দি পেল হর্স – ১৮

অষ্টাদশ অধ্যায় 

—আচ্ছা, ঘটনাটা কি ঘটলো? ব্রেকফাস্টের টেবিলে রোডা সোৎসাহে জানতে চাইলো। 

—ওহো, সেই একই রকম। শান্তভাবে জবাব দিলাম। 

ডেসপার্ড আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। অনুভূতি সক্ষম একজন মানুষ শুধালো—নানা আকারের জিনিস কি নামানো হয়েছিলো মেঝের উপর? 

—অনেকগুলো। 

—কোনো শাদা মোরগ? 

—স্বাভাবিকভাবেই। মজা আর খেলার এই অংশে অভিনয় করেছে বেল্লা। 

—এবং সম্মোহন এবং অন্যান্য বস্তু? 

—তুমি যা বলছো, সেই সম্মোহনের ঘটনা ঘটলে, রোডা শুধালো—তুমি কি একটু অভিভূত হয়েছো? 

ধীরে ধীরে জবাব দিলাম অন্য দিক দিয়ে জঘন্য ভাবে, ডেসপার্ড মাথা নেড়ে বললো—কোনো লোক সত্য সত্যই এত বিশ্বাস করতে পারে না। বিচারশীল মনে বিশ্বাস করাও যায় না—কিন্তু এসব ঘটনার একটা প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। পূর্ব-আফ্রিকায় এসব অনেক ঘটতে দেখেছি। ওখানকার মানুষজনদের উপর ডাইনি ওঝাদের দারুণ প্রভাব—এবং লোকে স্বীকার করে যে, আজব ঘটনা এখনও ঘটে যা বুদ্ধিতে বিচার করা যায় না। 

—মৃত্যুর কথা বলছো? 

—হাঁ। যদি কোনো লোক জানতে পারে যে তাকে বেছে নেওয়া হয়েছে তাহলে সে মারা যায়। 

—মনে হয়, ইঙ্গিত দেওয়ার ক্ষমতা। 

—খুব সম্ভব তাই। 

—কিন্তু তাতে তুমি খুশি হওনি, তাই না? 

—না, ঠিক তা নয়। এমন অনেক ঘটনা ঘটে যা আমাদের বাকপটু পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক তথ্য দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। আমাদের ইউরোপে এসব ঘটনা সাধারণত ঘটে না। তবে কারো শোণিতে যদি একবার এই বিশ্বাস মিশে যায়। তবে তার রেশ থেকে যাবেই। 

একটা ছোট্ট ঘরে টেলিফোন রয়েছে। 

আমি টেলিফোনটা তুলে লন্ডনে জিনজারকে ফোন করার চেষ্টা করলাম। অনেকক্ষণ পরে ওপার থেকে ওর কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হলো? 

—কে? জিনজার? 

—তুমি ইস্টারব্রুক বলছো? কি ঘটলো? 

—তুমি নিজে ভালো আছো তো? 

—নিশ্চয় ভালো আছি। আর থাকবো নাই বা কেন? 

একটা সোয়াস্তির নিঃশ্বাস আমার বুক থেকে বেরিয়ে এল। জিনজারের তাহলে কোনো ক্ষতি হয়নি। ওর সেই বেপরোয়া আচরণ বুঝতে পেরে আমার মন থেকে ভয়ে উবে গেলো। কি করে বিশ্বাস করেছিলাম যে, জিনজারের মতন একজন রমণীকে এসব উলটো পালটা পাগলের কাণ্ড কারখানা আঘাত করবে? 

এবার জিনজার শুধালো—তুমি সুস্থ আছো তাই না? 

—সুস্থ আছি বলে কি বোঝাতে চাইছো? যখন কথা শুরু করেছিলো তখন সুস্থ ছিলো না, এখন হয়েছো। আচ্ছা, এর পর আমরা কি করবো? আরো দু এক সপ্তাহ কি আমাকে থাকতে হবে? শুধালো জিনজার। 

মিস্টার ব্রাডলির কাছ থেকে একশ পাউণ্ড জিততে হলে তোমাকে থাকতে হবে। 

—তুমি কি এখনো রোডার কাছে আছো? 

—আরো কয়েকদিন আছি। তারপর বোর্নমাউথে চলে যাব। তুমি রোজ একবার আমাকে ফোন করবে। অবশ্য আমিও ফোন করার চেষ্টা করবো। আচ্ছা এর মধ্যে কোনো সন্দেহভাজন লোক তোমার ওখানে গিয়েছিলো? 

—এমন লোকেরা এসেছিলো যাদের আশা করা যায়। এই যেমন ধরো দুধওয়ালা গ্যাসের মিস্ত্রি। আর একজন আমি কি কি ওষুধ আর প্রসাধন দ্রব্য ব্যবহার করি, একজন এসেছিলো নিউক্লিয়ার বোমা বিরোধী আবেদন পত্রে সই করাতে, একজন চাইতে এসেছিল অন্ধদের জন্য চাঁদা। জবাব দিলো জিনজার। 

—এদের কেউ ক্ষতি করার মতন লোক নয়। বললাম। 

জিনজার বললো—আর একজন আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি ডাক্তার করিগ্যান। 

—বোধ হয় ইনসপেক্টর লেজুন তাকে পাঠিয়েছিলো। টেলিফোন ছেড়ে দিলাম। মনে খানিকটা সোয়াস্তি পেলাম। 

পরের দিন লাঞ্চের পর সাধানজার লেনে হাজির হলাম। ভাবলাম একবার মিস্টার ভেনবলসের সঙ্গে দেখা করলে হয় না! যদি এ সময় ওর সাথে দেখা করতে যাই তবে কারো কোনো সন্দেহ হবে না। কেননা রোডার সঙ্গে ওর বাড়িতে গিয়েছিলাম। একটা রহস্য জড়িয়ে ভেনবলসের সঙ্গে। প্রথম থেকেই ওর সম্পর্কে আমার এই ধারণা। অসাধারণ বুদ্ধিমান লোক। লোকটাকে বোঝাতে গেলে বলতে হয় লুণ্ঠনকারী, ঘাতক। নিজে সে হত্যা করে না ঠিকই তবে হত্যা সংগঠিত করতে পারে ইচ্ছা মতন। তাই আমার ধারণা ভেনবলস এই ব্যাপারে জড়িত থাকতে পারে। তাই ভেনবলসের বাড়িতে হাজির হলাম। 

চাকা লাগানো চেয়ারে বসা ভেনবলস আমাকে দেখে দারুণ খুশি হলো। বললো—রোডা ফোন করে বলছিলা যে, আর একদিন আপনারা সবাই আমার বাড়িতে ডিনার খেতে আসবেন। 

—দেখুন, আমি আজ এসেছি আপনার মোঘল আমলের সংগৃহীত ঐতিহাসিক বস্তুগুলো ভালোভাবে দেখবো বলে। সেদিন সবগুলো দেখতে পারিনি। বললাম। 

আমার জীবনে রয়েছে অখণ্ড অবসর তাই মনে মনে চিন্তা করি রমণীর বস্তুসমূহ। সারা বিশ্বের মৌলিক আর কৃত্রিম বস্তু সমূহ কল্পনা করি। দেশ বিদেশ ঘুরে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখবার সৌভাগ্য থেকে আমি বেশ কয়েক বছর ধরে বঞ্চিত তাই সারা বিশ্ব থেকে নানা ধাতু সংগ্রহ করে নিজের বাড়িতে এনেছি। 

—কিন্তু এ সব সংগ্রহ করতে হলে তো অৰ্থ চাই। 

—হাঁ চাই। যার প্রয়োজন সে তার পথ নিজেই খুঁজে নেবে। সারা বিশ্বের অবস্থা বদলে যাচ্ছে। চিন্তিত মনে শুধালাম—বিশ্ব বদলে যাচ্ছে।

—নতুন নতুন পথ উন্মুক্ত হচ্ছে। 

ক্ষমা চেয়ে বললাম—আপনি মনে হয় জানেন না যে, এমন লোকজন লোকের সাথে কথা বলছেন যার মুখ ফেরানো উল্টো দিকে—অতীতের দিকে—ভবিষ্যতের দিকে নয়। 

ভেনবলস কাঁধ নাচিয়ে বললো—ভবিষ্যৎ? কে ভবিষ্যতের কথা আগাম বলতে পারে? আমি কেবল বলি বর্তমানের কথা—এখনকার কথা বলি এই মুহূর্তের কথা, আর কোনো কথা বলি না। নতুন নতুন যন্ত্রের আবিষ্কার হয়েছে। এমন যন্ত্রের আবিষ্কার হয়েছে যা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে প্রশ্নের জবাব দিতে পারে—অথচ এই জবাব দিতে মানুষকে বহু ঘণ্টা বা বহু দিনের শ্রম প্রয়োজন হয়। 

—কমপিউটার? ইলেকট্রনিক ব্রেনের কথা বলছেন? তাহলে কি লোকজনদের স্থান গ্রহণ করবে যন্ত্র অবশেষে? শুধালাম। 

—একালে লোক হচ্ছে মানব শক্তির একক। কিন্তু একক মানুষ, না। নিয়ন্ত্রক হিসাবে থাকবে মানুষ চিন্তাবিদ হবে মানুষ—আর তারই প্রশ্ন তৈরি করবে যন্ত্রের কাছ থেকে জবাব পাওয়ার জন্য। 

আমার মনে সন্দেহ। মাথা দুলিয়ে তাই বললাম স্বল্প শ্লেষ মেশানো কণ্ঠে—মানব, না অতি মানব কোনোটা? 

—কেন নয় ইস্টারব্রুক? কেন নয়? মনে রেখো আমরা জানি অথবা জানতে শুরু করেছি মানুষ জানোয়ার সম্পর্কে কিছু কিছু কথা। এই যে মস্তিষ্ক ধোলাইয়ের কথা শোনা যায় তা এখন খোলাখুলি মানুষ জনকে কৌতূহলী করে তুলেছে—মস্তিষ্ক ধোলাই করার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কেবল মানুষের দেহ নয়। মানুষের মনও কয়েকটা উত্তেজকের সংস্পর্শে সাড়া দেয়। 

—এ-ত ভয়ঙ্কর মতবাদ। বললাম, রোগীদের কাছে বিপদজনক। 

—সারা জীবনই ত বিপদজনক। ইস্টারব্রুক, আমরা ভুলে যাই যে, সভ্যতার একটা ছোট্ট গণ্ডীর মধ্যে আমরা লালিত পালিত হয়েছি। সভ্যতার এটাই হচ্ছে মূল কথা। ছোট ছোট গম্ভীর মানুষরা এক এক জায়গায় জমায়েত হয়েছে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। তারাই প্রকৃতিকে পরাস্ত করতে এবং একে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। তারা অরণ্যকে পরাজিত করেছে—কিন্তু সে জয় সাময়িক কালের জন্য। যে কোনো মুহূর্তে অরণ্য আবার নিয়ন্ত্রক হবে। অতীতকালের পর্বের নগরগুলো আজ মাটির ঢিবিতে পরিণত। গভীর জঙ্গলে সেই সব নগরের ধ্বংসস্তূপ এখন ঢাকা। তাই কখনও ভুলে যাবেন না, জীবন সব সময় বিপদজনক। 

ভেনবলসকে লজ্জিত দেখালো। বললো—আমি একটু বাড়িয়ে বলেছিলাম। 

আমি বুঝতে পারলাম ভেনবলস লজ্জিত হয়েছে বেশি কথা বলার জন্য। সে একা থাকে, তাই স্বাভাবিকভাবে তার সাথে কেউ কথা বলতে এলে খুশি হয়। তার কথা বলার প্রয়োজন হয়, অনেক কথা বলার ফাঁকে অনেক কিছু বাড়িয়ে বলে। তাই ওকে খোঁচা দিয়ে বললাম—মানুষই অতি মানব। আপনার এই তত্ত্ব সম্বন্ধে আধুনিক ব্যাখ্যা আমার কাছে বলেছিলেন। 

—এতে নতুনত্ব কিছু নেই। অতি মানবের তত্ত্ব বহু প্রাচীন। সমস্ত দর্শন শাস্ত্রের এটাই ভিত্তিভূমি। 

ভেনবলসের মুখে হাসির ছোঁওয়া। বললো—আমার এই ভূমিকার জন্য কি আমাকে দোষী ভাবছেন মিস্টার ইস্টারব্রুক? বাস্তবিক আমি সেটাই করি। আমার মতন দেহের এই অবস্থার জন্য এটাই ক্ষতিপূরণের পথ। হাঁটুর উপর ছড়িয়ে রাখা কম্বলে সে হাতের চাপড় মারলো। তার গলায় বিরক্তির সুর। 

বললাম—আপনাকে আমি কোনোও সমবেদনা জানাতে পারছি না। শুধু এইটুকু বলছি, যে লোক অভাবিত ধ্বংসকে সাফল্যে পরিণত করতে পারে সে লোক ঠিক আপনার মতনই মানুষ। 

—অবাক হয়ে ভাবছি কিসের জন্য আপনি একথা বলছেন? এই সব জিনিসপত্র দেখেই কি একথা বলছেন? হাত দিয়ে ঘরে সাজানো জিনিসগুলো দেখিয়ে ভেনবলস শুধালো। 

—আপনি যে ধনী তার প্রমাণ এগুলো। এগুলো আপনার পছন্দের আর রুচিরও পরিচয় দিচ্ছে। এসব বস্তু আপনি সংগ্রহ করেছেন ঠিকই তবে তার জন্য কায়িক পরিশ্রম আপনাকে করতে হয়নি। আপনি নিজেই সে কথা বলেছেন। 

—আমার কথা। বোকারাই পরিশ্রম করে। আসলে যে কোনো কাজ করার জন্য নিখুঁত মতলব ভাবতে হয়। তারপর সেই মতলব মতন কাজ করিয়ে নিতে হয়। এটাই হচ্ছে সহজ পদ্ধতি। 

অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। সরল কোনো কিছু অবাঞ্ছিত মানুষদের খতম করার মতন সরল কাজ কি? একাজ করার জন্য হত লোকটি ছাড়া আর কাউকে বিপদগ্রস্ত না করে নিজের প্রয়োজন মেটানো নিজের চাকা লাগানো চেয়ারে বসে চঞ্চ নাসিক ভেনবলস মতলব তৈরি করে আর আত্মতৃপ্ত তার দর্শনীয় কণ্ঠখানিকে পাঠায়। কিন্তু মতলব মতন কর্ম সাধন কে করে? থিরজা গ্রে কি? আমার নজর ভেনবলসের দিকে। সেই অবস্থায় বললাম—এ ধরনের দূর নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির কথা ওই আজব মহিলা মিস গ্রে আমাকে বলেছে। উঠে পড়ে বললাম–এর কোনো কিছুই আমি বিশ্বাস করিনি। তবে খুব মনোযোগ দিয়ে এসব কাজ করে। এবার চলি। বড় দেরি হয়ে গেলো। আমার বোন আমার জন্য ভাববে।