মলির দিকে ভৎর্সনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে অনিচ্ছুক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল জিল। তারপর ড্রেসিং গাউনটা গায়ের ওপর জড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল নিচে। মলি সদর দরজা খোলার শব্দ পেল। কার মৃদুকণ্ঠের আওয়াজও কানে ভেসে এল তার। মলি ধৈর্য রাখতে পারল না। আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে উঁকি মারার চেষ্টা করল। জিল একজন অপরিচিত দাঁড়িওলা ভদ্রলোককে গায়ে ওভারকোট খুলতে সাহায্য করছে। ভদ্রলোকের আপাদমস্তক পেঁজা পেঁজা বরফে আপদমস্তক ছেয়ে গেছে। তারপর সেই সঙ্গে তাদের কথাবার্তার দুচারটে শোনা গেল। একটা ঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে ভদ্রলোক বললেন–উফ। কথার সুরে বিদেশী সুরটা কানে লাগলো। তারপর বলল–হাতের সমস্ত আঙুলগুলো অসাড় হয়ে গেছে। ওগুলো আমার যে শরীরের অংশ তা বোঝাই যায় না। পায়ের অবস্থা তার চেয়েও খারাপ। শান বাঁধানো মেঝের ওপর শোনা গেল জোরে জোরে পা ঠোকার শব্দ।
আসুন… ভেতরে আসুন। এই বলে জিল লাইব্রেরী ঘরের দরজাটা খুলে দিল। তারপর বলল, ঘরটা এখনও বেশ গরম আছে। দুঃপাঁচমিনিটের মধ্যেই আপনার জন্য একটা ঘরের বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি। ততক্ষণ এখানে আপনি অপেক্ষা করুন।
বিনীত কণ্ঠে আগন্তুক বলল, আমাকে সত্যিই ভাগ্যবান বলা যায়।
মলির কৌতূহল আরো উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। সিঁড়ির মাথা থেকে দুধাপ নেমে এসে ও এবার জাফরিকাটা রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে অপরিচিত আগন্তুককে ভালোভাবে দেখতে লাগল। বয়স হয়েছে ভদ্রলোকের, গালের দুপাশে কালো চাপদাড়ি। দীর্ঘ, ঘন কালো ভূজোড়া ধনুকের মত বাঁকা। গ্রীক পুরাণে বর্ণিত প্রজ্ঞাবান শয়তানের চেহারার সঙ্গে কোথায় যেন একটা মিল পাওয়া যায়। রগের দুপাশের চুলে অল্প পাক ধরেছে, কিন্তু হাঁটা চলার মধ্যে আছে তারুণ্যের সাবলীল ভঙ্গি।
লাইব্রেরীর দরজাটা টেনে দিয়ে জিল দ্রুত পায়ে সিঁড়ি টপকে উঠে এল ওপরে। মলিও আড়িপাতা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল সোজা হয়ে।
মলি জানতে চাইল–ভদ্রলোকটি কে?
জিল মৃদু হেসে বলল–আমাদের অতিথিশালারই আরেক অতিথি বরফ ঝড়ের ধাক্কায় রাস্তার মাঝখানে গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে ভদ্রলোকের। কোনোরকমে গাড়ি থেকে নেমে এক হাঁটু বরফ পেরিয়ে অন্ধের মত সামনের দিকে এগোচ্ছিলেন, যদি কোনো আশ্রয় খুঁজে পাওয়া যায় এই আশা করে। এমন সময় আমাদের টাঙানো সাইনবোর্ডটা ওনার চোখে পড়ল। প্রথমে উনি ঠিক বিশ্বাস করতে পারেননি। সকাতর অনুনয়ে সাড়া দিয়ে ভগবান যেন এটা মিলিয়ে দিয়েছেন বলে এটা তার মনে হয়।
মলি প্রশ্ন করল, কোথাও কোনো গণ্ডোগোল নেই তো?
জিল বলল–আরে না না। এসব রাতে সিঁদেল চোরেরা রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় না।
মলি বলল–মানে আমি বলতে চাই…একজন বিদেশী তো বটে?
জিল বলল–হ্যাঁ তা ঠিক। নাম বললেন প্যারভিসিনি, তবে ভদ্রলোকের মানিব্যাগটা আমি দেখেছি। মনে হল শুধুমাত্র আমাকে দেখাবার জন্যই ইচ্ছে করে উনি বার করলেন ব্যাগটা পকেট থেকে। করকরে ক্যারেন্সি নোটে ঠাসা। ভদ্রলোককে কোনো ঘরটা দেওয়া যায় বল তো?
মলি বলল–কেন, সবুজ ডিসটেম্পার করা ঘরটাই দাওনা। সবকিছুই আছে সাজানো গোছানো। কেবলমাত্র বিছানাটা পেতে দিলেই হয়।
আমার মনে হয় ভদ্রলোককে গোটা দুয়েক পাজামাও ধার দিতে হবে। কেননা গাড়িতেই আটকে আছে ওনার সব মালপত্র। আমাকে বললেন, কোনোরকমে গাড়ির জানলা দিয়ে তিনিই শুধু নেমে আসতে পেরেছেন।
মলি বিছানার চাদরটা আর বালিশের ওয়াড় আর তোয়ালে আনতে ভেতরে গেল। তারপর দুজনে মিলে আবার দ্রুত হাতে শয্যা তৈরি করতে লাগল।
আকাশের যেরকম অবস্থা তাতে মনে হয় পথঘাট সব চাপা পড়ে যাবে বরফে। এই বরফ কেটে রাস্তা বার করতেও সময় লাগবে অনেক। আমরা দু-চার দিনের জন্য হয়তো বাইরের পারিপার্শ্বিক জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বো। ব্যাপারটা তাহলে খুব মজার হবে তাই না?– সম্পূর্ণ এক নতুন ধরনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা!–জিল বলল।
সন্দেহের সুরে মলি জবাব দিল–আমার বাপু অত কিছু মনে হচ্ছে না, কেবলমাত্র পাউরুটি দিয়ে নানা ধরনের খাবার তৈরি করা যা অসুবিধেজনক…। আচ্ছা জিল, আমার পাউরুটির কেক আর মিষ্টিটা তোমার খেতে খারাপ লাগে না তো?
জিল তাকে ভরসা দিয়ে বলল–কি যে বল! একেবারে অমৃত! অতিথিরা খেলে বর্তে যাবে। তবে রুটিওলা যে কি রকম রুটি দিয়ে গেছে সেটাই প্রধান চিন্তার বিষয়। পথঘাট বরফে ঢেকে গেলে অন্য কোনো রুটিওলাও আসবে না এদিকে।
শুধু রুটিওলা না, মাংসবিক্রেতাকেও তুমি দেখতে পাবে না। না আসবে কোনো পিওন, না আসবে কোনো হকার। এমনকি টেলিফোন যোগাযোগ পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে বিচ্ছিন্ন।
তখন একমাত্র সম্বল হবে রেডিও তারাই আমাদের কাছে কর্তব্যের নির্দেশ পাঠাবে।
তবে একটাই আমাদের ভরসা আছে যে আমাদের জেনারেটার আছে। জেনারেটারের সাহায্যেই আমরা নিজেদের ইলেকট্রিক লাইনগুলো চালু করতে পারব।
কাল সকালে উঠে প্রথমেই আমাদের জেনারেটারটা প্রস্তুত রাখা দরকার। তাছাড়া কয়লা ভর্তি করতে হবে চুল্লীটাতে।
তবে আমার বিশ্বাস আগামী দুচার দিনের মধ্যে নুতন করে কয়লা পাবার কোনোও সম্ভাবনা নেই। মজুত কমে যায়নি তো?
চারদিকে এখন উপস্থিত হচ্ছে নানা ঝামেলা। কি যে শুরু হল এই দুর্যোগ…। তাড়াতাড়ি কর জিল, এই ভদ্রলোক কি যেন নাম তার প্যারা-না কি তাকে ডেকে আন। আর আমি দাঁড়াতে পারব না। ঘুম পাচ্ছে। মলি বলল কথাগুলো।
জিলের আশঙ্কা যে ভুল নয় তার প্রমাণ পাওয়া গেল রাস্তার ওপর পাঁচ ফুট বরফ জমে আছে। অনেক ক্ষেত্রে দুঃসাধ্য বাপার হল জানলা দরজা খোলা। তুষারপাতের কোনো থামার চিহ্ন নেই ঝরছে তো ঝরছেই। সারা পৃথিবীটাই এখন নিরাবরণ বিধবার মতো সাদা পোষাকের মত জড়ানো। তার বুকের মধ্যে নিঃশব্দ মৃত্যুর হিমেল বিস্তার!
মিসেস বয়েল সকালের প্রাতঃকালীন খাবারে ব্যস্ত ছিলেন। এই মুহূর্তে ডাইনিংরুমে উপস্থিত ছিল না কেউই। পাশের টেবিলটা মেজর মেটকাফের জন্য ছিল নির্দিষ্ট। তিনি কিছু আগেই প্রাতঃরাশ সেরে উঠে গেছেন। তার ব্যবহৃত কাপপ্লেটগুলো পরিষ্কার করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মিঃ রেনের টেবিলটা সাজানো গোছানো আছে অবশ্য। কিন্তু ভদ্রলোকের এখনো দেখা পাওয়া যায়নি। একজন নিশ্চয় খুব সকালেই বিছানা ছেড়ে উঠে গেছেন। আরেকজনের সূর্য মাথার ওপর না উঠলে তার ঘুমই ভাঙে না। কিন্তু মিসেস বয়েল জানেন একটিমাত্র সঠিক সময় আছে প্রাতঃরাশের জন্য। সেই সময়টা হচ্ছে সকাল নটা।
মিসেস বয়েল এসব ভাবতে ভাবতেই সুস্বাদু ওমলেটটা শেষ করলেন। দুপাটি মজবুত শক্ত দাঁতের সাহায্যে শেষ করলেন হাতে গরম টোস্টগুলোও। তার মনে একটা রাগ রাগ ভাব ফুটে উঠছে। অভিযোগ করার মত কিছু খুঁজে না পাওয়ায় তার মধ্যে একটা আছে বিচলিত ভাব। মঙ্কসওয়েল ম্যানরকে যেমনটি হবে বলে তিনি ভেবেছিলেন, এসে দেখলেন তার ভাবনার সঙ্গে ওনার কোনো মিলই নেই। তিনি ভেবেছিলেন যে যেখানে হয়ত প্রত্যেকদিন তাস খেলার আসর বসে। কয়েকজন বর্ষিয়সী রমণীরও দেখা পাবেন বলে তার ধারণা ছিল। তাদের কাছে তিনি আড়ম্বর সহকারে তার সামাজিক খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠার গল্প করতে পারবেন। কত গণ্যমান্য উচ্চপদস্থ ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তার। সেকথা সকলের মনে শুনিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। এছারা সামরিক দপ্তরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যে তার নখদর্পণে সে কথাও শুনিয়েছেন তিনি।
যুদ্ধ পরিসমাপ্তি তার মনে এক নিঃসঙ্গতা এনে দিয়েছে। তিনি যেন এক নির্জন দ্বীপে পরিত্যক্ত কোনো নাবিক। যুদ্ধ চলাকালীন তিনি ছিলেন একজন কর্মব্যস্ত মহিলা। চারদিকে তার হাঁকডাকে তটস্থ হয়ে থাকত। সমস্ত অফিসটাই সেই মেজাজের ভারে থরথর করে কাপতো? তার চেয়ে উচচপদস্থ কর্তাব্যক্তি এই মহিলাটিকে ভয় পেতেন বিশেষভাবে। আর অধীনস্ত কর্মচারীরা তার সামনে পড়ে গেলে ভয় পেয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করত। এমনকি প্রকৃতই তার কোনো সাংগঠনিক ক্ষমতা আছে কিনা সে বিষয়ে কেউ মাপার সাহস করত না। কিন্তু এই উত্তেজনার মধ্যে বছরগুলো কেমন করেশেষ হয়ে গেছে। তিনি আবার কর্মস্থল থেকে সরে এসে ব্যক্তিজীবনে ফিরে এসেছেন। যুদ্ধের আগে তার যে নিজস্ব ব্যক্তিগত জীবন ছিল এখন যেন তার কোনো অস্তিত্বই নেই। এতদিন মিলিটারিরা তার বাড়িটা দখল করে রেখেছিল। সম্পূর্ণ না সারিয়ে নিলে তার মধ্যে বাস করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
তার যে সব পুর্বপরিচিত বন্ধুবান্ধব ছিল তারা প্রায় কে কোথায় রয়েছে তার ঠিক নেই। অবশ্য নতুন পাড়াপড়শিরাও ঠিকই খুঁজে যোগাড় করে নেবেন, তবে তার জন্যও কিছুটা সময় চাই! সেইজন্য কোনো হোটেল বা বোর্ডিং হাউসই সব সমস্যার সমাধান বলে আপাততঃ মনে হয়। এই সব ভেবেই মঙ্কসওয়েল ম্যানরকে তিনি নির্বাচিত করেছিলেন।
মিসেস বয়েল রাগতদৃষ্টিতে চারপাশে দেখলেন। বিড় বিড় করে মনে মনে বললেন, খুবই অসাধুতার পরিচয়। এরা যে সবেমাত্র শুরু করতে যাচ্ছে, সে কথাটা আগে আমাকে জানানো উচিত ছিল।
তিনি হাত দিয়ে ডিসটা একটু দূরে ঠেলে দিলেন। প্রাতঃরাশের প্রতিটি খাবার যে সুস্বাদু এবং সুপরিবেশিত এইজন্যেই তার রাগটা একটু বেশি। বিশেষ করে কমলালেবুর মোরব্বা এবং কফি, দুটোই প্রসংসার যোগ্য। মিসেস বয়েলের মনে হল, অভিযোগ জানাবার ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে অন্যায়ভাবে তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এমনকি তার বিছানাটাও পরিপাটি করে গোছানো। ওপরের চাদরটারও চারদিকে নক্সা করা। মাথার বালিশটাও ছিল খুব নরম এবং মোলায়েম। মিসেস বয়েল এই ধরনের আরাম ও সুখস্বাচ্ছন্দ্য পছন্দ করেন। কিন্তু অন্যের কাজের খুঁত ধরাটাও ছিল তার বিলাসের অঙ্গ। আর দুটোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে দ্বিতীয়টির প্রতি তার বেশি আসক্তি।
সম্রাজ্ঞীর মত মহিমান্বিত ভঙ্গিমায় চেয়ার ছেড়ে উঠে তিনি দাঁড়ালেন। তারপর ডাইনিংরুম পেরিয়ে পা দিলেন বারান্দায়। লাল-চুল বিশিষ্ট অস্বাভাবিক স্বভাবের যুবকটির সঙ্গে তার মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল। যুবকটির গলায় ঝুলছে এক পশমের টাই। কি-ই বা তার রঙের বাহার। গাঢ় রঙের সবুজের ওপর কালো লাইন দিয়ে চেককাটা।
মিসেস বয়েল মনে মনে ভাবলেন অস্বাভাবিক….। সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। তার ওপর পাশ কাটিয়ে যাবার সময় যুবকটি যেরকম তির্যক দৃষ্টিতে তাকালেন সেই তাকানোটাও তার একদম পছন্দ হল না। তার এই তির্যক দৃষ্টির মধ্যেই আছে এক অস্বস্তিকর অস্বাভাবিকতা– মনে মনে ভাবলেন তিনি।
মিসেস বয়েল নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি নিশ্চয় মানসিক ভাবে অসুস্থ। তাছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। একটু থেমে ছোকরার নিয়ম মাফিক মাথা নেড়ে অভিবাদন ফিরিয়ে দিলেন। ঘরটি বেশ আয়তনে বড়। দেওয়াল ঘেষে সারি সারি সুন্দর চেয়ার পাতা। বিশেষ করে গেলাপী রঙের বড় চেয়ার যে খুবই আরামদায়ক সেটা আর কাউকে বলার অপেক্ষা রাখে না। ওই গোলাপী চেয়ারটিই যে তার হবে সেটা মনে মনে ঠিক করে নিলেন তিনি। পাছে অন্য কোনো দাবিদার এসে ঝামেলা করে সেইজন্য দখল-স্বত্ব কায়েম করবার জন্য বোনার সাজসরঞ্জাম ভরা ব্যাগটা তার ওপর নামিয়ে রাখলেন। তারপর ডানদিকে থাকা বৈদ্যুতিক চুল্লীর সামনের দিকে এসে দাঁড়ালেন।
হ্যাঁ, তিনি যা সন্দেহ করেছিলেন, ঠিক তাই। চুল্লীটা নিজে উত্তপ্ত হলেও এর উষ্ণতা সঞ্চারের ক্ষমতা খুবই সীমিত। মিসেস বয়েলের চোখদুটো কিছুক্ষণের জন্য গোলাকার হয়ে উঠলো। এ বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য রাখা উচিত।
বিরক্তি চোখে তিনি এবার বন্ধ জানলার সার্শি ভেদ করে বাইরের দিকে তাকালেন। খুবই জঘন্য আবহাওয়া। খুবই ভয়ঙ্কর। তবে তিনি যে এখানে বেশিদিন থাকবেন না, সেটা সুনিশ্চিত। অবশ্য আরো দু-চারজন নতুন অতিথির আগমন ঘটলে জায়গাটা যে বাসযোগ্য হয়ে উঠবে তখন নতুন করে না হয় চিন্তা করা যাবে।
কেউ যেন চাপা গলায় পেছন থেকে হেসে উঠল। তারপর তাড়াতাড়ি মিসেস বয়েল ঘুরে দাঁড়ালেন। যুবক রেনই দরজার দিকে দাঁড়িয়ে তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টির মধ্যে সেই একই ভাবে হাসির আভাস।
মেজর মেটকাফ খিড়কির দরজায় বরফ দূর করার জন্য সাহায্য করছিলেন জিলকে। ভদ্রলোক রীতিমত পরিশ্রমী। জিলও আনন্দভরা মনে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিলেন সেজন্য।
মেজর মেটকাফ মাথা নেড়ে মন্তব্য করলেন, সত্যিই এটা একটা ভালো ব্যায়াম। দেহের যন্ত্রপাতিগুলো ঠিক রাখার জন্য রোজ এধরনের কোনো না কোনো শরীরচর্চা করা উচিত।
জিল মনে মনে এটাই চিন্তা করছিলেন যে মেটকাফ নিশ্চয় নিয়মিত স্বাস্থ্যচর্চা করেন! কেননা সকাল সাড়ে সাতটায় জিল প্রাতঃরাশ সেরে ফেলেন, তার সম্বন্ধে এই ধরনের চিন্তাই সবার আগে আসবে।
জিলের মানসিক চিন্তাভাবনার আঁচ ধরেই যেন মেজর বললেন–আমার জন্য আপনার স্ত্রী যে প্রাতরাশের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন এর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। ডিমটাও খুব সুন্দর খেতে হয়েছিল।
জিলকে হোটেলের নানারকম কাজকর্মের জন্য সকাল সাতটার আগে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তে হয়। এবং সে ও মলি দুজন মিলে ডিম সেদ্ধ করে চা তৈরি করল। তারপর সবকিছু বসবার ঘরে এনে রাখলো সাজিয়ে গুছিয়ে। প্রতিটি বস্তুই নিখুঁত ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। জিল। একটা কথা মনে মনে না ভেবে পারেনি।
সে যদি এই হোটেলের কোনো অতিথি হত তবে এমন বরফ ঝরা সকালে বিছানার গরম জায়গা ছেড়ে কেউই তুলতে পারত না তাকে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে বিছানা আঁকড়ে পড়ে থাকত।
তবে এই মেজর ভদ্রলোক খুব সকালেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছেন। প্রাতঃরাশও সেরে ফেলেছেন সকাল সকাল। তারপর সারা বাড়িময় ঘুরে বেড়িয়েছেন। দেখলেই বোঝা যায় অদম্য প্রাণশক্তিতে ভরপুর সুস্থ সবল মানুষ তিনি।
জিল আড়চোখে সাহায্যকারীর দিকে একবার তাকালো। ভদ্রলোকের প্রকৃতির সঠিক হদিশ পাওয়া শক্ত। পরিশ্রমী বয়স পেরিয়ে গেছে মনে হয় পঞ্চাশ। তবে তার দুটো চোখই যেন কেমন কেমন। সর্বদাই যেন একজোড়া তীক্ষ্ণ অনুসন্ধান দৃষ্টি মেলে সকলের ভাবগতিক লক্ষ্য করছেন। কিছুই যেন তার নজর এড়িয়ে যায় না। কি উদ্দেশ্য নিয়ে যে তিনি মঙ্কসওয়েল ম্যানরে এসে উঠেছেন জিল সেই কথাই চিন্তা করছিল। যুদ্ধ শেষ হবার ফলেই হয়তো তাকে সেনাবাহিনী থেকে নিতে হয়েছে অবসর এবং হাতে এখন আর কোনো কাজ নেই।
ঘুম থেকে দেরীতে উঠলেন মিঃ প্যারাভিসিনি। কফি আর এক টুকরো টোস্ট ছাড়া কিছুই খেলেন না তিনি। প্রাতঃরাশেও ইউরোপের স্বভাবজাত মিতব্যয়িতার পরিচয় দিলেন। তবে মলির সঙ্গে প্রথম দর্শনেই তার যেন বিনয়ের বাঁধ ভেঙে গেল। মলিও রীতিমতো অপ্রতিভ হয়ে উঠলো। ভদ্রলোক দু পায়ে ভর দিয়ে ব্যগ্রভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে তাকে অভিবাদন জানালেন। বললেন, আসুন আসুন, আমাদের মহীয়সী গৃহকত্রী…সুপ্রভাত! সত্যিই আপনি অসামান্য। বলুন আমি ঠিক বললাম কিনা?
মলি মাথা নেড়ে ইতস্ততঃ ভাবে সায় দিল। প্রকৃতপক্ষে এই প্রসঙ্গ দীর্ঘতর করবার তার কোনো ইচ্ছা ছিল না। এখন ভনিতা করবার মত একচুল সময় নেই।
ভাড়ার ঘরে তদারকি করতে করতে মলি বিড়বিড় করে বলল, আর কেন যে….প্রত্যেকে নিজের খেয়াল খুশিমত প্রাতঃরাশের সময় বেঁধে রাখে ঝক্কি-ঝামেলা সামলানো সত্যি বড় কঠিন কাজ।
মলি ডিসগুলো মুছে রেখে তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল দোতলায়। তাকে এখন যাবে না। জিল এখন সারা বাড়ির বরফ সাফ করতে ব্যস্ত।
মলি দ্রুত হাতে কাজ সারল। তবে তার মধ্যে যত্নের কোনো অভাব ছিল না। অতিথিদের স্নানঘরে জলের ঠিকমতো সরবরাহ করা হয়েছে কিনা সেদিকেও চোখ দেওয়া প্রয়োজন। মলি এবারে স্নানঘরগুলো ঘুরে দেখতে লাগল। এই সময় বেজে উঠল টেলিফোন। এত কাজের মধ্যে নতুন উপদ্রব যুক্ত হলে স্বভাবতঃই মনটা একটু বিগড়ে যায়। মলির বুকে জমতে শুরু করেছিল বিরক্তি। কিন্তু এই ঘোর দুর্যোগের দিনে টেলিফোনের লাইনটা ঠিক চালু আছে — এই কথা ভেবেও শান্তি পেল সে আবার কিছুটা। মলি যখন ছুটতে ছুটতে লাইব্রেরী ঘরে এসে পৌঁছলো তখন সে রীতিমতো হাঁপাচ্ছে।
সেই অবস্থাতেই তুলে নিলো রিসিভারটা।
হ্যাঁ..বলুন, দূরভাষের অপর প্রান্ত থেকে একটা ভরাট গম্ভীর স্বর ভেসে এলো, মঙ্কসওয়েল ম্যানর…?
হ্যাঁ, এটা মঙ্কসওয়েল ম্যানর অতিথিশালা।
আমি কম্যান্ডর ডেভিসের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
অনুগ্রহ করে যদি একটু খবর দেন…
কিন্তু তিনি এখন ফোন ধরবার মতো ফুরসৎ পাবেন কিনা বলতে পারি না। জবাব দিলো মলি।
আমি তার স্ত্রী মিসেস ডেভিস।… আপনি কে কথা বলছেন?
বার্কায়ারের পুলিস-সুপারিন্টেন্টে হবেন।
আচমকা ধাক্কা খেয়ে মলি যেন চমকে উঠলো কিছুটা।
ও…তাই বুঝি..?
শুনুন মিসেস ডেভিস, একটা গুরুতর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।
টেলিফোনে অবশ্য সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলতে চাই না, তবে আমি ডিটেকটিভ সার্জেন্ট ট্রেটারকে মঙ্কসওয়েল ম্যানর-এর ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছি। যে কোনো মুহূর্তেই ট্রেটার আপনাদের ওখানে পৌঁছে যেতে পারে।
কিন্তু মনে হয় না ভদ্রলোক আসতে পারবেন বলে। পথঘাট সমস্তই বন্ধ হয়ে গেছে বরফে। রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করাই দুঃসাধ্য ব্যাপার।
হগবেনের কণ্ঠস্বরে সুগভীর আশ্বাসের ধ্বনি। ট্রেটার যেভাবেই হোক পৌঁছে যাবে। সেজন্য চিন্তা করবেন না। তবে আপনার স্বামীকে জানিয়ে রাখবেন দয়া করে, ট্রেটারের কথা যেন শোনেন মন দিয়ে। এবং সে যা বলবে সেই নির্দেশই যেন মেনে চলেন। ব্যস্ আর কিছু নয়।
কিন্তু সুপরিনটেণ্ডেট হগবেন…. কেনই বা…।
মলি মাঝপথে থেমে গেল। হগবেন ইতিমধ্যে লাইন কেটে দিয়েছেন। তার অর্থ, তিনি বললেন যা এর বেশি তার আর কোনো বক্তব্য নেই। তবুও কয়েক মুহূর্ত বোকার মতন ফোন ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর রিসিভারটা ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখল। ইতিমধ্যে দরজা ঠেলে জিল ভেতরে ঢুকে পড়েছে।
মলির বুক থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল। সে বলল –যাক তাহলে এসে পড়েছ তুমি।
জিলের লম্বা চুলের ফাঁকে ফাঁকে সাদা বরফ জড়িয়ে আছে। গালে ও কপালে কয়লার কালি। চোখে মুখে রয়েছে ব্যস্ততার ছাপ। বলে উঠল সে –তোমার ব্যাপারটা কি মলি? আমি কয়লার ঝুড়িগুলো সব বোঝাই করে রেখেছি, ঠিকমতো কাঠের ব্যবস্থাও রেখে দিয়েছি। এখন গিয়ে মুরগির ঘরটা দেখতে হবে। তারপর ব্রয়লারটা সুবন্দোবস্ত করতে পারলেই এ বেলার মত আমার ছুটি। কিন্তু তোমাকে যেন কিছুটা চিন্তিত মনে হচ্ছে….
মলি বলল –পুলিস কর্তৃপক্ষ ফোন করেছিলেন, জিল।
জিল অবিশ্বাসের সুরে বলল– পুলিস?
মলি ম্লান মুখে বলল, হ্যাঁ। তারা একজন ইনসপেক্টর না সার্জেন্ট –কাকে যেন এখানে পাঠচ্ছেন।
জিল বলল –কিন্তু কেন? কি আমাদের অপরাধ?
মলি বলল –তা বলতে পারব না। আচ্ছা আমরা যে দুই পাউণ্ড আইরিশ মাখন আনিয়েছি তার জন্যে শুল্কবিভাগ কোনো আপত্তি তোলেনি তো?
জিল ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ চিন্তা করল তারপর বলল –টি.ভি-র লাইসেন্সটা ঠিক সময় রিনিউ করা হয়েছে তো, তাই না?
মলি বলল –হ্যাঁ, হ্যাঁ, সে সমস্ত ঝামেলা অনেক দিন আগেই মিটে গেছে। তবে সামনের বাড়ির বাসিন্দা মিসেস বিভূলকের কাছে আমি আমার পুরনো কোটটা দিয়ে নিয়েছিলেন পাঁচটা রেশনের কুপন। নিশ্চয় সেটা খুব একটা দোষের নয়, কারণ আমি যখন আমার পুরানো কোটটা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি তখন পাঁচটা রেশনেরই বা কুপন ভোগ করতে পারবো না কেন?…কিন্তু…কিন্তু…এ ছাড়া কি-ই বা হতে পারে আর? কিছুই বোঝা যাচ্ছে না ঠিক!…
দু-একদিন আগে খুব বড় একটা অ্যাকসিডেন্টর হাত থেকে আমি অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলাম। তবে সে ব্যাপারে কোনো দোষ নেই আমার। অন্য গাড়িটাই হুড়মুড়িয়ে আমার গাড়ির ওপর এসে পড়েছিল। এমন কি তার আগে হর্ণ পর্যন্ত দেয়নি।
অপ্রসন্ন সুরে গুণ গুণ করলো মলি, বলল –নিশ্চয় আমরা কিছু একটা করেছি।
আজকাল মুস্কিল হচ্ছে, তুমি যা কিছু করতে যাও সমস্তই বেআইনি। –জিলের গলায় রাগের সুর ছিল। সে আবার বলতে শুরু করল সেইজন্য সব সময়ই নিজেকে কেমন অপরাধী অপরাধী মনে হয়। তবে আমার বিশ্বাস এই অতিথিশালা সংক্রান্তই কিছু হবে। বিনা অনুমতিতে এ ধরনের কোনো ব্যবসা পরিচালনাটাই হয়তো আইনের চোখে দণ্ডনীয় অপরাধ!
আমার ধারণা কেবলমাত্র পানীয় পরিবেশনের ক্ষেত্রেই কিছু কিছু বাধানিষেধ চালু আছে। কিন্তু আমরা তো অতিথিদের টেবিলে কোনোরকম পানীয় সরবরাহ করিনি। তাহলে কেন নিজেদের ইচ্ছেমতো ব্যবসা চালাতে পারব না?
হ্যাঁ, আমি জানি! তোমার কথার মধ্যে যুক্তিও আছে যথেষ্ট। তবে ওই যা বললাম, আজকাল হয়ত সমস্ত ক্ষেত্রেই সরকারী বাধা নিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
হায় ভগবান! মলি দীর্ঘশ্বাস ফেললো, কেনই বা মরতে আমরা এই হোটেল খুলে বসতে গেলাম! প্রথম দিনই বরফ চাপা পড়ে — পথঘাট সব বন্ধ হয়ে গেলো। তার ফলে অসময়ের জন্যে যে সমস্ত টিনের খাবার আমরা মজুত করে রেখেছিলাম সে সবই অতিথিরা দুদিনে শেষ করে দেবে।
অল্পেতেই তুমি বেশি নার্ভাস হয়ে পোড়ো না। সান্ত্বনার সুরে জিল বললো, আমাদের হয়তো, এখন কিছুটা দুদিন যাচ্ছে, কিন্তু শীগগিরই দুর্যোগের মেঘ কেটে যাবে। অন্যমনস্ক ভাবে মলির কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো জিল। তাপর একটু থেমে সম্পূর্ণ ভিন্ন সুরে বলে উঠলো, একটা কথা কি জানো মলি, আমার কেবলই মনে হচ্ছে বিষয়টা নিশ্চয় খুব গুরুতর কিছু হবে। তা না হলে খামোকা একজন পুলিস সার্জেন্টকেই বা তারা এখানে পাঠাতে যাবে কেন? চোখ তুলে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে ইঙ্গিত করলো জিল, খুব জরুরী কিছু না হলে এমন দিনে…
মলিও কোনো কথা বললো না। দুজনে দুজনের দিকে উল্কণ্ঠিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ভেজানো দরজা ঠেলে মিসেস বয়েল ভেতরে প্রবেশ করলেন।
এই যে..আপনি এখানে মিঃ ডেভিস? মিসেস বয়েলের কণ্ঠস্বরে সুগভীর কাঠিন্য। ড্রয়িং রুমের তাপচুলল্লীটা যে ঠান্ডা পাথর হয়ে গেছে সে খবর কী আপনার কানে এসে পৌঁছেছে?
আমি খুবই দুঃখিত মিসেস বয়েল। আমাদের কয়লার মজুতটা একেবারে ফুরিয়ে এসেছে, তাই…
মিসেস বয়েল নির্দয় কণ্ঠে মন্তব্য করলেন, কিন্তু আমি সস্তায় সাত গিনি করে দিচ্ছি, সে কথাও ভুলে যাবেন না। সাতসাতটা গিনি! সেটাও নিশ্চয় ঠান্ডায় জমে যাবার জন্যে নয়।
জিল লজ্জিত গলায় বলে উঠল, এক্ষুনি গিয়েই আমি ওটা জ্বালাবার বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি।
জিল দ্রুতপায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। মিসস বয়েল এবার ফিরে তাকালেন মলির দিকে। একটা কথা আপনাকে বলছি বলে কিছু মনে করবেন না মিসেস ডেভিস। তবে এই যে যুবকটি এখানে আছে তার চালচলন খুবই অস্বাভাবিক। তার কথাবার্তা…এমন কি গলায় বাঁধা টাইটা পর্যন্ত…সব কিছুই খুব অদ্ভুত ধরনের। তার ওপর চুলটুল আঁচড়ানোর কোনো অভ্যাসও বোধহয় ওর নেই।
মলি জবাব দিল –কিন্তু যুবকটি তো একজন ভালো স্থপতি।
মাপ করবেন, আপনার কথার অর্থ…
ক্রিস্টোফার রেন একজন স্থপতি, এবং….
মিসেস বয়েল মাঝপথে বাধা দিয়ে বললেন– শুনুন শুনুন, মিসেস ডেভিস স্যার ক্রিস্টোফার রেনের নাম আমি শুনেছি। তিনি যে সত্যই একজন প্রথম শ্রেণীর স্থপতি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেন্টপল ইত্যাদি তাঁর অনেক কীর্তির কথাই সকলের জানা আছে। কিন্তু আপনারা মনে করেন যে দুদিন কোনো আর্ট স্কুলে পড়লেই শিল্পতত্ত্বের সবকিছু অনায়াসে শিখে ফেলা যায়।
আমি এখন এই যুবকটির কথাই বলছি। এর নামও ক্রিস্টোফার রেন। যুবকটির বাপ-মা চেয়েছিলেন বড় হলে তাদের ছেলে একজন নাম করা স্থপতি হবে। সেইজন্যেই ওরকম নামকরণ দেওয়া হয়েছিল এবং তাদের সেই স্বপ্নও প্রায় সত্যি হয়েছে বলা চলে।
মিসেস বয়েল নাক কোঁচকালেন বললেন, তবে আমার কাছে সমস্ত বিষয়টা খুবই সন্দেহজনক বলে মনে হচ্ছে। আমি যদি থাকতাম আপনার জায়গায় তাহলে ছেলেটির সম্বন্ধে রীতিমত খোঁজখবর না নিয়ে ছাড়তাম না। ওর সম্বন্ধে আপনিই বা কতটুকু জানেন?
আপনার সম্বন্ধে যতটুকু জানি ঠিক ততটুকুইমিসেস বয়েল। সেটা হচ্ছে এই যে আপনারা দুজনেই সস্তায় সাত গিনি করে দেবেন। এবং এইটুকু জানলেই চলে যাবে আমার, তাই নয় কি? কারণ সেটাই শুধু আমার জানার বিষয়। সত্যিই আমি আমার অতিথিদের পছন্দ করি কি…মলি চোখ তুলে তাকালেন সোজাসুজি। তারপর বলল–করি না, তাতে কিছু এসে যায় না।
মিসেস বয়েল এবার একটু রেগে গেলেন। বললেন– আপনার বয়স এবং অভিজ্ঞতা, দুটোই খুব কম। সেই কারণে কোনো অভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ গ্রহণ করাই এ ক্ষেত্রে সমীচিন। আচ্ছা, ওই অদ্ভুত-দর্শন বিদেশী ভদ্রলোকটিই বা কে? কখনই বা হাজির হলেন তিনি।
উত্তর দিলেন–মাঝরাতে।
তাই নাকি, ভারি অদ্ভুত তো। কোনো নতুন জায়গায় এসে ওঠবার পক্ষে সময়টা নিশ্চয় উপযুক্ত নয় খুব একটা?
মিষ্টি করে মলি ফোড়ন কেটে বলল–কিন্তু প্রকৃত ভ্রমণকারীকে ফিরিয়ে দেওয়া নীতিবিরুদ্ধ, মিসেস বয়েল। আপনি হয়ত এই আইন সম্পর্কে ঠিক অবহিত নন?
মিসেস বয়েল বললেন–আমার বক্তব্য হচ্ছে, এই যে ভদ্রলোক, প্যারাভিসিনি না কি যেন নাম–খুব সুবিধের বলে…
সাবধান…সাবধান ম্যাডাম। যদি আপনি শয়তানের সম্বন্ধে কোনো মন্তব্য করেন এবং ঘটনাচক্রে সে যদি…
মিসেস বয়েল সামনে ভূত দেখার মতই আচমকা লাফিয়ে উঠল। সাক্ষাৎ শয়তানই যেন এখন তাকে করছে সম্বোধন। নিঃশব্দ পায়ে মিঃ প্যারাভিসিনি যে কখন সেখানে হাজির হয়েছেন দুজনের কারুরই সেটা নজরে পড়েনি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক বিনম্রভঙ্গিতে হাত কচলাচ্ছিলেন। তার ঠোঁটের আগায় শয়তান সুলভ কুটিল হাসির উল্লাস।
মিসেস বয়েল বিব্রত ভঙ্গিতে মন্তব্য করে বললেন–আপনি আমায় চমকে দিয়েছিলেন, কখন যে চুপিসারে আমাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, একেবারে টের পাইনি।
প্যারাভিসিনি জানালেন–হ্যাঁ, আমি নিঃশব্দ পায়েই চলাফেরা করি। কেউ আমার পায়ের আওয়াজ শুনতে পায় না। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই মজার লাগে। তার ফলে কখনো সখনো আমার কানে অপরের আলাপ-আলোচনা এসে পৌঁছায়। তাতেও আমি খুব মজা পাই। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলেন, কিন্তু একবার যানি তা কিন্তু আমি কোনোদিন ভুলি না।
মিসেস বয়েল দ্বিধার সুরে বলে উঠলেন–তা তো বটেই। আমি আমার সাজসরঞ্জাম বোধহয় ড্রেসিংরুমেই ফেলে এসেছি যাই… দ্রুতপায়ে স্থান ত্যাগ করলেন মিসেস বয়েল। মলি কিছুটা বিমূঢ় চোখে বিদেশী ভদ্রলোককে দেখছিলেন। বেশ লাফিয়ে ঝাঁপিয়েই ভদ্রলোক এবার তার দিকে এগিয়ে এলেন।
তিনি বললেন–আমার মহীয়সী গৃহকত্রীকে যেন কিছুটা বিচলিত লাগছে! এর কারণ কি ম্যাডাম? মলি কোনো বাধা দেওয়ার আগেই ভদ্রলোক তার একটা হাত নিজের মুঠোর মধ্যে টেনে নিয়ে তালুর উল্টোদিকে মৃদু চুম্বন এঁকে দিল।
মলি একপা পিছিয়ে গেল। মিঃ প্যারাভিসিনিকে সে সত্যিই পছন্দ করে কিনা এ বিষয়ে সে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারল না। ভদ্রলোকের দুর্বোধ্য বাঁকা চোখে যেন এক পাশবিক লালসার আভাস দেখা যাচ্ছে।
হালকা সুরে মলি জবাব দিল–আজকে সকাল থেকেই নানারকম অশান্তির উপদ্রব দেখা দিয়েছে। হতচ্ছাড়া তুষারপাতই তার প্রধান কারণ।
মিঃ প্যারাভিসিনি মাথা নাড়তে নাড়তে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বললেন– হ্যাঁ, তা ঠিক। এই বরফই যত নষ্টের গোড়া, তাই সে কথা অস্বীকার করা যায় না।
আপনি কি বলতে চাইছেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না!
প্যারাভিসিনি চিন্তান্বিত সুরে জবাব দিল বলল–সেটা খুব অস্বাভাবিক নয়। পৃথিবীতে অনেক কিছুই আছে যা আপনি জানেন না। এবং একটা বিষয় সম্বন্ধে আমি নিশ্চিন্ত অতিথিশালার পরিচালনার ব্যাপারে আপনার খুব একটা অভিজ্ঞতা নেই।
মলির গাল লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল বলল–তা হয়তো সত্যি, তবে আমাদেরও উৎসাহের শেষ নেই। আমরা এর পেছনে লেগে থাকবো স্থির করেছি। প্যারাভিসিনি বললেন– বাহবা…বাহবা। এই তো চাই।
রাঁধুনি হিসাবে আমি মন্দ নই, বলুন? মলির কণ্ঠে উদ্বিগ্নতার সুর চাপা রইলো না।
না না, আপনার রাঁধুনির হাতে জাদু আছে। ঠিক আপনার মতো মোহনীয়।
উৎসাহিত ভাবে সায় দিলেন প্যারাভিসিনি। এই বিদেশীরা কি জঘন্য প্রকৃতিরই না হয়, মনে মনে চিন্তা করলো মলি।
প্যারাভিসিনি যেন মলির মনের কথা বুঝতে পারলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার আচার আচরণও সম্পূর্ণ বদলে গেলো। তিনি আবার রীতিমতো গম্ভীর ভাবেই বললেন, আমি কিন্তু একটা বিষয়ে আপনাকে সাবধান করে দিতে চাই মিসেস ডেভিস। আপনারা দুজনে বাইরের লোকদের খুব বেশি বিশ্বাস করবেন না।
এখানে যারা অতিথি আছেন, তাদের সবার পরিচয় কি আপনি জানেন?
এটা কি সত্যিই খুব প্রয়োজনীয়? মলিকে কিছুটা বিচলিত বোধ হতে হলো।
আমার ধারণা, অতিথিরা সাধারণত এমনিই এসে থাকেন… যাকে আপনি ছাদের নিচে আশ্রয় দিয়েছেন, তার সম্বন্ধে যতটা সম্ভব খোঁজখবর নেওয়াই কি সুবিবেচকের পরিচয় নয়?
সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়ে কিছুটা ভয় দেখানো ভঙ্গিতেই মলির কাঁধে দু-একটা টোকা দিলেন ভদ্রলোক। এই যেমন আমার কথাই ধরুন না! মাঝরাতে হুট করে আবার আবির্ভাব ঘটলো। আমি আপনাকে জানালাম, তুষারপাতের ফলে রাস্তার মধ্যিখানে আমার গাড়িটা আটকে পড়েছে। তাহলে প্রকৃতপক্ষে আপনি আমার সম্বন্ধে কতটুকু জানতে পারলেন?
একেবারে কিছুই না। এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অন্যান্য অতিথিদের সম্বন্ধেও আপনার অভিজ্ঞতা ঠিক একরকম!
মলি বলল কিন্তু মিসেস বয়েল তো… মলিকে মাঝখানে থেমে যেতে হল। কেননা মিসেস বয়েলই তার বোনার সাজসরঞ্জাম হাতে নিয়ে সেখানে এসে আবার হাজির হলেন।
ভদ্রমহিলা মৃদুস্বরে মন্তব্য করে তাপচুল্লীর পাশে একটা চেয়ারের দিকে এগিয়ে বললেন ড্রয়িংরুমটা বড় বেশি ঠাণ্ডা। তার চেয়ে এখানকার আবহাওয়া অনেক উষ্ণ আছে।
দ্রুত পায়ে মিসেস বয়েলকে অতিক্রম করে সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন প্যারাভিসিনি। তিনি বললেন–যদি ম্যাডাম অনুমতি দেন, আমি আপনার জন্যে তাপচুল্লীর আগুনটা একটু উস্কে দিতে পারি।
মিঃ প্যারাভিসিনির হাঁটাচলার মধ্যে একটা ক্ষিপ্রতাভাব আছে যা সহজেই সবার নজর কাড়ে। গতরাত্রেও তার এই বিশিষ্ট ভঙ্গিটি লক্ষ্য করেছিল মলি। ভদ্রলোক যখন হাঁটু গেড়ে বসে তাপচুল্লীর আগুনটা উস্কে দিতে ব্যস্ত ছিলেন তখন আরো একটা জিনিষ চোখে পড়ল মলির। এই বিদেশী অতিথি সব সময় তার পেছনের অংশটাই আলোর দিকে ফিরিয়ে রাখেন। তার কারণটাও এখন মনে মনে মলি উপলব্ধি করল। প্যারাভিসিনির সমস্ত মুখটাই যেন কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে।
তাহলে এই ক্লান্তিকর বোকা বুড়োটা বরাবর ছোকরা সেজে থাকবার জন্যেই এমনভাবে ভোল ধরেছে। তবে ভদ্রলোকের উদ্দেশ্য যে সিদ্ধ হয়নি সে কথা বোঝা যায় স্পষ্ট ভাবে। বয়সের ছাপ মুখ থেকে লুকোতে পারেনি। এমন কি সময় সময় প্রকৃত বয়সের অনুপাতে ছাপটা ফুটে উঠেছে একটু বেশি মাত্রায়। কেবলমাত্র হাঁটাচলার মধ্যে যৌবনোচিত ভঙ্গীটুকু কেমন যেন অসঙ্গতিপূর্ণ। মনে হয় একটা সযত্নলালিত কৃত্রিম আবরণ এটা তার।
হন্তদন্ত হয়ে মেজর মেটকাফের আগমনই অনুমান-নির্ভর কাল্পনিক জগৎ থেকে রূঢ় বাস্তবে মলিকে টেনে আনলো। তিনি বলেন–মিসেস ডেভিস, আমার ভয় হচ্ছে… ভয় হচ্ছে… তারপর চারদিকে তাকিয়ে নিজেকে সংযত করে গলার স্বর নামিয়ে মেজর বললেন–নিচের তলায় বাথরুমের জলের পাইপগুলো বোধহয় ঠান্ডায় জমে গেছে।
মলি বিড়বিড় করে বলল–হ্যায় ভগবান! আজকেই একের পর এক যত দুর্ভোগ শুরু হয়েছে। প্রথমে পুলিস,… তারপর এই পাইপ…।।
মিঃ প্যারাভিসিনি রীতিমত শব্দ করে লোহার খোঁচানিটা নামিয়ে রাখলেন পাশে। মিসেস বয়েলের বোনার কাজ হয়ে গেল বন্ধ। অবাক চোখে মলি তাকিয়ে দেখল, মেজর মেটকাফের সারা মুখ থেকে কে যেন রক্ত শুষে নিয়েছে। মুখের মাংসপেশীগুলোও শক্ত হয়ে উঠেছে অদ্ভুতভাবে। ভাবলেশহীন কাঠের মূর্তির মতো এখন যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
চকিত সুরে প্রশ্ন করলেন তিনি–পুলিস? আপনি কি পুলিসের কথা বললেন?
মলি মনে মনে বুঝতে পারল, ভদ্রলোকের এই আপাত ভাবলেশহীন মুখের পেছনেই একটা ঘটে চলেছে প্রচণ্ড রকমের আলোড়ন। অথবা তীব্র উত্তেজনাও এর উৎস হওয়া এমন কিছু বিচিত্র নয়। কিন্তু কিছু একটা যে আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই লোকটা…বিড়বিড় করে মলি বলল, আসলে ভয়ঙ্কর প্রকৃতির লোক হতে পারে।
ভদ্রলোক আবার প্রশ্ন করলেন। এবার তার কণ্ঠস্বরে শুধু একটা সামান্য কৌতূহলের সুরই প্রকাশ পেল–পুলিস কেন?
মলি জবাব দিল–দুচার মিনিট আগে পুলিস কর্তৃপক্ষ একটা ফোন করেছিলেন। তারা নাকি একজন সার্জেন্টকে এখানে পাঠাচ্ছেন। এবার তার জানলা দিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হল। চোখে মুখে দেখা গেল আশার আলো। তিনি বললেন– তবে এই দুর্যোগের মধ্যে তিনি এখানে পৌঁছতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস হয় না।
মলির দিকে আরেক পা এগিয়ে এসে মেজর বললেন–কিন্তু একজন পুলিসকেই বা তারা পাঠাচ্ছে কেন এখানে? মলি জবাব দেবার আগেই দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো জিল।
রাগের সুরে জিল বলল, ওঃ কয়লার চাওড়গুলো যেন বিশমনের ওপর ভারী। তারপর সবার দিকে তাকিয়ে অবাক সুরে প্রশ্ন করল–ব্যাপার কি? সবাইকে এত বিচলিত লাগছে কেন?
মেজর মেটকাফ তার দিকে এবার ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন– শুনলাম, এখানে নাকি পুলিস আসছে। এর কারণ কি?
মাথা নেড়ে জিল বলল–তাতে ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। কেউই এসে পৌঁছতে পারবে না এখানে। বরফ এখন পাঁচফুট উঁচু। সমস্ত পথঘাট বরফের তলায় চাপা পড়ে গেছে। সবরকম যানবাহন এখন বন্ধ।
সেই মুহূর্তে জানলার সার্শিতে কেউ ঠকঠক করে যেন শব্দ করল। শব্দটা পরিষ্কার শোনা গেল। প্রথমেই এক্সঙ্গে ঘরের প্রত্যেকেই চমকে উঠল। প্রথমে কেউই বুঝতে পারল না শব্দটা কোথা থেকে ঠিক আসছে। একটা অদৃশ্য ভৌতিক সঙ্কেতের মতো মনে হল।
তারপরই মলি গরাদহীন বড় ফ্রেঞ্চ জানলাটার দিকে ইঙ্গিত করে চেঁচিয়ে উঠল। একজন লোক বাইরে দাঁড়িয়ে সার্শির ওপর টোকা দিচ্ছে। লম্বা কাঠের স্কী জুতো পায়ে আছে বলেই যে তার পক্ষে বরফ ভেঙ্গে এতদূর আসতে পেরেছে সে রহস্যটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না।
জিল বিস্ময়সূচক অস্ফুট একটা শব্দ করেই দ্রুত এগিয়ে এসে ছিটকিনিটা খুলে দিল।
আগন্তুক ঘরের মধ্যে ঢুকেই জিলকে অভিবাদন করে বলল–ধন্যবাদ স্যার, আমি ডিটেকটিভ সার্জেন্ট ট্রেটার। তার চোখে মুখে উজ্জ্বল তারুণ্যের দীপ্তি। সকলের দিকে একবার চোখ তুলে তাকিয়ে নিজের পরিচয় তিনি নিজেই দিলেন।
মিসেস বয়েল তার বোনা বন্ধ করে একটু নড়েচড়ে বসলেন। তারপর মৃদু প্রতিবাদের ভঙ্গিতে বলল–আপনাকে দেখে তো ঠিক সার্জেন্ট বলে মনে হয় না। বয়স যেন খুবই কম।
ভদ্রলোক বয়সে যদিও নিতান্তই নবীন তবুও এই মন্তব্য শুনে রীতিমত অপমানিত বোধ করলেন। তার উত্তরের মধ্যে রাগের আভাস ফুটে উঠল–আমাকে দেখে যতটা অল্পবয়সী মনে হয়, আসলে কিন্তু ততটা ছেলেমানুষ আমি নই ম্যাডাম।
আগন্তুক ভদ্রলোক আরেকবার সকলের দিকে তাকিয়ে জিলের দিকে শেষে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলো। তারপর বলল।–আপনিই তো মিঃ ডেভিস, তাই না? আমি আমার ধরাচুড়ো সব খুলে কোথাও রেখে দিতে চাই!
হা… নিশ্চয়। আমার সঙ্গে আসুন…।
জিল আগন্তুককে ডেকে নিয়ে ভেতরে চলে যাবার পর মিসেস বয়েল রুক্ষ্ম ব্যাজার মুখে মন্তব্য করলেন–এই জন্যেই আমরা সরকারকে পুলিস পোষবার ট্যাক্স গুণে দিই। আর এদিকে বেতনভুক পুলিস কর্মচারীরা বরফের ওপর শীতকালীন খেলাধুলা এবং আমোদ প্রমোদ নিয়ে ব্যস্ত।
মলির মুখোমুখি এবার দাঁড়ালেন প্যারাভিসিনি। তাঁর কণ্ঠস্বরে এবার ক্রুদ্ধ মাপের গর্জন শোনা গেল। কেন আপনি পুলিস ডেকে পাঠিয়েছেন মিসেস ডেভিস?
প্যারাভিসিনির এই রক্তবর্ণ মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে কয়েক মুহূর্ত বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল মলি। ভদ্রলোকের এ চেহারা যেন সম্পূর্ণ নতুন। একটা ভয়ের ছায়া ঘনিয়ে উঠল বুকের মধ্যে তার। অসহায় ভাবে জবাব দিল–কিন্তু…আমি তো ডেকে পাঠাইনি ওদের…
মলির কথা শেষ হতে না হতেই উত্তেজিত ভঙ্গিতে ক্রিস্টোফার রেন ঘরে এসে দাঁড়ালেন। তার কণ্ঠস্বরে তীক্ষ্ণ প্রশ্নের খোঁচা, বড় হলঘরটায় যে ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন উনি কে? কোথা থেকেই বা উনি হাজির হলেন? এদিককার রাস্তাঘাট তো সব বন্ধ।
এ প্রশ্নের জবাব দিলেন মিসেস বয়েল। তার কণ্ঠে ক্ষোভ ও ভর্ৎসনা দুয়ের মিল। তিনি বললেন–বিশ্বাস করুন বা না করুন, সে আপনার খুশি–তবে এই ভদ্রলোক একজন পুলিস কর্মচারী। ব্যাপারটা একবার ভেবে দেখবেন। কর্তব্যরত পুলিস কর্মচারী স্কী পায়ে দিয়ে মাঠে ময়দানে ঘুরে বেড়াচ্ছে!…
সরকারী কর্মচারীরা আজকাল কিভাবে ফাঁকিবাজ ও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সেই কথাটা ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়াই যেন এই বক্তব্যের মূল উদ্দেশ্য। মেজর মেটকাফ মৃদুসুরে মলিকে প্রশ্ন করলেন, মাপ করবেন মিসেস ডেভিস, আমি কি এখানকার ফোনটা একবার ব্যবহার করতে পারি।
হা হা, যতবার খুশি!
এতে অনুমতি নেবার কোনো প্রয়োজন নেই! ফোনের দিকে এগিয়ে গেলেন মেজর।
ক্রিস্টোফার রেনের তীক্ষ্ণকণ্ঠ মন্তব্যও তার কানে এলো। ভদ্রলোকের চেহারাটা ভারী সুন্দর।
আপনারাও কি তাই মনে হয় না?
অবশ্য প্রত্যেক পুলিস কর্মচারীই কমবেশি স্মার্ট ও হ্যাণ্ডসাম।
হ্যাল্লো …হাল্লো…, রিসিভারটা তুলে নিয়ে দুচার মুহূর্ত নাড়াচাড়া করলেন মেজর, তারপর মলির দিকে ফিরে তাকালেন।
মিসেস ডেভিস, আপনার ফোনটা তো অচল হয়ে পড়ে আছে! নিশ্চয় কোথাও লাইনের কিছু গণ্ডগোল হয়েছে।
কিন্তু এতক্ষণ তো লাইন ঠিকই ছিলো। এইমাত্র.. ক্রিস্টোফার রেনের উচ্চকণ্ঠ সুরেলা হাসিই তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিলো।
বিকারগ্রস্ত রুগীর মতোই হাসতে লাগলেন ভদ্রলোক। অবশেষে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের সবরকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। হাসির ফাঁকে ফাঁকেই সরস ভঙ্গিতে মন্তব্য করলেন তিনি, ব্যাপারটা খুবই মজার…ভারি মজার….
কিন্তু এতে এত হাসির কি ব্যাপার ঘটলো কিছুই আমার মগজে ঢুকছে না। মেজরের কণ্ঠস্বরে কাঠিন্যের আভাস।
হ্যাঁ, ঠিকই তো। মিসেস বয়েলও সায় দিলেন মাথা নেড়ে। ক্রিস্টোফারের হাসি তখনও থামেনি।
না না, আপনারা কিছু মনে করবেন না। এটা আমার একটা ব্যক্তিগত রসিকতা। …চুপ…চুপ… ঠোঁটের ওপর তর্জনী রাখলেন তিনি, গোয়েন্দাপ্রবর এদিকেই আসছেন।
জিলের সঙ্গে সঙ্গেই সার্জেন্ট ট্রেটার হাজির হলেন। ভদ্রলোক এখন তার বদখদ স্কী দুটোর হাত থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
শুভ্র তুষারের কুচিগুলোও ঝেড়ে ফেলেছেন গা থেকে। তার হাতে ধরা একটা লম্বা নোট বই আর পেনসিল। চালচলনে সুগভীর পুলিস গাম্ভীর্যটুকুও ফুটে উঠেছে নিখুঁত ভাবে।
মলি, জিলের কণ্ঠে ব্যস্ততার আভাস, সার্জেন্ট ট্রেটার আমাদের সঙ্গে আলাদা ভাবে দু একটা কথা বলতে চান।
দুজনকে অনুসরণ করে মলি ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালো। জিলই তাদের পথ দেখিয়ে স্টাডিরুমের দিকে নিয়ে গেলো। বড় হলঘরটার ঠিক পেছনেই সাজানো-গোছানো ছোট আকারের স্টাডিরুম। সকলে ভেতরে ঢোকবার পর বাইরেটা একবার দেখে নিয়ে সন্তর্পণে দরজা ভেজিয়ে দিলেন ট্রেটার।
আমাদের অপরাধটা কি সার্জেন্ট…?
মলি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। একরাশ উৎকণ্ঠাই ঝরে পড়লো তার কণ্ঠস্বরে। অপরাধ! সার্জেন্ট ট্রেটার কয়েক মুহূর্ত অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ধীরে ধীরে তার ওষ্ঠাধরে চওড়া হাসি ফুটে উঠলো। না না, আপনারা সম্পূর্ণ ভুল বুঝেছেন। এই ভুল বোঝাবুঝির জন্যে আমি দুঃখিত। কিন্তু প্রকৃত ঘটনাটা একেবারেই আলাদা।
এটাকে এক ধরনের পুলিসি সাহায্যও বলা যেতে পারে। আমার আগমনের তাই হল মূল উদ্দেশ্য।
এবারেও সার্জেন্টের বক্তব্য তাদের বোধগম্য হয়েছে বলে মনে হয় না। দুজনেই তাকিয়ে রইল অবাক দৃষ্টিতে আগন্তুকের মুখের দিকে।
ট্রেটার আবার বলতে শুরু করলেন মিসেস লিয়ন মিসেস মউরীন লিয়নের নাম ইতিমধ্যে নিশ্চয় আপনারা শুনে থাকবেন? দুদিন আগে লণ্ডনের এক ভাড়াটে ফ্ল্যাট বাড়িতে ভদ্রমহিলা খুন হয়েছেন।
মলি মাথা নেড়ে বলল–হ্যাঁ।
ট্রেটার বলল–আমার প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, এই ভদ্রমহিলা কি আপনাদের পরিচিত ছিলেন? জিল বিড়বিড় সুরে বলল–না আগে কোনোদিন এর নাম পর্যন্ত আমরা শুনিনি। মলিও সেই কথায় সায় দিল।
ট্রেটার শান্ত গলায় বলল–আমাদেরও ধারণা সেইরকম। তবে মহিলাটির আসল নাম মনে হয় লিয়ন ছিল না। পুলিসের রেকর্ড বইয়ে আঙুলের ছাপ দেখে প্রকৃত সত্যটা জানা গেছে। তার আসল পদবী হচ্ছে গ্রেগ। মউরীন গ্রেগের মৃতস্বামী জন গ্রেগ ছিলেন একজন কৃষক। তাই হাতে তৈরি লরিজ ফাটাও। ফার্মটাও এখান থেকে বেশি দূরে নয়। নামটাও হয়তো আপনার এবং আপনাদের কাছে পরিচিত।
পড়ার ঘরের ভেতর একটা থমথমে পরিবেশ। কেবল ছাদ থেকে বাইরের উঠোনে বরফ ঝরে পড়ার টুপটাপ শব্দই মাঝে মাঝে এই মৌনতা ভেঙ্গে দিয়েছে। এই শব্দটার মধ্যেও কেমন এক ধরনের অশুভ অশরীরী সঙ্কেত।
ট্রেটার কোনো উত্তর না পেয়ে মুখ খুললেন। বললেন–তিনটে অনাথ শিশুকে এই ফার্মে রেখে মানুষ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাদের সরকারই খরচ জোগাতেন। এসব ১৯৪০ সালের ঘটনা। অল্প কয়েকদিন পর এদের একটি ছেলে মারা যায়। অত্যাচার এবং অবহেলাই যে ছেলেটির মৃত্যুর কারণ, সেটাও জানাজানি হতে দেরি হয়নি বিশেষ। অনেক পত্রপত্রিকাতেও ব্যাপারটা নিয়ে খুব লেখালেখি হয়েছিল। তার ফলেই আদালতের বিচারে জন আর মউরীনের যাবজ্জীবন জেল হয়ে যায়। কারাবাসের অল্প কিছুক্ষণকালের পর জন পুরনো একটা গাড়ি চুরি করে জেল থেকে পালিয়ে গিয়েছিল কিন্তু নিজের নিয়তিকে এড়াতে পারেনি। পালাবার পথেই বেচারা মোটর দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। মাস দুয়েক আগে মউরীনের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়।
জিল প্রশ্ন করল, তিনিই কি সম্প্রতি খুন হয়েছেন? এটা কার কীর্তি বলে আপনারা সন্দেহ করছেন?
উত্তর দেবার জন্য কোনোরকম ব্যস্ততা দেখা গেল না ট্রেটারের মধ্যে। তিনি তার নিজের প্রশ্নেই অবিচল। তিনি বললেন–লরিজের ঘটনাটা নিশ্চয় আপনাদের মনে আছে?
জিল ঘাড় নাড়ল। সে বলল–১৯৪০ সালের কথা বলছেন? আমি তো তখন জাহাজে চাকরি নিয়ে ভূমধ্যসাগরের বুকের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছি। পৃথিবীর সঙ্গে তখন আমার খুব একটা যোগাযোগ ছিল না।
ট্রেটার এবার প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে মলির দিকে ফিরে তাকালেন। আমতা-আমতা করে মলি বলল –আমার… আমার অবশ্য কিছু কিছু মনে পড়ছে। কিন্তু আপনিই বা সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন কেন? তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কই বা কি?
আপনার সামনে মস্ত বিপদ, মিসেস ডেভিস। এই মুহূর্তে নিরাপত্তার একান্তই প্রয়োজন।
জিলের কণ্ঠে শোনা গেল অবিশ্বাসের সুর। বলল–বিপদ…কিসের বিপদ?
ট্রেটার বলল–তাহলে সমস্ত ঘটনাটা শুনুন মন দিয়ে। মিসেস লিয়ন যেখানে খুন হন সেই অকুস্থলের কাছেই পাওয়া গেছে একটা নোটবই। তার মধ্যে লেখা ছিল দুটো ঠিকানা। তার মধ্যে একটা হচ্ছে চুয়াত্তর নম্বর কার্লভার স্ট্রীট।
মলি তীক্ষ্ণ স্বরে প্রশ্ন করল–ওই ফ্ল্যাট বাড়িতেই তো ভদ্রমহিলা খুন হয়েছেন, তাই না?
তরুণ সার্জেন্ট আত্মগত ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বললেন, অন্য ঠিকানাটা হচ্ছে মঙ্কসওয়েল ম্যানর।
মলি দু চোখ বিস্ময় মেশানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল–কি বললেন..মঙ্কসওয়েল ম্যানর। কিন্তু সমস্তটাই কেমন যেন অবিশ্বাস্য!
সেইজন্যেই সুপারিন্টেন্টে হগবেন আমাকে এখানে পাঠিয়ে দিলেন এত তাড়াতাড়ি। এই ঘটনার সঙ্গে আপনাদের কোনো যোগাযোগ আছে কিনা সেটাই এখন জানার বিষয়।-ট্রেটার কথাগুলো বলে ফেললেন।
জিলের কণ্ঠে অকপট অভিব্যক্তি শোনা গেল–কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো সম্পর্কের আভাস পর্যন্ত নেই। এটা হয়ত কোনো কাকতালীয় ব্যাপার।
শান্ত স্বরে ট্রেটার উত্তর দিলেন-সুপারিন্টেন্টে এই ব্যাপারটাকে এত তুচ্ছ বলে মনে করে না। তার মতে এ ব্যাপারে সাধ্যমত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আর যেহেতু বরফের ওপর স্কী পায়ে দিয়ে হাঁটা-চলা করতে আমি বিশেষ অভিজ্ঞ সেজন্য আমাকেই প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে পাঠালেন। আমি এখানকার সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করে তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করব। সকলের নিরাপত্তার জন্যও যথাসাধ্য তিনি ব্যবস্থা নেবার নির্দেশ দিয়েছেন।
জিল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ফিরে তাকিয়ে বলল–নিরাপত্তা…? হায় ভগবান! আপনি কি মনে করেন কারুর এখানে খুন হওয়ার আশঙ্কা আছে?
ট্রেটার বিনীত কণ্ঠে বললেন–আমি আপনাদের বিচলিত করতে চাই না। তবে সুপরিনটেন্ডেট হগবেন সেই রকম একটা কিছুর আশঙ্কা করছেন।
জিল প্রশ্ন করল–কিন্তু কেনই বা…
মাঝপথে জিলকে থামিয়ে দিয়ে ট্রেটার বলল– সেই কারণটার খোঁজেই আমি এখানে এসেছি।
তবে সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন যেন উদ্ভট।
হ্যাঁ তা ঠিক, তবে উদ্ভট বলেই বেশি বিপজ্জনক হয়ত!
মলি এবার মন্তব্য করল, বলল, আমার বিশ্বাস, আপনি নিশ্চয় সমস্ত ব্যাপারটা এখনো আমাদেরকে খুলে বলেননি। কিছু একটা বাকি থেকে গেছে!
ট্রেটার বলল– হ্যাঁ ম্যাডাম, আপনার অনুমান অভ্রান্ত। নোটবইয়ে ঠিকানা লেখা পাতাটার উপর দিকে ছেলে ভুলানো একটা ছড়ার লাইন লেখা ছিল। তিনটে ইঁদুর অন্ধ। নিহত মহিলার পেপাশাকের সঙ্গেও পিন দিয়ে একটা আটকানো কাগজের টুকরো পাওয়া গেছে। তাতে লেখা আছে– এই প্রথম এবং কাগজটার নিচের অংশে তিনটে ইঁদুরের ছবি আঁকা। ছবির তলায় ওই ছড়াটার প্রথম দুলাইনের স্বরলিপি।
ঘুম পাড়ানি মৃদুস্বরে মলি বিড়বিড় করল।
তিনটে ইঁদুর অন্ধ।
জানলা কপাট বন্ধ
বন্ধ ঘরে তারা।
ছুটতে ছুটতে সারা….
আচমকা বন্ধ হয়ে গেল তারা। সত্যিই কি ভায়বহ– কি বীভৎস ব্যাপারটা! তিনটে অনাথ শিশু ছিল, তাই বললেন না?
হ্যাঁ তিনজন, একটি পনেরো বছরের ছেলে, আর একটি চোদ্দ বছরের মেয়ে আর একটি বারো বছরের ছেলে। এই ছেলেটিই মারা গিয়েছিল শেষ পর্যন্ত।
কি ঘটলো অন্য দুজনের ভাগ্য?
যতদূর খোঁজ পাওয়া গেছে, প্রৌঢ় দম্পতির এক নিঃসন্তান মেয়েটিকে নিজেদের পালিতা কন্যা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। আমরা এখনও পাইনি সঠিক সন্ধান। অন্য ছেলেটির তেইশ বছর হবে এখন। আমরা তারও কোনো খোঁজ জানি না। তবে ছেলেবেলা থেকেই অদ্ভুত প্রকৃতির ছেলেটা ছিল। সেনা বিভাগে যোগ দেয় আঠারো বছর বয়সে, এবং বছর খানেক বাদেই সে নিরুদ্দেশ হয় সেনাবাহিনী ছেড়ে। সেনাবাহিনীর চিকিৎসক খুব জোরের সঙ্গেই বলেছিলেন: ছেলেটার মানসিক গঠন স্বাভাবিক নয়।
জিল প্রশ্ন করল– তাহলে আপনি কি মনে করেন সেই ছেলেটিই মিসেস লিয়নের হত্যাকারী? আর যেহেতু সে একজন বিকৃত মস্তিষ্কের, কোনো অজ্ঞাত কারণে সেইজন্যে এখানেও এসে পড়তে পারে সশরীরে?
আমাদের বিশ্বাস, এখানকার কোনো একজন বাসিন্দার সঙ্গে ওই মামলার কোনো সংযোগ আছে লঙরিজ ফার্মের সঙ্গে। এই যোগসূত্রটা জানতে পারলে বিষয়টা সহজ হয়ে আসত অনেকটা। এই যোগসূত্রটার সঙ্গে আপনার কোন যোগাযোগ নেই তাহলে মিঃ ডেভিস, মিসেস ডেভিস, আপনার কি এই একই বক্তব্য?
মলি বলল- আমি! ও…হ্যাঁ, নিশ্চয়…
এখানে কে কে অতিথি আছেন আর?
নামগুলো মলি একে একে বলে গেল। মিসেস বয়েল, মেজর মেটকাফ, মিঃ ক্রিস্টোফার রেন এবং মিঃ প্যারাভিসিনি। সমস্ত কিছুই ট্রেটার নোটবই খুলে লিখলেন।
ট্রেটার জিজ্ঞেস করলেন : চাকর-বাকর?
মলি জবাব দিল- আমাদের কোনো কাজের লোক নেই। এই দেখ, অনেকক্ষণ আগে আলুগুলো উনুনে চড়িয়ে এসেছিলাম সেদ্ধ করার জন্য, বেমালুম ভুলে গেছি সে কথাটাই। ভাগ্যিস মনে পড়ল আপনি চাকর-বাকরদের প্রসঙ্গটা তুললেন বলে।
দ্রুত পায়ে মলি বেরিয়ে গেল পড়ার ঘর ছেড়ে।
জিলের দিকে তাকিয়ে ট্রেটার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন–এই সমস্ত অতিথিদের সম্বন্ধে আপনি কি জানেন?
জিল ইতঃস্তত সুরে বলল– আমি…মানে আমরা…সত্যি বলতে কি, এদের সম্বন্ধে আমাদের খুবই সীমিত জ্ঞান। মিসেস বয়েল বোর্নমাউথের এক হোটেল থেকেই চিঠি পাঠিয়েছিলেন আমাদের এখানে। মেজর মেটকাফ লিমিংটন থেকে এসেছেন। কেনসিংটনের একটা প্রাইভেট হোটেলে থাকতেন মিঃ রেন। একমাত্র প্যারাভিসিনিই যেন আকাশ থেকে এসে পড়লেন। কিংবা বলা যেতে পারে বরফের জটিল আস্তরণ ভেদ করেই আবির্ভাব হয়েছিল তার। ভদ্রলোকের গাড়িটা আটকে পড়েছিল মাঝরাস্তায় বরফে।…তবে আমরা ধারণা, প্রত্যেক অতিথিই তাদের পরিচয়পত্র বা ওই জাতীয় কিছু নিশ্চয় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন।
ট্রেটার বললেন–হ্যাঁ, সেই সমস্ত ব্যাপারে আমি ঠিকসময়ে খোঁজখবর নেব।
জিল সহজ কণ্ঠে মন্তব্য করল– তবে একদিক দিয়ে আমাদের ভাগ্য ভালো। এই প্রচণ্ড দুর্যোগের মধ্যে সহজসাধ্য হবে না খুনীর আবির্ভাব।
ট্রেটার বললেন- হয়তো তার প্রয়োজন নেই আর মিঃ ডেভিস। জিল বড় বড় চোখে চেয়ে রইল। তারপর বলল– তার মানে? আপনি কি…?
দুদিন আগে মিসেস গ্রেগ মারা গিয়েছেন। আপনার প্রত্যেক অতিথি তো উপস্থিত হয়েছেন তারপরে, তাই নয় কি?
তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু একমাত্র মিঃ প্যারাভিসিনি ছাড়া প্রত্যেকেই তো আগে থেকে বুক করে রেখেছিলেন খবর দিয়ে।
সার্জেন্ট ট্রেটার গভীর নিঃশ্বাস ফেলেন একটা। তার কণ্ঠস্বরেও যেন একটা ক্লান্তির ছাপ। তিনি বললেন– এই খুনগুলোও আগে থেকেই ঠিক করা ছিল।
খুনগুলো সম্বন্ধে আপনি কি বলতে বা বোঝাতে চাইছেন? আমি তো একটা খুনের কথাই জানি। আরও খুনের সম্বন্ধে বা আপনি কিভাবে এতটা নিশ্চিত হচ্ছেন?
ট্রেটার বলল– কথাটা আপনি একপক্ষে ঠিকই বলেছেন। আগামী খুনটা আমর উচিত ছিল প্রতিরোধ করা। অন্ততপক্ষে তার জন্য চালিয়ে যাওয়া উচিত প্রচেষ্টা!
জিলের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল উত্তেজনায়। সে বলল– তবে…তবে আপনার আশঙ্কা সত্যি হয় যদি, এখানে একজন অতিথির সঙ্গেই ওই ছেলেটির বয়স মিলে যায় খুব। তিনি হলেন ক্রিস্টোফার রেন।
স্টাডিরুম থেকে সার্জেন্ট বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোলেন।
ট্রেটার বলল–মিসেস ডেভিস, আপনি আমার সঙ্গে একবার লাইব্রেরী ঘরে এলে আমি খুব খুশি হব। আমি সকলের সামনে বক্তব্য রাখতে চাই কতগুলো। অতিথিদের খবর দেবার জন্য মিঃ ডেভিসকে আমি পাঠিয়ে দিয়েছি।
ওয়ালটার র্যালে কি কুক্ষণেই যে এই বস্তুটির অবিষ্কার করেছিলেন, সেই কথা ভাবলেই আমি অবাক হয়ে যাই মঝে মধ্যে!
সার্জেন্ট ট্রেটার রসিকতাটি ঠিকমতো বুঝতে পারল না। তার মুখ ব্যাজার হয়ে এল বিরক্তিতে। মলিও নিজেকে সামলে নিল। কণ্ঠে ক্ষমা প্রার্থনার বিনীতভঙ্গি। সে বলল– আমি যেন এখনও ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছি না সম্পূর্ণভাবে।…ভাবতে গেলে এত অবাস্তব বলে মনে হয়…
এর মধ্যে অবাস্তবতা বলে কিছু নেই, মিসেস ডেভিস। সমস্তটাই যেন নিখুঁত পরিকল্পনা।
মলি জিজ্ঞাসার সুরে বলল- আচ্ছা লোকটার চেহারার বিবরণ নিশ্চয়ই আপনারা জানতে পেরেছেন?
ট্রেটার বলল- উচচতা মাঝারি, স্বাস্থ্যও খুব ছিপছিপে। গায়ে গাঢ় কালো রঙের ওভারকোট, বেশির ভাগটা মাফলারে ঢাকা। নিশ্চয় আপনি বুঝতে পারেন, যে কোনো সাধারণ লোকের চেহারার সঙ্গে এ বর্ণনা সম্পূর্ণ মিলে যায়। কিছুক্ষণ থেমে ট্রেটার বললেন আপনাদের বড় হলঘরটাতেও তো আমি তিনটে কালো ওভারকোট আর তিনটে হাল্কা বাদামী টুপি দেখলাম।
কিন্তু লণ্ডন থেকে তো কেউই আসেননি এখানে?
ট্রেটার বললেন– সত্যিই কি তাই, মিসেস ডেভিস? তারপরেই ট্রেটার দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে কোণের দিকে বড় টেবিল থেকে একটা খবরের কাগজ নিয়ে বললেন- এটা হচ্ছে উনিশে ফেব্রুয়ারীর ইভনিং স্ট্যাণ্ডার্ড। অর্থাৎ দুইদিন আগের লণ্ডনের সংস্করণ। নিশ্চয় পত্রিকাটি কেউ এখানে নিয়ে এসেছেন– তাই না?
মলি চোখদুটো বড় বড় করে তাকিয়ে বলল– কি আশ্চর্যের ব্যাপার। কোথা থেকেই বা এখানে এটা আসতে পারে। মনের অবচেতনে অস্পষ্ট এক স্মৃতির অনুরণন ঘটল তার।
ট্রেটার বললেন– লোকের মুখের কথাই সব সময় ঠিক বলে জেনে নেওয়া উচিত নয়। তাছাড়া যে সমস্ত অতিথিদের আপনি আশ্রয় দিয়েছেন এখানে তাদের সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানেন না আপনি একটুখানি থেমে ট্রেটার আবার বললেন আমার ধারণা, ব্যবসার ক্ষেত্রে দুজনেই একবারে আপনারা নবাগত।
ঘাড় নেড়ে মলি সায় দিয়ে বলল– হ্যাঁ আপনি ঠিকই ধরেছেন। এই মুহূর্তে তার নিজেকে আরো বেশি অনভিজ্ঞতা আর বেশি ছেলেমানুষ বলে মনে হচ্ছে।
ট্রেটার বলল- আপনাদের বিয়েটা খুব বেশিদিন হয়নি বলে মনে হচ্ছে।
মলির গলায় লজ্জার সুর ফুটে উঠল। সে বলল– সবে এক বছর এবং সেটাও ছিল খুব হঠাৎ!
অনুকম্পার ভঙ্গিতে ট্রেটার বলল– প্রথম দর্শনেই প্রেম, ওই জাতীয় কিছু তাই তো?
এ ধরনের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাকগলার জন্য মলি জানাতে পারল না কোনো তিরস্কার। শান্তভাবে মাথা দুলিয়ে বলল- হ্যাঁ। তারপর হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার জন্য দৃঢ় স্বরে বলল– বিয়ের আগে পনের দিনের পরিচয় আমাদের।
বিয়ের আগের উজ্জ্বল স্মৃতিতে তার চোখ দুটো আনন্দে নেচে উঠল। মধুর আবেশে তার বুকটা ভরে উঠল। তারা দুজনেই দুজনকে চেনে, জানে, এর মধ্যে কোনো ভুল নেই। দুঃখ দুর্দশায় ভরা পৃথিবীর বুকের ওপর তাদের দুজনের এই সাক্ষাৎটা খুব আশ্চর্যের হওয়াই স্বাভাবিক। একে অন্যের হৃদয়ে কি গভীর সুখই না বয়ে চলে। নিজের অজান্তেই একটা পাতলা হাসির রেখা সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল।
চমকে উঠে মলি নিজেকে সংযত করল। সার্জেন্ট ট্রেটার বেশ প্রশ্রয়পূর্ণ দৃষ্টিতেই তাকে দেখছিলেন?
ট্রেটার জিজ্ঞেস করলেন– আপনার স্বামী এ অঞ্চলের নিশ্চয় বাসিন্দা নন।
মলি হালকা ভবে মাথা নেড়ে বলল–না, ওর বাড়ি লিঙ্কনশায়ারে।
মলি জানালো তবে জিল ছেলেবেলায় কোথায় কিভাবে মানুষ হয়েছে তা সে জানে না, জিলের বাবা-মা এখন আর বেঁচে নেই– এইটুকুই সে জানে আর পুরনো দিনের কথা উঠলেই এড়িয়ে যায় জিল। মলির ধারণা, জিল খুব অসুখী ছিল ছেলেবেলায় তাই সেদিনগুলোকে সে ভুলে হকতে চায়।
ট্রেটার আবার মুখ খুললেন– কিছু মনে করবেন না, তবে হোটেল ব্যবসা চালাবার পক্ষে আপনাদের খুব অল্প বয়স।
বেশ! এ ব্যাপারে সে সম্বন্ধে কোনো রারি বিধিনিষেধ আছে কি? আর তাছাড়া বয়স বাইশ বছর হতে চলল আমার।
ট্রেটার আনন্দ মনে মহা দুলিয়ে বলল– হ্যাঁ, তাহলে মিসেস ডেভিস, আপনি নিশ্চয় এর জন্য প্রস্তুত? সার্জেন্ট ট্রেটার লাইব্রেরী ঘরে পা রাখতে না রাখতে সবাই যে যার বক্তব্য পেশ করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল।
ক্রিস্টোফার রেনের তীক্ষ্ণ গলাই প্রথমে তীরের মত বিদ্ধ করল কানে। তিনি যে এই বিষয়ে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন এবং রাতভোর তিনি যে আজ দু-চোখের পাতা এক করতে পারেননি সেই কথাই বললেন তিনি দৃঢ়স্বরে। আনুপূর্বিক সমস্ত বৃত্তন্ত শোনার জন্যও তার আগ্রহ কিছুমাত্র কম দেখা গেল না।
মিসেস বয়েলের মেদবহুল গলা ভেদ করে একথা চাপা ক্রদ্ধ ঘরঘরে আওয়াজ বের হল। অপদার্থ। সম্পূর্ণ অপদার্থ! এইভাবে একজন খুনে পাগলকে রাস্তায় চলাফেরা করতে দেওয়া যে কতটা বিপজ্জনক তা দায়িত্বজ্ঞান পুলিস কর্তৃপক্ষের বোঝা উচিত।
মিঃ প্যারভিসিনি স্বগতোক্তির সুরে হাত নেড়ে বলল। কিন্তু অঙ্গভঙ্গিই তার সার হল। মিসেস বয়েলের মোটা ঘরঘরে গলার নিচে তার সমস্ত বক্তব্যই চাপা পড়ে গেল। মেজর মেটকাফের হাবভাবেও একটা অধৈর্য্যের ছাপ লক্ষ্য করা যায়। তিনি মূল তথ্যগুলো ঠিকভাবে বুঝে নিতে চাইছিলেন।
ট্রেটার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর সকলকে থামিয়ে দেবার জন্য হাত তুললেন। তার চালচলনে পরিপূর্ণ কর্তৃত্বের আভাস। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, সঙ্গে সঙ্গেই সকলে থেমে গেল। ঘরের মধ্যে এখন শুধু নীরবতা।
ট্রেটার মুচকি হেসে বলল– ধন্যবাদ। মিঃ ডেভিসের কাছে আপনারা নিশ্চয় এতক্ষণে আমার আসার কারণটা শুনেছেন? আমি সঠিক উত্তরটা আপনাদের কাছ থেকে জানতে চাই। লরিজ ফার্মের ওই মামলাটার সঙ্গে কি আপনারা কেউ কোনোভাবে জড়িত ছিলেন?
ঘরের মধ্যে আবার দেখা দিল নীরবতা যেটা ছিল খুবই স্বস্তিকর। ভাবলেশহীন চারটে মুখ ট্রেটারের চোখের দিকে চোখ রাখল। কিছুক্ষণের পর উত্তজনা ও চাঞ্চল্যটুকুও যেন ব্লটিং পেপারের মত সবার মুখ থেকে শুকিয়ে গেল।