দি পেল হর্স – ১৪

চতুর্দশ অধ্যায় 

—তাহলে এখন আমরা নিশ্চিন্ত হলাম। বললো জিনজার। 

—নিশ্চিন্ত আমরা আগেই হয়েছিলাম। 

—হাঁ, স্বস্তি দিয়ে। তবে মনে একটা সন্দেহের কাঁটা বিঁধছিলো। 

কয়েকটা মুহূর্তের জন্য আমি নীরব-কল্পনার দৃষ্টিতে দেখছি। মিসেস টাকারটন চলেছে বার্মিংহাম শহরে। ওখানে মিউনিসিপ্যাল বিল্ডিংয়ে ঢুকে দেখা করলো মিস্টার ব্রাডলির সঙ্গে। মহিলা বিব্রত। হতাশ চেহারা দেখে আইনজ্ঞ মিস্টার ব্রাডলি অনেক কিছু আঁচ করে নিলো। সাহস দিলো মহিলাকে। যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিলো, এ ধরনের কাজে কোনোরকম বিপদের আশঙ্কা নেই। নিশ্চিন্ত হয়ে ঘরে ফিরে এলো মিসেস টাকারটন। তার মানে সারাক্ষণ অর্থের চিন্তা। সামান্য অর্থ নয়—অজস্র অর্থ। যে পরিমাণ অর্থ পেলে একজন মানুষ জীবনকে ভোগ করতে পারে, তার জীবনের সব আকাঙ্ক্ষা মিটে যায়। অথচ এই অজস্র অর্থের মালিক হতে চলেছে একটা উচ্ছন্নে যাওয়া মেয়ে–সুস্থ জীবন থেকে সে অধঃপতিত। জিন্সের প্যান্ট আর আঁটোসাঁটো শেমিজ পরে মেয়েটা তারই মতন অধঃপতিত যুবক যুবতীর সঙ্গে চেলসিয়া মদের ভাঁটিতে হুল্লোড় করে বেড়াচ্ছে। এমন একটা মেয়ে যে উচ্ছন্নে গেছে, আর ভালো নেই? কোনোদিন যে মেয়ে আর ভালো হবে না সে কেন এত বিপুল অর্থ পাবে? এবং কাজেই মিসেস টাকারটন আবার চললো বার্মিংহাম শহরে। এখন আরও সতর্কতা আরও নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য অনুরোধ। তারপর শর্তের কথা আলোচিত হলো। কল্পনা করতে পারছিলাম যে, মিস্টার ব্রাডলি খুব সহজে মহিলাকে শর্ত মানতে সম্মত করতে পারেনি। মহিলা শক্ত ধাতুতে গড়া। তবে শেষ পর্যন্ত ওদের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু তারপর কি ঘটেছিলো তা আমার কাছে অকল্পনীয়। জিনজার মুখের ভাব নিরিখ করছিলো। বললো সবটা কল্পনা করতে কি পারলে? 

—আমার মনের ভাব বুঝলে কি করে? 

তোমার মুখ দেখে মনে হলো। মহিলার বার্মিংহাম যাওয়া এবং মিস্টার ব্রাডলির সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার কাহিনী কল্পনা করছো, তাই না? 

—ঠিক তাই। কিন্তু এর পর কি ঘটলো তা আর ভাবতে পারছি না, বললাম। জিনজার ধীরে ধীরে বললো–পেল হর্সে সঠিকভাবে কি ঘটে তা এখনই হোক বা পরেই হোক কাউকে আমাদের কাছে এসে প্রকাশ করতেই হবে। 

—তা কি করে সম্ভব? 

—জানি না। আর কাজটা খুব সহজ নয়। সত্য সত্যই ওখানে যে গিয়েছে, আর যে ওদের সাহায্য নিয়েছে সে লোক কখনই আমাদের কাছে আসবে না। অথচ একমাত্র সেই লোকই ওখানে আসলে কি ঘটে তা বলতে পারে। 

—আমরা এখন পুলিশের কাছে গিয়ে সব বলতে পারি, তাই ত? শুধালাম। 

—হাঁ, পারি। কেননা এখন আমাদের কাছে সঠিক প্রমাণ রয়েছে। তোমার কি মনে হয় এই প্রমাণে কোনো কাজ হবে? 

মনে সন্দেহ জন্মালো। বললাম এটা ত ইচ্ছার প্রমাণ কিন্তু এটা কি যথেষ্ট হবে? মৃত্যু ইচ্ছা, কিন্তু আদালতে এটা আজগুবি বলে প্রতিপন্ন হবে। এমন কি ওই মৃত্যু ইচ্ছার গঠন পদ্ধতি যে কি তাও আমরা জানি না। 

—ঠিক আছে। কিন্তু ব্যাপারটা আমাদের জানতেই হবে। কিন্তু কিভাবে তা জানবো? 

—ঘটনাটা কি ভাবে ঘটছে তা কাউকে নিজের চোখে দেখতে হবে, নিজের কানে শুনতে হবে। কিন্তু ওই ঘরের মধ্যে কেউ লুকিয়ে দেখবে এবং শুনবে তাও সম্ভব নয়, অথচ ওই ঘরের মধ্যেই সব কিছু ঘটে সে সম্বন্ধে আমি নিশ্চিন্ত। সোজা হয়ে বসে জিনজার বললো—একটা উপায় আছে. তোমাকে আসল মক্কেল হয়ে ওখানে যেতে হবে। 

—একজন আসল মক্কেল হিসাবে? 

–হাঁ। হয় তুমি আর না হয় আমি যাবো। 

কাকে আমরা এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চাই তা নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন নেই। আমরা একজন ব্রাডলির ওখানে যাবো এবং ঘটাবার ব্যবস্থা করবো। 

—এ কাজে আমি সময় দিতে পারছি না। তীব্র কণ্ঠে বললাম। 

—কেন? 

—এতে বিপদ ঘটতে পারে। 

—আমাদের বিপদ হবে? 

—বোধ হয়। তবে আমি ভাবছি বলির কথা। 

এ কাজে বলি হাতে রাজী এমন একজনকে খুঁজতে হবে, তার একটি নামও থাকা চাই। ঝুটা হলে চলবে না, কেননা নির্ঘাৎ খোঁজ খবরও নেবে। তুমি কি এটা ভাবছো না? 

কয়েক মুহূর্ত ভেবে জিনজার মাথা নেড়ে বললো—হাঁ। বলিকে একজন আসল লোক হতে হবে। তার ঠিকানাও হতে হবে সঠিক। 

—আর সেজন্যই ত আমি তা চাই না। বললাম। জিনজার বললো—তুমি আর আমি এবার ভেবে দেখি, আমরা কাকে এই পৃথিবী থেকে পরপারে পাঠাতে চাই। আমার একজন কাকা আছে। মেরভিন কাকা। পয়সাঅলা লোক। কাকার অবশ্য এখন তখন অবস্থা। কাকা মরলে অবশ্য আমি তার তার সম্পত্তির একটা অংশ উত্তরাধিকার হিসাবে পাবো। তবে কাকার এভাবে মৃত্যু হোক তা আমি চাই না। কাকাকে আমি দারুণ ভালোবাসি। আচ্ছা, তোমার কি এমন কোনো আত্মীয় নেই যার মৃত্যু হলে তুমি টাকা কড়ি, সম্পত্তি উত্তরাধিকার হিসাবে লাভ করবে? 

মাথা নাড়ালাম। 

জিনজার বললো—দেখো আমারও বয়স হয়েছে, নতুন করে কেউ আমার প্রেমে পড়বে তার কোনো সম্ভাবনা নেই। তোমারও সেই একই অবস্থা। তার ওপর তুমি আবার বিয়ে করোনি যে, একটা কিছু মতলব সেই বউকে জড়িয়ে করবো। আমার মুখের উপর বিষণ্ণতার এক টুকরো মেঘ ছায়া ফেললো। 

এ প্রতিক্রিয়া জিনজারের নজর এড়ালো না। বললাম—ঘটনাটা অনেকদিন দিন আগে ঘটেছিলো। জানি না, সেকথা কারো মনে আছে কিনা। 

—তুমি কি কাউকে বিয়ে করেছিলে? 

—হাঁ। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আমরা বিয়ের কথা গোপন রেখেছিলাম। আমার বাবা মা জানলে তাঁরা এ বিয়ে মানতেন না। কেননা তখনও আমি সাবালক হইনি। আমরা দুজনেই বয়স বেশি বলে লিখেছিলুম। তাই জানাজানি হলে ও বিয়ে অসিদ্ধ হয়ে যাবে। 

জিনজার শুধালো—তারপর কি ঘটেছিলো? 

ওখানেই মোটর দুর্ঘটনায় সে মারা গেলো। মোটরে আমি ছিলাম। তার সাথে ছিলো আর এক বন্ধু। জবাব দিলাম। 

জিনজার বারেকের জন্য আমার দিকে তাকালো। মনে হয় সে বুঝেছে আমার স্ত্রীর সে স্বামীর প্রতি একনিষ্ঠ হওয়ার মতন গুণ ছিলো না তা আমি জানতে পেরেছিলাম। 

এবার বাস্তবায়িত কণ্ঠস্বর জিনজারের : তোমার বিয়ে কি ইংল্যান্ডে হয়েছিলো? 

—হাঁ পিটার করাফের রেজিস্ট্রি অফিসে। 

—কিন্তু তোমার স্ত্রীর মৃত্যু হয় ইতালীতে তাই ত? 

— হাঁ- 

—তা হলে ইংল্যান্ডে তার মৃত্যুর রেকর্ড নেই তাই না?

—না, নেই। 

—বৎস। আর কি চাই তোমার? এর চেয়ে সহজ উপায় আর কিছু হতেই পারে না। ধরো, একজনকে তুমি দারুণ ভালোবাসো। তাকে তুমি বিয়ে করতে চাও–কিন্তু, তুমি জানো না, তোমার আগের পক্ষের বউ বেঁচে আছে না মরে গেছে। অনেক বছর হলো তার সঙ্গে তোমার ছাড়াছাড়ি, তার কাছ থেকে এক কলম লেখা চিঠিও তুমি কোনোদিন পাওনি। এমন ঝুঁকি নিতে তোমার সাহস হচ্ছে। এমন সময় তোমার প্রথম পক্ষের বউ এসে আবার হাজির হলো। 

বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতন। তুমি বিবাহ বিচ্ছেদ চাও। কিন্তু সে কিছুতেই বিবাদ বিচ্ছেদে রাজী নয়। সে তোমার যুবতী প্রেমিকার কাছে গিয়ে তোমার মুখোশ খুলে দেওয়ার ভয় দেখায়। 

শুধালাম—আমার আবার যুবতী প্রেমিকা কে? 

— তুমি? 

—নিশ্চয় নয়। ও কাজে আমি ভুল লোক। আমি বরং তোমার সঙ্গে পাপ-পঙ্কে ডুব দিতে পারি! তুমি জানো, কার কথা আমি বলতে চাইছি। ওই মূর্তির মতন কৃষ্ণাঙ্গিনী মেয়েটির সঙ্গে ঘুরে বেড়াও তার কথা বলতে চাইছি। 

—হারসিয়া রেডাক্লিফ? তার কথা? কে তোমাকে তার কথা বললো? 

—নিশ্চয় বুঝতে পারছো, পপির মুখ থেকে শুনেছি। মেয়েটির হাতে টাকা কড়ি আছে। ঠিক আছে, ঠিক আছে। টাকার জন্য তুমি তাকে বিয়ে করবে একথা আমি বলছি না। তুমি সে ধরনের মানুষ নও। তবে জঘন্য মন ব্রাডলি সহজেই একথা বিশ্বাস করবে। এই হচ্ছে এখানকার অবস্থা। তুমি এবার হারসিয়াকে গিয়ে বলবে তোমার বউ ইংল্যান্ডে ফিরে এসেছে। দারুণ প্রতিহিংসা পরায়ণ তোমার বউ। বিবাহ বিচ্ছেদের কথা তাকে বলছো কিন্তু সে রাজী নয়। এবার পেল হর্সে গিয়ে সব বলো। ওর মানে এই থিরজা এবং চাষী মেয়ে বেল্লা বুঝতে পারবে কেন তুমি সেদিন ওখানে গিয়েছিলে। তারা তোমাকে একজন আগ্রহী মক্কেল হিসাবে গ্রহণ করবে। 

—মনে হয় এতেই কাজ হবে। বললাম। 

— তাহলে ব্রাডলির কাছে এমনভাবে কথাগুলো বলবে যেন সে ভাবে, তুমি টোপ গিলেছো। 

—আজগুবি বউয়ের কাহিনী খাড়া করা সহজ। কিন্তু তারা ত নাম-ধাম সব জানতে চাইবে। আর তখন আমাকে মাথা চুলকাতে…। 

জিনজার দৃঢ় কণ্ঠে বললো—না, তোমাকে মাথা চুলকাতে হবে না। আমি হব তোমার বউ।

****

জিনজারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই মুহূর্তে ও যেন চোখে ঠুলি পরেছে। সে যে দুরন্ত আবেগে হেসে উঠছে না এর জন্যই আমি বিস্মিত। ধীরে ধীরে নিজেকে ধাতস্থ করে নিচ্ছিলাম। 

এমন সময় বলে উঠলো জিনজার—এত অবাক হওয়ার প্রয়োজন নেই। এটা আমার নিছক একটা প্রস্তাব নয়। 

কথা বলার মতন শক্তি পেলাম। বললাম—জানো না তুমি কি বলছো। 

—নিশ্চয় জানি। আমি যে প্রস্তাব করছি তা করা সম্ভব—এবং এই প্রস্তাবের মানে হচ্ছে কোনো নির্দোষী লোককে সম্ভাব্য বিপদের মধ্যে টেনে আনার প্রয়োজন হবে না। 

—কিন্তু তুমি নিজেও বিপদে পড়বে। 

—সেটা আমার ব্যাপার, আমি মাথা ঘামাবো। 

—কিন্তু এ প্রস্তাবে কাজ হবে না। 

—হবেই। ভেবে ঠিক করেছি। একটা সাজানো গোছানো ফ্ল্যাটে গিয়ে উঠবো। একটা বা দুটো স্যুটকেস সঙ্গে নেবো। তাতে লাগানো থাকবে বিদেশের নাম লেখা লেবেল। মিসেস ইস্টারব্রুকের নামে ফ্ল্যাট ভাড়া করবো। তাহলে সংসারে এমন কেউ আছে যে বলবে না আমি মিসেস ইস্টারব্রুক নই? 

—তোমাকে জানে চেনে সেই বলবে। 

—আমার চেনা জানা লোক কেউ আমার দেখা পাবে না। অসুস্থতার দোহাই দিয়ে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি। পোশাক আন্দাজের রকম ফের করে আর সামান্য ছদ্মবেশ ধরে চেহারাটা এমন বদলে ফেলবো যে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবীই আমাকে চিনতে পারবে না। পনের বছর ধরে তোমার প্রথম পক্ষের বউ এদেশে আসেনি, কেউ তাকে দেখেওনি—তাই আমি যে তোমার সেই বউ নই তা কেউ সন্দেহ করবে না, পেল হর্সের লোকজনও সন্দেহ করবে না। তারা রেজেস্ট্রি বিয়ের পুরনো রেকর্ড যাচাই করবে। চার ধারে খোঁজও নেবে—শেষে বুঝতে পারবে তুমি সত্যিকারের একজন মক্কেল। 

 —কিন্তু জিনজার, তুমি এই প্রস্তাবের কঠিন দিকগুলো আর বিপদের ঝুঁকি বুঝতে পারছো না।

—বিপদের ঝুঁকি দূর। ওই লোকটা যাতে তোমার কয়েক হাজার টাকা চুক্তির নাম করে হাতাতে না পারে তাই তোমাকে সাহায্য করতে চাই। 

—ধরো, যদি একটা কিছু ঘটে? 

—আমার ঘটবে বলছো? কিন্তু সেটা বিচার করার কথা আমার, তাই না? 

—আমিই ত তোমাকে এ বিপদের মধ্যে টেনে এনেছি। 

—হাঁ আমাকে তুমি এনেছো। কিন্তু এখন আমরা দুজনেই এর সাথে জড়িয়ে গেছি। এখন আমি আর এই ব্যাপারটাকে কৌতুক বলে উড়িয়ে দিচ্ছি না। আমরা যা সত্য বলে বিশ্বাস করি তা যদি সত্য হয় তবে ওদের এই কাজ হচ্ছে বিরক্তিকর পালবিক বস্তু। এ ধরনের কাজ বন্ধ করতেই হবে। দ্যাখো এই খুন, ঘৃণা বা ইচ্ছা জনিত উগ্র স্বভাবের খুনীর খুন করা নয়। নয় ধন লিপ্সা মানবিক অবিশ্বাসজনিত খুন। কিন্তু এরা করেছে খুনের ব্যবসা, কারা, কিসের জন্য এই খুন তার বিচার হচ্ছে না। 

বললাম, এখন আমরা সব ঘটনা আর আমাদের সংগ্রহ করা তথ্য পুলিশকে জানাতে পারি। 

—কোনো পুলিশকে জানাবে? স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডে? 

—আমার মনে হয়, আঞ্চলিক গোয়েন্দা ইনসপেক্টর লেজুন হচ্ছে উপযুক্ত লোক।