দি পেল হর্স – ১০

দশম অধ্যায় 

প্লেনদাওয়ার ক্লোজ নব নির্মিত অট্টালিকা। অর্ধ-গোলাকৃতি এই অট্টালিকার নিচের তলায় এখনও রাজমিস্ত্রিরা কাজ করছে। মাঝামাঝি প্রবেশ দ্বারটা বসানো। গেটে লেখা নাম নজরে পড়ছে—এভারেস্ট। 

বাগানের রেলিঙ-এ ঝুঁকে যে লোকটি বিদ্যুতের বাল্ব বসানোর কাজ করাচ্ছে তাকে দেখেই ইনসপেক্টর লেজুন চিনতে পারলেন। চিনতে অসুবিধা হলো না যে ওই হচ্ছে, মিস্টার জ্যাকেরিয়া অসবর্ণ। গেট ঠেলে ইনস্পেক্টর ভিতরে ঢুকলেন। তাঁর বাড়িতে কে ঢুকলো তা দেখার জন্য মিস্টার অসবর্ণ সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। আগন্তুককে চিনতে পারার জন্য তাঁর মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। গ্রামের বাড়ির মিস্টার অসবর্ণের আচার আচরণ লন্ডনের দোকানের মিস্টার অসবর্ণের আচার আচরণ একই রকম, গরমিল নজরে পড়ছে না। পায়ে গ্রাম্য মুচীর তৈরি শক্ত চামড়ার জুতো। গায়ে হাতা আটা জামা পুরোটা। এমন মামুলি পোশাকে তাঁর সুদর্শন দেহে কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। তাঁর টাক মাথায় স্বেদ-বিন্দুর পাতলা আবরণ—পকেট থেকে রুমাল বার করে তিনি মাথার ঘাম মুছলেন। মহানন্দে মিস্টার অসবর্ণ বললেন, ইন্সপেক্টর লেজুন। আপনি আমার বাড়িতে আসাতে আমি সম্মানিত বোধ করছি। আপনার প্রাপ্তি স্বীকারপত্র আমি পেয়েছি। তবে একবারও ভাবিনি আপনি নিজেই আমার বাড়ি আসবেন। আমার এই এভারেস্টে আপনাকে সাদর আহ্বান জানাচ্ছি। আমার বাড়ির নামটা নিশ্চয় আপনাকে অবাক করছে। তাই না? হিমালয় পর্বত সম্বন্ধে আমি সব সময় কৌতূহলী, এভারেস্ট অভিযানের সব খবর আমি রাখি। আমাদের দেশের জন্য স্যার এডমন্ড হিলারি কি বিজয় সম্মান এনেছেন। কি মানুষ। কি ভয়ানক তাঁর সহ্যশক্তি। ব্যক্তিগতভাবে নিজে আমি কোনো দিন কোনো রকম কষ্ট সহ্য না করলেও যারা অপরাজিত পর্বতকে জানার জন্য অভিযানে যোগদান করেছে অথবা বরফ জমা মেরু অঞ্চলের গোপন রহস্য আবিষ্কার করার জন্য পাল তোলা জাহাজে যাত্রা করেছে তাদের আমি বাহবা দিই তাদের সাহসের জন্য। আসুন ভিতরে এসে বসুন। 

ইনসপেক্টর লেজুনকে নিয়ে মাস্টার অসবর্ণ তাঁর ছোটখাটো ছিমছাম আর পরিচ্ছন্ন বাংলোর মধ্যে নিয়ে গিয়ে বসালেন। চমৎকার মার্জিত আসবাবপত্রে সাজানো ঘর। 

মিস্টার অসবর্ণ বুঝিয়ে বলতে চাইলেন—সব কিছু এখনও ঠিক গুছিয়ে বসতে পারিনি। স্থানীয় নীলাম বাজারে মাঝে মাঝে আমি যাই। সস্তা ভালো ভালো জিনিসপত্র ওখানে পাওয়া যায়। এত কম দামে দোকানে এমন জিনিস পাওয়া যায় না। এবার বলুন পানীয় হিসাবে আপনাকে কি দেবো। এক গ্লাস শেরি দেবো কি? না কি বিয়ার দেবো? 

ইনসপেক্টর লেজুন বিয়ার চাইলেন। একটু পরে বিয়ারের দুটি গ্লাস নিয়ে ঘরে ফিরে এলেন মিস্টার অসবর্ণ, বললেন, পান করুন। এবার আমরা এভারেস্টে বসে আরামে গল্প করতে পারি। আমার এই বাড়ির নামের দুটো অর্থ আছে। সব সময় আমি রসিকতা করতে ভালোবাসি। 

এই ধরনের সামাজিক আদব কায়দা দেখাবার সুযোগ পেয়ে ভারি খুশি মিস্টার অসবর্ণ। একটু সামনে ঝুঁকে শুধালেন—আমার খবর পেয়ে কি আপনার সুবিধে পেয়েছে 

ইনসপেক্টর নরম গলায় জবাব দিলেন—না, যতটা আশা করেছিলাম ঠিক ততটা হয়নি।—ভারি হতাশ হলাম। ভেবেছিলাম, যে লোকটি সেদিন ফাদার গোরম্যানের পিছু নিয়েছিলেন, সেই ফাদারের খুনী। বড় বেশি আশা করেছিলাম। আরও জানতে পেরেছি, এই মিস্টার ভেনবলস স্থানীয় একজন সম্পদশালী মানুষ, সবাই তাঁকে ভক্তি শ্রদ্ধা করে। উত্তম সামাজিক গণ্ডির মধ্যে তাই তার ওঠা বসা। 

 —দেখুন। সেদিন রাতে যে ভেনবলসকে দেখেছিলেন তিনি কিছুতেই হীন হতে পারেন না।

মিস্টার অসবর্ণ সোজা হয়ে বসে বললেন। হাঁ তিনিই এই একই ব্যক্তি। এ সম্বন্ধে আমার মনে এতটুকু সন্দেহ নেই। কোনো একবার দেখা মুখ চিনতে কোনোদিন আমার ভুল হয় না। ইনসপেক্টর শান্ত কণ্ঠে বললেন, বোধহয় এবার আপনার ভুল হয়েছে। দেখুন, মিস্টার ভেনবলস পোলিও রোগে পঙ্গু। বছর তিনকে হলো কোমরের নিচ থেকে তাঁর গোটা নিম্নাঙ্গ পক্ষাঘাতে অসাড় হয়ে গেছে। তাই হাঁটতে অক্ষম। 

—পোলিও রোগ তবে তো ব্যাপারটা মিটেই গেলো। কিন্তু মনে কিছু করবেন না, ইনসপেক্টর। আপনি কি চিকিৎসকের এজাহার পেয়েছেন যে, তিনি সত্যি সত্যিই পক্ষাঘাতে পঙ্গু। 

—হ্যাঁ পেয়েছি মিস্টার অসবর্ণ। বিখ্যাত চিকিৎসক হারলে স্ট্রিটের স্যার উইলিয়াম ডাগডেল তাঁর চিকিৎসা করে থাকেন। জবাব দিলেন ইনসপেক্টর লেজুন। 

—হ্যাঁ খুবই নামকরা চিকিৎসক তিনি। দেখছি, আমি দারুণ ভুল করেছি। অথচ আমি খুবই নিশ্চিত ছিলাম। শুধু শুধু আপনাকে ঝঞ্ঝাটে জড়ালাম। সখেদে বললেন মিস্টার অসবর্ণ। 

তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন ইনসপেক্টর আপনার খবরের এখনও মূল্য রয়েছে। 

মিস্টার ভেনবলস সুস্পষ্টভাবে এক বিশেষ সুদর্শন পুরুষ। কাজেই আপনার সে রাতে দেখা মানুষটার সাথে মিস্টার ভেনবলসের দেহগত একটা মিল রয়েছে। এটা খুবই একটা মূল্যবান খবর। এমনি ধরনের আকৃতির মানুষ সমাজে বহুজন থাকতে পারে না। মিস্টার অসবর্ণ একটু উৎসাহিত হয়ে বললেন ঠিক অপরাধ জগতের একজন মানুষের সাথের মিস্টার ভেনবলসের আকৃতিগত মিল রয়েছে। এমন ধরনের মানুষ বহু হতে পারে না। তাহলে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের (ইংল্যান্ডের গোয়েন্দা পুলিশের সদর দপ্তর) ফাইলগুলোতে…। বলতে বলতে আশান্বিত হয়ে তিনি ইনসপেক্টরের মুখের দিকে তাকালেন। ধীর কণ্ঠে বলতে লাগলেন লেজুন, ব্যাপারটা এত সহজে মিটবে না। হয়ত তার সম্বন্ধে কোনো ফাইল রেকর্ড নেই। তা ছাড়া আপনার কথা শুনে বোঝা যাচ্ছে, সে রাতে ফাদার গোরম্যানকে আক্রমণ করার কোনো কারণ এই বিশেষ লোকটির ছিল না। 

মিস্টার অসবর্ণ হলেন আবার হতাশ। তিনি একসময় বললেন, আমাকে মাপ করুন। একটা খুনের মামলায় সাক্ষী দিতে পারবো ভেবেছিলাম। কিন্তু দেখছি বহু ফ্যাসাদ। তবে আমাকে কেউ আমার পথ থেকে সরাতে পারবে না। তা আপনাকে বলে রাখছি। আমার ধারণা অটুট থাকবে। লেজুন নীরবে মিস্টার অসবর্ণের হাবভাব কথাবার্তা মনে মনে খতিয়ে দেখতে লাগলেন। 

ইনসপেক্টরের এই নীরব ভাবনা বিচলিত করলো মিস্টার অসবর্ণকে। তাই একসময়ে শুধালো, হ্যাঁ, বলুন কি বলছেন? 

—মিস্টার অসবর্ণ, আপনার এই ধারণা অটুট থাকার কথা বলে কি বোঝাতে চাইছেন? বিস্মিত দেখালো মিস্টার অসবর্ণকে। বলতে লাগলেন—কারণ আমি নিশ্চিত ছিলাম এই সেই লোক। অথচ আপনার ধারণা, এ লোক সেই লোক নয়। কাজেই, আমার আর নিশ্চিত হবার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমার ধারণা…। 

লেজুন সামনে একটু ঝুঁকে বসে বলতে শুরু করলেন, আমি কেন আজ আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি তা শুনলে আপনি অবাক হবেন। চিকিৎসকের এজাহার দেখে জানতে পেরেছিলাম যে আপনার দেখা লোক ভেনবলস হতে পারে না, তবু কেন এসেছি? 

— ঠিক, ঠিক তাহলে কেন এসেছেন, ইনসপেক্টর লেজুন? 

—আপনার বর্ণিত সনাক্তকরণ পড়ে আমি প্রভাবিত হয়েছি, তাই দেখা করতে এসেছি। জানতে চাই কোনো কারণের উপর ভিত্তি করে আপনি এত নিশ্চিত হয়েছেন। মনে আছে তো সে রাতে ছিল কুয়াশায় ঢাকা। আপনার দোকানে আমি গিয়েছি। আপনার দোকানের দরজার কাছে যেখানে সে রাতে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে আপনি তাকিয়ে ছিলেন, ঠিক সে জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি পরখ করে এসেছি, আমার মনে হয়েছে কুয়াশা ভরা রাতে এত দূরের একটা চলমান মানুষের দেহ আবছা হয়ে যায়। স্পষ্টভাবে সেই মানুষটাকে চিনতে পারা প্রায় অসম্ভব কাজ। 

—একদিক দিয়ে আপনি সঠিক বলেছেন। কুয়াশা পড়ছিল। তবে পাতলা কুয়াশা তাই মাঝে মাঝে কিছু কিছু জায়গা পরিষ্কার হয়ে পড়েছিলো। দেখলাম কুয়াশাহীন পথ পেরিয়ে ফাদার গোরম্যান ওপার থেকে এপারে আসছেন। আর তাঁর পিছনে আসছে লোকটা। তাছাড়া পিছু নেওয়া লোকটা আমার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে লাইট জ্বালিয়ে সিগারেট ধরিয়েছিল। তাই তার মুখখানা সে রাতে স্পষ্ট ভাবে আমি দেখতে সক্ষম হয়েছিলাম।

—নজরে পড়েছিলো লোকটার নাক, কান এবং কপাল। আজব দেখতে মানুষটা। তাকে আমি দেখিনি। সে যদি আমার দোকানে কোনো দিন আসতো তবে তাকে আমি চিনতে পারতাম। বুঝলেন তো আমার কথা। মিস্টার অসবর্ণ চুপ করলেন। চিন্তিত মনে লেজুন বললেন, হাঁ বুঝতে পারলাম। 

সহসা আশাব্যঞ্জক কণ্ঠে মিস্টার অসবর্ণ বলে উঠলেন—ভাই বোধ হয় তার যমজ ভাই হবে। তাহলে একটা সমাধান পাওয়া গেলো। 

—যমজ ভাই হলো সমস্যার সমাধান? হেসে মাথা নেড়ে লেজুন বললেন, উপন্যাসের কাহিনীতে এমন সমাধান লেখা খুবই সহজ। কিন্তু জেনে রাখুন, বাস্তব জীবনে এমন ঘটে না। সত্যিই এমন ঘটে না। 

—না আমারও ধারণা এমন ঘটে না। তাহলে মনে হয় কোনো সহোদর ভাই। দারুণভাবে পারিবারিক সাদৃশ্য রয়েছে উভয়ের মধ্যে। বলার সময় মিস্টার অসবর্ণকে আনন্দিত মনে হলো। 

লেজুন খুব সতর্ক হয়ে কথাটা বললেন, আমরা যতদূর সম্ভব খবর সংগ্রহ করেছি তা থেকে জেনেছি, ভেনবলসের কোনো ভাই নেই। 

—আপনারা যতদূর সম্ভব খবর সংগ্রহ করতে পেরেছেন? 

—জাতিতে বৃটিশ হলেও ভেনবলসের জন্ম হয়েছিলো বিদেশে, তাঁর বাবা-মার সাথে মিস্টার ভেনবলস ইংল্যান্ডে আসেন। তখন তার বয়স এগারো বছর। 

—যদি আপনারা তাঁর সম্পর্কে জানতে না পেরে থাকেন তাহলে? বলছি তাঁর পরিবার- পরিজন সম্পর্কে? 

চিন্তিত লেজুন আবার বলতে লাগলেন, মিস্টার ভেনবলসের কাছে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা না করে আমরা আর বেশি কিছু জানতে পারবো এবং তা করবার মতন কোনো কারণ আমাদের হাতে নেই। 

ইনসপেক্টর লেজুন ইচ্ছে করেই কথাটা বললেন। তার কাছে না গিয়ে এবং তাকে না জিজ্ঞেস করেও তার সম্বন্ধে জানার উপায় রয়েছে কিন্তু মিস্টার অসবর্ণকে সে কথা জানানোর একটুও ইচ্ছে তার নেই। তারপর উঠে শুধালেন, চিকিৎসকের এজাহারে না থাকা সত্ত্বেও তার সনাক্তকরণ সম্পর্কে আপনি তাহলে নিশ্চিত? 

মিস্টার অসবর্ণ জানালেন—নিশ্চয়। দেখা মানুষের মুখ মনে রাখা আমার একটা হবি। কিন্তু নামগুলো মনে রাখতে পারি না। 

—আপনার মতন লোককে আমি সাক্ষীর কাঠগড়ায় চাই। সনাক্তকরণ ব্যাপারটা বড় ঝামেলার। বেশির ভাগ লোকই সাক্ষী দিতে এসে গোলমাল পাকায়। 

—এটা আমার ঈশ্বরের দান। তা ছাড়া আমি চর্চা করি। জানেন আমি ম্যাজিকও জানি। খ্রিস্টমাসের আসরে বাচ্চাদের দেখাই। এটাও শিখেছি। দাঁড়ান, দাঁড়ান। আপনার বুকপকেটে কি রয়েছে দেখি। তারপর একটু ঝুঁকে ইনসপেক্টর-এর বুকপকেট থেকে একটা ছাইদানি বার করলেন। 

—এ হে! আপনি পুলিশে চাকরি করছেন? 

দুজনে হেসে উঠলেন। 

ইন্সপেক্টর চলে গেলেন। 

গেটের কাছে দাঁড়িয়ে মিস্টার অসবর্ণ আওড়ালেন—মেডিক্যাল এভিডেন্স। সত্যিকারের চিকিৎসক। আমি চিকিৎসকদের সম্পর্কে যা জানি তার অর্ধেক যদি ওই লোকটা জানতো। চিকিৎসকরা-ওরা সব নির্দোষ। সত্যিকারের চিকিৎসা বাস্তবিক।