৩. মার্গারেট ভিলা

১১. মার্গারেট ভিলা

মার্গারেট ভিলায় ডাইনিং রুমে বসে লাঞ্চ খাচ্ছিল লেডী টাম্পলিন, তার স্বামী মিঃ চার্লস ইভান্স ওরফে চ্যাব্বি। লেডীর ভূতপূর্ব স্বামীর ঔরসজাত মেয়ে লেনক্স এবং ক্যাথারিন। ক্যাথারিন-এর দিকে তাকিয়ে লেডী টাম্পলিন বলল, তাহলে শেষ পর্যন্ত তুমিও জড়িয়ে পড়লে। আমি কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছি না, তোমাকে এ ব্যাপারে পুলিশ কেন টানছে।

লেডী টাম্পলিনের কথাটা ক্যাথারিনের কাছে বিরক্ত বোধ হল তাছাড়া লাঞ্চ টেবিলে এসব আলোচনা মোটেই ভালো লাগল না তাই সে চুপ করে রইল।

চ্যাব্বি বলল, পুলিশ যখন ওকে নিতে চাইল তখন আমিও সঙ্গে যেতে চাইলাম কিন্তু আমাকে তারা অপেক্ষা করতে বলল।

লেডী টাম্পলিন আবার বলল, আমার মনে হয় নিহত মেয়েটির সঙ্গে তোমার যে সব কথাবার্তা হয়েছে তা থেকে ওরা একটা সূত্র বের করতে চেষ্টা করছে।

ওদের কথাগুলো যে ক্যাথারিনের ভালো লাগছিল না সে কথা লেনক্স বুঝতে পেরে মায়ের দিকে তাকিয়ে বেশ বিরক্তির সুরেই বলল, দয়া করে থামবে এবার!

মেয়ের বিরক্তি লক্ষ্য করে লেডী টাম্পলিনও বিব্রত স্বরে বলল, তুমি জানো না লেনা। খবরের কাগজে-বিষয়টাকে এমনভাবে লিখবে যে শেষ পর্যন্ত হয়ত আমাকেও টেনে আনবে এর মধ্যে। যাতে এটা না হয় সে ব্যবস্থা আমি করছি। মঁসিয়ে দ্য হেভীল্যাণ্ড আমার বিশেষ বন্ধু। খবরের কাগজের রিপোর্টারদের ওপর তার অসীম প্রভাব। তাঁর সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা করব আমি। কি বলো ক্যাথারিন? মতলবটা কেমন মনে হয় তোমার?

এতক্ষণে কথা বলল ক্যাথারিন, না এসব কিছুই করতে হবে না আপনাকে।

ক্যাথারিন-এর কথা শুনে লেডী টাম্পলিন বেশ একটু দমে গেল। কিন্তু কেউ তাকে থামাবে এটা সে সহ্য করতে পারে না। তাই সে শুরু করল, মাদাম ক্যাথারিনকে আমি চিনতাম। ভারি সুন্দর চেহারা ছিল তার। তাছাড়া খরচের হাতটা এত বেশি যে জলের মতো টাকা খরচ করত সে।

লাঞ্চ শেষ হয়ে গেলে লেনক্স ক্যাথারিন-এর দিকে তাকিয়ে বলল, চলো মাসী, তোমার ঘরটা একবার দেখে আসি।

ক্যাথারিন খুশী মনেই লেনক্স-এর কথায় সম্মতি জানাল, হ্যাঁ তাই চলো। ক্যাথারিন তিন তলায় ছোট একটি ঘরে নিয়ে গেল। ঘরটা অবশ্য ছোট হলেও চমৎকার সাজানো রয়েছে।

ঘরে ঢুকে একটা সোফার ওপর দুজনে বসল কিন্তু তখনও ক্যাথারিনের বিরক্ত ভাবটা কাটেনি। তাই লেনক্স বলল, মায়ের কথায় তুমি কিছু মনে করো না মাসী। মায়ের স্বভাবই ওই রকম। কোনো কিছু নিয়ে কথা বলতে শুরু করলে আর থামতে চায় না আর চ্যাক্মিমশাইও একই রকম, সেই জন্যেই আমি তোমাকে ওদের কবল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এলাম। এবার তুমি বিশ্রাম নাও, আমি চলি।

এখুনি যাবে?

–হ্যাঁ, ওরা কি বলছে তা শুনতে চাই আমি। সে আবার মায়ের কাছে ফিরে এলো। তার মা আর মিঃ ইভান্স তখন দোতলার বারান্দায় কথাবার্তা বলছিল। লেডী টাম্পলিন বলল, মেয়েটাকে যত বোকা ভাবছিলাম তত নয়। তবে, বড় গম্ভীর। কথা একরকম বলতেই চায় না!

চ্যাব্বি বলল, তা ঠিক। তবে ভদ্রমহিলার চেহারাটা কিন্তু খুবই সুন্দর। পোষাক পরিচ্ছদও বেশ রুচি সম্মত। সব দিক থেকে সমাজে মেশবার উপযুক্ত।

উপযুক্ত না ছাই। অমন গোমড়ামুখো মেয়ে কি সমাজে মেলামেশা করতে পারে?

 এবার লেনক্স বলল, মোটেই গোমড়ামুখো নয়। তোমরা দুজনে যা শুরু করেছিলে তাতে মরা মানুষেরও রাগ হয়। সারা সকাল পুলিশের হয়রানি সহ্য করেছে আবার তোমরা তাকে রেহাই দিচ্ছিলে না।

-তুমি যাই বল না কেন লেনা, পরের সম্পত্তি হাতে পেয়ে খুব অহঙ্কারী হয়েছে। আর মনটাও বেশ ছোট।

-ওর কাছ থেকে কিছু খসানো যাবে না তাই না?

–কি বলতে চাও তুমি?

–ঠিকই বলছি। ওর কাছ থেকে কিছু হাতিয়ে নেবার মতলবেই তো তুমি ওকে চিঠি লিখে এখানে এনেছ।

-তুমি ভুলে যাচ্ছ যে ও আমার মামাতো বোন।

 এই কথা শুনে চ্যাব্বি হঠাৎ উৎসাহিত হল, তাই নাকি? তাহলে তো আমি ওর নাম ধরেই ডাকতে পারি তাই না?

–তা পার বৈকি?

–বেশ। তা এখন থেকে আমি ওকে নাম ধরেই ডাকবো, টেনিস খেলতে পারে নিশ্চয়ই।

–ও খেলবে টেনিস। তাহলেই হয়েছে। সারাটা জীবন গেল বুড়ীর সেবা করতে। টেনিস খেলা জানবে কোত্থেকে

লেনক্স এবার রেগে গেল, তোমরা তাহলে পরনিন্দা করতে থাকো আমি চললাম। উঠে দাঁড়াল লেনক্স।

–কোথায় চললে?–জিজ্ঞাসা করলো তার মা।

–কোথায় আবার! তোমরা যার নিন্দায় পঞ্চমুখ হয়েছ তার কাছেই যাচ্ছি আমি।

ক্যাথারিন সমুদ্রের দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে ছিল। লেনক্স এসে বলল–কি গো মাসী! অমন তন্ময় হয়ে কি দেখছ?

-না কিছু না। কখন এলে তুমি?

–এই আসছি। একটা কথা তোমাকে বলতে এলাম।

–কি?

-তুমি এখানে না এলেই ভালো করতে। কেন এলে এখানে?

–না এলে যে তোমার সঙ্গে পরিচয় হোত না।

–না, ঠাট্টা নয়। তোমার দিদির স্বামীটি একটি চীজ। সব সময় স্ত্রীর আঁচল ধরেই আছে। কোনো স্বামী যে স্ত্রীর ওইভাবে মোসাহেবী করতে পারে তা আমার জানা ছিল না।

–মিঃ চ্যাব্বি বুঝি দিদির মোসাহেবী করে?

–হরদম। আর মোসাহেবী না করলে চলবেই বা কি করে টাকা চাই তো।

–সেকি উনি কোনো কাজকর্ম করেন না?

করেন বৈকি। বেকার সমিতির প্রেসিডেন্ট।

লেনক্স-এর কথা শুনে হেসে ক্যাথারিন বলল, তুমি তো খুব হাসাতে পার দেখছি। এবার আমার কথাটা শোন। তোমার মায়ের কাছে নিশ্চয়ই শুনেছ যে আমি এতদিন এক বৃদ্ধ মহিলার সেবা শুশ্রূষা করতাম। ভদ্রমহিলা মারা যাবার আগে তার সমস্ত সম্পত্তির-উইল করেছেন আমার নামে।

-হা শুনেছি। পদ্ধতিটা বোধহয় ভালোই, তাই না?

–হ্যাঁ, তা ভালোই বলা চলে। তবে সম্পত্তির মূল্য পঞ্চাশ লক্ষ পাউণ্ডেরও ওপর।

–বলো কি মাসী। তুমি তাহলে একজন জাঁদরেল মহিলা।

–তাই বুঝি। তা হবে, তারপর শোনো, এতদিন আমি হাই সোসাইটিতে মেলামেশা করার কোনো সুযোগ পাইনি। এবার আমি হাই সোসাইটিতে মিশতে চাই। আর সেই জন্যেই তোমার মায়ের চিঠি পেয়েই চলে এসেছি। তবে আমি আসাতে দিদি যদি……

ক্যাথারিনের কথা শেষ হবার আগেই লেডী টাম্পলিন হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল; একটা সুখবর আছে লেনা।

কি?

–এইমাত্র ড্রেক আমাকে ফোন করে জানিয়ে দিল, আজ রাত্রে সে আমাদের এখানে ডিনার খাবে।

–এটা সত্যিই সুখবর মা, আজকের ডিনারটা খুবই আকর্ষণীয় হবে দেখছি।

 –হ্যাঁ ড্রেক আসাতে ডিনার পার্টিটা সত্যই জমজমাট হবে।

–তুমি কি ডিনার পার্টির ব্যবস্থা করেছ নাকি?

–নিশ্চয়ই। ক্যাথারিনের সঙ্গে পরস্পরের পরিচয় করে দিতে হবে তো। কয়েকজন বিশিষ্ট লোককে নিমন্ত্রণ করতে বেরোচ্ছি। তুমি কি আমার সঙ্গে যেতে চাও?

–না, মা। আমি আজ মাসীর সঙ্গে গল্প করছি আর কোথাও বেরোব না।

লেডী টাম্পলিন চলে গেলে ক্যাথারিন বলল, ড্রেক কে লেনা?

–লর্ড লুকোনবারীর ছেলে। যেমন বংশমর্যাদা তার তেমন চেহারা। তাছাড়া চালচলন কথাবার্তা সবেতেই চৌকস। মেয়েরা তো তাকে দেখলেই পতঙ্গের মত ছুটে যায় তার দিকে।

-কেন?

-কেন তা বলতে পারি না। তবে মনে হয় তার বেপরোয়া চাল চলনে তার জুয়াড়ী স্বভাবের জন্যেই তার দিকে ঝুঁকে পড়ে।

জুয়াড়ী স্বভাব মানে?

–মানে, জুয়ায় তার সর্বস্ব পণ রাখতে ওর বাধে না। এটা নাকি ওর বংশানুক্রমিক স্বভাব। আমি শুনেছি, ওর পূর্বপুরুষেরা তাদের সমস্ত সম্পত্তি বাজি ধরে জুয়া খেলতেন। তাছাড়া কেউ কেউ নাকি তাদের সুন্দরী বউদেরও বাজি ধরতেন। বংশের সেই ধারাটাই ড্রেক পেয়েছে।

আরও কিছুক্ষণ গল্প করে লেনক্স বিদায় নিল। যাবার আগে ক্যাথারিনকে বলে গেল, সে যেন তার সবচেয়ে দামী আর সুন্দর পোশাকটা পরে ডিনার পার্টিতে যায়।

রাত প্রায় সাড়ে সাতটায় ক্যাথারিন ড্রয়িংরুমে এলো। ড্রয়িংরুমটা ইতিমধ্যেই বিশিষ্ট আর বৈশিষ্টদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ পরীর মত সুন্দর বেশে ক্যাথারিনকে ঢুকতে দেখে সবাই খুশী হলো।

লেডী ট্যাম্পলিন খুশী হলো তার মামাতো বোনকে দেখে। সে মনে মনে স্বীকার করল যে সত্যই মেয়েটার কাণ্ডজ্ঞান আছে। উঠে দাঁড়িয়ে গেস্টদের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কাজিন, মিস ক্যাথারিন গ্রে। মস্ত বড় সম্পত্তির মালিক। অনেক কাজ ওর কিন্তু আমার অনুরোধে কাজকর্ম ফেলে রেখেই চলে এসেছে।

গেস্টরা খুশী হলো। একে একে এসে ক্যাথারিন-এর সঙ্গে করমর্দন করতে লাগলো। লেডী টাম্পলিন প্রত্যেকের পরিচয় জানিয়ে দিল সঙ্গে সঙ্গে।

এদিকে খানসামা এসে জানিয়ে গেছে যে, ডিনারের আয়োজন প্রস্তুত হয়ে গেছে। কিন্তু ড্রেক কে না দেখে লেডী টাম্পলিন বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল।

একটু পরেই ড্রেক এসে হাজির। ঘরে ঢুকেই নাটকীয় কায়দায় বো করল অতিথিদের উদ্দেশ্যে। দেরির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করল। তারপর সোজা এগিয়ে গেল লেডী টাম্পলিনের সামনে।

লেডী টাম্পলিন করমর্দন করে ড্রেককে পাশের চেয়ারটা দেখিয়ে বলল, বসো ড্রেক। আমরা এতক্ষণ তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম। তোমার এত দেরি করা উচিত হয়নি।

ড্রেক আরেকবার ক্ষমা প্রার্থনা করল তার ত্রুটির জন্যে। তারপর শুরু হলো কুশল প্রশ্ন। লেডী টাম্পলিন আলাপে জমে উঠল। ক্যাথারিন একটু দূরে বসে ড্রেককে লক্ষ্য করছিল। তাহলে ইনিই ড্রেক। এই নিয়ে চারবার এর সঙ্গে দেখ হল। স্যাভয় হোটেলের করিডেরে, টমাস কুক-এর অফিসে, ব্লু ট্রেনে। এবং চতুর্থবার এখানে।

তার মনে হল ড্রেক তাকে চিনতে পেরেছে। সে মাঝে মঝেই তাকাচ্ছিল তার দিকে। ড্রেক ক্যাথারিনকে লক্ষ্য করছে দেখে টাম্পলিন বলল, আমার মামাতো বোন ক্যাথারিন। আমার এখানে কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে এসেছে। মস্ত বড় সম্পত্তির মালিক হয়েছে ও।

–বিবাহিত নন নিশ্চয়ই? মৃদু স্বরে ড্রেক বলল।

-না এখনও বিয়ে হয়নি ওর। ভাবছি, এবার পাত্রস্থ করব। এই রকম দু-চারটে কথা বলার পর খানসামা বলল, ডিনার তৈরি আপনারা সবাই আসুন।

ডিনারের জন্যে সবাই রওনা হল ডাইনিং হলের দিকে। ডিনার টেবিলে বসেই ক্যাথারিন দেখল তার পাশের আসনে ড্রেক বসেছে। সে তখন ড্রেক-এর দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে যে আপনার সঙ্গে দেখা হবে স্বপ্নেও ভাবিনি।

–আমিও তাই, এইবার নিয়ে তিনবার দেখা হলো আপনার সঙ্গে। স্যাভয় হোটেলে, কুক কোম্পানির অফিসে এবং তৃতীয়বার এখানে।

–আপনি হয়তো ভুল করলেন মঁসিয়ে। এবার নিয়ে চারবার ব্লু ট্রেনেও দেখা হয়েছিল আপনার সঙ্গে।

-কি বললেন ব্লু ট্রেনে? হ্যাঁ তা হয়তো….

হঠাৎ যেন মুখের চেহারাটা বদলে গেল ড্রেকের। কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিয়ে স্বাভাবিক স্বরে বলল, হ্যাঁ, ট্রেনে একটা বিশ্রী কাণ্ড হয়েছে শুনলাম। কে একজন মারা গেছেন নাকি ট্রেনে।

-হ্যাঁ। একজন মহিলা।

–বড়ই দুঃখের ব্যাপার। ট্রেনে মৃত্যুটা খুবই মর্মান্তিক তাই না?

টেবিলের অপরদিক থেকে একজন আমেরিকান মহিলা বলল, মিঃ ক্যাথারিন কি আমাকে চিনতে পারছেন না?

–সেকি! আপনাকে চিনতে পারবো না মানে। কেমন আছেন বলুন?

–তা একরকম ভালই আছি। আপনি কবে এলেন?

–আজই সকালে।

ব্লু ট্রেনে নিশ্চয়ই?

–হ্যাঁ।

এদিকে ক্যাথারিন ভাবছে এর সঙ্গে কি সেই নিহত ভদ্রমহিলার কোনো সম্পর্ক আছে। তার পদবীটাও তো ক্যাথারিন। তবে কি সে তার স্ত্রী। কিন্তু তাই যদি হয় তবে ইনি এমন হেসে কথা বলছেন কেমন করে।

ক্যাথারিন যখন এইসব ভাবছে সেই সময় একজন চাকর এসে ড্রেককে একখানা চিরকুট দিয়ে কানে কানে কি যেন বলল।

চিরকুট খানা একবার পড়েই ড্রেক দাঁড়িয়ে পড়ল। লেডী টাম্পলিনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে এক্ষুনি একবার বাইরে যেতে হচ্ছে মাদাম। পুলিশের প্রিফেক্ট আমার সঙ্গে এক্ষুনি একবার দেখা করতে চান। আমি বুঝতে পারছি না কেন তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। এই কথা বলেই ড্রেক ডাইনিং হল থেকে বেরিয়ে গেল, সে চলে গেল।

লেডী টাম্পলিন বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে বলল, কি ব্যাপার! পুলিশ ওর খোঁজ করছে কেন!

প্রত্যেকের মনে তখন একই প্রশ্ন–পুলিশ ওর খোঁজ করছে কেন?

.

১২.

মৃত্যু সংবাদ

মিঃ আলডিন তার সেক্রেটারীর জন্যে অপেক্ষা করছেন। একটা বিশেষ কাজের জন্য তাকে প্যারীতে পাঠিয়েছেন। কথা আছে রাত আটটার মধ্যেই ফিরে আসবে সে এবং রিপোর্ট নিয়ে এলেই তিনি তার ভবিষ্যত কর্মপন্থা ঠিক করবেন।

ঠিক সময়েই ফিরে এলো কিংটন। তাকে দেখে মিঃ আলডিন বললেন, খবর ভালো তো? ওদিক সব ঠিক আছে?

-হা স্যার। সবই ঠিক আছে। আপনি গেলেই কাজটা হয়ে যাবে।

–আর কোনো খবর?

–বিজনেসের খবর আর কিছু নেই। তবে মিস ম্যাসন-এর সঙ্গে আমার প্যারীতে দেখা হয়েছিল।

–তার মানে! সেকি রুথের সঙ্গে যায়নি নাকি?

-না। সে বললে যে, মিসেস ক্যাথারিন তাকে প্যারীতে নামিয়ে দিয়েছেন। তিনি নাকি বলেছেন তার পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত সে যেন রীহ্ হোটেলে অপেক্ষা করে।

-তোমার সঙ্গে কোথায় তার দেখা হয়েছিল?

গেয়ার দ্য নয়েন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে।

 খবরটা শুনে বিরক্ত হলেন আলডিন। তার মনে হলো মিস ম্যাসনকে প্যারীতে নামিয়ে দিয়ে রুথ একা গেছে সেই হতভাগা কাউন্টের সঙ্গে মিশতে। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, মিঃ ম্যাসন আর কিছু বলেছিল কি?

-হ্যাঁ বলেছিল। সে বললে, মিসেস ক্যাথারিন-এর সঙ্গে হঠাৎ তার এক বন্ধুর দেখা হয়ে যায় ট্রেনে। তারপরই তিনি তাকে প্যারী স্টেশনে নেমে যেতে বলেন। মিঃ আলডিনকে গম্ভীর ভাবে চুপ করে থাকতে দেখে কিংটন বলল, এবার আমি কি যেতে পারি স্যার?

–হ্যাঁ, তুমি এখন যাও। আজ রাতটা বিশ্রাম নাও গিয়ে।

কিংটন পা বাড়াতেই হোটেলের একটি বয় একখানা টেলিগ্রাম মিঃ আলডিন-এর হাতে দিয়ে বলল, আপনার টেলিগ্রাম স্যার।

–ঠিক আছে, তুমি এবার যেতে পার।

টেলিগ্রামটা পড়ে আলডিনের মুখের ভাব বদলে গেল। মুখখানা ছাই-এর মত ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অক্লান্তভাবে চেয়ারের ওপর ধপ করে বসে পড়লেন তিনি।

মিঃ আলডিন-এর এই ভাবান্তর দেখে কিংটন বিনীতভাবে প্রশ্ন করলেন, কি হয়েছে স্যার?

 কোনো কথা না বলে আলডিন টেলিগ্রামটা কিংটনের হাতে দিলেন। টেলিগ্রামটা পড়ে কিংটন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। কি সর্বনাশ!

হা কিংটন, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমি এখুনি নিস-এ রওনা হব। চাকরকে বলো পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমার ব্যাগ স্যুটকেশ গুছিয়ে দিতে আর তুমিও তৈরি হয়ে নাও।–আমার সঙ্গে যেতে হবে।

এবার কেরানী এসে হাজির হলো সেখানে। মিঃ আলডিন রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন–কি ভাই?

–মিঃ গোবি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, স্যার।

–চুলোয় যাক। আমি এখন কারুর সঙ্গে দেখা করবো না। মিঃ আলডিনের কথা শুনে কেরানী ঘাবড়ে গিয়ে যাবার জন্যে পা বাড়াল।

-শোনো।

 থমকে দাঁড়াল কেরানী। কি বলছেন, স্যার?

–মিঃ গোবিকে এখানে পাঠিয়ে দাও। এক মিনিটের মধ্যেই মিঃ গোবি এসে পড়ল।

–আপনার বক্তব্য তাড়াতাড়ি শেষ করুন মিঃ গোবি। আমি এক্ষুনি একটা বিশেষ কাজে বের হচ্ছি।

আপনি আমার কাছে মিঃ ক্যাথারিন-এর গতিবিধির খবর জানতে চেয়েছিলেন। তিনি গত চোদ্দ তারিখে রিভিয়ারায় গেছেন। আবার বলল মিঃ গোবি, তাছাড়া মিরেলি নামে যে নাচিয়ে মেয়েটির সঙ্গে দহরম মহরম সেও রিভিয়ারায় গেছে।

–কোনো ট্রেনে গেছে?

–ব্লু ট্রেনে।

-ধন্যবাদ মিঃ গোবি। দুটো খবরই আমার কাছে মূল্যবান। আচ্ছা আপনি আসুন, গুড নাইট।

.

১৩.

ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে

 তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেট ক্যারেজ-এর আদালত। আজ এখানে বিচার হচ্ছে না। সুতরাং ভিড় নেই।

আদালত কক্ষে আজ মাদাম রুথ ক্যাথারিন-এর হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রাথমিক এবং গোপন শুনানির দিন স্থির হয়েছে। কয়েকজন সাক্ষীকে আনা হয়েছে, তারা বাইরের ঘরে অপেক্ষা করছে।

আদালত কক্ষে ম্যাজিস্ট্রেট এবং তার আরদালী ও দুজন দেহরক্ষী ছাড়া আর যাঁরা উপস্থিত আছেন তারা হলেন নিস শহরের কমিশনার অব পুলিশ মঁসিয়ে কক্স। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রাইভেট ডিটেকটিভ মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো এবং নিহত মাদাম ক্যাথারিন-এর পিতা মিঃ কিউফাশ ভ্যান আলডিন।

মঁসিয়ে পোয়ারোই প্রথমে কথা বললেন, মঁসিয়ে আলডিন দ্রুত অ্যাকশন আশা করেন, তাই না মঁসিয়ে কক্স?

পোয়ারোর কথা শুনে এবং বিশেষ করে তার সিভিল ড্রেস দেখে মিঃ আলডিন তার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। যেন বলতে চাইলেন–ইনি আবার কে?

তার মনে কথাটা আঁচ করে মঁসিয়ে কক্স বললেন, একে বোধহয় আপনি চেনেন না। আলডিন, এর নাম এরকুল পোয়ারো। পোয়ারোর নাম এবং খ্যাতির কথা আগেই শুনেছেন তাই পরিচয় পেয়ে খুশী হলেন।

পরিচয় পর্ব শেষ হতেই মিঃ আলডিন বললেন, আমি আপনাকে অনুরোধ করছি মিঃ পোয়ারো, আমার ইচ্ছে আপনি আমার পক্ষে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করুন পুলিশের কাজ পুলিশ তো করবেই। তাদের বাধা দেবার কিছু নেই, আমি শুধু জানতে চাই হত্যাকারী কে? আশা করি আমার অনুরোধটা আপনি রাখবেন।

–আপনার প্রস্তাবে আমি সম্মত, মিঃ আলডিন।

-ধন্যবাদ, আপনি যে কোনো সময়, যে কোনো স্থানে যে কোনো অবস্থায় আমার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন। তাতে কোনোই অসুবিধা হবে না।

–ঠিক আছে মঁসিয়ে। আমি আজ থেকে কাজে লেগে যাচ্ছি।

এবার ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, এবার তাহলে কাজ আরম্ভ করতে পারি। কি বলেন মঁসিয়ে কক্স?

–নিশ্চয়ই স্যার। আর দেরি করা ঠিক নয়।

ম্যাজিস্ট্রেট কনস্টেবলের দিকে তাকিয়ে বললেন, নিয়ে এসো এখানে। দুমিনিটের মধ্যেই স্ত্রীলোকটিকে আনা হলো ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে। ম্যাজিস্ট্রেট তাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন।

-আপনার নাম?

–আমার নাম অ্যাডা বিয়েত্রিস্। ডাক নাম অ্যাড়া ম্যাসন।

 –মাদাম ক্যাথারিনকে চেনেন কি?

–বিশেষভাবে। আমি তার মেইড।

 –তিনি নিহত হয়েছেন সে খবর জানেন কি?

 –জানি।

—আপনরা কি একই সঙ্গে রওনা হয়েছিলেন?

–হ্যাঁ।

–আপনি যখন লণ্ডন থেকে রওনা হন তখন কি আপনি জানতেন যে আপানকে প্যারীতে নেমে যেতে হবে?

-না, স্যার।

 –আপনি কি এর আগেও মাদাম ক্যাথারিন-এর সঙ্গে বিদেশে গেছেন?

–না, স্যার, সে সুযোগ হয়নি, কারণ মাত্র দুমাস হলো আমি তার মেইড নিযুক্ত হই।

–ট্রেনে ওঠবার সময় বা ওঠবার পরে মাদাম ক্যাথারিন-এর কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করেছিলেন কি?

–হ্যাঁ করেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল তিনি বেশ কিছুটা চিন্তিত।

–আপনাকে যে প্যারীতে নেমে যেতে হবে সে কথা উনি কখন আপনাকে বলেন?

–গেয়ার দ্য নায়ন স্টেশনে, ওখানে ট্রেনটা থামতেই মিসেস ক্যাথারিন প্ল্যাটফর্মে নামার জন্যে করিডরে আসেন। কিন্তু প্ল্যাটফর্মে নামা আর হয়নি তার। আমি দেখতে পাই, একজন ভদ্রলোককে সঙ্গে করে আবার তিনি ফিরে আসেন।

–ভদ্রলোকটিকে আপনি চেনেন কি?

-না স্যার। আমি তাকে আমার কামরা থেকে অল্পক্ষণের জন্য দেখতে পাই। তাছাড়া মুখটাও ভালো করে দেখতে পাইনি।

-তারপর কি হলো?

–তারপর মিসেস ক্যাথারিন তার কামরার ভেতরে যে দরজাটা ছিল তা বন্ধ করে দেন। কিছু পরে দরজাটা একটু ফাঁক করে আমার হাতে কিছু টাকা দিয়ে তিনি বলেন যে তার কাছে নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত আমি যেন রীজ হোটেলে অপেক্ষা করি।

-তারপর?

তাঁর নির্দেশমত আমি প্যারী স্টেশনে নেমে যাই এবং রীজ হোটেলে একটা রুম নিয়ে তাঁর নির্দেশের অপেক্ষা করি।

–আপনি যখন নেমে যান তখন সেই লোকটিকে দেখতে পেয়েছিলেন কি?

-হ্যাঁ, পেয়েছিলাম। তিনি তখন মিসেস ক্যাথারিন-এর কামরার ভেতরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

-এবার তার মুখটা দেখতে পেয়েছিলেন নিশ্চয়ই?

-না স্যার। ভদ্রলোক আমার দিকে পেছন ফিরে ছিলেন তাই আমি তার মুখটা দেখতে পাইনি।

-তাঁকে কি ওই ট্রেনের যাত্রী বলে মনে হয়েছিল আপনার?

–না।

–কেন বলুন তো?

-তার গায়ে পুরু ওভারকোট আর মাথায় ফেল্ট-এর হ্যাট ছিল। এয়ার কণ্ডিশন করা ট্রেনে কোনো যাত্রী এরকম পোশাক পরে থাকে না। আমার মনে হয় মিসেস ক্যাথারিন-এর সঙ্গে দেখা করার জন্যেই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েছিল। ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হতেই তাকে নিজের কামরায় নিয়ে আসেন। তবে এটা আমার অনুমান মাত্র।

-মাদাম ক্যাথারিন কি কণ্ডাক্টরকে তার ঘুম ভাঙাতে নিষেধ করেছিলেন?

–হ্যাঁ, স্যার।

–এটা কি অস্বাভাবিক মনে হয়নি আপনার?

–না, কারণ অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমানো তার অভ্যাস।

–তার জিনিসপত্রের ভেতরে একটা ভেলভেটের বাক্স ছিল?

 –হ্যাঁ, ছিল।

–তার ভেতরে কি ছিল বলতে পারেন কি?

–সঠিক বলতে পারি না। তবে আমার ধারণা, ওর ভেতরে হীরে বা ওই জাতীয় কোনো দামী রত্ন ছিল।

–নেমে যাবার সময় সেই বাক্সটা কি আপনি নিয়ে গিয়েছিলেন?

–সে কি! আমি সেটা নিয়ে যাব কেন?

তার সঙ্গে কি আরও হীরে, জহরত ছিল?

 –ছিল বলেই মনে হয়। কারণ তিনি হীরে জহরত খুবই পছন্দ করতেন।

 –হার্ট অফ ফায়ার নামে কোনো রুবী তার কাছে ছিল কি?

–থাকতে পারে, কারণ ওই নামটা যেন একবার তার মুখে শুনেছিলাম বলে মনে হচ্ছে।

রুবীটা সম্বন্ধে কি বলেছিলেন তিনি?

–বলেছিলেন যে তার কাছে এমন একটা রুবী আছে যার দাম কয়েক লক্ষ পাউণ্ড। রুবীটার নাম হার্ট অফ ফায়ার বলেই মনে হয় কথাটা বলেছিলেন।

মিস ম্যাসন-এর থেকে হার্ট অফ ফায়ার-এর কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে আলডিন জিজ্ঞেস করলেন, ওটা কি সে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিল?

হা স্যার। সেই রকম কথাই যেন শুনেছিলাম তার কাছে।

–হ্যায় ভগবান! তাহলে ঐ রুবীটাই ওর মৃত্যুর কারণ। আমি তাকে পইপই করে বলেছিলাম ওটা ব্যাঙ্কে রেখে আসতে। আমার কথা সে গ্রাহ্যই করেনি। এবং এই জন্যেই প্রাণ দিতে হয়েছে। এই সময় ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, আপনারা আর কিছু জিজ্ঞেস করতে চান কি এঁকে?

কমিশনার বললেন, না স্যার, আমার কিছু জিজ্ঞাসা নেই। মিঃ পোয়ারো কিছু জিজ্ঞেস করবেন কি?

-না! আমার কিছু জিজ্ঞাস্য নেই।

ম্যাজিস্ট্রেট তখন মিস ম্যাসন-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনাকে আর কয়েক মিনিট অপেক্ষা করতে হবে মাদমোয়াজেল, আপনার কথাগুলো সব টাইপ করতে দেওয়া হয়েছে। আপনি পাশের ঘরে গিয়ে বসুন। কিছুক্ষণের মধ্যেই টাইপ কাগজ আপনার কাছে পাঠানো হবে। আপনি সেটা পড়ে সই করে দিলেই আপনার ছুটি।

মিস ম্যাসন সেখান থেকে চলে যাবার পর ম্যাজিস্ট্রেট তার ড্রয়ারের ভেতর থেকে একখানা ভাঁজ করা কাগজ বের করে বললেন, এই চিঠিখানা মাদাম ক্যাথারিন-এর হ্যাণ্ডব্যাগের ভেতরে পাওয়া গেছে। আমার মনে হয় এই চিঠিখানা গুরুত্বপূর্ণ।

-আমি একবার দেখতে পারি কি চিঠিখানা?–বললেন মিঃ আলডিন।

–নিশ্চয়ই পারেন। দেখুন।

মিঃ আলডিন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে চিঠিখানা নিয়ে পড়তে লাগলেন। তাতে লেখা ছিল :

প্রিয়তমে,

আমি এখন তোমার কথামতই চলব। তুমি ঠিকই বলেছ রিভিয়ারায় থাকাটা ঠিক হবে না। তাই আমি ওর দ্বীপে সব ব্যবস্থা করেছি। জায়গাটা সব দিক থেকেই নিরাপদ। তোমার কোনোই চিন্তা নেই। আমার মুখ থেকে কোনো কথাই বের হবে না।

আর একটা কথা, হার্ট অফ ফায়ার সম্বন্ধে আমি একটা প্রবন্ধ লিখছি। আসবার সময় ওটা সঙ্গে নিয়ে এসো। আমি একবার ওর চেহারাটা দেখতে চাই।

আজ এই পর্যন্তই। দেখা হলে সব হবে। তোমার পথ চেয়ে বসে আছি। ইতি

তোমার
আরমাগু

চিঠিখানা পড়ে মিঃ আলডিন-এর চোখমুখ রাগে একেবারে লাল হয়ে গেল। কোনো কথা না বলে তিনি চিঠিখানা ম্যাজিস্ট্রেটকে ফিরিয়ে দিলেন।

চিঠিখানা ড্রয়ারে রাখতে যাবেন এই সময় পোয়ারো বললেন, ওটা আমার দেখলে কি আপত্তি আছে?

-না, আপত্তি আর কি। এই নিন।

 চিঠিখানা পড়ে পোয়ারো বললেন, এ থেকে দুটো গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট আমরা পাচ্ছি। একটি হলো মাদাম ক্যাথারিন এই রুবীটা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছিলেন এবং অপরটি হলো রুবীটা দেখবার জন্যে পত্ৰলেখকের আগ্রহ। আশা করি, মিঃ আলডিন ওই লোকটাকে চেনেন?

-হ্যাঁ চিনি। যে লোকটা চিঠিখানা লিখেছে সে নিজেকে কাউন্ট দ্য রোচি বলে পরিচয় দিয়ে থাকে।

–আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে ঔ লোকটার সম্বন্ধে দু-একটা কথা জানতে চাই আপনার কাছে। আমি জানি এখন জিজ্ঞেস করা মানে আপনাকে দুঃখ দেওয়া। কিন্তু আপনার মেয়ের হত্যাকারীকে বের করতে হলে তো আমার সবকিছু জানতেই হবে। আপনি দয়া করে আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবেন।

নিশ্চয়ই দেবো। কি জানতে চান বলুন?

–লোকটার সম্বন্ধে আপনি যা যা জানেন, দয়া করে সব খুলে বলুন।

-বেশ, তাহলে শুনুন। আজ থেকে বার বছর আগে রুথ-এর সঙ্গে প্যারীতে ওর পরিচয় হয়। রুথ-এর বয়স তখন সবে মাত্র আঠারো বছর। ওই বয়সে মেয়েরা সাধারণতঃ রোমান্টিক হয়। রুথ-এরও তাই হলো। আমার অজ্ঞাতে ওদের মেলামেশা চলতে থাকে। বেশ কিছুদিন পর আমি ব্যাপারটা জানতে পারি।

–তারপর?

-আমি তখন ওই কাউন্ট-এর সম্বন্ধে গোপনে খোঁজখবর নিতে থাকি। কয়েক দিনের মধ্যেই জানতে পারি যে ওর পরিচয়টা একেবারে ভুয়ো। ওর বাপ, দাদা চোদ্দ পুরুষ কেউই কাউন্ট ছিল না। আমি আরও জানতে পারি যে লোকটা একটা পয়লা নম্বরের স্কাউনড্রেল। বড় ঘরের মেয়েদের পটিয়ে তাদের ব্ল্যাকমেল করাই ওর কাজ।

এই সময় কমিশনার বলে উঠলেন : আপনি ঠিকই বলেছেন। সত্যিই ওর কাজ হলো মেয়েদের ব্ল্যাকমেল করা। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজও আমরা ওকে আইনের ফাঁদে ফেলতে পারিনি। যে সব মেয়েকে ব্ল্যাকমেল করে তারা কেলেঙ্কারির ভয়ে পুলিশের কাছে মুখ খোলে না। এবং কোর্টেও আসতে চায় না। আর এই সুযোগে কাউণ্ট মশাই তার কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ওর ওপরে আমাদের নজর আছে। এবার আপনার বক্তব্য বলুন।

কাউন্টের আসল পরিচয় পাবার পর আমি রুথকে ওর খপ্পর থেকে উদ্ধার করে লর্ড লুকোনবারীর ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিই। ভেবেছিলাম ওদের দাম্পত্য জীবন সুখের হবে কিন্তু তা হলো না। চরিত্রহীন লর্ড নন্দন রুথ-এর সঙ্গে এমন দুব্যবহার করতে লাগলো যে শেষ পর্যন্ত আমি রুথকে বিবাহ-বিচ্ছেদের মামলা দায়ের করতে বলি।

–মামলাটা কি রুজু হয়েছে? –বললেন পোয়ারো।

–না। কথা ছিল যে রুথ রিভিয়ারা থেকে ফিরে এলে মামলাটা রুজু করা হবে।

–এবার হার্ট অফ ফায়ার সম্বন্ধে বলুন।

মাস দুয়েক আগে থেকে রুবীটা সংগ্রহ করার চেষ্টা করতে করতে দশদিন আগে সেটা আমার হাতে আসে।

-তারপর কি করলেন?

রুবীটা আমার হাতে আসার পরদিনই আমি সেটা রুথকে উপহার দিই। তবে আমি ওকে বিশেষভাবে বলেছিলাম যে রুবীটা রিভিয়ারায় যাবার সময়ে যেন সঙ্গে না নেয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় ও আমার কথা অমান্য করার ফলে ওকে প্রাণ দিতে হলো।

মিঃ আলডিন-এর কাছে সব কথাগুলি জেনে মঁসিয়ে পোয়ারো বললেন, এবার তাহলে ঘটনাগুলিকে পর্যায়ক্রমে সজানো যায়। পরপর সাজালে যা দাঁড়াচ্ছে, ত হলো :

(১) হার্ট অফ ফায়ার যে মাদাম ক্যাথারিন-এর কাছে আছে এ খবর কাউন্ট দ্য রোচি জানতে পেরেছিল।

(২) মাদাম ক্যাথারিন যাতে রুবীটা সঙ্গে নিয়ে যান, তার জন্য চিঠিতে ওই রুবী সম্বন্ধে প্রবন্ধ রচনার আকারে গল্প জুড়ে দিয়েছিল কাউন্ট।

(৩) গেয়ার দ্য নায়ন স্টেশনে একটি লোক ট্রেনে উঠে মাদাম ক্যাথারিন-এর কামরায় ঢুকেছিল। মাদাম নিজেই তাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন।

(৪) মাদামের মেইড মিস ম্যাসন সেই লোকটিকে দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু তার মুখ দেখতে না পাওয়ায় তাকে চিনতে পারেনি।

(৫) লোকটি মাদামের কামরায় আসবার পরে মাদাম তার মেইডকে প্যারী স্টেশনে নেমে যেতে বলেন।

(৬) মেইড প্যারী স্টেশনে নেমে যায়। তবে যাওয়ার আগেও সে লোকটিকে দেখতে পেয়েছিল।

(৭) মিস ম্যাসন-এর কাছ থেকে জানা যায় যে, ভেলভেটের বাক্সটা মাদামের কাছেই ছিল।

(৮) মাদাম কন্ডাক্টরকে বলেছিলেন, সে যেন সকালে তার ঘুম না ভাঙায়।

(৯) এর পরেই মাদাম নিহত হল এবং হার্ট অফ ফায়ার অপহৃত হয়।

 (১০) সেই লোকটির আর পাত্তা পাওয়া যায় না।

মঁসিয়ে পোয়ারোর ঘটনা সাজাবার কায়দা দেখে সবাই খুশী হলেন। কমিশনার বললেন, এবার হত্যাকারীর মোটিভটা বুঝতে পারা যাচ্ছে।

তাছাড়া হত্যাকারী কে? সে সম্বন্ধে একটা ধারণার সৃষ্টি হচ্ছে–বললেন ম্যাজিস্ট্রেট।

পোয়ারো বললেন, এবার ওপরের দশদফা ঘটনাকে বিশ্লেষণ করা যাক।

মিস ম্যাসন-এর সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে গেয়ার দ্য নায়ন স্টেশনে গাড়ি থামলে মাদাম ক্যাথারিন ট্রেন থেকে প্ল্যাটফর্মে নামবার জন্যে করিডরে আসেন। প্ল্যাটফর্মে কোনো একটি লোককে তিনি দেখতে পান। লোকটিকে তিনি সঙ্গে করে নিজের কামরায় নিয়ে আসেন।

এরপর মাদামের কাজকর্ম ও কথাবার্তা শুনে স্বাভাবিক ভাবেই সন্দেহ আসে যে ওই লোকটি কাউন্ট দ্য রোচি ছাড়া আর কেউ নয়। এবং আরো সন্দেহ হয় যে, কাউন্টই মাদামকে হত্যা করে রুবীটা অপহরণ করে সরে পড়েছিল।

আপনি ঠিকই বলেছেন মঁসিয়ে। আমারও ঠিক এই রকম মনে হচ্ছে যে, ওই শয়তান রুথকে হত্যা করেছে।

–না মিঃ আলডিন। আগে থেকেই এটা ধরে নেওয়া চলে না। ঘটনা পরম্পরায় কাউন্ট দ্য রোচির ওপরে সন্দেহ এলেও সেই-ই যে ট্রেনে উঠেছিল তার কোনো প্রমাণ নেই।

–কিন্তু তাহলে আর কে হতে পারে! না মঁসিয়ে, আপনি যাই বলুন না কেন, আমার বিশ্বাস লোকটি কাউন্ট ছাড়া আর কেউ নয়।

আমার এই রকমই সন্দেহ, মিঃ আলডিন। কিন্তু সন্দেহ হলেই আইনতঃ আমরা তাকে। গ্রেফতার করতে পারি না।

ম্যাজিস্ট্রেট কথাটা স্বীকার করলেন। বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন, সত্যিই তার বিরুদ্ধে আমরা এমন কোনো প্রমাণই পাচ্ছি না যে, যার জোরে তাকে এই মামলার আসামী হিসেবে গ্রেপ্তার করা যায়।

–সত্যিই যদি তিনি অপরাধী হন। বললেন পোয়ারো।

–আপনি এখনও যদি বলছেন।

-হা মঁসিয়ে কমিশনার, এখনও আমি যদি বলছি।–কথাটা বেশ জোর দিয়েই বললেন পোয়ারো।

কথাটা প্রথমে কমিশনারের খারাপ লাগল কিন্তু পরক্ষণেই তিনি ভাবলেন যে, সত্যিই অনুমানের ওপর নির্ভর করে কাউকে আগে থেকেই অপরাধী বলে ধরে নেওয়া যায় না বা উচিৎ নয়।

-আপনার কথাই ঠিক মঁসিয়ে। এরপর আপনি কি বলতে চান। তার জন্যে আমার খুবই আগ্রহ হচ্ছে।

–এরপর যা বলতে চাইছি সেটা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ কথা নয়। সত্যিই যদি কাউন্ট অপরাধী হয়; সে তাহলে একটা আত্মরক্ষার পথও বেছে রেখেছে। কাউন্ট-এর মতো চতুর লোক আগে থেকে সাবধান না হয়ে কোনো কিছু করেছে বলে মনে হয় না। কিন্তু তা সত্ত্বে কোনো একটি বিশেষ কারণের জন্য তার ওপরে পুরোপুরি সন্দেহ আসছে না।

–কি সে কারণ?

মনস্তত্ত্ব।

–মনস্তত্ত্ব, বলেন কি!

–ঠিকই বলছি। কাউন্ট একটা লম্পট। স্বীকার করি এ কথা। কাউন্ট জোচ্চোর, তাতেও ভুল নেই। কাউন্ট নারী লোভী তাও জানি। সে হার্ট অফ ফায়ার চুরি করার মতলব করেছিল সেও ঠিক। কিন্তু সে যে হত্যাকারী, একথা স্বীকার করতে পারছি না। এই ধরণের লোকেরা স্বভাবতই ভীরু হয়। কোনো রকম বিপদের ঝুঁকি নিতে চায় না তারা। ছলচাতুরী আর জাল জোছুরী যাদের পেশা তারা হত্যা করে না। ধরা পড়ে ফাঁসীকাষ্ঠে প্রাণ দিতে হবে–তাই তারা একাজ থেকে সব সময় দূরে থাকে।

ম্যাজিস্ট্রেট কিন্তু মেনে নিতে পারেন না তার কথা। তিনি বললেন, আমার অভিজ্ঞতা কিন্তু অন্যরকম। আমার বিচারক জীবনে এমন কেসও আমি দেখেছি যে অভিজাত বংশের লোকেরাও সময় সময় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। অতএব আপনার সঙ্গে আমি একমত নই।

–বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্নে মতভেদ নিশ্চয়ই থাকতে পারে। আমি শুধু আমার ব্যক্তিগত মতমতই ব্যক্ত করেছি। তবে সঙ্গে সঙ্গে আমি এও বলতে চাই যে, কাউন্টকে আমি জালে ফেলতে পারলে খুবই খুশী হব। আমি চাই ঐ রকম ভদ্রবেশী শয়তানকে আদালতে হাজির করে পুলিশ তার মুখোশ খুলে দিক। আশা করি আপনিও তাই চান।

নিশ্চয়ই।

–আপনার মতামত কি মিঃ আলডিন?

-আমিও চাই শয়তানটাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করা হোক।

ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, কিন্তু বর্তমানে আমাদের হাতে এমন কোনো প্রমাণ নেই যার বলে ওকে গ্রেপ্তার করা যায়। তবে ওর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ করার জন্যে আমি চেষ্টা করবো। আজই বিভিন্ন স্থানে টেলিগ্রাম করব ওর খবরা-খবর সংগ্রহ করতে।

–আপনি যদি চান আমিও এ ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করতে রাজী আছি। বললেন পোয়ারো।

–আপনার সাহায্য পেলে আমরা খুবই খুশী হব। আপনি তাহলে কবে থেকে কাজে নামতে চান?

-আজ থেকেই।

.

১৪.

পোয়ারো কাজ শুরু হলো

মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো তার কাজ শুরু করলেন। তার কাজের ধরন একেবারেই আলাদা। এটি হলো ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ। এবং এই পদ্ধতিতেই তিনি কাজ শুরু করলেন।

-আপনার হয়তো মনে হচ্ছে যে কাউন্ট দ্য রোচিই মাদাম ক্যাথারিন-এর হত্যাকারী, তাই না?–পোয়ারো বললেন।

-হ্যাঁ, আমার দৃঢ় ধারণা ওই শয়তানই রুথকে হত্যা করেছে।

–কিন্তু আরও একটি ঘটনা আপনি একেবারেই ছেড়ে দিচ্ছেন যে।

–কোনো ঘটনা?

ঘটনাটা হলো –মিঃ ক্যাথারিনও ওই ট্রেনে ভ্রমণ করেছিলেন।

–আপনি ড্রেককে কি সন্দেহ করেন?

–না। এখনও সেরকম কিছু মনে করছি না। তবে ইতিমধ্যেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। পুলিশের প্রিফেক্ট নিজে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন।

–তার কাছে কি বলেছে সে?

–তিনি বলেছেন তার স্ত্রী যে ওই ট্রেনে ভ্রমণ করছিলেন সে খবর তিনি জানতেন না।

-আমারও তাই মনে হয়। কারণ সে যদি জানত যে রুথ এই ট্রেনে ভ্রমণ করছে, তাহলে সে তার ফিয়াসেকে নিয়ে একই ট্রেনে ভ্রমণ করত না।

–ফিয়াসে! –বিস্ময়ের সঙ্গে বেরিয়ে এলো কমিশনারের মুখ থেকে; কে সে?

–তার নাম মিরেলি।–আলডিন বললেন, শুনেছি সে নাকি একজন নাম করা নাচিয়ে।

–ঠিকই শুনেছেন। নাচিয়ে হিসেবে সত্যিই তার নাম আছে।–বললেন কমিশনার।

–আর একটা কথা আমি যোগ করতে চাই।–পোয়ারো বললেন, কথাটা হলো, মিরেলিকে পেতে হলে জলের মতো টাকা ব্যয় করতে হয়। আর একটা কথা জানতে চাইছি।

–কি জানতে চান?

–স্ত্রীর মৃত্যুতে আর্থিক দিক দিয়ে কোনো লাভ হয়েছে কি?

-তা হয়েছে বৈকি! ব্যাঙ্কে রুথ-এর নামে ত্রিশ লক্ষ পাউণ্ড জমা আছে। ও টাকা এখন তারই প্রাপ্য। অথচ রুথ যদি কোনো উইল করে যেত তাহলে ও টাকার উত্তরাধিকারী হত উইলের বেনিফিসিয়ারী। তবে আমি যতদূর জানি রুথ কোনো উইল করেনি।

–অর্থাৎ তার মৃত্যুতে মিঃ ক্যাথারিন ত্রিশ লক্ষ টাকা পেয়ে যাচ্ছেন। তাই না?

 –হ্যাঁ। সেই রকমই।

–মিঃ ক্যাথারিন-এর আর্থিক অবস্থা কি রকম?

–খুবই খারাপ। দেউলেও বলা চলে। আমি বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়েছি যে, দেনায় একেবারে ডুবে আছে সে।

–মাদাম ক্যাথারিন যে ডাইভোর্সের মামলা রুজু করতে যাচ্ছিলেন, এ খবর তিনি জানতেন কি?

-হ্যাঁ, জানত। আমি নিজেই সে কথা তাকে বলেছিলাম।

ডিভোর্সের মামলা ডিক্রি হলেও টাকা নিশ্চয়ই তিনি পেতেন না। তাই না?

–কি বলতে চাইছেন আপনি?

–কিছুই বলতে চাইছি না। আমি শুধু ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করছি।

উঠে দাঁড়ালেন পোয়ারো। ম্যাজিস্ট্রেটের দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার আমি চলি, আশা করি শীগগিরই কিছু নতুন খবর জানাতে পারব আপনাকে।

-না মঁসিয়ে। এই মুহূর্তে আপনার কাছে জানার আর কিছু নেই।

–আপনার না থাকলেও আমার আছে। চলুন, বাইরে গিয়ে সে কথা বলছি।

 কোর্ট থেকে বেরিয়ে দুজনে হাঁটতে লাগলেন। মিঃ আলডিন বললেন, আপনি হয়তো জানেন যে আমার কিছু টাকা কড়ি আছে।

-হ্যাঁ, কয়েক শো কোটি ডলার।

 –এবং রুথ আমার একমাত্র সন্তান।

–তাও জানি।

–তাহলে আমার মনের কথাটা শুনুন। পুলিশ তদন্তের ওপরে আমি আস্থা রাখতে পারছি না। আমি রুথ-এর হত্যাকরীকে খুঁজে পেতে চাই। আমার জীবনটা যে পাষণ্ড হতাশায় ভরে দিয়েছে তাকে আমি উপযুক্ত শাস্তি দিতে চাই।

–আপনি কি আইনকে নিজের হাতে নিতে চান?

দরকার হলে তাও আমি নেব। হত্যাকরীকে যদি আপনি খুঁজে বের করতে পারেন। অথচ আইনের চোখে সে ধরা ছোঁয়ার বাইরে, তখন আর আমি আইনের তোয়াক্কা করি কেন। আপনি কি হত্যাকারীকে বের করতে পারবেন?

–এরকুল পোয়ারো আজ পর্যন্ত যতগুলো কেস হাতে নিয়েছে, তার কোনোটাতেই সে বিফল হয়নি, মিঃ আলডিন।

-বেশ, তাহলে আজ থেকেই কাজে লেগে যান। টাকাকড়ির দরকার হবে কি কিছু?

-এখুনি দরকার হবে না। আপনার মতো আমার কোটি কোটি ডলার না থাকলেও টাকাকড়ির অভাব আমার নেই। আমাকে যা দেবার তা পরে দিলেও চলবে।

–আমার কাছ থেকে আর কিছু জানতে চান কি?

–হ্যাঁ, আর একটা কথা জানতে চাই।

–কি বলুন।

–আপনার মেয়ে যে ডিভোর্সের মামলা রুজু করতে যাচ্ছে একথাটা আপনার জামাইকে কবে এবং কোথায় বলেছিলেন?

–আটদিন আগে তাকে আমার ড্রয়িংরুমে ডেকে এনে বলেছিলাম।

–কথাটা শুনে তিনি কি বলেছিলেন?

 –সে আমার মেয়ের চরিত্র সম্বন্ধে কথা তুলেছিল।

 –আপনি কি তাকে মামলাটা কনটেস্ট করতে নিষেধ করেছিলেন?

–হ্যাঁ, মানে, একরকম তাই বটে।

–আপনি কি তার পরেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন?

–না।

না শব্দটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে পোয়ারো থমকে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, এ কেস আমি হাতে নেব না। আচ্ছা। চলি মঁসিয়ে আলডিন।

-সে কি! হঠাৎ এভাবে বেঁকে বসলেন কেন বলুন তো?

–আপনি আমার কাছে ঘটনা গোপন করছেন, মিঃ আলডিন। আমি জানি যে, এর পরেও আপনি মিঃ ক্যাথারিন-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। আমার কাছে যারা ঘটনা গোপন করেন, তাদের কেস আমি হাতে নিই না।

খুবই দুঃখিত এবং লজ্জিত মঁসিয়ে। সত্যিই আমি ঘটনাটা গোপন করেছিলাম। আমি টাকা দিয়ে তার মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল।

টাকার অঙ্কটা বলবেন কি?

–এক লাখ পাউণ্ড।

–ঠিক আছে। আশা করি পনের দিনের মধ্যেই হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে পারব। মিঃ আলডিন পোয়ারোর কথায় নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, ধন্যবাদ মঁসিয়ে। আপনার কথা আমার কাছে যথেষ্ট মূল্যবান।

.

১৫.

 অভিজাত সংস্কৃতি

 পরদিন সকালে পোয়ারোর সঙ্গে ভৃত্য জর্জ-এর কথা হচ্ছিলো। পোয়ারো বলেছিলেন, এর আগে তুমি রিভিয়ারায় এসেছিলে কি, জর্জ?

-হ্যাঁ, এসেছিলাম। আমি তখন লর্ড এডওয়ার্ড ফ্রমোটান-এর কাছে চাকরি করতাম।

-মনে কর তুমি লর্ড ফ্রমোটান। এবং কোনো কারণে তোমার আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়েছে, অথচ তোমার স্ত্রীর হাতে রয়েছে প্রচুর টাকা। এই অবস্থায় তোমার স্ত্রী যদি তোমার বিরুদ্ধে ডিভোর্সের মামলা করতে চায়, তাহলে তুমি কি করবে?

-আমি আমার স্ত্রীর মত পরিবর্তন করতে চেষ্টা করবো।

–শান্তিপূর্ণ উপায়ে, না ভয় দেখিয়ে?

–কোনো লর্ড কখনও তার স্ত্রীর সঙ্গে অভদ্র ব্যবহার করেন না।

–কোনো লর্ডের ছেলের সম্বন্ধে কি এ কথা খাটে?

–নিশ্চয়ই। কোনো লর্ড-এর ছেলে যত অভাবেই পড়ুক না কেন সে কখনও তার স্ত্রীর সঙ্গে অভদ্র ব্যবহার করবে না। সে চরিত্রহীন হতে পারে, জুয়াড়ী হতে পারে, কিন্তু কোনোরকম হীন কাজ সে কিছুতেই করবে না।

জর্জ-এর কথা শেষ হতে না হতেই হোটেলের একজন চাকর চিরকূট এনে পোয়ারোর হাতে দিয়ে বলল, একজন পুলিশ অফিসার আপনার উত্তরের জন্যে রিসেপশন রুমে অপেক্ষা করছেন।

স্যার। চিরকূট খানা পাঠিয়েছেন কমিশনার অফ পুলিশ। তিনি লিখেছেন : কাউন্ট দ্য লা রোচিকে আদালতে ডেকে পাঠানো হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবার সময় আপনি উপস্থিত থাকলে ভালো হয়। ম্যাজিস্ট্রেটেরও এরকমই ইচ্ছা।-কক্স।

তিনি চাকরটিকে বললেন, পুলিশ অফিসারকে একটু অপেক্ষা করতে বল, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।

মিনিট পনেরর মধ্যেই কোর্টে হাজির হলে পোয়ারো। তিনি আসতেই ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, আসুন মঁসিয়ে পোয়ারো। আমরা আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি।

-কাউন্ট মশাই কি এসে গেছেন?

–হ্যাঁ, তাঁকে পাশের ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছে।-বললেন কমিশনার।

–বেশ, এবার তাহলে নিয়ে আসুন তাঁকে। শোনা যাক, মহামান্য কাউন্ট কি বলতে চান!

ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে তক্ষুনি আনা হলো কাউন্টকে। সবাই লক্ষ্য করলেন পোশাক পরিচ্ছদ আর চেহারার দিক থেকে লোকটাকে খুব উঁচুদরের লোক বলে মনে হয়। তাঁর দিকে তাকিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, দয়া করে আসন গ্রহণ করুন মঁসিয়ে লা কাউন্ট।

কাউন্ট বললেন, আমাকে কি জন্য তলব করা হয়েছে। দয়া করে বলবেন কি?

নিশ্চয়ই বলব। আপনাকে ডেকে এনেছি মাদাম ক্যাথারিন-এর সম্বন্ধে দু-চারটে কথা জিজ্ঞেস করবার জন্যে। আমি জানতে পেরেছি যে আপনার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল।

–নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে পরিচয় থাকাটা অপরাধ নাকি?

–আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন মিঃ কাউন্ট। আপনি হয়তো জানেন না যে, মাদাম ক্যাথারিন মারা গেছেন।

-মারা গেছেন! বলেন কি!

–শুধু মারা গেছেন বললে ভুল হবে। তিনি নিহত হয়েছেন।

–কী সর্বনাশ! মাদাম ক্যাথারিন নিহত হয়েছেন। এ কি দুঃসংবাদ। কবে, কখন, কোথায় নিহত হলেন তিনি? কে তাকে হত্যা করল?

–গত চোদ্দই জানুয়ারি শেষরাত্রে ব্লু ট্রেনের একটা কামরার ভেতরে নিহত হয়েছেন তিনি। কোনো অজ্ঞাত আততায়ী তার গলায় ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করেছে তাঁকে।

খবরটা শুনে কাউন্ট দ্য রোচি একেবারে মুষড়ে গেলেন। তিনি মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ এমনভাবে ছিলেন যে, দেখেই মনে হলো তিনি যেন শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছেন।

মিনিট দুই এইভাবে থাকবার পর তিনি বললেন, ট্রেনে ভ্রমণ করা দেখছি রীতিমত বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। আজকাল ট্রেন ডাকাতরা নির্বিবাদে যা খুশী তাই করে চলেছে। আর

আমাদের পুলিশ বিভাগ নিরপরাধ লোকদের ধরে টানা-হাচড়া ও হয়রানি করছে।

–পুলিশ বিভাগ অকারণে কাউকে হয়রান করে না মিঃ কাউন্ট। বললেন কমিশনার।

-শুনে ব্যথিত হলাম। তা আমাকে ট্রেন ডাকাত বলে মনে হয়েছে নাকি আপনাদের?

কাউন্টকে থামিয়ে দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট গম্ভীর স্বরে বললেন, দয়া করে থামুন মঁসিয়ে। পুলিশ এত বোকা নয় যে আপনাকে ট্রেন ডাকাত বলে মনে করবে। যাক, এবার শুনুন, কেন আপনাকে ডেকে আনা হলো। নিহত মাদাম ক্যাথারিন-এর হ্যাণ্ডব্যাগে আপনার লেখা একখানা চিঠি পাওয়া গেছে। চিঠির বিষয়বস্তু আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে।

ম্যাজিস্ট্রেটের কথায় কাউন্ট বেশ ঘাবড়ে গেলেন। তার চোখে মুখে একটা অস্বস্তির ভাব ফুটে উঠলো।

ম্যাজিস্ট্রেট আবার বললেন, চিঠিখানা পড়ে আমরা জানতে পেরেছি যে মাদাম ক্যাথারিন আপনার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে আসছেন। শুধু তাই নয়, আপনি তাকে ইতিহাসে বিখ্যাত হার্ট অব ফায়ার রুবীটাও সঙ্গে আনতে লিখেছিলেন। অতএব বুঝতে পারছেন, বিনা কারণে আপনাকে এখানে আনা হয়নি। ওই চিঠি সম্বন্ধে আপনার বক্তব্য আমরা শুনতে চাই।

ম্যাজিস্ট্রেটের প্রশ্নের জবাবে কাউন্ট দ্য লা রোচি ধীর অথচ স্পষ্ট কণ্ঠে বললেন, চিঠিখানা যখন আপনারা পড়েই ফেলেছেন তখন আর কিছু গোপন করে লাভ নেই। আমি অকপটেই স্বীকার করছি মাদাম ক্যাথারিন-এর সঙ্গে আমার প্রণয় ছিল। আমরা রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। এবং অনেকের মতো আমারও একটা প্রাইভেট লাইফ আছে। মাদাম ক্যাথারিন সত্যিই আমার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে আসছিলেন।

–আপনি গেয়ার দ্য নয়েন স্টেশনে মাদামের সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবং তারপর ট্রেনে উঠে তাঁর কামরাতেই ছিলেন। তাই নয় কি?

-না, এ কথা সত্যি নয়।

-আপনি কি চোদ্দ তারিখে সন্ধ্যার সময় তাঁর সঙ্গে গেয়ার দ্য নয়েন স্টেশনে দেখা করেননি?

–নিশ্চয়ই না। ঐ তারিখে ভোর বেলায় আমি নিস-এ পৌঁছই। অতএব আপনার অনুমান একেবারে ভিত্তিহীন।

-ভিত্তিহীন হলেই আমি খুশী হব মিঃ কাউন্ট। কিন্তু আপনার বক্তব্যের সমর্থনে আমরা কিছু সাক্ষ্য প্রমাণ চাই। চোদ্দ তারিখের বিকেল বেলা থেকে পনেরো তারিখের ভোর রাত্রি পর্যন্ত আপনি কোথায় কোথায় ছিলেন এবং কি করছিলেন তার একটা তথ্য নির্ভর প্রমাণ আপনার কাছে আছে তাই না মঁসিয়ে?

ম্যাজিস্ট্রেটের কথা শুনে কাউন্ট বললেন, সেদিন সন্ধ্যার পরে মন্টিকার্লোর কাফে দ্য প্যারীতে ডিনার খেতে যাই। ডিনার শেষ হলে আমি যাই লে স্পোর্টিং-এ, সেখানে জুয়া খেলে কয়েক হাজার ফ্র লাভ করেছিলাম।

-তারপর কি করলেন?

–তারপর সোজা আমি বাড়িতে চলে আসি।

–আপনি কি ট্রেনে এসেছিলেন?

–না। আমি আমার টু সীটার গাড়ীতে এসেছিলাম।

–আপনার সঙ্গে আর কেউ ছিল নাকি?

–না।

–আপনার এই বক্তব্যের সমর্থনে কোনো প্রমাণ দিতে পারবেন কি?

–নিশ্চয়ই পারব, কাফে দ্য প্যারী এবং লে স্পোর্টিং-এ অনেকেই আমাকে দেখেছিলেন। ওই দু জায়গায় খবর নিলেই আমার কথার সত্যতা জানতে পারবেন।

–আপনি বাড়িতে এসেছিলেন কখন?

শেষ রাত্রে।

দরজা খুলে দিয়েছিল কে? আপনার চাকর নিশ্চয়ই।

–না, আমি নিজেই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেছিলাম। সদর দরজার একটা বাড়তি চাবি আমার কাছে থাকে।

সেই চাবির সাহয্যেই আমি ভেতরে ঢুকেছিলাম।

–তার মানে, লে স্পোর্টিং থেকে বাড়িতে ফেরা অবধি আপনার বক্তব্যের সমর্থনে কোনো প্রমাণ নেই। তাই না?

-হ্যাঁ, অবস্থাটা প্রায় সেই রকমই দাঁড়াচ্ছে।

হাকিম কনস্টেবলকে ডেকে বললেন, মহিলাদের ঘরে যে স্ত্রীলোকটি বসে আছে, তাকে নিয়ে এস।

এক মিনিটের মধ্যে মিস ম্যাসন হাজির হলেন আদালত কক্ষে। তাঁর দিকে তাকিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, আপনাকে একটা বিশেষ দরকারে ডেকে আনা হয়েছে এখানে।

-কি জানতে চান বলুন।

–আপনি বসুন, তারপর বলছি।

ম্যাসনের কানে কানে ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, দেখুন তো এই ভদ্রলোকটিকে আপনি চেনেন কি না।

কাউন্ট দ্য লা রোচিকে দেখিয়ে দিলেন তিনি।

মিস ম্যাসন কাউন্টকে ভালো করে লক্ষ্য করে বলল, না, এঁকে আমি দেখেছি বলে মনে হয় না।

তার কথায় ম্যাজিস্ট্রেট হতাশ হলেও সেটা প্রকাশ না করে বললেন, আচ্ছা, কার্জন স্ট্রীটের বাড়িতে এঁকে কোনোদিন দেখেছিলেন কি?

-না, তাও ঠিক নয়। মাদামের কামরায় সেদিন যাকে দেখেছিলাম, তার চেহারাটা প্রায় ওঁর মতোই। তবুও আমি সঠিকভাবে বলতে পারছি না, ইনিই সেই ভদ্রলোক কি না।

পোয়ারো এতক্ষণ প্রশ্নোত্তর শুনে যাচ্ছিলেন। তিনি এবার বললেন, আপনার টিকিটখানা কি করেছিলেন মাদমোয়াজেল ম্যাসন?

-টিকিট।

 –টিকিট। লণ্ডন থেকে নিস পর্যন্ত ট্রেনের টিকিটের কথা বলছি আমি।

পোয়ারোর প্রশ্নের উত্তরে মিস ম্যাসন বেশ একটু বিব্রত হয়ে পড়লেন। তারপর কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, টিকিটখানা কণ্ডাক্টরকে দিয়েছিলাম।

কথাটা শুনে পোয়ারো এবং কমিশনার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন। চোখে-চোখে কি যেন কথা হলো উভয়ের মধ্যে। ম্যাজিস্ট্রেটও লক্ষ্য করেছিলেন এটা। কিন্তু ও নিয়ে আর কিছু না বলে মিস ম্যাসন-এর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, আচ্ছা, আপনি এখন যেতে পারেন মিস ম্যাসন।

মিস ম্যাসন চলে যেতেই পোয়ারো তার নোট বইয়ের পৃষ্ঠায় কি যেন লিখলেন। তারপর পৃষ্ঠাখানা ছিঁড়ে ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে দিলেন।

কাগজখানা পড়ে কমিশনারের হাতে দিলেন ম্যাজিস্ট্রেট। কমিশনার সেটা পড়ে পোয়ারোর দিকে একবার তাকিয়ে কোর্ট থেকে বেরিয়ে গেলেন।

এদিকে কাউন্ট একটু বিরক্ত স্বরে হাকিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাকে আর কতক্ষণ থাকতে হবে স্যার?

-না, আর আপনাকে আটকে রাখব না। আপনি এবার যেতে পারেন।

ম্যাজিস্ট্রেটের কথা শুনে কাউন্ট উঠে দাঁড়িয়ে তাকে অভিবাদন জানিয়ে কোর্ট থেকে বেরিয়ে গেলেন।

কাউন্ট যাবার মিনিট দুই পরেই কমিশনার ফিরে এসে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার উপদেশমত ওর পেছনে দুজন গুপ্তচর নিযুক্ত করে এলাম।

পোয়ারো বললেন, শুধু গুপ্তচরদের ওপর নির্ভর করে বসে থাকলেই চলবে না, মঁসিয়ে কমিশনার আমাদের নিজেদেরও কাজে নামতে হবে। আমাদের যাচাই করতে হবে ওঁর কথাগুলো কত পারসেন্ট সত্যি। তাছাড়া, উনি যাতে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে না পারেন যে আমরা ওর গতিবিধি লক্ষ্য করছি।

পোয়ারোর কথা শেষ না হতেই মিঃ ক্যাথারিন এসে হাজির হলো আদালত কক্ষে। ম্যাজিস্ট্রেটের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে আদালতে তলব করে আনা হলো কেন, স্যার?

মিঃ ক্যাথারিন-এর কথাগুলি অনেকটা কৈফিয়ত চাওয়ার মতো শোনায়।

–আপনি হয়তো ভুলে গেছেন এটা আদালত কক্ষ এবং যার সঙ্গে আপনি কথা বলছেন তিনি ম্যাজিস্ট্রেট।

ম্যাজিস্ট্রেটের ধমক খেয়ে ক্যাথারিন বুঝতে পারল ওভাবে কথা বলা তার উচিত হয়নি।

-আমাকে ক্ষমা করবেন স্যার। নানা করণে আমার মনটা এতই চঞ্চল হয়েছে যে স্থান কাল পাত্র ভুলেই গিয়েছিলাম।

–ঠিক আছে, আপনি বসুন। আমরা আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। আশাকরি উত্তরগুলো ঠিকমত পাবো।

–কি জানতে চান, বলুন।

-আপনি বলেছিলেন যে, ট্রেনে আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি। কথাটা কি ঠিক?

–নিশ্চয়ই। কিন্তু এই কথাটা জিজ্ঞেস করার জন্যেই যদি আমাকে ডেকে আনা হয়ে থাকে তাহলে আমি বলব যে ফরাসী পুলিশের কাণ্ডজ্ঞান কিছুটা কম।

–পুলিশের কাণ্ডজ্ঞান ঠিকই আছে মিঃ ক্যাথারিন। এবার যা যা জিজ্ঞেস করা হচ্ছে সেগুলোর উত্তর দিন।–বললেন ম্যাজিস্ট্রেট।

–বেশ প্রশ্ন করুন।

প্রশ্ন করতে শুরু করলেন পোয়ারো।

–আপনার স্ত্রী নিশ্চয়ই কোনো উইল করে যাননি?

–সেই রকমই মনে হয়।

–তিনি যদি কোনো উইল না করে থাকেন তাহলে তার সম্পত্তির আইনসম্মত উত্তরাধিকারী কে হচ্ছেন, মঁসিয়ে?

–কি বলতে চাইছেন আপনি?

-আমি বলতে চাইছি যে মাদাম ক্যাথারিন-এর মৃত্যুর পর তাঁর যাবতীয় সম্পত্তির মালিক হয়েছেন তার স্বামী, অর্থাৎ আপনি কেমন, ঠিক তো?

–হয়তো তাই। কিন্তু আপনি কে? তাছাড়া আপনাকে প্রশ্ন করার অধিকার কে দিল?

-আমার নাম এরকুল পোয়ারো। নামটা হয়তো আপনার অপরিচিত নয়। আর প্রশ্ন করার অধিকার-ম্যাজিস্ট্রেট নিজে আমাকে এই অধিকার দিয়েছেন।

-আপনি কি তাহলে মনে করেন যে, আমিই আমার স্ত্রীকে হত্যা করেছি? যদি তাকে হত্যা করতাম তাহলে নিশ্চয়ই আমি তার রুবীটা চুরি করতাম না?

–ঠিকই বলেছেন মঁসিয়ে। আমিও তাই মনে করি।

–আমার মনে হয়, অভিশপ্ত হার্ট অ ফায়ারই তার মৃত্যুর কারণ। ইতিহাস প্রসিদ্ধ রত্নের জন্য আগেও কয়েকটা হত্যাকাণ্ড হয়েছে, কিন্তু নারীহত্যা বোধহয় এই প্রথম।

-আমারও তাই মনে হয় মঁসিয়ে। এবার আরেকটা কথা জানতে চাইছি আপনার কাছে।

–বলুন।

–আপনার স্ত্রীর সঙ্গে সর্বশেষ আপনার দেখা হয়েছিল কতদিন আগে?

একটু চিন্তা করে ক্যাথারিন বলল, ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল তিন সপ্তাহ আগে।

–তারিখটা মনে আছে কি?

 –না। তবে তারিখটা তিন সপ্তাহ আগে তো বটেই, এমন কি কিছু বেশি হতেও পারে। ক্যাথারিন তখন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অনুমতি চাইল, এবার তাহলে আমি যেতে পারি কি?

-হ্যাঁ, আপনি এবার যেতে পারেন।

মিঃ ক্যাথারিন আদালত কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতেই পোয়ারো তাকালেন কমিশনারের দিকে।

–আমাকে কিছু বলতে চাইছেন? জিজ্ঞেস করলেন কমিশনার।

–হ্যাঁ, হার্ট অব ফায়ার চুরি যাবার কথা আপনি কবে বলেছেন মিঃ ক্যাথারিনকে?

 –আমি এ ব্যাপারে কোনো কথাই ওকে বলিনি।

-তাহলে ওটা চুরি যাবার কথা উনি কেমন করে জানলেন? মাদাম ক্যাথারিন-এর সঙ্গে ওঁর দেখা হয়েছিল তিন সপ্তাহ আগে। সে সময় মাদাম নিজেও জানতেন না যে হার্ট অব ফায়ার তার হাতে আসবে। ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হচ্ছে না কি?

পোয়ারো উঠে দাঁড়ালেন।

–আপনি কি চলে যাচ্ছেন?

–হ্যাঁ, আমাকে এখুনি যেতে হচ্ছে।

 পোয়ারো কোট থেকে বেরিয়ে গেলেন।