৩১. আবার ব্লু ট্রেনে
ভয়াবহ গতিতে ছুটে চলেছে ব্লু ট্রেন। যার আর একম নাম– কোটিপতি ট্রেন। শুধু কোটিপতিরাই এই ট্রেনে ভ্রমণ করার খরচ পোষাতে পারেন। অনেকক্ষণ ধরে অনেক বড় একটা বাঁক শেষ করে আবার ভূমধ্যসাগরের কোণ ঘেঁসে হাওয়ার বেগে ছুটে চলল। কোটিপতিদের ট্রেন-ব্লু ট্রেন। ভ্যান আলডিন, কিংটন আর পোয়ারো কোনো কথা না বলে যে যার জানালা দিয়ে প্রকৃতির দৃশ্য দেখছিলেন।
ভ্যান আলডিন ও কিংটন-এর কামরা দুটোর মাঝখানে পরস্পর সংযোগকারী দরজা আছে। ঠিক যেমন আসল ঘটনার দিন রুথের কামরা আর তার পরিচারিকার কামরা দুটোর মাঝখানে ছিল। পোয়ারোর নিজের কামরাটা ছিল একটু পেছন দিকে।
এবারের ব্লু ট্রেনে ভ্রমণ ভ্যান আলডিন-এর মনে এক অতি বেদনাদায়ক স্মৃতি বয়ে যাচ্ছিল। তাঁর বারবার মনে পড়ছিল যে তার প্রাণাধিক রুথ-এর এই ট্রেনের কামরায় শেষ দেখা করুণ মুখখানা। পোয়ারো আর কিংটন কখনও নিজেদের মধ্যে নিচু গলায় কথা বলছিলেন। দুজনেই মিঃ আলডিন-এর মনোভাব বুঝে তাকে বিরক্ত করেননি।
তারপর ট্রেন যথাসময়ে গেয়ার দ্য নয়েন-এ পৌঁছানো মাত্রই বিদ্যুৎবেগে কাজে লেগে গেলেন পোয়ারো। ভ্যান আলডিন বুঝলেন পোয়ারোর ট্রেনে করে এই ভ্রমণের উদ্দেশ্যই হলো সেদিনের সেই ঘটনার ছবিটা তুলে ধরা। অবশ্য পোয়ারো নিজেই প্রত্যেকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে লাগলেন। প্রথমেই রুথ ক্যাথারিন–এর পরিচারিকার ভূমিকায়। ঠিক যেন রুথ ক্যাথারিন–এর পরিচারিকা নিজের কামরায় তাড়াতাড়ি ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর রুথ ক্যাথারিন-এর ভূমিকায়। স্বামীকে অপ্রত্যাশিতভাবে ট্রেনে নিজের কামরায় দেখে উদ্বিগ্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে উঠল। তারপর স্বামী ড্রেক ক্যাথারিন–এর ভূমিকায় ড্রেক ক্যাথারিন যেন হঠাৎই আবিষ্কার করলেন যে তার স্ত্রী রুথও ঐ ট্রেনে যাচ্ছে। তারপর পোয়ারো দ্বিতীয় কামরাটায় কোনো ব্যক্তির পক্ষে নিজেকে আত্মগোপন করে রাখার যতরকমের সম্ভাব্য জায়গা থাকতে পারে সেগুলোও যাচিয়ে দেখলেন।
ট্রেন প্যারীতে আসতেই হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। শক্ত করে ভ্যান আলডিনের হাতটা চেপে ধরলেন। একটা জিনিস ভেবে দেখিনি আগে, আমাদের প্যারীতে নেমে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি, তাড়াতাড়ি নামুন। নামুন! কোনোমতে টেনে হিঁচড়ে স্যুটকেসগুলো নিয়ে ট্রেন থেকে তাড়াতাড়ি নেমে পড়লেন। হতভম্ব আলডিন ও কিংটন নেমে পড়লেন। পোয়ারোর এই অদ্ভুত কাজকর্ম তার ক্ষমতা সম্বন্ধে আলডিনকে আরও বেশি। নিরাশ করতে লাগল। রেলিঙের ধারে এসে ওদের থামতে হলো টিকিট কালেক্টরের কাছে। টিকিট খুঁজতে গিয়ে দেখলেন, ট্রেনের কণ্ডাক্টরের কাছেই রয়ে গেছে ওদের তিনজনের টিকিট। নামার সময় কেউই খেয়াল করেননি। পোয়ারো অনেক অনুনয়-বিনয় করলেন, কিন্তু রাশভারী টিকিট কালেক্টরের মন তাতে বিগলিত হলো না। পোয়ারো কিন্তু নিরাশ না হয়ে তখনও বুঝিয়ে চললেন….
কথা না বাড়িয়ে চলুন এখান থেকে চলে যাই। আলডিন খুবই বিরক্ত হলেন। বুঝতে পারছি আপনারও তাড়া আছে। ক্যালে থেকে হিসেব করে যা ভাড়া হয় চুকিয়ে দিন, তারপর চলুন আপনার যা করণীয় আছে করবেন।
পোয়ারো খুব সরল ভাবে বললেন, সত্যি আমি বোকা। আমার দেখছি দিন দিন মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। চলুন, আমরা ট্রেনেই ফিরে যাই। আবার আমাদের যাত্রা শুরু করি। মনে হয় ভাগ্য ভালো, ট্রেনটা পেয়ে যাব আমরা। চলুন, চলুন।
আলডিন ও পোয়ারো ওঠবার সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন ছেড়ে দিল। সবশেষে কিংটন কোনোমতে চলন্ত ট্রেনে লাফ মেরে উঠলো।
কণ্ডাক্টর খুব যত্ন করে আবার লাগেজগুলো বয়ে নিয়ে ওদের কামরায় রেখে দিল। আলডিন মুখে কিছু না বললে বিরক্তস্বরে কিংটনকে বললেন, লোকটা বুনো হাঁসের পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছে। ঘটনার জটিলতায় লোকটা নিজের আস্থা তো হারিয়েছেই। সেই সঙ্গে নিজের ধৈৰ্য্যও হারিয়ে ফেলেছে। লোকটার বুদ্ধি ছিল। চিন্তাশক্তি ছিল কিন্তু হলে হবে কি? যে নিজের মাথা ঠিক রাখতে পারে না। এই মুহূর্তে বলছে এক পরমুহূর্তে করছে আরেক। এমন লোকের দ্বারা কোনো সিদ্ধান্তে আসা কি করে সম্ভব?
কয়েক মুহূর্তের পরে হতাশ মনে পোয়ারো এসে আলডিন ও কিংটনের কাছে খুবই দুর্দশাগ্রস্তের মত অনুনয় বিনয় করে ক্ষমা চাইলেন। মিঃ আলডিন মনের রাগ আর মুখে প্রকাশ করলেন না। ট্রেনেই তারা ডিনার খেলেন। ডিনার খাওয়ার পর পোয়ারো বললেন, এবার আমরা তিনজনেই মিঃ আলডিন-এর কামরায় গিয়ে বসব, পোয়রোর কথায় দুজনেই অবাক হলেন।
–আপনি আমাদের কাছে কিছু গোপন করছেন মঁসিয়ে।
–চোখ কুঁচকে মিঃ আলডিন বললেন।
–আমি? কি লাভ বলুন।
আলডিন মুখে কিছু না বললেও মনে মনে খুবই অসন্তুষ্ট হলেন। কণ্ডাক্টর রাতে তার শোবার বিছানা করতে এলে তাকে ফিরিয়ে দিলেন। নিঃশব্দে তিনজনে বসে ব্লু ট্রেনের দোলানি খেতে লাগলেন।
হঠাৎ পোয়ারো কেমন যেন অস্থির আর চঞ্চল হলেন।
-মেজর কিংটন, আপনার কামরার দরজাটা বন্ধ আছে তো? মানে আমি বলছি কামরা থেকে করিডরে যাবার দরজাটা।
–হ্যাঁ, আমি এখনি বন্ধ করে এসেছি।
–ঠিক বন্ধ করেছেন তো?
–যদি বলেন তো আবার একবার নিশ্চিত হয়ে আসি।
–না না, আপনাকে যেতে হবে না। আমি দেখে আসছি।….
–পোয়ারো গিয়ে আবার কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে ফিরে এসে বললেন, ঠিকই বলেছেন আপনি, বন্ধই আছে দরজাটা।–বয়স হয়েছে তো। তাই অকারণে ব্যস্ত হই। এবার দু-কামরার মাঝের দরজাটা বন্ধ করে পোয়ারো ডান দিকের কোণে গিয়ে বসলেন।
সময় কেটে যাচ্ছে। তিনজনেই ক্ৰমে ঢুলতে শুরু করলেন। মিঃ আলডিন ও কিংটন ভেবে বেশি বিরক্ত হচ্ছিলেন যে প্রত্যেকের আলাদা কামরা রিজার্ভ থাকলেও পোয়ারো কি করছেন। পোয়ারো থেকে থেকে ঘড়ি দেখতে লাগলেন। মাঝে একবার গিয়ে সংযোগকারী দরজাটা খুলে পাসের ঘরটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিলেন। আবার এসে নিজের জায়গায় বসলেন।
–কি ব্যাপার বলুন তো? ফিসফিস করল কিংটন। আপনাকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে। কিছু ঘটবে আসা করছেন নাকি?
-হ্যাঁ, ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছি আমি… যেন টালির ছাদে ওত পেতে শিকারের আসায় বসে থাকা ধূর্ত বেড়াল। সামান্যতম শব্দও আমাকে সতর্ক করে দিচ্ছে।
-ওঃ জীবনে এতবার ট্রেনে চাপলাম কিন্তু এবারের মতো জঘন্য ট্রেন যাত্রা-হাই তুলে বিড়বিড় করতে লাগলেন কিংটন। আমার মনে হয় মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি জানেন কি হবে।
তারপর কিংটন একটু আরাম করে বসে ঘুমোতে লাগল। আলডিনও এভাবে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। পোয়ারো আবার ঘড়ি দেখলেন। ঝুঁকে পড়ে আলডিন-এর কাধ ধরে মৃদু আঁকানি দিয়ে বললেন, আপনি তো দেখছি ঘুমে বিভোর কিন্তু এদিকে যে পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যেই
ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসলেন আলডিন। নয়েনস্? হে ভগবান।তার চোখ মুখ কেমন যেন উদভ্রান্ত আর ফ্যাকাশে মনে হলো। তাহলে তো সেই ভয়ঙ্কর মুহূর্ত, যখন আমার রুথকে মেরে ফেলা হয়। তার করুণ উদভ্রান্ত দৃষ্টি সামনে প্রসারিত। ঠোঁট দুটো সামান্য ফঁক, মন খুঁজে বেড়াতে লাগলো এক ভয়াবহ ঘটনার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া হৃদয়ের ধনকে। যে তার জীবনের সবটুকু আনন্দ নিয়ে চলে গেছে।
মাঝে মাঝে ব্রেকের একটানা লম্বা আওয়াজ করে ট্রেনের গতি কমতে লাগল। তারপর ট্রেন নয়েন স্টেশনে ঢুকল। আলডিন জানলাগুলো খুলে ঝুঁকে বাইরের দিকটা দেখলেন।
-মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনার নতুন সূত্র যদি নির্ভুল হয় অর্থাৎ ড্রেককে যদি বাদ দিই, তাহলে বলতে হয় এইখানেই সেই লোকটি ট্রেন থেকে নেমে গিয়েছিল।
-না। কোনো লোক ট্রেন থেকে নামেনি। গম্ভীর মুখে তাকালেন পোয়ারো।
–সেকি। আপনার নুতন সূত্র অনুযায়ী তো-।
-না মঁসিয়ে আলডিন, আমি আবার বলছি, কোনো লোক ট্রেন থেকে নামেনি। ট্রেন থেকে যে নেমেছিল সে লোক নয়। সে একজন স্ত্রীলোক।
চমকে তাকালেন কিংটন।
–একজন স্ত্রীলোক! চেঁচিয়ে উঠলেন আলডিন।
-হ্যাঁ, একজন স্ত্রীলোক। আপনার হয়তো মনে থাকতে নাও পারে মঁসিয়ে, কিন্তু মিস গ্রে তাঁর বক্তব্যে টুপি ও ওভার কোট পরা একটি যুবককে প্ল্যাটফর্মে পায়চারী করতে দেখার কথা বলেছিলেন।
সাধারণতঃ অনেকক্ষণ একভাবে ট্রেনে বসে থাকার পর কোনো স্টেশন এলে আমরা যেমন প্ল্যাটফর্মে নেমে পায়চারি করে হাত পায়ের খিল ছাড়িয়ে নিই। সেই রকমই ভান করেছিল সে, যেটা মিস গ্রে ধরতে না পেরে ট্রেনের প্যাসেঞ্জার বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু আমার বিশ্বাস সেই যুবকটি একজন স্ত্রীলোক।
-কিন্তু কে সেই স্ত্রীলোক? আলডিন বলল।
–তার নাম?–পোয়ারো গলার স্বরে অদ্ভুত একটা আস্থা নিয়ে বললেন, বহু বছর যাবৎ সবাই তাকে যে নামে চিনত তা হলো– কি টি কিড়। কিন্তু মিঃ আলডিন, আপনি তাকে চিনতেন অন্য নামে–অ্যাজ ম্যাসন।
–ম্প্রিঙের মতো লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল কিংটন। কি বললেন?
সবেগে কিংটন-এর দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন পোয়ারো। কি বললেন? ওঃ হোঃ! ভুলেই গিয়েছিলাম। প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট কেস বের করে এগিয়ে ধরলেন কিংটন-এর দিকে; মঁসিয়ে, দয়া করে আপনারই সিগারেট কেস থেকে আপনাকেই একটি সিগারেট অফার করার অনুমতি দিন আমাকে। প্যারীর যে বাঁকটাতে আপনি ট্রেনে উঠেছিলেন সেইখানে অসাবধানবশতঃ এটা আপনার পকেট থেকে পড়ে যায়।
কিংটন বোকার মতো তাকিয়েই এগিয়ে গেল দরজার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে গর্জন করে উঠলেন পোয়ারো।
-না, যাবার চেষ্টা করবেন না। পাশের কামরার দরজা খোেলাই আছে। এবং আপনাকে সম্পূর্ণভাবে ঘিরে ফেলা হয়েছে। প্যারী থেকে ট্রেন ছাড়বার সময় করিডরে যাবার দরজাটা আমি নিজে খুলে দিয়ে এসেছি? এখন সেখানে অপেক্ষা করছে আমাদের পুলিশ বন্ধুরা। হাঁ, ফরাসী পুলিশের আপনাকে বিশেষ জরুরী প্রয়োজন আছে। মঁসিয়ে কিংটন–কিংটন? নাঃ তার চেয়ে বরং বলি মঁসিয়ে লে মার্কুইস।
.
৩২.
পোয়ারোর বিশ্লেষণ নেগ্রেসকোতে মিঃ আলডিন-এর নিজস্ব স্যুইটে সেদিন এরকুল পোয়ারোর লাঞ্চের নেমন্তন্ন ছিল। মুখোমুখি দুটো চেয়ারে বসে খাচ্ছিলেন আলডিন ও পোয়ারো। খাওয়া শেষ করে পোয়ারো তার নিজের ছোট একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘরের কড়িকাঠের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে কি ভাবলেন তারপর তাকালেন আলডিনের দিকে।
ঘটনার বিশ্লেষণ শুনতে চান? হ্যাঁ, বলব।–একটা টান দিলেন সিগারেটে। একটা জিনিসই আমাকে ধাঁধায় ফেলেছিল। জানেন কি সেটা? সেটা হলো মৃতের মুখ। বিকৃত করা মুখ। খুনের ব্যাপারে মৃতের পরিচিতের জন্যে এই রকম করে খুনীরা। বিকৃত করা মুখটা দেখেই আমার মনে হয়েছিল–সত্যিই কি উনি মিসেস ক্যাথারিন। কিন্তু একমাত্র গ্রে-র নির্ভুল সনাক্তকরণের জন্যে আমার আর চিন্তা ছিল না।
–পরিচারিকাকে কখন থেকে আপনার সন্দেহ হলো?
–প্রথম থেকে নয়। ট্রেনের কামরায় পাওয়া সিগারেট কেসটা ও বলে, ওটা নাকি মিসেস ক্যাথারিন তার স্বামীকে উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে প্রথম থেকেই গরমিল। আর সেই গরমিল যখন উভয়কেই বৈষম্যের চরমে উপস্থিত করেছিল, ঠিক সেই সময় স্ত্রীর পক্ষে স্বামীকে উপহার দেওয়াটা যথার্থই অবিশ্বাস্য। এটাই আমাকে আজ ম্যাসন-এর সততা সম্বন্ধে সন্ধিগ্ধ করে তোলে। অ্যাজ ম্যাসন মাত্র দুমাস কাজে লেগেছে, আর এই দুমাসের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক খারাপ বই ভালো হয়নি। মিঃ ড্রেক প্রায়ই মিরেলির কাছে থাকতেন। আর মিসেস ক্যাথারিনও রিভিয়ারায় কাউন্ট-এর সঙ্গে মিলতে যেতেন। এমন পরিস্থিতিতে পরিচারিকার উপহার দেওয়ার কথাটা মেনে নিই কেমন করে? তবুও এত কাণ্ডের পরেও ঠিক জুত করে অ্যাজ ম্যাসন-এর সম্বন্ধে কিছু একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ সে প্যারীতে নেমে গিয়েছিল, আর তার চেয়েও বড় কথা সে প্যারীতে নামার পরেও অনেকেই মিসেস ক্যাথারিনকে জীবিত দেখেছেন, কিন্তু–পোয়ারো একটু ঝুঁকে এসে মিঃ আলডিন-এর সামনে একটা আঙুল নাড়লেন নিজেকে দেখিয়ে; মঁসিয়ে আলডিন, আমার অসীম বিশ্বাস আর আস্থা আছে এই ছোটোখাটো লোকটার ওপরে। আমার মনে প্রশ্ন জাগে অ্যাজ ম্যাসন আদৌ যে প্যারীতে নেমেছিল সেটা কেমন করে জেনেছি? অবশ্য আপনার সেক্রেটারী বলেছে। সে মিস ম্যাসনকে প্যারীতে দেখেছে। কিংটন তখন সম্পূর্ণ তৃতীয় ব্যক্তি। তার সঙ্গে এ কেসের কোনো সম্পর্কই ছিল না। এবং কণ্ডাক্টরের কথায় আমার মনে অসম্ভব আর প্রায় আজগুবি একটা চিন্তা উঁকি দিল। মনে মনে ভাবলাম। আমার অসম্ভব চিন্তায় বলছে অ্যাজ ম্যাসনকে প্যারীতে দেখতে যাওয়ার কথাটা একটু ধোঁয়াটে মতন।
পকেট থেকে সিল্কের রুমাল বের করলেন পোয়ারো। কিংটন-এর অ্যাজ ম্যাসনকে প্যারীর রীজ হোটেলে দেখতে পাওয়া নিয়েই কাজ শুরু করি। যদিও ওটা বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হয়েছিল, কিন্তু খুব সতর্কভাবে ঘটনাকে খুঁটিয়ে দেখার পর দুটো জিনিস আমার নজরে আসে। প্রথমত:-একটা আশ্চর্য রকম যোগাযোগ বেরিয়ে পড়ল–কিংটন নিজেও ঠিক দুমাস হলো আপনার কাজ করছে। দ্বিতীয়ত :- কিংটন-এরও প্রথম অক্ষর K মুখটা রুমাল দিয়ে মুছলেন। যদি ধরা যায়, মানে নেহাতই কল্পনা করি যে সিগারেট কেসটা তার এবং তারা দুজনে মিলে যদি এ কাজ করে। তাহলে অ্যাজ ম্যাসনকে সিগারেট কেসটা দেখানো মাত্রই সে এটা কিংটন-এর বলে চিনতে পেরেছিল। সেক্ষেত্রে মিস ম্যাসন-এর ঐ ধরনের মিথ্যে বলা ছাড়া উপায় ছিল না। মিস ম্যাসন এমনই একটা উত্তর দেয়, যেটা মিঃ ক্যাথারিনকে আরও বেশি অপরাধের জালে জড়িয়ে ফেলে। অবশ্য আসল উদ্দেশ্য এটা ছিল না, কাউন্টকে ফসানোর জন্যেই সে বলে। কিন্তু কাউন্ট যদি খুনের সময় অন্য কোথাও ছিল বলে প্রমাণ করেন, সেইজন্যই মিস ম্যাসন নিশ্চিন্ত হজয়ে কাউন্ট-এর সম্বন্ধে কিছু বলেনি। এবার আমি একটা ঘটনা বলি যা কিছুদিন আগে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস আপনি লক্ষ্য করবেন। আমি ম্যাসনকে যতবার বলি, যে লোকটাকে সে ট্রেনের কামরায় দেখেছিল সে কাউন্ট নয়, সে ড্রেক ক্যাথারিন, সে সময় তাকে বেশ বিচলিত হতে দেখি। কিন্তু আমি আপনার ওখান থেকে হোটেলে ফিরে আসার একটু পরেই আপনি, আমায় ফোন করে জানান যে অ্যাজ ম্যাসন জানিয়েছে যে সে ভেবে দেখল, ঐ লোকটা ড্রেক ক্যাথারিনই, কাউন্ট নয়। আমি এটাই আশা করেছিলাম। তার মানে আপনার ওখান থেকে ফিরে অ্যাজ ম্যাসন কারো সঙ্গে পরামর্শ করে তারপর তার মতামত আপনাকে জানায়। এখন প্রশ্ন হল কে সেই পরামর্শদাতা? মেজর রিচার্ড কিংটন আর একটা তুচ্ছ ঘটনা–কথায় কথায় কিংটন একবার বলেছিল, ইয়র্কশায়ারে যে বাড়িতে সে থাকত, সে বাড়িতে নাকি একবার রত্ন চুরির ঘটনা ঘটে। দুটো চুরির ঘটনার এই মিল হয়তো আকস্মিক–আবার হয়তো উভয় ঘটনাই গ্রন্থিবদ্ধ–একটা ক্ষীণতর যোগসূত্র হয়তো বা আছে। অন্ততঃ আমার তা-ই মনে হচ্ছিল। জানেন তো ডিটেকটিভকে প্রথমে করতে হয় অনুমান। পরে সেই অনুমানকে কাজে লাগাতে হয় বিচার-বুদ্ধি ও যুক্তির সাহায্যে।
–কিন্তু একটা ব্যাপার যে আমি বুঝতে পারছি না মঁসিয়ে পোয়ারো? প্যারীতে ট্রেনের ভেতরে ঐ লোকটা তাহলে কে ছিল? ড্রেক ক্যাথারিন না কাউন্ট?
–আঃ হা। সমস্ত ব্যাপারটা ওইখানেই একটা বিরাট ধোঁকা দেওয়া হয়েছে আসলে কোনো লোকই ছিল না। বুঝতে পারছেন না চালাকিটা কোথায়? আচ্ছা, ট্রেনের সেই লোকটার কথা আমরা কার বক্তব্য থেকে জানতে পারছি? শুধুমাত্র অ্যাজ ম্যাসনই একথা বলেছে। সেটা আমরা বিশ্বাস করছি কেন? কিংটন বলেছে তার সঙ্গে অ্যাজ ম্যাসন-এর প্যারীতে দেখা হয়েছে। তাহলে দেখুন আমরা কিংটন-এর কথায় বিশ্বাস করেছি যে অ্যাজ ম্যাসনকে প্যারীতে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই তো?
–কেন? পরিচারিকাকে নামিয়ে দেবার কথা রুথ নিজেই কণ্ডাক্টরকে বলেছে।
–ব্যস্ত হবেন না। আসছি। ও ব্যাপারেই আসছি। হ্যাঁ, মিসেস ক্যাথারিন-এর নিজের উক্তি বলেই আমরা ধরে নিয়েছি, কিন্তু এটা মিসেস ক্যাথারিন-এর উক্তি নয়।
তার মানে?
তার মানে মঁসিয়ে, মৃত কখনও কথা বলে না। কণ্ডাক্টরকে যখন একথা বলা হয়, তার আগেই মিসেস ক্যাথারিন-এর মৃত্যু হয়েছে। এটা মিসেস ক্যাথারিন বলেনি, বলেছে পরিচারিকা। এবং দুটো বলার মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়ে গেছে।
–আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না আঁসিয়ে। তাহলে কি কণ্ডাক্টর মিথ্যে বলেছে?
-না না, কখনও না। মিথ্যে সে কখনও বলেনি। যা সত্যি তাই সে বলেছে। কিন্তু যে রুথ তার পরিচারিকা নামিয়ে দেবার কথা বলেছে, সে আপনার মেয়ে রুথ নয়। সে সেজেছিল মাত্র।
হতভম্ব আলডিন-এর মুখে কোনো কথা নেই।
–মঁসিয়ে আলডিন, মনে রাখবেন গেয়ার দ্য নয়েনস পৌঁছবার আগেই আপনার মেয়েকে হত্যা করা হয়। এটা হলো অ্যাজ ম্যাসন-এর কাজ, সে তার কী নিহত হবার পর তার গা থেকে ফারের কোট এবং মাথার টুপিটা খোলে। নিজে সেগুলো পরে নিয়ে তারই ছদ্মবেশে কামরা থেকে হাত বাড়িয়ে ডিনারের বাক্স কেনে এবং সেই কণ্ডাক্টরকে একথা বলে।
–অসম্ভব। তার মানে আপনি বলতে চাইছেন রুথ-এর ছদ্মবেশে অ্যাজ ম্যাসনই একাজগুলো করেছে? আর কণ্ডাক্টর তাকে চিনতে পারল না।
-না মঁসিয়ে আলডিন, না। কিছুই অসম্ভব নয়। ক্ষণিকের দেখায় একজন আরেকজনের মুখ যত না মনে রাখে, তার চেয়েও বেশি মনে রাখে তার সাজপোশাককে। আপনার মেয়ে এবং অ্যাজ ম্যাসন দুজনেই মাথায় মাথায়। তার ওপর সেই একই ফারের কোট তার গায়ে, মাথায় সেই একই টুপি এবং সর্বোপরি রুথ ক্যাথারিন-এর মাথা থেকে কেটে নেওয়া কয়েক গোছা সোনালী চুল। নিজের মাথার দু-পাশের চুলের সঙ্গে বিনুনি করে কান পর্যন্ত ঝুলিয়ে দিয়ে মাথার টুপিটাকে চোখ পর্যন্ত টেনে দেয়। ও সহজেই কণ্ডাক্টরের চোখকে ফাঁকি দেয়। কণ্ডাক্টরের কাজ যাত্রীরা যখন ট্রেনে ওঠে তখন টিকিটগুলো সংগ্রহ করে রিজার্ভেশন চার্ট দেখে যাত্রীদের স্ব স্ব কামরা বলে দেওয়া। কাজেই কণ্ডাক্টরের পক্ষে সম্ভব নয় প্রতিটি যাত্রীর মুখ চিনে রাখা। শুধু মাত্র রাত্রে যাত্রীদের কামরায় গিয়ে তাদের বিছানাগুলো ঠিক করে বিছিয়ে দেওয়া। এখানেও সে তাই করেছে। একথা ঠিক অ্যাজ ম্যাসনই টিকিটগুলো তার হাতে জমা দেয়। কিন্তু টিকিট সংগ্রহ করার সময় সে রিজার্ভেশন চার্ট দেখে কামরা বলে দিতে ব্যস্ত ছিল। একটি স্ত্রী লোকের হাত থেকে টিকিট নিচ্ছে এটাই লক্ষ্য করেছে শুধু। কত্রী বা পরিচারিকাকে চিনে রাখার প্রয়োজন মনে করেনি। আর এও মনে রাখবেন, অ্যাজ ম্যাসন বা কিটি কিন্তু একজন নামকরা তুখোড় অভিনেত্রী। মুহূর্তের মধ্যে নিজের চেহারা বা কণ্ঠস্বর বদলে দিতে সে অদ্বিতীয়। তার পক্ষে ছদ্মবেশ ধরা পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু একটা বিপদের আশঙ্কা ছিল, যেটা হলো পরদিন সকালে রুথ ক্যাথারিনকে ঘুম ভাঙাতে এসে কণ্ডাক্টর হয়তো চিনে ফেলবে যে গতরাতে বিছানা পাতবার সময় সে যার সঙ্গে কথা বলেছে সে এই নিহত মহিলাটি নয়। এই কারণেই রুথ-এর মুখ বিকৃত করেছিল। অত্যন্ত মূল্যবান একটা সূত্র কণ্ডাক্টরের চোখের সামনেই ছিল। কিন্তু শুধু অসাধারণ দূরদর্শিতার জন্যে অ্যাজ ম্যাসন তার চোখে ধুলো দিয়েছে। এছাড়া আরও একটা বিপদের আশঙ্কা করেছিল মিস ম্যাসন, সেটা প্যারী থেকে ট্রেন ছাড়বার পর হয়তো ক্যাথারিন গ্রে এই কামরায় মিস ক্যাথারিন কাছে আসতে পারে। তাই সে মিস গ্রে কে দেখিয়ে ডিনার বাক্সটা কেনে এবং নিজের কামরা ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়। অর্থাৎ মিস গ্রেকে হাবভাবে বোঝাল সে যেন তার কামরায় না আসেন।
–কিন্তু রুথকে কে হত্যা করল আর কখন?
–প্রথমেই মনে রাখতে হবে এই অপরাধ দুজনে মিলে করেছে কিংটন ও অ্যাজ ম্যাসন। কিংটন সেদিন আপনারই কাজে প্যারী যায় এবং প্যারীর কাছে যে লুপ অর্থাৎ বড় বাঁকটা আছে, যেখানে ট্রেনের গতি মন্থর হয় সেখানে কোনো একটা জায়গায় কিংটন ট্রেনে ওঠে। মিসেস ক্যাথারিন তাকে দেখে খুবই অবাক হয়। তারপর কিংটন হয়তো বেশ কিছু দেখিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে বাইরে মিসেস ক্যাথারিন-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করায় এবং যেই সে সেদিকে দৃষ্টি ফেরায়, অমনি মুহূর্তের মধ্যে পেছন থেকে সরু মজবুত সিল্ক কর্ডটা তার গলায় পেঁচিয়ে দেয়। বাকি কাজটা মাত্র কয়েক সেকেণ্ডের ব্যাপার। কামরার দরজা বন্ধই ছিল। এরপর কিংটন ও অ্যাজ ম্যাসন কাজে লেগে যায়। প্রথমে মিস ক্যাথারিন-এর ওপরের জামাগুলো খুলে নেয়। তারপর মৃত দেহটাকে একটা কম্বলের মধ্যে জড়িয়ে পাশের সংযোগকারী কামরায় সুটকেস ও ব্যাগের সঙ্গে সিটের ওপর রেখে দেয়। এবার কিংটন জুয়েলস কেসটা নিয়ে নেমে যায়। বলা বাহুল্য ট্রেনটা তখনও বাঁকের মধ্যে থাকায় গতি আস্তেই ছিল। কিংটন দেখল বারো ঘন্টার আগে খুনের ব্যাপার জানাজানি হবার কোনো ভয় নেই, তারপর আজ ম্যাসন-এর মিসেস ক্যাথারিন সেজে কণ্ডাক্টরকে এক গল্প ফাদার ব্যাপার তো আছেই। সুতরাং অপরাধের সময় নিজের উপস্থিতিকে অন্য কোথাও প্রমাণ করতে বেগ পেতে হবে না। রুথ এর ড্রেস পরে নিয়ে গেয়ার দ্য নয়েন–এ এবার ডিনার বাক্সে কেনে অ্যাজ ম্যাসন। তারপর কণ্ডাক্টরকে তাঁদের ফাঁদের গল্প করল। কণ্ডাক্টরকে বলার সময় সে জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল। যাতে করিডর দিয়ে যাবার সময় কেউ তার মুখ দেখতে না পায়। সেখান দিয়ে তখন অনেকেই যাতায়াত করছিলেন। এমন কি মিস গ্রে ও সেই সময় সেখান দিয়ে যায় এবং যার ফলেই অনেকের মতো সে, সে সময় মিসেস ক্যাথারিন-এর জীবিত থাকার কথা বলেছিল।
-বলুন, বলুন,–আলডিন তাড়া দেয়।
ট্রেন নয়েনস্-এ আসার আগেই অ্যাজ ম্যাসন মৃতদেহটাকে আবার আগের কামরায় নিয়ে আসে। নিজে মিসেস ক্যাথারিন-এর ছদ্মবেশ বদলে ফেলে পুরুষ মানুষের ছদ্মবেশ ধরে ও ট্রেন থেকে নামার জন্য প্রস্তুত হয়। ড্রেক যখন তার স্ত্রীর কামরায় ঢোকে তখন সে দেখে তার স্ত্রী ঘুমোচ্ছে। মিঃ ক্যাথারিন আসার আগেই সবকিছু নিখুঁতভাবে সাজানো হয়ে গিয়েছিল। এবং অ্যাজ ম্যাসন তখন তার নিজের কামরাতেই লুকিয়েছিল। তারপর নয়েনস্-এ ট্রেন থামলে কণ্ডাক্টর যেই ট্রেন থেকে প্ল্যাটফর্মে নামে সেই সুযোগে পুরুষবেশী অ্যাজ ম্যাসনও প্ল্যাটফর্মে নেমে পায়চারী করতে থাকে। তারপর একসময় সকলের অলক্ষ্যে ঘুরতে ঘুরতে পরের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে প্রথম ট্রেনটা ধরে প্যারীতে গিয়ে পৌঁছয় এবং সেখান থেকে রীজ হোটেলে গিয়ে ওঠে। সেখানে কিংটন-এর অপরাধী জীবনের একমহিলা সহকারিণী আগের রাত থেকেই হোটেলের একটা ঘর বুক করে রাখে। সে শুধু চুপচাপ সেখানে আপনার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। রুবীগুলো এখন তার কাছে নেই এবং কখন ছিলও না। এদিকে আপনার সেক্রেটারীর ওপর কারোর নজরই পড়েনি তাই সে নির্ভাবনায় রুবীগুলো নিয়ে নিস্-এ চলে আসে। সেখানে মঁসিয়ে পপপুলাস-এর কাছে ওগুলো বিক্রির ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছে। শুধু ব্যবস্থা অনুযায়ী রুবীগুলো পপোপুলাস-এর কাছে পৌঁছে দেয় অ্যাজ ম্যাসন। মার্কুইস-এর মতো দুর্ধর্ষ ও তীক্ষ্ণবুদ্ধি সম্পন্ন অপরাধীরও এক যোগ্য প্ল্যান বটে। তার স্বভাবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস হলো তার সুন্দর ব্যবহার মানুষকে আকৃষ্ট করে। এবং আপনিও তার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে অতি অল্প সময়ের আলাপেই তাঁকে সেক্রেটারী নিযুক্ত করেন।
–কিন্তু কিংটন আমার সেক্রেটারী হবার জন্যে কোনো ব্যগ্রতা দেখায়নি। একথা আমি হলফ করতে বলতে পারি।
-সেক্রেটারী হবার জন্য সে ব্যগ্রতা দেখায়নি ঠিকই কিন্তু, সে আপানকে ব্যর্থ করে তুলেছিল। হা হা, এটাই তো তার অপরকে আকর্ষণ করার অদ্ভুত ক্ষমতা। আপনার সেক্রেটারী হবার জন্য কোনো ছলচাতুরী না করে শুধু মন ভোলানো ব্যবহারেই আপনাকে তার শিকার করে ফেলল। রিচার্ড কিংটনের কোনোরকম অসামাজিক বা অপরাধমূলক কাজের নজির নেই। বরং বড় ঘরের ছেলে, শিক্ষিত, সমাজের নামী লোকদের সঙ্গে কারবার এবং গত বিশ্বযুদ্ধে পদাতিক বাহিনীতে মেজর ছিলেন। আমি যখন একটু একটু করে মাকুইস-এর খোঁজ খবর নিতে থাকি তখন অনেক জায়গায় দুজনের মিল খুঁজে পাই। কিংটন অনর্গল ফরাসী ভাষায় কথা বলতে পারে। মাকুইসও পারে। কিংটন যে সময় ইংল্যাণ্ডে, আমেরিকা ও ফ্রান্সে ছিল মাকুইস-এর অপরাধগুলোও ঠিক একই সময় সংঘটিত হয়। মার্কুইস-এর শেষ অপরাধ সুইজারল্যাণ্ডে এবং সেই সময় সেইখানেই আপনার সঙ্গে কিংটনের পরিচয় হয়। সুইজারল্যাণ্ডে আপনার আগমন যে হার্ট অব ফায়ার সংগ্রহ করতে সে কথাও আপনি কথায় কথায় কিংটনকে বলেন।
কিন্তু সে খুন করতে গেল কেন?–করুণ একটা ভাব ফুটে উঠল আলডিন-এর মুখে এতই ধূর্ত যখন সে। শুধু রুবীগুলো চুরি করলেই তো পারত।
-না মঁসিয়ে আলডিন।–মাথা নাড়লেন পোয়ারো। মার্কুইস-এর এটাই প্রথম খুন নয়। অপরাধের সঙ্গে হত্যা করাটাও ওর একটা প্রধান চারিত্রিক বিশেষত্ব। আর অপরাধের কোনো প্রমাণই রাখে না মাকুইস সামান্য হলেও তাকে নিঃশেষে মুছে দেয়। সুতরাং খুন তাকে করতেই হয়। সিগারেটে একটা টান দিয়ে কাত হয়ে বললেন পোয়ারো, রত্ন চুরি করাই মার্কুইস-এর একটা বিশেষত্ব। বিশেষ করে যে সব রত্ন দুষ্প্রাপ্য। আপনার হার্ট অব ফায়ার সংগ্রহের কথা জেনে নেওয়ার পরই সে তার মতলব ঠিক করে ফেলে। প্যারীতে যেদিন আপনি রুবীটা কেনেন সেদিন দুজন গুণ্ডাকে আপনার পেছনে লাগিয়েছিল সেটা নেহাতই একটা মামুলী চেষ্টা। অবশ্য মার্কুইস পরের মতলবটা এতই মারাত্মক ভাবে করেছিল যে সেবার অকৃতকার্যতা তাকে বিন্দুমাত্র ঘাবড়ায়নি।
কিন্তু মার্কুইস রক্তমাংসের মানুষ। আরও সকলের মতো মার্কুইস-এর দুর্বলতা এসেছিল। হ্যাঁ, সে ভালোবেসে ফেলেছিল মিস ক্যাথারিন গ্রেকে। এখানে তার কোনো ছলচাতুরী ছিল না। মনে প্রাণে সে মিস গ্রেকে ভালোবেসেছিল! কিন্তু মার্কুইস-এর ধারণা ছিল মিস গ্রে মিঃ ক্যাথারিনকে ভালোবাসে। তাই ঘটনাক্রমে মিঃ ক্যাথারিন যখন এই খুনের ব্যাপারে জড়িয়ে গেল, মাকুইস-এর সামনে তখন সুবর্ণ সুযোগ মিঃ ক্যাথারিনকে ফাঁসিয়ে দেবার। বেচারা ড্রেক ক্যাথারিনকে হাজতে যেতে হলো। পায়ের উপর পা দিয়ে বসলেন পোয়ারো, এদিকে একদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। মন্টিকার্লোর বাগানে বসে মিস গ্রেকে প্রেম নিবেদন করল কিংটন। কিংটন চলে যাবার ঠিক পরেই মিস গ্রে হঠাৎ অদ্ভুত ভাবে আপনার মৃত কন্যার উপস্থিতি অনুভব করল। এবং এই উপস্থিতি সম্পর্কে মিস গ্রে দৃঢ় নিশ্চিত। আর আমি ভালোভাবে জানি মিস গ্রে কোনো রকম কল্পনা প্রবণতাকে মনে স্থান দেন না। উনি শুধু আপনার মেয়ের উপস্থিতিই অনুভব করেননি উপরন্তু আপনার মেয়ে যে তাকে একান্তভাবে কিছু একটা বলতে চেষ্টা করেছিলেন সে সম্বন্ধেও তিনি স্থির নিশ্চিত।
প্রথমে মিস গ্রে আপনার মেয়ের ইঙ্গিতটা বুঝতে পারেনি কিন্তু অনেক চিন্তার পর তার মনে হয় আপনার মৃত কন্যা কিংটনকেই খুনী বলে দেখিয়ে দিতে এসেছিলেন। এইভাবে একটা আজব ঘটনার মধ্যে দিয়ে উনি কিন্তু ইঙ্গিতটাকে বিশ্বাস করেছিলেন সেই বিশ্বাসে তিনি তার কাজ করে যেতে লাগলেন। তিনি কিংটনকে প্রত্যাখ্যান না করে বরং এমন ভাব দেখালেন যেন তিনিও বিশ্বাস করেন যে ড্রেক ক্যাথারিনই দোষী।
–আশ্চর্য তো আলডিন ফিসফিস করে বললেন।
–হ্যাঁ, সত্যিই অদ্ভুত ব্যাপার। এ কাউকে বলায় নয় মিস গ্রেও তাই কাউকে কিছু বলেননি। আরও একটা জায়গায় আমি ধাঁধাঁয় পড়েছিলাম। আপনার সেক্রেটারী একটু খুঁড়িয়ে চলত। কারণ জিজ্ঞেস করায় সে বলে যুদ্ধে তাঁর পায়ে বুলেট লাগে তাই। অথচ মার্কুইস খুঁড়িয়ে চলে না। এই দুটো অমিল আমাকে ভাবিয়ে তোলে। কিন্তু লেনক্স একবার আমাকে বলেন, তার মায়ের সৈনিকদের হাসপাতালে যে ডাক্তার কিংটনকে চিকিৎসা করেছেন তিনি দীর্ঘদিন পরেও কিংটনকে খুঁড়িয়ে চলতে দেখে অবাক হন। তখনই আমার সন্দেহ হয়। এই খুঁড়িয়ে চলাটাই তার ছদ্মবেশ। কিংটন ও মার্কুইস-এর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করার জন্যেই এই ছলনা। আমি লণ্ডনে গিয়ে সেই ডাক্তারের সঙ্গে ভালোভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম যে এটা ওর ছলনা ছাড়া কিছুই নয়। পরশুদিন কিংটন-এর শুনানীর সময় আমি সেই ডাক্তারের নাম বলেছি। যার নাম কিংটন কখনও কাউকে বলেনি। কারণ কিংটন জানত যে তার খুঁড়িয়ে চলার কোনো যুক্তিই ডাক্তারের কাছে ছিল না। আর এখানেই আমি আমার শেষ মোক্ষম সিদ্ধান্তে পৌঁছই। মিস গ্রেও আমাকে একটা পুরনো খবরের কাগজের কাটিং দেখান যা থেকে আমি জানতে পারি, কিংটন যখন লেডি টাম্পলিন-এর সৈনিক হাসপাতালে ছিল, সেই সময় সেখানে একটা ডাকাতির ঘটনা ঘটে। প্যারী থেকে আমার চিঠি পেয়েই মিস গ্রে বুঝতে পারে যে ওঁর আর আমার সন্দেহ একই লক্ষ্যে। প্যারীতে আমার জানবার ছিল যে অ্যাজ ম্যাসন রীজ হোটেলে কখন এসে পৌঁছয়? হ্যাঁ, আমার ধারণা ঠিক। আগের রাতেই রীজ হোটেলে একটা ঘর অ্যাজ ম্যাসন-এর নামে রিজার্ভ হলেও অ্যাজ ম্যাসন সেখানে পরের দিন ভোরে পৌঁছায়।
পোয়ারো চুপ করলেন। কিছুক্ষণ বাদে আস্তে আস্তে আলডিন একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন। মঁসিয়ে পোয়ারো আপনার প্রশংসা করার মতো কোনো ভাষা নেই। আপনি সত্যিই অনন্য। আমি আপনার কাছে চির কৃতজ্ঞ। আমি আপনাকে একটা চেক দিতে চাই, যদিও এর দ্বারা আমি আমার কৃতজ্ঞতার পরিমাণ আপানকে বোঝাতে পারব না।
উঠে দাঁড়ালেন পোয়ারো। মৃদু হাসি ও বিনম্র স্বরে বললেন, আমি তো সামান্য এরকুল পোয়ারো। আমাকে দিয়ে আপনার কার্যোদ্ধার হয়েছে। এটাই আমার সবচেয়ে বড় আনন্দ ও বড় পুরস্কার।
আলডিন-এর কাছে বিদায় নিয়ে হোটেলের লাউঞ্জে দেখা হলো মঁসিয়ে পপোপুলাস ও তাঁর মেয়ে জিয়ার সঙ্গে।
–আরে। মঁসিয়ে পোয়ারো যে, আমি তো ভেবেছিলাম আপনি নিস থেকে চলেই গেছেন। পোয়ারোর একটা হাত নিজের হাতে নিলেন পপোপুলাস।
–আমার কাজই আমাকে আবার টেনে নিয়ে এলো।
–কাজ?
–সত্যিই তাই। আপনি আছেন কেমন?
–ভালোই আছি। কালই আমরা প্যারীতে ফিরে যাচ্ছি।
-খুব সুখবর। শুনলাম আপনি না কি প্রাক্তন গ্রীক মন্ত্রীকে বেশ ভালোভাবেই বধ করেছেন?
-আমি?
-হ্যাঁ। আপনি ওঁর কাছে একটা অপূর্ব সুন্দর রুবী বিক্রি করেছেন না? যেটা নৃত্যশিল্পী মিরেলি পরেন। অবশ্য ব্যাপারটা একান্তভাবে আপনার আমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ বলেই বললাম।
-ও হ্যাঁ। ঠিকই বলেছেন মঁসিয়ে পোয়ারো।
-আচ্ছা, রুবাটা সেই বিখ্যাত হার্ট অব ফায়ারর মত নয় তো?
–অনেকটা তার সঙ্গে মিল আছে বটে।
–সত্যিই মিঃ পপোপুলাস, রত্নের ব্যাপারে আপনার হাতযশ অসামান্য। কিন্তু মাদমোয়াজেল জিয়া যে আমাকে নিঃসঙ্গ করে এত তাড়াতাড়ি প্যারী ফিরে যাচ্ছেন, কোথায় ভাবলাম কাজকর্ম শেষ হলো, এবার মিস জিয়ার সঙ্গে প্রাণ খুলে আলাপ করা যাবে। না; তা আর হলো না দেখছি।
-আচ্ছা, জিজ্ঞেস করতে পারি কি মঁসিয়ে কাজটা কি ছিল এখানে?–বললেন পপোপুলাস।
–নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, স্বচ্ছন্দে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। এতদিন যে শুধু বুদ্ধির জোরেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে অবাধে অপরাধ লীলা চালিয়ে এসেছে, সেই মাকুইসকে ধরার ব্যাপারেই একটা সাহায্য করলাম মাত্র। মাকুইস-এর এবারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল এরকুল পোয়ারো।
-মাকুইস।–বিড়বিড় করলেন পপোপুলাস। কেমন যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে নামটা?; মনে করতে পারছি না।
–ও আপনি মনে করতে পারবেন না। ও কথা বাদ দিন। আমি একজন বিখ্যাত অপরাধীর কথা বলেছিলাম। রত্ন চুরি করাই তার অন্যতম প্রধান নেশা। সম্প্রতি সে মাদাম ক্যাথারিন নামে এক ইংরেজ মহিলাকে খুন করার জন্যে গ্রেপ্তার হয়েছে।
-তাই নাকি। শুনতে হবে তো একদিন ঘটনাটা। আজ আমার আবার একটু কাজ….
-হা মঁসিয়ে পপোপুলাস, আমারও একটু তাড়া আছে। মাদমোয়াজেল জিয়া, আবার কোনো এক সুন্দর দিনে আপনার সুন্দর মুখ দেখার আশায় রইলাম, তখন ভালো করে আলাপ করা যাবে। চলি।
পোয়ারোর সুন্দর রসিকতায় মুগ্ধ হয়ে বাবা ও মেয়ে তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর পপোপুলাস বললেন, লোকটা একটা ধূর্তের শিরোমণি।
–কিন্তু যাই বলো বাবা, আমার কিন্তু ওকে ভালোলাগে। আমি ওঁকে পছন্দ করি। ওর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ওপর যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে আমার।
-কিন্তু আমাদের কাছে ও একটা সাক্ষাৎ শয়তান, সাক্ষাৎ….
.
৩৩.
সমুদ্রের স্বাদ
আরও দুদিন কেটে গেছে। সেই মর্মান্তিক ঘটনার স্মৃতি মানুষের মন থেকে অতীতের দিকে এগিয়ে গেছে। শুধু একটা প্রায় মিলিয়ে যাওয়া স্মৃতির করুণ সুর কয়েকটি বিশেষ মনকে থেকে থেকে আক্ষেপে ভরিয়ে তুলেছে। মার্গারেট ভিলার বারান্দায় মুখোমুখি বসে এরকুল পোয়ারো ও লেনক্স। সামনের সমুদ্রকে আজ যেন বড় বেশি নীল দেখাচ্ছে। পোয়ারো এই মাত্র লেনক্সকে সমস্ত ঘটনাটা শোনালেন। চুপ করে একটু ভেবে তারপর আস্তে আস্তে বলল লেনক্স, ড্রেকের কি হলো?
–তাকে গতকাল ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
–কোথায় গেছে সে?–করুণ দেখাল লেনক্সকে
–গত রাত্রেই তিনি নিস্ ছেড়ে চলে গেছেন।
–কোথায়? সেন্ট মেরি মিড়-এ?
–হ্যাঁ।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকবার পর লেনক্স প্রায় অস্ফুট স্বরে বলল, আমারই চিনতে ভুল হয়েছে মাসীকে। আমি ভেবেছিলাম ও বোধহয় ড্রেককে গ্রাহ্যই করে না।
মিস গ্রে অত্যন্ত চাপা স্বভাবের মহিলা। উচ্ছ্বাসের আতিশয্যে কখনও অধীর হন না। নিজের মনের কথা আজ অবধি কাউকেই বলেননি।
–অবশ্য আমাকে বললে নিশ্চয়ই ওর কোনো ক্ষতি হতো না।– অভিমান ফুটে উঠল। লেনক্স-এর স্বরে।
-হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। আপনাকে বিশ্বাস করলে তার নিশ্চয়ই কোনো ক্ষতি হতো না। কিন্তু মাদমোয়াজেল ক্যাথারিন সেই জাতের মেয়ে, যারা নিজের কথা বলার চেয়েও অন্যের কথা শুনতে ভালোবাসে। এদের জীবনের সুখ-দুঃখের কোনো ব্যাপারেই এঁরা অন্যকে ভাগীদার করেন না। নিজেরাই সব সইয়ে নেন।
-সত্যি আমি কি বোকা! জানেন, আমি ভাবতাম, মাসী বোধ হয় কিংটনকে ভালোবাসে। আমার আরও একটু বোঝা উচিত ছিল। তাহলে হয়তো আমি অহেতুক নিজেকে ড্রেক-এর প্রতি….।
-গলার আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে চোখের পাতাগুলোও ভিজে আসছিল লেনক্স-এর। পোয়ারো তাড়াতাড়ি তার একটা হাত তুলে নিজের হাতে নিয়ে একটু চাপ দিলেন। মাদমোয়াজেল দুঃখ করবেন না। আমি জানি আপনি ক্যাথারিনকে ভালোবাসেন। তিনি কিন্তু। আপনাকে অত্যন্ত স্নেহের চোখে দেখেন।
–ঠিকই বলেছেন আপনি।–বাঁ হাতের আঙুল দিয়ে গালের ওপর গড়িয়ে পড়া কয়েক ফোঁটা চোখের জল মুছে নিল লেনক্স। তাছাড়া ড্রেকের কাছে এখনও আমি ছোটটিই হয়ে গেছি। ও এখন পরিণত স্পর্শের আস্বাদ চায়। অনেকক্ষণ চুপ করে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ সে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। কিন্তু যাই বলুন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমিও কিছু সাহায্য করেছি। যে ভাবেই হোক আমার সাহায্যও কাজে লেগেছে।
নিশ্চয়ই আপনি সাহায্য করেছেন মাদমোয়াজেল। আপনি যে মুহূর্তে বলেন খুনীর পক্ষে ট্রেনের যাত্রী না হয়েও বাইরে থেকে খুন করা সম্ভব, সেই মুহূর্ত থেকেই আমি সত্যের আলো দেখতে পাই। আমার কাছে খুনের ব্যাপারটা তখন জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। তার আগে খুন হওয়ার ঘটনাটা আমার কাছে বেশ জটিল মনে হয়েছিল। সে কৃতিত্ব সম্পূর্ণ আপনার। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল লেনক্স :- ওই আমার সান্ত্বনা–তাতেই আমি খুশী।
অনেকদূর থেকে ইঞ্জিনের তীব্র বাঁশির আওয়াজ ভেসে এলো। লেনক্স বলল, এই সেই ব্ল ট্রেন যাচ্ছে। আচ্ছা মঁসিয়ে পোয়ারো ট্রেন জিনিসটা অদ্ভুত সৃষ্টি না। এ কোনোদিন থামবে না। এর চলার কোনো বিরাম নেই। বিশ্রাম নেই। মানুষ খুন হচ্ছে। কত নানা রকমের ঘটনা ঘটছে। এই ট্রেনের বুকে অথচ বিরামহীন তার চলা। যাকগে, কি সব যা তা বকে চলেছি আমি।
-হা হা, ঠিকই বলেছেন মাদমোয়াজেল। মানুষের জীবনটা তত ট্রেনেরই মতন! ট্রেনেরই মত তার অবিশ্রাম গতিবেগ। তবে দুয়ের মিল মঙ্গলসূচক।
-কেন?
–কারণ যাত্রাপথ যত দীর্ঘই হোক না কেন ট্রেনকে অবশেষে একটা জায়গায় থামতেই হয়। যাত্রাপথেরও একসময় শেষ হয়। আর সেই যে একটা প্রবাদ আছে-যাত্রাপথের শেষ হলেই মানুষ তার ভালোবাসার জনকে পায়।
হেসে উঠল লেনক্স। আমার বেলায় ও কথা প্রযোজ্য নয়। একেবারেই মিলল না।
-এখনও আপনার যাত্রাপথ শেষ হয়নি মাদমোয়াজেল। শেষ হোক–তখন নিশ্চয়ই মিলবে। আপনি এখনও ছেলেমানুষ।
নিজেকে যতটা ছেলেমানুষ ভাবেন তার চেয়েও অনেক বেশি ছেলেমানুষ আপনি। মানুষের ট্রেনরূপী জীবনে বিশ্বাস রাখবেন মাদমোয়াজেল, কারণ এই ট্রেনের চালক স্বয়ং সর্বশক্তিমান ঈশ্বর।
আবার ইঞ্জিনের বাঁশি শোনা গেল।
-ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখবেন মাদমোয়াজেল। অন্তরঙ্গ চোখে তাকালেন পোয়ারো, আর বিশ্বাস রাখবেন এই এরকুল পোয়ারোর দিকে। আপনাদের পোয়ারো ঈশ্বরে বিশ্বাস করে যে মূল্য লাভ করেছে, তা স্বর্গীয় তা অমৃত সমান।