিতে দক্ষিণপূর্ব ইওরোপের বিভিন্নজাতীয় পণ্ডিত-সমাজে গ্রীক ভাষা সাহিত্যিক ভাষারূপে প্রচলিত ছিল। মধ্যযুগে সমগ্র ইওরোপে লাটিন ভাষা ঐরকম প্রতিষ্ঠা পায়। মুসলমান রাজত্বকাল পর্যন্ত সংস্কৃত সমগ্র ভারতের হিন্দু বিদ্বৎসমাজের সাহিত্যের ভাষা ছিল।

বর্তমান ইংরেজী প্রভৃতি ইওরোপীয় ভাষায় যে গ্রীক ও লাটিন অংশ আছে তার বেশীর ভাগই বিকৃত। বিজ্ঞানের প্রয়োজনে গ্রীক লাটিন উপাদান যোগে অসংখ্য পারিভাষিক শব্দ রচিত হয়েছে, কিন্তু তাদের বিশুদ্ধির জন্য বিশেষ চেষ্টা করা হয় নি। আধুনিক ইওরোপীয় বৈজ্ঞানিক পরিভাষা অধিকাংশই dog latin অর্থাৎ বিকৃত লাটিন। পণ্ডিতগণ সজ্ঞানেই এইরকম শব্দ গঠন করেছেন, আধুনিক প্রয়োজন সিদ্ধির জন্য ব্যাকরণ অগ্রাহ্য করে মৃত ভাষার হাড় মাস চামড়া কাজে লাগাতে তারা সংকোচ বোধ করেন নি। সৌভাগ্যক্রমে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা পরিভাষা সংকলনে এরকম অনাচার আবশ্যক হয় নি।

প্রাচীন গ্রীক ও লাটিন যে অর্থে মৃতভাষা, সংস্কৃতকে সে অর্থে মৃত বলা যায় না। সংস্কৃত বাক্য মরেছে, অর্থাৎ সাধারণে সে ভাষায় কথা বলে না, কিন্তু অসংখ্য সংস্কৃত শব্দ আধুনিক সাহিত্যিক বাংলা ভাষার অঙ্গীভূত হয়ে বেঁচে আছে, উচ্চারণের বিকার হলেও রূপ বদলায় নি। আমরা শুধু প্রাচীন সংস্কৃত শব্দ প্রয়োগ করি না, দরকার হলে সংস্কৃত রীতিতেই নূতন শব্দ এবং নূতন সমাসবদ্ধ পদ রচনা করি। সংস্কৃত ভাষা বাংলার জননী কি মাতামহী তা ভাষাবিজ্ঞানীরা বলতে পারেন। সম্বন্ধ যাই হোক, ভাগ্যক্রমে আধুনিক বাংলা ভাষা বিপুল সংস্কৃত শব্দভাণ্ডারের উত্তরাধিকারিণী হয়েছে। এই অধিকারের সঙ্গে তাকে সম্পত্তিরক্ষার দায়িত্বও নিতে হয়েছে। যিনি সাহিত্যচর্চা করতে চান তাঁকে কিঞ্চিৎ সংস্কৃত ব্যাকরণ, অন্তত সংস্কৃত প্রাতিপদিকের গঠন ও যোজনের মোটামুটি নিয়ম শিখতেই হবে।

শব্দের প্রয়োগে অবাধ স্বাধীনতা বা স্বেচ্ছাচার চলে না, সকলে একই নিয়মের অনুবর্তী না হলে ভাষা দুর্বোধ হয়, সাহিত্যের যা মূল উদ্দেশ্য–ভাবের আদান-প্রদান, তা ব্যাহত হয়। অসংস্কৃত শব্দের প্রয়োগে কতকটা উজ্জ্বলতা অনিবার্য, কারণ এমন কোনও প্রবল শাসন নেই যা সকলেই মেনে নিতে পারে। কিন্তু সংস্কৃত শব্দে ব্যাকরণ অভিধানের শাসন। আছে। যদি আমরা মনে করি যে এই শাসন বাংলা ভাষার স্বচ্ছন্দ গতির অন্তরায় তবে মহা ভুল করব। সংস্কৃত শব্দে যে সুচিরাগত নিয়মের বন্ধন আছে সকলেই তা প্রামাণিক বলে মেনে নিতে পারে, তাতে শব্দ এবং তার অর্থ স্থির থাকে, কিন্তু ভাষার স্বচ্ছন্দতা কিছুমাত্র বাধা পায় না।

বাংলার তুল্য হিন্দী মরাঠি প্রভৃতি কতকগুলি ভাষাতেও সংস্কৃত শব্দের প্রাচুর্য আছে, এবং সেই কারণেই বাংলা হিন্দী প্রভৃতি ভাষী অল্পায়াসে পরস্পরের ভাষা শিখতে পারে। ভারতের কয়েকটি প্রদেশের ভাষায় এই যে শব্দসাম্য আছে তা অবহেলার বিষয় নয়, এই সাম্য যত বজায় থাকে ততই সকলের পক্ষে মঙ্গল।

এদেশে ৭০/৮০ বৎসর পূর্ব পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের চর্চা অল্পসংখ্যক পণ্ডিত ব্যক্তিদের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। তারা প্রায় সকলেই সংস্কৃতজ্ঞ ছিলেন, সেজন্য তাদের হাতে সংস্কৃত শব্দের বিকৃতি আর অপপ্রয়োগ বেশী ঘটে নি। ‘ইতিমধ্যে, মহারথী, সক্ষম, সততা, সিঞ্চন, সৃজন’ প্রভৃতি কয়েকটি অশুদ্ধ শব্দ বহুকাল থেকে বাংলা ভাষায় স্থান পেয়েছে, এখন এগুলিকে ছাড়া শক্ত, ছাড়বার প্রয়োজনও নেই। বর্তমানকালে সাহিত্যচর্চা খুব ব্যাপক হয়েছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সকল লেখকের উপযুক্ত শিক্ষার সুযোগ হয় নি, তার ফলে অশুদ্ধ এবং অপপ্রযুক্ত শব্দের বাহুল্য দেখা দিয়েছে। এই উদ্ধৃঙ্খলতা উপেক্ষার বিষয় নয়। অতি বড় বিদ্বানেরও মাঝে মাঝে স্বলন হয়, কিন্তু তাতে স্থায়ী অনিষ্ট হয় না যদি তারা নিজের ভুল বোঝবার পরে সতর্ক হন। কিন্তু লেখকরা যদি নিরঙ্কুশ হন এবং তাদের ভুল বার বার ছাপার অক্ষরে দেখা দেয় তবে তা সংক্রামক রোগের মতন সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি।–

প্রামাণিক অর্থে ‘প্রামাণ্য’, ইতিহাস অর্থে ‘ইতিকথা’, ‘ক্ষীণ বা মিটমিটে’ অর্থে ‘স্তিমিত’, আয়ত্ত অর্থে ‘আয়ত্তাধীন’ চলছে। কর্মসূত্রে বা কর্মোপলক্ষ্যে স্থানে ‘কর্মব্যপদেশে’ লেখা হচ্ছে। ‘উত্তৰ্ষত, ঔৎকর্ষ, প্রসারতা, সৌজন্যতা, ঐক্যতা, ঐক্যতান, উচিৎ’ প্রভৃতি অদ্ভুত শব্দ চলছে। ‘আধুনিকী’ স্থানে ‘আধুনিকা’, প্রচুর অর্থে যথেষ্ট, সংজ্ঞার্থ বা definition অর্থে ‘সংজ্ঞা’ প্রায় কায়েম হয়ে গেছে। অনেকে কবিতায় শ্রেণী অর্থে ‘বলাকা’ লিখছেন।

আজকাল সাহিত্যের প্রধান বাহন সংবাদপত্র। এই বাহনের প্রভাব কিরকম ব্যাপক হয়েছে তা সাধারণের লেখা আর কথা লক্ষ্য করলে বোঝা যায়। Situation অর্থে অনর্থক ‘পরিস্থিতি’ লেখা হচ্ছে, যদিও অবস্থা লিখলেই কাজ চলে। আইন লঙ্ঘন স্থানে ‘আইন অমান্য’, আলোচনা স্থানে ‘আলোচনী’, কার্যকর উপায় স্থানে ‘কার্যকরী উপায়’, পূর্বেই ভাবা উচিত ছিল স্থানে পূর্বাহেই…’ লেখা হচ্ছে। সাংবাদিকদের অদ্ভুত ভাষা মার্জনীয়। তাঁদের রাত জেগে কাজ করতে হয়, অতি অল্প সময়ে রাশি রাশি সংবাদ ইংরেজী থেকে বাংলায় তরজমা করতে হয়, ভাষার বিশুদ্ধির উপর দৃষ্টি রাখবার সময় নেই, তাদের ভাষা ইংরেজীগন্ধী হওয়া বিচিত্র নয়। Stalin’s speech has given rise to a first class political problem–‘স্টালিনের বক্তৃতা একটি প্রথম শ্রেণীর রাজনৈতিক সমস্যার সৃষ্টি করিয়াছে’! The Congress party did not take part in the discussion-কংগ্রেসদল এই আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেন নাই’!

কিছুকাল পূর্বে একটি ইংরেজী পত্রিকায় পড়েছিলাম যে Times প্রভৃতি সংবাদপত্রের বেতনভুক্ লেখকগণকে মাঝে মাঝে শব্দের প্রয়োগ সম্বন্ধে সতর্ক করা হয়। এদেশেও অনুরূপ ব্যবস্থা হতে পারে। সংবাদপত্রের সম্পাদকমণ্ডলের মধ্যে সুশিক্ষিত লোকের অভাব নেই। তারা সহকারীদের প্রত্যেক লেখা ছাপবার আগে সংশোধন করে দেবেন এমন আশা করা অন্যায়। কিন্তু যদি তারা দেখেন যে কোনও অশুদ্ধ শব্দ বা অপপ্রয়োগ বার বার ছাপা হচ্ছে তবে মাঝে মাঝে শুদ্ধাশুদ্ধির ফর্দ করে দিয়ে তাদের অধীন লেখকদের সতর্ক করে দিতে পারেন। কয়েকটি বিলাতী পত্রিকায় ভাষার বিশুদ্ধি সম্বন্ধে মাঝে মাঝে আলোচনা ও বিতর্ক ছাপা হয়। এদেশেও অনুরূপ ব্যবস্থা হলে বাংলা সাহিত্যের কল্যাণ হবে।