দি পেল হর্স – ৯

নবম অধ্যায় 

হারসিয়া হালকা গলায় বললো, গ্রামে কি সব চিত্তাকর্ষক ঘটনা ঘটছে। 

এখুনি আমাদের ডিনার খাওয়ার পালা চুকলো। এক এক কাপ নিছক কালচে কফির পেয়ালা বসানো আমাদের সামনে। 

ওর দিকে তাকালাম। এসব কথা ওর মুখ থেকে শুনবো বলে আশা করিনি। 

মিনিট পনেরো ধরে আমার কাহিনী ওকে শুনিয়েছি। বেশ বুদ্ধিমতীর মতন আগ্রহ ভরে সে আমার কাহিনী শুনেছে। কিন্তু শোনবার পর তার কাছ থেকে যে সাড়া পেলাম তা আমার কাছে একেবারেই আশাব্যঞ্জক নয়। তার কণ্ঠস্বরে আশ্রয় দেওয়ার ইঙ্গিতও নয়। তাকে মানসিকভাবে আহত মনে হলো না। দেখা পেলো না তার মধ্যে কোনোও চাঞ্চল্য। 

—যে সব লোক বলাবলি করে যে, গ্রাম শান্ত, বোবা আর যত উত্তেজনার খোরাক সবকিছু রয়েছে শহরে তারা জানে না তারা কি বলছে। হারসিয়া বলতে লাগলো, ডাইনীদের অবশিষ্টরা ভেঙে পড়া কুটিরের মধ্যে গিয়ে মুখ লুকিয়েছে, সহিষ্ণু যুবকরা জমিদারের খাস খামারে তাদের জন্য নীরবে আড়ম্বরহীন শব সৎকারের ব্যবস্থা করেছে। বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোর বুকে এখনও শুধু কুসংস্কারের অস্তিত্ব রয়েছে। মধ্যবয়সী কুমারীরা কেবল মন্ত্রতন্ত্র আওড়ায়, ডুগডুগি বাজায় আর কাগজের উপর মৃত আত্মার আদেশ লেখার জন্য ‘ভর’ হওয়ার ভান করে। এ সম্বন্ধে লেখকরা চটকদার প্রবন্ধও লিখে থাকে। আচ্ছা চেষ্টা করে এমন প্রবন্ধ লিখছো না কেন? 

—হারসিয়া, মনে হচ্ছে তোমাকে যা বলছি তা তুমি ঠিক বুঝতে পারছো না। 

—না মার্ক, বুঝতে পারছি। মনে হচ্ছে, তোমার কাহিনী দারুণ রোমাঞ্চকারী এবং চিত্তাকর্ষক যেন ইতিহাসের পাতায় উদ্ধৃত, মধ্যযুগের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনার সঙ্গে একটা যোগ রয়েছে। 

বিরক্ত হয়ে বললাম, ইতিহাসের দিক দিয়ে বিচার করার জন্য আমি মাথা ঘামাচ্ছি না। কেবল যা সত্য এবং ঘটনা তার প্রতিই আমার কৌতূহল। তা হচ্ছে কয়েকটা না লেখা একখানা কাগজ। জানি ওই লোকগুলোর কি হয়েছে? এবং অবশিষ্টদের ভাগ্যে এখন কি ঘটতে চলেছে অথবা কি হচ্ছে? 

—তুমি কি ভাবাবেগে ভেসে যাচ্ছো না মার্ক? 

নাছোড়বান্দার মতন জবাব দিলাম, না, আমার তা মনে হচ্ছে না। সর্বনাশ যা ঘটেছে তা আমার ধারণায় সত্য। আর কেবল আমিই এ কথা ভাবছি না। পাদরী সাহেবের স্ত্রীও আমার কথায় সায় দিয়েছেন। 

বিরক্ত তিক্ত কণ্ঠে বললো হারসিয়া, ওহো পাদরী সাহেবের স্ত্রীও সায় দিয়েছে। 

—না, না। পাদরী সাহেবের স্ত্রী ঠিক এভাবে কথাটা বলেননি। অসাধারণ রমণী তিনি। গোটা ঘটনাটা কিন্তু সত্য, হারসিয়া। 

হারসিয়া বারেক কাঁধ নাচিয়ে বললো, হবেও বা। 

—কিন্তু তোমার কি তা মনে হচ্ছে না? 

—আমার ধারণা তোমার কল্পনাশক্তি খানিকটা উড়ে গেছে, মার্ক, সাহস করেই বলছি তোমার এই মধ্য বয়স্কা বিড়লীরা নিজেদের উপর প্রকৃত বিশ্বাস স্থাপন করে কাজ করছে। তাই ওরা যে নোংরা স্বভাবের বিড়ালী সে সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত। 

— কিন্তু সত্যিকারের মন্দ স্বভাবের স্ত্রীলোক নয়। 

—সত্যি কথা, মার্ক তারা তেমন হবে কি করে? 

মুহূর্তের জন্য নীরব হলাম। আমার মন দোদুল্যমান, আলোক থেকে আঁধারে যাচ্ছে। আবার ফিরে আসছে আলোকে। আঁধার হচ্ছে ‘পেল হর্স’ পান্থশালা—আর আলোকের সূর্য প্রতীক হারসিয়া। প্রতিদিনের চেতনাসম্পন্ন এক শুভ্র আলোকশিখা—যেন খোপে শক্ত করে আটকানো একটা উজ্জ্বল বিদ্যুৎবাতি—সমস্ত আঁধার ঢাকা কোণগুলো আলোকে ভরে দিচ্ছে। ঘরের মধ্যে দৈনন্দিন ব্যবহার করা বস্তু সম্ভার আর আসবাব ছাড়া আর কিছু নেই, একেবারেই কিছু নেই। কিন্তু তবু হারসিয়ার ছড়িয়ে দেওয়া আলোক তরঙ্গ – যা বস্তু সম্ভারকে পরিষ্কার ভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে, সে আলোক তরঙ্গ নকল। 

আমার মন ফিরে এলো। দৃঢ়ভাবে, উদ্ধতভাবে। তাই বললাম, আমি এর সবকিছু দেখতে চাই, হারসিয়া। যা কিছু ঘটছে তার তলদেশ পরখ করা প্রয়োজন। 

—মানছি তোমার কথা। সত্যিই তোমার তা করা উচিত। এটা মজার ব্যাপারও হতে পারে। সত্যিই এটাও একটা মজা ছাড়া আর কিছু হবে না। 

তীব্রকণ্ঠে জবাব দিলাম, না, এটা মজা নয়। তুমি আমাকে সাহায্য করো, এটাই আমি চাই হারসিয়া। 

 —তোমাকে সাহায্য করবো? কিন্তু কিভাবে? 

—ব্যাপারটা তদন্তের কাজে আমাকে সাহায্য করো। এটা আসলে কি সেটাই জানতে চেষ্টা করো।

—কিন্তু মার্ক, এখন আমি ভয়ানক ব্যস্ত। পত্রিকার জন্য প্রবন্ধ লিখছি। আর বাইজানটিয়ান বস্তুগুলো নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। আমার দুজন ছাত্রকে কথা দিয়েছি…। তার কণ্ঠস্বরে যুক্তির বুদ্ধিমত্তার স্পর্শ রয়েছে। 

কিন্তু আমি একেবারেই তার কথা শুনছিলাম না। এক সময় বললাম, বুঝেছি। তোমার হাতে বহু কাজ রয়েছে। 

—ঠিক তাই। আমার অভিযোগ শুনে হারসিয়া সোয়াস্তি লাভ করেই যেন কথাটা বললো। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। হারসিয়ার চোখে মুখে এই আসকারা দেওয়ার ভাবপ্রকাশ দেখে আমি দারুণ অবাক হয়ে গেলাম। নতুন খেলনা নিয়ে ছেলেকে অভিনিবিষ্ট দেখে একমাত্র মায়ের মুখেই এমন আসকারার ভাবপ্রকাশ ঘটে। 

উচ্ছন্নে যাক ওর মুখের এসব ভাবপ্রকাশ, আমি বাচ্চা ছেলে নই। কোনো মায়ের সন্ধানে আমি উদ্‌গ্রীব নই—নিশ্চয় এই ধরনের কোনো মায়ের খোঁজ করছি না, আমার নিজের মা ছিলেন আনন্দময়ী, নিরানন্দের কোনো চিহ্ন ছিল না, তাঁর আচারআচরণে, তাই তাঁর চারপাশে যারা ছিলো এবং তাঁর ছেলেরা গভীর শ্রদ্ধায় তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতো। বিরক্ত চিত্তে মুখোমুখি বসে থাকা হারসিয়াকে আমি মনে মনে যাচাই করছিলাম। 

কত রূপবতী, মানসিক দিক দিয়ে কত উন্নত, কত বুদ্ধিমতী আর কত বিচিত্র পড়াশুনার অভিজ্ঞতা হারসিয়ার। এবং কিভাবে কোনো একজন এত কিছু আহরণ করে? কাজের ব্যাপারটা একেবারেই অবাধ্য। 

****

পরের দিন সকালবেলাতেই জিম করিগ্যানের সাথে দেখা করতে গেলাম, কিন্তু দেখা হলো না। তাই একটা চিরকুট লিখে জানিয়ে এলাম যে, যদি সে সন্ধ্যে ছ’টা থেকে সাতটার মধ্যে চা পানে বাড়ি ফেরে তবে আমি আসবো। জানি করিগ্যান খুবই কাজে ব্যস্ত। তাই আমার মনে তার সাথে দেখা হওয়া সম্বন্ধে বেশ সন্দেহ ছিলো। কিন্তু সাতটা বাজতে দশ মিনিট আগে সত্যিই সে হাজির হলো। আমি যখন ওর জন্য হুইস্কি ঢালছিলাম তখন সে আমার বই ও নানা ধরনের ছবি সংগ্রহ করে দেখাচ্ছিলো অবাক হয়ে। অবশেষে সে মন্তব্য করলো যে, আমার কর্মব্যস্ত পুলিশ সার্জেন নয় হওয়া উচিত ছিলো একজন মোগল সম্রাট। 

অবশেষে আসনে বসে করিগ্যান বললো, সাহস করে এটা বলতে পারি যে নারীঘটিত ব্যাপারে সম্রাটরা সবসময় ব্যতিব্যস্ত থাকলেও আমি এ ব্যাপারে একেবারে মুক্ত পুরুষ। 

—তাহলে তুমি বিয়ে করোনি? 

—ভয় নেই। তোমার ঐ অগোছালো সংসার দেখেই কথাটা অনুমান করে নিচ্ছি। ঘরে বউ থাকলে এসব অগোছালো কখন ঘুচে যেতো। মদের গেলাসটা টেবিলে রাখতে রাখতে বললাম, তোমার মত আমি মেয়েদের খারাপ মনে করি না, বুঝেছো? 

করিগ্যান মদের গেলাসে চুমুক দিলো। 

—তুমি হয়তো অবাক হয়ে ভাবছো, কেন তোমার সাথে আমার দেখা হওয়াটা খুবই জরুরি। এর মধ্যে এমন একটা ব্যাপার ঘটে গেছে যার সঙ্গে আগের দিন তোমাতে আমাতে সে বিষয়ের আলোচনা করছিলাম তার সম্পর্ক রয়েছে। 

—ব্যাপারটা কি বলো তো? ওহো, বুঝেছি। সেই ফাদার গোরম্যানের খুন হওয়ার ব্যাপারটা! 

—হাঁ। তবে প্রথমে বলো ‘পেল হর্স’ শব্দ দুটো শুনে তুমি কি কিছু বুঝতে পেরেছো?

—পেল হর্স…পেল হর্স…না, বুঝতে পারছি না। কিন্তু কেন জিজ্ঞাসা করছো? সাথে পেল হর্সের একটা সম্পর্ক থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বন্ধুদের সাথে সুচ ডিপিঙ নামের একটা গ্রামে বেড়াতে গিয়েছিলাম। বন্ধুরা আমাকে একটা পুরানো আমলের কফিখানায় নিয়ে যায়। ওটাই সেকালে ছিল পান্থনিবাস, ‘পেল হর্স’। 

—একটু থামো। সুচ ডিপিঙের নাম করলে তো? ওটা বোনসাউথের কাছাকাছি কোনো গ্রামে? 

—গ্রামটা বোধহয় বোনসাউথ থেকে মাইল পনের দূরেই হবে। 

—মনে হয়, ‘ভেনবলস’ নামের কোনো লোকের সাথে ওখানে তোমার দেখা হয়নি? 

—হ্যাঁ নিশ্চয় হয়েছে। 

—সত্যিই দেখা হয়েছে কি? উত্তেজনায় করিগ্যান সোজা হয়ে উঠে বসলো, দেখছি গ্রামে শহরে ঘুরে বেড়ানোর তোমার প্রবল শক্তি রয়েছে। কেমন দেখতে তাকে? 

—খুবই দর্শনীয় আর উল্লেখযোগ্য লোক সে। 

—সত্যিই কি সে দর্শনীয়? কোনো দিক দিয়ে সে দর্শনীয়? 

—প্রধানত তার ব্যক্তিত্বের জন্য। যদিও পোলিও রোগের দরুণ সে প্রায় পুরোপুরি পঙ্গু। করিগ্যান আমাকে তীব্রকণ্ঠে বাধা দিয়ে শুধালো, কি বললে? 

—কয়েক বছর আগে তার পোলিও হয়েছিল। তার ফলে তার কোমর থেকে নিম্নাঙ্গ পক্ষাঘাতে পুরোপুরি অক্ষম। 

বিরক্তি তিক্ত চিত্তে করিগ্যান চেয়ারের পিঠে ঠেসান দিয়ে বসলো। কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে বললো, ওটাই তাকে কুঁরে কুঁরে শেষ করছে। আমার মনে হচ্ছে, এটাই ওর পক্ষে ভালো। 

—তুমি কি বলতে চাইছো, বুঝতে পারছি না। করিগ্যান বললো, তোমাকে একবার গোয়েন্দা দপ্তরের প্রধান ইনসপেক্টর লেজুনের সঙ্গে দেখা করতে হবে। তোমার কথা তার কাজে লাগবে। ফাদার গোরম্যান খুন হওয়ার পর ইনসপেক্টর লেজুন জনসাধারণের কাছে খবর জানতে চেয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করছে, যদি কোনো লোক সে রাতে ফাদার গোরম্যানকে অনুসরণ করতে দেখে থাকে তবে সে যেন থানায় সমস্ত খবর পাঠায়। যে সব খবর এসেছে তার মধ্যে সারবস্তু কিছু নেই। খুনের ঘটনার কাছাকাছি অঞ্চলের একটি ওষুধের দোকানের কর্মী অসবর্ণ। সে জানিয়েছে, সে রাতে ফাদার গোরম্যান তবে দোকানের সামনে দিয়ে গিয়েছিলেন আর একজন তাঁর পিছু নিয়েছিলো। লোকটিকে সে ভালোভাবে দেখেছিলো তাই তার চেহারার বর্ণনাও জানিয়েছে। মনে হয় আবার লোকটাকে কোথাও দেখলে সে ঠিক চিনতে পারবে। 

আমি নীরবে করিগ্যানের কথা শুনছিলাম, – কদিন আগে ওই অসবর্ণ জানিয়েছে যে, সে এখন কাজ থেকে অবসর নিয়ে বোনসাউথের কাছাকাছি এক গ্রামে বাস করছে। গ্রামের মেলায় সে ওই লোকটিকে দেখতে পেয়েছে। লোকটা চাকালাগানো চেয়ারে বসে মেলায় ঘুরছিলো। মেলার লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে অসবর্ণ জানতে পেরেছে যে, লোকটার নাম ভেনবলস। 

বলা শেষ করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে করিগ্যান আমার দিকে তাকাল। 

ঘাড় নেড়ে বললাম। ঠিক, ওই লোকটাই ভেনবলস। সে সত্যিই ভেনবলস। কিন্তু সে রাতে প্যাডিংটনের রাস্তায় ফাদার গোরম্যানকে অনুসরণ করেছিলো। সে তো দু’পায়ে ভর দিয়ে হাঁটছিলো। সে কি করে ভেনবলস্ হবে। দৈহিক বিচারে এমনটা সম্ভব নয়। তাই অসবর্ণ ভুল করেছে। 

—অসবর্ণ কিন্তু নির্ভুলভাবে লোকটার চেহারার বর্ণনা দিয়েছে। দেহের উচ্চতা প্রায় ছ’ফুট। উঁচু খৰ্গ নাসা এবং সহজে নজরে পড়ে এমন কণ্ঠমণি। ঠিক বলছি না? 

—হ্যাঁ ভেনবলসের চেহারার সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে। কিন্তু…। 

—জানি। সিস্টা অসবর্ণের লোক চেনার ক্ষমতা খুব সীমিত। তাই চেহারার মধ্যে সামান্য মিল আছে, দেখে ঠিক লোককে চিনতে ভুল করেছে। কিন্তু ওই অঞ্চল থেকে তুমিও তো এসেছো, মুখে শুধু পেল হর্সের কথাই বলছো আর কোনো সঠিক খবর তোমার কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে না। এই ‘পেল হর্স’ বস্তুটি কি? 

তোমার কাহিনী শোনাও এবার। 

তাকে সাবধান করে দিয়ে বললাম, সে কাহিনী তুমি বিশ্বাস করবে না। কেননা নিশ্চয়ই তা বিশ্বাস করতে পারছি না। 

—ঠিক আছে। বলো তো শুনি। 

থিরজা গ্রের সাথে আমার যে সব কথাবার্তা হয়েছে তা বললাম। 

করিগ্যানের মনে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। বললো, ঠিক অবর্ণনীয় ঘটনার সংঘাত। 

—ঠিক তাই। তাই না? 

—হ্যাঁ, নিশ্চয় তোমার কি হয়েছে মার্ক? অনেকগুলো সাদা মুরগী মনে হয়। বলি দিয়ে দিয়েছো। স্থানীয় এক ডাইনীর উপর ভর হচ্ছে সে মাধ্যম। আর মধ্যবয়সী এক গ্রাম্য কুমারী সুদূরে নিশ্চিত প্রাণঘাতী মৃত্যু রশ্মি পাঠাচ্ছে। এসব উদ্ভট পাগলামি বুঝলে হে? ভারি গলায় বললাম, হ্যাঁ। পাগলামি তো বটেই। 

—ওহো। আমার কথায় সায় দেওয়ার চেষ্টা থামাও মার্ক। যা তুমি করে এসেছো তা শুনে মনে হচ্ছে যে, এর মধ্যে একটা কিছু আছে। এর সঙ্গে একটা সত্য যে সম্পর্কিত তা তুমিও বিশ্বাস করো, তাই না? 

—প্রথমে তোমাকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছি। যারা মারা গেছে তাদের প্রত্যেকের মনে মৃত্যুর জন্য একটা গোপন আকুতি বা ইচ্ছে ছিল। এর মধ্যে কি কোনো বৈজ্ঞানিক সত্য নিহিত আছে? 

মুহূর্তের জন্য করিগ্যান দ্বিধাগ্রস্ত হলো। তারপর বলতে লাগলো, দ্যাখো আমি মনঃসমীক্ষক নই। আলোচনা কেবল তোমার আর আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে বলছি যে, আমার ধারণা এই সব লোকগুলো নিজেরাই একটু বাতিকগ্রস্ত। মদের গাঁজলার মতন তাদের আচার আচরণ। নানা তত্ত্বের মিশ্রণ তারা আকণ্ঠ পান করে। এসব নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করাও তাদের স্বভাব। তোমাকে বলতে পারি যে, অর্থের লালসায় কোনো পুরুষ যখন কোনো বৃদ্ধাকে খুন করে তখন বিবাদীর পক্ষে খুনের ব্যাখ্যা করার জন্য কোনো চিকিৎসা শাস্ত্র বিশারদ সাক্ষী হাজির হোক তা পুলিশ চায় না আর সাক্ষ্য দেওয়ার কাজটা ভালো চোখে দেখেও না। 

—তুমি তোমার সেই কোষ সম্বন্ধীয় তত্ত্ব আওড়ানো তাই তো? 

হাসলো করিগ্যান। তারপর একসময় বলতে লাগলো, ঠিক আছে। স্বীকার করছি আমিও তাত্ত্বিক। কিন্তু আমার তত্ত্বের মধ্যে নিহিত রয়েছে বাস্তব কারণ যদি কোনো দিন সে—সত্য আবিষ্কার করতে পারি। কিন্তু এসব অবচেতন মনের কাণ্ডকারখানা। বোগাস। 

—তুমি কি এটা বিশ্বাস করো না? 

—নিশ্চয় এটা বিশ্বাস করি। তবে এই ছোকরাগুলো এটা নিয়ে বড় বেশি বাড়াবাড়ি করছে। এই যে অবচেতন মনের ‘মৃত্যু ইচ্ছা’–বলছি এসব সম্বন্ধেই। অবশ্য এর মধ্যে একটা কিছু নিশ্চয় থাকতে পারে এবং আছে, কিন্তু ওরা যতটা বলছে বা বোঝাচ্ছে ততটা সত্য নেই।

—কিন্তু এমন বস্তুর তো অস্তিত্ব রয়েছে। নিজের মনের জেদ প্রকাশ করে বললাম।

—তুমি বরং এখন গিয়ে মনস্তত্ত্বের একখানা বই কিনে এনে পড়াশোনা করো তবে ভালো হয়। 

—থিরজা গ্রে দাবি করেছে, যা জানবার তা সবই সে জেনেছে। 

—থিরজা গ্রে। নাক ঝাড়ার এক ধরনের বিশ্রি আওয়াজ করে করিগ্যান বললো, একটা আধ ঝলসানো গ্রাম্য কুমারী মননবিদ্যার কতটুকু জানে? 

—সে বলেছে যে, অনেক কিছুই তার জানা 

—আগেই তো বলেছি, এ ঘটনার সংঘাত। মন্তব্য করলাম—সুপরিচিত ধ্যানধারণা স্বীকার করে না এমন কোনো আবিষ্কার লোকজন এ ধরনের মন্তব্য করে থাকে। তাই তো ব্যাঙেরাও রেলিঙের উপর দাপিয়ে ঘোরে…। 

সে আমাকে বাধা দিয়ে বললো, তাহলে দেখছি বঁড়শি, সুতো, ফাতনা সবই তুমি গিলে ফেলেছো। তাই না? 

—একেবারেই তা নয়। আমি শুধু জানতে চাই এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কিনা। করিগ্যান নাক থেকে এক আজব আওয়াজ করে বললো, বৈজ্ঞানিক ভিত্তি! ফুঃ।

—ঠিক আছে। আমি কেবল সেটাই জানতে চাই। 

—এর পরে তুমি বলতে শুরু করবে, সেই হচ্ছে বাক্স হাতে রমণী। 

—বাক্স হাতে রমণী কে? 

—এ হচ্ছে মাঝে মাঝে ছড়িয়ে পড়া নানা ধরনের আজব কাহিনীর একটি—ঠাকুমার ঝুলি থেকে বেরিয়ে আসা নস্ত্রাদামের একটা কাহিনী। কিছু লোক আছে, যারা এসব কাহিনী শুনে বিশ্বাস করে। 

—আমাকে অন্তত তুমি এটুকু জানাতে পারো যে, ওই নামের তালিকা নিয়ে কি ভাবছো? 

—ছেলেরা কড়া দৃষ্টিতে সন্ধান করছে, খোঁজখবর নিচ্ছে। তবে এ ধরনের কাজে যথেষ্ট সময় লাগে এবং রুটিন মাফিক কাজ করতে হয়। ঠিকানাবিহীন নাম অথবা পদবীহীন কেবল দীক্ষান্তরের নাম দেখে কাউকে খুঁজে বার করা বা সনাক্ত করা খুবই কঠিন কাজ। 

—দ্যাখো, অন্য কোণ থেকে আমরা ঘটনাটা বিচার করতে পারি। একটা ঘটনা তোমাকে আমি বুঝতে বলছি। সাম্প্রতিক কালে বা ধরো বিগত এক বছরের মধ্যে তালিকায় লেখা এই নামগুলোর মানুষ মারা গেছে আর তাদের নাম মৃত্যু তালিকায় উঠেছে। তাদের ডেথ্ সার্টিফিকেট আছে। আমি ঠিক বলছি না? 

আজব দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ঠিক বলেছো। তোমার কথার যুক্তি আছে। 

—এটাই বিচার্য বিষয় যে, তারা সবাই একই ভাবে মারা গেছে। 

—হাঁ। কিন্তু যে ভাবে বলছো, ঘটনাটা তা নাও হতে পারে, মার্ক। বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জে কত লোক প্রতি বছর মারা যায় সে সম্পর্কে তোমার কি কোনো ধারণা আছে? এবং তাদের মধ্যে অনেকেরই নামের মিল থাকে—কাজেই এ বিচার করে কোনো সুবিধে হবে না। 

—দেলা ফনটেইন বললো— মেরি দেলা ফনটেইন। এ নামটা কিন্তু খুব সাধারণ নয়, তাই না? জানি গত মঙ্গলবারে তার দেহ সৎকার করা হয়েছে। আমার দিকে দ্রুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে বললো, সে কথা জানলে কি করে? মনে হচ্ছে কাগজে খবরটা পড়েছো। 

—মহিলার এক বন্ধুর মুখে খবরটা শুনেছি। 

—তার মৃত্যু সম্পর্কে গোলমাল কিছু নেই যে তা তোমায় বলতে পারি। আসলে পুলিশ যে সব মৃত্যু সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছে সেগুলোর মধ্যে কোনো গোলমাল নেই। দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু হলে অবশ্য সন্দেহ থাকতো। কিন্তু সবগুলোই স্বাভাবিক মৃত্যু। নিউমোনিয়া, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, মস্তিষ্কে টিউমার, গলস্টোন আর একটা ক্ষেত্রে পোলিও—এ রোগগুলোর মধ্যে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। 

ঘাড় নেড়ে বললাম, না, দুর্ঘটনা নয়। বিষপ্রয়োগও নয়। সাধারণ রোগ থেকে মৃত্যু ঘটেছে। 

থিরজা গ্রেও ঠিক এই দাবি করেছে। 

—তুমি কি সত্যিই বোঝাতে চাইছো যে, ওই মহিলা যাকে কোনোদিন দেখেনি এমন একজনকে বহু মাইল দূর থেকেও নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত করতে পারে এবং যার ফলে তার মৃত্যু হয়? 

—এ ধরনের কোনো কথা আমি বোঝাতে চাইছি না। তবে সে করেছে এমন কাজ। কাজটি আমার মনে হয় চমকপ্রদ এবং এ ধরনের কাজ করা যে অসম্ভব সেটাই আমি বিশ্বাস করতে চাই। কিন্তু কতকগুলো কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা ঘটেছে। অবাঞ্ছিত লোকদের খতম করার ঘটনায় মাঝে মাঝে ‘পেল হর্স’ কথাটা উল্লেখিত হয়েছে। একটা বাড়ির নাম ‘পেল হর্স’ এবং সেখানে যে মহিলা থাকে সে রীতিমতন গর্বিত কণ্ঠে বলেছে যে, এ ধরনের ঘটনা ঘটানো সম্ভব। এই অঞ্চলের অধিবাসী একজন লোক রয়েছে, যে রাতে ফাদার গোরম্যান খুন হয়েছিলেন সে রাতে এই লোকটি ফাদার গোরম্যানের পিছু নিয়েছিলো। ফাদার সে রাতে এক মরণাপন্ন মহিলাকে দেখতে গিয়ে দারুণ বদমায়েশির কথা শুনেছিলেন, তোমার কি মনে হয় না বহু ঘটনার সম্মিলন ঘটেছে। 

—এ লোকটা নিশ্চয়ই ভেনবলস হতেই পারে না কেননা তুমিই বলেছো, কয়েক বছর আগে তার দেহ পক্ষাঘাতে পঙ্গু হয়। 

—চিকিৎসা শাস্ত্রের দৃষ্টিতে পক্ষাঘাত রোগ ঝুটা হওয়া সম্ভব নয়। তাই না?

—নিশ্চয়ই সম্ভব নয়। কারণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো অপুষ্টির দরুন শীর্ণ হয়ে যায়।

তার যুক্তির স্বীকার করে নিয়ে সখেদে বললাম, এ প্রশ্নের জবাব ঠিকই দিয়েছো।

বড় দুঃখের ব্যাপার। এই সংস্থাটার কি যে নামকরণ করবো জানি না-এমন একটা সংস্থা যে মানব সংহারে বিশেষভাবে পারদর্শী। 

আমার বিশ্বাস ভেনবলসই এই সংস্থাটা চালাচ্ছে। তারই বুদ্ধিতে চলছে। ওই বাড়ির মূল্যবান জিনিসগুলো দেখে মনে হয়, সে অগাধ সম্পত্তির মালিক, কিন্তু এ সম্পত্তি সে পেলো কোথায়? 

একটু ভেবে আবার বলতে লাগলাম-এ যে লোকগুলো এবং অন্যান্যরা যারা তাদের বিছানায় স্বাভাবিক ভাবে মৃত্যুবরণ করেছে তাদের মৃত্যুর জন্য সে সব লোকজন কি মুনাফা করতে পেরেছে? 

—কেউ কেউ মৃত্যুর পর সব সময় লাভবান হয়। 

—কেউ বেশি, কেউ কম। তুমি যা বলতে চাইছো সেই অনুযায়ী কোনোরকম সন্দেহজনক অবস্থার তো সৃষ্টি হয়নি। 

—না, তা হয়নি। 

—তুমি বোধ হয় জানো যে, লেডি হেসকথ ডিউবয় পঞ্চাশ হাজার টাকা রেখে গেছেন। তার এক ভাইঝি আর এক ভাইপো সে অর্থের উত্তরাধিকারী। ভাইপো থাকে কানাডায়। আর ভাইঝির বিয়ে হয়ে গেছে, থাকে উত্তর ইংল্যান্ডে। দুজনেই অর্থের সদ্ব্যবহার করতে পারে। থমসিনা টাকারটন তার পিতার অগাধ সম্পদের উত্তরাধিকারী হয়েছিল। যদি থমসিনা একুশ বছর বয়সের আগে অবিবাহিতা অবস্থায় মারা যেতো তবে তার সব সম্পদ আবার তার সত্মার হাতেই পড়তো। মনে হচ্ছে এই সত্মা একদম সৎ একজন মহিলা। তারপর ধরো তোমার এই মিসেস দেলা ফনটেইন—তার রেখে যাওয়া সম্পদ পেয়েছে তার এক মাসতুতো বোন…। 

—ওহো তার এই মাসতুতো বোন এখন কোথায় থাকে? 

—সে এখন তার স্বামীর সাথে কেনিয়াতে থাকে। 

—সবাই আশ্চর্যজনকভাবে অনুপস্থিত। মন্তব্য ছুঁড়ে দিলাম। 

করিগ্যান বারেকের জন্য আমার দিকে বিরক্তি মেশানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, এই তিনজন স্যানফোর্ড যাদের নাম বাছাই করেছে তাদের একজন নিজের চেয়েও অনেক কম বয়সী যুবতী বউকে তালাক দিয়ে খুব অল্প দিনের মধ্যে আবার বিয়ে করেছিলো। অন্য স্যানফোর্ডের আসল নাম আর. সি. স্যানফোর্ড–সে তার বউকে তালাক দেয়নি। সন্দেহ করা হয় সিওনি হারসন্দস ওয়ার্থ মারা গেছে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের জন্য। লোকটা বহু মানুষকে ব্ল্যাকমেল করে অগাধ সম্পদ অর্জন করেছিলো। তার মৃত্যুতে অভিজাত পরিবারের মানুষ সোয়াস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বেঁচেছে। 

— তাহলে তুমি বলতে চাইছো যে, এদের মৃত্যু হয়েছে স্বাভাবিক ভাবেই। কিন্তু করিগ্যানের কি হয়েছিল? 

করিগ্যান মুচকি হাসি হেসে বললো, দেখো, করিগ্যান একটা সাধারণ নাম। বহু করিগ্যান মারা গিয়েছে—আমরা যতদূর খবর পেয়েছি তাতে জানা যায় যে, এরা কারো কোনোরকম সুবিধা করার জন্য মারা যায়নি। 

—এই সমস্যারও সমাধান হলো। এর পর তুমিই হচ্ছো সম্ভাব্য বলি। তুমি কিন্তু খুব সাবধানে থাকার চেষ্টা করো। 

—থাকবো। তবে তোমার এই ডাইনী আমাকে পেটের রোগ অথবা স্প্যানিশ ফ্লুতে মারতে পারবে না। চিকিৎসকের কোনো দুঃসাধ্য রোগও আমার হবে না। 

—শোন জিম। থিরজা গ্রের দাবি নিয়ে আমি তদন্ত করতে চাই। আমাকে কি সাহায্য করবে?

—না, আমি চাই না। তোমার মতন একজন চতুর শিক্ষিত লোক কেন এমনভাবে কু-সংস্কারের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। 

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, আর কোনো শব্দ কি তুমি ব্যবহার করতে পারো না? তোমার ওই একই কথা শুনে শুনে বিরক্ত হয়ে উঠেছি। 

—তুমি কি বড় নাছোড়বান্দা লোক নও মার্ক? বললাম, ভেবে দেখেছি, একজনকে তো নাছোড়বান্দা হতেই হবে।