দি পেল হর্স – ৫

পঞ্চম অধ্যায় 

—আঃ কি সোয়াস্তি পেলাম। গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন মিসেস অলিভার–বুঝেছি ব্যাপারটা শেষ হয়ে গেছে এবং কিছুই ঘটেনি। 

আমোদ প্রমোদে গা ঢেলে দেওয়ার সময় এটা। রোডার উৎসব সব সময় সঠিকভাবে উৎসবের মধ্য দিয়েই শেষ হয়ে থাকে। খুব ভোর থেকেই আবহাওয়ার তীব্র খামখেয়ালিপনা তাই এবারে সবার মনে ছিল দারুণ উৎকণ্ঠা। রীতিমতন তর্কাতর্কি শুরু হলো যে, খোলা জায়গায় দোকানঘরগুলো বানানো হবে কিংবা গোটা উৎসবের ব্যবস্থা করা হবে বিস্তৃত খামারবাড়ি এবং তাঁবুর মধ্যে। চা পানের ব্যবস্থা তাঁর কুটির শিল্পের দোকানঘরগুলো সম্পর্কে স্থানীয় লোকজন বেশি মাথা ঘামাচ্ছিল। বেশ বুদ্ধি খাটিয়ে রোডা সব বিবাদবিসম্বাদ মিটিয়ে ফেললো। মাঝে মাঝে রোডার খুশমেজাজী কিন্তু ছটফটে কুকুরগুলো বাইরে বেরিয়ে আসছিল। 

এই দারুণ উৎসব উপলক্ষেই কুকুরগুলো লাগাম ছাড়া বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সন্দেহ সঙ্গত। বিবর্ণ লোমের ঠাস বুনুনি পোশাকপরা এক সুদর্শনা তারকা সুন্দরীর আগমন হলো। এই আমোদ-প্রমোদ উৎসবের উদ্বোধন করে সুন্দরী মনোহরভঙ্গীতে দু-চারটে কথাও বললো। গীর্জার ছাদ বানানোর খরচ তোলবার জন্য এই উৎসবের ব্যবস্থা হলেও সুন্দরী দেশছাড়া মানুষদের আগমন নিয়ে ভাষণ দিলো। এরপর শুরু হলো উৎসব। 

ভিড় উপছে পড়লো সারি সারি বোতল সাজানো পানীয়ের দোকানে। চা পানের সময় হৈ চৈ লেগে গেল। অতিথি অভ্যাগতরা একই সঙ্গে সবাই ব্যগ্র হয়ে উঠেছিলো চা পানের জন্য তাঁবুর মধ্যে ঢুকতে। 

অবশেষে শুভ সন্ধ্যায় আবির্ভাব ঘটলো। বিস্তৃত খামার বাড়ির মধ্যে তখনও স্থানীয় নরনারীর নাচ জমজমাট হয়ে উঠেছিলো। বাজি পোড়ানো আর অগ্নি উৎসবের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু গ্রামের পরিবারগুলো এখন ক্লান্ত-তারা বাড়ির মুখে হাঁটা দিল। 

—নিজের নিজের বাড়ির খাওয়ার ঘরে টেবিলে ওরা গিয়ে বসবে আর খাবে ঠান্ডা ডিনার। ক্লান্ত একঘেয়ে সুরে দিনটা কেমনভাবে কাটলো তাই নিয়ে সবাই আলোচনায় মেতে উঠবে। সবাই সবার নিজের কথা বলবে।—অপরের কথা শোনবার ধৈর্য্য কারো নেই। এসবই কেমন এলোমেলো—কিন্তু আরামদায়ক। 

বাঁধন ছাড়া কুকুরগুলো টেবিলের নিচে মনের সুখে হাড় চিবোতে ব্যস্ত। 

—শিশু মঙ্গলের এই উৎসবে আসছে বছর আমরা আরো বেশি আনন্দ করবো।—মৃ-দু কণ্ঠে বলল রোডা। 

—শিশুদের জন্য নিযুক্ত স্কটল্যান্ডবাসী গভর্নেস মিস ম্যাকলিস্টার বললো-কিছু ব্যাপার আমার কাছে বড় তাজ্জব মনে হচ্ছে, পরপর তিন বছর মাইকেল বেন্ট্র কি করে মাটিতে পুঁতে রাখা সম্পদের হদিস পেলো। সে কি আগে থাকতে কোথায় পোঁতা হবে তার খবর পেয়েছিলো? 

—লেডি ব্রুকব্যাঙ্ক শুয়োরটা জিতে নিয়েছে, বলতে লাগলো রোডা—মনে হয় না, ও শুয়োরটা জিততে চেয়েছিলো। খেলার শেষে তাকে দারুণ লজ্জিত দেখাচ্ছিল। 

আমার ভগ্নি রোডা ও তার স্বামী কর্নেল ডেসপার্ড ঐ ডিনার পার্টিতে হাজির ছিল। আর ছিলো মিস ম্যাকলিস্টার, তার মাথাভর্তি চুল। এক যুবতী যার নাম জিনজার, মিসেস অলিভার এবং পল্লী-পুরোহিত রেভারেন্ড ক্যালের ডেল ক্যালথ্রপ আর তার স্ত্রী। পল্লী-পুরোহিত ছিল বয়স্ক আলাপী পণ্ডিত মানুষ—কথায় কথায় ধ্রুপদীয় গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি আওড়াতে পটু আর এতেই দারুণ আনন্দ লাভ করে। এর ফলে একটা লজ্জাকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। কখনও কখনও কথাবার্তার আচমকা সমাপ্তি ঘটে। এখনও অবশ্য তেমনিটাই ঘটেছে। পল্লী-পুরোহিত এমনি একটা লোক যে কেউ তার কথাবার্তা শুনে খুশি হলো কিনা তা নিয়ে সে মাথা ব্যথা করে না। সে যে উদ্ধৃতি আওড়াবার অবসর পেয়েছে এটাই তার পুরস্কার। 

টেবিলের ধারে বসে পল্লী-পুরোহিত আওড়ায়—হোরেস বলেছেন…। বাক্যালাপে সাময়িক সমাপ্তি ঘটলো। তারপর। 

একটু চিন্তিতভাবে জিনজার বললো—মনে হয় মিসেস হসফিল এক বোতল শ্যাম্পেন দিয়ে ঠকিয়ে এমন কাজ করেছে। তার ভাইপোতে ওটা পেয়েছে। 

মিসেস ডেল ক্যালথ্রপ অপ্রতিভ স্বভাবের নারী। তার চোখ দুটো বড় সুন্দর, চিন্তিত মনে মহিলা তখন মিসেস অলিভারকে বোঝাবার চেষ্টা করছিলো। আচমকা মহিলা শুধালো—এই উৎসবে কি ঘটবে বলে তোমরা আশা করছিলে? 

—হাঁ খুনটুন এ ধরনের একটা কিছু কি? মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ কৌতূহলী হয়ে উঠল।

—কিন্তু খুনটুন হবে কেন? 

—কোনো কারণ তো তেমন ঘটেনি। সত্যিই এটা একেবারে অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু আমি একবার একটি উৎসবে গিয়েছিলাম সেখানে এরকম ঘটনা ঘটেছিলো। 

—বুঝেছি। আর তাতে তুমি দিশাহারা হয়ে পড়েছিলে কি? 

—দারুণভাবে হয়েছিলাম। 

পল্লী-পুরোহিত ল্যাটিন ভাষা ছেড়ে আওড়ালো গ্রীক ভাষায়। সবাই নীরব। 

উৎসবের সততা সম্বন্ধে মিস ম্যাকলিস্টারের মনে কিন্তু সন্দেহ। 

—কিংস আমর্স দোকানের বৃদ্ধা মহিলা লাগ্ এখানকার স্টলের জন্য বারো ডজন মদের বোতল পাঠিয়ে ভারি খেলোয়াড়ি মনোভাব দেখিয়েছে। বললো ডেসপার্ড। 

— তীব্র কণ্ঠে শুধালাম। কিংস আর্মস দোকান? 

—আমাদের এখানকার দোকান ওটা। রোডা বলল। 

—এখানে আর কি কোনো মদের দোকান নেই? আচ্ছা তুমি কি পেল হর্সের নামে কোনো দোকানের কথা বলেছিলে। মিসেস অলিভারকে শুধালাম। 

আমার মনের আশার প্রতিক্রিয়া ঘটলো না। নির্বিকার মুখগুলো আমার দিকে ফেরানো।

রাডা বলল, পেল হর্স মদের দোকান নয়, বলছি না…।. 

—এটা একটা পুরানো সরাইখানা, বললো ডেসপার্ড। 

—বলছি ওটা বোধ হয় হয় ষোড়শ শতাব্দীতে তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু এখন এখানে আর কিছু নেই। একটা সাধারণ বাড়ি। তাই তো ভাবি এখন ওদের নামটা পালটানো উচিৎ। 

—না, না। কিছুতেই না। বললো জিনজার—এটার নাম ওয়েসাইড অথবা ফেরার ভিউ রাখা খুবই ছেলেমানুষি হবে। আমার ধারণা পেল হর্স নামটাই বেশি সুন্দর এবং পুরানো সরাইখানার নাম লেখা একখানা সুন্দর সাইন বোর্ডও ওখানে হলের মধ্যে ঝোলানো রয়েছে। 

—কারা সরাইখানার মালিক শুধালাম। 

—সরাইখানার মালিক হিরজা গ্রে, বললো রোডা। 

—জানি না, আজ তুমি তাকে ওখানে দেখতে পাবে কিনা। দীর্ঘদেহী মহিলা মাথায় কদমছাঁটা পাকা চুল। 

—মহিলা দারুণ হটযোগে বিশ্বাস করে, বললো ডেসপার্ড-প্রেততত্ত্ব সম্মোহন বিদ্যা আর যাদু রহস্য নিয়ে মাথা ঘামায়। ঠিক মারণ বিদ্যা নয়। তবে ওই ধরনের জিনিস, জিনজার সহসা বেদম হাসতে শুরু করলো। তারপর হাসি থামিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বললো—ভাবছিলাম যেন মিস গ্রে মখমলের বেদীর উপর মাদাম ডি মনটেস্ প্যান বসে আছেন। 

—জিনজার। বললো রোডা—পল্লী-পুরোহিতের সামনে একথা বলো না। 

একেবারেই না, লজ্জিত পল্লী-পুরোহিত বললো – প্রাচীন লেখকরা বলেছেন…। বেশ কিছুক্ষণ পল্লী-পুরোহিত গ্রীক ভাষায় উদ্ধৃতি আওড়ালো। 

ঘরের মধ্যে নীরবতা নেমে এলো। 

একসময় আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে বললাম—মিস গ্রে, আমি কিন্তু এখনও জানতে চাই ওরা কে? এবং ওদের সাথে আর কে কে আছে? 

—ওহো, একজন বন্ধু থাকে মহিলার সাথে। সিবিল স্ট্যামফোবাওস্ আমার বিশ্বাস তার উপরই অপদেবতা ভর হয়। তাকে নিশ্চয় দেখেছো। গলায় হাড় আর পুঁথির মালা পরে। মাঝে মাঝে পরিধান করে শাড়ি। কেন পরিধান করে তা ভাবতে পারছি না। ও তো কোনোদিন ভারতবর্ষে যায়নি। 

এবং তারপর রয়েছে বেল্লা, মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ বললো—মেয়েটি ওদের রাঁধুনী। সেও ডাইনী। লিটল ডানিঙ গ্রামের মেয়ে। সে যে ভালোভাবে ডাইনীবিদ্যা রপ্ত করেছে তা গ্রামের লোক ভালোভাবে জানতো। এটা ওদের পারিবারিক বিদ্যা। মেয়েটির মা-ও ছিলো ডাইনী। সাধারণভাবে কথাগুলো আওড়ালেন মহিলা। 

বললাম—আচ্ছা মিসেস ডেন, তুমি এমনভাবে কথা বলছো যেন ডাইনী বিদ্যায় তুমি বিশ্বাস করো। 

—কিন্তু নিশ্চয় করি। ডাইনীবিদ্যার কোনো রহস্য নেই। অথবা নেই কারো কাছ থেকে সে কথা গোপন করে রাখা। এই বিদ্যা একেবারেই সাধারণ। এটা একটা পারিবারিক সম্পদ যা তুমিও উত্তরাধিকার হিসাবে পেতে চাইবে। ছেলেমেয়েদের বলতে হবে তারা যেন তাদের বিড়ালটাকে মারধোর করতে, অথবা মাঝে মাঝে লোকজন তোমার কাছে ঘরে তৈরি পনীর কিংবা জ্যাম তোমার কাছে উপহার হিসাবে পাঠাবে। 

মহিলার দিকে তাকালাম— 

আমার দু চোখে সন্দেহের কালো মেঘ জমেছে। মহিলাকে খুব আন্তরিক এবং ভাবগম্ভীর মনে হচ্ছে। 

—ভাগ্য ফেরাতে সিবিল আজ আমাদের সাহায্য করছে, বললো রোডা—জুয়া খেলার তাবুতে সে বসেছিল। আমার বিশ্বাস, একাজ সে ভালোই পারে। 

—আমাকে সে বহু টাকা পাইয়ে দিয়েছে। বললো জিনজার—টাকা আমি পেয়ে গেছি। সমুদ্রের পরে এক কৃষ্ণকায় বিদেশিনী নারী। সুদর্শনা। তার সাথী দু দুটো স্বামী আর ছটা ছেলেমেয়ে, সত্যি ভারি সাদাসিধে মেয়েটা। 

—কার্টিস মেয়েটাকে আমি হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসতে দেখেছিলাম। রোডা বলল—এবং তার ছোকরা মরদটার সাথে মস্করা করছিলো। বলেছিল যে সমুদ্রবেলায় সেই সবেধন নীলমণি নুড়ি নয়। 

–সে কি ফিরে আসতে চায় না কি? রোডার স্বামী জানতে চাইলো। 

–হাঁ। মেয়েটা আমার কাছে কি শপথ করেছিলো তা তোমাদের কাছে ভাঙছি না। বললো সে—প্রিয়া আমার, তুমি হয়তো সে কথা পছন্দ করবে না। 

—টমের ভালোর জন্য। 

—বুড়ি মিসেস পার্কারের মন একদম বিরক্তিতে ভরে গেছে, হাসতে হাসতে বললো জিনজার। 

—মেয়েটি বললো, এসব বোকামি। তোমরা দুজনে এ কাজ কখনই করতে পারো না। কিন্তু তখন মিসেস ক্রিপস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলো আমার মতন লিজি তুমি জানো যে অন্যেরা যা দেখতে পায় না মিস স্ট্যামফোর্বাওস তা দেখতে পায় এবং মিস গ্রে সে দিনটি জানে কখন মৃত্যু ঘটবে। রমণীর ভবিষ্যদ্বাণী কোনোদিন ভুল হয়নি। মাঝে মধ্যে মনে হয় আমার দেহের মধ্যে যেন একটা কিছু শিরশির করে চলেছে। এবং মিস পার্কার বললো—মৃত্যু—এক ভিন্ন বস্তু। মৃত্যু একটা দিন। এবং মিসেস ক্রিপস বললো—যা হোক আর যাই ঘটুক ওই তিনজনের মনে আমি আঘাত দিতে চাই না। আর আমি তা করবোও না। 

—খবরগুলোর মধ্যে যথেষ্ট উত্তেজনার খোরাক রয়েছে। আমার মন ওদের সাথে দেখা করতে চাইছে। মিসেস অলিভার আগ্রহ সহকারে বললো। 

কর্নেল ডেসপার্ড শপথ করলো—আমরা কাল তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাব। ওই সেকালের সরাইখানাটা সত্যিই দেখবার মতন। সরাইখানাটার চরিত্র না বদলে ওরা সেটাকে খুব আরামদায়ক করে তুলেছে খুবই চতুর পারদর্শিতায়। 

—আমি কালই সকালবেলায় ফোন করে দেবো হিরজাকে। রোডা বললো। আমি কাল রাতে ঘুমতে পেরেছিলাম একটু হাল্কা মনে এটা আমি স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি। পেল হর্স শব্দটা আমার কাছে অজানা এবং অশুভ বলে টানাপোড়েন চলছিল। এখন বুঝতে পারলাম যে ওটা সেরকম কিছু নয়। যদি কিনা এই পেল হর্স সম্বন্ধে আর কোথায়ও কিছু না থেকে থাকে? 

ঘুমিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত আমার মনের মধ্যে ধারণাটা ঘুরতে লাগলো। 

****

পরের দিন রবিবার। মনের মধ্যে আরাম উপভোগের নিখাদ বাসনা শুধু। একটা জলসার পর মনের যেমন অবস্থা হয় ঠিক তেমনি অবস্থা সরাইয়ের। হালকা বাতাসের ছোঁয়ায় কাত হয়ে পড়া তাঁবুগুলোর পর্দা উড়ছে—পরের দিন খুব ভোরেই খাদ্যদ্রব্য সরবরাহকারীর লোকজনরা এসে তাঁবুগুলো খুলে নিয়ে যাবে। সোমবার সকাল থেকে আমরা সবাই মিলে হিসেব নিকেশ করতে শুরু করলাম। এটাই হচ্ছে সকলের মনের ইচ্ছে—সব মিটিয়ে ফেলা ভালো। 

কাজকর্ম চুকে যাওয়ার পর বাইরে ঘুরে আসার ব্যবস্থা করলো রোডা নিজেই। তাই সবাই হাজির হলাম গীর্জায়। প্রার্থনা শুরু হয়ে গিয়েছে। মিস্টার ডেন ক্যালথ্রপ তখন ইসাইয়া থেকে পাঠ করে পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যা করেছেন।

—কিন্তু ব্যাখ্যায় তিনি যত না ধর্মের কথা বলেছেন তার চেয়ে বেশি পারস্যের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। 

রোডা প্রার্থনা সভা ভাঙার পর বললো, আমরা মিস্টার ভেনবলসের নিমন্ত্রণে তাঁর সাথে মধ্যাহ্নভোজ খেতে যাচ্ছি। তাকে তোমার ভালো লাগবে মার্ক। চলো সত্যিই আগ্রহ জাগানো মানুষ। সব জায়গায় ঘোরা আর সব কাজ করে, সব ধরনের আজব বস্তু সম্পর্কে তার জানাশোনার অন্ত নেই। বছর তিনেক আগে প্রায়রকোর্টে বাড়িখানা কিনেছিলো। কেনার পর যেভাবে বাড়িখানার হাল ফিরিয়ে নিয়েছেন, ততে মনে হয় বহু অর্থ খরচ করতে হয়েছে তাকে, এক সময় পোলিও রোগে ভোগার ফলে তার নিম্নাঙ্গ কুঁকড়ে গিয়েছে—তাই এখন চাকালাগানো চেয়ারে বসে সে চলাফেরা করে। বড় দুঃখজনক ঘটনা—কেননা আমার বিশ্বাস আগে দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানো তার অভ্যাস ছিলো। এখন অবশ্য ওর পুঁজি সামান্য রোল করে চলেছে। জমেছে ধন সম্পদের পাহাড়—এসব বলছি কেননা প্রায় ভেঙে পড়া বাড়িখানা কি চমৎকার ভাবে বানিয়ে নিয়েছে। ওর বাড়িতে জাঁকালো পোশাকপরা অনেক চাকর বাকর কাজ করে। বাড়ির ঘরগুলো সাজানো গোছানোর জন্য সে খুবই গর্বিত। ‘প্রায়র কোর্ট বাড়িখানা এখান থেকে প্রায় কয়েক মাইল দূরে। আমাদের নিয়ে গাড়ি ওখানে হাজির হতে গৃহকর্তা চাকালাগানো চেয়ারে বসে নিজেই চাকা ঘুরিয়ে দালান পেরিয়ে আমাদের সম্বর্ধনা জানাতে এলেন। 

তোমরা সবাই এসেছো বলে আমার দারুণ ভালো লাগছে। আন্তরিকতার সুরে সে বললো। কাল সব কাজকর্ম শেষ হলে তোমরা নিশ্চয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলে। রোডা তোমাদের উৎসব খুবই সফল হয়েছে। প্রায় বছর পঞ্চাশ বয়স হবে মিস্টার ভেনবলসের। বাজপাখীর মতন শীর্ণ মুখমণ্ডল, চঞ্চুর মতন নাসিকাটা উদ্ধত ভঙ্গিতে উঁচিয়ে রয়েছে। পরনের জামাটার কলার দুধার খোলা—এটাই প্রমাণ করেছে তার মন ছিল সেকালে। 

রোডা সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। 

মিসেস অলিভারের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো ভেনবলস। 

—কাল এই মহিলাকে আমি তার বৃত্তিমূলক কাজ করতে দেখেছি। তাঁর লেখা ছ-খানা বইয়ে তিনি সই করে দিলেন। খ্রিসমাসের ছটি উপহার। আপনি ভারি সুন্দর লেখেন, মিসেস অলিভার। আমাদের জন্য আরো বই লিখুন। আরো বেশি বেশি লিখতে পারেন না? তারপর জিনজারের দিকে তাকিয়ে সে বললো – ওহে খুকি, একটা জ্যান্ত হাঁস আমার হাতে দিয়ে দারুণ ঠকিয়েছিলে। 

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ভেনবলস—গত মাসের রিভিয়ু পত্রিকায় তোমার লেখা পড়েছি। 

—আমাদের মিলন উৎসবে আপনি যাওয়ায় আমরা সবাই খুব খুশি মিস্টার ভেনবলস। বললো রোডা—আপনার পাঠানো মোটা টাকার চাঁদার চেক আমরা পেয়েছি। আশা করিনি যে—আপনি সশরীরে ওখানে হাজির হবেন। 

—ওহো, এ ধরনের মিলন উৎসব আমার খুব ভালো লাগে। ইংরেজদের গ্রাম্য জীবনের এটা একটা অংশ তাই না? 

উৎসবস্থলের দোকান থেকে একটা বড় পুতুল কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। আর মাথায় উজ্জ্বল জরিদার কাপড়ের পাগড়ি পরে এবং গলায় এক টন ওজনের কুটো মিশরীয় পুঁথির মালা ঝুলিয়ে আমাদের সিবিল আমার সম্বন্ধে যে আশ্চর্যজনক আর অবাস্তব ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলো তা শুনে এসেছি। 

—ভালোমানুষ বুড়ি সিবিল, বললো কর্নেল ডেসপার্ড—আজ বিকেলে আমরা ওখানে যাচ্ছি থিরজার চায়ের নিমন্ত্রণ রাখতে। জায়গাটি ভারি আকর্ষণীয়। 

—পেল হর্স? হ্যাঁ। আমার ধারণা এখনও ওটা সরাইখানাই রয়েছে। সব সময় মনে হয় সরাইখানাটা রহস্যে আচ্ছন্ন। আর ওটার অতীত ইতিহাস হচ্ছে অস্বাভাবিক দুষ্কৃতির ঘটনায় ভরা। যে দুষ্কৃতি চোরাচালান এমন কি তার কাছাকাছি কাজ নয়। এটা বোধ হয় পথ দস্যুদের একটা ডেরা ছিল। কিংবা ধনবান পথিকরা ওখানে রাত কাটাতো এবং তারপর থেকে আর তাদের কোনো হদিস পাওয়া যেতো না। মনে হয় এখন ওটা তিন জন বৃদ্ধার পছন্দসই বাসস্থান হয়ে উঠেছে। 

—ওহো! ওদের সম্পর্কে এমন সব কথা ভাবিনি। বললো রোডা সিবিল স্ট্যামফোবাওস সব সময় শাড়ি পরে থাকেন। তার আচার আচরণ এমন আজগুবি যে সে সব সময় লোকজনের মাথার পিছনে ক্ষীণ আলোকপ্রভা দেখতে পায়। সত্যিকারের মোহময় আকর্ষণ তাই না? সে যে তোমার মনের কথা জানে এটা তুমি নিজেই অনুভব করতে পারবে। তার অতীন্দ্রিয় দৃশ্য দেখার শক্তি সম্পর্কে নিজে কোনো কথা না বললেও ও প্রত্যেককেই বলে তার এ শক্তি রয়েছে। বেল্লার দু দুটো স্বামী করে দিয়েছে সে এখনও বুড়ি হয়নি। 

কর্নেল ডেসপার্ড কথাগুলো বললো। হাসতে হাসতে বললো ভেনবলস—ওর হয়ে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাইছি। 

ডেসপার্ড আবার বললো—ওদের মৃত্যু সম্পর্কে প্রতিবেশীরা যে সব কথা বলে তার অশুভ ব্যাখ্যা হচ্ছে, ওরা স্বামীরা বেল্লাকে অখুশি করেছিলো—কাজেই সে তাদের দিকে তাকিয়েছিলো। তার চোখের দৃষ্টিতে ছিলো এক ধরনের দ্যুতি। এর ফলে তারা অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং তাদের দেহ যায় শুকিয়ে। 

—কথাটা ভুলে গেছি। ও অবশ্যই স্থানীয় ডাইনী হবে? 

—মিসেস ডেন ক্যালথ্রপও তাই বলে। 

—পঙ্গু ভেনবলস চিন্তিত মনে বললো, ডাইনীবিদ্যা তো বড় মজার ব্যাপার। সারা পৃথিবীজুড়ে এদের জাত রয়েছে। আমি যখন পূর্ব আফ্রিকায় ছিলাম…। সে সহজ গলায় মজার মজার কথা বলতে শুরু করলো এ বিষয়ে। সে বললো—আফ্রিকার জড়িবুটি দেওয়া বদ্যিদের কথা, আর বললো বোর্নিওর স্বল্প পরিচিত ধর্মীয় আচরণের কাহিনী—এবং শপথ করলো লাঞ্চ খাওয়ার শেষে সে পশ্চিম আফ্রিকার যাদুকরদের ব্যবহার করা মুখোশের কিছু কিছু নমুনা দেখাবে। 

রোডা হেসে বললো—এ বাড়িতে সব কিছুই আছে। 

সে কাঁধ নাচিয়ে বললো ঠিকই তো। কেউ যদি সবকিছু দেখতে না পায় তবে তার কাছে সবকিছু আনার ব্যবস্থা করতে হবে। 

নিমেষের মধ্যে তার কণ্ঠস্বরে বিরক্তির ভাব বোঝা গেল। নিজের পঙ্গু পা দুটোর দিকে বারেক তাকালো। 

—বিশ্বে অসংখ্য ধরনের বস্তু রয়েছে। ভেনবলস বলতে লাগলো যে আমার মনে হয় এর জন্য আমার অক্ষমতা দায়ী। অনেক কিছু আমি দেখতে চাই জানতে চাই। আমার জীবনে এর জন্য কসুর আমি কম করিনি। কখনো কখনো হয়তো করেছি এইটুকুই আমার জীবনে সান্ত্বনা। 

–আচমকা মিসেস অলিভার শুধালো এখানে কেন? 

অন্যদের মনের সহজ ভাবটুকুর সুর সামান্য যেন ছিঁড়ে গেলো, হাওয়াতে যখন কোনো একটা বিয়োগান্ত ঘটনা ভেসে বেড়ায় তখন মানুষের মনের ভাব যেন পাল্টে যায়। কেবলমাত্র মিসেস অলিভারের মনে কোনো ভাবান্তর ঘটলো না। 

ব্যাপারটা শুধু জানবার জন্য মিসেস অলিভার জিজ্ঞাসা করেছিল। তার মনের সরল কৌতূহল পরিবেশ হালকা করে তুললো। 

ভেনবলস জিজ্ঞাসার সুরে তার দিকে তাকিয়ে ছিল।

—বলছি, মিসেস অলিভার বললো—এই গ্রামাঞ্চলে আপনি কেন বাস করতে এসেছেন। কত বস্তুর অস্তিত্ব রয়েছে, কত ঘটনা ঘটেছে দূর দূর অঞ্চলে। আপনার কি এখানে কোনো বন্ধুবান্ধব আছে? 

—না। কেন এই জায়গায় এসেছি সেটা জানতে চাইছেন বলে বলছি এখানে আমার কোনো বন্ধুবান্ধব নেই। 

তার মুখে এক টুকরো শ্লেষমিশ্রিত হাসি ভেসে উঠলো। 

অবাক মনে ভাবতে লাগলাম তার এই অক্ষমতা তার মনে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। সব দেশে দেশে স্বাধীনভাবে অবধারিতভাবে ঘুরে বেড়াবার অক্ষমতার জন্যই কি তার মন অত ক্ষতবিক্ষত? অথবা পরিবেশ বদলে যাওয়ার জন্য কি সে তুলনামূলকভাবে সত্যিকারের মহানুভবতার সাহায্যে নিজের মানসিক অবস্থাকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে, গড়ে তুলেছে মেজাজের সমতা? 

ভেনবলস বুঝি আমার মনের ভাবনা, বুঝতে পেরেই বললো, আপনার প্রবন্ধে মহানুভবতার সম্পর্কে একটা প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দেশগুলোতে এই শব্দটার যেসব অর্থ প্রচলিত হয়েছে সেগুলো আপনি তুলনামূলকভাবে বিচার করেছেন। কিন্তু এখানে এই ইংল্যান্ডে আজকাল একজন মহান মানব শব্দ সমূহ ব্যবহার করে আমরা কি বোঝাতে চাই? 

—বুদ্ধিজীবীদের মহানুভবতা নিশ্চয়, জবাব দিলাম, এবং সঙ্গে সঙ্গে একইভাবে নিশ্চয় বলেছি মানসিক শক্তির কথা, তাই তো? 

আমার দিকে সে তাকিয়ে রইলো, তার দৃষ্টি উজ্জ্বল এবং দ্যুতিময়। 

—আচ্ছা, দুরাত্মা বলে কি কোনো লোক সংসারে নেই? তবে কাকে মহানুভব মানব বলে বর্ণনা করা যাবে? জিজ্ঞাসা করলো ভেনবলস। 

—অবশ্যই আছে। সজোরে বলে উঠলো রোডা। নেপোলিয়ন এবং হিটলারের মতন এমন অনেক লোক রয়েছে। তাঁরা সকলে ছিলেন মহান মানব। 

—কেননা তাঁদের কর্মের ফল, তাই তো? শুধালো ডেসপার্ড—কিন্তু তাঁদের সাথে কেউ ব্যক্তিগত ভাবে পরিচিত হয়ে থাকলে তিনি প্রভাবিত হয়েছেন কি না সে সম্বন্ধে আমার মনে সন্দেহ আছে। 

জিনজার সামনে ঝুঁকে বসে নিজের ঝাঁকড়া চুলের মধ্যে আঙুল বুলাচ্ছিলো। 

—দারুণ মজাদার ভাবনা তো, বললো জিনজার-বোধহয় এমন মর্মস্পর্শী খর্বকায় রূপে বিবেচিত হওয়ার জন্য, কারণ কৃত্রিম ভঙ্গির জন্য অক্ষম ভাবে। 

রোডা দারুণ ভাবে প্রতিবাদ করলো—না একেবারেই না। তারা যদি অমন হতেন তবে তাঁরা কিছুতেই এ ধরনের কর্মফল লাভ করতে পারতেন না। 

—জানি না। মিসেস অলিভার বললো। তবে নির্বোধ একটা শিশু একটা বাড়িতে আগুন লাগাতে পারে। 

—শান্ত হোন। ভেনবলস বললো- সে ধরনের অমঙ্গলজনক বস্তুর সত্যিকারের অস্তিত্ব নেই, আজকের দিনে সে সব বস্তুর ক্রিয়াকলাপ দেখানোর চেষ্টা আমি পছন্দ করি না। জানি, পাপের অস্তিত্ব আছে। অমঙ্গলজনক ক্রিয়াকাণ্ড ঘটে। এবং পাপ খুবই শক্তিশালী। মাঝেমাঝে পাপের চেয়ে সততার শক্তি বেশি বলে প্রমাণিত হয়। কাজেই পাপ রয়েছে। তাকে চিনতে হবে—তার সাথে লড়াই করতে হবে। নইলে…। আচমকা দু’হাত ছড়িয়ে দিয়ে সে বললো—আমরা অন্ধকারে ডুবে যাবো। 

—অবশ্য শয়তানকে নিয়েই আমার কাহিনী দানা বাঁধে। মিসেস অলিভার ক্ষমা চাইলো এবং বললো–বলছি তাকে বিশ্বাস করি। কিন্তু সব সময় তার কাজকর্ম আমার কাছে ছেলেমানুষি বলে মনে হয়। তার পাগুলোতে খুর রয়েছে। আর একটা ল্যাজ আছে, আরো এমনি অনেক কিছু। মুক অভিনেতার মতো চারধারে ঘুরে বেড়ায়। অবশ্য মাঝে মাঝে আমি ভয়ঙ্কর দুষ্কৃতিদের কাহিনী লিখে থাকি। লোকজনেরা এমন কাহিনী পছন্দ করে। কিন্তু এসব দুষ্কৃতিদের ধরা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। কেউ তাকে চিনতে পারে না। আমিও তার কাহিনী আকর্ষণীয় করে তুলি—কিন্তু রহস্যের সমাধান যখন হয়ে যায় তখন মনে হয় সবটা যেন বলা হলো না। এ হচ্ছে এক ধরনের কাহিনীর শেষভাগের গুরুত্বহীনতা। এর চেয়ে ব্যাঙ্কের তহবিল তছরূপকারী কোনো ম্যানেজার অথবা স্ত্রীর হাত থেকে মুক্ত হয়ে বাচ্চাদের ধাত্রীকে শাদি করতে ইচ্ছুক স্বামীর কাহিনী লেখা খুবই সহজ আমার কথা বুঝলে তো। 

সবাই হেসে উঠলো। 

মিসেস অলিভার ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বললো, জানি খুব গুছিয়ে বলতে পারলাম না। কিন্তু যা বললাম তা বুঝেছো তো?