দি পেল হর্স – ১৫

পঞ্চদশ অধ্যায় 

আঞ্চলিক গোয়েন্দা দপ্তরের ইনস্পেক্টর লেজুনকে প্রথম দেখার পর থেকেই আমার ভালো লেগেছে, নীরব সক্ষমতার মূর্ত প্রতীক সে। ভেবেছিলাম লোকটি নিশ্চয়ই কল্পনা প্রবণ অফিসার গোঁড়ামি নয়, এমন বিষয় সে নিশ্চয় বিচার বিবেচনা করতে চাইবে। 

আমাকে বললো ইনসপেক্টর, ডাক্তার করিগ্যানের মুখে আপনার কথা শুনেছি, তাঁর সঙ্গে আপনার দেখাও হয়েছে। প্রথম থেকে তিনি এ ব্যাপারে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। এ অঞ্চলে ফাদার গোরম্যান ছিলেন পরিচিত আর শ্রদ্ধার মানুষ। এখন আপনি বলছেন আমাদের জন্য কিছু বিশেষ খবর এনেছেন তাই ত? 

—পেল হর্স নামের একটা জায়গার সঙ্গে এই বিশেষ খবর জড়িত। 

—সূচ 

— হাঁ। 

ডিপিঙ নামের এক গ্রামে ওই বাড়িখানা। তাই না? 

—সব কথা খুলে বলুন ত! 

প্রথমেই পেল হর্সের সাথে জড়িত আজগুবি রহস্যের কথা বললাম। বললাম রোডার সাথে দেখা করার কথা। তিন বোনের রহস্যময় জীবনের কথাও জানালাম। আর থিরজার সঙ্গে আমার যে সব আলোচনা হয়েছিলো সেদিন বিকেলবেলায় তাও বর্ণনা করলাম। 

—তার কথায় আপনি কি প্রভাবিত? 

লজ্জিত হয়ে বললাম – সত্যিই বলছি, আমি এসব একেবারেই বিশ্বাস করি না..।

— বিশ্বাস করেন না, মিস্টার ইস্টারব্রুক? 

আমার ত মনে হয়, আপনি বিশ্বাস করেন। মৃদু হেসে আবার বললো ইনসপেক্টর, একটা কথা আপনি লুকোচ্ছেন, তাই না? মনে আগ্রহ নিয়েই ত আপনি সূচ ডিপিঙ গিয়েছিলেন, কেন? 

—মনে হয় মেয়েটি ভয় পেয়েছিল তাই গিয়েছিলাম। 

—ফুলের দোকানের যুবতীটি কে? 

—কথায় কথায় মেয়েটি পেল হর্সের কথা বলছিলো। বলার সময় তাকে ভীত সন্ত্রস্ত দেখাচ্ছিলো। মনে হয়েছিলো পেল হর্সে ভয় পাওয়ার নিশ্চয়ই কিছু আছে। সে সময় ডাক্তার করিগ্যানের সাথে দেখা হয়। তিনি আমাকে একটা নামের তালিকা দেন। তার মধ্যে দু’জন তখন মারা গেছে। তৃতীয় নামটা ছিলো আমার পরিচিত। পরে জানতে পারলাম, ওই মহিলাও মারা গেছেন। 

—মহিলা বোধ হয় মিসেস দেলা ফনটেইন? 

— হাঁ। 

—বেশ, তারপর বলুন। 

—ঠিক করলাম। এ ব্যাপারটা সম্বন্ধে আরো জানার চেষ্টা করবো 

—অনুসন্ধান শুরু করলেন। কিন্তু কিভাবে করলেন? 

মিসেস টাকারটনের সাথে আমার সাক্ষাৎকারের ঘটনা বললাম। শেষে বললাম, মিউনিসিপ্যাল বিল্ডিং এ বসবাসকারী মিস্টার ব্রাডলির কথা। 

ইনসপেক্টরের আগ্রহ এখন উজ্জীবিত। তাই বললো, তাহলে মিস্টার ব্রাডলিও রয়েছে এর মধ্যে। 

—তাকে কি চেনেন? 

— হাঁ। মিস্টার ব্রাডলি সম্বন্ধে পুলিশ দপ্তর সব কিছুই জানে। লোকটা আমাদের খুব বেগ দিয়েছিল। ঝামেলা পাকিয়েছিল। ওর কাজ কারবার একদম নিখুঁত। এমন কিছু করে না যার জন্য ওর গায়ে আমরা পিন ফোটাতে পারি, আইনের সব অলিগলি ওর জানা। তাই নীতি রেখার সাচ্চা দিক ধরে হাঁটতে অক্ষম। এমনকি আইন এড়িয়ে চলার শত পথ নামক বই লেখারও উপযুক্ত একজন লেখক। কিন্তু এটা বলতে পারি যে, কাউকে খুন করার কাজ সংগঠিত করে না—খুনের মতলব তার মাথায় নেই…। 

বললাম, আমাদের আলোচনার বিবরণ ত আপনাকে বলেছি, আপনি কি এর বিহিত করতে পারেন? 

—না আপনার কাহিনী শুনে কোনো বিহিত করা সম্ভব নয়। আপনাদের আলোচনার ত কোনো সাক্ষী সবুদ নেই। ইচ্ছে করলে ওই লোকটি ঘটনার সত্যটা অস্বীকার করতে পারে। তাছাড়া একটা কথা সে ঠিকই বলেছে, যে কোনো লোক যে কোনো বিষয়ে বাজী ধরতে পারে। সে বাজী ধরলে কোনো একজন নির্দিষ্ট লোক মারা যাবে না, কিন্তু সে হেরে গেল। এর জন্য সে অপরাধী হবে কেন? তাই বলছি সত্যিকারের অপরাধীর সঙ্গে ব্রাডলির সংযোগ আছে এমন প্রমাণ না পেলে পুলিশ কিছু করবে না। করতে পারবেও না। আর সে কাজ সহজও হবে না। ইনসপেক্টর বারেক কাঁধ নাচিয়ে শুধালো, আচ্ছা সূচ ডিপিঙ যাওয়ার পর ভেনবলসের কোনো লোকের সাথে কি আপনার আলাপ হয়েছে? 

—হাঁ এদিন তার সাথে লাঞ্চ খেয়েছি। 

—তার সাথে আলাপ করে কি মনে হয়েছে আপনার? 

—দারুণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। কিন্তু ভদ্রলোক একেবারে পঙ্গু। 

—হাঁ পোলিও রোগে পঙ্গু। 

—ভদ্রলোক চাকা লাগানো চেয়ারে বসেই কেবল ঘুরতে পারে। কিন্তু তার অক্ষমতাই তাকে বাঁচাতে এবং জীবন উপভোগ করতে মানসিক দৃঢ়তা জোগাচ্ছে। ইনসপেক্টরের অনুরোধ ভেনবলসের বাড়ি। তার শিল্পে সংগ্রহশালা এবং এ ব্যাপারে তার মনের আগ্রহের গভীরতা ব্যাখ্যা করলাম। 

—এমন একজন মানুষ হয়েও ভেনবলস আজ পঙ্গু। সখেদে মন্তব্য করলো ইনসপেক্টর।

—মাপ করবেন, একটা ব্যাপার জানতে চাইছি। সে কি সত্যিই পঙ্গু। নাকি এটা তার খোলস? 

—তার পঙ্গু সম্পর্কে আমরা সুনিশ্চিত। হারনি স্ট্রিটের বিখ্যাত চিকিৎসক স্যার উইলিয়াম জানিয়েছেন, ওর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অপুষ্টির জন্য পঙ্গু হয়ে গেছে। অথচ আমাদের মিস্টার অসবর্ণ নিশ্চিত যে, সে রাতে বার্টিন স্ট্রিটে সে তাকে হাঁটতে দেখেছে। কিন্তু সে ভুল দেখেছে। তবে ভেনবলসের মতন লোক যদি গোপনে মানুষ খুন করার সংস্থার মতলব দেনেওয়ালা হয় তা হবে একটা দুঃখজনক ঘটনা। 

—আমারও তাই ধারণা। বললাম। সামনের টেবিলের ওপর তর্জনী বুলিয়ে গোলাকার রেখার জাল আঁকতে আঁকতে ইনসপেক্টর লেজুন বললো— পুলিশ দপ্তর এ ব্যাপারে যা কিছু জেনেছে এবং আপনি যা জেনেছেন এই উভয় তথ্য মিলিয়ে আমরা সমস্ত ঘটনাগুলো বিচার বিবেচনা করে দেখতে পারি এই ভাবনাটা যুক্তি পূর্ণ যে, এক ধরনের দালালি সংস্থা বা সংগঠন আছে যার সদস্যরা অবাঞ্ছিত মানুষদের খতম করার কাজ করে এবং একাজে তারা বিশেষভাবে দক্ষ। এদের কাজ কর্ম অমার্জিত, অপরিণত নয়। তারা সাধারণ ঠ্যাঙাড়ে বা খুনীকে কাজে লাগায় না। তাদের হাতের বলি মানুষগুলো যে নিখুঁতভাবে স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেনি তার প্রমাণ রাখবারও দরকার হয়নি। আপনি যে তিনজনের কথা বলেছেন তাদের সম্পর্কে অনিশ্চিত খবর রয়েছে—তাদের প্রত্যেকের মৃত্যু ঘটেছে স্বাভাবিকভাবে। আর তাদের মৃত্যুর জন্য কেউ না কেউ লাভবান হয়েছে। কিন্তু তার কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ নেই খুনীরা দারুণ চালাক। তাই এই মৃত্যুর ঘটনাগুলো যে আসলে খুন তা সন্দেহ করার মতন সূত্র আমরা পাইনি। এক মরণাপন্ন বৃদ্ধা মৃত্যুকালীন স্বীকৃতি দানের সময় ফাদার গোরম্যানকে কয়েকটা নাম উল্লেখ করেছিলেন মরণোত্তর শান্তি লাভের জন্য। ফাদার গোরম্যানের লেখা চিরকুটে আমরা সেই নামগুলো পেয়েছি। আর ঐ যে থিরজা গ্রে নামের স্ত্রীলোকটির কথা বলছেন সে নাকি তার শক্তির কথা আপনার কাছে বড় গলায় বলেছে। তার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ এনে আদালতে তুলুন, তার কোনো শাস্তি হবে না তাই না? 

বললাম, হাঁ কারণ প্রমাণ করা যাবে না। তবে একটা উপায় আছে? 

আমার দিকে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে লেজুন শুধালো, কি উপায়? 

—ওরা কি ভাবে ওদের এই খুনের ব্যবসা সংগঠিত করে থাকে তা জানবার জন্য আমরা তদন্ত করতে চাই। ওদের মক্কেল হয়ে যাবো আমি নিজে। আর আমার বান্ধবী ওদের হাতে খুনের শিকার হবে। একটা খুনের সঙ্গে জড়িয়ে থেকে আমরা সব কিছু জানবো, ইনসপেক্টর 

—কিন্তু আপনার বান্ধবী কি জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন তাই না? 

—তাকে বুঝিয়েছি। বিপদের কথাও বলেছি। কিন্তু শুনছে না। জেদ ধরে বসে আছে, এ কাজ সে করবেই। আচমকা শুধালো ইনসপেক্টর—বললেন মেয়েটির স্বর্ণকেশিনী তাই না? 

—হাঁ, জবাব দিলাম। 

—এ ধরনের মেয়েদের সাথে তর্ক করাই নিরর্থক। আমার কি তা অজানা।

ইনসপেক্টরের স্ত্রীও কি তবে স্বর্ণকেশিনী, অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম।