দি পেল হর্স – ৪

চতুর্থ অধ্যায় 

থিয়েটার হল ওল্ড ভিক্ থেকে বেরিয়ে এলাম। সঙ্গী আমার বান্ধবী হারসিয়া রেডক্লিফ। ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের অভিনয় দু’জনে মিলে দেখতে গিয়েছিলাম। রাস্তায় আমাদের গাড়ি দাঁড় করানো। বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যে রাস্তা পার হওয়ার সময় হারসিয়া কটু কণ্ঠে মন্তব্য করলো। যে দিন ওল্ড ভিকে থিয়েটার দেখতে আসি সেদিন বৃষ্টি পড়তে শুরু করে এটা এমনি ধরনের একটা বস্তু। 

ওর ঐ রকম ধারণায় আমি সায় দিতে পারলাম না। আমি বললাম যে সে কেবল বৃষ্টির দিনগুলির কথা মনে করে রাখে। ও ঠিক সূর্যঘড়ির বিপরীত একটা সামগ্রী। 

আমি যখন গাড়ির ক্লাচে চাপ দিচ্ছিলাম তখনি আবার বলে উঠল। এই গিন্দবোর্নে আমার দিনগুলো সৌভাগ্যে ভরে গেছে। এখানে নিখুঁত ছাড়া আমি কিছুই ভাবতে পারি না—কারণ আজকাল সব কিছুই নিখুঁত। সঙ্গীত—চমৎকার ফুলের বাগান—সাদা সাদা ফুলে ভরা গাছের সার। 

আমরা গিন্দবোর্ন এবং গান সম্বন্ধে আলোচনা করলাম কিছুক্ষণ। 

হঠাৎ হারসিয়া বলে উঠলো—আমরা কি ডোভারে প্রাতঃরাশে যাচ্ছি না। তবে খাব কি?

—ডোভারে। তোমার ভাবনা কি অস্বাভাবিক। ওখানে গিয়ে আমরা ফ্যান্টাসিতে ঢুকবো। ম্যাকবেথ নাটকের এমন রক্তক্ষয়ী ঘটনা আর বিষণ্ণতা সমৃদ্ধ সুন্দর অভিনয় দেখার পর সত্যিকারের ভালো খাদ্য আর পানীয় প্রয়োজন। শেক্সপীয়ার আমাকে সব সময় ক্ষুধার্ত করে তোলে। 

—হাঁ। ওয়াগনারাও তাই করেন। কভেন্ট গার্ডেনে বিশ্রামের সময় ভাজা স্যালমন মাছের স্যাণ্ডউইচ মনে কোনো দাগ রাখতে দেয় না। ডোভারের কথা বলছি কারণ ও দিকেই তো তুমি গাড়ি চালাচ্ছো। 

মাঝে মাঝে লোককে ঘোরাপথে যেতে হয় সেটা বোঝাতে চাইলাম। 

—কিন্তু তুমি তো বেশ ঘুরছো, তুমি পুরানো কেস্ট রোড থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছো। 

এখন দেখলাম হারসিয়ার কথাই ঠিক, চারধারের পরিবেশ নিরীক্ষণ করলাম। ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললাম, এখানে এলে আমার কেমন যেন গোলমাল হয়ে যায়। 

হারসিয়া স্বীকার করলো—সত্যিই গোলমেলে। ওয়াটারলু স্টেশনের চারধারে ঘুরে ঘুরে মরতে হয়। 

অবশেষে ওয়েস্টমিনিস্টার সেতুর কাছাকাছি সফল ভাবে পৌঁছবার পর আমরা আবার কথাবার্তা শুরু করলাম।—এই কিছু সময় আগে ম্যাকবেথ নাটকের অভিনয় সম্বন্ধে আমরা আলোচনা করছিলাম। আমার বান্ধবী হারসিয়া। সে এক সুন্দরী যুবতী। তার বয়স ২৮ বছর বীরের মতন তার দেহের গড়ন। গ্রীক দেশের রমণীর মতো তার দেহ এবং নিখুঁত। মাথাভরা কোঁকড়া চুলের ঢাল তার কাঁধের উপর উপছে পড়ছে। আমার বোন সব সময় তার নাম উল্লেখ করার সময় বলে যে সে মার্কের বান্ধবী। 

এমন প্রশ্নের আদলে কথাটা সে আওড়ায় যে আমি আর বিরক্তি প্রকাশ করতে পারি না কোনো সময়। 

ফ্যান্টাসি রেস্তোরাঁ আমাদের দুজনকে ভিতরে আহ্বান জানিয়ে যেন আনন্দ প্রকাশ করলো। পরিচালক যে সে আমাদের দুজনকে গোলাপী রঙের মখমল ঢাকা দেওয়ালের ধারে একখানা টেবিলে বসালো। ফ্যান্টাসি এমনি একজন যে সে জনপ্রিয় হওয়ার যোগ্য। টেবিলগুলো বেশ কাছাকাছি রাখা। আমরা চেয়ারে বসতেই পাশের টেবিলের লোকেরা খুশি মনে অভ্যর্থনা জানালেন। 

ডেভিড আরডিংলি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের লেকচারার। সে তার সঙ্গিনীর সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল। মেয়েটি দেখতে খুবই ভালো। মাথায় চুল খুব সুন্দরভাবে বাধা। একটা কোণ করে চুল কুন্তলগুলি যেন তার ব্রহ্মতালুর দিকে উর্ধ্বমুখী। বলতে বেশ অবাক লাগছে মেয়েটিকে বেশ মানিয়েছে। 

বড় বড় নীল চোখের তারা আর ওষ্ঠদ্বয় ঈষৎ বিস্ফারিত—যেন আধখোলা একটা ফুলের কুঁড়ি। ডেভিডের অন্য আর মেয়ের মতন এই মেয়েটিও ফাজিল। ডেভিড একজন নামকরা চতুর যুবক। বাস্তবে ডেভিড অল্প বয়সের মেয়েদের নিয়ে মজা লুটে বেড়ায়। সে সবসময় খুশিতে সময় কাটাতে ভালোবাসে। 

—গলায় বেশ জোর দিয়ে বলল, এটি আমার আদরের কুকুর ছানা। ওই মার্ক আর হারসিয়াকে দেখো। ওরা দারুণ গম্ভীর আর নাক উঁচু। তুমি একবার চেষ্টা করে ওদের পাশে বসো এবং দেখো। আমি বাজি ফেলে বলতে পারি তুমি যেন শেক্সপীয়ার কিংবা ইবসেনের মানস চরিত্র। 

—ওল্ড ডিক মঞ্চে ম্যাকবেথের অভিনয়, বলল হারসিয়া। 

—ব্যাটসনের প্রযোজনা সম্পর্কে তোমার কি ধারণা? 

—আমার ভালো লাগে, জবাব দিল হারসিয়া—মঞ্চের আলোকপাত মনে আগ্রহ এবং এমন সুন্দরভাবে অভিনীত পানভোজনের দৃশ্য আমি এর আগে কখনও দেখিনি। 

—ওহো, কিন্তু ডাইনীদের ব্যাপার কি বলো? 

—ব্রেসকট। বললো হারসিয়া এবং আর একটু যোগ করলো। তারা তো রয়েছেই ডেভিড সায় দিলো। 

মনে হচ্ছে একটা ছায়ামূর্তি হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে। বললো, যে—ওরা সবাই লাফালাফি করছে এবং প্রত্যেকেরই আচরণে ফুটে উঠেছে তিন ভাঁজা করা দৈত্য রাজার আদল। তুমি আশা না করে থাকতে পারো না যে, এবার খাস একটা পরী সাদা পোশাকে সেজে মঞ্চে ঢুকবে আর মোটা গলায় আওড়াবে। 

তোমার দুষ্টুবুদ্ধি হবে না জয়ী। শেষের সেদিনে, এই ম্যাকবেথ, যে নাকি হাজির হবে সেখানে। 

আমরা সবাই খুব জোরে হাসলাম। ডেভিড কিন্তু হাসির রোল শুনে আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকালো। আর ঝাঁঝালো গলায় শুধালো—কি ভাবছো তুমি? 

কিছু না। অন্যায় এবং দৈত্যরাজ সম্বন্ধে আমি মনে মনে ভাবছিলাম। হাঁ…আর ভাবছিলাম সপরী সম্পর্কেও। 

—তোমার সদ প্রস্তাবটি কি? 

—ওহো চেলসিয়ার কফিখানায়। 

—তুমি কত চালাক আর স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছো আজকাল মার্ক, তাই না? সব কিছুই ঘটছে চেলসিয়ার পরিবেশে। ওখানেই উত্তরাধিকারিণীরা অসুবিধার মধ্যে রয়েছে, বিবাহ সঙ্কট চললে। কাজেই পপিকে ওখানে থাকতে হবে, তাই না খুকু? 

পপি তার বড় বড় দুচোখ মেলে তাকালো। 

—চেলসিয়া যেতে আমি ঘৃণা বোধ করি। আমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি ফ্যান্টাসিকে। এমন মনোরম সুস্বাদু খাবারদাবার। প্রতিবাদ করে পপি বললো। 

—তোমার পক্ষে সেটাই ভালো পপি। সত্যি কথা বলতে কি চেলসিয়ায় খাওয়ার মতন রেস্ত তোমার নেই। মার্ক, তুমি এবার ম্যাকবেথ ও জঘন্য ডাইনীদের সম্বন্ধে আরো কিছু বলো। তাহলে প্রযোজনার কাজে নামলে কিভাবে ডাইনীদের অভিনয় করাবো তা জানতে পারবো। 

ডেভিড অতীতে অভিনেতা সংঘের নামকরা সদস্য ছিল। 

—আচ্ছা, কি ভাবে? 

—আমি ওদের খুবই সাধারণ রূপ দেবো। ঠিক ধূর্ত, শান্ত বৃদ্ধাদের মতন রূপ। আর হাবভাব হবে গ্রামাঞ্চলের ডাইনীদের মতো। 

—কিন্তু আজকাল তো দেশে কোনো ডাইনীর অস্তিত্ব নেই? অবাক চোখে তার দিকে তাকালো পপি। 

—তুমি একথা বলতে পারছো কেননা তুমি লণ্ডন শহরে বসবাস করা মেয়ে। 

ইংল্যাণ্ডে গ্রামে এখনও একজন করে ডাইনী আছে। পাহাড়ের তৃতীয় কুটিরখানাতেই তো রয়েছে বৃদ্ধা মিসেস ব্লাক। ছোট বাচ্চাদের নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে যে তারা যেন বৃদ্ধাকে বিরক্ত না করে। আর মাঝে মাঝে বৃদ্ধাকে ভাজা পিঠে পাঠানো হয়। 

বলতে বলতে অর্থবহ ভাবে আঙুল নাড়ালো, বারেক থেমে বললো – তুমি যদি বৃদ্ধাকে আবার বিরক্ত করো তবে তোমার গাইগরুগুলো দুধ দেওয়া বন্ধ করবে। তোমার আলুচাষ করা মার খাবে, অথবা ক্ষুদে জনির গোড়ালি যাবে মুচড়ে। কাজেই তোমাকে বৃদ্ধা মিসেস ব্লাকের নজরে থাকতে হবে। মুখে কেউ কিছু বলতে চায় না…তবে সবাই একথা জানে। 

—তুমি ঠাট্টা করছো। 

পপি ভিজে গলায় বললো, না আমি ঠাট্টা করছি না। আমি ঠিক বলছি, তাই না মার্ক?

—দেশে শিক্ষাপ্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এ-সব কুসংস্কার একেবারে উৎখাত হয়ে গেছে। জোর গলায় হারসিয়া বললো। 

 —দেশের গ্রামগুলোতে তা হয়নি। তুমি কি বলো মার্ক? 

—আমার মনে হয় তুমি ঠিকই বলছো। বললাম ধীরে ধীরে—যদিও আমি ঠিক ভাবে জানি না।

গ্রামের পরিবেশে আমি খুবই বেশিদিন ছিলাম না। 

—বুঝতে পারছি না কিভাবে তুমি সাধারণ বৃদ্ধাদের দিয়ে ডাইনীর অভিনয় করাতে চেষ্টা করছো। 

ডেভিডের আগের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে বললো হারসিয়া—নিশ্চয়ই ওদের ঘিরে ছিলো অতি প্রাকৃতিক এক পরিবেশ। 

ডেভিড একবার জবাব দিলো, ওহে একবার ভাবো, এটাকে বরং পাগলামি বলা যায়। কেউ যদি মাথার চুলে খড় কুটো গুঁজে ঘুরে বেড়ায়, পা টেনে টেনে হাঁটে, পাগলের মতন দেখায় তাকে, তবে সেটা ভয়ানক ভীতিজনক হয়ে ওঠে। কিন্তু আমার কাছে একবার আমাকে মানসিক রোগীদের হাসপাতালে এক ডাক্তারের কাছে একটা খবর নিয়ে যেতে হয়েছিল, আমাকে একখানা ঘরে বসানো হয়েছিল। সেই ঘরে বসে একজন সুন্দর মহিলা দুধে চুমুক দিচ্ছিল। মহিলা নিয়মমাফিক আবহাওয়া সম্পর্কে মন্তব্য করলো। তারপরই সহসা একটু সামনে ঝুঁকে মৃদু কণ্ঠে শুধালো : 

—আচ্ছা, ওই ফায়ারপ্লেসের আড়ালে তোমার বাচ্চাটাকে কি কবর দেওয়া হয়েছে? এবং তারপর মাথা দোলাতে দোলাতে বললো—ঠিক ঘড়িতে তখন বারোটা বেজে দশ মিনিট, একই টাইমে রোজ ঘটনাটা ঘটে। এমন ভান করেছো যে তুমি যেন তার রক্ত দেখোনি।—এমন ঠান্ডা গলায় ঘটনাটা বলেছিল। শিরদাঁড়াটা ভয়ে শির শির করে উঠলো। 

—সত্যিই কি কেউ ফায়ারপ্লেসের আড়ালে কবর দিয়েছিলো? পপি জানতে চাইলো।

ডেভিড তার কথায় কান না দিয়ে বলতে লাগলো : 

প্ল্যানচেটের মাধ্যমে অশরীরী আত্মাকে ডেকে কথা বলা যায়। সেই সময় ঘর অন্ধকার হয়ে যাবে। ঘরের দরজায় টোকা পড়বে। অশরীরীক পায়ের আওয়াজ জাগবে। আত্মা এসে বসবে। তারপর ঘরে ফিরে সে মাছ-ভাত খাবে। মনে হবে যেন সে একজন সাধারণ মহিলা। হাসি, খুশি মানুষ 

—তাহলে ডাইনী সম্বন্ধে এটাই তোমাদের ধারণা। বললাম—ঠিক সেই তিনটে স্কটিশ বুড়ির মতন–বুড়িদের দিব্য দৃষ্টি ছিল—গোপনে তারা কৌশল অভ্যাস করতো। একটা হাঁড়ির উপর তাদের জাদুমন্ত্র আওড়াতো। অশরীরীক আত্মার সাথে কথা বলত। অথচ তারা একদম সাধারণ জীবন যাপন করতো। এইরকম জীব ছিল এই তিন কুড়ি, হাঁ এটা রীতিমতন মনকে প্রভাবিত করে। 

যদি কোনো অভিনেতা দিয়ে এমন অভিনয় করাতে পারো। সে শুকনো গলায় বলে উঠল। হারসিয়া। 

—ওখানেই তো কিছু বলার আছে। ডেভিড কথাটা মেনে নিল। যদি পাণ্ডুলিপিতে কোনোরকম মত্ততা দেখাবার কথা থাকে তবে অভিনেতা সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে চাইবে শহরের দিকে। মঞ্চে যদি মৃত্যুর দৃশ্য থাকে তবে একি অবস্থার সৃষ্টি হয়। কোনো অভিনেতাই সম্পূর্ণ নিথর অবস্থায় মৃত ব্যক্তির মতন লুটিয়ে পড়তে পারে না। তাই তাকে যন্ত্রণায় কাতরাতে হয়। ছটফট করতে হয়, দু চোখ ঘোরাতে হয়, হাঁফাতে হয়, বুক মাথা খামচে ধরে তাকে অভিনয় করে দেখাতে হয়। 

অভিনয়ের কথা বলছো, ফিল্মের অভিনীত ম্যাকবেথ সম্বন্ধে তোমার ধারণা কি? এ ব্যাপারটায় সমালোচকদের দারুণ মতভেদ রয়েছে। 

আমার ধারণা এটা দারুণ অভিনয়। হারসিয়া বললো—নিশি পাওয়া অবস্থায় হাঁটার দৃশ্যের পরই ডাক্তারের সঙ্গে সেই দৃশ্য সেই কথা—তুমি কি অসুস্থ মনকে সারিয়ে তুলতে পারো না। আমি এর আগে যা কোনোদিন ভাবিনি তাই তিনি অভিনয়ে আজ ফুটিয়ে তুলেছেন। আর সত্যি সত্যি তিনি ডাক্তারকে বলেছেন তাঁর মৃত্যু ঘটাতে। তবু তিনি তাঁর স্ত্রীকে ভালোবাসতেন। তিনি অভিনয় দিয়ে তাঁর মনের ভয় এবং ভালোবাসার মধ্যেকার দ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তুলেছেন। এরপর তোমার মৃত্যু হওয়া উচিত। কথাগুলি তিনি যেভাবে বলেছেন এই রকম বলবার ধরন আমি জীবনে কখনও শুনিনি। 

—আজকের দিনে এইরকম তাঁর অভিনয় দেখলে শেক্সপীয়ারও কিছুটা অবাক হয়ে যেতেন। শুকনো গলায় বললাম। 

—ডেভিড বললেন এবং সন্দেহ করলেন। বুরবেজ কোম্পানী এর মধ্যেই তাঁর আত্মার তৃষ্ণা কিছুটা মেটাতে পেরেছে। 

হারসিয়া বিড় বিড় করে বললেন—প্রযোজক যা কিছু করেছে সেটাই তো লেখকের কাছে একটা চিরন্তন বিস্ময়। 

—সত্যিই কেউ বেকনকে ডাকেনি শেক্সপীয়ার লিখতে? শুধালো পপি। 

—ও মতবাদ আজকাল একেবারেই অচল। সমবেদনার্দ্র কণ্ঠে বললো ডেভিড—তুমি কি জানো বেকন সম্পর্কে? 

—পপি বিজয়ীর মতো বললো তিনি বারুদ আবিষ্কার করেছিলেন। আমাদের দিকে তাকালেন ডেভিড। 

—বুঝছো তো এই মেয়েটাকে আমি কেন ভালোবাসি? বললো সব সময় সে আজব আজব জিনিস জানতে পারে। রজার নয়। ফ্রান্সিস আমার ভালোবাসার মানুষ। 

—খবরটা আমার মনে কৌতূহল জাগাচ্ছে হারসিয়া বললো—ফিল্মিং তৃতীয় খুনের অভিনয় করছে। এর কি কোনো নজীর আছে? 

ডেভিড জবাব দিলো-আমারো তাই বিশ্বাস। তখনকার দিনে এর যথেষ্ট সুযোগ ছিল। কোনো ছোটখাটো কাজ করানোর দরকার হলে পেশাদার খুনী পাওয়া সম্ভব ছিল। এটাই মজার ব্যাপার আজকালকার দিনেও এই রকম পেশাদার খুনী পাওয়া যায়। 

হারসিয়া প্রতিবাদ করলো। গুণ্ডার দল, বদমাশের বাহিনী যাই বলো না কেন তারা শেষ হয়ে গেছে। যাদের কথা বলতে চাইছি তারা গুণ্ডার দল নয়। নয় সমাজবিরোধী কিংবা নয় অপরাধ রাজ্যের মস্তান, ডেভিড বললো। তারা একদম সাধারণ মানুষ, তারা কারো হাত থেকে মুক্তি পেতে চায়। এরা ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী, মস্ত ধনী। এমিলি চাচী বড় বেশিদিন বেঁচে রয়েছে, ওই কদাকার স্বামী।—সে নাকি সব কাজে বাধা দেয়। কাজটা তাহলে কত সহজে সুষ্ঠুভাবে হয়ে যাবে যদি হ্যারোডাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলতে পারো— তোমাদের দলের দুজন খুনীকে কি পাঠাতে পারবে। 

আমরা সবাই হেসে উঠলাম। 

—কিন্তু যে কোনো লোক এ কাজ করতেই পারে তাই না? পপি বললো। 

আমরা তার দিকে তাকালাম। 

—আচ্ছা পুতুল মেয়ে কিভাবে তারা পারে। শুধালো ডেভিড। 

—আমি বলছি, এ কাজ চাইলে লোকজনরা করতে পারে। তোমরা তো বলছো লোকজনরা আমাদের পছন্দ করে। আমার বিশ্বাস এ কাজটিতে খুব খরচা পড়ছে। 

পপির গোলগাল দু’চোখে নিষ্পাপ কৌতূহলের দৃষ্টি স্পষ্ট—তার অধরযুগল অর্ধ বিস্ফারিত। 

—তুমি কি বলতে চাইছো? কৌতূহলী প্রশ্ন ডেভিডের। পপিকে কিছুটা হতভম্ব মনে হল।

—ওহো! আমার মনে হচ্ছে আমি একটা গোলমাল করে ফেলেছি। আমি বলতে চাইছি পেল হর্সের কথা। এ ধরনের একটা ব্যাপার। 

—পেল হর্স—একটা রঙচটা ঘোড়া সে আবার কি ধরনের ঘোড়া? পপি লজ্জায় মাথাটা নত করলো। 

—কথাটা বলে ফেলে বোকা বনে গেলাম। লোকের মুখে কথাটা শুনে ভুলবশত বলে ফেলেছি। 

—হয়ত ওটা একধরনের ঘোড়ার গাড়ী হবে। ডেভিড মনে সান্ত্বনা জানানোর জন্য বলল। 

****

আমরা সবাই জানি একটা জিনিসের কথা শোনবার পর চল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে যদি জিনিসটা চোখে পড়ে যায় তবে এই ঘটনাটা মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় একটা তাজ্জব ব্যাপার। পরের দিন সকালবেলাই প্রমাণ পেলাম— 

—ফ্লাক্স ম্যান–৭৩৮৪১ 

টেলিফোনের মধ্যে হাঁফের টান শোনা গেল। তারপর হাঁফাতে হাঁফাতে একজন উদ্ধত ভাবে বললো—ব্যাপারটা আমি ভেবে দেখছি আমি এখুন আসছি। 

দারুণ ভাবে মনে মনে ভাবতে লাগলাম। 

—চমৎকার। একটুক্ষণ ভেবে বললাম, এটা এটা কি….? 

—যা হোক কণ্ঠস্বর আবার ধ্বনিত হলো—বাজ দু বার আঘাত হানে না। 

—তুমি কি বলছো সঠিক নম্বরটা জানতে পেরেছো? 

—নিশ্চয় পেরেছি। তুমি তো মার্ক ইস্টারব্রুক তাই না? 

—ঠিক ধরেছো –বললাম শ্রীমতী অলিভার। 

কণ্ঠস্বরে বিস্ময় ঝরে পড়লো। আমি যে কে ছিলাম তা কি জানতে না? এ কথাটা আমি একেবারেই ভাবিনি। রোডার ভোজসভা ছিল সেটা। আমি যাবো এবং মহিলা চাইলে বইয়ে সই করবো। 

—তোমার পক্ষে সেটা চমৎকার কাজ করা হবে। অবশ্যই, ওরা তোমাকে থাকতেও দেবে।

—দলের লোকজনেরা থাকবে না, থাকবে কি? আশঙ্কিত কণ্ঠে শুধালো শ্রীমতী অলিভার।

—এ ব্যাপারের ধরন তো তোমার জানা, মহিলা বলতে লাগলো—লোকজন আমার কাছে আসছে আর শুধাচ্ছে আমি কিছু লিখছি কিনা এখন। যদিও তারা দেখছে যে, না লিখে এখন আমি হয় ঝাঁঝালো পানীয় আর না হয় টমেটোর রস পান করছি। এবং বলে, ওরা আমার লেখা বই পড়তে খুব ভালোবাসে।—অবশ্য এ ধরনের কথা শুনতে ভালো লাগে যদিও এর সঠিক জবাব আমি কখনও দিতে পারিনি। ধরো যদি বলি, বড় খুশী হলাম, কথাটা যেন শোনায়, আপনার সাথে দেখা হওয়াতে খুশি হলাম। এটা একটা মামুলি কথা। অবশ্য এটাও ঠিক যে, তুমি ভাবতে পারছো না ওরা চাইবে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে পিঙ্ক হর্সে গিয়ে কিছু একটা পান করবো। 

—পিঙ্ক হর্স সেটা আবার কি? 

—হাঁ, পেল হর্স, বলছি, এটা একটা মদের দোকান। ওদের মদের দোকানে যেতে ঘেন্না করে। কিন্তু এক চুমুক মদ পানের জন্য আমার মন দারুণ ছট্‌ফট্ করছে। 

— আচ্ছা, এই পেল হর্স বলতে তুমি কি বোঝাতে চাইছো? 

—ওখানে এই নামে একটা ভাঁটিখানা আছে, তাই না? ওটার নাম হয়তো পিঙ্ক হর্সও হতে পারে তাই তো? কিংবা ভাটিখানাটা ওখানে না হয়ে অন্য কোথাও হতে পারে। এটা স্রেফ আমার কল্পনা। অনেক জিনিসই আমি কল্পনা করে নিতে পারি। 

—কোকাটু কেমন আছে? তার খবর কি? শুধালাম। 

—কোকাটু? শ্রীমতী অলিভার—আমার মনে হয় তোমার মাথা বিগড়ে গেছে কিংবা মন খারাপ বা আর কিছু হয়েছে। তাই বলছো পিঙ্ক হর্স কোকাটু আর ক্রিকেট বলগুলো। 

শ্রীমতী অলিভার ফোন নামিয়ে রাখলো। দ্বিতীয় দফায় বলা পেল হর্স শব্দটা নিয়ে ভাবছিলাম আর ঠিক তখনি টেলিফোনটা বেজে উঠলো। 

এবার একজন নামকরা আইনবিদ মিস্টার গোমস হোয়াইট ফোন করেছিলেন—তিনি আমাকে জানালেন যে, আমার পালিতা মা লেডি হেসকথ ডিউবয়ের উইল মোতাবেক আমি তাঁর তিনখানা ছবি বেছে নিতে পারি। 

—অবশ্য এগুলো যে বিশেষ মূল্যবান তা নয়, হতাশ বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন মিস্টার গোমস হোয়াইট—তবে শুনেছি জীবিত অবস্থায় আপনি তার ছবিগুলো সম্পর্কে প্রশংসা করেছিলেন। 

—মহিলা ভারতীয় দৃশ্যের কয়েকখানা চমৎকার জলরঙ ছবি এঁকেছিলেন, বললাম – আপনি এ সম্বন্ধে আগে আমাকে একখানা চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু আমি সে চিঠির কথা একদম ভুলে বসে আছি। 

—ঠিক তাই হয়েছে। বললেন মিস্টার গোমস হোয়াইট— 

কিন্তু দলিলের ইচ্ছাপত্র সরকারি ভাবে অনুমোদিত হয়েছে। এবং সম্পত্তির তত্তাবধায়কদের মধ্যে আমিও একজন – আমরা সবাই এখন তাঁর লণ্ডন শহরের বাড়ির জিনিসপত্রগুলো বিক্রির ব্যবস্থা করছি। যদি নিকট ভবিষ্যতে কোনো একদিন আপনি এলিসমিয়ার স্কোয়ারে যেতে পারেন…। 

—এবার আমি উঠবো। বললাম, বুঝতে পারলাম, কাজ করার পক্ষে সকালটা বড় প্রতিকূল। 

****

খান তিনেক জলরঙা ছবি বগলদাবা করে ঊনপঞ্চাশ নম্বর এলিসমিয়ার স্কোয়ার থেকে বেরোচ্ছি এমন সময় বিপরীত থেকে আসা এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দোরগোড়ায় আমার ধাক্কা লাগলো। লজ্জিত কণ্ঠে ক্ষমা চাইলাম—ক্ষমা পেলাম। একখানা ট্যাক্সি দাঁড় করানোর জন্য হাত তুলতে গিয়ে একটা কথা মনে পড়ে গেলো এবং সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে জোরালো গলায় শুধালাম। 

—আরে। করিগ্যান না? 

—হাঁ, আর তুমি, তুমি তো মার্ক ইস্টারব্রুক। অক্সফোর্ডে পড়বার সময় জিম করিগ্যান আর আমি ছিলাম সতীর্থ—কিন্তু মনে হয় বছর পনেরো আগে আমাদের মধ্যে শেষ দেখাসাক্ষাৎ হয়েছিলো। 

—মনে হচ্ছে তোমায় আমি চিনি, কিন্তু ঠিক কোথায় দেখেছি তা মনে পড়ছে না একদম। বললো করিগ্যান—মাঝে মাঝে তোমার লেখাটেখা পড়ি, এবং সে সব পড়তে যে ভালো লাগে তাও জানাচ্ছি। 

—তোমার কি খবর? যেমন ইচ্ছে ছিলো তেমনি ভাবে রিসার্চ করছো তো? 

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো করিগ্যান-কদাচিৎ। রিসার্চের কাজ নিজের মনের মতন করা বড় খরচ সাপেক্ষ। অবশ্য কোনো লাখপতি বা কোটিপতিকে ধরতে না পারলে এ কাজ করা যায় না। 

—যকৃতের জীবাণু তাই না? 

—কি জব্বর স্মরণ শক্তি। না যকৃতের জীবাণু নিয়ে আর পরীক্ষানিরীক্ষা করছি না। ক্ষুদ্রান্তের গ্রন্থি থেকে নির্গত সারের গুণাগুণ পরীক্ষানিরীক্ষা করার আগ্রহ আজকাল আমাকে পেয়ে বসেছে। তুমি জানো না এসবের সঙ্গে প্লীহার যোগ রয়েছে। বাইরে থেকে মনে হয় এদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। 

কথাগুলো সে বলেছিলো যেন সে একজন উদ্দীপ্ত বিজ্ঞানী। 

—তাহলে তোমার বিশেষ উদ্দেশ্য কি? 

করিগ্যান ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে জানালো—যে দেখো আমি একটা সিদ্ধান্তে এসেছি ঐগুলো মানুষের আচরণকেও প্রভাবিত করে থাকে। মোট কথায় বলতে গেলে এরা যেন মোটরের ব্রেকে লাগানোর তরল তৈলাক্ত পদার্থের মতন কাজ করে। তরল তৈল ব্যবহার না করলে কোনো নিয়ন্ত্রক যন্ত্রপাতি কাজ করে না। আমি কেবল বলতে পারি মানব দেহে এই রস স্রাবের ঘাটতি হলে সে একজন অপরাধী হয়ে উঠতে পারে। 

সজোরে শিস্ দিয়ে বললাম—তাহলে আদিম পাপের ক্ষেত্রে কি ঘটছে? 

—বাস্তবিক এটা কি? বললো ডাক্তার করিগ্যান—লোকজনরা এটা পছন্দ করবে না, তারা করবে কি? দুর্ভাগ্যের কথা এ ব্যাপারে কাউকে আমি আগ্রহী করে তুলতে পারি না। তাই এখন আমি উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের একজন পুলিশ সার্জেন। খুবই মজার কাজ। ওখানে নানা ধরনের অপরাধী নজরে পড়ছে। আমার সাথে আমার বাড়িতে গিয়ে কি লাঞ্চ খাবে। না কি তোমাকে নিয়ে দোকানে ঢুকে তোমাকে বিরক্ত করবো। 

—তাই আমি চাই। কিন্তু তুমি তো ওখানে যাচ্ছো। করিগ্যানের পিছনে ওর বাড়ির দিকে ইঙ্গিতে ঘাড় নাড়লাম। 

—না, ঠিক তা নয়। জবাব দিলো করিগ্যান—আমি একবার ওখানে যাবো। 

—ওখানে বাড়ির কেয়ার টেকার ছাড়া আর কেউ নেই। 

—আমিও তাই ভাবছিলাম। কিন্তু লোভি হেসকেথ ডিউবয় সম্পর্কে পারলে কিছু কিছু খবর আমি সংগ্রহ করতে চাই। 

তবে আমার মনে হয় ও বাড়ির কেয়ার টেকারের চেয়ে মহিলা সম্পর্কে অনেক বেশি খবর আমি তোমাকে দিতে পারবো। মহিলা ছিলেন আমার ধর্ম মা। তিনি আমাকে লালন পালন করেছিলেন। 

—সত্যিই কি তিনি তাই করেছিলেন? এটা সৌভাগ্যের কথা। কোথায় খাওয়ার জন্য আমরা ঢুকবো। লোনডেস স্কোয়ারের কাছেই একটা খাবার ঘর আছে। ওখানে সমুদ্রজাত উপাদান দিয়ে বিশেষ ধরনের স্যুপ তৈরি হয়। সেই ছোট্ট খাবারঘরে ঢুকে আমরা চেয়ারে বসলাম—ফরাসী নাবিকদের মতন পোশাকপরা ফ্যাকাসে মুখ এক ছোকরা স্যুপের ডেকচি আমাদের সামনে এনে বসলো। স্যুপ থেকে তখন ধোঁয়া উড়ছে। 

স্যুপ চেখে বললাম—চমৎকার। করিগ্যান, এবার বলো তুমি বৃদ্ধা মহিলা সম্পর্কে কি জানতে চাও? এবং ঘটনাক্রমে কেন জানতে চাও? 

একটু চিন্তা করে বললাম-মহিলা ছিলো প্রাচীনপন্থী। একেবারে ভিক্টোরিয়ান যুগের মতন আচার আচরণ মহিলার। একটা নগণ্য দ্বীপভূমির প্রাক্তন গভর্নরের বিধবা এই মহিলা ধনী আর আয়েসী রমণী। শীতকালে এসটোরিল এবং এ ধরনের বিদেশভূমিতে ভ্রমণ করতে অভ্যস্ত। তাঁর বাড়িখানা যেন একটা রহস্যপুরী, ভিক্টোরিয়ার যুগের আসবাবে ভরা এবং একেবারে জঘন্য সেকেলে রূপোর নক্সাকাটা সে সব আসবাবপত্র। নিঃসন্তান মহিলা বাড়িতে একজোড়া লোমশ কুকুর পুষেছিলো। নিজের সন্তানের মতন তাদের ভালোবাসেন। রক্ষণশীল মতবাদে বিশ্বাসী। সদাশয় হলেও তিনি স্বৈরতান্ত্রিক। নিজের পছন্দমতন জীবনচর্যায় অভ্যস্ত। বলো, তাঁর সম্বন্ধে আর তুমি কি জানতে চাও? 

করিগ্যান জবাব দিলো-ঠিক জানি না কেউ তাকে কোনো দিন ব্ল্যাকমেল করেছিলো কিনা? তুমি তা বলবে কি? 

ব্ল্যাকমেল করা? বিস্মিত হয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বললাম—এর চেয়ে অস্বাভাবিক কিছু আমি কল্পনা করতে পারছি না। এসব কি ব্যাপার? আমি তখনি ফাদার গোরম্যানের খুন হওয়ার ব্যাপারটা জানতে পারলাম। চামচটা টেবিল থেকে নামিয়ে রেখে শুধালাম। এই নামের তালিকাটা কি দেখেছো? এখানা কি তুমি পেয়েছো? 

—আসল তালিকাটা পাইনি। তবে নামগুলো লিখে নিয়েছি। এই দেখো। পকেট থেকে নাম লেখা কাগজখানা বার করে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। কাগজখানা হাতে নিয়ে দেখতে লাগলাম। 

—পারকিনস? দুজন পারকিনসের কথা আমি জানি। নৌবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল আর্থার পারকিনস। আর একজনের নাম হচ্ছে হেনরি পারকিনস–সে সরকারি দপ্তরে কাজ করেন। ওরসিরদ-মেজর ওরসিরদ একজন নাবিক। স্যাণ্ডফোর্ড— শৈশবকালে স্যাণ্ডফোর্ড ছিলেন আমাদের গীর্জার বৃদ্ধ যাজক। হারমণ্ড সওয়ার্থ? না টাকারটন—। বলতে বলতে থামলাম বারেক –টাকারটন…মনে হয় তুমি থমসিনা টাকারটনের কথা বলছো না? 

কৌতূহলী করিগ্যান আমার দিকে তাকিয়ে শুধালো—এটুকুই আমার জানা। আচ্ছা মহিলা কে? তিনি কি করেন? 

—এখন কিছুই করেন না। সপ্তাহখানেক আগে খবরের কাগজে তাঁর মৃত্যুর খবর ছাপা হয়েছিল। 

—তাহলে এসব খবর শুনে কোনো সুরাহা হলো না। নামের তালিকার উপর নজর বুলাতে বুলাতে বললাম—শা। আমি শা নামের একজন দাঁতের ডাক্তারকে জানি। আর জিরোম শা তো একজন অভিজাত ও নামজাদা লোক। দেলা ফন্টেন নামটা আমি সম্প্রতি শুনেছি। কিন্তু কোথায় শুনেছি তো আমার মনে পড়ছে না। করিগ্যান। এসব খবর থেকে তোমার কি কোনো সাহায্য হবে? 

—আমি একেবারেই তা ভাবছি না। তোমার নামও তালিকায় রয়েছে এটা বড় দুর্ভাগ্যের কথা। 

—হতে পারে। এর সঙ্গে ব্ল্যাকমেলের সম্পর্ক রয়েছে তা তুমি ভাবছো কেন? 

—গোয়েন্দা ইনসপেক্টর লেজুনের প্রস্তাব এটা। মনে হচ্ছে এটা হওয়ার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু আরো সম্ভাবনা থাকতে পারে। এটা মাদক দ্রব্যের চোরা চালানকারীদের নামের তালিকা হতে পারে কিংবা হতে পারে নেশাগ্রস্থদের তালিকা অথবা গোপন চক্রীদের নামের তালিকা। আসলে যে কোনো একটা তালিকা হওয়া সম্ভব। তবে এ ব্যাপারে একটা জিনিস নিশ্চিত যে, এই তালিকাটা হাতানোর জন্য একজন মানুষকে খুন করা খুবই জরুরি হওয়া সম্ভব। 

কৌতূহলী হয়ে শুধালাম।—তোমার কাজের সাথে পুলিশের যেটুকু সম্পর্ক রয়েছে সে সম্বন্ধে কি জানতে তুমি সব সময় আগ্রহ দেখাও? 

মাথা নেড়ে সে জবাব দিলো—সব সময় যে আগ্রহ দেখাই তা বলতে পারি না। অপরাধীর চরিত্র জানতেই আমি আগ্রহী। জানতে আগ্রহী তার অতীত জীবনের পটভূমি, আর বয়সবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার শিক্ষালাভের ইতিবৃত্ত এবং জানতে আগ্রহী তার দেহের বিভিন্ন গ্রন্থিসংস্থানের অবস্থা। হাঁ এসবই আমি জানতে চাই। 

—তাহলে এই নামের তালিকাটা সম্পর্কে তুমি জানতে এত আগ্রহী কেন? 

—জানতে পারলে আমার পক্ষে খুব ভালো হত। আস্তে আস্তে বললো করিগ্যান। বোধ হয় ঐ তালিকায় আমার নামটা রয়েছে। করিগ্যানদের ব্যাপার তাই। নিজে একজন করিগ্যান তাই অন্য আর একজনে করিগ্যানকে উদ্ধার করতে চাই। 

—উদ্ধার করতে চাও? তাহলে নিশ্চয় এটা উৎপীড়িতদের নামের তালিকা উৎপীড়নকারীদের তালিকা নয়। কিন্তু এটা যে কোনোও একটা দলের তালিকাও হতে পারে? 

—একেবারে ঠিক কথাই বলছো তুমি। এ ব্যাপারে আমার পক্ষে খুব আগ্রহ দেখালে বিদ্‌ঘুটে অবস্থার সৃষ্টি হবে। মনে হয় মনের অবস্থা একটা আবেগ। মনে হয় ফাদার গোরম্যানের সম্পর্কে কিছু করার কথা। তার সাথে আমার ঘন ঘন দেখা না হলেও জানতাম ফাদার মানুষ হিসাবে খুব সুন্দর ছিলেন। প্রত্যেকেই তাকে ভালোবাসতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন। কঠোর জঙ্গী মনোভাবপূর্ণ লোক ছিলেন। এই নামের তালিকাটি তিনি জীবন মৃত্যুর সাথে যুক্ত বলে মনে করতেন আর এই কথাটা তিনি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। … 

পুলিশ কি আততায়ীর কোনো হদিশ পায়নি? 

—হাঁ সে দীর্ঘ কাজের ফিরিস্তি। সেদিন যে মহিলা তাঁকে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য ডেকেছিলো তার অতীত জীবনের খবরাখবর জানবার চেষ্টা করছে পুলিশ। 

—কে সেই মহিলা? 

—ওপর থেকে বিচার করলে মহিলার কাজের মধ্যে কোনো রহস্য নজরে পড়ে না।

মহিলা বিধবা, আমাদের ধারণা মহিলার স্বামী ঘোড়দৌড়ের সাথে যুক্ত ছিলো, কিন্তু কাজটা বেআইনী নয়। মহিলা নিজে একটা ব্যবসা সংস্থায় কাজ করতো। ক্রেতাদের সম্পর্কে সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা এবং অন্যরাও প্রায় কিছুই বলতে পারেনি। উত্তর ইংল্যান্ডের ল্যাঙ্কাশায়ার থেকে মহিলা এখানে এসেছিলেন, মহিলার নিজস্ব বলতে কিছুই ছিলো না–এর এটাই বিদ্‌ঘুটে ব্যাপার। 

কাঁধ নাচিয়ে বললাম—এ ধরনের আচরণ আরো অনেকের জীবনে ঘটে থাকে। এটাই তাদের জীবনচর্চার পদ্ধতি। তাদের জীবনটা সত্যই একাকীত্বের জগৎ। 

—হাঁ তুমি যখন বলছো তখন সেটাই সত্য। 

—যা হোক তুমি কি সে জন্যই খোঁজখবর নিতে শুরু করেছ? 

—কেবল এধার ওধার একটা খোঁজখবর নিচ্ছি। হেসকেথ ডিউবয় নামটাও সচরাচর শোনা যায় না…। কথাটা শেষ না করেই সে থামলো, কিন্তু তুমি যা আমাকে বললে তাতে মনে হচ্ছে এখান থেকে কোনো সূত্র পাওয়া সম্ভব নয়। 

—না, কোনো মাদকাসক্ত লোক বা মাদক চোরাচালানকারীর খোঁজ ওখানে পাওয়া যাবে না। নিশ্চিত কণ্ঠে জানালাম। এটাও সঠিক যে, পাবে না কোনো গোপনচক্রীর হদিস। শুধু একটা কলঙ্কশূন্য জীবনের অস্তিত্ব ওখানে ছিল। যাকে ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করা হত। তাই ভাবতেই পারছি না যে এই নামের তালিকার মধ্যে মহিলার ভয় পাবার মত কি আছে। মহিলা তার সোনাদানা সব ব্যাঙ্কে রেখেছিল সেগুলোও লুট করে নেবার ভয় তার ছিল। 

—অন্য কোনো হেসকথ ডিউবয়ের কথা কি শুনেছো? তাদের ছেলের কথা? 

—না সন্তানটন্তান তার কিছু ছিল না। মনে হয় ঐ মহিলার একজন বোনের ছেলে ও আরেকজন বোনের মেয়ে আছে। কিন্তু তাদের পদবী ভিন্ন ছিল। মহিলার স্বামী ছিল পরিবারের একমাত্র সন্তান। 

আমি যে তার খুব সাহায্য করেছি একথাটা করিগ্যান আমাকে রুক্ষ কণ্ঠে বললো। নিজের হাতের ঘড়িটায় নজর বুলিয়ে নিয়ে খুশি খুশি গলায় জানালো সে, এখন তাকে একজন জেরা করবে। তারপর করিগ্যান চলে গেল। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ঘরে ফিরে গেলাম। কিন্তু কিছুতেই আমার কাজে মন বসছিল না। তাই শেষের দিকে ডেভিড আরডিংলিকে আমি ফোন করলাম। 

—কে ডেভিড? আমি মার্ক কথা বলছি। আচ্ছা সেদিন তোমার সাথে গিয়ে একটা মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তার ডাক নাম পপি। তার পোশাকি নামটা বলতো। 

—আমার বান্ধবীকে মনে ধরেছে। তাই না? ডেভিডের কণ্ঠস্বরে খুশির ঝিলিক। আমি রসিকতা করে বললাম, তোমার হাতে তো অনেক রয়েছে। একজনকে তুমি নিশ্চয়ই ছাড়তে পারবে। 

—বুড়ো খোকা, তুমি নিজেই তো ওজনদার লোক। মনে হচ্ছে তুমি মেয়েটার প্রেমে গভীরভাবে জড়িয়ে গেছো। 

গভীর ভাবে জড়িয়ে গেছি, এটা একটা বিরক্তিকর মন্তব্য। তবু মনে হলো এই মন্তব্যটা আমার মনে আঘাত হানলো। হারসিয়ার সঙ্গে আমার সম্পর্কটাকে খুব সুন্দর ভাবে বর্ণনা করল। এবং কথাটা কেন আমার মনকে হতাশ করে তুলেছে? মনে মনে সব সময় আমি তো এ ইচ্ছে পালন করছি যে, একদিন হারসিয়ার সাথে আমার বিয়ে হবে,… আমি তো জানি তার চেয়ে আমি আর কাউকে পছন্দ করি না ও ভালোবাসি না। আমাদের মধ্যে অনেক কিছুর মিল আছে। 

কেন যে আমার এত হাই তোলার ইচ্ছে তার কারণ ভাবতেই পারছি না…ও আমাদের ভবিষ্যৎ জীবনের ছবিটা যেন আমার দৃষ্টির সামনে ছড়ানো। 

আমি আর হারসিয়া আমাদের দুজনের ভালোলাগার একটা অভিনয় দেখতে চলেছি। সঙ্গীত ও অভিনয় এই দুটো নিয়ে মেতে উঠেছি। হারসিয়া যে আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। 

আমার অবচেতন মন থেকে একটা বিদ্রূপ কণ্ঠ শয়তানের বাচ্চা যেন বলে উঠলো, কিন্তু এতে যথেষ্ট মজা নেই। আমার মন আহত হলো। 

—কি ঘুমতে যাচ্ছ? শুধালো ডেভিড। 

—নিশ্চয় না। সত্যি কথা বলতে কি তোমার বান্ধবী পপিকে আমার চিত্তাকর্ষক মনে হচ্ছে। 

—ভালো কথা একটু একটু করে তার সব পরিচয় প্রকাশ পাচ্ছে। ওর আসল নাম হচ্ছে প্যাসেলা স্টারলিং এবং মেফেয়ারে একটা ফুলের দোকানে সে কাজ করে। জানতো তিনটে মরা ডালের সাথে একটা টিউলিপ বাঁধা পাপড়িগুলো পিছন দিকে পিন দিয়ে আটকানো, সঙ্গে একটা শুকনো দাগে ভরা লরেন্স পাতা। দাম তিন গুণ। 

আমাকে ডেভিড ঠিকানা দিল। 

সদাশয় জ্যাঠামশায়ের মতন বলল, যাও এবার মেয়েটাকে নিয়ে ফূর্তি করতে পারবে এবং মজা লুটতে পারবে। মেয়েটি কিছুই বুঝতে পারছে না যে তার মাথায় বুদ্ধিসুদ্ধি কিছুই নেই। যা তুমি বলবে তাই সে বিশ্বাস করে নেয়। সে মনে প্রাণে একজন ধর্মপরায়ণ, কোনো রকম মিথ্যে আশা আমি দেখাই না। ডেভিড ফোন ছেড়ে দিল। 

****

ফ্লাওয়ার স্টাডিজ লিমিটেডের প্রবেশ পথ পেরিয়ে কম্পিত দেহে ভিতরে ঢুকলাম। হলুদ রঙের গার্ডেনিয়া ফুলের দম বন্ধ করা সুগন্ধ প্রায় আমাকে ঠেলে ঘর থেকে বার করে দিলো। বিবর্ণ সবুজ ডালপালা আঁকা পোশাকপরা ঠিক পপির মতন দেখতে এক দঙ্গল মেয়ে আমাকে গোলমালে ফেলে দিলো। 

অবশেষে আমি তাকে চিনতে পারলাম, সে একটা ঠিকানা লিখেছিল। কিন্তু একটা বানান লিখতে অসুবিধায় পড়েছিল, সেই বানানটা হলো ফরটেস্কু ক্রিসেন্ট। একসময় সে ঠিকানা লিখে পাঁচ পাউন্ড নোটের ভাঙানি দিয়ে পপি একটু সোয়াস্তি লাভ করলো। 

আর তখুনি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম, সেদিন রাতে আমাদের দেখা হয়েছিল, সঙ্গে ছিল ডেভিড আরডিংলি। পপি আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চিৎকার করে বলল হ্যাঁ মনে পড়েছে। 

সহসা দ্বিধা এবং সন্দেহ আমার মনে জেঁকে বসল। বললাম, তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। মনে হয় কিছু ফুল কিনে নিলে আমার পক্ষে সুবিধা হবে। তাই না? 

ঠিক যেন আসল জায়গায় চাপ দেওয়া হয়েছে তাই পপি বলে উঠল, আমাদের দোকানে কিছু চমৎকার গোলাপ রয়েছে। টাটকা। আজই আনা হয়েছে। 

—বোধ হয় এই হলুদ রঙের গোলাপগুলো তাই না? নজরে পড়লো চারিদিকে গোলাপ ফুল সাজানো। জানতে চাইলাম ওগুলোর দাম কত? 

—দারুণ, দারুণ সস্তা। মৃদু কণ্ঠে পপি জবাব দিল। এক একটা মাত্র পাঁচ শিলিঙ।

আবেগে আমার মনের ভিতরটা ফুলে উঠলো। বললাম, গোটা ছয়েক কিনবো।—প্রত্যেকটার সঙ্গে দারুণ দারুণ এক ধরনের পাতা বাঁধা আছে। 

বিশেষ ধরনের পাতাগুলো সন্দেহের চোখে দেখতে লাগলাম। পাতাগুলো প্রায় শুকিয়ে আমার মত অবস্থা হয়েছে। ওগুলোর বদলে টাটকা ফার্ন পাতায় বাঁধা গোলাপগুলো বেছে নিলাম। অবশ্য এর জন্য স্পষ্টভাবেই আমার অবস্থা পপির দৃষ্টিতে একটু হেয় হলো। 

পপি তখন বিব্রত ভাবে ফার্ন পাতায় জড়ানো গোলাপগুলো আমার জন্য বাঁধছিলো। ঠিক তক্ষুনি বললাম, তোমাকে আমি কিছু প্রশ্ন করতে চাই। সে দিন সন্ধ্যাবেলা তুমি পেল হর্সের কথা বলেছিলে। 

দারুণ ভাবে চমকে উঠলো পপি, ফার্ন পাতায় জড়ানো গোলাপ ফুলগুলো তার হাত থেকে মেঝেতে পড়ে গেল। 

—এই পেল হর্স সম্বন্ধে তুমি কি আরো কিছু বলতে পারো?

আনত দেহ সোজা করে শুধালো পপি, কি যেন বলছিলে? 

—তোমার কাছ থেকে পেল হর্স সম্বন্ধে জানতে চাইছি।

—পেল হর্স? কি বলছো তুমি? 

সেদিন সন্ধ্যাবেলায় তুমিই তো বলেছিলে। 

—এ ধরনের কোনো কথা যে বলেনি সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। পেল হর্স সম্বন্ধে আমি কোনোদিন কিছু শুনিনি। 

—কেউ তোমাকে এ সম্বন্ধে কিছু বলেছিল—সে লোকটা কে? পপি খুব দ্রুত ভাবে শ্বাস টেনে এই কথাটা বলেছিল। 

—তুমি কি বলছো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমাদের খরিদ্দারের সঙ্গে এত কথা বলার অধিকার নেই। আমার পছন্দ করা গোলাপ ফুলগুলো কাগজে মুড়ে পপি আমার হাতে দিয়ে বললো—এগুলোর মোট দাম পঁয়ত্রিশ শিলিঙ। গুঁজে দিয়ে অন্য আর একজন খরিদ্দারের দিকে চলে গেল। 

ধীরে ধীরে দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম। কয়েক পা এগোতে মনে মনে হিসাব করলাম। যে পপি হিসাবে ভুল করেছে। ফার্ন পাতায় জড়ানো গোলাপ ফুলগুলোর এক একটার দাম সাত এবং ছয় কাজেই সে আমাকে বেশি অর্থ ফেরৎ দিয়েছে। হিসাবে ও ভুল করেছে এ থেকে বুঝতে পারলাম যে, তার মন অন্য দিকে নিবদ্ধ ছিলো। 

ফিরে গেলাম দোকানে। সেই সুন্দর অচেনা মুখখানা ও বড় বড় দুটো নীল চোখ দেখলাম। ঐ চোখ দুটোতে কি যেন রহস্য জড়িয়ে রয়েছে। মনে মনে আওড়ালাম—ভয় পেয়েছে। ভয়ে সিটিয়ে রয়েছে…কিন্তু কেন? কেন?