হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের খোঁজে
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের একটি নিবন্ধ আমার নজর কেড়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন বিজ্ঞান সাময়িকী ও খবরের কাগজগুলোতে বেশ কিছু লেখা বেরুচ্ছে। ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে ভাববার; চাঞ্চল্যকর তো বটেই। ঘটনাটা হল, বাংলাদেশসহ এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার কয়েকটি দেশে কোটি কোটি মেয়ে সকলের চোখের আড়ালে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে তারা প্রতিদিন-প্রতিমুহূর্তে। তাদের খোঁজ করা দরকার। কোথায় যাচ্ছে তারা—কী হচ্ছে তাদের—কেমন করে সেটা সম্ভব হচ্ছে, এসবই জানা দরকার।
প্রতি পরিবারে সমান সমান ছেলে ও মেয়ে সন্তানের সংখ্যা যদিও সচরাচর চোখে পড়ে না, তবু প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ও পরিসংখ্যানের ফর্মুলা অনুযায়ী গড়ে মেয়ে ও ছেলের মোট সংখ্যায় খুব বেশি একটা তারতম্য হয় না। লিঙ্গভেদে বৈষম্যমূলক আচরণ করা না হলে স্বাভাবিকভাবে মেয়ে ও ছেলের আনুপাতিক হার ১.০৫ বা এর খুব কাছাকাছি হতে দেখা যায়। আর এই সংখ্যাটি কিছু জরুরি পরিস্থিতি ছাড়া সর্বকালে সর্বদেশের জন্যেই প্রযোজ্য। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ ইউরোপ- আমেরিকার অনেক দেশেই মেয়ে আর ছেলের আনুপাতিক হার ১.০৫ বা তার সামান্য ওপরে অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন ছেলের সঙ্গে ১০৫টি মেয়ে রয়েছে। অথচ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। অর্থাৎ এই আনুপাতিক হার মেয়েদের বদলে ছেলেদের অনুকূলে। এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু কিছু অঞ্চলে মেয়ে ও ছেলের হার কমতে কমতে একের নিচে চলে এসেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে, এই হার মিসরে ০.৯৫। বাংলাদেশ, চীন ও পশ্চিম এশিয়ায় ০.৯৪; ভারতে ০.৯৩ আর পাকিস্তানে ০.৯০। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে, এসব দেশে মেয়েদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণই এই অস্বাভাবিক সংখ্যার জন্যে দায়ী। যে-তিনটি উপকরণ প্রধানত মেয়ে ও ছেলের আনুপাতিক হারের জন্যে দায়ী সেগুলো হলো : (১) জন্মের হার, (২) মৃত্যুর হার ও (৩) দেশত্যাগ অথবা বহিরাগমনজনিত পরিবর্তন।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জন্মের তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, সব জায়গাতেই মেয়েসন্তানদের চেয়ে শতকরা ৫% পুত্রসন্তান বেশি জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু সংখ্যায় বেশি জন্মগ্রহণ করলেও জীবন ধারণ বা বেঁচে থাকার ক্ষমতা ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের বেশি। এ ছাড়া হৃৎপিণ্ডের অসুখ, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক ইত্যাদির মতো মারাত্মক অসুখগুলোর প্রকোপও মেয়েদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম। ফলে তাদের সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল গড়ে ছেলেদের চেয়ে বেশি। যুদ্ধ, ধূমপান, মদ্যপান, সড়ক-দুর্ঘটনা, খুনখারাবিজনিত মৃত্যুর হারও যেহেতু পুরুষদের মধ্যেই অপেক্ষাকৃত বেশি, সেহেতু সব দিক থেকেই মোট সংখ্যায় মেয়েদের পক্ষে পুরুষদের তুলনায় এগিয়ে থাকা স্বাভাবিক। উন্নত দেশগুলোতে সেটাই ঘটে থাকে। দেশত্যাগী বা বহিরাগতদের কারণে কোনো কোনো বিশেষ সময়ে বিশেষ দেশে মেয়ে ও ছেলের আনুপাতিক হার কিছুটা হেরফের হলেও প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশের সাথে প্রতিটি উন্নত দেশের মেয়ে ও ছেলের পার্থক্যের কারণ কখনোই এটা হতে পারে না। হলেও উল্টোটাই হওয়া উচিত।
আর সেটাই যদি সত্য হয়, তা হলে এশিয়ায় মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের সংখ্যা এত বেশি কেন? এসব অঞ্চলের কোটি কোটি মেয়েরা কোথায় যাচ্ছে? ইউরোপ ও আমেরিকায় যা স্বাভাবিক, সেই হিসেব করলে চীনে ৫ কোটি মেয়ের কোনো হদিস পাওয়া যায় না। তারা গেল কোথায়?
কেউ কেউ যুক্তি দিতে পারেন যে, আমেরিকা বা ইউরোপকে মানদণ্ড বিবেচনা করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশকে বিচার করলে চলবে না। কেননা ওইসব দেশের তুলনায় জন্মের হার ও মৃত্যুর হার আমাদের মতো দেশে অনেক বেশি। সম্ভাব্য জীবনসীমাও তুলনামূলকভাবে কম। এই সকল তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে যদি এশিয়ার দেশগুলোতে উন্নত দেশের পরিবর্তে আফ্রিকার উপ-সাহারা অঞ্চলের সঙ্গে তুলনা করা যায়, তা হলে কী হয়? আফ্রিকার ওইসব অঞ্চলে জন্ম-মৃত্যুর হার ও সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল যেহেতু আমাদের দেশের সঙ্গে তুলনীয়, ওখানকার মেয়ে-পুরুষের আনুপাতিক হারের পার্থক্য কেবলমাত্র মেয়েদের সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থানগত কারণের জন্যেই হওয়া স্বাভাবিক। অর্থোপার্জনে মেয়েদের অংশগ্রহণ করার কারণে উপ-সাহারা অঞ্চলের আফ্রিকানদের মধ্যে মেয়েদের প্রতি বিরূপ মনোভাব তেমন লক্ষণীয় নয়। সেই হিসেবে দেখা গেছে যে, উপ-সাহারা অঞ্চলে মেয়ে-পুরুষের আনুপাতিক হার ১.০২২। এ সংখ্যাটিকে মানদণ্ড বিবেচনা করলেও চীনদেশের ৪.৪ কোটি ও ভারতে ৩.৭ কোটিসহ সমগ্র পৃথিবীতে ১০ কোটি মেয়ের কোনো খোঁজ মেলে না। আশির ও নব্বইয়ের দশকে অমর্ত্য সেনের হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের ওপর রচিত সিরিজের ওপর পরবর্তীকালে অন্যান্য অনেক অর্থনীতিবিদরাই কাজ করেছেন। সম্প্রতি জার্মানির স্টিফেন ক্লাজেন ও ক্লদিয়া উইঙ্ক এ ব্যাপারে বিস্তারিত গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, অর্মত্য সেনের আনুমানিক সংখ্যা ১০ কোটির চাইতেও বেশি এই হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের সংখ্যা। একবিংশ শতাব্দীর দোর গোড়ায় এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১১.৩ কোটি। প্রধানত দুই উপায়ে এই সংখ্যা নির্ণিত হয় : (১) বয়স অনুযায়ী ছেলে ও মেয়েদের মৃত্যুর হার নির্ণয় করা এবং (২) আপামর জীবিত জনসংখ্যার মধ্যে পুরুষ ও নারীর সংখ্যার আনুপাতিক হার বের করা। ভাবতে গা শিউরে ওঠে যে, বিংশ শতাব্দীতে জগৎজুড়ে দুর্ভিক্ষজনিত কারণে যেসব মৃত্যু হয়েছে, সেসব একত্রিত মৃত্যুর সংখ্যার চাইতেও বেশি এই হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের সংখ্যা। এই সংখ্যা দুই বিশ্বযুদ্ধে নিহত এবং ১৯১৮-২০ সালের ভয়াবহ ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীতে মৃতের একত্রিত সংখ্যার চাইতেও বড়। পৃথিবী জুড়ে এইডস্ রোগে মৃতের সংখ্যার চাইতেও বেশি এ সংখ্যা। তবে আশার কথা হলো, ইদানীংকালে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় এ ব্যাপারে উন্নতি লক্ষ করা গিয়েছে। ভারতে অপেক্ষাকৃত কম উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। আর চীনে অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। মেয়েদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নতির সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের সংখ্যার নিম্নগতি লক্ষ করা যায়। অন্য একটি জরিপে কোল এবং তাঁর সহকর্মীরা জন্ম- মৃত্যুর হার ও সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল বিবেচনা করে দেখিয়েছেন যে, মেয়েদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা না হলে এশিয়ার দেশগুলোতে এই মুহূর্তে যতজন নারীর অস্তিত্বের কথা ছিল, তার তুলনায় চীনে ২.৯ কোটি, ভারতে ২.৩ কোটি এবং অন্যান্য দেশসহ পৃথিবীতে সবসুদ্ধ অন্তত ৬ কোটি মেয়ে কম বিদ্যমান।
অন্যান্য দেশের তুলনায় এশিয়ায় মেয়েদের এই নিম্ন আনুপাতিক হারের কারণটা কী? অনেক কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ছেলেশিশুর তুলনায় মেয়ে-শিশুর মৃত্যুর হার অনেক বেশি এশিয়ায়। ভারতের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, জন্মের পর প্রথম চার দশকে পুরুষের তুলনায় নারীর মৃত্যুর হার অনেক বেশি। এর অন্যতম কারণ অবশ্য গর্ভবতী মেয়েদের গর্ভাবস্থায় ও প্রসবকালীন মৃত্যুর হার অধিক। কিন্তু জন্মের পর থেকে প্রাক্-কৈশোর পর্যন্ত মেয়েদের সংখ্যা স্বল্পতার জন্যে তো গর্ভাবস্থায় জটিলতাজনিত মৃত্যু দায়ী হতে পারে না। তা হলে? অন্য কারণগুলো কী? বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত সংবাদে জানা গেছে যে, এর প্রধান কারণ নারীশিশুর প্রতি পরিবার ও সমাজের অবহেলা ও ঔদাসীন্য। বাংলাদেশসহ এশিয়ার অনেক দেশে প্রতিনিয়ত মেয়েশিশুরা পরিবারে এ ধরনের বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। কয়েক বছর আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আওতাভুক্ত “ট্রপিকেল ডিজিজ রিসার্চ” (টি ডি আর) বুলেটিনের একটি নিবন্ধে এ ধরনের একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য ছিল। ওই নিবন্ধে একটি সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে থাইল্যান্ডে বিশেষজ্ঞরা লক্ষ করেন যে, ওই রোগে ছেলেরাই তুলনামূলকভাবে বেশি আক্রান্ত হয়। এর কারণ অনুসন্ধান করতে না পেরে লিঙ্গভেদের দরুন দৈহিক পার্থক্যকেই তাঁরা প্রথমত দায়ী করে বসেছিলেন। তারপর পরম বিস্ময়ে তাঁরা লক্ষ করলেন, ব্যাপারটা তা নয়। হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে যেসব রোগীকে নিয়ে আসা হয়, তারা বেশিরভাগই হল পুরুষ রোগী। মেয়ে রোগীদের, এমনকি অসুস্থ শিশু মেয়েদেরও অপেক্ষাকৃত কম আনা হয় চিকিৎসা কেন্দ্রে। এটার সত্যতা বিচার করার জন্যে তাঁরা একই সংক্রামক ব্যাধি সম্পর্কে তথ্য আহরণ করলেন হাসপাতালের পরিবর্তে বাড়ি বাড়ি গিয়ে। মাঠকর্মীদের সংগৃহীত সেই তথ্যে জানা গেল, প্রকৃতপক্ষে ছেলে আর মেয়েদের মধ্যে এই রোগের প্রাদুর্ভাবের কোনো তারতম্যই নেই। এ ঘটনার পর ট্রপিকেল ডিজিজ রিসার্চ বিভাগ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কেবলমাত্র মেয়েদের ওপর বিভিন্ন ট্রপিকেল রোগের প্রকোপ, আনুষঙ্গিক সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা ও রাজনৈতিক বিষয়গুলোর ওপর গবেষণার জন্যে একটি পৃথক কমিটি ও বিশেষ ফান্ডের ব্যবস্থা করে। অনুরূপভাবে মনিকা দাসগুপ্তের একটি সমীক্ষায় দৃষ্টি উন্মোচনকারী এক তথ্যের সন্ধান পাওয়া গেছে। পাঞ্জাবে পাঁচ বছরের কম বয়সী ছেলেমেয়েদের মৃত্যুর হার জরিপ করতে গিয়ে তিনি লক্ষ করছেন যে, যেসব মেয়ে শিশুদের বড় কোনো বোন নেই, তাদের মৃত্যুর হার সমবয়সী ছেলে শিশুদের মৃত্যুর হারের তুলনায় সামান্য বেশি। কিন্তু যেসব মেয়েশিশুর একটি অগ্রজ সহোদরা রয়ে গেছে, তাদের মৃত্যুর হার ছেলেশিশুদের তুলনায় দ্বিগুণ। এ তথ্য এই সংবাদই পরিবেশন করে যে, মেয়েশিশুদের প্রতি এ সকল দেশে রয়েছে পরিবারের গভীর অবজ্ঞা, যা কিছুটা কম স্পষ্ট হয় যদি কন্যাটি ভাগ্যক্রমে প্রথম সন্তান হয়। দাসগুপ্তের এই নিরীক্ষা অনুযায়ী শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে মেয়েদের জন্যে ১৯.৬ ও ছেলেদের জন্যে ১৪.৮।
ইতোমধ্যেই পরবর্তী সন্তানের জন্ম না হলে উন্নয়নশীল দেশের মেয়েশিশুরা সাধারণত এক থেকে দু বছর বয়স পর্যন্ত অন্তত খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে মারাত্মক বৈষম্যের শিকার হয় না। এর কারণ—দেশের অনেক মায়েরাই দীর্ঘদিন পর্যন্ত শুধুমাত্র বুকের দুধ খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখেন সন্তানদের। আর তাই এই সময়টাতে মেয়েসন্তানদের খাবারের জন্যে বাড়তি খরচের দরকার হয় না। কিন্তু যখন থেকেই শিশুরা বাইরের খাবার খেতে শুরু করে তখন থেকেই ছেলেশিশুদের তুলনায় মেয়েশিশুদের মধ্যে পুষ্টির অভাব ঘটতে শুরু করে। মেয়েদের প্রতি অবহেলা ও আপামর ভুল শিক্ষার ফলে সাধারণ গরিব পরিবারে তাদের অপেক্ষাকৃত কম ও নিকৃষ্টমানের খাদ্য পরিবেশন করা হয়। এ ছাড়া অসুখবিসুখে তাদের চিকিৎসা, শুশ্রূষা ও বিশ্রামের যথোপযুক্ত ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয় না।
কয়েকটি রাজনৈতিক নীতি ও চিকিৎসাক্ষেত্রে প্রযুক্তির অগ্রগতিও পরোক্ষভাবে মেয়েদের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে কাজ করছে। প্রথমত, চীনে সত্তর দশকে এক সন্তানের বাধ্যবাধকতা সরকারিভাবে অনুমোদিত হয়ে যাবার পর মেয়ে ও ছেলের আনুপাতিক হার আরো কমতে শুরু করে। সদ্যোজাত কন্যা সন্তানকে মেরে ফেলার মতো জঘন্য রীতি প্রাচীনকাল থেকেই এ সমাজে প্রচলিত থাকলেও এই প্রগতির যুগে তা আবার নতুন করে ঘটতে শুরু করেছে চীনদেশে এক সন্তানের নীতি প্রবর্তিত হবার পর থেকেই। বংশরক্ষা ও অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতার জন্যে এ দেশে পুত্রসন্তানের প্রতি পক্ষপাতিত্ব আমাদের দেশের মতোই প্রচলিত। ফলে চীনদেশে বর্তমানে নারী-পুরুষের আনুপাতিক হার ০.৯৪ হবার অন্যতম কারণ শিশুকন্যা নিধন অথবা প্রথম কন্যার জন্মসংবাদ গোপন রেখে দ্বিতীয় সন্তান গ্রহণ। যে-সন্তানের অস্তিত্ব জনসম্মুখে স্বীকার করতেই কুণ্ঠা, সে-সন্তানের পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান সহজেই অনুমেয়। কয়েক বছর আগে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রথম পৃষ্ঠায় বেশ কয়েকটি সংবাদ বেরিয়েছিল চীনের এক সন্তান কর্মসূচি ও মেয়েশিশুদের অবস্থা সম্পর্কে।
বিজ্ঞানের নবতম প্রযুক্তির সাহায্যে আরেকভাবে জন্মের আগেই মেয়ে সন্তানদের বিনষ্ট করা হচ্ছে ইদানীং। এই পদ্ধতিটির বৈজ্ঞানিক নাম এমনিওসিন্টেসিস। এই পরীক্ষার জন্যে গর্ভবতীর পেটের ভেতর মোটা সুঁই ঢুকিয়ে ৩০-৩৫ মিলিমিটার এমনিওটিক ফ্লুইড (গর্ভর্থলির ভেতর যে পানীয়তে শিশু ভেসে বেড়ায়) বের করে আনা হয় সিরিঞ্জ নিয়ে। সেই পানীয়তে ছড়িয়ে থাকে ভ্রূণের শরীর থেকে ছিটকে পড়া জীবকোষ। এই জীবকোষ পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞরা বলে দিতে পারেন অনাগত শিশুটির মারাত্মক জন্মগত কোন অসুখ আছে কি না অথবা তার বিকলাঙ্গ হবার আশঙ্কা রয়েছে কি না। অবশ্য মাত্র কয়েকটি জন্মগত অসুখ বা অসুবিধের সম্ভাবনাই কেবল জানা যায় এ পরীক্ষায়, সার্বিক সুস্থতার নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না। আরো একটি সংবাদ জানা যায় এ পরীক্ষার মাধ্যমে। জানা যায় শিশুটি মেয়ে না ছেলে। শেষের তথ্যটি জানার জন্যে এ পরীক্ষার উদ্ভব হয় নি। প্রথম তথ্যগুলো জানার জন্য যে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করতে হয়, তাতেই অতিরিক্ত সংবাদ হিসেবে এই খবরটি বেরিয়ে আসে। বস্তুত পশ্চিমা দেশগুলোতে শিশুর লিঙ্গ নির্ণয়ের জন্যে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা বেআইনি। মায়ের বয়স ৩৫-এর বেশি হলে (যখন বিকলাঙ্গ অথবা অসুস্থ শিশু জন্মাবার সম্ভাবনা বেশি থাকে) অথবা পারিবারিক ধারা বা মায়ের ঝুঁকিপূর্ণ জীবন যাপনের কারণে অনাগত সন্তানের সুস্থতা সম্পর্কে প্রশ্ন জাগলেই কেবল এ পরীক্ষা করা হয়। অথচ ভারতসহ বেশ কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশে এই পদ্ধতিটি ভুল ও অন্যায়ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে গর্ভের সন্তানটির লিঙ্গ নির্ণয়ের উপায় হিসেবে। নিউইয়র্ক টাইমসের একটি খবর অনুসারে বম্বের ক্লিনিকগুলোতে লাইন ধরে গর্ভবতী মহিলারা দাঁড়িয়ে থাকে এ পরীক্ষা গ্রহণের জন্যে। কোনো কোনো প্রাইভেট ক্লিনিকে নাম লিখিয়ে শত শত মেয়েরা অপেক্ষা করছে তাদের ভবিষ্যৎ সন্তানদের লিঙ্গ জানবার আশায়। আর যখন তারা জানতে পারে গর্ভের সন্তান অনাকাঙ্ক্ষিত কন্যা, তখন তাদের জন্যে সেই ক্লিনিকেই ব্যবস্থা রয়েছে গর্ভপাতের। যথেষ্ট পরিমাণ এমনিওটিক ফ্লুইড জমা না হওয়া পর্যন্ত এ পরীক্ষা যেহেতু করা যায় না, সেহেতু গর্ভের প্রথমাবস্থায় এমনিওসিন্টেসিস করা সম্ভব নয়। যে পর্যায়ে তা করা হয় তখন যদি গর্ভপাত অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে, তাহলে কেবলমাত্র অভিজ্ঞ ডাক্তারের সাহায্যে যথোচিত সতর্কতার সঙ্গেই করা বাঞ্ছনীয়। অন্যথায় গর্ভবতীর জীবনাশঙ্কা দেখা দিতে পারে। অনাগত শিশুটির বিকলাঙ্গ হবার বা বংশগত রোগের শিকার হবার সম্ভাবনা এতই অল্প যে, পশ্চিমের অধিকাংশ গর্ভবতীকেই এ পরীক্ষার পর গর্ভপাত করতে হয় না। অথচ বাঞ্ছিত লিঙ্গের সন্তানের জন্যে উন্নয়নশীল দেশে যারা এ পরীক্ষা করে থাকে, তাদের শতকরা প্রায় পঞ্চাশ ভাগেরই সম্ভাবনা থাকে গর্ভপাতের ঝুঁকি নেবার। সবচেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার হল যে, পরীক্ষাটি মা ও অনাগত সন্তান উভয়ের জন্যেই বেশ খানিকটা ঝুঁকিপূর্ণ; উপরন্তু যা এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোতেও যথেষ্ট খরচসাপেক্ষ, সেই পরীক্ষাটি সরকার কেমন করে এত সহজে এত স্বল্প খরচে সকলের জন্যে ব্যবহৃত হবার সুযোগ দিল, সেটা খুবই রহস্যজনক। পরিবার পরিকল্পনায় উৎসাহ দেওয়াই যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, একবারও কি তারা ভেবে দেখবে না মেয়ে-পুরুষের ভারসাম্য যেখানে ইতোমধ্যেই লঙ্ঘিত এবং মেয়েরা সংখ্যায় এতটা কম, সেখানে এরকম একটি পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বিচারে মেয়ে ভ্রূণের বিনাশ শুধু যে অমানবিক তা-ই নয়, ভবিষ্যতের জন্যেও তা একটি বড় রকম সামাজিক সমস্যার কারণ হতে পারে। (পরবর্তীকালে অবশ্য ভারতে এ প্রযুক্তির যথেচ্ছ ব্যবহারের বিরুদ্ধে আইন পাস হয়েছে।)
মেয়েদের সংখ্যা ছেলেদের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেশ কম এবং তা আরো কমছে। এটা বাস্তব সত্য। কিন্তু এর সমাধান কী? গতানুগতিক মূল্যবোধের পরিবর্তন ও সাংস্কৃতিক বিপ্লব অবশ্যই প্রয়োজন। ছেলেশিশুর প্রতি অহেতুক স্পর্শকাতরতা নিরসনে বাস্তব পদক্ষেপ ও গঠনমূলক নির্দিষ্ট কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা খুবই জরুরি। দেখা গেছে, মেয়েদের আর্থিক স্বাবলম্বী হবার সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের বিষয়ে মানুষের মনোভাবের যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটে। জীবন ও সংসারের মৌলিক ব্যাপারগুলোতে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাও বাড়ে মেয়েদের। ঘরের বাইরে অর্থকরী কাজে নিযুক্ত মেয়েদের সমাজে ও সংসারে সম্মান ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। নিজেদের ও মেয়েসন্তানদের ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে কথা বলার সাহস জাগে এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও তা মেনে নেয়। কেননা একটি অর্থোপার্জনক্ষম মেয়ে তার পরিবারে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়, মেয়েরা পুরুষদের ওপর নির্ভরশীল নয়; পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্য ও সচ্ছলতায় তাদের দায় আছে, করণীয় আছে এবং তা তারা যথোচিতভাবে পালন করছে। অর্থোপার্জন ছাড়াও শিক্ষার বিস্তার এইসব হারানো মেয়েদের সন্ধানলাভে ও তাদের ভবিষ্যতে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে মুক্তি দিতে পারে। এ ছাড়া আইনগতভাবে সম্পত্তির উত্তরাধিকার ও বৈষয়িক মালিকানা অর্জন এবং বিবাহ ও অন্যান্য বিষয়ে মেয়েদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা স্বীকৃত হলেও সমাজ থেকে নারীর প্রতি এ ধরনের অনভিপ্রেত ও বৈষম্যমূলক আচরণ কমতে শুরু করবে। এ সকল ব্যাপারে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করা ও সরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
ড. অমর্ত্য সেন উদাহরণস্বরূপ ভারতের কেরালা রাজ্যের কথা উল্লেখ করেছেন। এই অঞ্চলটি ঊনবিংশ শতাব্দী থেকেই শিক্ষাক্ষেত্রে ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেক এগিয়ে রয়েছে। আজো এই রাজ্যে ওই দেশের সবচেয়ে উঁচুমানের স্কুলশিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। শতকরা ৯০ জনেরও বেশি লোক লেখাপড়া জানে সেখানে। অধিকাংশ মেয়েরা সম্পত্তির ভাগ পায়। মেয়েদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অর্থকরী কাজে নিয়োজিত। ওখানকার স্বাস্থ্য-বিভাগও উন্নতমানের এবং জনসাধারণ ব্যাপকভাবে এর সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। কেরালা যদিও ভারতের অন্য সকল দরিদ্র রাজ্যগুলোর একটি, তবু সরকারি পর্যায়ে এখানে বিভিন্ন জনহিতকর পরিকল্পনা গ্রহণের কারণে এ রাজ্যে সম্ভাব্য জীবনসীমা বর্তমানে মেয়েদের বেলায় ৭৩ বছর ও পুরুষদের বেলায় ৬৭ বছরে উন্নীত হয়েছে, যা ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অনেক বেশি। উল্লেখ্য, কেরালায় মেয়ে ও পুরুষের আনুপাতিক হার আমেরিকা ও ইউরোপের মতো ১.০৪, যদিও সারা ভারতে এই হার গড়ে ০.৯৩। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার তুলনায় মেয়েদের অস্তিত্বের ব্যাপারে কেরালার এই উজ্জ্বলতর অবস্থান এই সত্যই নতুন করে মনে করিয়ে দেয় যে, প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজসচেতনতা ও সুস্থ পরিকল্পনার মাধ্যমে এইসব হারানো মেয়েদের উদ্ধার করা সম্ভব, সম্ভব বঞ্চিত এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে ন্যায্য আলোর মুখ দেখানো। আর মানবজাতির সার্বিক মঙ্গলের জন্যেই তা করা উচিত।