দি পেল হর্স – ১৭

সপ্তদশ অধ্যায় 

—তুমি কি থিরজার ভর দেখতে যাবে নাকি? রোডা জানতে চাইলো। 

—কেন যাবো না? 

—এ ধরনের জিনিস দেখার আগ্রহ তোমার আছে তা কখনো আমি ভাবিনি মার্ক।

— আমি ঠিক সত্যিকারের আগ্রহী নই। কিন্তু ওই তিন মহিলা কি আজব কাজকর্ম করে সেটাই আমি দেখতে চাই। বললাম। 

আলোচনাটা হালকাভাবে উড়িয়ে দেবো ভেবেছিলাম কিন্তু সম্ভব হলো না। বাঁকা চোখে দেখলাম হাপু ডেসপার্ড চিন্তিত মুখে আমার দিকে তাকিয়েছিলো। লোকটি খুব ধূর্ত আর দুঃসাহসিক জীবনে অভ্যস্ত। বিপদের অনুমান করতে তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় খুবই তীক্ষ্ণ হলো। মনে হলো, লোকটা বিপদের আঁচ পেলো, কৌতূহল নয়, এর সঙ্গে নিশ্চয় আরো কিছু জড়িত। 

—তাহলে আমি তোমার সাথে যাবো, মার্ক। আনন্দিত কণ্ঠে বললো রোডা, সব সময় ওখানে যাওয়ার ইচ্ছে হয় আমার। 

—না, এ ধরনের কোনো কিছু করবে না, রোডা। গর্জন করলো ডেসপার্ড। 

—কিন্তু এসব মৃত আত্মাকে আমি একটুও বিশ্বাস করি না। তুমি তো জানো, শুধু তামাসা দেখার জন্য যাচ্ছি। বললো রোডা। 

ডেসপার্ড বললে—এধরনের কাজকর্ম কিন্তু তামাসা নয়। এর মধ্যে সত্যও কিছু আছে কিন্তু যারা কেবল কৌতূহল দেখতে ওখানে যায় তাদের উপর এই কাজকর্ম প্রভাব বিস্তার করে। 

তাহলে মার্ককেও বোঝাও যাতে না যায় ওখানে। 

মার্কের দায়িত্ব ভার তো আমার উপর নেই। 

বিরক্ত হলেও নিজের মন থেকে বিরক্তি দূর করে রোডা আমার সঙ্গে হাজির হলো পেল হর্সে। 

সে দিনই এক প্রহর বেলায় গ্রাসের পথে থিরজা গ্রের সাথে সহসা দেখা হলো।

আমার সঙ্গে ছিল রোডা। 

থিরজা গ্রে কলকণ্ঠে বলে উঠলো—মিস্টার ইস্টারব্রুক। আজ সন্ধ্যায় আপনাকে আমাদের বাড়িতে আশা করছি। আপনাকে একটা দারুণ দৃশ্য দেখাবো। সিবিলের উপর আশ্চর্যজনক কিছু ভর হয়। তাই তার মুখ থেকে কি কথা শোনা যাবে তা আগে থেকে কেউ কল্পনা করতেও পারে না। তাই বলছি আপনি এতে হতাশ হবেন না। খোলা মনে আসবেন। সৎ অনুসন্ধানকারীকে আসার জন্য আমি সাদর আহ্বান জানাই। কিন্তু কৌতুকপ্রিয় চটুল দর্শক আসুক তা চাই না। তাতে ঘটনা মন্দ পথ নেয়। 

রোডা বলে উঠলো – আমিও তো আসতে চাই। কিন্তু ডেসপার্ড এসব ব্যাপারে দারুণ বিরোধী। 

—যা হোক, আপনাকে আমি আসতে বলছি না। বাইরের একজন লোক এলেই যথেষ্ট হবে। তারপর আমার দিকে ফিরে থিরজা গ্রে বললো—আমাদের বাড়িতে যদি আসেন তবে আমাদের সঙ্গেই হালকা কিছু খাবার খেয়ে নেবেন। ভোর হওয়ার আগে আমরা কখনও ভরপেট খাই না। আপনাকে আমরা আজ সন্ধ্যেবেলা আশা করছি, মিস্টার ইস্টারব্রুক। বলা শেষ করে ঘাড় নুইয়ে অভিবাদন জানালো থিরজা। এবং লঘুপদে হেঁটে চলে গেলো। 

ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার সন্দেহগ্রস্ত মন এমনই অভিভূত হয়ে গিয়েছিল যে রোডা কি বলছিলো তা আমার কানেই ঢোকেনি—এখন চমক ভাঙতে রোডাকে শুধালাম—কি বলেছিলে যেন? 

—এখানে আসার পর থেকে তোমাকে যেন কেমন আজব আনমনা মনে হচ্ছে। কি হয়েছে বলো তো? বই লেখায় খুব মন দিয়েছো, তাই না? 

—বই? হ্যাঁ,অল্প বিস্তর ওতেই ব্যস্ত। জবাব দিলাম। 

এবার রোডা মন্তব্য করল সরস কণ্ঠে—মনে হচ্ছে তুমি প্রেমে পড়েছো। প্রেমে পড়লে পুরুষদের অল্প বিস্তর বুদ্ধি লোপ হয়। কিন্তু নারীদের বেলায় ঠিক উল্টোটাই ঘটে; বুদ্ধি উজ্জ্বল হয় এবং রূপ লাবণ্য দ্বিগুণ বেড়ে যায়। তাই মজার ব্যাপার হলো প্রেম নারীকে মহীয়ান করে আর প্রেমে পড়লে পুরুষ অসুস্থ মেষশাবক বনে যায়। 

একটু রেগে মেগে বললাম -ধন্যবাদ। 

—আমার উপর রাগ করো না, মার্ক। মেয়েটা সত্যিই সুন্দরী। 

—কে সুন্দরী? 

—কেন? হারসিয়া রেডক্লিফ। সে সত্যিই তোমার উপযুক্ত। ও সুদর্শনা এবং চালাক চতুর।

এই মুহর্তে ওর প্রস্তাব আমি ভাবতে পারছি না। তাই কোনো জবাব দিলো না। গির্জার পাদরির বাড়িতে আসা যেন নিজের বাড়ি ঘোরা। 

****

সদরটা খোলা। আমাদের সাদর আহ্বান জানাচ্ছে যেন। বাড়ির সিঁড়িতে পা রাখতেই। মনে হলো আমার কাঁধ থেকে একটা বোঝা নেমে গেল। 

দর দালানের গাছ দুয়ার দিয়ে ভিতরে ঢুকলেন মিসে ডেন ক্যালথ্রপ। হাতে একটা বড় সবুজ রঙের প্লাস্টিকের ঝুড়ি। আমাকে দেখে মিসেস ক্যালথ্রপ বললেন—একি তুমি এসেছো। ভালোই হয়েছে। ঝুড়িটা ধরো। 

ঝুড়িটা নিয়ে মিসেস ক্যালগ্রুপের সাথে সেই ছায়া ঢাকা ঘরে ঢুকলাম। তিনি ফায়ার প্লেসের আগুন উসকে দিয়ে খান কয়েক কাঠ গুঁজে দিলেন আগুনে। একখানা চেয়ারে আমাকে বসতে বলে শুধোলেন—কি করলে? 

তাঁর উত্তেজিত আচরণ আমাকে মুখর করলো। বললাম একটা কিছু আমাকে করতে বলেছিলেন। আমি কিছু করতেই সচেষ্ট। 

—খুব ভালো কথা। কি করছো? 

সব কিছু তাঁকে খুলে বললাম। 

মিসেস ক্যালথ্রপ চিন্তিত মনে শুধালেন—আজ রাতেই? 

—হাঁ। 

মিনিট খানেক নীরবে ভাবতে লাগলেন মিসেস ক্যালথ্রপ। 

নিজেকে সাহায্য করতে অক্ষম। সহসা সজোরে বলে উঠলাম—একাজ আমি করতে চাইনি। একেবারেই করতে চাইনি। 

—কেন তুমি তা চাইবে? 

জবাব দিতে পারলাম না বেশ কিছুক্ষণ। শেষে ভীত কণ্ঠে বললাম—জিনজারের জন্য বড় ভয় হচ্ছে। তাঁর সদয় দু আঁখির দৃষ্টি আমার মুখের উপর নিশ্চল। 

বললাম—জানেন না কি সাহসী মেয়ে সে। যদি তারা ওর কোনো ক্ষতি করে…। 

ধীর কণ্ঠে বললেন মিসেস ক্যালথ্রপ–তুমি যা বলছো তা শুনে বুঝতে পারছি না, কিভাবে ওরা তার ক্ষতি করবে। 

—ওরাও অন্যদের ক্ষতি করেছে। বললাম। 

—তাই তো মনের ইচ্ছে… মিসেস ক্যালথ্রপকে অসন্তুষ্ট মনে হলো। 

—অন্য দিক দিয়ে বিচার করলে, জিনজার ভালো থাকবে। চিন্ত্যনীয় সব রকম সাবধানতা নেওয়া হয়েছে। তার কোনো দৈহিক ক্ষতি ঘটাতে পারবে না। 

—কিন্তু এই লোকগুলোও দাবি করে থাকে যে, তারা দৈহিক ক্ষতি করতে সক্ষম ওরা বলে, মানসিক আঘাতের মাধ্যমে তারা দৈহিক ক্ষতি সাধন করে। 

ওরা যদি সত্যিই তা করতে সক্ষম হয় তবে তা হবে একটা আশ্চর্য জনক ঘটনা। এ এক দুঃস্বপ্নকর ঘটনা। আমরাও একমত হয়েছি একাজ বন্ধ করতেই হবে। 

—কিন্তু বিপদের ঝুঁকি সে নিজেই নিচ্ছে, ধীরে ধীরে বললাম। 

—কাউকে বিপদের ঝুঁকি নিতেই হবে। এর ফলে তোমার অহঙ্কারে আঘাত লাগে—আমার যেন এমন বিপদ না হয় এটাই তুমি ভাবতে থাকো। এ ঝুঁকি তোমায় নিতে হবে। জিনজার যে ভূমিকায় অভিনয় করছে তার জন্য সে অত্যন্ত উপযুক্ত। জিনজার বুদ্ধিমতী। তার জন্য তোমার উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার নেই। 

—ওকথা ভেবে আমি উদ্বিগ্ন হচ্ছি না। 

—ঠিক আছে। উদ্বিগ্ন হয়ে তুমি তার কোনো ভালো করতে পারবে না। এই সমস্যা ছেড়ে সরে থাকা আমাদের উচিৎ হবে না। এই পরীক্ষা করতে গিয়ে যদি জিনজারের মৃত্যু হয় তবে সে মৃত্যু হবে একটা ভালো কাজ করতে গিয়ে 

—আপনি বড় নিষ্ঠুর। বললাম। 

মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ বললেন—কাউকে না কাউকে নিষ্ঠুর হতেই হবে। সব সময় মন্দ ঘটবে এটাই মনে করতে হবে, তুমি জানো না মনে এ ধরনের ভাবনা সৃষ্টি করতে পারলে উৎসাহ বর্ধিত হয়। যে কাজ করবে বলে ঠিক করছো তা শুরু করে দাও, দেখবে যতটা মন্দ ঘটবে ভাবছো তেমন মন্দ কিছু ঘটবে না। 

মন থেকে সন্দেহ না ঘুচলেও বললাম–হয়ত আপনি ঠিকই বলছেন। আচ্ছা আপনার এখানে কি টেলিফোন আছে? 

—হাঁ। আছে। 

—আজ রাতের ঘটনা ঘটবার পর জিনজারের সাথে আমাকে যোগাযোগ রাখতে হবে। রোজই তাকে একবার ফোন করতে হবে। আচ্ছা; এখান থেকে রোজ তাকে ফোন করা যাবে তো? 

—নিশ্চয়ই। রোডার বাড়ি থেকে এত বেশি যাতায়াত করলে লোক জানাজানি হবে নাতো? 

—উপায় নেই। রোডার বাড়িতে এখন আমায় ক-দিন থাকতে হবে। লন্ডনে যাওয়া চলবে না। আজকের রাত…। বলতে বলতে উঠে পড়লাম। 

****

পেল হর্সে আমার উপস্থিতি অতিমাত্রায় সামাজিক হিসাবে গৃহীত হলো। জানি না ঠিক কি ধরনের পরিপ্রেক্ষিতের প্রভাব আশা করা হয়েছিল—কিন্তু যাই হোক এটা সে জিনিস নয়। 

দরজা খুলে দিল গ্রে। তার পরণে সাধারণ কালো পশমের পোশাক। ব্যবসায়ী সুলভ কণ্ঠে বললো—এসে গেছেন। ভালোই হলো। আমরা এক্ষুনি রাতের খাবার খেয়ে নেবো। 

দরদালানে পাতা খাওয়ার টেবিল। খুবই সাধারণ খাবার দাবার। বেল্লা পরিবেশন করছে, পরণে কালো কাপড়ের পোশাক, ইতালির অধিবাসী রমণীর মতন তাকে দেখাচ্ছে। আর ময়ূরকণ্ঠী রঙের লম্বা রুল পোশাক পরেছে সিবিল। পোশাকে সোনালি চুমকি রসানো। তবে ওর গলায় এখন পুঁতির মালা ঝুলছে না। একজোড়া কঙ্কন ওর দু হাতের কব্জিতে পরা। 

খাওয়ার পালা চুকিলে থিরজা গ্রে জানালো এবার ‘ভর’ হবে। সবাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাগানের খামার ঘরে হাজির হলাম। 

এর আগের দিন এই ঘরে আমি এসেছিলাম। দিনের বেলা এটাই থিরজার লাইব্রেরি। কিন্তু এখন রাতের পরিবেশে ঘরখানার চেহারা একদম বদলে গেছে। আড়াল থেকে আলোর ছটা এসে ঘরখানা আলোকিত করে তুলেছে। তবে নরম; মৃদু আলো। ঘরের মাঝামাঝি একটা মঞ্চ—ঠিক যেন একটা ডিভান পাতা। তার ওপর গোলাপি রঙের একখানা চাদর বিছানো। তার ওপর নানা ধরনের চিহ্ন আঁকা। ঘরের এক কোণে জ্বলন্ত কয়লা রাখার পাত্র আর পাশেই একটা পুরনো আমলের বেসিন। 

ঘরের অন্য দিকে একখানা চেয়ার। 

আমি ওর কথা মতন শান্ত ভাবে বসলাম। 

থিরজার আচরণ এখন বদলে গেছে। কিন্তু কিভাবে বদলেছে তা বুঝতে পারছি না। সিবিলের মেকি ভোজ বিদ্যার কোনো পরিচয় পাচ্ছি না। এ যেন আচরণ সরানো দৈনন্দিন জীবন যাপনের দৃশ্য। ও যেন এক সাধারণ স্ত্রীলোক—এগিয়ে চলেছে অস্ত্রপ্রচারের জন্য নির্দিষ্ট টেবিলের দিকে একজন শল্য চিকিৎসকের মতন। সিবিল যখন তাক থেকে একটা লম্বা ঝুল ওভারঅল হাতে নিলো তখনই আমার মনে উত্তেজনা উচ্চগ্রামে পৌঁছালো। আলোয় বুঝতে পারলাম ধাতুর তার দিয়ে বোনা চাদরে ওভার অলটা তৈরি। খুব পাতলা—বুলেট প্রুফ জ্যাকেটের মতন। মুখে বললো থিরজা—সকলকেই প্রয়োজনীয় সাবধান হতে হয়। ওর চেয়ারে আপনি সাবধানে বসে থাকুন। কোনো কারণেই চেয়ার থেকে উঠে পড়বেন না। উঠে পড়া নিরাপদ হবে না। এটা ছেলে খেলা নয়। যে শক্তিগুলোকে নিয়ে আমি কাজ করি তাদের ঠিক মতন চালাতে না পারলে বিপদ ঘটে। আপনাকে যা আনতে বলা হয়েছে তা কি এনেছেন? 

কোনো কথা না বলে পকেট থেকে একটা পাঁশুটে রঙের দস্তানা বার করে ওর হাতে দিলাম। একটা আলোর সামনে দস্তানাটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে থিরজা বললো- ঠিক আছে। যে এটা ব্যবহার করে তার গায়ের গন্ধ রয়েছে। তারপর ঘরের শেষে রাখা রেডিয়োর মতন বাক্সের উপর ওটা রাখলো। বললো—বেল্লা, সিবিল এবার শুরু করো। আমরা তৈরি। মিস্টার ইস্টারব্রুক এখানে রসিকতা করতে আসেননি। 

সিবিল ডিভানের উপর শুয়ে পড়লো। 

থিরজা কয়েকটা আলো নিভিয়ে দিলো। চাকা লাগানো ফ্রেমের উপর চাঁদোয়া খাটানো। সেই ফ্রেমটা ডিভানের উপর এমনভাবে স্থাপন করলে যাতে ডিভানটা নরম দাওয়ার নিচে আলো-আঁধারীতে ঢাকা পড়ে। 

—পরিপূর্ণ সম্মোহনের জন্য অত্যন্ত চড়া আলো ক্ষতিকর। মনে কোনো রকম সন্দেহ রাখবেন না, মিস্টার ইস্টারব্রুক। আমরা এখন তো তৈরি বেল্লা, তাই না? 

ছায়ার আড়াল থেকে বেল্লা আমার দিকে এগিয়ে এলো। থিরজা তার ডান হাতে আমার বাঁ হাতে চেপে ধরলো। আর বাঁ হাতে ধরলো বেল্লার ডান হাত। বেল্লার বাঁ হাত জড়ানো আমার ডান হাত। থিরজার হাত খানা শুকনো আর কঠিন। আর বেল্লার হাত ঠান্ডা আর অস্থিহীন নরম। আমার দেহমন বিতৃষ্ণায় কেঁপে উঠলো। 

সহসা সুমধুর সুরের মূর্ছনা ধ্বনিত হলো। মনে হলো সুরের ঝরণা বুঝি ঘরের ছাদ থেকে ঝরে পড়ছে। 

আমার দেহ মন হিম এবং সঙ্কট ভরা তবু ফল্গু স্রোতের মতন এক অবাঞ্ছিত আবেগ ধৰ্মী ঘটনার আশঙ্কা সম্পর্কে আমার মন সচেতন। 

শোকযাত্রার মতন সুরের মূর্ছনা থামলো। কটি মানুষের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ কানে আসছে না। সহসা সিবিল কথা বললো। নারীর কণ্ঠ নয়—এ যেন পুরুষের ভারি কণ্ঠস্বর। উচ্চারণে ভিনদেশী শ্বাসাঘাত। কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হলো—আমি এসেছি এখানে। বেল্লা আমার হাত ছেড়ে ছায়ার নিচে সরে গেলো। থিরজা বললো—সুপ্রভাত। তুমি কি ম্যাকন দল— আমিই ম্যাকন দল। 

ডিভানের কাছে গিয়ে থিরজা চাঁদোয়াটা গুটিয়ে ফেললো। নরম আলো ছড়িয়ে পড়লো সিবিলের মুখে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সিবিল। তার মুখের চেহারাটা গেছে বদলে। মুখের রেখাগুলো এখন আর নজরে পড়ছে না, তাকে মনে হচ্ছে অনেক কম বয়সী। এই মুহূর্তে তাকে যে কেউ বলবে, সে সুন্দরী, সুদর্শনা। 

থিরজা জানতে চাইলো–ম্যাকান দল তুমি কি আমার ইচ্ছা মতন এবং আমার হুকুম মতন কাজ করতে প্রস্তুত? 

গভীর কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হলো—আমি প্রস্তুত। এখানে শায়িত যে দেহটির মধ্যে তুমি এখন অবস্থান করছো সে দেহটিকে দৈহিক ক্ষতি থেকে বাঁচাতে কি তুমি সচেষ্ট হবে? এর জীবনীশক্তি কি আমার উদ্দেশ্যে দান করবে যাতে এর মাধ্যমে আমি আমার উদ্দেশ্য সাধন করতে পারি? 

—দান করবো। 

—এই মৃতকে পাঠাতে হবে মৃত্যু ঘটানোর জন্য। থিরজা এক পা পেছিয়ে এলো। বেল্লা একখানা ক্রুশ বিদ্ধ যীশুর প্রতীক বাড়িয়ে দিলো। থিরজা প্রতীক খানা উল্টো করে রাখলো সিবিলের বুকের উপর। থিরজা একটা শিশি থেকে কয়েক ফোঁটা জল ঢাললো সিবিলের কপালে। জলের চিহ্ন আঁকলো। বুঝতে পারলাম আঁকলো উল্টানো ক্রুশ চিহ্ন। 

এক পা পিছিয়ে এসে থিরজা বললো—সব প্রস্তুত। 

বেল্লা শব্দ দুটো আবার উচ্চারণ করলো—সব প্রস্তুত…। ঘর থেকে চলে গেলো। এবার মৃদু কণ্ঠে আমাকে বলতে লাগলো থিরজা, এই যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান মন্ত্রাদি এগুলোর ব্যবহার কালে কালে বদলে গেছে—এ সব মানুষের মনে প্রভাব বিস্তার করে। কিসে জনতার আবেগ উজ্জীবিত হয়ে ওঠে, তার সঠিক জবাব আমাদের জানা নেই। তবে পুরাকালের এই ধর্মীয় আচরণের অস্তিত্ব আজও রয়েছে। 

বেল্লা আবার খামারে ফিরে এলো। তার হাতে একটা জীবন্ত মোরগ মুক্ত হওয়ার জন্য ছটফট করছে। জ্বলন্ত অঙ্গার পাত্রের চারধারে বেল্লা খড়ি দিয়ে মেঝের উপর নানা ধরনের চিহ্ন আঁকলো। তামার পাত্রের চারধারে আঁকার গোলাকার রেখার ধারে মোরগের ঠোঁট চেপে ধরলো। মৃদু অথচ সুরেলা গলায় মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে আরও প্রতীক আঁকতে লাগলো—ওর মন্ত্রগুলো সবই অবোধ্য। 

আমার উপর থিরজার দৃষ্টি নিবদ্ধ। এক সময় সে বললো–আপনি এসব খুব পছন্দ করছেন না, তাই না? এসব মন্ত্র তন্ত্র খুবই প্রাচীন, একেবারে পুরানো আমলের। এই যে মারণ যজ্ঞ যা পুরাকালের জড়ি বুটি—তা মা মরণকালে যেচে আমার হাতে দিয়ে যায়। থিরজাকে আর আমি বুঝতে পারছি না—তার আচরণ আর আমার মনকে প্রভাবিত করতে পারছে না—তবে বেল্লার ভয়ানক কাজকর্ম আমাকে অভিভূত করছে। 

জ্বলন্ত অঙ্গার পাত্রের উপর হাত বাড়ালো—বেল্লা—আর আগুন লেলিহান শিখায় জ্বলে উঠলো। নিশ্চয় বেল্লা আগুনে কিছু ফেলেছে—পুড়ছে। সুগন্ধ ছড়াচ্ছে ঘরের মধ্যে সেই অজানা ধাতু। 

—আমরা এবার প্রস্তুত। জানালো থিরজা। সেই রেডিও সদৃশ বাক্সটার ঢাকনা খুললো থিরজা। ওটা একটা বৈদ্যুতিক যন্ত্র। তার নিচে চাকা লাগানো। বাক্সটাকে টেনে এনে ডিভানের পাশে রাখলো। ঝুঁকে পড়ে বাক্সের ভিতরের যন্ত্রপাতি ঠিক করলো, আমার দেওয়া দস্তানাটা একটা বেগুনে রঙের আলোর সামনে ধরে বাক্সের ভিতরে রাখা কম্পাস উত্তর পূর্ব…ডিগ্রী। …এবার ঠিক হয়েছে। 

ডিভানের উপর নিশ্চলভাবে শায়িত দেহটাকে উদ্দেশ্য করে আওড়াতে লাগলো – সিবিল ডায়ানা হেলেন তোমার মরণশীল দেহ থেকে তুমি এখন মুক্ত। নিরাপত্তার জন্য তোমার এই দেহ এখন পাহারা দেবে মৃত আত্মা ম্যাকান দল। এই দস্তানার অধিকারিণীর মধ্যে প্রবেশ করার জন্য তোমাকে মুক্ত করা হোল সব মানুষের মতন তার জীবনের লক্ষ্য এখন মৃত্যুর দিকে নিবদ্ধ। মৃত্যু ছাড়া চরম পাওয়ার পরিতৃপ্তি কোনো অস্তিত্ব নেই। কেবল মৃত্যুই সমস্ত সমস্যার সমাধান করে। একমাত্র মৃত্যুই দান করে পরম শাস্তি—প্রকৃত শাস্তি। কথাগুলো বার বার উচ্চারিত হচ্ছে। ধ্বনিত হচ্ছে। প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ওই যন্ত্রের মতন বিশাল বাক্সটা মৃদু গঞ্জন করছে—তার ভিতরে বিজলী বাতিটা জ্বল জ্বল করছে। আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন–বুঝি আমি ভেসে চলেছি। আর তখুনি আমার মনে হলো, যা কিছু ঘটছে তাকে নিয়ে আর আমি রসিকতা করতে পারি না। 

ডিভানে শায়িত আধোমুখ দেহটি এখন পুরোপুরি থিরজার গোলাম—তাই তার মাধ্যমে থিরজার ক্ষমতা প্রকাশিত। একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে সে ওই দেহটির আত্মাকে কাজে লাগাবে। এখন অস্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারছি, কেন, মিসেস অলিভার থিরজাকে নয় সামান্য সিবিলকে ভয় পেয়েছিলেন? সিবিলের একটা স্বাভাবিক ক্ষমতা রয়েছে—এবং এই ক্ষমতার জন্য তার মন অথবা মেধার প্রয়োজন হচ্ছে না। এটা হচ্ছে দৈহিক ক্ষমতা এই ক্ষমতার সাহায্যে সে নিজেকে এই দেহ থেকে মুক্ত করতে সক্ষম। আর সেই মুক্ত আত্মা তখন তার নয়—সেই আত্মার অধিকারিণী থিরজা। সাময়িকভাবে থিরজা তাকে ব্যবহার করছে। 

আচমকা এই বাক্সটা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠলাম। ওটার মাধ্যমে কি শয়তানি গোপনতা হাসিল করা হচ্ছে? এমন কোনো রশ্মি কি ওটার মধ্যে বাস্তবে তৈরি করা সম্ভব যা মানব মনের কোষের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে? প্রভাবিত করতে পারে এক বিশেষ মানব মনকে? 

থিরজা বলতে লাগলো – দুর্বল একটা স্থান…সব সময় একটা দুর্বল স্থান থাকেই… মাংসের গভীর মাংসাশীর মধ্যে…দুর্বলতার মাধ্যমে জন্ম নেয় শক্তি…মৃত্যুর শক্তি এবং শান্তি…মৃত্যুর অভিমুখে— ধীরে ধীরে, স্বাভাবিক ভাবে, মৃত্যুর দিকে—প্রকৃত পথ, স্বাভাবিক পথ। দেহের পেশী সমূহ মনের হুকুম মেনে চলে…তাদের হুকুম করো…তাদের চালাও… মৃত্যুর অভিমুখে…মৃত্যু, বিজয়ী…মৃত্যু…অচিরে….খুব তাড়াতাড়ি মৃত্যু। মৃত্যু। 

তার উচ্চগ্রাম কণ্ঠস্বর এখন উথাল পাতাল ক্রন্দনে পরিণত, এবং বেল্লার দিক থেকে এক ভয়ঙ্কর জান্তব আর্তকণ্ঠের চিৎকার ধ্বনিত হলো। উঠে দাঁড়ালো—বেল্লা, ঝলসে উঠলো, মোরগটার শ্বাসরুদ্ধ ভয়ঙ্কর আর্তনাদ, তামার পাত্রে রক্তের ধারা ঝরে পড়ছে। রক্ত ভরা তামার পাত্রটা হাতে নিয়ে বেল্লা ছুটে আসতে আসতে চিৎকার করতে লাগলো—রক্ত, এই রক্ত, রক্ত। 

যন্ত্রের ভিতর থেকে দস্তানা টেনে বার করলো—থিরজা। বেল্লা দস্তানাটা নিয়ে রক্তের মধ্যে ডুবিয়ে আবার চেঁচিয়ে উঠলো—রক্ত, এই রক্ত, রক্ত। তারপর জ্বলন্ত অন্ধকার পাত্রটার চারধারে ঘুরতে ঘুরতে জ্ঞান হারিয়ে মেঝের উপর লুটিয়ে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রটার গর্জন থামলো —নিশ্চল হল। 

অসুস্থতা বোধ করলাম। মনে হলো মহাশূন্যে আমি ঘুরছি। 

থিরজার কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হলো—সুস্পষ্ট আর সুললিত। 

—পুরাকালের যাদুবিদ্যার সঙ্গে নতুন কালের মেলবন্ধনে। বিশ্বাস ভিত্তিক প্রাচীনকালের সঙ্গে নবীন যুগের বিজ্ঞান সম্মত জ্ঞানের মিলন। একসঙ্গে তাদের অস্তিত্ব বজায় থাকবে…।