পুনরায় ট্রেটার নীরবতা ভাঙ্গল, তার গলায় গম্ভীর আবেদনের সুর। তিনি বললেন, দয়া করে আমার বক্তব্যটা বোঝাবার চেষ্টা করুন মন দিয়ে। পুলিস কর্তৃপক্ষের বিশ্বাস আপনাদেরই কোনো একজন এখন গভীর বিপদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন এসে। মনে রাখবেন আপনারা, খুবই সাংঘাতিক ধরনের বিপদ। কার ভাগ্যে এই দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে, সেই প্রশ্নের মীমাংসা করাই এখন সবার আগে প্রয়োজন।
তবুও কথা শোনা গেল না কারুর মুখে।
প্রশ্নটা শুরু করি। মিঃ প্যারাভিসিনি, আপনি…?
মিঃ প্যারাভিসিনি ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক টেনে দিল যেটা ছিল সাময়িক। প্রতিবাদের ইঙ্গিতে হাত নাড়তে লাগলেন। তার আচার-আচরণে বিদেশী ঢং সহজেই চোখে লাগে।
এ অঞ্চলে আমি যে একজন নবাগত বিদেশী, সে কথা সার্জেন্ট ভুলে যাবেন না। এখানকার স্থানীয় কোনো ঘটনার সঙ্গেই আমার যোগ ছিল না কোনো কোনোদিন ছিলোও না।
মিঃ রেন?
ক্রিস্টোফারের শানিত কণ্ঠ বেজে উঠল। সে বলল– ওই ঘটনার আমার বয়স ছিল খুবই কম। এমন কি সমস্ত ঘটনাটাও এখন আমি আবছাভাবে মনে করতে পারি না।
মেজর মেটকাফ…এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?
ভদ্রলোক উত্তর দেবার জন্য ঠিক প্রস্তুত ছিলেন না। তাই তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন– দৈনিক পত্রিকার মারফৎ আমি সমস্ত ঘটনাটাই, জানতে পারি, কিন্তু তখন আমি চাকুরীসূত্রে এডিনবুয়োয় থাকতাম।
ট্রেটার বললেন, এই আপনাদের শেষ কথা তাহলে? কেউ কিছু বলবেন আর?
আবার সেই আগের মত নীরবতা নেমে এল।
আস্তে আস্তে ট্রেটার তার বুকের মধ্যে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন। বললেন– যদি আপনাদের মধ্যে কেউ মারা যান–কথাটা থামিয়ে সকলের দিকে তাকিয়ে আবার বললেন তবে তার জন্য তিনিই দায়ী থাকবেন। এই বলে তাড়াতাড়ি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
আপন মনে রেন চেঁচিয়ে উঠে বললেন– কি আশ্চর্যের ব্যাপার! ঠিক যেন কোনো রোমাঞ্চকর নাটকের দৃশ্য। …তবে ভদ্রলোকের চেহারাটা যে রীতিমতো সুন্দর সন্দেহ নেই তাতে। এইজন্য পুলিস কর্মচারীদের এত পছন্দ করি আমি। কত শক্তসমর্থ আর দৃঢ়চেতা, সমস্ত পরিবেশটার মধ্যেও একটা ভয়ার্ত শিহরণের ঘনঘটা। ছেলেভুলানো ছড়াটাও বেশ মজার তাই না। তিনটে ইঁদুর অন্ধ…জানলা কপাট বন্ধ…
শিস্ দিয়ে ছড়ার সুরটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল রেন।
মলি এবার বিমূঢ় চিত্তে চেঁচিয়ে উঠে বলল– দোহাই আপনার, থামুন..থামুন।
রেনের চোখেমুখে হাসির ছটা। বলল– কিন্তু ম্যাডাম এটাকে আমার স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দেরই প্রকাশ বলে মেনে নেবেন। জীবনে কখনো কোনো খুনের মামলায় জড়িয়ে পড়ার সৌভাগ্য হয়নি। এ অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন। সেই কারণে বুকের মধ্যে অস্থির একটা উত্তেজনা অনুভব করছি।
মিসেস বয়েল গর্জে উঠে বললেন, নাটক না ছাই। আমি এর একবর্ণ বিশ্বাস করি না।
ক্রিস্টোফারের চোখে আনন্দের ঝিলিক দিয়ে উঠল। সে বলল–তাহলে মিসেস বয়েল, এক মিনিট অপেক্ষা করুন আপনি, মৃদুস্বরে ফিসফিস করে সে বলল–আমি নিঃশব্দে পেছনে দাঁড়িয়ে আপনার গলাটা…
মলির ভয়ার্ত গলা ভেদ করে একটা যন্ত্রণাকাতর শব্দ বেরিয়ে এল। রাগের ঝঝও দেখা গেল জিলের গলায়। সে বলে উঠল–মিঃ রেন, আপনার পৈশাচিক ঠাট্টার জন্য আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। সম্ভবতঃ সভ্য সমাজের রীতিনীতিগুলো…
মেজর মেটকাফ ব্যাজার মুখ করে বললেন–যদিও এটা কোনো ঠাট্টাতামাশার ব্যাপার নয়।
প্রতিবাদে মুখর হয়ে রেন বলল–কিন্তু মেজর সত্যিই কি তাই? পাগলদের তো ঠাট্টা তামাশা এরকমই হয়ে থাকে। আর সেইজন্যই তো সমস্ত পরিস্থিতিটির মধ্যে একটা অদ্ভুত মাদকতা মিশে আছে।
তার দুটো চোখ সবার চোখের উপর দিয়ে ঘুরে গেল আস্তে আস্তে। ঠোঁটের ফাঁকে লেগে রয়েছে তার হালকা হাসির রেখা। সে বলল–একবার যদি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের বর্তমান চেহারাগুলো আপনারা দেখতেন…।
ট্রেটারের মতোই সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেলেন তিনি।
মিসেস বয়েলই এই চেতনা ফিরে পেলেন। তিনি বললেন–সভ্যতা ভব্যতার লেশটুকুও নেই ওর মধ্যে। কথাবার্তাগুলো শুনলে মনে হয় বিকৃত মস্তিষ্কের লোক। কিন্তু এমন ভাব দেখায় যেন তার খুব টনটনে জ্ঞান।
চিন্তার সুরে মেজর বলল–ভদ্রলোক বলেছিলেন, গত যুদ্ধের সময় একবার বিমান দুর্ঘটনার মুখে পড়ে তাকে নাকি পুরো আটচল্লিশ ঘণ্টা থাকতে হয় মাটির নিচে কবরস্থ হয়ে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ঘটনাটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
মিসেস বয়েল তার গলায় কাঠিন্যের ছোঁওয়া রেখে বললেন, লোকে তাদের স্নায়ুদূর্বলের কারণ হিসাবে এত বাজে অজুহাত দেখায়… আমি জোর গলায় বলতে পারি যে এই যুদ্ধের ধকল আমাকেও খুব একটা কম সামলাতে হয়নি। অনেকের চেয়ে আমারই অভিজ্ঞতা বেশি। তবে তার জন্য স্নায়ুবিক বৈকল্য আমার ঘটেনি।
তির্যক সুরে মেটকাফ বললেন–আমার মনে হয় বর্তমানে যা কিছু সমস্যা সব আপনাকে ঘিরে মিসেস বয়েল!
তার মানে? কি বলতে চান আপনি? মিসেস বয়েল জিজ্ঞেস করলেন।
মেটকাফ শান্ত গলায় বললেন–১৯৪০ সালে আপনিই তো এ অঞ্চলের রিফিউজি পুনর্বাসন দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত অফিসার ছিলেন। কথার মাঝখানে ভদ্রলোক এক নজর তাকালেন মলির দিকে। বিষাদগ্রস্ত ভঙ্গিতে মলি মাথা নাড়ল, তিনি আবার প্রশ্ন করলেন-বলুন তো, কথাটা কি সত্যি নয়?
মিসেস বয়েলের চোখে মুখে দেখা গেল রাগের ছাপ। তিনি বললেন–তাতে কি অন্যায়টা হয়েছে? ঝাঝালো সুরে তিনি জানতে চাইলেন।
মেটকাফ গম্ভীর গলায় বলল–তিনটে অনাথ শিশুকে লরিজ ফার্মে পাঠানোর জন্য আপনিই মুখ্যত দায়ী।
কিন্তু মেজর মেটকাফ ওইরকম শোচনীয় ঘটনার জন্য কেনই বা দায়ী থাকবো আমি বলতে পারেন? আমি ওই ফার্মের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সন্তুষ্ট হয়েছিলাম। তারাও তিনটে বাচ্চাকে সবিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছিল মানুষ করবার দায়িত্ব নিয়ে। তবে আমি কেন মাঝখানে দোষের ভাগীদার হব, বা এর দায়-দায়িত্ব সমস্তই আমার উপর বর্তাবে…? শেষের দিকে তার গলার স্বর ম্লান হয়ে গেল।
জিল তীক্ষ্ণকণ্ঠে চেঁচিয়ে বলল–সার্জেন্ট ট্রেটারকে আপনারা এ সম্বন্ধে সবকিছু জানালেন না কেন?
চড়া সুরে বয়েল উত্তর দিলেন–এটা পুলিসের কোনো ব্যাপার নয়, আমি নিজেই দেখাশোনা করতে পারি নিজেদের।
মেটকাফ মৃদুস্বরে তার মন্তব্যটা ছুঁড়ে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। তিনি বললেন– আমরাও দেখবার একটা সুযোগ পাব।
জিল প্রশ্নের বান ছুঁড়ে দিল মলির দিকে–তুমি কি ভদ্রমহিলাকে আগে থেকে জানতে?
বাজারের সামনেই বড় রাস্তার উপরেই তো আপনাদের দোতলা বাড়ি ছিল তাই না?
সেটা সামরিক কর্তৃপক্ষ জরুরী প্রয়োজনে দখল করে নিয়েছিলেন। বয়েল কথার উত্তর দিলেন। তারপর আবার বিরাজপূর্ণ স্বরে আবার বললেন–এখন একেবারেই অবস্থা ভেঙ্গে গেছে! জানলা বরগাগুলোরও আর চিহ্ন নেই কোনো, হয়ত খুঁজে পাওয়াই যাবে না। এটাতো একধরনের ডাকাতি বললেই হয়।
অকারণে হাসতে শুরু করেন মিঃ প্যারাভিসিনি। তাঁর হাসির ভঙ্গিটাও সম্পূর্ণ আলাদা। পেছন দিকে মাথা হেলিয়ে চোখ দুটো বুজে দুর্বল বেগে তিনি হেসে চললেন।
হাসির ফাঁকে ফাঁকে তিনি সকলের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বললেন–তামাকে মাপ করুন। কিন্তু সমগ্র ঘটনাগুলো এতই মজার যে হাসিটাকে আমি কিছুতেই আর সামলাতে পারছি না। হ্যাঁ, সত্যিই পরিবেশটাকে খুব ভালোভাবে আমি উপভোগ করছি!
সার্জেন্ট ট্রেটার ভেতরে পা দিলেন। তার দু চোখের বিরূপ দৃষ্টি হাস্যরত প্যারাভিসিনির মুখের উপর কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। বিরক্তিতে তার দীর্ঘ ভজ জোড়া কুঁচকে গেল। তারপর বললেন, প্রত্যেকে যে বর্তমান পরিস্থিতির জন্য একটা মজার ইন্ধন খুঁজে পেয়েছেন এজন্য বিশেষ আনন্দিত আমি।
আমি দুঃখিত ইনসপেক্টর! সত্যিই খুবই অনুতপ্ত আমি, এর জন্য আপনার সাবধান বাণীই কিছুটা হালকা হয়ে যেতে বসেছে।
ট্রেটার হাল্কাভাবে নিজের বঁটা বাঁকিয়ে বললেন–সমস্ত পরিবেশটা আপনাদের চোখের সামনে ফুটিয়ে তোলার যথাসাধ্য চেষ্টা করছি আমি। যদিও, আমি ইনসপেক্টর নই সামান্য একজন সার্জেন্ট মাত্র। ট্রেটার মলির দিকে একবার ঘুরে দাঁড়ালেন। বললেন–মিসেস ডেভিস, আমি এখনকার ফোনটা একবার ব্যবহার করতে চাই।
প্যারাভিসিনি নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলল–সত্যিই আমি ব্যাপারটাকে বড় বেশি ঘু করে তুলেছি। এখানে তার বেশিক্ষণ না থাকাই ভালো।
তবে তার চালচলনে কোনো চিহ্নই ছিল না আত্মগোপনের জন্য, সহজাত বলিষ্ঠ পদক্ষেপেই তিনি বিদায় নিলেন সেখান থেকে।
জিল মন্তব্য করলেন–ভদ্রলোক সত্যিই গভীর জলের মাছ।
ট্রেটার বললেন–হ্যাঁ, কেন যেন অপরাধী সুলভ মনোভাব, এক বিন্দুও বিশ্বাস করা উচিত নয়।
মলি চেঁচিয়ে বলল–তাই বুবি : তাহলে…তাহলে আপনি কি মনে করেন.কিন্তু বয়সটাতো বেশি দেখায় অনেকটা। অবশ্য এই বয়সটাই সত্যি কিনা সেটা জানা খুবই কঠিন। মেকআপ করেও অনেকসময় বয়স বাড়িয়ে নেওয়া যেতে পারে তবে ভদ্রলোক যখন চলাফেরা করেন তখন মনে হয় যেন এক যুবকই হেঁটে যাচ্ছে। সত্যিই সার্জেন্ট, খুব সম্ভবতঃ মিঃ প্যারাভিসিনি গোপন করতে চায় তার আসল বয়সটা। সত্যিই কি আপনি ওনাকে সন্দেহ করছেন।
সার্জেন্ট ট্রেটার বিরক্তি সহকারে মলির উত্তরটা বা সিদ্ধান্তটা ভেঙ্গে দিয়ে বললেন ঐভাবে শুধুমাত্র কল্পনার উপর নির্ভর করে আমরা সঠিক জায়গায় গিয়ে পৌঁছতে পারব না, মিসেস ডেভিস। তবে সুপারিন্টেন্টে হগবেনকে সব খুলে বলতে হবে। কথা বলতে বলতেই তিনি টেলিফোনটার দিকে এগিয়ে গেলেন।
মলি মাথা নেড়ে বলল–কিন্তু এখন আর তা সম্ভব নয়। কারণ ফোন এখন অচল।
ট্রেটার চমকে চোখ তুলে তাকিয়ে বললেন–কি বললেন? ফোন অচল? কখন থেকে? তার গলার স্বরের তীক্ষ্ণতায় সকলে চমকে উঠলেন।
একটু আগেই মেজর মেটকাফ রিং করছিলেন তখনই ধরা পড়ল ব্যাপারটা।
কিন্তু সকালে তো লাইন চালু ছিল! সুপারিন্টেন্টে হগবেনের জরুরী নির্দেশও পেয়েছেন। আপনারা!
হা, সে কথা ঠিক। বোধ হয় সকাল দশটা নাগাদই ফোনটা বিকল হয়ে যায়, বাইরে যা অবস্থা, কোথাও হয়ত তার ছিঁড়ে গেছে!
ট্রেটারের গম্ভীর মুখটা তাও কাটলো না। তিনি বললেন–খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার! তিনি যেন নিজেকে শুনিয়েই বললেন, কেউ ইচ্ছে করেই লাইন কেটে দিতে পারে।
মলির দুচোখে দেখা গেল অবাকের ছাপ। সে বলল–আপনার কি ধারণা?
ঐ বিষয়ে প্রয়োজন নিশ্চিত হওয়া–ট্রেটার কথাটা বলতে বলতে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেল। জিল দু-এক মুহূর্ত ইতস্ততঃ করল। এর পর সার্জেন্টের পেছন পেছন সেও একসময় চোখের বাইরে চলে গেল।
মলি করুণ সুরে আর্তনাদ করে বলল–হ্যায় ভগবান, লাঞ্চের সময় তো প্রায় হয়ে এল। আমাকে এখনি গিয়ে সব কাজ শেষ করতে হবে। তা না হলে অতিথিদের আর খাওয়া জুটবে না।
মলি ঘর ছেড়ে দৌড়ে চলে যাওয়ার পর মিসেস বয়েল ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলেন–পদে পদেই অযোগ্যতার চূড়ান্ত নিদর্শন! এটা কি একটা হোটেল। আমি কখনও এর জন্য সপ্তায় সাত গিনি দিতে রাজী নই।
সার্জেন্ট ট্রেটার টেলিফোনের লাইন ধরে সামনের দিকে এগিয়ে চললেন। তিনি বললেন এর সঙ্গে কোনো অন্য সংযুক্ত লাইন আছে নাকি? তিনি জিলকে প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ, দোতলায় শোবার ঘরে এর লাইনটা টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে! আমি কি দেখে আসব ওপরে গিয়ে?
যদি কিছু মনে না করেন…?
ট্রেটার জানলার সার্শি খুলে মাথা ঝুঁকিয়ে দেখতে লাগলেন বাইরেটা। সার্শির গায়ে জমে থাকা বরফের টুকরোগুলো ঝরিয়ে দিলেন ঠুকে ঠুকে। জিত দোতলায় উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে!
বড় ড্রইং রুমটার মধ্যে ছিলেন প্যারাভিসিনি। দেওয়ালের গা ঘেঁষে বিরাট লম্বা ধাঁচের সাবেকী আমলের পিয়ানো, তিনি আস্তে আস্তে পায়ে এগিয়ে গিয়ে সাদাকালো রীডের ওপর হাতটা রাখলেন। ক্ষিপ্ত আঙ্গুলগুলো তার সঞ্চালনের সঙ্গে সঙ্গে সারা হলটা করে উঠল গমগম। ছেলেভুলানো ছড়ার সুরটা যেন বুকের মধ্যে বয়ে আনলো রহস্যের মাদকতা।
তিনটে ইঁদুর অন্ধ।
জানলা কপাট বন্ধ
বন্ধ ঘরে তারা
ছুটতে ছুটতে সারা…
একটি সোফায় গা এলিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন শোবার ঘরে ক্রিস্টোফার রেন। যন্ত্রসঙ্গীতের বাজনা তার কানে এল, কিছুটা আনন্দ সহকারে রেন সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের বাইরে পায়চারি করতে লাগল। গানের তালে তালে শিস্ দিতে শুরু করল মৃদুস্বরে। আচমকাই বন্ধ হয়ে গেল তার শিস্। রেন এবার পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে বসে পড়লেন শৌখিন মেহগনি। খাটের প্রান্তে। তার সারা দেহটা অস্থির একটা আবেগে থরথর করে কেঁপে উঠল। ক্রিস্টোফার দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। কান্নার ফাঁকে ফাঁকে বিড়বিড় করে বলল আর পারছি না! আমি আর পারছি না…
পরক্ষণেই তার স্বভাবে ঘটল এক আমূল পরিবর্তন। কান্নার আবেগটুকু শক্ত হাতে মুছে দিয়ে তিনি দৃঢ় পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–পারতেই হবে।…নিয়তি নির্দিষ্ট এই পথ দিয়েই আমাকে চলতে হবে। তার গলায় দেখা গেল প্রত্যয়ের সুর।
জিল তার নিভৃত শোবার ঘরে টেলিফোনটার পাশে দাঁড়িয়েছিলো। দেওয়ালের ধারে সরু কাঠের জানলায় মলির পোশাক পরিচ্ছদ সাজানো আছে। একটা পশমের দস্তানা গড়াগড়ি যাচ্ছে মেঝের ওপর। জিল হেঁট হয়ে দস্তানাটা তুলে নিয়ে টাঙ্গিয়ে রাখল আলনার হুকের ওপর। একটা গোলাপী রঙের বাসের টিকিট উড়তে উড়তে এসে পড়ল জিলের কোটের গায়ে। টিকিটটা যে দস্তানার মধ্যে থেকেই বেরিয়ে এসেছে সেটা তার নজরে এড়ায়নি। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে কোটের উপর সেঁটে থাকা ডাকটিকিটটা কাগজের টুকরোর দিকে জিল তাকিয়ে রইল। আস্তে আস্তে তার মুখের স্বাভাবিক রঙটা গেল বদলে। কিছুক্ষণ আগে যে লোকটা এখানে এসেছিল, এ যেন সে নয়। স্বপ্নের মত আস্তে আস্তে এসে যে দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল সে বোধহয় অন্য কেউ। ও বাইরে বেরিয়ে এক মিনিটের জন্য থমকে দাঁড়াল। লম্বা টানা বারান্দার বিপরীত দিকে এক পলক দেখে নিল চওড়া সিঁড়িটা।
মলি একে একে সমস্ত আলুর খোসা ছাড়িয়ে রাখলো একটা পাত্রের মধ্যে। তারপর তাতে নুন-মশলা ছড়িয়ে উনুনের উপর বসিয়ে দিল। তার বাঁপাশে জ্বলছে আরো দুটো গ্যাসের উনুন। তাদের প্রত্যেকটির মাথার ওপরে বসানো বিভিন্ন রকম আয়তনের পাত্র। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস মলি ফেলল। যেন সব কিছুই এগোচ্ছে পরিকল্পনা মতো।
কিছুটা দূরেই টেবিলের ওপর দুদিনের পুরোন ইভনিং স্ট্যাণ্ডার্ডটাও নজরে পড়ল, তবে তার ক্রু জোড়া আপনা-আপনি কুঁচকে গেল। শুধু যদি ঘটনাটা মনে রাখতে পারত…
হঠাৎ যেন তার মাথায় বজ্রপাত হল। দু-হাতে চোখ ঢেকে ভয়ার্ত সুরে চেঁচিয়ে উঠল মলি, না…না…কখনই না…।
আবার আস্তে আস্তে মলি হাত নামাল। তার দুচোখে রয়েছে একটা বিভ্রান্তির ছাপ। এমন ভাবে সে সবদিকে চোখ মেলে চাইল মনে হল এ পরিবেশে সে যেন নতুন। অথচ ঘরটার মধ্যে আবহাওয়াটা এতই গরম ও আরামদায়ক, কত খোলামেলা। তার সঙ্গে মনের মত খাদ্যবস্তুর তৃপ্তিকর গন্ধ।
চাপা কণ্ঠে মলি আবার ফিসফিস করে বলল–না..না…এ হতে পারে না।
স্বপ্নের মতোই মলি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। রান্নাঘরের বাঁদিকের দরজা পার হয়ে দাঁড়াল বড় হলঘরটার মধ্যে। সমস্ত বাড়িটার মধ্যে বিরাজ করছে এক অদ্ভুত নীরবতা। কেবলমাত্র অনেক দূরে মনে হচ্ছে কেউ যেন একনাগাড়ে শিস্ দিয়ে চলেছে। তার খুব পরিচিত সুরটা। কান পেতে ভালোভাবে শোনার চেষ্টা করল সেই সুরটা মলি। কিছুক্ষণের পর এক তীব্র অস্বস্তিতে তার সর্বাঙ্গ শিউরে উঠল। সেই ছেলেভুলোনো সুরটা।
মলি ভয়ে ভয়ে তার রান্নাঘরে ফিরে গেল। পরিচিত পরিবেশের মধ্যে দাঁড়িয়ে নিজের মনটা কিছুটা স্বস্তি পেল। হ্যাঁ, সুশৃঙ্খলভাবেই যেন সবকিছু এগিয়ে চলছে।
মেজর মেটকাফ পিছনের সিঁড়ি বেয়ে বড় হলঘরটার মধ্যে ঢুকলেন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন এক মিনিট। তারপর সিঁড়ির নিচে বাসনপত্র রাখবার জন্য কাঠের আলমারীর দিকে গেলেন এগিয়ে। চারদিকে শেষবারের মত একবার চোখ তুলে তাকাল। কেউ নেই আশেপাশে। কোনো সাড়াশব্দও পাওয়া যাচ্ছে না। কাজকর্ম সব সেড়ে নেবার এটাই হল উপযুক্ত সময়।…
একা একা ঘরের মধ্যে পশমের মাফলার বুনছিলেন মিসেস বয়েল। বোনার কাজটা বন্ধ রেখে রেডিওর সুইচটা অন্ করে দিলেন হাত বাড়িয়ে। চোখেমুখে তার যেন লেগে রয়েছে। বিরক্তির ছাপ। মেয়ে গলার সুন্দর প্যানপ্যানানি তার বিরক্তিকে আরো যেন বাড়িয়ে তুলল। ছেলেভুলোনা ছড়াটার মানে নিয়েই ভদ্রমহিলা বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। একটু অধৈর্য হয়ে মিসেস বয়েল রেডিওর নবটা আবার ঘোরালেন। এখানেও পুরোদমে চলছে বক্তৃতা। তবে সুরটা ছিল পুরুষ মানুষের। এবং গলাটাও ছিল বেশ ভরাট ও মার্জিত। মানসিক কীর্তির বিচিত্র গতিপ্রকৃতি বিষয়েই তিনি আলোচনা করছিলেন।
বক্তা বলছিলেন, ভয়ের দিকটাই প্রথমে ভালোভাবে লক্ষ্য করতে হবে। মনে করুন নিঃশব্দে আপনার পেছনের দরজাটা খুলে গেল…
সত্যি সত্যি পেছন দিকের একটা দরজা নিঃশব্দে গেল খুলে।
মিসেস বয়েল ভীষণ ভাবে চমকে উঠে পেছন দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ওঃ আপনি? তারপর বয়েল একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, তারপর আবার বললেন কি ক্লান্তিকর অনুষ্ঠানই যে রেডিওর মাধ্যমে প্রচার করা হয়। আমি তো দুদণ্ড ধৈর্য্য ধরে শোনার মত কিছুই খুঁজে পাই না।
আজকাল আমি রেডিও নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাই না মিসেস বয়েল।
মিসেস বয়েল একটু রেগে গেলেন। বললেন–কিন্তু তাছাড়া এখানে করার মত কী-ই আছে। সম্ভাব্য খুনির সঙ্গে বাস করা অবশ্য যদিও আমি ওইসব আজগুবি নাটকের একবিন্দুও বিশ্বাস করি না…
আগন্তুক বললেন–সত্যিই বিশ্বাস করেন না, মিসেস বয়েল?
মিসেস বয়েল বললেন–আপনার এ প্রশ্নের অর্থ…?
আগন্তুকের বর্ষাতির বেল্টটা এত দ্রুত গতিতে মিসেস বয়েলের গলায় জড়িয়ে গেল, তিনি এর ভেতরকার মর্মার্থটা ঠিকমত বুঝে উঠতে পারলেন না। রেডিওর আওয়াজটা আরও বেশি করে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সারা ঘরটা বিদগ্ধ বক্তার গমগমে হয়ে উঠেছে তার বক্তৃতায়।
তবে মিসেস বয়েল গণ্ডগোল করতে পারেনি শেষ সময়ে। কারণ হত্যাকারী সত্যিই দক্ষ এবং তৎপর। সকলেই বড় রান্নাঘরে জমায়েত হল। গ্যাসের আগুনে টগবগ করে ফুটছে আলুগুলো। মাংসের ডেকচি থেকে বের হয়ে আসছে রসনার তৃপ্তিকর সুগন্ধি।
সন্দেহের চোখে একে অপরকে দেখে চলছে। মলি পাঁচপায়ার চেয়ারে গা এলিয়ে বসেছিল। তার সমস্ত মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ভয়ে। তার দুচোখে রয়েছে উদভ্রান্ত দৃষ্টির ছাপ। সার্জেন্ট ট্রেটার খুব জোরের সঙ্গে মলিকে বীয়ার খাবার নির্দেশ দিলেন।
সার্জেন্ট ট্রেটারের মুখে একটা থমথমে রাগের আভাস। তিনি তাকালেন সবার দিকে। পাঁচ মিনিট আগে মলির ভয়ার্ত চীৎকারে সবাই ছুটে এসেছিল লাইব্রেরি ঘরে।
ট্রেটার বললেন–আপনি যখন মৃতদেহটা দেখতে পেলেন, খুব সম্ভব তার দু-এক মিনিট আগেই ভদ্রমহিলা খুন হয়েছেন। আচ্ছা, লাইব্রেরি ঘরে ঢোকার কারুর পায়ের আওয়াজ শুনতে পাননি?
ক্লান্ত গলায় মলি জবাব দিল–একটা শুধু মৃদু শিশের শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম। তবে সেটা কিছুক্ষণ আগে। আমার…আমার মনে হচ্ছে যেন…অবশ্য সে বিষয়ে যদিও আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত নই…দরজা বন্ধ করার একটা শব্দও আমার কানে এসে পৌঁছেছিল। তখন আমি লাইব্রেরি ঘরের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলাম।
ট্রেটার জিজ্ঞেস করল–কোনো দরজা?
নিৰ্দ্ধিধার সুরে মলি বলল–ঠিক বলতে পারব না।
ট্রেটার জিজ্ঞেস করলেন মিসেস ডেভিস, একটু ভেবে দেখুন। ওপরে না নিচে..আপনার বাঁ দিকে না ডান দিকে…?
মলি বিরক্তিতে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল–আমি, সত্যিই জানি না সার্জেন্ট। এমন কি ঠিক শব্দ শুনেছি কিনা সে নিয়েও আমার মনে যথেষ্ট সন্দেহ আছে!
জিল রাগের সুরে ঝাঁঝালো গলায় বলল–এইভাবে উৎপীড়ন করাটা খুব অন্যায়। ও যে এখনো রীতিমত অসুস্থ সেটা কি আপনার চোখে পড়ছে না?
ট্রেটার বললেন–আমি যে একটা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে এসেছি সেকথা আপনি ভুলে যাবেন না কম্যাণ্ডার ডেভিস।
জিল বলল-নামের আগে আর আমি ম্যাণ্ডার শব্দটা ব্যবহার করি না, সার্জেন্ট।
ট্রেটার মাথা নেড়ে বললেন–সে তো ঠিকই। তবে ওই যে বললাম আমি এখানে একটা খুনের তদন্ত করতে এসেছি। এবং এই ঘটনার আগে কেউ আমার কথা শোনেননি। আপনারা ভালো ভাবেই জানেন যে মিসেস বয়েলও আমার কথাটা বিশেষ গুরুত্ব দেখাননি। তিনি আমার কাছে খুব জরুরী খবরটাই গোপন করেছিলেন। আপনারাও তাই করেছেন। তাহলে আর কিছু আমার বলার নেই। মিসেস বয়েল মারা গেছেন এবং খুব তাড়াতাড়ি এই রহস্যের উদ্ঘাটন না করলে আরও একটা খুন হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
আর একটা…? যত সব অর্থহীন ধ্যানধারণা! … কেন আরেকটা খুন হতে যাবেই বা কেন?
বিমর্ষ মনে ট্রেটার জবাব দিলেন–কারণ, কাগজের টুকরোর মধ্যে আঁকা ছিল তিনটে ইঁদুরের ছবি।
জিলের গলায় শোনা গেল অবিশ্বাসের সুর। সে বলল–প্রতিটি ইঁদুরই কি এক একটা মৃত্যুর প্রতীক। কিন্তু…কিন্তু তার মধ্যে তো একটা সংযোগ থাকবে? মানে…মানে আমি বলতে চাই, ওই মামলাটার সঙ্গে কেউ কি জড়িত ছিলেন?
ছিলেন নিশ্চয়। বর্তমানে যা পরিস্থিতি তাই দেখে তো এটাই মনে হচ্ছে!
কিন্তু আরেকটা হত্যাই বা এখানে ঘটবে কেন?
ট্রেটার উত্তর দিলেন তার কারণ, ওই নোটবইটাতে দুটো মাত্র ঠিকানারই উল্লেখ ছিল। একটা ছিল চুয়াত্তর নম্বর কার্লভার স্ট্রীট এবং অন্যটি মঙ্কসওয়েল ম্যানর। কালর্ভার স্ট্রীটে একটি মাত্র সম্ভাব্য শিকারের সন্ধান আমরা পেয়েছি। তিনি মারা গেছেন। কিন্তু মঙ্কসওয়েল ম্যানরের কথা সম্পূর্ণ আলাদা। এখানের ক্ষেত্রটা হল অনেক বড়।
এই সমস্ত চিন্তা ভাবনা ভিত্তিহীন ট্রেটার। লরিজ ফার্মের কুচক্রিরা যে পাকেচক্তে এখানে এসে হাজির হবেন, এরকম সম্ভাবনা খুব একটা ম আশা করা যায় না।
ট্রেটার বললেন–তবে কোনো কোনো পরিস্থিতিতে সম্ভাবনাটা এবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। আপনি নয় নিজেই বিষয়টা একবার ভালোভাবে দেখুন! ট্রেটার এবার সমবেত অতিথিদের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। তারপর আবার বললেন মিসেস বয়েলের মৃত্যুর সময় কে কোথায় ছিলেন তার বিবরণ আপনারা আমাকে দিয়েছেন। যদিও সেটা আমি যাচাই করে নেব। মিঃ রেন, মিসেস ডেভিস যখন চীৎকার করে ওঠেন, তখন তো আপনি আপনার ঘরেই ছিলেন তাই তো?
মিঃ রেন সম্মতিসূচক চিহ্নে মাথা নাড়লেন।
ট্রেটার বললেন–মিঃ ডেভিস, আপনি দোতলায় শোবার ঘরে পরীক্ষা করছিলেন এক্সটেনশনটা–তাই তো?
জিল জবাব দিল, বলল–হ্যাঁ।
মিঃ প্যারাভিসিনি আপনি ড্রয়িংরুমে বসে পিয়ানো বাজাচ্ছিলেন তাই তো? যদিও আপনার বাজানা কেউই শুনতে পাননি!
প্যারাভিসিনি বললেন আমি খুব আস্তে আস্তে বাজাচ্ছিলাম। একেবারে নিচু পর্দায়, শুধুমাত্র একটা আঙ্গুল দিয়েই টোক মারছিলাম।
ট্রেটার জিজ্ঞেস করলেন–কোনো সুরটা বাজাচ্ছিলেন আপনি?
মিঃ প্যারাভিসিনি উত্তর দিলেন–তিনটে ইঁদুর অন্ধ। দোতলায় মিঃ রেন তখনও এই সুরটার শিই দিচ্ছিলেন, প্রত্যেকের মাথায় তখন এই একটিমাত্র সুরই খেলা করছে। হাসতে হাসতে বললেন প্যারাভিসিনি।
ব্যাজার মুখে মলি বলল–সুরটা যেমন অস্বস্তিকর, তেমনি সাংঘাতিক।
মেটকাফ প্রশ্ন করলেন–টেলিফোন অচল হওয়ার কারণটাই বা কি? তারটা কি ইচ্ছাকৃতভাবে কাটা হয়েছে?
আপনার ভয়টাই সত্যি মেজরডাইনিং হলের জানলার ঠিক পাশেই খানিকটা তার কেউ কেটে দিয়েছে। মিসেস ডেভিস যখন মৃতদেহটা আবিষ্কার করে চেঁচিয়ে উঠলেন তখনই এই ব্যাপারটা আমি আবিষ্কার করলাম।
তীক্ষ কণ্ঠে জিল জানতে চাইল–সমস্ত ব্যাপারটাই যেন কেমন অদ্ভুত। এর পেছনে হত্যাকারীর কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে মনে হয়?
ট্রেটার জিলের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বললেন–মিঃ ডেভিস, এই মুহূর্তে সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন। খুনী হয়ত মনে করেন বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলে কাজের পক্ষে সেটা সহজ হবে। কিংবা হয়ত এর পেছনে কোনো উদ্দেশ্যই নেই। আমাদের চিন্তাকে বাড়িয়ে তোলা বা আমাদেরকে ভুল পথে চালনা করাই হয়ত তার কারসাজি। অল্প একটু হেসে ট্রেটার আবার বললেন–প্রত্যেক খুনীই নিজেকে খুব চালাক আর বুদ্ধিমান বলে মনে করে। নিজেদের প্রতি আছে তাদের অগাধ আস্থা। কাজের ক্ষেত্রে অপরাধীদের মানসিক দিক নিয়ে আমাদের পরীক্ষা করতে হয়। এটা আমাদের ট্রেনিংয়ের একটা দিক। এই সমস্ত মানসিক বিকারগ্রস্ত অপরাধীদের কাৰ্যসূচী খুবই কৌতূহলোদ্দীপক।
জিলের কণ্ঠে শোনা গেল ব্যঙ্গের ঝাঁঝ–আমরা কি বড় বড় বক্তৃতা বন্ধ করে বর্তমান সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারি?
ট্রেটার বললেন–হ্যাঁ, নিশ্চয় মিঃ ডেভিস। আমাদের কাছে এখন প্রধান আলোচ্য বিষয় দুটো। একটা হল-খুন, আর দ্বিতীয়টা হল বিপদ। এই দুটো শব্দের মধ্যে আমাদের লক্ষ্যটা নিয়ে যেতে হবে।…মেজর মেটকাফ, আপনার গতিবিধি সম্পকে আমাকে আগে পরিষ্কার হতে দিন। আপনার বক্তব্য এই হত্যাকাণ্ডের সময় মদের বোতল মজুত রাখবার জন্য মাটির নিচে যে চোরাকুঠরিটা আছে সেখানে ছিলেন আপনি। কি জন্য আপনি সেখানে গিয়েছিলেন?
মেটকাফ জবাব দিলেন– তেমন কোনো উদ্দেশ্য আমার ছিল না : ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে ওদিকে ছোট্ট দরজাটা আমার চোখে পড়ল। দরজাটা খুলতেই দেখলাম একটা সরু সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। ওই সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতেই চোরকুঠরিটার সন্ধান পেলাম।
মেটকাফ এবার জিলকে লক্ষ্য করে বললেন–আপনাদের মাটির নিচে ভাড়ার ঘরটা সত্যিই খুব সুন্দর। প্রাচীন মঠে মন্দিরে এরম গুপ্ত স্থান পাওয়া যায় সন্ধান করলে।
ট্রেটার বললেন–আমরা এখানে প্রাচীনকালের স্থাপত্য শিল্প নিয়ে গবেষণা করতে বসিনি, মেজর মেটকাফ এখানে একটা হত্যাকাণ্ডের তদন্ত চলছে।…মিসেস ডেভিস, আপনি আমার কথা শুনুন। আমি দরজাটা খোলা রেখেই বাইরে যাচ্ছি… কথাটা বলতে বলতেই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল ট্রেটার। কয়েক সেকেণ্ড পর কোথায় দরজা ভেজানো একটা শব্দ কানে এল। যদিও শব্দটা ছিল খুবই ক্ষীণ। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলেন– এই শব্দটাই কি আপনার তখন কানে এসেছিল?
মলি বলল হ্যাঁ, অনেকটা যেন এই রকমই।
ট্রেটার বললেন–এটা সিঁড়ির নিচে কাঠের আলমারির দরজা বন্ধ করার শব্দ। ঘটনাটা হতে পারে যে খুনী মিসেস বয়েলকে খুন করার পর হলঘরের মধ্যেই ফিরে যাচ্ছিল। এমন সময় মিসেস ডেভিসের পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে তাড়াতাড়ি ওই আলমারির মধ্যে ঢুকে পাল্লাটা টেনে নেয়।
রেন উত্তেজিত ভাবে বললেন–তাহলে নিশ্চয়ই আলমারির গায়ে খুনীর আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে?
মেজর মেটকাফ বললেন কিন্তু ওই আলমারির হাতলের মধ্যে আমার আঙুলের ছাপও রয়ে গেছে।
ট্রেটার মাথা নাড়িয়ে বললেন–তা ঠিকই, তবে তার একটা সন্তোষজনক উত্তর আমরা পেয়েছি, তাই নয় কি?
জিল দৃঢ় কণ্ঠের সুরে বলল- দেখুন সার্জেন্ট, একথা ঠিকই যে বর্তমান পরিস্থিতিটা সামলানোর সব ভার সরকারীভাবে অর্পণ করা হয়েছে আপনার ওপরেই। তবে বাড়িটা যে আমার সে কথাও ভুলে গেলে চলবে না এবং আমারও একটা নৈতিক কর্তব্য আছে অতিথিদের নিরাপত্তার ব্যাপারে। দুর্ঘটনা এড়াবার জন্য আমাদের তো কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
সার্জেন্ট সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন–যেমন…?
মানে…আমি বলতে চাই। এই অপকীর্তির প্রধান হোতা হিসেবে যার পর প্রথমেই সন্দেহ জাগে তাকে কি আপাতত আটক করে রাখা যায় না?
কথা থামিয়ে জিল এবার সোজাসুজি ক্রিস্টোফার রেনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো।
আসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন ক্রিস্টোফার। উত্তেজনার আধিক্যে তার সুর কণ্ঠস্বর আরো তীক্ষ্ণ শোনালো। এটা সত্যি নয়। কখনোই সত্যি নয়।
আপনারা সকলে মিলে আমার পেছনে লাগছেন! প্রত্যেকেই আমাকে বিরূপ দৃষ্টিতে দেখে! আপনারা মিলে যুক্তি করে আমার উপর দোষটা চাপিয়ে দিচ্ছেন।
কিন্তু এটা তো উৎপীড়ন…
নির্মম নিষ্ঠুর উৎপীড়ন….
অমন ভেঙে পড়বেন না। শান্ত স্বরে উপদেশ দিলেন মেটকাফ।
শক্ত হোন…দৃঢ় হোন…নিজেকে সংযত করুন।
আপনার দুঃশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই, মিঃ রেন। ধীর পায়ে এগিয়ে এলোে মলি।
উত্তেজিত রেনের পিঠে হাত দিয়ে তাকে আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করলো।
আমরা কেউই আপনার বিরুদ্ধে যাইনি। মলি ব্যাকুল দৃষ্টিতে ট্রেটারের দিকে তাকালে ভদ্রলোককে সে ভরসা দিল।
আমরা আগে থেকে কাউকেই অপরাধী হিসেবে ধরে নিয়ে, এইভাবে মামলা সাজিয়ে চেষ্টা করব। জবাব দিলেন ট্রেটার।
আপনি সেটা বুঝিয়ে বলুন, যে আপনি ভদ্রলোককে গ্রেপ্তার করতে যাচ্ছেন না।
না না, আপাতত কাউকেই গ্রেপ্তারের কোনো ইচ্ছা নেই।
তার জন্যে সুনিশ্চিত সাক্ষী প্রমাণের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে তার কোনো আভাসই পাওয়া যাচ্ছে না।
জিল চেঁচিয়ে উঠলো, মনে হচ্ছে তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে, মলি।
সার্জেন্টের অবস্থাও সেইরকম।
ঠিক মতো বিচার বিবেচনা করে দেখা গেল, অপরাধীর চেহারার সঙ্গে একজনের মিল খুঁজে পাওয়া গেছে, এবং জিল শোনে…
ঈশ্বরের দোহাই একটু শান্ত হও…
মলি বিধ্বস্ত অসহায় ভঙ্গিতে মিনতি করল। বলল, সার্জেন্ট ট্রেটার, আড়ালে আমি আপনার সঙ্গে একটা কথা বলতে চাই। যদি অনুগ্রহ করে এক মিনিট সময় দেন?
জেদের সুরে জিল বলল–আমিও থাকবো তোমার সঙ্গে।
মলি বলল–না জিল…তুমিও না! আমার অনুরোধ…
জিলের চোখে মুখে বজ্রের মেঘের মতই কালো ছায়া নেমে এল। বলল, কি যে আছে তোমার মাথায় তা আমি বুঝতে পারছি না!
অন্য সকলের সঙ্গে জিলও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় খুব জোড়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
হ্যাঁ বলুন মিসেস ডেভিস, কি আপনার বক্তব্য?
মলির মুখ থেকে কিছুক্ষণের জন্যও উদ্বেগ ও বিভ্রান্তির ছায়াটাও সম্পূর্ণ মিলিয়ে যায়নি। গলার সুরে দেখা গেল অস্বস্তির ছোঁয়া। বলল–সার্জেন্ট ট্রেটার, বর্তমানের ঘটনার প্রসঙ্গে আপনি আমাদের কাছে লঙরিজের ওই মামলাটার উল্লেখ করেছিলেন। আপনার কি ধারণা, ভাগ্যহত ওই তিনটি অনাথ শিশুর মধ্যে এই সমস্ত খুনের জন্য দায়ী বড় ছেলেটিই? কিন্তু সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেন না।
মিসেস ডেভিস, আপনার বক্তব্যটা খুবই যুক্তিসঙ্গত। তবে যাবতীয় সম্ভাবনা ইঙ্গিত করছে সেই দিকেই। মানসিক অস্থিরতা, সেনাবাহিনী থেকে পলায়ন, চিকিৎসকের রিপোর্ট….
মলি বলল হ্যাঁ, আমি জানি, ক্রিস্টোফারকে সন্দেহ করার প্রধান কারণ সেটাই। কিন্তু ওই ভদ্রলোকের দ্বারা এ কাজ সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। নিশ্চয় আড়াল থেকে কেউ তাকে ইন্ধন জুগিয়েছে। আচ্ছা, ওই তিনটি বাচ্চার বাবা মা বা অন্য কোনো আত্মীয় স্বজনের সন্ধান পাওয়া যায়নি?
ওদের মা মারা গিয়েছিল অনেকদিন আগেই। যুদ্ধকালে দরকারী কাজে ওই তিনটে বাচ্চাকে বাবার দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
সেই ভদ্রলোকেরই বা কি খবর? এখন তিনি কোথায়?
আমাদের কাছে কোনো খবর নেই। যুদ্ধের প্রয়োজন মিটে যাওয়ায় এক বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে তাকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়।
ছেলের যদি মানসিক ভারসাম্য বজায় ঠিক না হয় তবে তার বাবার ক্ষেত্রেও এই একই ব্যাপার ঘটতে পারে?
হা নিশ্চয়!
তাহলে আমাদের বর্তমান হত্যাকারী যে মাঝবয়সী বা বৃদ্ধলোক এ ধারণা কিছু অসম্ভব নয়? এই প্রসঙ্গে আমার একটা কথা খুব মনে পড়ছে। মেজর মেটকাফ যখন প্রথম জানতে পারেন যে পুলিস কর্তৃপক্ষ এখানে আসছেন তখন খুব বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন তিনি।… হ্যাঁ তিনি সত্যিই খুব ভয় পেয়েছিলেন।
সার্জেন্ট ট্রেটার শান্ত গলায় বললেন–আমাকে বিশ্বাস করুন মিসেস ডেভিস। প্রথম থেকে সবরকম বিচার-বিবেচনা করেছি আমি। জিম নামে ওই ছেলেটা বা তার বাবা–এমন কি তার বোনের সম্ভাবনাও বাদ দেওয়া যায় না। আমাদের বর্তমান হত্যাকারী একজন মহিলাও হতে পারেন–তা জানেন? কোনো কিছুই আমার নজর থেকে এড়িয়ে যায়নি। আমি মনে মনে নিশ্চিত, তবে নির্ভরযোগ্য কোনো প্রমাণের খুবই অভাব। বর্তমানে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর সম্বন্ধে সম্পূর্ণ তথ্য জানা খুবই কঠিন কাজ।
আমাদের এই কর্মজীবনে অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতারই মুখোমুখি হতে হয় সে সম্বন্ধে কোনো ধারণা নেই আপনার। যদিও অধিকাংশ মামলাই বিবাহ-সংক্রান্ত। কিছুদিনের পরিচয়েই বিয়ে, বা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মধ্যে তাড়াতাড়ি করে বিবাহ–এ সমস্তই খুব বিপজ্জনক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে চেনে না, এমন কি তাদের আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবের কোনো পাত্তা নেই। একে অন্যের মুখের কথাতেই বিশ্বাস করে। হয়ত ছেলেটা বলল–যে সে একজন পাইলট, কিংবা সেনাবাহিনীর কোনো মেজর। ব্যস্ মেয়েটাও তাই বিশ্বাস করে নেয়। তারপর বছর দুই পার হতে না হতেই বিবাহিত জীবনযাপনের পর জানা গেল– ছেলেটা কোনো পালিয়ে আসা ব্যাঙ্ক কর্মচারী। তার নামে বিরাট একটা অঙ্কের বিল কুলছে মামলার জন্য। তার অন্য কোনো সংসার থাকাটাও বিচিত্র কিছু নয়। অথবা হতে পারে সে আসলে একজন যুদ্ধ পলাতক কোনো সৈনিক। সামরিক বিভাগ তার নামে হুলিয়া জারি করেছে…।
ট্রেটার একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল, আপনার মনের মধ্যে যে কি হচ্ছে তা আমি বেশ ভালোই বুঝতে পারছি। তবে মিসেস ডেভিস একটা কথা মনে রাখবেন আমাদের বর্তমান হত্যাকারী সমস্ত পরিবেশ-পরিস্থিতিটা ভালো করেই বেশ উপভোগ করছে।…হ্যাঁ, এ বিয়ে আমি নিশ্চিত।
আস্তে আস্তে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল ট্রেটার। মলি কিছুক্ষণ পাথরের মত নিশ্চল অবস্থায় রইল। তার হাত-পাগুলো যেন অসাড় হয়ে গেছে। তার চোখের কোণে দেখা দিয়েছে চিন্তার ছাপ। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল জ্বলন্ত গ্যাসের দিকে। পরিচিত মসলার সুগন্ধে মলি যেন নিজেকে নতুন করে ফিরে পেল। গুরুভার হৃদয়টা অনেকটা যেন হাল্কা হল। অনেকক্ষণ পরে সে তার নিজের ঘরের গৃহস্থালীর নিবিড় নীড়ে একটা আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। রান্নাবান্না সংসারের খুঁটিনাটি দায়দায়িত্ব–এইসব হাসি-কান্না নিয়েই তার গদ্যময় জীবন। এবং অনেক অনেক বছর আগে থেকে নারীরাই এর ঝামেলা-ঝক্কি সামলে এসেছে। বিপদসঙ্কুল উন্মত্ত পৃথিবীর বুকে এই রান্নাঘরটাই নিরাপদ আশ্রয় নারীদের।
বন্ধ করা দরজাটা একটুখানি খুলল। ঘাড় ঘুরিয়ে মলি তাকিয়ে দেখল ক্রিস্টোফার রেন ঢুকল। ভদ্রলোক এখনও বেশ হাঁপাচ্ছেন।
রেনের তীব্র গলা শোনা গেল–এদিককার খবর সব শুনেছেন। কি ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানাই না চারদিকে ঘটে চলেছে–সার্জেন্ট ট্রেটার তার স্কী দুটো খুঁজে পাচ্ছেন না।
মলি বলল–চাকা লাগানো স্কী দুটোর কথা বলছেন? কেন…সে-দুটো চুরি করেছে কে? আর কি লাভ সে-দুটো চুরি করে?
খবরটা আমারও ভাবনার বাইরে চলে যাচ্ছে…মানে..আমি বলতে চাই, সার্জেন্ট ট্রেটার সত্যিই যদি আমাদের ছেড়ে যেতে চান তাহলে খুনীরই তো সব থেকে বেশি লাভ হবে। সেই জন্য এই ঘটনার মধ্যে আমি সুনির্দিষ্ট কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছি না।
জিল তো নিজেই সিঁড়ির নিচে কাঠের আলমারিতে স্কী দুটো রেখে এসেছিল।
রেন মৃদু হেসে বললেন–ভালো, কিন্তু এখন সেদুটো সে জায়গায় নেই। ব্যাপারটা সত্যিই আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। আমাদের সার্জেন্ট কিন্তু খুব রেগে গেছেন–জানেন! রাগী কচ্ছপের মত সারা বাড়িটা তিনি এখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হতভাগ্য মেজরকে তো জেরার পর জেরা করে কাহিল করে ছাড়ছেন। কিন্তু মেজর একটা কথাই বলে চলেছেন। তিনি যখন কাঠের আলমারিটা খুলছিলেন তখন স্কী দুটো আছে কি নেই ভালোভাবে তিনি সেটা লক্ষ্য করেননি। এ বিষয়ে কোনো খেয়ালই তার ছিল না। ট্রেটারের বক্তব্য এতবড় জিনিষটা ভদ্রলোকের নজর এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কোনো রহস্যময় কারণেই তিনি এখন সত্যি কথাটা গোপন করছেন। রেন আরেক পা এগিয়ে এসে বললেন–এই সমস্ত ব্যাপারটা সার্জেন্ট ট্রেটারকে বেশ খানিকটা দমিয়ে দিয়েছে।
ব্যাজার মুখে মলি বলল–আমিও খুব এতে বিব্রত বোধ হচ্ছি। প্রত্যেকের স্নায়ু এখন অসুস্থ হয়ে উঠেছে।
রেন মাথা নেড়ে বললেন–আমাকে নয়, আমি বরং উদ্বুদ্ধ হয়ে যাচ্ছি বলতে পারেন। সমস্ত ব্যাপারটা এত বেশি অস্বাভাবিক….
মলি তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে বলল–আপনি যদি মিসেস বয়েলের মৃতদেহটা প্রথম আবিষ্কার করতেন, তাহলে…তাহলে আপনি এরকম কথা বলতে পারতেন না। দৃশ্যটা যেন আমার চোখের সামনে ভাসছে…কিছুতেই যেন সেটা আমি ভুলতে পারছি না। সারা মুখটা বিশ্রীভাবে ফুটে উঠেছে, তার মধ্যে একটা গাঢ় বেগুনি আভা…
আপনা-আপনি কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এল মলির। ওর সারা শরীর যেন কেঁপে উঠল থরথরিয়ে। ক্রিস্টোফার এগিয়ে এসে মলির পিঠে হাত রাখলেন। বললেন–সত্যিই, আমি বাস্তবিকপক্ষে খুব নির্বোধ। আমার উচিত ছিল বোঝা, আমি দুঃখিত মিসেস ডেভিস, আমি এতটা ভেবে দেখিনি।
একটা বোবা কান্না যেন মলির গলাকে আটকে ধরল। সে বলল–এইমাত্র সবকিছু যেন কিরকম সহজ ও স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। এই রান্নাঘর…সমস্ত জিনিষপত্র..মলি অস্পষ্ট ধরা গলায় বলে গেল–কিন্তু…কিন্তু আবার হঠাৎই দুঃস্বপ্নের ছায়াগুলো পুনরাবির্ভাব ঘটল!
রেন মলির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। তার চোখেমুখে দেখা গেল এক অদ্ভুত অভিব্যক্তি। সব বুঝতে পেরেছে এরকম ভান করে মাথা নাড়িয়ে বার কয়েকবার বললেন হ্যাঁ আমি বুঝতে পারছি। তাহলে…তাহলে এখন আমি যাই। এখন আপনাকে বিরক্ত না করাই ভালো!
অনুরোধের সুরে মলি বললনা, আপনি যাবেন না।
ততক্ষণে রেন দরজার কাছে পৌঁছে গেলেন। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তিনি ঘাড় ঘুরে তাকালেন। তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে বললেন–আপনি কি সত্যিই তাই চান?
মলি বলল–কি চাওয়ার কথা বলছেন?
মানে আমি এখানে থাকি সেটাই কি আপনি চান?
মলি বলল হ্যাঁ, নিশ্চয়, আমি এখন একলা থাকতে চাই না। একলা থাকলেই আমায় ঘিরে ধরছে হাজার রকমের দুশ্চিন্তা।
একটা চেয়ার টেনে বসলেন ক্রিস্টোফার রেন শান্ত ভঙ্গিতে। মলিও তার হাতের কাজ শেষ করে একটা চেয়ার টেনে বসল।
ক্রিস্টোফার বিড়বিড় করে বলল সত্যিই খুব আশ্চর্যের ব্যাপার!
মলি বলল–কি আশ্চর্যের ব্যাপার?
আপনি যে আমার সঙ্গে একা থাকতে ভয় পাচ্ছেন না সেইজন্য খুব অবাক লাগছে। আচ্ছা সত্যিই আপনি ভয় পাচ্ছেন না তো?
মলি মাথা নাড়ল, জোরে বলল–না, মোটেই না।
এই ভয় না পাওয়ার কারণ কি, মিসেস ডেভিস?রেন প্রশ্ন করল।
আমি জানি না ঠিক, তবে এটা সত্যি।
কিন্তু অপরাধী হিসেবে আমার ওপরেই তো প্রথম জাগে সন্দেহটা। আমার সঙ্গে মিলে যায় সবকিছুই।
মলি দৃঢ়কণ্ঠে জানাল–না। সন্দেহভাজন আরো অনেকেই আছে। সার্জেন্ট ট্রেটারের সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছিল সেই বিষয়ে।
তিনি কি বিশ্বাস করেছেন আপনার কথা?
ধীরে ধীরে মলি উত্তর দিল–অবিশ্বাসও করেননি।
কতগুলো টুকরো টুকরো শব্দ তার মাথার মধ্যে বার বার ভেসে আসছে। বিশেষ করে ট্রেটারের সেই অমোঘ উক্তি–আপনার মনের মধ্যে এমন কি ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটে চলেছে আমি তার কিছুটা বুঝতে পারি, মিসেস ডেভিস!
সব কিছুই কি তিনি জানতে পেরেছেন? আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য তিনি করেছেন। প্রকৃত হত্যাকারী নাকি সমস্ত পরিস্থিতিটা বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছেন? এটাও কি সত্যি!
ঈষৎ উদ্বিগ্ন কণ্ঠেই রেনকে প্রশ্ন করলো মলি, আপনি নিশ্চয়ই এই বিপদসঙ্কুল পরিবেশটা মনে মনে বুঝতে পারছেন না। মুখে আপনি যাই বলুন না কেন।
আসল ব্যাপারটা নিশ্চয় তা নয়।
না না, নিশ্চয় না, অবাক হয়ে মলি তাকিয়ে রইল ক্রিস্টোফারের দিকে।
এ ধরনের একটা ঘটনা আপনার মাথায় ঢুকলো কি করে?
এটা আমার বক্তব্য নয়, সার্জেন্ট ট্রেটারের। আমি…আমি…ওই লোকটাকে ঘৃণা করি।
কিভাবে আপনার মাথায় ঢুকলো এই ধরনের একটা ধারণা? যা একদমই সত্যি নয়…যা একেবারেই অসম্ভব…
মলির কণ্ঠস্বর ভাঙা ভাঙা।
তার শরীরটা অবসাদে এখন ভেঙে পড়েছে।
কান্নার ভারে চোখ দুটো বুজে আসছে।
মলি টেবিলে মাথা রেখে মুখ ঢাকলো। ক্রিস্টোফার এগিয়ে এসে মলির পিঠে হাত রাখলো।
তার কণ্ঠে গভীর সমবেদনার স্পর্শ। ক্রিস্টোফার ডাকলেন, মলি মুখ তোলো, এই প্রথম নাম ধরে ডাকলেন।
তোমার কি হয়েছে?
ধীরে ধীরে মলি সংযত করলো নিজেকে। ক্রিস্টোফারের আচার আচরণের ছেলেমানুষ সুলভ প্রগলভতার কোনো চিহ্ন নেই।
কি ব্যাপার মলি?
ক্রিস্টোফার পুনরায় প্রশ্ন করলেন।
মলি অপলখ চোখ তুলে রেনের দিকে তাকিয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত।
তার দৃষ্টির গভীরে একটা স্থির আলোর উদ্ভাস। ক্রিস্টোফার আমাদের এই পরিচয়টা কত দিনের?
দু দিন মাত্র…?
প্রায় সেই রকমই। কিন্তু তোমার কি মনে হচ্ছে না পরস্পরকে আমরা জানি অনেকদিন আগেই?
হ্যাঁ, ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত! তাই না?
ঠিক বলা যায় না। তবে আমরা যেন পরস্পরের হৃদয়টা গভীরভাবে বুঝতে পারছি। দুজনেই আমরা এখন একই বিপদের মুখোমুখি এসে পড়েছি বলেই হয়ত এমন একটা সহমর্মিতা গড়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে।
ক্রিস্টোফারের গলায় কোনো প্রশ্নের আভাস ছিল না। সহজ সরল বিবৃতির মতই শোনাল কথাটা। এর উত্তর দেওয়ার জন্যও মলির মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। একটু থেমে অন্য প্রসঙ্গ শুরু হল। তার কথার সুরেও ঝঝ নেই প্রশ্নের। স্বাভাবিক একটা সত্যকে সে নির্বিঘ্নে বলেছে। বলল তোমার আসল নামটা নিশ্চয় ক্রিস্টোফার রেন নয়…?
উত্তর দিলনা।
মলি বলল–তবে তুমি কেন…।
নাম বদলিয়ে ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি এই তো? আমার এটাকে একটা ব্যক্তিগত খেয়ালও বলা যায়। ছোটবেলায় আমার সহপাঠীরা আমাকে ক্রিস্টোফার রবিন বলে ডাকতো। সেখান থেকেই এই নামটা মাথায় এসেছে আমার।
মলি জিজ্ঞেস করল–তাহলে তোমার আসল নামটা কি?
শান্ত গলায় ক্রিস্টোফার জবাব দিলেন-আসল নামটা শুনে তোমার কোনো উপকার হবে না। তবে স্থপতি আমি নই। প্রকৃতপক্ষে আমি একজন পলাতক সৈনিক।
কিছুক্ষণের জন্য মলির দু চোখে একটা ভয় ও উদ্বেগের ছায়া ঘনিয়ে এল।
সেটা ক্রিস্টোফারের নজর এড়াল না, বলল–হ্যাঁ,…ঠিক আমাদের অজ্ঞাতকুলশীল হত্যাকারীর মত। সেইজন্যেই তো বললাম, আমার সঙ্গে খুব ভালো মিশে যায় খুনীর বৈশিষ্ট্যগুলো।
মলি ধমকে উঠে বলল–বোকার মত কথা বলো না। আগেই জানিয়েছি, হত্যাকারী বলে আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না, ঠিক আছে আগাগোড়া খুলে বল তোমার কাহিনীটা। সেনাবাহিনী থেকে পালাতে গেলে কেন? ভয়…?
ভয় পেয়ে পালিয়েছি কিনা সে বিষয়ে জিজ্ঞেস করছো? না। ব্যাপারটা অদ্ভুত হলেও সত্যি। তেমন কোনো ভয় ছিল না আমার। অন্ততপক্ষে সাধারণ অন্যান্য সৈনিকদের চেয়ে আমার সাহস কিছু কম ছিল না। এমন কি গোলাগুলি চলাকালীনও আমার মেজাজ শান্ত থাকত আশ্চর্যভাবে। সেজন্য আমার একটা বিশেষ সুনাম ছিল সেনাবাহিনীতে। এই সব তুচ্ছ কারণে আমি সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসিনি। প্রকৃত কারণ হল আমার মা।
মলি বলল–তোমার মা?
রেন বলল–হ্যাঁ, গত যুদ্ধের সময় নাৎসী বিমানবাহিনীর আক্রমণে আমার মা মারা যায়। তিনি যে বাড়িতে ছিলেন, বোমার আঘাতে সেই বাড়িটা একেবারে ধ্বংস হয়ে যায়। সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে মৃতদেহটা বার করে আনতে হয়েছিল। খবরটা শোনার পরই কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল মাথাটা। সাময়িকভাবে আমি বোধহয় পাগলই হয়ে গেলাম। আমার মনে হল–মা নয়, আমিই যেন সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে চাপা পড়ে আছি। আমাকে সেই মুহূর্তে উদ্ধার না করলে আমি শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাব।–অসহায়ভাবে ক্রিস্টোফার মাথা ঝাঁকালেন। অপরিসীম ক্লান্তিতে বুজে আসতে চাইছে কণ্ঠস্বর। দুঃস্বপ্নে ভরা সেই দিনগুলির কথা কেউ বোঝে না। শিবির ছেড়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেলাম।