দি পেল হর্স – ৭

সপ্তম অধ্যায় 

—এই যে তোমরা ফিরলে এতক্ষণে। আমরা ভাবছিলাম, তোমরা গেলে কোথায়! খোলা দরজা পেরিয়ে বাইরে আসতে রোডা শুধালো। তার পেছন পেছন অন্য সবাই বেরিয়ে এলো। চারদিকে এক নজর বুলিয়ে আবার বললো –তুমি কি এইখানে সাধনা করো তাই না? 

— ঠিক জেনেছো। থিরজা গ্রের মুখের হাসি ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে গেলো – তোমার কাজকর্ম সম্বন্ধে তোমার চেয়ে বেশি জেনে ফেলে গ্রামের লোকজন। শুনলাম তোমার সম্বন্ধে গ্রামে নাকি দারুণ দুর্নাম রটে গেছে। একশো বছর আগে এমন ঘটনা ঘটলে ডুবিয়ে মারা হতো, সাঁতরে পালাতে হতো আর না হয় চিতায় জ্বলতে হতো। আমার একজন অতি প্রমাতামহী কিংবা এক বা একাধিক আমাদের বংশের প্রাচীন মহিলাকে ডাইনী বলে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। আমার বিশ্বাস, ঘটনাটা ঘটেছিল আয়ারল্যান্ডে। সে সব দিন এমনই ছিলো। 

—সব সময় আমার ধারণা ছিলো যে তুমি স্কটল্যান্ডের অধিবাসিনী। 

—বাবার দিক থেকে আমি স্কটল্যান্ডের, কিন্তু মায়ের দিক দিয়ে আয়ারল্যান্ডের সেই রক্তধারা আমার শরীরে বইছে। আমাদের সিবিল হচ্ছে অজগরনাগিনী গ্রীকজাতীয় রক্ত বইছে ওর ধমণীতে আর সেকালের ইংরেজ ঘরের মেয়ে বেল্লা। 

—ভয়ানক তীব্র এক মানব জাতীয় মিশ্র সুরা। মন্তব্য করলো কর্নেল ডেসপার্ড।

—তুমি যেমন ইচ্ছে বলতে পারো। 

জিনজার বললো, বড় মজা তো। থিরজা বারেকের জন্য দেখলো জিনজারকে। 

—হাঁ একদিক দিয়ে তাই বটে। মিসেস অলিভারের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো থিরজা। ইন্দ্রজালের দ্বারা একজনকে খুন করা হয়েছে এমন একটা কাহিনী নিয়ে বই লেখো তুমি। ইন্দ্রজাল সম্বন্ধে অনেক খবরাখবর আমি তোমাকে দিতে পারবো। লজ্জিত মিসেস অলিভার ক্ষণেক তাকে শুধু দেখলো। তারপর ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বললো—দেখো আমি শুধু সাধারণ মানুষের খুনের কাহিনী নিয়ে লিখি। তার বলার ধরনটা এমন যেন কেউ বলছে—আমি শুধু সাধারণ রান্নাবান্না রাঁধতে পারি। তারপর মিসেস অলিভার আরো বললো—ঠিক এমন লোকের সম্পর্কে লিখি যে তার পথের কাঁটা উপড়ে ফেলতে চেষ্টা করে চতুরতার সঙ্গে। 

—তবে আমার কথা হলো তারা খুবই চতুর। ডেসপার্ড বললো। হাতের কব্জিতে বাঁধা ঘড়িটা এক পলক দেখে বললো—রোডা মনে হয়…। হাঁ, এবার আমাদের উঠতে হবে। মনে হচ্ছে, আমাদের খুব দেরি হয়ে গেছে। বিদায় নেওয়ার পালা চুকলো। আমরা আর বাড়ির ভেতর গেলাম না। পাশের একটা গেট দিয়ে বাইরে চলে এলাম। 

কর্নেল ডেসপার্ড তারের জাল দিয়ে ঘেরা একটা জায়গা দেখিয়ে বললো—অনেক মুরগী পোষ দেখছি। 

—মোরগগুলিকে আমি দু চোখে দেখতে পারি না – জিনজার বললো—এমন বিশ্রীভাবে ওরা ডাক ছাড়ে। 

—বোধহয় ওগুলো ককরেল জাতের মোরগ। এবার যে কথা বললো সে বেল্লা। বাড়ির খিড়কির দরজা দিয়ে সে বেরিয়ে এসেছে। 

—সাদা ককরেল জাতের মোরগ ওগুলো। বললাম। 

—ওগুলো কি টেবিল বার্ড? ডেসপার্ড শুধালো। বেল্লা জবাব দিলো—ওগুলো আমাদের প্রয়োজন মেটায়। আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ছোটখাটো মুখখানা বিস্ময়ে হতবাক্। মুখের হাঁ খানা যে টানা বক্র রেখা। দু চোখে ধূর্ত সন্ধানী দৃষ্টি। 

—ওদের দেখাশোনা করার কাজ বেল্লার। থিরজা গ্রে হাল্কা সুরে বললো। 

আমরা বিদায় নিলাম। আর ঠিক তখুনি সিবিল স্ট্যামফোবিওস সদর দরজা পেরিয়ে দ্রুত পদে এগিয়ে এলো বিদায়ী অতিথিদের সঙ্গে দেখা করতে। আমাদের গাড়ি যখন ফিরে আসছে তখন মিসেস অলিভার আচমকা বললো—ঐ রমণীকে আমি একদম পছন্দ করি না। একদম আমার ভালো মনে হয় না। 

ডেসপার্ড তাকে সমর্থন জানিয়ে বললো—তবে বুড়ি থিরজাকে অত গভীরভাবে বিচার করো না। সে অনর্গল খবরগুলো আমাদের মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে আমাদের মনে কি ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করে দেখতে চেয়েছে। 

—ওর কথা বলছি না—দুষ্টুবুদ্ধির স্ত্রীলোক। একটা সুযোগ পাওয়ার জন্য যেন তীক্ষ্ণ নজরে অপেক্ষা করছে। কিন্তু অপর স্ত্রীলোকটির মতন সে অত ভয়ঙ্কর প্রকৃতির নয়। 

—বেল্লার কথা বলছো? মেনে নিচ্ছি সে একটু রহস্যময়ী। 

—ওদের কথা আমি বলতে চাইছি না। বলছি ওই সিবিলের কথা। তাকে ঠিক নির্বোধ বলে মনে হচ্ছিল। ওই সব পুঁতির মালা আর ঝালর এবং জাদুবিদ্যাচর্চার মন্তরপাতি আর আজগুবি পুনর্জন্মের কাহিনী সে বলছিল। (আচ্ছা রান্নাঘরের ঝি কিংবা কুৎসিত দর্শন বুড়ো চাষী কেন পুনর্জন্ম লাভ করে না? সব সময় এ ঘটনা ঘটেছে মিশরের কোনো রাজকুমারী কিংবা ব্যাবিলনের কোনো সুদর্শন ক্রীতদাসের জীবনে। ব্যাপারটা বড় গোলমেলে।) তা সবই এক কথা। স্ত্রীলোকটি নির্বোধ বটে। আমার ধারণা সে সত্যই ঘটনা ঘটাতে পারে, আর সে সব খুবই আজব ঘটনা। সব ঘটনা বাঁকা চোখে দেখা আমার অভ্যাস। তবে ওকে দিয়ে করানো যাবে। কেননা ও নির্বোধ। মনে হচ্ছে কেউ আমার কথা ধরতে পারছে না। মিসেস অলিভার থেমে গেল। তার কণ্ঠে সমবেদনার ছোঁয়া। 

—আমারও তাই মনে হচ্ছে। বললো জিনজার, তোমার কথা যদি সঠিক না হয় তবে আমার অবাক হওয়া উচিত হবে না। 

—সত্যি একজন ভূতপ্রেতের ওঝার কাছে আমাদের যাওয়া প্রয়োজন। রোডা রাগান্বিত স্বরে বললো। এতে বরং আমরা কিছু মজার খোরাক পাবো। 

—না, তোমরা যেতে পারবে না। ডেসপার্ড দৃঢ় কণ্ঠে জানালো, এ ধরনের লোকজনের সাথে মেলামেশা করতে আমি তোমাদের দেবো না। ওরা হালকা তর্কাতর্কি আর হাসাহাসিতে মেতে উঠলো। মিসেস অলিভার যখন পরের দিনের সকালবেলার ট্রেনের ব্যাপারে জানতে চাইলো তখনই আমার সম্বিত ফিরে এলো। 

বললাম, আমার গাড়িতে ফিরতে পারবে। 

মিসেস অলিভারের দৃষ্টিতে সন্দেহের ছায়া ঘনিয়েছে। তাই বললো, না, আমি ট্রেনেই ফিরবো। 

—এর আগেও তো তুমি আমার গাড়িতে গেছো। বিশ্বাস করার মতন ড্রাইভার আমি।

—ব্যাপারটা তা নয় মার্ক। আগামীকাল সকালে একজনের শব সৎকারে আমাকে হাজির থাকতে হবে। কাজেই তোমার গাড়িতে গেলে শহরে পৌঁছতে আমার দেরি হয়ে যাবে। তারপরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিসেস অলিভার বললো, জানো শব সৎকারে যেতে আমার ঘৃণা হয়। 

—যেতেই হবে তোমাকে? 

—মনে হয় এক্ষেত্রে আমাকে নিশ্চয়ই যেতে হবে। মেরী দেল ফনটেইন আমার বহুদিনের বান্ধবী। আমার যাওয়া সে চায়। এ ধরনের মানুষ সে ছিলো। 

—অবশ্যই। বললাম, দেল ফনটেইন…নিশ্চয়। সবাই অবাক নয়নে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। 

বললাম, দুঃখিত। সম্প্রতি দেল ফনটেইন নামটা মনে হয় কোথায় শুনেছি…তাই। তোমার মুখে হয়তো শুনেছি, তাই না? কয়েকবার অলিভারের মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম—কোনো একটা নার্সিং হোমে তুমি যেন তার সাথে দেখা করতে যাবে এমন ধরনের কিছু একটা বলে ছিলে। 

—বলেছিলাম বুঝি? তা হতেও পারে।

—কিসে মারা গেছে মহিলা? 

— বিষক্রিয়ায় স্নায়ু প্রদাহের জন্য…এমনি ধরনের কোনো একটা রোগে। জিনজার কৌতূহলীর দৃষ্টিতে আমাকে নিরীক্ষা করেছিলো। তার দু’চোখে তীব্র সন্ধানী দৃষ্টি। আমরা সবাই গাড়ি থেকে নামলাম। আচমকা বললাম, খানিকটা পায়চারি করে আসি। খুব জব্বর লাঞ্চ খাওয়া হয়েছে। একটু পরিশ্রম করলে হজমের সুবিধা হবে। আমার সাথী হওয়ার জন্য কেউ প্রস্তাব করার আগে আমি একাই চলতে শুরু করলাম। আমি ভীষণভাবে একাকী কিছুক্ষণ থাকতে চাই। আমার চিন্তা-ভাবনাগুলোকে এই সময়টাতেই ঝাড়াই বাছাই করে নেবো। 

এসব ঘটনা কি? নিজের মনকে আমি এ ঘটনার একটা পরিচ্ছন্ন ব্যাখ্যা শোনাতে চাই। পপি যখন অপ্রত্যাশিত কিন্তু আতঙ্কজনক মন্তব্যটা ছুঁড়ে দিয়েছিলো যে, যদি কোনো লোকের কবল থেকে মুক্তি চাও তবে পেল হর্সে যাও। ওটাই উপযুক্ত জায়গা। 

সেই মন্তব্যটা অনুসরণ করতে জিম করিগ্যানের সাথে আমার দেখা হয়েছে এবং জেনেছি তার নামের তালিকা, সঙ্গে ফাদার গোরম্যানের খুন হওয়ার সম্পর্ক জড়িয়ে রয়েছে। ওই তালিকাতে দেখা হেসকেথ ডিউবয় আর টাকারটনের নাম দেখে লুইজির কফিবারে ওই নামদুটো এক সন্ধ্যায় শোনার ঘটনা আমাকে স্মরণ করতে হয়েছে। তালিকায় দেলা ফনটেইনেরও নাম ছিলো, তবে পরিচয় অস্পষ্ট। এক অসুস্থ বন্ধুর কথা প্রসঙ্গে মিসেস অলিভার এই নামটা উল্লেখ করেছেন। এই অসুস্থ লোকটি এখন মৃত। এর পরের কারণটা ঠিক মনে করতে না পারলেও ফুলের দোকানে পপিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়েছিলাম। পপি কথাগুলো শোনার পর প্রতিবাদ করে বলেছিলো যে পেল হর্স নামে যে একটি সংস্থা আছে তা তার জানা নেই। পপি যে ভয় পেয়েছিলো তা তাকে তখন দেখে আর কথা বলে পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিলাম। 

—আজ, থিরজা গ্রে-কে দেখলাম। 

কিন্তু নিশ্চয় পেল হর্স আর তার অধিবাসী এক জিনিস এবং ওই নামের তালিকা অন্য আর এক ধরনের জিনিস, দুটির মধ্যে একেবারেই কোনো সংযোগ নেই। কিন্তু কোনো প্রয়োজন সার্থক করতে আমি মনে মনে এই দুটিকে জুড়তে চাইছি? মুহূর্তের জন্য কেন আমি ভাবছি, কল্পনা করছি যে, এই দুটির মধ্যে সংযাগ রয়েছে? 

ধরে নেওয়া যায় মিসেস দেলা ফনটেইন বাস করতো লন্ডন শহরে। আর থমসিনা টাকারটনের বাস ছিলো সারের কোনো একটা জায়গায়। ওই তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদের কারো সাথে এই ছোট্ট গ্রাম সুচ ডিপিঙের কোনো যোগসূত্র থাকতে পারে না। যদি না…। 

ঠিক তখনি আমি কিংস আর্মস পাবের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। কিংস্ আর্মস্ একটা খাওয়ার ঘর। সাদা রঙ করা বোর্ডে লিখে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে এবং লাঞ্চ ডিনার এবং চা খাবার সরবরাহের সব ব্যবস্থা রয়েছে। 

পাবের দরজা ঠেলে খুলে ভিতরে ঢুকলাম। মদ সরবরাহের বার আমার বাঁ-দিকে, ওটা তখনও বন্ধ। ডানদিকে ছোটখাটো একটা লাউঞ্জ, বিস্বাদ ধোঁয়ার গন্ধ। সিঁড়ির এক পাশে একটা নোটিশ অফিস। অফিসের জানলায় কাঁচের শার্সি দৃঢ়ভাবে আটকানো। পাশে একটা ঘণ্টা বাজানোর বেল। দিনের কোনো একসময় পাবটা একদম খালি থাকে। অফিসের জানালার উপর নাম লেখার তেলচিটে রেজিস্টার দর্শকদের ওতে নাম লিখতে হয়। রেজিস্টারখানা নিয়ে পাতা উল্টে দেখতে লাগলাম। খুব বেশি মানুষজনের এখানে আনাগোনা নেই। পাঁচ-ছটা নাম লেখা, এক সপ্তাহের মধ্যে ওদের বেশির ভাগই শুধু রাতটুকুর জন্য থেকেছে। রেজিস্টার থেকে নামগুলো টুকে নিলাম। 

একটু পরে রেজিস্টারখানা বন্ধ করলাম। কিন্ত এখনও কারো দেখা নেই। আর ঠিক এই মুহূর্তে কাউকে আমার প্রশ্ন করারও নেই। তাই আবার পথে নামলাম, বিষণ্ণ বিকাল। গত বছর স্যানফোর্ড নামের একজন লোক এবং পারকিনসন নামের আর একজন এই কিংস্ আর্মস হোটেলে ছিলো এটা কি কেবল একটা ঘটনার সংগঠন? দুটো নামই করিগ্যানের নামের তালিকায় ছিলো। তবে নামগুলো বিরল নয়। আরো একটা নাম লিখে নিয়েছি, নামটা হচ্ছে মার্টিন ডিগবি। যে মার্টিন ডিগবিকে আমি জানি সে যদি এই মার্টিন ডিগবি হয় তবে সে আমার মিন চাচী লেডি হেসকথ ডিউবয়ের ভাইপো। 

কোথায় যে চলেছি তা বুঝতে পারছিলাম না। কারো সাথে কথা বলার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল। জিম করিগ্যান, কিংবা ডেভিড আরডিংলি বা শান্তশিষ্ট হারসিয়ার সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো হত। আমার গোলমেলে ভাবনা আমাকে পীড়া দিচ্ছিল, আর একলা থাকতে পারছি না। সত্যি কথা বলতে কি আমি যা জেনেছি, যা ভাবছি তা নিয়ে কেউ আমার সাথে তর্ক করুক, সত্যের আলোক ঝলসে উঠুক আমার মনে। 

ঘণ্টাখানেক জল-কাদা-ভরা পলিপথ হেঁটে অবশেষে গ্রামের পুরোহিতের বাড়ি হাজির হলাম এবং নোংরা দেউড়ির দরজার পাশে লাগানো জঙ্ ধরা ঘণ্টা বাজালাম। 

****

আশাতীত এক দানবীর মতন আমার সামনে হাজির হয়ে মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ। বললো, ঘন্টাটা বাজে না। আগেই আমার মনে সে সন্দেহ হয়েছিলো। 

—বার দুয়েক ওরা ঘণ্টাটা সারিয়ে দিয়েছিলো, বললো মিসেস ক্যালথ্রপ, কিন্তু বেশিদিন ঘণ্টাটা চালু থাকেনি। তাই নিজেই আমি সজাগ থাকি। যদি কিছু জরুরি খবর আসে। আচ্ছা তুমিও তা জরুরি কাজেই এসেছো তাই না? 

—হাঁ আমার কাছে ব্যাপার খুবই জরুরি। পুরোপুরি আমার মুখের দিকে দৃষ্টি রেখে মিসেস ক্যালথ্রপ শুধালো, আমিও তাই ভাবছি। ব্যাপারটা খুবই খারাপ….কিন্তু কাকে চাও তুমি? গ্রামের পুরোহিতকে? 

—ঠিক নিশ্চিত হয়ে বলতে পারছি না…। আমি গ্রামের পুরোহিতের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। কিন্তু আমার মনে হঠাৎ একটা সন্দেহ দেখা দিল। কিন্তু কারণটা ঠিক বুঝতে পারছি না। 

আর ঠিক তক্ষুনি মিসেস ক্যালথ্রপ আমাকে বললো, বলছি, গ্রামের পুরোহিত হওয়ার কথা ছেড়ে দিলেও আমার স্বামী খুবই ভালো মানুষ। আর এর ফলে মাঝে মাঝে আমাদের খুবই অসুবিধের মধ্যে পড়তে হয় জানো, ভালো মানুষরা মন্দকে চিনতে পারে না। কাজেই আমার সাথে কথা বলে। আমার মুখে মৃদু হাসি ফুটলো। শুধালাম, তাহলে মন্দর দেখভাল করা আপনার কাজ? 

—ঠিক তাই। গীর্জায় নানা ধরনের পাপ কাজ অনুষ্ঠিত হয়। সে সবের খবরাখবর রাখা জরুরি প্রয়োজন। জবাব দিল মিসেস ক্যালথ্রপ। তাহলে পাদরি হিসাবে মন্দ কাজের দেখভাল করার সাথে আপনার স্বামীর কি কোনো সম্পর্ক নেই? 

মিসেস ক্যালথ্রপ আমার কথার ভুল শুধরে দিয়ে বললো, পাপের জন্য ক্ষমা প্রদর্শনই তার কাজ। সে শুধু পাপের হাত থেকে পাপীকে নিষ্কৃতি দিতে পারে। আমি ক্ষমা করতে পারি না। তবে অনুষ্ঠিত পাপ কাজগুলো বাছাই করে তাকে সাহায্য করতে পারি। এ কাজ জানা থাকলে লোকে অপরকে ক্ষতি করার কাজে বাধা দিতে পারে। কেউ জনসাধারণকে নিজের মঙ্গল সাধনে প্রবৃত্ত করতে পারে না। আমি যে পারি না এটাই বলেছি। একমাত্র ঈশ্বরই মানুষকে অনুশোচনা করাতে সক্ষম, অথবা বলতে পারি যে, তুমিও তা জানো না। আজকাল অবশ্য অজস্র লোক তা জানে না। 

—আপনার অভিজ্ঞতার লব্ধ জ্ঞানের প্রতিবাদ করতে চাইছি না, বললাম, তবে মানুষজনকে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে চাই। 

খুব তাড়াতাড়ি ঐ মহিলা আমার মুখের দিকে নজর বুলিয়ে নিলো। তারপর বললো, ব্যাপারটা হলো এই। এসো ভিতরে এসো বসো। আমরা সহজভাবে সবকিছু আলোচনা করতে পারবো। 

পাদরীর বসবার ঘরখানা বেশ বড়সড় এবং অগোছালো ঘরের মধ্যে ভিক্টোরিয়ার আমলের আসবাবপত্তর সাজানো। আলোর কিছুটা অভাব থাকলেও ঘরখানা বিশেষ কোনো কারণে পুরো আঁধার ঢাকা নয়। বরং বেশ আরামদায়ক বিশ্রামের উপযুক্ত পরিবেশ। কদাকার চেয়ারগুলো দেখলে মনে হয় বহু বছর ধরে কারা যেন এর উপর বসে আছে। মস্ত বড় একটা ঘড়ি টিক্ টিক্ শব্দে চলছে। এই পরিবেশে সবসময় কথা বলা যায়, লোকে মনের কথা মুখ ফুটে বলতে পারে। বাইরে নানা ঝামেলা সহ্য করার পর এখানে নির্ঝঞ্ঝাট আরাম করতে সক্ষম হয়। 

এই ঘরে বসেই অনুভব করলাম, গোল চোখ যুবতী কন্যারা জল ভরা ছল ছল দৃষ্টিতে এখানে বসেই প্রথম জানতে পারে তারা আসন্ন প্রসবা এবং বিশ্রুত কণ্ঠে যুবতীরা তাদের বিপদের কথা মিসেস ডেন ক্যালগ্রুপের কাছে বলে, তার পরামর্শ গ্রহণ করে, যদিও সব সময় পরামর্শগুলোর সঙ্গে ধর্মীয় গোঁড়ামির যোগ থাকে না। এখানেই ক্রুদ্ধ আত্মীয়রা তাদের সন্তানসন্ততিদের উপর তাদের জমে ওঠা বিরক্তি উজাড় করে দেয়, নির্দ্বিধায় প্রকাশ করে। এইখানে বসেই জননীরা বুঝিয়ে বলে, তাদের বক্কেরা একেবারেই খারাপ ছেলে ছিলো না। শুধু তাদের একটু মাথা গরম। তাই তাদেরকে সংশোধন করার জন্য দূরে স্কুলে পাঠানোর কথাটা একদম একটা আজগুবি প্রস্তাব। স্বামী এবং স্ত্রীরা এখানে বসেই তাদের বিবাহ সম্বন্ধীয় ঝঞ্ঝাটের কথাগুলো খুলে বলে। 

আর আজ সেই ঘরেই বসে পণ্ডিত এবং বিশ্বপ্রেমী লেখক আমি ইস্টারব্রুক বসে আছি এক অভিজ্ঞ বয়সী বৃদ্ধার সামনে। সুন্দর ধূসর দুটি চোখ মহিলার। আমার সমস্যাগুলো আমি এই মহিলার সামনে তুলে ধরতে ইচ্ছুক। কেন? কারণ জানি না। শুধু এক আজব নিশ্চয়তা আমার মনে যে এই মহিলার কাছেই এসব সমস্যার কথা খুলে বলা যায়। 

বলতে শুরু করলাম, একটু আগেই থিরজা গ্রের সাথে চা পান সেরে এলাম। মিসেস ক্যালথ্রপকে কোনো বিষয় বুঝিয়ে বলা কঠিন কাজ নয়। সে সঙ্গে সঙ্গে কথার অর্থ বুঝতে পারে। 

—বুঝতে পেরেছি। ঘটনাটা তোমাকে কি বিব্রত করেছে? এই তিনজনকে সহ্য করা এবং তাদের হালচাল বুঝতে পারা যে একটু কঠিন কাজ তা স্বীকার করছি। আমি নিজেই অবাক হয়েছি এত সব ওদের অহঙ্কারী কথাবার্তা। আমার অভিজ্ঞতা বলে নিয়ম অনুযায়ী আসল দুষ্টরা এত অহঙ্কার প্রকাশ করে না। অন্যায় কাজ করে তারা সম্পূর্ণ নীরব থাকে। সত্যসত্যই তোমার অন্যায় কাজ গুরুতর নয় বলেই তুমি এত কথা বলতে চাইছো। অন্যায় কাজ বড় জঘন্য নিচ আর ঘৃণ্য। তাই অন্যায় কাজগুলোকে যাতে জমকালো আর গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় তার জন্য দারুণ ভাবে চেষ্টা করতে হবে। গ্রাম্য ডাইনীরা সাধারণত বাচাল আর রগচটা বৃদ্ধা। তারা মানুষকে শুধু ভয় পাইয়ে দেয় এবং এই সব কাজ করে তারা কিছুই পায় না। অথচ কাজটা অতি সহজেই করা যায়। তাই তো মিসেস ব্রাউনের মুরগীগুলো মারা গেল তোমরা সবাই মাথা নেড়ে দুঃখের সঙ্গে বলেছিলে, আহা! গত সপ্তাহের মঙ্গলবারে মহিলার বিল্লি আমার পুশিকে বিরক্ত করেছিলো। তার ফলেই এমনটা ঘটেছে। বেল্লা ভয়ের এ ধরনের ডাইনী হলেও তার মধ্যে আরো কিছু ক্ষমতা আছে। একেবারেই শিশুকাল থেকেই তার মধ্যে এ ধরনের ক্ষমতা জন্মেছে। সেই ক্ষমতা এখন বেড়ে উঠেছে গ্রাম্য পরিবেশে এসে। যখন এই ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে তখন তা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, প্রভাব বিস্তারের প্রবণতাকে ভাসিয়ে দিয়ে প্রকাশ পায় ঈর্ষা। সিবিল স্ট্যামফোর্বওসের মতন এমন বাচাল রমণী আমি আমার জীবনে আর কখনও দেখিনি। তবে তার উপর আত্মার ভয় খুবই সফল হয়। থিরজা, ওকে আমি জানি না। সে তোমাকে কি বলেছে বলে মনে হয়। এমন কিছু হয়তো বলেছে যার জন্য তুমি বিব্রত হয়ে পড়েছো তাই না? 

—আপনি অনেক কিছু জানেন, মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ। আপনি যা কিছু জেনেছেন এবং যা কিছু শুনেছেন সেই অভিজ্ঞতার সাহায্য আপনি কি বলবেন যে সরাসরি যোগাযোগ না থাকলেও একজন মানুষকে ধ্বংস করতে পারে? 

মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ বিস্ফারিত দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে শুধালেন, তুমি যখন ধ্বংসের কথা বলছো তখন মনে করতে পারি সেটা খুন? এটাই বাস্তব ঘটনা তাই তো? 

—হাঁ। 

মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ জোরালো গলায় জবাব দিলেন, এটা অবাস্তব ব্যাপার।

একটা সোয়াস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। 

—কিন্তু আমারও ভুল হতে পারে, বললেন মিসেস ক্যালথ্রপ, আমার বাবা বলতেন, বিমানপোত অলীক কল্পনা। এবং আমার ঠাকুর্দা বলতেন রেলওয়ে ট্রেনও অবাস্তব ঘটনা। কিন্তু এখন এদের দুটোই বাস্তব ঘটনা। সে সময় এদের আবিষ্কার ছিল অসম্ভব কল্পনা। কিন্তু এখন আর তারা অসম্ভব নয়। থিরজা কি করেছ, সক্রিয় মৃত্যু রশ্মি, না আর কিছু-না কি তারা তিনজনে মৃত আত্মাকে আহ্বান করে ইচ্ছা জানিয়েছে? 

আমি হেসে বললাম, দেখছি সব ব্যাপারটাই আপনি প্রকাশ করেছেন। ওই রমণী যাতে আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারে তার সুযোগ তাকে দিতে হবে। মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ বলে উঠলেন, না, না। ও কাজ করবেন না। আপনি ঠিক ‘ভর’ হওয়ার মাধ্যম নন। ঘটনাটার সঙ্গে আরও কিছু জড়িয়ে আছে। এসব ঘটার আগেই সে ঘটনাটা ঘটেছিলো। এরপর খুব সংক্ষেপে ফাদার গোরম্যানের খুনের ঘটনা তাঁকে বললাম। এবং পেল হর্স নাইট ক্লাবের কথাটাও। তারপর পকেট থেকে ডাক্তার করিগ্যানের লেখা নামের তালিকার অনুরূপ তাঁকে দেখালাম। ভুরু কুঁচকে মিসেস ক্যালথ্রপ তালিকার নামগুলোর উপর নজর বুলিয়ে বললেন, বুঝেছি, এই লোকগুলো? এদের মধ্যে মিল কোথায়? 

—আমরা নিশ্চিতভাবে কিছু জানি না। ব্ল্যাকমেল বা গোপন নেশার বস্তু হতে পারে?

—বাজে কথা। জবাব দিলেন মিসেস ক্যালথ্রপ, এর জন্য তুমি চিন্তিত নও। তুমি বিশ্বাস করো যে, আসলে তারা সবাই মৃত তাই না? একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বিশ্বাস করি না। মিন্নি হেসকথ ডিউবয়, থমসিনা টাকারটন এবং মেরী দেলা কনটেইন, এরা তিনজনই মারা গেছে। অস্বাভাবিক কারণেই তারা শয্যায় মারা গেছে। থিরজা গ্রে দাবি করেছে যে এটা ঘটাতোই। 

—তুমি বলছো যে, সেই এটা ঘটিয়েছে? 

—না, না। আসলে সে কোনো বিশেষ লোকের কথা বলেনি। তার বিশ্বাস যে, বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনাভিত্তিক এটাই সে বুঝিয়ে বলেছিল। মিসেস ক্যালথ্রপ চিত্তিত মনে শুধালো, এটা শুনে আজগুবি কাণ্ড মনে হচ্ছে। 

—জানি। এ ব্যাপারটা আমি শান্ত মনে নম্রভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে নিজের মনেই হাসতাম যদি না কৌতূহলজনক ‘পেল হর্স’ সম্বন্ধে উল্লেখ করা হতো। 

মিসেস ডেন ক্যালথ্রপ চিন্তিত মনে বললো, পেল হর্স কথাটার মধ্যে যেন একটা ইঙ্গিত রয়েছে। মুহূর্তের জন্য নীরব থেকে মহিলা মাথা ভুলে আবার বললো, ব্যাপারটা অন্যায়। খুবই অন্যায়। এর পিছনে সে উদ্দেশ্যই থাকে না। কেন এর রদ করতেই হবে। কিন্তু এটা তো তোমার জানা। 

—হাঁ। কিন্তু কি করা যায়? 

—উপায় একটা তোমাকে খুঁজতেই হবে। আর সময় নষ্ট করা যায় না। মিসেস ক্যালথ্রপ উঠে দাঁড়িয়ে চঞ্চলভাবে একটা পাক ঘুরে আবার বললো, এ ব্যাপারে তুমি এখুনি খোঁজখবর নিতে থাকো। এ কাজে তোমাকে সাহায্য করতে পারে এমন কোনো বন্ধু তোমার কি নেই? 

ভাবতে লাগলাম। জিম করিগ্যান? ব্যস্ত লোক তার হাতে সময় কম, তবু তার পক্ষে যা করা সম্ভব তা এর মধ্যেই সে করতে শুরু করেছে। ডেভিড আরডিংলি, কিন্তু সে কি এই ঘটনার কথাও বিশ্বাস করবে? হারসিয়া? হাঁ, হারসিয়া রয়েছে। পরিচ্ছন্ন বুদ্ধি এবং প্রশংসাজনক বিচারশক্তি। তাকে যদি এ কাজের সাহায্যকারিণী হিসাবে নামাতে রাজী করানো যায় তবে একটা প্রবল ক্ষমতা হাতে পাওয়া যাবে। যা হোক সে এবং আমি…কথা শেষ করলাম না। হারসিয়া সুস্থির বুদ্ধির রমণী। 

মিসেস ক্যালথ্রপ ব্যবসায়ী বুদ্ধিসম্পন্না মহিলা। তাই সংক্ষেপে শুধালো, কি কারো কথা ভাবতে পারলে? খুব ভালো কথা তাহলে। 

—তিনজন ডাইনীর উপর আমি নজর রাখবো। এটা যে জবাব নয় তা এখনও মনে হচ্ছে। এই স্ট্যামফোর্বওস নারী যখন মিশরীয় রহস্য আর পিরামিডের ভবিষ্যৎবাণী সম্বন্ধে গালগল্প করেছিলো তখনই আমার এটা মনে হয়েছিলো। অবশ্য পিরামিডের অস্তিত্ব রয়েছে, রয়েছে তার সম্পর্কে নানা কাহিনী আর মন্দিরের রহস্যসমূহও তো আছে তবু মহিলার কথা স্রেফ গালগল্প। তাই মনে না করে পারলাম না যে, থিরজা গ্রের দখলে একটা কিছু আছে, সে তার সন্ধান পেয়েছে, বা লোকজনের মুখ থেকে শুনেছে এবং নিজের গুরুত্ব সম্বন্ধে অহঙ্কার প্রকাশ করার এবং ডাইনীবিদ্যা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এইসব গালগল্প বানিয়ে বানিয়ে বলছে। লোকজন দুষ্টুমির চমকে তাই এত মোহিত হয়। সৎ-লোকেরা এর জন্য অহঙ্কার করে না। এটা অবাস্তব তাই না? আমার মনে হয় এর জন্যই খৃস্টধর্মের মধ্যে এই মালিন্যের স্পর্শ ঘটেছে। তারা এমনকি জানেও না যে তারা সৎ লোক। 

কয়েকটা মুহূর্ত নীরব থেকে মহিলা আবার বললো, আমাদের এখন এই মহিলাদের কোনো একজনের সাথে পেল হর্সের কি সম্পর্ক রয়েছে তা জানার প্রয়োজন। আর সেটাই হবে নির্দিষ্ট একটা উপায়।