ঘনীকৃত তৈল

ঘনীকৃত তৈল

চলিত কথায় ‘তৈল’ বলিলে যেসকল বস্তু বুঝায় তাহাদের কতকগুলি সাধারণ লক্ষণ দেখা যায়। সকল তৈলই দাহ, অম্লাধিক তরল এবং জলে অদ্রাব্য। তাৰ্পিন কেরোসিন ও সর্ষপ তৈলে এইসকল লক্ষণ বর্তমান। পক্ষান্তরে স্পিরিট তৈল নয়, কারণ তাহা দাহ ও তরল হইলেও জলের সহিত মিশে।

কিন্তু তাৰ্পিন কেরোসিন ও সর্ষপ তৈলের কতকগুলি প্রকৃতিগত বৈষম্য আছে। তাৰ্পিন সহজে উবিয়া . যায়, কেরোসিন উবিতে সময় লাগে, সর্ষপ তৈল মোটেই উবে না। সর্ষপ তৈলের সহিত সোডা মিশাইয়া সাবান করা যায়, কিন্তু তাৰ্পিন ও কেরোসিনে সাবান হয় না।

আমরা মোটামুটি কাজ চালাইবার জন্য পদার্থের সুল লক্ষণ দেখিয়া শ্রেণীবিভাগ করি, কিন্তু বিজ্ঞানী তাহাতে সন্তুষ্ট নন। তাঁহারা নানাপ্রকার পরীক্ষা করিয়া দেখেন কোন্ লক্ষণগুলি পদার্থের গঠন ও ক্রিয়ার পরিচায়ক, এবং সেই গুলিকেই মুখ্য লক্ষণ গণ্য করিয়া শ্রেণীবিভাগ করেন। শ্রেণী নির্দেশের জন্য বিজ্ঞানী নূতন নাম রচনা করেন, অথবা প্রচলিত নাম বজায় রাখিয়া তাহার অর্থ সংকুচিত বা প্রসারিত করেন। এজন্য লৌকিক ও বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিভাগে অনেক স্থলে বিরোধ দেখা যায়। লোকে বলে চিংড়ি-মাছ, বিজ্ঞানী বলেন চিংড়ি মাছ নয়। লোকে কয়েকপ্রকার লবণ জানে, যথা সৈন্ধব, করচ, লিভারপুল, বেআইনী, ইত্যাদি। বিজ্ঞানী বলেন, লবণ তোমার রান্নাঘরের একচেটে নয়, লবণ অসংখ্য, ফটকিরি তুতেও লবণ। কবি লেখেন—তাল-তমাল। বিজ্ঞানী বলেন-ও দুই গাছে টের তফাত, বরং ঘাস-বাঁশ লিখিতে পার।

রসায়নশাস্ত্র অনুসারে তাৰ্পিন কেরোসিন ও সর্ষপ তৈল তিন পৃথক শ্রেণীতে পড়ে। তার্পিন, চন্দন, নেবুর তৈল প্রভৃতি গন্ধতৈল প্রথম শ্রেণী। কেরোসিন, পেট্রল, ভ্যাসেলিন, এমন কি কঠিন প্যারাফিন—যাহা হইতে বর্মা-বাতি হয়, দ্বিতীয় শ্ৰেণী। সর্ষপ তৈল, তিল তৈল, ঘৃত, চর্বি প্রভৃতি উদভিজ্জ ও প্রাণিজ মেহদ্রব্য তৃতীয় শ্রেণী। তৃতীয় শ্রেণীর সাধারণ ইংরেজী নাম fat; আমরা এই শ্রেণীকেই তৈল’ নামে অভিহিত করিব। অপর দুই শ্রেণী এই প্রবন্ধের বিষয়ীভূত নয়।

তৈল মানুষের খাদ্যের একটি প্রধান উপাদান। ভারতের প্রদেশভেদে সর্ষপ তিল চীনাবাদাম ও নারিকেল তৈল বন্ধনে ব্যবহৃত হয়। ধৃতের ত কথাই নাই, ভারতবাসী মাত্রই ধৃতভক্ত। চর্বির ভক্তও অনেক আছে। কার্পাসবীজের তৈলও আজকাল রন্ধনে চলিতেছে। কোনও কোনও স্থানে তিসির তৈলও বাদ যায় না। মাদ্রাজে রেড়ির তৈলে প্রস্তুত উপাদেয় আমের আচার খাইয়াছি।

সাধারণ সাবানের উপাদান তৈল ও সোডা। তৈলভেদে সাবানের গুণের তারতম্য হয়। চর্বি ও নারিকেল তৈলের সাবান শক্ত, রেড়ি তিল চীনাবাদাম প্রভৃতি তৈলের সাবান নরম। লোকে নরম সাবান পছন্দ করে না, সেজন্য অন্য তৈলের সহিত কিছু চবি ও নারিকেল তৈল মিশানো হয়। নারিকেল তৈলের বিশেষ গুণ—সাবানে প্রচুর ফেনা হয়। কোনও কোনও কাজে নরম সাবানই দরকার হয়, সেজন্য নারিকেল তৈল ও চর্বি না দিয়া অন্য উদভিজ্জ তৈল বা মাছের তৈল ব্যবহার করা হয় এবং সোডার বদলে অল্লাধিক পটাশ দেওয়া হয়। কিন্তু মোটের উপর কঠিন সাবানেরই আদর বেশী, সেজন্য চর্বি ও নারিকেল তেলের কাটতি ক্রমে বাড়িতেছে।

কলের তাঁতে বুনিবার পূর্বে সুতায় যে মাড় দেওয়া হয় তাহার একটি প্রধান উপকরণ চবি। আমাদের দেশের তাঁতীরা নারিকেল তৈল দেয়, কিন্তু মিলে চর্বিই প্রকৃষ্ট বলিয়া গণ্য হয়। এই কারণেও চর্বির মূল্যবৃদ্ধি হইতেছে।

লুচি কচুরি প্রস্তুত করিবার সময় ময়দায় ঘিএর মোন দেওয়া হয়, তাহার ফলে খাবার খাস্তা হয়, অর্থাৎ ময়দাপিণ্ডের চিমসা ভাব দূর হয়। খাজা, ঢাকাই পরটা প্রভৃতিতে প্রচুর ময়ান থাকে, সেজন্য ভাজিবার সময় স্তরে স্তরে আলগা হইয়া যায়। কিন্তু যদি ঘিএর বদলে তেলের ময়ান দেওয়া হয় তবে তত ভাল হয় না। চর্বি দিলে ঘিএর চেয়েও ভাল হয়, অবশ্য সকলে সে পরীক্ষা করিতে রাজী হইবে না। বিলাতী বিস্কুটে এযাবৎ চর্বির ময়ান চলিয়া আসিতেছে। এদেশে যে হিন্দু বিস্কুট’ প্রস্তুত হয় তাহা বিলাতীর সমকক্ষ নয়। ইহার প্রধান কারণ—নিপুণতার অভাব, কিন্তু চর্বির বদলে ঘি বা মাখন ব্যবহারও অন্যতম কারণ।

তৈল চর্বি ইত্যাদির যতরকম প্রয়োগ আছে তাহার বর্ণনা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। এখন ঘনীকৃত তৈলের কথা পাড়ি।

প্রায় ত্রিশ বৎসর পূর্বে একজন ফরাসী রসায়নবিৎ আবিষ্কার করেন যে নিকেল-ধাতুর সূক্ষ্ম চূর্ণের সাহায্যে তৈলের সহিত হাইড্রোজেন গ্যাস যোগ করা যায়, তাহার ফলে তরল তৈল ঘনীভূত হয়। এই প্রক্রিয়ায় নিকেল অনুঘটকের (catalyst) কাজ করে মাত্র, উৎপন্ন বস্তুর অঙ্গীভূত হয় না। উক্ত আবিষ্কারের পর বহু বিজ্ঞানী এই প্রক্রিয়ার উত্তরোত্তর উন্নতিসাধন করিয়াছেন, তাহার ফলে একটি বিশাল ব্যবসায়ের প্রতিষ্ঠা হইয়াছে।

যে-কোনও তৈল এই উপায়ে রূপান্তরিত করিতে পারা যায়। হাইড্রোজেনের মাত্রা অনুসারে ধৃতের তুল্য কোমল, চবির তুল্য, মোমের তুল্য কঠিন অথবা তদপেক্ষাও কঠিন বস্তু উৎপন্ন হয়। সর্ষপ তৈল, নিম তৈল, এমন কি পূতিগন্ধ মাছের তৈল পর্যন্ত বর্ণহীন গন্ধহীন ঘন বস্তুতে পরিণত হয়।

Hydrogenated oil বা solidified oil বা ঘনীকৃত তৈল এখন ইউরোপ ও আমেরিকার নানা স্থানে প্রস্তুত হইতেছে। এই ব্যবসায়ে হলাণ্ড মুখ্য স্থান অধিকার করিয়াছে এবং ইংলাও ক্রমশ অগ্রসর হইতেছে। এতদিন চর্বি দ্বারা যে কাজ হইত, এখন বহুস্থলে ঘনীকৃত তৈল দ্বারা তাহা সম্পন্ন হইতেছে। যেসকল উদভিজ্জ ও প্রাণিজ তৈল পূর্বে অতি নিকৃষ্ট ও অব্যবহার্য বলিয়া গণ্য হইত, এখন তাহাদেরও সদ্গতি হইতেছে।

রুটি-মাখন বিলাতের জনপ্রিয় খাদ্য। কিন্তু গরিব লোকে মাখনের খরচ যোগাইতে পারে না, সেজন্য মারগারিন’ নামক কৃত্রিম মাখনের সৃষ্টি হইয়াছে। পূর্বে ইহার উপাদান ছিল চর্বি, উদভিজ্জ তৈল, কিঞ্চিৎ দুগ্ধ এবং ঈষৎ মাত্রায় পিষ্ট গোস্তানের নির্যাস। শেষোক্ত উপাদান মিশ্রণের ফলে মারগারিনে মাখনের স্বাদ ও গন্ধ কিয়ৎপরিমাণে উৎপন্ন হয়। ভাল মারগারিনে কিছু খাঁটী মাখনও মিশ্রিত থাকে। আজকাল যে মারগারিন প্রস্তুত হইতেছে তাহাতে চর্বি ও স্বাভাবিক উভিজ্ঞ তৈল প্রায় থাকে না, তৎপরিবর্তে মাখনের তুল্য ঘনীকৃত তৈল দেওয়া হয়, কিন্তু অন্যান্য উপাদান পূর্ববৎ বজায় আছে। চকোলেট টফি প্রভৃতি খাদ্যে পূর্বে মাখন দেওয়া হইত, এখন প্রায় ঘনীকৃত তৈল দেওয়া হইতেছে, তাহার ফলে লাভ বাড়িয়াছে এবং বিকৃতির আশঙ্কাও কমিয়াছে। বিস্কুটেও ক্রমশ চর্বির বদলে ঘনীকৃত তৈল চলিতেছে, সেজন্য কোনও কোনও ব্যবসায়ী সগর্বে বলিতেছেন—তাহাদের জিনিস খাইলে হিন্দু-মুসলমানের জাতি যায় না। সাবান ও অন্যান্য বহু ব্যবসায়ে ঘনীকৃত তৈলের প্রয়োগ ক্রমশ প্রসারিত হইতেছে। মোট কথা, বিশেষ বিশেষ কর্মের উপযুক্ত অনেকপ্রকার ঘনীকৃত তৈল প্রস্তুত হইতেছে এবং লোকেও তাহার প্রয়োগ শিখিতেছে।

এই নূতন বস্তুর ব্যবহার কয়েক বৎসর পূর্বে ইউরোপ ও আমেরিকাতেই আবদ্ধ ছিল। কিন্তু উৎপাদনবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়িগণ নব নব ক্ষেত্রের সন্ধান করিতে লাগিলেন। অচিরে দৃষ্টি পড়িল এই দেশের উপর। ভারতগাভী সর্বদা হাঁ করিয়া আছে, বিলাতী বণিক যাহা মুখে গুজিয়া দিবে তাহাই নির্বিচারে গিলিবে এবং দাতার ভাণ্ড দুগ্ধে ভরিয়া দিবে। অতএব বিশেষ করিয়া এই দেশের জন্য এক অভিনব বস্তু সৃষ্ট হইল-vegetable product’ বা ‘উদভিজ্জ পদার্থ। ব্যবসায়িগণ প্রচার করিলেন—ইহাতে স্বাস্থ্যহানি হয় না, ধর্মহানি হয় না, এবং পবিত্রতার নিদর্শনস্বরূপ ইহার মার্কা দিলেন-মহীরুহ বা পদ্মকোরক বা নবকিশলয়। ভারতের জঠরাগ্নি এই বিজ্ঞানসম্ভূত হবির আহুতি পাইয়া পরিতৃপ্ত হইল, হালুইকর ও হোটেলওয়ালা মহাননে স্বাহা বলিল, দরিদ্র গৃহবধু লুচি ভাজিয়া কৃতার্থ হইল। দেশের সর্বত্র এই বস্তু ক্রমে ক্রমে প্রচলিত হইতেছে এবং শীঘ্রই পল্লীর ঘরে ঘরে কেরোসিন তৈলের ন্যায় বিরাজ করিবে এমন লক্ষণ দেখা যাইতেছে। আজকাল বহুস্থলে ভোজের রন্ধনে মৃতের সহিত আধাআধি ইহ চলিতেছে। ধর্মভীরু ঘিওয়ালার কুণ্ঠা দূর হইয়াছে, এখন আর চর্বি ভেজাল দিবার দরকার হয় না, মহীরুহ-মার্কা মিশাইলেই চলে। সুদূর পল্লীতে অনেক গোয়ালার ঘরে খোঁজ করিলে এই জিনিসের টিন মিলিবে। ঘি ভেজালের প্রথম পর্ব এখন গোয়ালার ঘরেই নিষ্পন্ন হয়।

কিন্তু এত গুণ এত সুবিধা সত্ত্বেও এই দ্রব্যের বিরুদ্ধে কয়েকজন উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন। কলিকাতা করপোরেশনে এবং বিভিন্ন প্রাদেশিক কাউনসিলে এ সম্বন্ধে বহু বিতর্ক হইয়া গিয়াছে, অবশ্য তাহাতে কোনও ফল হয় নাই। ঘনীকৃত তৈলের সপক্ষে ও বিপক্ষে যে সকল যুক্তি দেওয়া হইয়াছে তাহার মর্ম এই।

সপক্ষ বলেন—খাঁটী ঘি নিশ্চয়ই খুব ভাল জিনিস, তাহার সহিত আমরা প্রতিযোগিতা করিতেছি না। কিন্তু সকলের ঘি খাইবার সংগতি নাই। অনেক খাদ্যদ্রব্য আছে যাহা তেল দিয়া তৈয়ারি করিলে ভাল হয় না, যথা লুচি কচুরি গজা মিঠাই চপ। এইসকল দ্রব্য ভাজিবার জন্য বাজারের ভেজাল ঘিএর বদলে অপেক্ষাকৃত সস্তা অথচ নির্দোষ ঘনীকৃত তৈল ব্যবহার করিবে না কেন? ইহাতে ভাল ঘিএর সুগন্ধ নাই সত্য, কিন্তু দুর্গন্ধও নাই, এমন কি কোনও গন্ধই নাই। ইহাতে খাবার ভাজিলে তেলেভাজা বলিয়া বোধ হয় না, বরং ঘি-ভাজা বলিয়াই ভ্রম হয়, অথচ বাজারের ঘিএর দুর্গন্ধ অনুভূত হয় না। ঘিএর উপর ভারতবাসীর যে প্রবল আসক্তি আছে তাহা অঞ্চ তেলে মিটিতে পারে না, কিন্তু নির্গন্ধ ঘনীকৃত তৈলে বহুপরিমাণে মিটিবে। সাধারণ লোকের ঘিওর উপর লোভ আছে কিন্তু পয়সা নাই, সেজন্যই ভেজাল ঘি চলিতেছে। দূষিত চর্বিময় ভেজাল ঘি না খাইয়া নির্দোষ ঘনীকৃত তৈল খাইলে স্বাস্থ্য ও ধর্ম উভয়ই রক্ষা পাইবে। যদি ঘৃতের সুগন্ধ চাও, তবে ঘনীকৃত তৈলের সহিত কিঞ্চিৎ বিশুদ্ধ ঘৃত মিশাইয়া লইতে পার, বাজারের ঘি খাইয়া আত্মবঞ্চনা করিও না।

বিপক্ষ বলেন—ভেজাল ঘি খুবই চলে ইহা অতি সত্য কথা। কিন্তু ঘনীকৃত তৈলের আমদানির ফলে ঐ ভেজাল বাড়িয়াছে এবং আরও বাড়িবে। ভেজাল ঘি চবি চীনাবাদাম তৈল ইত্যাদির মিশ্রণ যত সহজে ধরা যায়, ঘনীকৃত তৈলের মিশ্রণ তত সহজে ধরা যায় না। যাহারা সজ্ঞানে বা চক্ষু মুদিয়া সস্তায় ভেজাল ঘি কেনে তাহাদিগকে কেহই রক্ষা করিতে পারিবে না। কিন্তু যাহারা সাবধানতার ফলে এপর্যন্ত প্রবঞ্চিত হয় নাই, এখন তাহারাও অজ্ঞাতসারে ভেজাল কিনিতেছে। মাখন গলাইলেও বিশ্বাস নাই, কারণ তাহাতেও মারগারিন আকারে ঘনীকৃত তৈল প্রবেশ করিয়াছে। আর এক কথা—ঘৃতে ভাইটামিন আছে, ঘনীকৃত তৈলে নাই, অতএব ঘৃতের পরিবর্তে ঘনীকৃত তৈলের চলন বাড়িলে লোকের স্বাস্থ্যহানি হইবে। আর, যতই বৃক্ষ লতা ফল ফুলের মার্কা দাও এবং উদভিজ্জ পদার্থ বলিয়া প্রচার কর, উহা যে অতি সস্তা মাছের তেল হইতে প্রস্তুত নয় তাহারই বা প্রমাণ কি? বিলাতী ব্যবসাদার মাত্রেই তো ধর্মপুত্র নয়। আরও এক কথা-ঘনীকৃত তৈলে ঈষৎ মাত্রায় নিকেল ধাতু দ্রবীভূত থাকে, রাসায়নিকগণ তাহা জানেন। তাহাতে কালক্রমে স্বাস্থ্যহানি হয় কিনা কে বলিতে পারে?

এই বিতর্ক লইয়া বেশী মাথা ঘামাইবার দরকার নাই। দূরদর্শী দেশহিতৈষী মাত্রই বুঝিবেন—বিদেশী ঘনীকৃত তৈল সর্বথা বর্জনীয়। কেবল একটা কথা বলা যাইতে পারে ভাইটামিনের অভাব জনিত আপত্তি প্রবল নয়। সাবধানে মাখন গলাইয়া ঘি করিলে ভাইটামিন সমস্তই বজায় থাকে। কিন্তু বাজারের ঘি তৈয়ারির সময় বিশেষ যত্ন লওয়া হয় না, গোয়ালা ও আড়তদারের গৃহে বহুবার উন্মুক্ত কটাহে জাল দেওয়া হয়, তাহাতে ভাইটামিন অনেকটা নষ্ট হয়, অবশ্য কিছু অবশিষ্ট থাকে। হালুইকরের কটাহে যে ঘি দিনের পর দিন উত্তপ্ত করা হয় তাহাতে কিছুমাত্র ভাইটামিন থাকে কিনা সন্দেহ। এবিষয়ে কেহ পরীক্ষা করিয়াছেন কিনা জানি না। মোট কথা, শড়ির রান্নায় যে ঘি দেওয়া হয় তাহাতে ভাইটামিন থাকিতে পারে কিন্তু বাজারের ঘৃতপক খাবারে না থাকাই সম্ভবপর। ইহাও বিবেচ্য—দেশের অধিকাংশ লোক ঘি খাইতে পায় না, রান্নায় তেলই বেশী চলে, এবং তেলে ভাইটামিন নাই, অন্তত ঘিএ যে ভাইটামিন থাকে তাহা নাই।

কিন্তু অন্য যুক্তি অনাবশ্যক। বিদেশী ঘনীকৃত তৈলের বিরুদ্ধে অখণ্ডনীয় যুক্তি ইহাতে ধর্মহানি হয়। এই ধর্ম গতানুগতিক অন্ধসংস্কার নয়, ভাইটামিনের ধর্মও নয়, দেশের স্বার্থরক্ষার ধর্ম, আত্মনির্ভরতার ধর্ম। এই ধর্মবুদ্ধির উন্মেষের ফলে ভারতবাসী বুঝিয়াছে যে বিদেশী বস্ত্রে লজ্জা নিবারণ হয় না, বৃদ্ধি পায় মাত্র। ঘি খাইবার পয়সা নাই, কিন্তু কোন্ দুঃখে বিদেশী তৈল খাইব? এদেশের স্বাভাবিক তৈল কি দোষ করিল? সর্ষপ তৈলের ঝাঁজ সব সময় ভাল না লাগে তত অন্য তৈল আছে। প্রাচীন ভারতে ‘তৈল’ শব্দে তিল তৈলই বুঝাইত, লোকে তাহাতেই রাধিত, বোম্বাই মাদ্রাজ মধ্যপ্রদেশে এখনও তাহা চলে। ইহা স্নিগ্ধ, নির্দোষ, সুপচ। বাঙালীর নাক সিটকাইবার কারণ নাই। সর্ষপ তৈলের উগ্র গন্ধ আমরা সহিতে পারি, বাজারের কচুরি গজা খাইবার সময় ঘিএর বিকৃত গন্ধ মনে মনে মার্জনা করি, নির্গন্ধ ভেজিটেবল প্রডক্ট উত্তপ্ত হইলে দুর্গন্ধ হয় তাহাও জানি, তবে তিল চীনাবাদাম তৈলে অভ্যস্ত হইব না কেন? সাহেবের দেখাদেখি কঁচা শাকে স্যালাড অয়েল মিশাইয়া খাই, তাহাতে কি গন্ধ নাই? অশ্বত্থামা পিটুলি-গোলা খাইয়া ভাবিয়াছিলেন দুধ, আমরাও একটা নূতন কিছু খাইয়া ভাবিতে চাই ঘি খাইতেছি। এজন্য বিদেশী ‘উদভিজ্জ’ পদার্থ অনাবশ্যক, লুচি কচুরি ভাঙ্গার উপযুক্ত স্বদেশী উদভিজ্জ তৈল যথেষ্ট আছে। নিমন্ত্রিত কুটুম্বকে ঠকানো হয়তো একটু শক্ত হইবে, কিন্তু দেশবাসীর আত্মসম্মান রক্ষা পাইবে। যদি কলিকাতা ও অন্যান্য নগরের মিউনিসিপালিটি চেষ্টা করেন তবে তিলাদি তৈলের প্রচার সহজেই হইতে পারিবে। শ্ৰীযুক্ত চুনিলাল বসু, বিমলচন্দ্র ঘোষ, সুন্দরীমোহন দাস, রমেশচন্দ্র রায় প্রভৃতি ভিষ মহোদয়গণ প্রবন্ধাদি দ্বারা সাধারণকে এবিষয়ে জ্ঞানদান করিতে পারেন। ময়রা যাহাতে প্রকাশ্যভাবে বিশুদ্ধ তৈলের অথবা তমিশ্ৰিত তৈলের খাবার বেচিতে পারে তাহার ব্যবস্থা আবশ্যক। এইরকম খাবার ঘনীকৃত তৈলের অথবা খারাপ ঘির খাবার অপেক্ষা কোনও অংশে নিকৃষ্ট নয়। ঘি খাইব, অভাবে অজ্ঞাত-উপাদান ভেজাল দ্রব্য খাইব—লোকের এই মানসতার পরিবর্তন আবশ্যক। ঘি খাইব, না জুটিলে সজ্ঞানে বিশুদ্ধ তৈল খাইব অথবা ঘৃতমিশ্রিত তৈল খাইব–ইহাই সদবুদ্ধি।

কয়েকজন বাঙালী রসায়নবিৎ ঘনীকৃত তৈল উৎপাদনে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছেন। যদি তাঁহাদের চেষ্টায় এদেশে ইহার উৎপাদন হয় তবে ধর্মহানির আপত্তি থাকিবে না। যতদিন তাহা না হয় ততদিন ক্ষমতায় কুলাইলে ঘি খাইব, অথবা সর্ষপ তিল চীনাবাদাম বা নারিকেল তৈল খাইব, অথবা ধৃত ও তৈল মিশাইয়া খাইব, রুচিতে না বাধিলে স্বদেশী চর্বিও খাইব, কিন্তু বিদেশী ঘনীকৃত তৈল পূতনার স্তনবৎ পরিহার করিব।