দি পেল হর্স – ১২

দ্বাদশ অধ্যায় 

দিন তিনেক পর জিনজার ফোন করলো আমাকে। 

—তোমাকে একটা নাম আর ঠিকানা দিচ্ছি। লিখে নাও। বললো জিনজার। নোটবুক খুলে লেখার জন্য তৈরি হয়ে বললাম, বলো। 

—নাম ব্রাডলে। আর ঠিকানা – আটাত্তর নম্বর মিউনিসিপ্যাল স্কোয়ার বিল্ডিংস বারমিংহাম। 

—এই নাম আর ঠিকানা কি হবে? 

—ঈশ্বর জানেন। আমি জানি না। সন্দেহ আছে, এটা পপির কাজ 

— পপি? সত্যি? 

—হাঁ পপিকে আমি জেরা করেছি, তার ওপর নজরও রেখেছি। বুঝেছি, চেষ্টা করলে ওর মুখ থেকে অনেক কিছু জানতে পারবো। ওর মনটাকে নরম করতে পারলে সব কিছু সহজে পেয়ে যাবো। 

মেয়ে মহলের গোপন রহস্য। তুমি ঠিক বুঝবে না। কোনো মেয়ে যদি অন্য এক মেয়ের কাছে মনের কথা বলে তবে সে কিছু মনে করে না। এটা সামান্য ব্যাপার। 

—এটা তাহলে সাংগঠনিক আদান প্রদান তাই না? 

—কথাটা সেভাবে বলতে পারো। আমরা একসাথে লাঞ্চ খেতে গিয়ে আমার জীবনের প্রেমকাহিনী বলছিলাম—অনেক বাধা বিপত্তি–আমার প্রেমিক পুরুষটি বিবাহিত। তার বউ ক্যাথলিক। তাই কিছুতেই তার বউ বিবাহবিচ্ছেদে রাজী হচ্ছে না। বুঝতে পারছো আমরা বেঁচে থেকে প্রেমহীন নরক যন্ত্রণা ভোগ করছি। অথচ বউটি পঙ্গু এবং শয্যাশায়ী। দীর্ঘকাল ধরে এমনি অবস্থায় ভুগছে। মরছেও না। ওই বউটি মরলে এখন সব দিক দিয়ে ভালো হয়। তারপর বললাম, ভাবছি একবার পেল হর্সে যাবো। কিন্তু কি করে ওখানে যোগাযোগ করবো তা বুঝতে পারছি না। আর জানি না ওরা অনেক টাকা নেবে কিনা! পপি জবাব দিলো যে, সে যতদূর জানে ওখানে খরচ অনেক হবে। বললাম, আমার কিছু টাকা পয়সা পাওয়ার আশা আছে। আমার বড়জ্যাঠার সম্পত্তি। সেই বুড়োও যদি তাড়াতাড়ি সরে তবে আমার সমস্যা মেটে। আচ্ছা, ওরা আগাম কাজ করে বোধ হয়? কিন্তু ওদের সঙ্গে কি ভাবে যোগাযোগ করবো? আর তখুনি পপি আমাকে এই নাম আর ঠিকানা দিয়ে বললো, এর সঙ্গে কাজের কথা আর তোমাকে এর জন্য কত টাকা দিতে হবে তা ঠিক করে নিও। 

—এ ত দেখছি দারুণ খবর। বললাম। 

—হাঁ তাই। 

একটি মুহূর্তের জন্য আমরা উভয়ে নীরব রইলাম। বিস্মিত কণ্ঠে একসময় বললাম—সে খোলাখুলি সবকিছু তোমায় বললো? তাকে কি একটুও ভীত মনে হয়নি? 

অধীর কণ্ঠে জবাব দিলো জিনজার–বুঝতে পারছো না, আমার কাছে বলার জন্য ভয়ের কোনো কারণ সে বোধ করেনি। দ্যাখো মার্ক, আমরা যা ভাবছি সে নিরিখে এটা যদি সত্য সত্যই একটা ব্যবসা তবে লোকজনের মধ্যে তার সম্প্রচার প্রয়োজন, তাই না? বলতে চাইছি, ওরা সব সময় নতুন নতুন মক্কেল পাকড়াও করতে চায়। 

—এ ধরনের ঘটনা যে ঘটে তা বিশ্বাস করে আমরা পাগল বনছি। 

—ঠিক আমরা। আমরা পাগল। তুমি কি মিস্টার ব্রাডলের সঙ্গে দেখা করতে বারমিংহাম যাচ্ছো? 

হাঁ, মিস্টার ব্রাডলের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। অবশ্য যদি লোকটার অস্তিত্ব থাকে।

সত্যিই লোকটার অস্তিত্ব আছে একথাটা তখন আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু আমি ভুল করেছিলাম। মিস্টার ব্রাডলের অস্তিত্ব আছে। 

মিউনিসিপ্যাল স্কোয়ার বিল্ডিংস ঠিক যেন একটা অতিকায় মৌচাক—আর তার খোপে খোপে অজস্র অফিস। আটাত্তর নম্বরটা চার তলায়। ঘসা কাঁচের দরজার গায়ে পরিচ্ছন্নভাবে লেখা—সি. আর. ব্রাডলে ভারপ্রাপ্ত দালাল। এবং নিচে একটু ছোট অক্ষরে লেখা—দয়া করে ভিতরে আসুন। 

ভিতরে ঢুকলাম। 

ছোট খাটো বাইরের অফিসটা ফাঁকা। এবং পাশের ঘরের ‘প্রাইভেট’ লেখা দরজার পাল্লাটা সামান্য খোলা। ওপাশ থেকে ডাক এলো—দয়া করে ভিতরে আসুন। 

ভিতরের অফিস ঘরটা একটু বড়ো সড়ো। ঘরে একখানা টেবিল, দু একখানা আরামদায়ক চেয়ার, একটা টেলিফোন, একটা তাক ভরা ফাইল—টেবিলের ওপাশে বসা মিস্টার ব্রাডলে। ছোটোখাটো লোকটির গায়ের রঙ কালো। দুটো কালো চোখে ধূর্ত দৃষ্টি। পরনে ব্যবসায়ী সুলভ কালো রঙের পোশাক। তার চেহারায়, আচার আচরণে আভিজাত্যের লক্ষণ। 

আনন্দিত কণ্ঠে লোকটি বললো-দরজাটা বন্ধ করে দিন, দেবেন কি? এবং বসুন, ওই চেয়ারখানা খুবই আরামদায়ক। বলুন কি করতে পারি আপনার জন্য? 

তার দিকে তাকালাম। কি করে শুরু করবো জানতাম না। কি বলবো তারও কোনো ধারণা ছিলো না। আমার মনের হতাশাই সরাসরি আক্রমণাত্মক শব্দ ব্যবহার করতে উৎসাহ দিলো। কিংবা ওর ভাঁটার মতন দুচোখের দৃষ্টি দেখেই আক্রমণ শানালাম। 

—কত খরচ পড়বে? শুধালাম। 

আমার প্রশ্ন ওকে বিচলিত করলো। খুশি হলাম যেভাবে তার বিচলিত হওয়ার কথা তা সে হয়নি দেখে। ওর আসলে বসে থাকলে যে ধারণা করতাম যে, মাথায় কিছু নেই এমন একটা লোক তার অফিসে ঢুকেছে—এ ধারণা তার মাথায় আসেনি। 

তার ভুরু দুটো তির্যক হলো। 

বললো—ঠিক আছে। আসতে আপনার বেশি সময় নষ্ট হয়নি ত? 

আমি কিন্তু নিজের কথায় অনড় থেকে শুধালাম—আমার প্রশ্নের জবাব কি? 

সামান্য ভর্ৎসনা করার ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে সে বললো–এভাবে কোনো কিছু আলোচনা করা যায় না। আমরা উপযুক্ত আচরণ করবো। 

কাঁধ নাচিয়ে বললাম—আপনার কথাই মানলাম। তা উপযুক্ত আচরণ কি? 

—আমরা এখনও কেউ কারো সাথে পরিচিত হইনি, হয়েছি কি? আমি আপনার নামও জানি না। 

বললাম—এই মুহূর্তে আপনাকে আমার নাম বলার ইচ্ছা অনুভব করছি না।

—সতর্কতা? 

—সতর্কতা। 

—একটি প্রশংসা সূচকগুণ—যদিও সব সময় তা বাস্তবায়িত হয় না। এখন বলুন, কে আমার কাছে আপনাকে পাঠিয়েছে? কে আমাদের পরস্পরের বন্ধু? 

—আবার আপনাকে তা বলতে পারছি না। আমার এক বন্ধুর এক বন্ধু আছে সে আপনাদের এক বন্ধুকে জানে। 

মিস্টার ব্রাডলি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললো–এমনিভাবে আমার অনেক মক্কেল এখানে আসে। কতকগুলো সমস্যা মার্জিত। মনে করতে পারি যে, আপনি আমার পেশার কথা জানেন? কিন্তু আমার জবাব শোনবার জন্য সে অপেক্ষা করতে চাইলো না। সে নিজেই তাড়াতাড়ি আমার জবাব দিলো- রেসের মাঠের ভারপ্রাপ্ত দালাল? ঘোড়া সম্পর্কে কি আপনি জানতে আগ্রহী? লোকটার সাথে তর্ক এড়াবার জন্য বললাম—আমি রেসুড়ে নই। 

—ঘোড়ার অনেক ধরনের বিশেষত্ব আছে। রেসের ঘোড়া, শিকারের জন্য ঘোড়া, ভাড়া দেওয়ার জন্য ঘোড়া। ঘোড়াদের এই খেলোয়াড়ি দিকটায় আমি আগ্রহী। বাজি ধরার অভ্যাস। মুহূর্ত থেমে সে এবার শুধালো—তা কোনো বিশেষ ঘোড়ার দিকে কি আপনার মনের আগ্রহ? বারেক কাঁধ নাচিয়ে নিজের সর্বনাশ করে বললাম—পেল হর্স…। একটি ফ্যাকাসে ঘোড়া। 

—বাঃ চমৎকার। আপনি নিজেই দেখছি একটি ডার্ক হর্স। রহস্যময় লোক। তবে বিব্রত হওয়ার প্রয়োজন নেই। 

খানিকটা কটুকণ্ঠে বললাম—ওটা নিছক আপনার বক্তব্য। 

মিস্টার ব্রাডলের আচরণ এ সত্ত্বেও আরো কোমল ও সুখকর হয়ে উঠলো—আপনার মনোভাব আমি সম্পূর্ণ বুঝতে পারছি। আপনার উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠার প্রয়োজন নেই। নিজে আমি একজন আইন ব্যবসায়ী। যদিও আদালত থেকে আমি বিতাড়িত। নইলে এখানে এমনভাবে বসে থাকতাম না। আইন আমার জন্য। তাই আমি যে সব কাজের অনুমোদন করি তার মধ্যে কোনো খুঁত থাকে না। এটা ধরার খেলা। মানুষ যে কোনো ব্যাপারেই বাজি ধরতে পারে। যেমন দেখুন—কাল বৃষ্টি হবে কি না বা রাশিয়ানরা চাঁদে মানুষ পাঠাতে পারবে কি না। অথবা আপনার স্ত্রীর যমজ সন্তান হবে কিনা। আপনিও বাজি ধরতে পারেন মিসেস ব্রাডলি খৃষ্টমাসের আগেই মারা যাবে অথবা মিসেস করিগ্যান শতবর্ষ জীবনী হবে। আপনি বিচার শক্তি বা ইচ্ছা শক্তি ব্যবহার করে এসব নির্ধারণ করতে পারেন। একেবারেই সহজ একটা কাজ। 

অনুভব করলাম যে, ঠিক যেন অস্ত্রোপচারের আগে একজন শল্য চিকিৎসক অভয়বাণী শোনাচ্ছে। সত্যিই এটা খুবই সহজ ব্যাপার। 

একসময় ধীরে ধীরে বললাম—এই পেল হর্সের রহস্যটা সত্যিই বুঝতে পারছি না। 

—আপনি কি তার জন্য চিন্তিত? হাঁ অনেকেই এর জন্য উদ্বিগ্ন হয়। স্বর্গ ও মত্যে বহু আশ্চর্যজনক ঘটনাই ঘটে থাকে। খোলাখুলি বলছি, আমি নিজেও এর মাথা মুণ্ডু বুঝতে পারি না। কিন্তু সবচেয়ে চমকপ্রদ উপায়ে এর ফল ফলে। 

—এ সম্বন্ধে আরো কিছু যদি আমাকে বলবেন…। নিজের কাজ সম্বন্ধে এখন আমি অটল—সতর্ক, উৎসাহ-কিন্তু ভীম। আমার এই মানসিক অবস্থা মিস্টার ব্রাডলি বুঝতে পারছে—আর এই অবস্থান মোকাবিলা করতে তিনি সক্ষম। 

—ও জায়গাটা কি আপনি চেনেন? 

সিদ্ধান্ত দ্রুত স্থির করে ফেললাম। এখন মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া মূর্খামি হবে। বললাম—হাঁ, ওদের একজন ওখানে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো। 

—চমৎকার পুরনো পান্থ নিবাস। ঐতিহাসিক আগ্রহ সঞ্চারকারী বস্তুতে পূর্ণ। এবং ওরা চমৎকার ভাবে ওটা পুননির্মাণ করছে। বন্ধু, আমার ধারণা মিস গ্রের সাথে আপনার দেখা হয়েছে তাই না? 

—হাঁ, হাঁ, নিশ্চয়। আপনি সঠিক জায়গাতেই আঘাত করছেন। অসাধারণ মহিলা। এবং অসাধারণ মহিলার ক্ষমতা 

—সে যে কাজ করতে পারে বলে দাবি করছে নিশ্চয়ই সে সব করা সম্ভব নয়? 

—ঠিক তাই। এটাই বিচার্য বিষয়। যে সব জিনিস জানতে এবং করতে পারে বলে দাবি করছে সেসব জানা বা করা সম্ভব নয়। সবাই একথাটাই বলে থাকে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ আদালতে আইনের দৃষ্টিতে…। 

ওর কালচে ভাঁটার মতন দু’চোখের দৃষ্টি আমার ভিতরটা কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে। 

মিস্টার ব্রাডলি জোরালো গলায় আবার কথাগুলো বলতে লাগলেন—আদালতে আইনের দৃষ্টিতে এ ব্যাপারটা হাস্যকর বলে নির্ধারিত হবে। যদি ওই মহিলা নিজে উঠে দাঁড়িয়ে স্বীকৃতি সূচক জবানবন্দী দেয় যে, সে খুন করেছে, খুন করছে দূর থেকে আঘাত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কিংবা ইচ্ছা শক্তির দ্বারা যে মহিলা খুশিমতন যে কোনো অবাধ্য নামই বলুক না তবুও এই স্বীকৃতি সূচক জবানবন্দীর জন্য তাকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। এমন কি তার জবানবন্দী যদি সত্য হয়। (অবশ্য আপনার আমার মতন বিবেচক লোক তা মুহূর্তের জন্যও বিশ্বাস করবে না ) তবুও তা আইন সিদ্ধভাবে আদালতে গৃহীত হবে না। দূর থেকে নিয়ন্ত্রিত খুন আদালতে বিচার যোগ্য খুন হবে না। এটা গাল গল্প। এ ব্যাপারটার তাই এটাই সৌন্দর্য—মুহূর্তের জন্য চিন্তা করলে আপনিও এ সৌন্দর্যের তারিফ করবেন। 

বুঝতে পারলাম আমাকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে। যাদু বিদ্যার দ্বারা খুন করা হলে ইংল্যান্ডের আদালতে তা আইনের দৃষ্টিতে বিচার্য বলে গৃহীত হয় না। 

আমি যদি কাউকে লাঠির ঘায়ে বা ছুরিকাঘাতে খুন করার জন্য একজন গুণ্ডাকে ভাড়া করে নিয়োগ করি তবে খুনের ঘটনা ঘটাবার আগে সাহায্যকারী রূপে এবং তার সাথে মিল ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে অপরাধী সাব্যস্ত হবো। কিন্তু যদি থিরজা গ্রে কে তার যাদুবিদ্যা প্রয়োগ করার জন্য নিয়োগ করি তবে সেই যাদু বিদ্যা প্রয়োগের যুক্তি আদালতে গ্রাহ্য হবে না। মিস্টার ব্রাডলির কথা অনুসারে এটাই হচ্ছে জিনিসটার বা পদ্ধতিটির সৌন্দর্য। 

আমার মনের স্বাভাবিক সন্দেহ প্রবণতা বলে উঠলো প্রতিবাদ করার জন্য। চিৎকার করে বললাম—উচ্ছন্নে যাক এসব সৌন্দর্য। আমি এসব বিশ্বাস করি না। এমন কাজ করা সম্ভব নয়। 

—আপনার সাথে আমি একমত। সত্যি আমিও বিশ্বাস করি না। থিরজা গ্রে একজন অসাধারণ মহিলা, অসাধারণ কিছু কিছু শক্তি তার আছে—কিন্তু যে সব জিনিস সে দাবি করে তা কোনো লোক বিশ্বাস করতে পারে না। আপনার মতন আমিও বলছি—এ এক অপূর্ব সুন্দর বস্তু। আজকের যুগে কোনো লোকই সত্যিই বাহবা নিতে পারে না যে, ইংল্যান্ডের কুটিরে বসে ক্যাপ বা আর কোনো স্থানে বসবাসকারী একটি লোককে ভাবনার ঢেউ বা সেটা যাই হোক না কেন, তার দ্বারা একজন মানুষকে কোনো সুবিধাজনক রোগে সে অসুস্থ করে তুলতে এবং তার মৃত্যু ঘটাতে পারে। 

—কিন্তু ঠিক এ কাজই করতে পারে বলে দাবি করছে থিরজা গ্রে, তাই ত? 

—ঠিক তাই। অবশ্যই মহিলার শক্তি আছে। সে স্কচ জাতির মানুষ। আর যাকে তৃতীয় নয়নের দৃষ্টি বলে তা এই জাতির মানুষদের বিশেষত্ব। আর এটাই আমি বিশ্বাস করি এবং বিশ্বাস করি নিঃসন্দেহে। একটু ঝুঁকে বসে বেশ মন কাড়া ভঙ্গিতে মিস্টার ব্রাডলি আঙুল নাড়াতে লাগলো। তারপর আবার এক সময় সে বললো—থিরজা গ্রে আগে থেকেই জানতে পারে কখন লোকটির মৃত্যু ঘটবে। এটা এক ধরনের ঐশ্বরিক দান। এবং তাই এ শক্তির সে অধিকারিণী। বলা শেষ করে পিছনে হেলান দিয়ে বসে সে আমার প্রতিক্রিয়া দেখতে লাগলো। 

আমি কিন্তু নীরব। অনড়। 

একটা ঘটনা ধরা যাক। কোনো একজন, ধরুন আপনি নিজে বা আর কেউ জানতে খুবই উদগ্রীব, ধরুন এলিজা পিসি মারা যাবে। এমনি ধরনের একটা খবর জানা আপনার পক্ষে দারুণ প্রয়োজন—আপনি অস্বীকার করতেও বাধ্য। এর মধ্যে নিষ্ঠুরতার কোনো স্পর্শ নেই—নেই কোনো অন্যায়—এটা শুধু একটা ব্যবসায়িক সুবিধা গ্রহণের সুযোগ। কি মতলব করতে হবে? আমরা কি স্বীকার করবো যে, এর ফলে আগামী নভেম্বরে হাতে কিছু প্রয়োজনীয় অর্থ আসবে? যদি আপনি জানতে পারেন যে এই উদ্দেশ্য সাধনের দ্বিতীয় একটা পথও রয়েছে—সে পথটা খুবই মূল্যবান। মৃত্যু এমনই একটা সুযোগ। এলিজা পিসি হয়ত ডাক্তারদের চেষ্টায় আরো বছর দশেক বেঁচে থাকতো। বুড়ি পিসিকে হয়ত খুবই ভালোবাসেন, কিন্তু বুড়ির মৃত্যু সংবাদ আগাম জানতে পারলে আপনি দারুণ খুশি হয়ে উঠতেন। মিস্টার ব্রাডলি থামলো। একটুখানি সামনে ঝুঁকে বলতে শুরু করলো—ঠিক এই অবস্থায় আমি দেখা দিই। আমি হচ্ছি জুয়াড়ি। আমার নিজে শর্তে আমি যে কোনো ব্যাপারে বাজী ধরে থাকি। আপনি আমার কাছে এলেন। স্বাভাবিকভাবেই আপনি বুড়ি পিসির মৃত্যু সম্বন্ধে বাজী ধরতে চাইবেন না। এটা আপনার মনকে বিব্রত করে তুলবে। কাজেই ব্যাপারটা এভাবে বিচার করা যায়। আপনি আমার সঙ্গে বাজী ধরলেন যে, এলিজা পিসি আগামী খৃষ্টমাস পর্যন্ত সুস্থ সবল থাকবে—কিন্তু আমি বাজী ধরলাম যে, থাকবে না। 

ভাঁটার মতন দু চোখের দৃষ্টি আমার উপর আরোপিত আমাকে দেখছে… 

—এর মধ্যে অন্যায় কিছু নেই, আছে কি? একেবারে সরল কথা। এ বিষয়ে আমাদের মধ্যে একটা বিরোধ হয়েছে। আমি বলছি, এলিজা পিসির মৃত্যু আসন্ন –আপনি বলছেন, না। মৃত্যু আসন্ন নয়। এই বিষয়ে একটা চুক্তি পত্র করে আমরা সই করলাম। আমি আপনাকে একটা তারিখ জানিয়ে বললাম যে, এই তারিখের পনেরো দিন আগে হোক বা পরে হোক এলিজা পিসির মৃত্যু হবে এবং তার শ্রাদ্ধও চুকে যাবে। আপনি বললেন যে, তেমনটা কিছুতেই ঘটবে না। আপনার কথা সত্য হলে আমি বাজীর টাকা আপনাকে মিটিয়ে দেবো। আর আপনার কথা যদি না মেলে, তবে আপনি আমাকে বাজীর টাকা মিটিয়ে দেবেন। 

তার দিকে তাকালাম। যে লোক তার জীবন পথ থেকে একজন ধনী বৃদ্ধাকে সরিয়ে দিতে চায় ঠিক তেমন একজন লোকের মানসিক অবস্থা ভাবতে চেষ্টা করলাম। এই লোকটার বদলে ভাবতে লাগলাম একজন ব্ল্যাকমেলারকে। এ কাজটা খুব সহজ হলো। লোকটা কয়েক বছর ধরে আমাকে ক্ষত বিক্ষত করে তুলেছে। আর সহ্য করতে পারছি না। সে সরুক এটাই আমি চাই। কিন্তু নিজে আমি তাকে খুন করবো তেমন স্নায়বিক ক্ষমতা আমার নেই—কিন্তু এর জন্য যে কোনো বস্তু আমি দিতে পারি—হাঁ। যে কোনো বস্তু। কথা বললাম— কণ্ঠস্বর কর্কশ শোনালো। এক ধরনের বিশ্বাস অবলম্বন করে নিজের ভূমিকায় যেন অভিনয় করে চলেছি। 

শুধালাম— শর্তগুলো কি? 

মিস্টার ব্রাডলির আচরণ দ্রুত বদলে গেলো। 

আনন্দোজ্জ্বল প্রায় কৌতুকপ্রিয় আচরণ। 

—আসল জায়গায় আসা গেলো, তাই না? অথবা আপনি রাজী হলেন। জানতে চাইছেন, কত খরচ পড়বে? সত্যিই আমি অবাক হয়ে গেছি। এত দ্রুত কাউকে রাজী হতে কখনও দেখিনি। 

আবার শুধালাম—শর্তগুলো কি? 

—নানা ধরনের ঘটনা আর বিষয়ের উপর তা নির্ভরশীল। যার জন্য বাজী ধরা হচ্ছে তার অর্থমূল্যের পরিমাণের উপর সেটা নির্ভর করে থাকে। মক্কেল কত পরিমাণ অর্থ লাভ করবে তার উপর সেটা নির্ভর করে। অসুবিধাজনক স্বামীর কবল বা ব্ল্যাকমেলারের শোষণ কিংবা এমনি ধরনের আর কারো হাত থেকে মুক্তি—এসব কিছু বিচার বিবেচনা করে তবে ঠিক করতে হয় আমার মক্কেল কি পরিমাণ অর্থ দিতে সক্ষম হবে। খোলাখুলি স্বীকার করছি যে, সে জাতীয় কাজ আমি হাতে নিই না। এ ব্যাপারে এলিজা পিসির সম্পত্তির অর্থ মূল্যের উপর শর্ত নির্ভরশীল। মৌখিক চুক্তির দ্বারা শর্তগুলো নির্ধারিত হবে। আমরা দুজনেই এই চুক্তি করে লাভবান হতে চাই, তাই না? বিশেষ ধরনের বিষম কাজ করার জন্য ব্যয় হয় পাঁচশো টাকার এক টাকা এই অনুপাতে। 

—পাঁচশো টাকার এক টাকা অনুপাত? এত বেশি কঠিন শর্ত। 

—আমার শর্ত একটু বেশি কঠিন। এলিজা পিসির মৃত্যু যদি আসন্ন হতো তাহলে আপনি তা ভালোভাবে জানতেন, আমার কাছে আসতেন না। দু সপ্তাহের মধ্যে মৃত্যু হবে এমন ঘোষণা করা খুবই কঠিন কাজ। তাই পাঁচ হাজার পাউণ্ডের অনুপাত এক হাজার পাউণ্ড দাবি কিছুতেই অস্বাভাবিক হতে পারে না। 

ধরুন, আপনি হেরে গেলেন, তাহলে? 

—সেটা হবে আমার পক্ষে খারাপ। তবে বাজীর টাকা শোধ করে দেবো। 

—আর আমি যদি হারি, তবে আমিও বাজীর টাকা শোধ করবো। ধরুন যদি না দিই?

মিস্টার ব্রাডলি চেয়ারে হেলান দিয়ে আধ বোঁজা চোখে নরম গলায় বললো- 

সে রকম করার পরামর্শ আপনাকে দিচ্ছি না, আমি সত্যিই দেবো না সে পরামর্শ।

লোকটার মৃদু কণ্ঠস্বর—কিন্তু আমার দেহে ভয়ের শিহরণ কিলবিল করে উঠলো।

অথচ সে সরাসরি আমাকে ভয় দেখায়নি। ভয়ের সঞ্চার ছিলো। 

উঠে দাঁড়িয়ে বললাম—আমি একবার ভেবে দেখি, মিস্টার ব্রাডলির শান্ত কণ্ঠস্বর, অচঞ্চল বাকচাতুরি—নিশ্চয় ভেবে দেখবেন। 

কোনো কাজ তাড়াহুড়ো করে করবেন না। কাজটা যদি করবেন বলে ঠিক করেন ফিরে আসবেন। তখন আমরা সব কিছু নিয়ে আলোচনা করবো। সংসারে তাড়াহুড়ো করা নিরর্থক। সময় নিন। চলে এলাম। শুনছিলাম তখনও ওর শেষ কথাগুলোর প্রতিধ্বনি…। 

—সময় নিন…।