দি অ্যাডভেন্ট অফ স্যাটান – ২

খানিকটা তফাতে গাড়ি থামিয়ে ডিউক নেমে পড়লেন, রেক্সও। 

ডিউক বললেন, বাকি পথটা হেঁটেই যাব, এতক্ষণে নিশ্চয় সাইমন পৌঁছে গেছে, তাই আমরা যে এগিয়ে আসছি সে সম্বন্ধে ওদের সাবধান করে দিলে বোকামি হবে। যদি আমরা যথেষ্ট পরিমাণে সতর্কতা পালন করি তাহলে হয়ত তাকে অপ্রস্তুত অবস্থায় পেয়ে যেতে পারি। যখন বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করছে সেই সময় ছাড়া, কোনো সময়েই মোকাটা সাধারণ মানুষের থেকে বেশি কিছু নয়। 

পেছনের দরজার কাছে এসে তাঁরা অত বড় বাড়িটার কোথাও আলো দেখতে পেলেন না, যেন জনমানবের চিহ্ন নেই সেখানে। 

রেক্স ফিসফিস করে বললেন, আগে প্রয়োজন পালাবার পথ ঠিক করা, যাতে তাড়াতাড়ির সময় বিপদে না পড়ি। উত্তরে তেমনি ফিসফিস করে রেক্স একটা ল্যাবার্নাম গাছ দেখিয়ে বললেন, এটা কেমন হয়, চলবে না? 

ঘাড় নেড়ে ডিউক নিঃশব্দে সম্মতি জানালেন। দেখেই বুঝতে পারলেন নিচের ডালগুলোর সাহায্যে দুই লাফে দেয়ালের উপরে ওঠা যাবে। তারপর সন্তর্পণে দৌড়তে দৌড়তে একফালি ফাঁকা জায়গা পার হয়ে আবার একগুচ্ছ ঝোপের মধ্যে পৌঁছে গেলেন। এই ঝোপ বাড়িটাকে সম্পূর্ণ ঘিরে রয়েছে। 

সেখান থেকে রেক্স পাশের জানালাগুলো লক্ষ্য করতে থাকলেন। কোথাও আলোর আভাস পর্যন্ত পাওয়া গেল না। ডিউক এগিয়ে চললেন, রেক্স তাঁর পিছু নিলেন। শেষ পর্যন্ত পেছনের উঠোনের প্রবেশপথের কাছে এসে ঝোপের সমাপ্তি হল। এদিকে হয়ত রান্নাঘরটা হবে। 

ডিউকের আস্তিনে টান দিয়ে রেঞ্জ ফিসফিস করে বললেন, সাবধান কিন্তু, কুকুর আছে হয়তো! 

ডিউক তাঁকে সুনিশ্চিত করে বললেন, থাকতেই পারে না, যেখানে ব্ল্যাক ম্যাজিক চলে কুকুর তার ত্রিসীমানাতেও থাকবে না। হাল্কা দ্রুত পায়ে উঠোন অতিক্রম করে তিনি চলে গেলেন বাড়ির বিপরীত প্রান্তের বাগানে। সেখানকার জানালাগুলোও সব অন্ধকারে ঢাকা, এক অস্বস্তিকর স্তব্ধতা সেখানে বিরাজ করছে। ডিউক তেমনি ক্ষীণ স্বরে বললেন, ব্যাপারটা ভালো বুঝছি না। সাইমন এসেছে বড়জোর পনেরো মিনিট আগে, সুতরাং উপরের ঘরগুলোতে তো আলো অবশ্যই থাকার কথা। হয়তো সবাই চলে গেছে, যাই হোক দেখাই যাক, যদি থাকে তো হঠাৎ ঢুকে পড়ে চমকে দিতে পারি কি না। নিচের তলায় একটা সঙ্কীর্ণ জানালা ডিউকের চোখে পড়ল। তিনি ভাবলেন, ওটা নিশ্চয়ই পায়খানা হবে, অধিকাংশ লোকেই পায়খানার জানালা বন্ধ করতে ভুলে যায়। 

ঘাস পার হয়ে রেক্স নিঃশব্দে তাঁকে অনুসরণ করলে, তারপর হাঁটু ধরে তাঁকে জানালায় চৌকাঠ বরাবর তুলে ধরলেন তারপর ডিউকের মাথা আর কাঁধ ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর একটা পতনের শব্দ রেক্সের কানে এল, ডিউকের মুখ দেখা দিলে জিজ্ঞাসা করলেন, লাগেনি তো? 

ডিউক বললেন, সামান্য তাহলেও আমার বয়সের মানুষের কাছে উড়িয়ে দেবার নয়। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, দরজাটা খোলাই আছে। রেক্স ভিতরে যাওয়া মাত্র ডিউক মেঝেতে বসলেন। বললেন, বেশ এবার খুলে ফেল জুতো আর মোজা। 

জুতো না হয় খুললাম, যদিও তাহলে দৌড়তে হলে পায়ে লাগতে পারে। কিন্তু মোজা কেন? রেক্স প্রশ্ন করলেন। 

তর্ক করে সময় নষ্ট করো না। 

আচ্ছা বেশ। এবার কী করব? 

জুতো আবার পর, আর তার উপরে পর মোজা, তাহলেই আর তাড়াতাড়ি দৌড়তে কোনো অসুবিধে হবে না। রেক্স আদেশ পালন করলে ডিউক গলা নাময়ে বললেন, এখন আর একটুও শব্দ করা নয়। মনে হচ্ছে সাইমন ছাড়া সবাই চলে গেছে এবং যদি মোকাটা আমাদের প্রতীক্ষায় ওঁত পেতে না থাকে, তাহলে হয়ত আমরা সাইমনকে পেয়ে যেতে পারি। আর যদি সেই কালো ভৃত্যটাকে দেখতে পাও, ভুলেও তার চোখে তাকিও না। 

অত্যন্ত সাবধানে তিনি দরজা খুলে উঁকি দিয়ে তাকালেন। হলঘরটা অন্ধকার, একটা ক্ষীণ আলো উপরের একটা জানালা দিয়ে আসছে। সেই আলোয় দেখলেন বৈঠকখানা—ঘরের দরজা খোলা, মুহূর্তকাল কান পাতলেন, তারপর দুজনে বৈঠকখানায় গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন। একটা খড়খড়ি তুলে দিলেন। তারপর অস্পষ্ট আলোয় আসবাবপত্রের আবছায়া চোখে পড়ল, সেইসঙ্গে চোখে পড়ল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত প্লেট আর গ্লাস। রেক্স শ্যাম্পেনের একটা বোতল তুলে নিলেন, তার তিন ভাগের এক ভাগ খরচ হয়েছে। ডিউকও দেখলেন সেটা বুঝতে পারলেন, যখন তাঁরা সাইমনকে ধরে নিয়ে পালিয়ে যান তখন সবাই ভয় পেয়ে খাওয়া শেষ না করেই উঠে পড়েছিল। তড়িঘড়ি বন্ধ করে তাঁরা চুপিসারে হলঘরে ফিরে গেলেন। 

চাকরদের ঘরে যাওয়ার দরজাটা ছাড়াও আর একটা দরজা আছে যেটা খুলে লাইব্রেরি ঘরে যাওয়া যায়। ঘরটা নিতান্তই ছোট, তার দূর প্রান্তে দুটো গরাদহীন জানালা যাতে কোনো পর্দা নেই। যেখান দিয়ে বাগানটা চোখে পড়ে, তারার আলোয় রহস্যময় আর ভূতুড়ে মনে হচ্ছে। রেক্সকে দরজার কাছে রেখে ডিউক পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলেন, খুললেন জানালাগুলো। সেই গাছটা দেখতে পেলেন, পালানো সহজ হবে বলে যেটা তাঁরা চিহ্নিত করে রেখেছিলেন। দেখা গেল, বাড়িটা সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত। উপরতলায় গিয়ে তাঁরা শোবার ঘরগুলো পরীক্ষা করলেন। কোনো বিছানাতেই রাত্রে শয়নের কোনো চিহ্ন নেই। 

সবগুলো ঘর পরীক্ষা করা হয়ে গেলে ডিউক বললেন, বোঝা যাচ্ছে, সকলকে এখান থেকে সরিয়ে দিয়ে মোকাটা সাইমনের জন্যে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন যাতে সে আসামাত্রই তাকে নিয়ে চলে যেতে পারে। 

রেক্স বললেন, নিশ্চয় তাই। এবং এখন আমরাও চলে যেতে পারি—প্রচণ্ড ঠান্ডা এখানে। সত্যি। কিন্তু তাহলেও এক্ষুনি যাচ্ছি না। বাড়িটা খুব ভালো করে খুঁজে দেখার এক সুবর্ণ সুযোগ আমাদের সামনে, কে বলতে পারে, হয়তো অনেক কিছুই জানতে পারব। বাতিগুলো সব জ্বলতে থাকুক। এসো নিচে যাই। 

বৈঠকখানায় খাবার টেবিলটা তেমনি রয়েছে। সেখানে উপস্থিত হয়ে ডিউক এক গ্লাস মদ পান করলেন। রেক্স একটা প্লেটে করে কিছুটা মাংস নিয়ে খেলেন। তারপর বললেন, আচ্ছা মোকাটা কোথায় এবং কেন সেখানে গেছে? 

শেষ প্রশ্নের উত্তর সহজ। এ দেশে ব্ল্যাক ম্যাজিকের বিপক্ষে কোনো আইন নেই বটে, তাহলেও সে নিশ্চয় চায় না তার এইসব কাজ সাধারণ্যে প্রকাশ পাক। কিন্তু তোমার প্রথম প্রশ্ন—সে কোথায় গেছে, সে সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণা নেই। 

রেক্স জিজ্ঞাসা করলেন, এবার আমরা কি করব? 

দেখব সাইমনের কাগজগুলো পাই কি না, সেগুলো উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখলে হয়ত কিছু জানা যেতে পারে, যেমন ধর এইসব লোকদের নাম ঠিকানা। চল লাইব্রেরিতে যাই আগে। 

সাইমনের ডেস্কগুলো একটার পর একটা খুলে রেখে পরীক্ষা করা হল। কিন্তু দেখা গেল যে সবই বলতে গেলে শুধু হিসেবপত্র। মিনিট দশেক ধরে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও যখন কাজের কিছুই পাওয়া গেল না তখন তাঁরা নিচের তলায় গেলেন। প্রত্যেকটা ড্রয়ার খুলে পরীক্ষা করলেন। সেখানেও সেরকম কিছুই তাঁরা পেলেন না। এইসব পরীক্ষার সময় রেক্স ডিউকের পাশে ছিলেন। শেষ ঘরটা পরীক্ষা করেও যখন তাঁরা কিছুই পেলেন না তখন ডিউক বললেন, নিশ্চয় এই বাড়িতেই ওদের কার্যকলাপের কিছু নিদর্শন থাকবে। এবং তা আমি খুঁজে বার করবই করব। রেক্স বললেন, আচ্ছা, মানমন্দিরটা তো পরীক্ষা করে দেখা হয়নি, সেটা দেখা যাক না। আমার মনে হয় সেখানে ঠিক মিলতে পারে। 

ঠিক বলেছ, তাই চল। এই বলে ডিউক সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলেন। 

কয়েক ঘণ্টা আগে যেমনটি দেখেছিলেন সবই তেমনি আছে,–মন্ত্রপূত পঞ্চপ্রদীপ, আর সেই দুটো গণ্ডী যা সেটাকে ঘিরে রেখেছে। বোঝা গেল তাঁরা চলে যাওয়ার পর আর এখানে কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। এবং এ বিষয়ে নিঃসন্দেহে হওয়ার জন্যে ডিউক দেয়ালের কাছে রাখা বেতের ঝুড়িটার ঢাকনা খুললেন। বললেন, দেখ রেক্স, যাদের বলি দেওয়া হবে সেই কালো মোরগ আর সাদা মুরগি তেমন রয়ে গেছে। যাবার সময় এ দুটোকে মুক্তি দিয়ে বাগানে ছেড়ে দেব। 

ওদের আসল উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আপনার কী মনে হয়? রেক্স জিজ্ঞাসা করলেন। সাইমনের জন্মের প্রাক্কালে যে সব গ্রহ নক্ষত্র একত্র হয়েছিল সেগুলো আজও তেমনি একত্র হয়েছে। তাই আজ ওরা সেই সুযোগ নিয়ে তার মাধ্যমে কিছু করতে চায়,হয়ত কোনো পরিচিত অন্ধকারের শক্তিকে, কিংবা যাকে আমি নরক বলি সেখানকার কোনো ভয়ঙ্করকে আবাহন করতে চায়, কোনো বিশেষ বিষয়ে কিছু জানবার জন্যে। 

অধৈর্য রেক্স বলে উঠলেন, কিন্তু ওসব আমার একটুও বিশ্বাস হয় না। একদল গুণ্ডা সাইমনকে ধরে নিয়ে এসে সম্মোহিত করেছে এবং তারপর ব্ল্যাক ম্যাজিকের সহায়তায় তাকে বশ করেছে—এ পর্যন্ত যাহোক আমি সম্ভব বলে মানতে পারি। কিন্তু এর বেশি যা কিছু সবই আমার কাছে নিতান্তই অর্থহীন ছাড়া কিছু নয়। 

ডিউক বললেন, হয়ত তোমাকে শীঘ্রই এই ধারণা পালটাতে হবে রেক্স। যাই হোক, আগে এখন খোঁজার কাজটা শেষ করা যাক, কী বল? বেশ কিন্তু তাহলেও আমার মনে হচ্ছে পুলিশকে জানালেই ভালো হতো। 

যন্ত্রপাতিগুলো পরীক্ষানিরীক্ষা করে কিছুই সন্দেহজনক বস্তু পাওয়া গেল না। তারপর তাঁরা দেখতে পেল ঘুরানো বইয়ের তাক। কিন্তু ভিতরেও কেবল একটা ত্রিকোণমিতির আর জ্যোতিষ্কদের চার্ট, তা ছাড়া আর কিছু নেই। 

ডিউক একটু বিরক্তিসূচক মনোভাব নিয়ে বলে উঠলেন, কী আশ্চর্য, কিছু তো অন্তত এখানে থাকার কথা–তরোয়াল, কিংবা খাপ, বা শয়তানের ধর্মগ্রন্থ,–যেসব না হলে তো ওদের উপচার সম্পূর্ণ হয় না। 

সবই নিশ্চয় যাওয়ার সময় নিয়ে গেছে। রেক্স বললেন। 

তাই হবে হয়তো। তাহলেও দেখতে হবে পরীক্ষা করে। তুমি দেয়ালগুলো পরীক্ষা কর, আমি মেঝেটা পরীক্ষা করে দেখছি। কোথাও যে কোনো গোপন জায়গা আছে তাতে সন্দেহমাত্র নেই। 

আকস্মিক রেক্সের উল্লসিত চিৎকার, পেয়েছি, পেয়েছি—এই যে একটা কোটর দেখছি। সামান্য হাতড়াতেই একটা লুকানো স্প্রিং তাঁরা আবিষ্কার করলেন এবং সেটা টিপতেই একটা ডালা খুলে গেল। চার ফুট গভীর সেই ফাঁকে অদ্ভুত কিছু বস্তু তাঁদের চোখে পড়ল। হ্যালে কাঠের একটা জাদু দণ্ড, সোনা খচিত স্ফটিকের সেই একটা টর্চ যার পেছন দিকটা সূঁচলো যাতে মাটিতে পুঁতলে সিধে হয়ে থাকতে পারে কিছু মোমবাতি, একটা ছোট তরোয়াল, দুটো বড় বই, চন্দ্রকলার আকারের বাঁকানো গলাবিশিষ্ট একটা ছোরা, একটা আংটি, একটা ভৃঙ্গার, একটা পুরানো ব্রোঞ্জের বাতি যার ন-টা পলতে, একটা মন্ত্রপূত পঞ্চপ্রদীপ যাতে অজানা চিহ্ন খোদিত। সমস্ত কিছুই অত্যন্ত প্রাচীন এবং ঘন ঘন ব্যবহারের পরিচয় তাতে। পেয়েছি, পেয়ে গেছি। ডিউক বলে উঠলেন—ভাগ্যি থেকে গিয়েছিলাম, রেক্স! এ সবই অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য, প্রায় নিশ্চয় করে বলতে পারি যে এখানেই ওদের এ বিষয়ে সব কিছু রয়েছে, এবং এগুলো সরালেই আর ওরা আমাদের কোনো অনিষ্ট করতে পারবে না। এই বলে ডিউক প্রাচীন বইদুটো তুলে নিলেন। একটা বই বাঁধানো রয়েছে তামায়। তাতে কি সব আঁকাজোকা। দুটো বইই যেমন পুরাতন তেমনি দুষ্প্রাপ্য, ব্ল্যাক ম্যাজিক নিয়ে যাদের কর্ম তাদের কাছে তেমনি অপরিহার্য। রেক্স বললেন, মোকাটা হয়তো ভাবেনি আমরা সাইমনের খোঁজে ক্রমে তাকে না পেয়ে এইভাবে তন্ন তন্ন করে সব জায়গায় খুঁজব – কিন্তু ঐ কনকনে হাওয়াটা কোথা থেকে আসছে বলুন তো। এই বলে হঠাৎ রেক্স তাঁর ঘাড়ের পেছনে হাত থাবড়ালেন। আর ডিউকও তাড়াতাড়ি বইদুটো নামিয়ে রাখলেন। রেক্স এমনভাবে ফিরে দাঁড়ালেন যেন ছোবল খেয়েছেন, তিনিও কনকনে হাওয়াটা অনুভব করেছিলেন। সেই কনকনানি ক্রমেই বাড়তে বাড়তে বরফ-শীতল হয়ে উঠেছে। ইলেকট্রিকের বাতিগুলো দপ্ দপ্ করে স্তিমিত হয়ে এল, সমস্ত ঘর ছায়ায় ভরে উঠল, একটা বেগুনি রঙের কুয়াশা পঞ্চপ্রদীপের মাঝখান থেকে উঠে আসতে থাকল। তারপর প্রচণ্ড বেগে পাক খেতে খেতে আর ক্রমেই বড় হতে হতে শেষ পর্যন্ত আকার গ্রহণ করল। আলোগুলো আবার দপ্ দপ্ করতে থাকল এবং অবশেষে নিবে গেল, শুধু বেগুনি কুয়াশার জন্যেই ঘরটা অন্ধকারে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হল না। একটা বিশ্রী পচা গন্ধ তাঁরা পেলেন। একটা ধূসর বস্তু তাঁদের চোখের সামনে অবয়ব ধারণ করতে লাগল, তাঁরা দেখলেন সাত ফুট উঁচু একটা ধূসর রঙের মুখ ফুটে উঠছে। যে চোখে সেই মূর্তি তাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল তাতে বিদ্বেষ ও দৃঢ় সংকল্পের প্রকাশ। চোখের মণি সাদা হয়ে উঠলেও মুখটা কিন্তু রয়ে গেল ধূসর। তারপর সেই কুয়াশা ক্রমে তার কাঁধ এবং অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পরিণত হতে থাকল। 

তাঁদের দম বন্ধ হওয়ার আগেই সেই অবয়ব সম্পূর্ণ হয়ে উঠল। মোকাটার কৃষ্ণকায় ভৃত্যের সূক্ষ্ম শরীর তাঁদের নিকটে দাঁড়িয়ে। ডিউক তাকে যেমন দেখেছিলেন অবিকল সেই মূর্তিতে,—তেমনি ছ ফুট আট ইঞ্চি তার দৈর্ঘ্য, চোখে সেই জ্বলন্ত কয়লার ন্যায় দৃষ্টি। ভয় পাওয়া বলতে যা বোঝায় রেক্স সে অবস্থা অনেক আগেই পার হয়ে এসেছেন, তাঁর পক্ষে এখন ঝুঁকে পড়া বা চিৎকার করা বা দৌড়ে পালানো সম্পূর্ণ অসম্ভব। অনড় হয়ে তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন সেখানে। যে বরফশীতল কনকনে ভাবমূর্তিটা থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছিল তাতে তাঁর সর্বশরীর অবশ হয়ে গেছে। তাঁর কপালের একটা ছোটশিরা দপ্ দপ্ করছে, দুই হাঁটু যেন ক্রমেই দুর্বল হয়ে আসছে। একটা পরিষ্কার, ধারালো স্বর তিনি শুনতে পাচ্ছেন, ওর চোখে তাকাবে না—ওর চোখে তাকাবে না—ওর চোখে তাকাবে না! কিন্তু ডিউকের এই অত্যন্ত জরুরি সাবধান বাণী সত্ত্বেও রেক্স কিছুতেই মূর্তিটার শয়তানী মাখা হলদে চোখের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারলেন না। সে দৃষ্টি তার কালো মুখে যে জ্বলছে আর জ্বলছে। তাঁর দৃষ্টির সম্মুখেই মূর্তিটা ক্রমশই লম্বা ও চওড়ায় বেড়ে উঠছে। শেষ পর্যন্ত বুঝি সমস্ত ঘরটাতেই ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। এক অস্বাস্থ্যকর, ভয়ঙ্কর পূতি গন্ধ তার দেহ থেকে বের হচ্ছে। 

হঠাৎ তার চোখ থেকে রক্তিম আভা বার হতে থাকল,–রেক্স উপলব্ধি করলেন, তাঁর আপাদমস্তক থর্ থর্ করে কাঁপছে। তিনি প্রার্থনা করতে চেষ্টা করলেন—হে স্বর্গত পিতা, হে পবিত্র…পবিত্র…কথাগুলো অনেক কাল উচ্চারণ না করায় তাঁর মনে পড়ল না। এমন একটা শিহরণ তার সারা শরীর জ্বালায়, যেন কোনো বৈদ্যুতি তারের শক পেয়েছেন। তাঁর বাঁ-হাঁটু কাঁপছে। হাত তুলে মুখ চাপা দেবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না, হাত দুটো শরীর বরাবর একেবারে শক্ত হয়ে রয়েছে—যেন অদৃশ্য ইস্পাতের বাঁধনে বাঁধা। তাঁর প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও এক অমোঘ শক্তি তাঁকে সেই মূর্তির দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এবং কিছু বুঝতে পারার আগেই তিনি এক পা এগিয়ে গেলেন। 

ডিউক রেক্সের এক ফুটের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁর দৃষ্টি মেঝের উপর স্থিরনিবদ্ধ। মূর্তিটির স্বরূপ তিনি জানেন না, দেখতে পাননি। তবে বরফশীতল আবহাওয়া লক্ষ্য করে আলোর দপদপানি থেকে আর ভয়ঙ্কর দুর্গন্ধ থেকেই তিনি মোটামুটি একটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। 

এমন সময় তিনি অনুভব করলেন রেক্স এগোচ্ছেন। কাঁপা ঠোঁটে তিনি গ্রীক, হিব্রু আর পারসিক ভাষায় কিছু উচ্চারণ করলেন, কোনো অতীতে পড়েছিলেন, সেই মন্ত্রে আলোর শক্তি আবাহন করলেন। এবং তৎক্ষণাৎ তাঁর মনে পড়ে গেল স্বস্তিকাটার কথা, – সেটা তাঁর সঙ্গেই ছিল। সেটা তুলে বৃত্তের কেন্দ্রের দিকে ফেরালেন। সঙ্গে সঙ্গে এক হতাশাব্যঞ্জক চিৎকার উঠল যাতে ক্রোধ, ভীতি ও যন্ত্রণার প্রকাশ, যেন কোনো জন্তুকে অত্যন্ত উত্তপ্ত লৌহশলাকা দিয়ে বিদ্ধ করা হয়েছে। এবং সেই সময়েই সেই হিমবাহ মন্ত্রের মত ঘুচে গেল। সেই ভয়ঙ্কর চিৎকার তখনও ধ্বনিত হয়ে চলেছে। তক্ষুনি ডিউক রেক্সকে বাহুতে ধরে দরজার দিকে দৌড়তে আরম্ভ করলেন এবং দৌড়তে দৌড়তে গড়াতে গড়াতে দু’জনে নেমে যেতে থাকলেন। 

স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পাওয়ার পর রেক্সের প্রথম বক্তব্য হল, যা যা আপনাকে বলেছি সে সবই আমি ফিরিয়ে নিচ্ছি—জীবনে আমি কখনও এমন ভয় পাইনি! 

ভয় আমিও পেয়েছিলাম, তবে, তা শেষ দিকটায়। 

ভাগ্যক্রমে তাঁরা অবিলম্বে একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেলেন। 

লাইব্রেরি ঘরে যখন পৌঁছলেন তখন রাত তিনটে বেজে গেছে, অবশ্য রাত তিনটে পর্যন্ত জেগে থাকা রেক্সের পক্ষে খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়, কারণ বলনাচ থেকে ফিরতে অনেক সময়েই তাঁর এরকম রাত হয়। এবং ডিউকের পক্ষেও এই কারণে নয় যে তাঁর ধারণায় কোনো চিত্তাকর্ষক ব্যাপারে আলোচনা করার উপযুক্ত সময় হচ্ছে, ভোরের আগে যে কয় ঘণ্টা স্তব্ধতা বিরাজ করে। 

একথা সে-কথার পরে ডিউক বললেন, যা দাঁড়াচ্ছে, সাইমনকে উদ্ধার করতে হলে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে সে কোথায়। অসুবিধা হচ্ছে এই যে, ওদের দলের কারুরই ঠিকানা আমরা জানি না যে তার কাছ থেকে মোকাটার ঠিকানা জানতে পারব। 

এ কথায় রেক্স লাফ দিয়ে উঠলেন। বললেন, কেন, ট্যানিথের সাহায্যেই তা জানা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে, তার ঠিকানা আমি সুনিশ্চিত ভাবে জানি। 

সেকি, সে তোমাকে তার ঠিকানা দিল? 

হ্যাঁ, কারণ তখন সে জানত না যে আমি তার দলভুক্ত নই। ঘাবড়াবেন না। নিশ্চয় আমি তার কাছ থেকে যা জানবার জানতে পারব। 

ডিউক বললেন, কিন্তু খুব সাবধান! মহিলাটি অপূর্ব সুন্দরী এবং আমার ধারণা, অত্যন্ত বিপজ্জনক। 

কোনো স্ত্রীলোককেই আমি ভয় করি না, তাছাড়া এই দলের লোকেরা কেউই দিনের বেলায় আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। 

তা ঠিক। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত—এই সময়টা তারা নিতান্তই বলহীন হয়ে থাকে। 

তবে তো ভালই হল। ভোরবেলাই আমি ক্ল্যারিজে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করব। অনেক আলোচনার পর স্থির হল রেক্স ট্যানিথকে সঙ্গে করে পেঙবোর্নে ডিউকের নদীতটের বাড়িতে নিয়ে যাবেন, তখন ডিউক তাঁর সঙ্গে কথা কওয়ার দায়িত্বটা নিজের হাতে নেবেন। কাজটা মোটেই সহজ হবে না বটে, কিন্তু তাহলেও যথাসাধ্য চেষ্টা করা হবে। বিশেষ করে রেক্স বললেন, বছরের গোড়ার দিকে কোনো তরুণীকে পিকনিকে যাওয়ার প্রস্তাবটা সেই তরুণী কিভাবে নেবেন বলা শক্ত। সবে তো আজ এপ্রিল মাসের ২৯–না, ৩০ তারিখ। 

হঠাৎ আঁৎকে উঠলেন কাউন্ট তারিখটা শুনে, এক ভয়ঙ্কর দুর্ভাবনা তাঁকে পেয়ে বসল। বলে উঠলেন, হা ঈশ্বর, এতক্ষণ আমি কথাটা ভেবে দেখিনি! 

কী ব্যাপার? রেক্স জিজ্ঞাসা করলেন। 

ওদের একটা সভার ঠিকানা না হয় আমরা পেলাম, কিন্তু এরকম সভার কেন্দ্র হয়তো ইংল্যান্ডে ওদের গোটা বারো ছড়ানো আছে ওরা সবাই হয়তো এখন ওদের বৃহৎ বাৎসরিক সভার পথে চলেছে। এবং সাইমনকে যে ওরা সেখানেই নিয়ে যাচ্ছে তাতে সন্দেহমাত্র নেই। 

কী বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না। 

রেক্সের কাঁধে হাত দিয়ে ডিউক বললেন, এপ্রিল মাসের শেষ দিনে ইউরোপের প্রত্যেক চাষী দরজায় ডাবল তালা লাগায়। সেই তারিখে যত গোপন অমঙ্গল আত্মপ্রকাশ করে। তা সাইমনকে উদ্ধার করতে হলে আগামী কুড়ি ঘণ্টার মধ্যেই তা করতে হবে। যে রাত আসছে, সেই ৩০শে এপ্রিলের রাত হচ্ছে মে ডে-র আগের রাত। 

স্নান করতে করতে রেক্স পরিস্থিতিটা মনে মনে হিসেব করে দেখলেন। এক, মোকাটা আর এইসব শয়তানের উপাসকরা কাজে কর্মে অত্যন্ত নিপুণ এবং যে কোনো উপায়েই হোক মোকাটা সাইমনের উপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করেছেন। দুই, তাদের কাছে বাধা পেয়েই তারা সাইমনের বাড়ি থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে এবং সেইসঙ্গে সাইমনকে সঙ্গে নিয়েছে। তিন, সাইমনকে তাদের ধর্মে দীক্ষা নেবার পর আর তাড়াতাড়ি সৎপথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। চার, আজ হচ্ছে মে ডে-র আগের দিন। এবং ডিউকের মতে মে-ডেই ওদের বাৎসরিক অধিবেশনের দিন। পাঁচ, একথা অবশ্যই স্বীকার্য যে এই সুযোগে মোকাটা সাইমনকে তাঁর ধর্মে রূপান্তরিত করবেন। তার জন্যে সময় আছে আর বার ঘণ্টার মত এবং সেই সন্ধ্যার মধ্যেই মোকাটাকে খুঁজে বার করতে হবে এবং সাইমনকে উদ্ধার করতে হবে। এবং মোকাটার পিছন নিতে হলে একমাত্র পথ হচ্ছে, ট্যানিথের নিকট থেকে ঠিকানা নেওয়া,—ছলে বলে কৌশলে যেমন করে হোক। স্নান সেরে, পরিপাটি করে প্রাতরাশ শেষ করে রেক্স ডিউকের রোলস্ রয়েসটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন, শোফারকে সঙ্গে না নিয়ে। 

হোটেলে যখন তিনি প্রবেশ করলেন তখন বেলা দশটার একটু বেশি। তাঁর মনে আশা হয়তো নিশ্চয় ট্যানিথ এরই মধ্যে বেরিয়ে যায়নি। তিনি প্রতীক্ষা করবেন ঠিক করলেন। 

রেক্স আলোচনা করছেন, এমন সময় একটি ছোট্ট ছেলে এসে বলল—মিঃ ভ্যান রাইন, মিঃ ভ্যান রাইন। 

সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে রেক্স ছেলেটির মুখের দিকে তাকালেন। আশ্চর্য হলেন ভেবে কেমন করে ছেলেটির তাঁর নাম জানল বা তিনি যে এসেছেন সে খবর পেল। 

ছেলেটির কথায় তিনি বললেন, হ্যাঁ আমি। ছেলেটি বলল, যে মহিলার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন তিনি আমাকে এই বলতে পাঠালেন যে আপনাকে বসিয়ে রাখার জন্যে তিনি দুঃখিত, মিনিট পনেরোর মধ্যেই এসে আপনার সঙ্গে দেখা করবেন। 

ভদ্রমহিলাটি যে ট্যানিথ তাতে তাঁর সন্দেহমাত্র নেই, কারণ সে ছাড়া আর কে হতে পারে? কিন্তু সে কেমন করে জানল যে তিনি এসেছেন? আসতে দেখেছে নাকি? একটু সামলে নিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন, তারপর বেশ জড়সড় একগুচ্ছ শিলাক ফুল কিনে নিয়ে ফিরে এলেন এবং সেই ছেলেটিকে দেখতে পেয়ে সেটা তার হাতে দিয়ে ভদ্রমহিলাটিকে দিতে বললেন। 

মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই লিফটের দরজা খুলে গেল, এলেন বৃদ্ধা কাউন্টেস দুর্ফে, রেক্স নিজেকে সামলে নেবার আগেই তিনি তাঁর আংটি পরা হাত বাড়িয়ে দিলেন। বললেন, ভারি খুশি হলাম আপনাকে দেখে, অনেক ধন্যবাদ আপনি এসেছেন বলে। 

বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলে রেক্স শুধুমাত্র এই জানলেন তিনি ডিউককে আর তাঁকে মোকাটার আর তাঁর দলবলের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করেছেন, ভেবেছেন তাঁদের মত ডিউকরাও সেট-এর কবচের সন্ধানে চলেছেন। আর রেক্স বৃদ্ধার ভুল না ভেঙে সাবধানে এমনভাবে কথা কইতে লাগলেন যাতে তাঁর সন্দেহ না জাগে। এবং তিনি ভদ্রমহিলাকে বোঝাতে পারলেন যে মেটের কবচ উদ্ধারের ব্যাপারে তাঁরা মোকাটার থেকে বেশি শক্তিশালী। এবং সেইসঙ্গে এও জানতে পারলেন যে মহিলাটির ধারণা সাইমন তাঁদের দলেই রয়ে গেছেন। 

বৃদ্ধার অনর্গল বকবকানির মধ্যে একসময় ট্যানিথ এসে হাজির হলেন। রেক্সের হাতে হাত মেলালেন তিনি। রেক্স ভালো করেই জানেন যে ট্যানিথকে আর সাইমনকে বাঁচাতে হলে অন্ধকার নেমে আসার আগেই তা করতে হবে। 

ট্যানিথ বললেন, আপনি কি চেয়েছিলেন যে মাদাম আপনাকে আমার সঙ্গে দেখা করতে দেন? হ্যাঁ এবং সে জন্যে প্রয়োজন হলে আমি সারাদিনই অপেক্ষা করতে প্রস্তুত ছিলাম। এবং যখন দেখা হল তখন নিশ্চয় ভালো করেই আপনার সঙ্গে আলাপ করব। 

রেক্স ট্যানিথের সঙ্গ পেতে ব্যস্ত ছিলেন। তাই যখন ট্যানিথ বললেন তাঁর দুএকটা ছোটখাটো কাজ আছে তখন রেক্স তাঁকে গাড়িতে তুলে সেই সব ঠিকানায় নিয়ে গেলেন কিন্তু কিছুতেই মোকাটার বা দলের কোনো সভ্যের ঠিকানা জানতে পারলেন না। শেষ পর্যন্ত তাঁকে ডিউকের নদীতীরের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্যে গাড়িতে তুললেন। 

এদিকে ট্যানিথকে সন্ধ্যের আগেই দলের সভায় যেতে হবে, বাৎসরিক সভা। কিন্তু রেক্স শুধুই কথা বলে বলে তাঁকে অন্যমনস্ক করতে চেষ্টা করে চলেছেন লক্ষ্য করে তিনি সুযোগের অপেক্ষায় রইলেন। 

এক জায়গায় রেক্স গাড়ি থেকে নেমে গেলেন। একটা টেলিফোন করতে চান। 

টেলিফোনে ডিউককে পেয়ে গেলেন তিনি। জানালেন ওঁদের অধিবেশন কোথায় অনুষ্ঠিত হবে জেনেছেন এবং ট্যানিথকে হাত করেছেন, এবং সে রাজি হয়েছে—হ্যাঁ ঈশ্বর, একি! 

এই সুযোগে যে ট্যানিথ নিজেই গাড়ি নিয়ে পালাবেন তা তিনি একেবারেই আন্দাজ করতে পারেননি। 

আবার তিনি ডিউককে ফোন করলেন, জানালেন কেমন করে ট্যানিথ তাঁকে বোকা বানিয়ে রোলস রয়েসটা নিয়ে পালিয়েছে। উত্তরে ডিউক তাঁকে হাঙ্গারফোর্ডের দি বেয়ার-এ তাঁর জন্যে প্রতীক্ষা করতে বললেন। 

ডিউক স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। মেট্রোপলিটন পুলিশের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার তাঁর সুহৃদ বন্ধু। তাঁকে জানালেন গাড়িটার জন্যে ভাবনা নেই, কিন্তু প্রয়োজনীয় যে সব কাগজপত্র গাড়িতে আছে সেগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাড়িটা নীল রঙের রোলস রয়েস ১৯৩৪ মডেলের নম্বর হল ১২১৬, মালিক ডিউক দ্য রিশলো। গাড়িটা শেষ দেখা গেছে মার্লবোরোর পথে। চালক এক মহিলা, বয়স তেইশ, সুশ্রী, দীর্ঘাঙ্গী, সুকেশা, ফ্যাকাশে মুখে বড় বড় চোখ, পরণে হালকা সবুজ গ্রীষ্মের পোশাক, আর মাথায় ছোট হ্যাট—জরুরি। 

ট্যানিথ ছাড়াও কাউন্টেস দুর্ফের চলাফেরার উপরেও নজর রাখার ব্যবস্থা হলো এবং ঐ দলের আর একজনকেও অনুসরণ করার ব্যবস্থা ডিউক করলেন। তবে, এসবই বেসরকারীভাবে। কিন্তু সাইমনের বা মোকাটার কোনো খবর পাওয়া গেল না। তাহলেও অধিবেশন যেখানে বসছে তার ঠিকানা যখন পাওয়া গেছে তখন আশা আছে, হয়ত একটা শেষ চেষ্টা করে দেখা যাবে। অমঙ্গলের বিরুদ্ধে যথাসম্ভব প্রস্তুতি নিয়ে ডিউক রেক্সকে সঙ্গে করে যাত্রা করলেন। 

পরিষ্কার রাত। তারার অস্পষ্ট আলোয় গ্রামাঞ্চল ঈষৎ আলোকিত। ঘন বনের মধ্যে বড় বড় গাছের আড়লে বিরাট বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, ঘনসন্নিবদ্ধ গাছপালার ফাঁক দিয়ে বাড়ির কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না। শেষপর্যন্ত যা খুঁজছিলেন তা দেখতে পেলেন, এবং যে উচ্চ প্রাচীরে ঘেরা বাড়িটা তার আর এক জায়গার উপর দিকটা ভেঙে পড়েছে। আরও সুবিধে এই ভেঙে যাওয়া ইটগুলো এমনভাবে নিচে পড়ে আছে যে সেগুলোকে সিঁড়ির মত ব্যবহার করে সেখান দিয়ে উঠে ভিতরে যাওয়া সম্ভব। 

ভিতরে গিয়ে তাঁরা একটু অপেক্ষা করলেন, বড় বড় গুঁড়ির ফাঁক দিয়ে তাকালেন। কিন্তু একে অন্ধকার, তার উপর ঘন গাছপালার ভিড়, দৃষ্টি চলল না। 

বুকে ক্রুশচিহ্ন এঁকে আর হাতে একটা করে ক্রুশ ধরে দুজনে চোরা পায়ে এগিয়ে চললেন। 

পাঁচিল থেকে বাড়িটার দূরত্ব দুশো গজের মত, ছায়া-ছায়ামত তাঁদের চোখে পড়ছে। একতলার জানলা দিয়ে অস্পষ্ট আলো আসছে, অস্ফুট গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছে যা থেকে বুঝতে দেরি হবে না যে বাড়িতে অনেক লোকজন আছে। তাঁরা ঠিক করলেন বাড়িটা ঘুরে ফিরে দেখবেন। কত যে দামি দামি গাড়ি। গুণে দেখা গেল, সাতান্নটা অন্তত। একটা জানালা দিয়ে কথাবার্তার আর উচ্চ হাসির আওয়াজ শোনা গেল। দুজনে পা টিপে টিপে সেই জানালার কাছে গেলেন। পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলেন ঘরের ভিতরটা। 

ঘরটা বিশাল বড়। দুটো বিলিয়ার্ড টেবিল সেই ঘরে। বিশেষ পরিপাটিভাবে ঘরটি সাজানো। তারপর দুজনে গাছপালার আড়ালে চলে গেলেন। সেখান থেকে এগিয়ে গেলেন বাড়ির বিপরীত দিকে। অনেক খোঁজার পর তাঁরা একটা জায়গা পেয়ে গেলেন যেখান থেকে একটা ঘরের এক অংশ চোখে পড়ে। মনে হল এ ঘরটায় অতিথিদের অভ্যর্থনা করে আনা হয়। 

জানালার দিকে পেছন ফিরে বসা এক ব্যক্তির জন্যে তাঁদের দৃষ্টি ব্যাহত হচ্ছে বটে, তাহলেও যা দেখতে পাচ্ছেন তাতে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে তাদের সবারই মুখে মুখোশ, আর পোশাক কালো আলখাল্লায় ঢাকা। 

জানালার কাছে যে বসে ছিল সে মাথা ফেরাতে ডিউক লক্ষ্য করলেন, তার বাঁ কানের উপর দিকটা কাটা। এই কান দেখে ডিউকের তাকে পরিচিত বলে মনে হল, কিন্তু ঠিক কোথায়, কী অবস্থায় দেখেছন তা তাঁর মনে পড়ল না। অন্যদের কয়েক জনকে সেদিন সাইমনের বাড়িতে দেখেছেন বলে চিনতে পারলেন। কিছুক্ষণ পরে রেক্স সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন। আলোর সংকীর্ণ রেখায় একজন বেঁটেখাটো মোটাসোটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে দেখলেন, তার মুখে কালো মুখোশ থাকা সত্ত্বেও রেক্স তাঁকে মোকাটা বলে চিনতে পারলেন। এবং আর এক মুখোশধারীকে সাইমন বলে সনাক্ত করতেও তাঁর অসুবিধে হল না। বলে উঠলেন সাইমনকে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু কেমন করে ওর কাছে যাওয়া যায় তা ভেবে পাচ্ছি না। 

আমি ভেবে ভেবে মন ঠিক করতে পারছি না। আসলে ওকে উদ্ধার করার জন্য যেভাবে প্রস্তুত হয়ে আসা উচিত ছিল সে সময় আমরা পাইনি। 

এখন ভাগ্যের উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই, হয়ত উপযুক্ত সুযোগ পেয়েও যেতে পারি। যদি কোনো সময়ে তাকে কোনো ঘরে একা বা সামান্য কয়েক জনের সঙ্গে পেয়ে যাই তবু চেষ্টা করতে পারি। এখন শুধু সুযোগের অপেক্ষায় থাকা। আচ্ছা, ওদের কাজ আরম্ভ করার কোনো সূত্র কি আন্দাজ করতে পারছ? 

না, তেমন কিছুই না। ডিউক আস্তে আস্তে বললেন, ঠিক এগারটা বেজেছে। মাঝরাত্রির আগে নিশ্চয় ওরা শুরু করবে না। সুতরাং আপাতত সময়ের অভাব নেই, এখনই মরিয়া হতে হবে না। ইতিমধ্যে হয়ত উপযুক্ত সুযোগ এসে যেতে পারে। 

আরও মিনিট দশেক এইভাবেই কাটল। হাসি বন্ধ হয়েছে। কিন্তু তাহলেও ঘরের বাইরে থেকেই তাঁরা একটা মৃদু উত্তেজনার আভাস পেলেন। দলের আরও কয়েকজনকে সাইমনের বাড়িতে দেখেছেন বলে ডিউক চিনতে পারলেন। তাঁর মনে হল যেন ঘরটা একটু একটু করে খালি হয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয় ওরা এখান থেকে চলে যাচ্ছে। ডিউক বললেন, মনে হচ্ছে অধিবেশন এখানে নয়, অন্য কোথাও বসবে। এবং এবারই হয়ত আমাদের সেই সুযোগ আসবে। চলে এস। 

খুব সন্তর্পণে তাঁরা চলে গেলেন যেখানে গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক সেই সময়ে একটা বড় গাড়ি লোকজনে ভর্তি হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেখলেন, আর দ্বিতীয় একটা গাড়ি মালপত্রে ভর্তি হচ্ছে, সেটারও ছাড়ার সময় পার হয়েছে। এবং সেটাও ছেড়ে দিল, তার সামনের সীটে দুজন মানুষ। 

ঝোপের আড়ালে থেকে ওঁরা দুজনে গাড়িগুলোর চলে যাওয়া লক্ষ্য করে চললেন, প্রতিক্ষণেই আশা করেছেন সাইমনের সাক্ষাৎ মিলবে। তাঁরা স্থির করেছেন দেখা পাওয়ামাত্রই ঝাঁপিয়ে পড়বেন। কাজটা চরম দুঃসাহসের হবে সন্দেহ নেই, কিন্তু তা ছাড়া আর এখন নতুন করে কল্পনা করার সময় নেই। অন্ধকারের আর এই বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে হয়ত তাঁরা কোনোরকমে কাজ হাসিল করতে পারবেন। 

কোনো গাড়িতেই শোফার নেই, এবং একে একে অর্ধেকগুলো গাড়িতে দু-তিনজন করে চলে গেল। তারপর বড় বড় গাড়িগুলোর এক একটায় পাঁচজন করে উঠছে দেখা গেল। শয়তানপন্থীদের মধ্যে যখন আর দশ বারোজন অবশিষ্ট তখন ডিউক ফিস্ ফিস্ করে রেক্সকে বললেন, মনে হচ্ছে হয়তো আমরা সাইমনকে হারিয়েছি,–এবার আমাদের গাড়িতে ফিরতে হবে নচেৎ ওদের চিহ্ন হারিয়ে ফেলব। 

গাড়ির দিকে সন্তর্পণে এগিয়ে যাচ্ছে, এমন সময় একটি বড় ডিলাজ গাড়ি ওঁদের একশো গজ দূর দিয়ে বেরিয়ে গেল। ডিউকের মনে হল গাড়িগুলো দুমিনিট সময়ের তফাতে এগিয়ে চলেছে নাতে রাস্তায় যানজটের সৃষ্টি না হয়, আর দেখে কোনো শোভাযাত্রা বলেও মনে না হয়। তিনি বললেন, এটাই যদি শেষ গাড়ি হয় তাহলে আমাদের গাড়ির আলো দেখে ওরা সন্দিগ্ধ হয়ে উঠবে আর যদি শেষ গাড়ি না হয় তাহলে ডিলাজটা আমাদের আলো দেখে তাদেরই পরবর্তী গাড়ি বলে মনে করবে। সুতরাং এই হচ্ছে সুযোগ। এই বলে তিনি গাড়ি চালিয়ে দিলেন। রেক্স পেছন দিকে তাকিয়ে ছিলেন, দেখলেন সত্যিই আর একটা গাড়ি এগিয়ে আসছে। সামনের বা পেছনের কোনো গাড়িকেই সন্দিগ্ধ হতে না দিয়ে ডিউক গাড়ি থামালেন, আর পেছনের গাড়িটা তাঁদের থেকে দশ গজ মত এগিয়ে গিয়ে থামল। 

অন্ধকার গাড়িতে বসে ডিউক আর রেক্স চুপি চুপি মতলব ঠিক করলেন, তারপর রেক্স নেমে এগিয়ে গেলেন ব্যাপারটা দেখতে। 

ফিরে এলেন মিনিট দশেক পরে। বললেন, শয়তানপন্থীরা এ পাহাড়ের উপর দিয়ে ওপারের খাদে নেমে যাচ্ছে। 

তাহলে চল আমরা ওদের পিছু নিই। 

শত্রুপক্ষের গাড়িগুলো অবশেষে পৌঁছল পাহাড়ের মাথায়, সেখান থেকে নিচে তাকালে একটা গ্যালারির মত মনে হয়। আর নিচে একটা ছোট হ্রদ। 

ডিউক বললেন, সন্দেহ নেই ওদের শয়তানি এখানেই অনুষ্ঠিত হবে, কারণ এমন কোনো জায়গাতেই তা অনুষ্ঠিত হতে পারে না যেখানে জলাশয় নেই। সাইমন আসছেন কিনা। একটা মাত্র ফ্যাকাসে বেগুনি আলো জ্বলছে, সেই আলোয় তাঁরা অত দূর থেকেও ওদের মোটামুটি দেখতে পেলেন এবং মোকাটার কৃষ্ণকায় ভৃত্যটিকেও তাঁদের চিনতে অসুবিধে হল না। বুঝতে পারলেন এবার ওদের নারকীয় অনুষ্ঠান শুরু হবে। 

ওদের চলাফেরা আর কথাবার্তা ভালো করে লক্ষ্য করার জন্যে তাঁরা চোখ আর কান যথাসম্ভব তীক্ষ্ণ করে সেই অন্ধকারে যেখানে শয়তানপন্থীদের সমাবেশ হয়েছে সেদিকে মন দিলেন। 

জায়গাটা ইস্বার আর টিলস্হেডর—এই দুটি গ্রামের মাঝামাঝি বলে তাঁদের মন হল, আর এর উত্তরে মাইল পাঁচেক দূরে ইস্টারটন গ্রাম। লোক চলাচলের পথ থেকে এ জায়গা অনেকটাই তফাতে, তা ছাড়া সময়টাও মধ্যরাত। সুতরাং কোনো পথিকেরই এখন এখান দিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই, এবং একথা জেনেই শয়তানপন্থীরা এই নিচু উপত্যকাটা বেছে নিয়েছে। 

ক্ষীণ চাঁদের আলোয় তাঁরা দেখলেন টেবিলগুলো প্রচুর পরিমাণ খাদ্যবস্তুতে আর মদ্যে সাজানো হয়েছে। সবাই এক বড়বড় বৃত্তের সৃষ্টি করে সিংহাসন ঘিরে রয়েছে। ডিউক আর রেক্সের সব থেকে নিকটবর্তী যে উপাসক তার দূরত্ব পঞ্চাশ গজের বেশি হবে না। 

এ উৎসব ওদের কতক্ষণ ধরে চলে? চাপা গলায় রেক্স জিজ্ঞাসা করলেন। 

যতক্ষণ না মোরগ ডাকছে, অর্থাৎ, এই ধাতুতে, যখন প্রায় ভোর চারটে তখন পর্যন্ত। অতি প্রাচীনকাল থেকে এই বিশ্বাস চলে আসছে যে মোরগ ডাকার পর আর মন্ত্রতন্ত্রের কোনো প্রভাব থাকে না। সাইমনের দিকে ভালো করে লক্ষ্য রাখ। 

হ্যাঁ তা তো রাখছি। কিন্তু এই এতক্ষণ ধরে ওরা কী করবে? 

প্রথমেই শয়তানের কাছে আনুগত্য স্বীকার করবে। তারপর পেট ভরে খাওয়াদাওয়া করবে, মদ্য পান করবে—অর্থাৎ ওদের প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে, খ্রীষ্টানরা উপাসনার সময় যা যা করণীয় কাজ করে, আর যেভাবে করে তার ঠিক বিপরীতটি করা। ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা উপাসনার আগে উপবাস করে, কিন্তু ওরা উপাসনার আগে পানভোজনে মত্ত হয়। ঐ দেখ, ওদের যারা প্রধান এখন তারা বেদীর সামনে এসেছে। রেক্স লক্ষ্য করল, গোটাছয়েক কালো মানুষ মোমবাতি সাজাচ্ছে—১১টি বাতি দিয়ে একটা বৃত্তের সৃষ্টি করে মাঝখানে একটা বাতি রাখছে। সিংহাসনের সামনে বাতিগুলো জ্বলবে। 

বাতাস বইছে না, তাই বাতির শিখগুলো স্থির হয়ে জোরালো নীল আলো বিকিরণ করছে, তাতে পঞ্চাশ গজ মত জায়গা আলোকিত হয়ে উঠেছে খাবার টেবিলগুলোও সেই আলোর পরিধির মধ্যে পড়ে। এবং এই পরিধির বাইরের সব কিছুই যেন আগের থেকেও বেশি অন্ধকারে ডুবে গেল। 

ডিউক বললেন, জানি এই মোমবাতিগুলো পিচ আর গন্ধক দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি, কিছুক্ষণের মধ্যেই তার গন্ধ পাবে। লক্ষ্য কর পুরোহিতদের; আফ্রিকার জঙ্গলে যে সব উপাসনা দেখবে তার বর্বরতার সঙ্গে এদের বিশেষ পার্থক্য নেই। 

জনতা যে সময়ে টেবিলের উপর ভিড় করছে, ওদের প্রধানরা সেই সময় অদ্ভুত ধরনের পোশাক পরতে ব্যস্ত। কারও পরণে প্রকাণ্ড বেড়ালের মুখোশ যার ল্যাজটা লুটাচ্ছে, কারও মুখোশ ব্যাঙের, কারও আবার হাঁ করা নেকড়ের। মোকাটাকে তখনও চেনা যাচ্ছে তার স্থূল বপুর জন্যে। দু কাঁধে দুটো ডানার নিমিত্তে তাঁকে দেখাচ্ছে প্রকাণ্ড বাদুড়ের মত। 

রেক্সের শরীর কেঁপে উঠল—ঐ আবার পাহাড় বেয়ে একটা কনকনে হাওয়া আসছে। সিংহাসনে যে বসে আছে তাকান তার দিকে, দেখুন তার চেহারা বদলে যাচ্ছে। 

মোমবাতিগুলো জ্বলবার আগে সেই মূর্তি থেকে যে হালকা বেগুনি আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল তাতে এটুকু বোঝা যাচ্ছিল যে সে চেহারা মানুষের এবং তার মুখটা কালো। কিন্তু তাঁদের চোখের সামনেই তা ধূসর হয়ে গেল। আর মাথাটাও বদলে যেতে লাগল। 

আস্তে আস্তে বলে উঠলেন ডিউক, রেক্স, একি এ যে মেণ্ডিসের ছাগল! হাঁ ঈশ্বর কি বীভৎস ব্যাপার! ইতিমধ্যেই প্রাণীর চেহারাটা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। হাত দুটো প্রকাণ্ড খুড়ে পর্যবসিত হল, মাথাটা পরিণত হল এক অতি প্রকাণ্ড ছাগলের মাথায়, দু চোখে ফুটল ভয়াল দৃষ্টি। দু কান খাড়া হল। আর টাক মাথায় চারটে বাঁকানো শিং দেখা দিল। পুরোহিতটা তাদের জীবজন্তুর মুখোশ পরিহিত চেহারা নিয়ে গন্ধদ্রব্য জ্বেলে ঘোরাতে শুরু করল, দুর্গন্ধে রেক্সের প্রায় দম বন্ধ হয়ে গেল। তিনি বলে উঠলেন, ওরা কী পোড়াচ্ছে বলুন তো? 

কাঁটাগাছ, আপেলের পাতা, চিরসবুজ মার্টল গুল্ম ও এমনি আরও কত কী তাদের মধ্যে কয়েকটা দুর্গন্ধ হলে ক্ষতিকর নয়, কিন্তু অন্যগুলো রিপু-উত্তেজক, মানুষকে পশুর পর্যায়ে নিয়ে যায়—তার ফল অবিলম্বেই দেখতে পাবে। যাই হোক এখন সাইমনের দেখা পাওয়া দরকার। 

ঐ—ঐ সাইমন—দেখুন, দেখুন। ঐ ব্যাঙের মুখোশ পরা লোকটার বাঁয়ে। 

এমন সময় উঠে দাঁড়াল এক ছাগল। দেখা গেল তার উচ্চতা পুরোহিতের থেকে অনেক বেশি, পুরোহিতের দিকে পিছন ফিরে সে দাঁড়াল, আর তারা সবাই নীরবে তার কাছে এগিয়ে গেল। 

যারা ছিল তাদের মধ্যে সাইমন ছিলেন সবার পেছনে। তিনিও এগোতে যাবেন, এমন সময় রেক্স ফিস্ ফিস্ করে বলে উঠলেন, এই হচ্ছে সুযোগ, পরে আর এমন সুযোগ নাও আসতে পারে। চুপ চুপ! ডিউকও ফিস্ ফিস্ করে বললেন, দীক্ষা দানের সময় এখনও আসেনি। তা আসবে পানভোজন শেষ হওয়ার পরে। নিশ্চয় এখন আমাদের উপযুক্ত সুযোগ। 

তেমনি দু’জনে শুয়ে শুয়ে লক্ষ্য করতে থাকলেন। এটুকু তাঁরা বুঝেছেন যে তাঁদের সময় প্রায় এসে গেছে, এবং সেই সুযোগেই সাইমনকে উদ্ধার করতে হবে। কিন্তু যতই দুঃসাহসী তাঁরা হোন, এ কাজে যে তাঁদের সাফল্যের সম্ভাবনা অতি অল্প সে বিষয়েও তাঁদের মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই—শত্রুরা সংখ্যায় একশোর কম হবে না। 

রেক্স বললেন, একটা কিছু মতলব বার করুন, কারণ জোর করে যদি সাইমনকে ধরে নিয়ে আসার চেষ্টা করি তো দশ সেকেন্ডের মধ্যেই ওরা আমাদের পাকড়ে ফেলবে। 

ডিউক বিমর্ষ স্বরে বললেন, হ্যাঁ তা তো জানি। ওরা যদি এভাবে সবাই জড়ো হয়ে না থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকত তাহলে হয়ত সাইমনের সঙ্গে যে দু একজন থাকত তাদের মোকাবিলা করতে পারতাম, কিন্তু এখন ব্যাপার যা দাঁড়াচ্ছে তাতে কী করলে ভালো হবে বুঝতে পারছি না। এই মুহূর্তে যদি তাকে জোর করে ধরে আনতে যাই তো আমাদের মৃত্যু অনিবার্য। এবং সেটা ওদের কাছে এই রাতে বিশেষ করেই স্বাগত হবে, সিংহাসনের মূর্তিটির কাছে নরবলি দিয়ে ওরা ধন্য হবে। 

রেক্স বললেন, বলেন কী খুন করবে? আমার কিন্তু তা মনে হয় না, যতই নোংরা আর ন্যক্কারজনক ওদের এইসব প্রক্রিয়া হোক। 

নেতিবাচক ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে ডিউক বললেন, পৃথিবীর উপাসনার সব থেকে পুরানো প্রক্রিয়া হচ্ছে বলি দেওয়া। ওসাইরিসের আর অ্যাডেনিসের হত্যাকাণ্ড, অ্যার্টিসের শাস্তি আর মেক্সিকো ও পেরুর ধর্মবিশ্বাস – এসবের মধ্যে আছে বলিদানের প্রথা। খ্রীষ্টপূর্ব ধর্মগ্রন্থেও পাওয়া যায়, ঈশ্বরের কাছে সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে রক্ত। তাছাড়া সেণ্ট পলও বলেছেন বিনা রক্তে কোনো পূজাই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারে না। রেক্স বললেন, ও তো প্রাচীনকালের অসভ্যদের নিষ্ঠুরতার পরিচয়। 

ঠিক তা নয়, রক্তই হচ্ছে জীবন। মানুষের বা অন্য যে কোনো প্রাণীরই হোক, রক্তপাতের সঙ্গে সঙ্গে একটা তেজ নির্গত হয়ে আবহাওয়ায় ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে এবং বিশেষ কোনো বৃত্তের মধ্যে যদি এই রক্তপাত সংঘটিত হয় তাহলে সেই তেজ ধরে রাখা এবং কাজে লাগানো সম্ভব হয় যেভাবে ইলেকট্রিক তরঙ্গ কাজে লাগানো হয়। 

কিন্তু তা বলে ওরা নরবলি দিতে সাহস করবে? 

সেটা নির্ভর করে তারা মানুষের মধ্যে কি পরিমাণ অমঙ্গল নিয়ে আসতে চায় তার উপরে। যুদ্ধ বাধানো উদ্দেশ্য হলে ওরা যুদ্ধদেবতার মাংসের উদ্দেশ্যে ভেড়া বলি দেয়, – যদি বল্গাহীন লালসাই উদ্দেশ্য হয় তাদের ছাগল বলি দেয়। এইভাবে উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গে বলির পরিবর্তন হয়। এবং যে কোনো উদ্দেশ্যেই সব থেকে ভাল ফল পাওয়া যায় নরবলিতে এবং এই মুহূর্তে ওদের মধ্যে মনুষ্যত্বের বিশেষ অবশেষ নেই। 

কী সর্বনাশ! যেমন করেই হোক এখন আমাদের সাইমনকে উদ্ধার করতে হবে। 

এই সব কাজ সমাধা হলে ওরা এখন খেতে বসবার জন্যে তাড়াহুড়ো করছে। ছুরি কাঁটার কোনো বালাই নেই, হাতে তুলেই সবাই গব-গব করে মাংস খেতে শুরু করল, ইতিমধ্যেই তাদের মধ্যে পশুভাব প্রবল হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে। দেখতে দেখতে তারা পানভোজনে মত্ত হয়ে উঠল। ডিউক আস্তে আস্তে করে বললেন, চল এগোনো যাক একটু। যেভাবে ওরা গোগ্রাসে খেয়ে চলেছে তাতে মনে হচ্ছে, হয়ত সাইমনকে উদ্ধার করার একটা সুযোগ আমরা পেয়ে যাব। মুহূর্তের জন্যে যদি ও দল থেকে কয়েক পা-ও এগিয়ে আসে তো আর কোনো কথা নয়, এক আঘাতে অজ্ঞান করে ফেলতে হবে। গুড়ি মেরে নামতে নামতে দুই বন্ধু হ্রদের কুড়ি গজের মধ্যে এসে গেলেন—বিকট তার দূরত্ব আর মাত্র পনেরো গজের মত মোমবাতির আলোয় ওদের মুখোশ সত্ত্বেও আলাদা করে চেনা সম্ভব হচ্ছিল। 

সাইমনও ওদের মত এমনভাবে একখণ্ড মাংস চিবোচ্ছিল যেন সেও পশুতে পরিণত হয়েছে। মুখোশ পরা এক স্ত্রী লোকের হাত থেকে সে একটা মদের বোতল কেড়ে নিয়ে তার অনেকখানিই সেই মেয়েটির আর তার নিজের মাথার উপর ছড়িয়ে দিল, তারপর বাকিটা গিলে ফেলল। 

রেক্সের মনে হল নিশ্চয় তিনি দুঃস্বপ্ন দেখছেন। নতুবা সাইমনের মত রুচিসম্পন্ন মানুষের পক্ষে, এইসব শিক্ষিত মানুষের পক্ষে কেমন করে এহেন পশুসুলভ ব্যবহার সম্ভব? যাই হোক দুঃস্বপ্ন যে নয় তাতে সন্দেহ নেই। শয়তানপন্থীরা প্রায় আধঘণ্টা ধরে নিতান্ত নেকড়ে আর কুকুরের মতই নিজেদের মধ্যে ধস্তাধস্তি মারামারি আরম্ভ করে দিল, তার ফলে টেবিলগুলো গেল উলটে, সমস্ত জায়গাটা খাদ্যের শেষে আর চিবানো হাড়ের আর খালি বোতলের ভিড়ে ভরে উঠল। 

অবশেষে সাইমনও প্রায় মাতালের মত দল থেকে একটু সরে গিয়ে ঘাসের উপর দু হাতে মাথা রেখে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। 

এইবার—এইবার ওকে উদ্ধার করতে হবে। রেক্স বলে উঠলেন। 

যাবেন বলে উঠে দাঁড়াতে উদ্যত হয়েছেন, এমন সময় কানকাটা লোকটা সাইমনের কাছে গেল, সেইসঙ্গে আরও কয়েকটি নারী-পুরুষ। মহা আক্রোশে দাঁতে দাঁত ঘসে ডিউক বাধ্য হয়েই রেক্সকে অস্ত্রহীন করলেন। ক্ষিপ্তপ্রায় হয়ে বলে উঠলেন, উঁহু, এক্ষুনি নয়, আরও একটু দেরি করতে হবে—নিশ্চয় এর থেকে ভালো সুযোগ পেয়ে যাব। আবার তাঁরা ছায়ার মধ্যে ফিরে গেলেন। যারা টেবিলে খেতে বসেছিল ইতিমধ্যে তারা টলতে শুরু করেছে। তারা ফিরে গেল সিংহাসনে আরূঢ় ছাগলের নিকটে, রেক্স আর ডিউক এমন একাগ্রভাবে সাইমনের উপর দৃষ্টি রাখছিলেন যে তখনও পর্যন্ত লক্ষ্য করেননি যে এরমধ্যেই মোকাটা আর তাঁর জনাছয়েক অনুচর একটা বিশেষ টেবিল বিছিয়ে ছাগলের কাছে বসে খেতে শুরু করেছে। কিন্তু অন্যদের থেকে এদের অনেক বেশি প্রকৃতিস্থ মনে হচ্ছে 

রেক্স বললেন, তাহলে শয়তানও খায় দেখছি। 

হ্যাঁ এবং অন্তত তার প্রধান পুরোহিতরা যে খায় তাতে আর সন্দেহ কী! এবং খাবারটা যে নরমাংস তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। হয়ত কান সদ্য প্রসূত মৃত শিশুকে কিংবা চুরি করে আনা কোনো শিশুকে হত্যা করে রান্না করেছে,—যাই হোক ওটা যে নরমাংস তাতে সন্দেহমাত্র নেই। 

এই সময় একটা প্রকাণ্ড কড়াই এনে সিংহাসনের কাছে রাখা হল। তখনি মোকাটা আর তাঁর সঙ্গীরা প্রত্যেকে তাদের পাত্র থেকে খানিকটা করে মাংস সেই কড়াইয়ে ফেলে দিলেন। আর একজন একটা গোলাকার বস্তু কড়াইয়ে ফেলে দিতে একটা আওয়াজ উঠল। বস্তুটা যে কী তা বুঝতে পেরে আর রেক্সের মনে ডিউকের কথার সত্যতা সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ রইল না,—সেটা একটা মড়ার মাথার খুলি। 

ডিউক বললেন, এইসব মাংস যে কড়াইয়ে ফেলা হচ্ছে এগুলোর সঙ্গে আরও কিছু মিশিয়ে আবার সেদ্ধ করা হবে, তারপর তার সঙ্গে ছাই মিশ্রণ করে যে বস্তু তৈরি হবে অনুষ্ঠানের শেষে ওরা তা খাবে।—হা ঈশ্বর, এবার ওরা যা করতে যাচ্ছে তার থেকে অধৰ্ম আর কিছু হতে পারে না। তাকিও না, তাকিও না ওদিকে, এই বলে তিনি দু হাতে মুখ ঢাকলেন। কিন্তু কী এক আশ্চর্য আকর্ষণে রেক্স প্রত্যক্ষ করে চললেন। 

চার ফুট লম্বা একটা কাঠের ক্রুশ ছাগলটার দুই পায়ের মাঝখানে রাখল। তারপর সেটাকে ভীষণ জোরে পাথরের উপর আছড়ে মারা মাত্র সেটা ভেঙে দু টুকরো হয়ে গেল। তারপর বেড়ালের মুখোশ পরা লোকটা ক্রুশের ভাঙা দণ্ডটা তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিল সঙ্গীদের দিকে, আর তারা সেটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলল, আর সে ক্রুশটা নিয়ে উল্টো করে সিংহাসনে বসা ছাগলের নিকটে পুঁতে দিল। 

একটা বৃহৎ পানপাত্র ওদের হাতে হাতে ফিরছিল, রেক্স লক্ষ্য করে চললেন। একজনের হাত থেকে আর একজনের হাতে এই করতে করতে শেষে ঐ পাত্রটি বেড়ালের মুখোশ পরা মানুষটির হাতে গেল। তারপর আর এক ব্যক্তি গোলাকার একটা বস্তু নিয়ে এলে রেক্স সেগুলিকে বিস্কুট বলে চিনতে পারলেন। কোনো গীর্জা থেকে চুরি করা হলেও পবিত্র বস্তু বলে পরিচিত। 

শয়তানপন্থীরা এই অত্যন্ত পবিত্র বিস্কুটগুলোকে টুকরো-টুকরো করে সেই পাত্রে রাখল, তারপর ভাঙা ক্রুশটা দিয়ে একটু নড়বার পর সেটা ছাগলের কাছে দিল। তখন ছাগলই দু পায়ে সেটা ধরে আচমকা এমনভাবে ছিটকে দিল যে সমস্তটাই পড়ে গেল। তারপরে সবাই সেই পবিত্র বিস্কুটের ভগ্নাবশেষের উপরে উদ্দাম নৃত্য আরম্ভ করল। সমস্ত কিছুই সংঘটিত হলো সম্পূর্ণ নিঃশব্দে। কেউ একটা কথাও উচ্চারণ করল না। 

এ আর সহ্য হয় না! রেক্স বলে উঠলেন, নিশ্চয় ওরা সবাই পাগল হয়ে গেছে। ভাগ্যে ট্যানিথ এখানে নেই, নিশ্চয় সেও সহ্য করতে পারত না। এরপর শুরু হল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে গান সহযোগে এক উদ্দাম উলঙ্গ নাচ, যার বর্ণনা না দেওয়াই ভালো। 

এই ব্যাপার পুরোদমে চলছে, হঠাৎ ডিউক চট করে উঠে বসলেন : রেক্স, এবারে আর কিছু না করলেই নয়, কারণ এর পরেই ওদের অভিষেক ক্রিয়া আরম্ভ হবে, এবং তা সম্পন্ন হওয়ার পর আর আমাদের কোনো আশাই থাকবে না। 

সমর্থন করে রেক্স তাঁকে বললেন, হ্যাঁ ওদের এখন যা অবস্থা তাতে হয়ত এই মুহূর্তে কাজটা অসম্ভব হবে না। তা ছাড়া এখন ওদের পরণে কিছু নেই, এই অবস্থায় বিশেষ লড়াই করা ওদের পক্ষে সম্ভব হবে না। 

.