নোবেল-বিজয়ী নারী বিজ্ঞানী
বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, সৃষ্টিশীল রচনা, মানব অধিকার প্রতিষ্ঠা, শান্তি প্রতিস্থাপন কিংবা অর্থনৈতিক তথ্য উদ্ভাবনে মৌলিক অবদানের জন্যে জগৎ জুড়ে সম্মানসূচক যেসকল স্বীকৃতি বা পুরস্কার রয়েছে, তার ভেতর নোবেল পুরস্কার নিঃসন্দেহে সবচেয়ে মূল্যবান ও আদৃত। অবিবাহিত নিঃসন্তান আলফ্রেড নোবেল ডাইনামাইট আবিষ্কারের মাধ্যমে উপার্জিত তাঁর বিপুল অর্থের সবটাই উইল করে রেখে গিয়েছিলেন মানব কল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তি মানুষের উল্লেখযোগ্য, ও মৌলিক অবদানের স্বীকৃতি দেবার জন্যে। পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা, শরীরবিদ্যা অথবা চিকিৎসাশাস্ত্র, সাহিত্য- এবং শান্তি এই পাঁচ বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক ও কল্যাণমূলক কর্ম সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করার জন্যে এই বাৎসরিক পুরস্কার প্রবর্তিত হয় ১৯০১ সাল থেকে। যে পুরস্কার সমস্ত মানবকুলের জন্য অবারিত। কোনো বিশেষ দেশ বা ভৌগিলিক সীমানার মধ্যে তা আবদ্ধিত নয়। শোনা যায় নোবেলের ব্যক্তিগত সহকারী ও বন্ধু অস্ট্রিয়ান নারী বার্টা ফোন স্যুটনারের অনুরোধ এবং আগ্রহেই নোবেল শান্তিতে পুরস্কার প্রবর্তন করেন। ১৯০৩ সালে, অর্থাৎ নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনের তৃতীয় বছরে, বার্টা তাঁর মানব কল্যাণকর বিবিধ কর্ম এবং শান্তির অন্বেষণে গৃহীত নানা ধরনের পদক্ষেপ ও পুস্তক রচনার জন্যে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৬৯ সাল থেকে প্রবর্তিত হয় অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারের ব্যবস্থা। সেন্ট্রাল ব্যাংক অব সুইডেন অর্থনীতিতে পুরস্কার দেবার জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান করে এবং নোবেল কমিটি তা অনুমোদন করে। ফলে অর্থনীতির পুরস্কারটি অন্য পাঁচটি বিষয়ের মতো আক্ষরিক অর্থে নোবেল পুরস্কার নয়—একে বলা হয়, আলফ্রেড নোবেলের স্মরণে অর্থনীতিতে পুরস্কার। কিন্তু সাধারণ অর্থে এবং জগৎ জুড়ে সাধারণ লোকের কাছে অর্থনীতির পুরস্কারটিও আর পাঁচটি নোবেল পুরস্কারের মতোই একইভাবে সমান সম্মানীয় ও আকাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠেছে, এবং সুইডিশ ব্যাংকের অর্থে এই পুরস্কার দেবার ব্যবস্থা করার জন্যে একে এখন আর তেমন আলাদা করে দেখা হয় না। যেহেতু কেবল জীবিত ব্যক্তিদেরই নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়, নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির অন্যতম শর্ত বা আবশ্যিক প্রয়োজনীয়তা হলো অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ জীবন। ব্যক্তিমানুষের অবদান, বিশেষ করে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও সাহিত্যে অবদান, অধিকাংশ সময়েই সময় দ্বারা পরীক্ষিত ও উত্তীর্ণ হতে হয় এর গুণাগুণ, মৌলিকত্ব ও স্থায়িত্ব যাচাই করার জন্যে। অনেক অসাধারণ মেধাবী ব্যক্তি তাঁদের বড় বড় আবিষ্কার বা সৃষ্টির জন্যে নোবেল পুরস্কারে স্বীকৃতি পান নি কেবল স্বল্পায়ু হওয়ার জন্যে। আবার, মানবিক বিবেচনার ভুলে অথবা অবহেলায়ও কখনো কখনো প্রকৃত যোগ্য ও কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিরা বঞ্চিত হয়েছে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হতে। গান্ধী মারা যাবার প্রায় ষাট বছর পর অবশেষে নোবেল কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেছে, কয়েকবার তাঁর নাম বিবেচনায় আসা সত্ত্বেও গান্ধীকে শান্তি পুরস্কার না দিয়ে ভুল করেছে নোবেল কমিটি। গান্ধীর অহিংসা দর্শনের অনুসারী নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং, আং সান সুকি অবশ্য নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। এমন ধরনের ভুল-ভ্রান্তি এবং ঘাটতি রয়েছে প্রায় প্রতিটি বিষয়েই। তা সত্ত্বেও, আজো নোবেল পুরস্কার মানব সমাজের ব্যক্তিমানুষের মৌলিক অবদানের জন্যে সবচেয়ে কাঙ্খিত পুরস্কার ও স্বীকৃতি।
১৯০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ছয়টি বিষয়ে সর্বমোট ৮১৬ টি পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে। এর ভেতর প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের বিশেষ কয়েকটি বছর সহ কোনো কোনো বছর কোনো কোনো বিষয়ে পুরস্কার দেওয়া হয় নি। শান্তিতে বিশটি প্রতিষ্ঠান সহ সকল বিষয় মিলিয়ে যে সর্বমোট ৮১৬ টি পুরস্কার দেয়া হয়েছে,তার মধ্যে মাত্র ৩৬টি পুরস্কার (৪%) পেয়েছে নারীরা।` এর ভেতর মাদাম কুরী, যিনি সর্বপ্রথম নারী নোবেল বিজয়ী, দুবার পুরস্কার লাভ করেন। আর ১৯৭৬ সালে একই শান্তি পুরস্কার লাভ করেন দুইজন নারী- আয়ারল্যান্ডের বেটি উইলিয়ামস ও মেইরিভ কোরিগান।
প্রথম নোবেল পুরস্কার মেরি কুরী তাঁর স্বামী পিয়ের কুরীর সঙ্গে গ্রহণ করেন ১৯০৩ সালে পদার্থ বিদ্যায়। দ্বিতীয়টি পান ১৯১১ সালে রসায়ন বিদ্যায় একাই। মাদাম কুরীর মতো আরো তিন জন নোবেল বিজয়ী দুবার করে নোবেল পুরস্কার পান কিন্তু তাঁরা তিন জনেই পুরুষ। এছাড়া দুটি প্রতিষ্ঠানও–রেডক্রস (তিনবার) ও জাতিসঙ্ঘের শরণার্থীদের জন্যে হাইকমিশন (দুবার), একাধিকবার নোবেল পুরস্কার পায় শান্তিতে। যার ফলে এ পর্যন্ত ৭৮৯ জন ব্যক্তি ও ২০ টি প্রতিষ্ঠান মিলে মোট ৮১৬টি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এর মধ্যে মোট নারীর সংখ্যা কেবল ৩৬ জন। যেহেতু কোনো এক বছরে, কোনো একটি বিষয়ে তিন জনকে পর্যন্ত পুরস্কার দেয়ার রেওয়াজ রয়েছে, পদার্থবিজ্ঞানে মোট ১৮৪ জন পুরস্কার লাভ করেন এ পর্যন্ত। এর মধ্যে নারী নোবেল বিজয়ীর সংখ্যা ২। অর্থাৎ মাত্র শতকরা ১%। রসায়নশাস্ত্রে এ পর্যন্ত ১৫৭ জন পুরস্কার পান এবং নারী বিজয়ীয় সংখ্যা মাত্র ৩ (২%)। চিকিৎসা/শরীরবিদ্যায় মোট নোবেল বিজয়ীর সংখ্যা ১৯২ এবং নারী বিজয়ীর সংখ্যা ৮ (৪%)। সাহিত্যই একমাত্র বিষয় যেখানে দু’বছর ছাড়া প্রতিবারই মাত্র একজনকেই পুরস্কৃত করা হয়। মাত্র দুবার পেয়েছেন দু’জন করে। এ পর্যন্ত ১০৫ জন সাহিত্যে নোবেল বিজয়ীর মধ্যে নারী বিজয়ীর সংখ্যা ১১ (১০%)। শান্তিতে মোট ১২০টি পুরস্কারের (ব্যক্তি ও সংস্থাসহ) মধ্যে নারী বিজয়ীর সংখ্যা ১২ (১০%)। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯৬৯ সাল থেকে দেয়া অর্থনীতিতে আজ পর্যন্ত পুরস্কার পেয়েছেন ৬২ জন এবং এঁরা সকলেই পুরুষ, কোনো নারী এ পর্যন্ত অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান নি।
[১. সর্বমোট ৮১৬টি পুরস্কারের মধ্যে চার ব্যক্তি দুবার করে এবং দুটি প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে দুবার ও তিনবার করে নোবেল অর্জন করেন।
২. ৩৬টি পুরস্কার যা নারীরা পেয়েছেন, তাদের মধ্যে মেরী কুরী একাই দুটি পুরস্কার পান (১৯০৩ ও ১৯১১ সালে)। আবার বেটি উইলিয়ামস ও মেইরিড কোরিগান দু জনে মিলে একটি শান্তি পুরস্কার পান ১৯৭৬ সালে।]
গত দু-তিন দশক ধরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতি লক্ষণীয়। নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ব্যাপারে গত পঁচিশ বছরের পরিসংখ্যান ধরা যাক। এ সময় পদার্থবিদ্যা, রসায়ন কিংবা অর্থনীতিতে কোনো নারী নোবেল পুরস্কার পান নি। এই তিনটি বিষয়ে গত পঁচিশ বছরে একজন নারীও নোবেল পুরস্কার না পেলেও বাকি তিনটি বিষয়ে অর্থাৎ শরীরবিদ্যা/ চিকিৎসাশাস্ত্র, সাহিত্য ও শান্তিতে এই সময়কালে নারীদের নোবেল বিজয়ের আনুপাতিক হার আগের তুলনায় বেড়েছে। শরীরবিদ্যা/ চিকিৎসাশাস্ত্রে এ সময় মোট ৫৭ জন পুরস্কার লাভ করেন এবং এর মধ্যে নারী বিজ্ঞানীর সংখ্যা ৬, অর্থাৎ ১০%। শান্তিতে মোট আটত্রিশটি পুরস্কারের (ব্যক্তি ও সংস্থাসহ) মধ্যে নারী বিজয়ীর সংখ্যা ৫ (অর্থাৎ ১৩%)। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো সাম্প্রতিককালে সাহিত্যে নোবেল প্রাপ্তিতে নারীদের অবস্থান। গত পঁচিশ বছরে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ২৬ জন। এর মধ্যে নারী বিজয়ীর সংখ্যা ৫, অর্থাৎ ১৯%।
এখন কেবল বিজ্ঞানের তিনটি বিষয়ে নোবেল পুরস্কার নিয়ে আলোচনা করা যাক। দেখা যাচ্ছে ১৯৬৪ সালের পর থেকে, অর্থাৎ গত ৪৪ বছরে পদার্থবিজ্ঞানে বা রসায়নশাস্ত্রে কোনো নারী বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পান নি। অর্থাৎ যে সময়টাতে ভৌত বিজ্ঞানে (পদার্থ ও রসায়ন বিজ্ঞান) কোনো নারী নোবেল পুরস্কার পান নি, ঠিক সে সময়টাতেই শরীরবিদ্যা/ চিকিৎসাশাস্ত্রে মোট ছয় জন নোবেল পুরস্কার পান (এই বিষয়ে মোট নারী বিজয়ীর সংখ্যা ৮)।
প্রতিটি নারী নোবেল বিজয়ীর জীবনই যেন একটি যুদ্ধক্ষেত্র। সর্বপ্রথম নারী বিজ্ঞানী মেরী কুরী জীবদ্দশায় পদে পদে কত যে বৈষম্য, বাধা এবং অবহেলার শিকার হয়েছেন, তা বলতে গেলে আজ অবিশ্বাস্য শোনাবে। কিন্তু মেরীর মনোবল, অধ্যবসায় ও আপসহীন সংগ্রামের জন্যে তিনি অবশেষে জয়ী হয়েছেন। শিক্ষক মাতাপিতার সন্তান মেরীর জন্মস্থান পোল্যান্ড থেকে উচ্চ শিক্ষার্থে তিনি ফ্রান্সে আসেন। তারা দুই বোন মিলে ঠিক করেন, পড়াশোনার খরচ যোগাতে একজন যখন পড়বেন, তখন অন্যজন চাকরি করবেন এবং তারপর আবার অন্যজন পড়বেন, এবং এইজন চাকরি করবেন। নোবেল বিজয়ী নারী বিজ্ঞানীদের জীবন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তাদের বিভিন্ন ধরনের বাধা ও নিষেধ উত্তরণ করে বিজ্ঞান সাধনায় জয়ী হতে হয়েছে। প্রথমত বিজ্ঞানে নারীর পড়াশোনা করাটাকেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলে মেনে নেওয়া হতো না বিংশ শতাব্দীর প্রথমাংশ পর্যন্ত ভিক্টোরিয়ান ধারায় বিশ্বাসী পশ্চিমী সমাজেরও এখন ধারণা ছিল, নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য ও সুগৃহিণীর গুণাবলি বিকশিত হবার এমনকি বিবাহে যোগ্যতা অর্জনের ক্ষেত্রেও বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশুনা ও গবেষণা অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। মেয়েদের কাছে তখন সময় ও পুরুষের প্রত্যাশা ছিল অন্যরকম। ভাবা হতো, মেয়েরা হবে নম্র, দুর্বল, অযৌক্তিক এবং আবেগপ্রবণ। কিন্তু নারী বিজ্ঞানীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল ঠিক উল্টো—তারা স্বভাবে চরিত্রে দৃঢ়, সবল এবং যৌক্তিক। ইউরোপে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্তও নারীদের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়াশোনা করা বিশেষ করে বিজ্ঞান চর্চা করা সহজ ছিল না। আমেরিকায় উচ্চ শিক্ষায় ততটা সরাসরি বাধা না থাকলেও বিজ্ঞান পেশায় চাকরি বাকরি করা বিশেষ করে বিজ্ঞান গবেষণার সুযোগ মোটেই ছিল না। বিজ্ঞানে শিক্ষা সমাপ্ত করে নারীদের মেয়েদের স্কুল বা মেয়েদের কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষিকা হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। তখন গবেষণা করতে চাইলে বড়জোর স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বিনা বেতনে, বিশেষ করে স্বামীর গবেষণাগারে কাজ করতে হতো তাদের। মাদাম কুরী, মারিয়া মাইয়ার, গার্টি কোরি, বারবারা ম্যাকক্লিনটক, গাড এলিয়ন-এর মতো নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীদের জীবনের অনেকটা সময়েই বাধ্য হয়ে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ অথবা বিজ্ঞান-অসম্পর্কিত ছোটখাট কাজ করতে হয়েছে— বিনা বেতনে। অথবা স্রেফ বেকার বসে থাকতে হয়েছে ঘরে। তার উপর আমেরিকার ১৯৭২ সালের আগে পর্যপ্ত নিয়ম ছিল, একই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত কোনো পুরুষ শিক্ষক বা কর্মীর স্ত্রীদের সে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে দেয়া হবে না। সেই সময়, অধিকাংশ বিজ্ঞানী নারীর স্বামীই বিজ্ঞানী ছিলেন (আজো আমেরিকায় ৭০% নারী পদার্থবিজ্ঞানীর স্বামীরাও বিজ্ঞানী)। এবং তারা যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চাকরিসূত্রে আবদ্ধ ছিলেন, তাঁদের স্ত্রীরা যোগ্যতায় সমান বা অধিকতর যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সুযোগ পেতেন না। বড় জোর বিনা বেতনে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করার সুযোগ মিলত। ১৯৭২ সালের Federal Equal Opportunity Act পাস হবার পর এ বৈষম্যের কিছুটা অবসান ঘটে। মারিয়া মাইয়ার অথবা পার্টি কোরির মতো নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীদেরও জীবনের অনেকটা সময় পদহীন, সম্মানীবিহীন স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করে যেতে হয়েছে তাঁদের স্বামীদের গবেষণাগারে। স্যান্ড্রা হার্ডিং এসব দেখেশুনে মন্তব্য করেছিলেন, “Women have been more systematically excluded from doing serious science than from performing any other social activity, except, penhaps, frontline warfare.”
নোবেল বিজয়ী বার জন নারী বিজ্ঞানীর জীবনবৃত্তান্ত পর্যালোচনা করলে কতগুলো সাধারণ বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। এই বিজ্ঞানীরা প্রত্যেকেই সাদা এবং তাঁরা হয় আমেরিকান অথবা ইউরোপিয়ান। এঁরা সকলেই হয় খ্রিস্টান অথবা ইহুদি। যদিও মেরি কুরী ও তার কন্যা আইরিন কুরী পরবর্তীকালে নিজেদের নাস্তিক ঘোষণা করেছিলেন। ইহুদি সম্প্রদায় পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.৪% হওয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত সর্বমোট নোবেল বিজয়ীদের মধ্যে এক চতুর্থাংশই ইহুদি সম্প্রদায়ের। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, নারী নোবেল বিজয়ীদের মধ্যেও এর ব্যতিক্রম দেখা যায় না। বারোজন নারী বিজ্ঞানীর (১৩টি পুরস্কার; ১২ জন নারী) মধ্যে চার জনই ইহুদি সম্প্রদায়ভুক্ত (৩৩.৩%)। বারো জন নারী বিজ্ঞানীর মধ্যে জন্মসূত্রে ৪ জন যুক্তরাষ্ট্রের এবং ৮ জন ইউরোপের। কিন্তু নোবেল প্রাপ্তির সময় এই একই বিজ্ঞানীদের ৭ জনের জাতীয়তা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আর ৫ জনের ইউরোপের। অর্থাৎ তিন জন ইউরোপিয়ান নারী বিজ্ঞানী আমেরিকায় চলে এসেছিলেন এবং উন্নততর বিজ্ঞান সাধনার সুযোগ-সুবিধা পেয়েছিলেন যা তাদের পরবর্তীকালে নোবেল অর্জনে সহায়তা করেছে। এই বারো জনের মধ্যে প্রথম ছয় জন বিবাহিত ও জননী। চার জন অবিবাহিত। এক জন ডিভোর্সড। সর্বশেষ জন বিধবা। শেষের ছয় জনের কোনো সন্তান নেই। প্রথম ছয় জন নোবেল বিজ্ঞানী নারীর মধ্যে পাঁচ জনের স্বামী ছিলেন বিজ্ঞানী এবং তিন জন তাঁদের স্বামীর সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। মেরী কুরী, তাঁর কন্যা আইরিন জুলিও-কুরী এবং গার্টি কোরি স্বামীর সঙ্গে নোবেল পুরস্কার পান। সর্ব প্রথম তিনটি নোবেল পুরস্কার যা নারীরা জয় করেন, তার প্রতিটিই আসে কুরী পরিবারে। মাদাম কুরী পদার্থবিদ্যায় ১৯০৩ সালে পান তাঁর স্বামীর সঙ্গে ও ১৯১১ সালে পান একাই রসায়নশাস্ত্রে। এরপরের অর্থাৎ তৃতীয় পুরস্কারটি আসে মেরী কুরীর কন্যা আইরিন জুলিও-কুরী ও তার স্বামী ফ্রেডেরিকের জন্যে ১৯৩৫ সালে।
শুধু নারী বলে নয়, রাজনৈতিক বিশ্বাস কিংবা ধর্মীয় কারণেও অনেক নারী বিজ্ঞানীকে প্রচুর বাধা ও বৈষম্যের ভেতর দিয়ে তাঁদের জীবন ও কাজ চালিয়ে যেতে হয়েছে। আইরিন কুরীর কমিউনিজমের প্রতি অনুরাগ তাঁর অনেক ভোগান্তির ও সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবার জন্যে দায়ী। ১৯৪৮ সালে নোবেল বিজয়ী আইরিন যখন তাঁর মায়ের (দুবার নোবেল বিজয়ী মেরি কুরী) সঙ্গে নিউইয়র্ক আসেন, তাঁকে এলিস আইল্যান্ডে একরাত জেল-বাস করতে হয় যদিও তিনি সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টিতে কখনো যোগ দেন নি, তবে বরাবর ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করেছিলেন। ফ্রান্স সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপে পরদিন সকালে তাকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। ইহুদি হবার কারণে রিতা লেভি মন্তালচিনিকে তার শোবার ঘরে ছোট্ট গবেষণাগার বানিয়ে সবার চোখের আড়ালে নীরবে কাজ করে যেতে হয়েছে ইতালিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। ইহুদি হবার কারণে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় স্থানচ্যুত ও দেশচ্যুত হওয়ায় লিজ মিটনারের মতো বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কার পান নি। লিজ মিটনার তার বাড়ির অন্ধকার বেসমেন্টে প্রথম গবেষণা শুরু করেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নারীদের ক্ষতি করলেও ঘর থেকে বেরিয়ে আসার এবং পড়াশুনা ও কর্মক্ষেত্রে নিজেদের জায়গা করে নেবার যথেষ্ট সুযোগও করে দিয়েছেন। অল্প বয়সী হাজার হাজার তরুণের যুদ্ধে বিনিয়োগ যে শূন্যতার সৃষ্টি করেছিল সর্বত্র, সেই সুযোগে অনেক নারী প্রথম বাইরে বেরিয়ে এসে জীবিকা ও সত্যিকারের পেশায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পান। রোজালিন ইয়ালো নিজেই স্বীকার করেছেন, সাধারণ ইহুদি পরিবার থেকে আসা তার পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা ও পরবর্তীকালে গবেষণার সুযোগ অনেকটাই করে দিয়েছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন তরুণ পুরুষদের শূন্যতা
বিজ্ঞান গবেষণা ও আবিষ্কার অন্য সকল নোবেল পুরস্কারের বিষয় থেকে এইকারণে আলাদা যে অধিকাংশ সময়েই বিজ্ঞান গবেষণা চলে যৌথভাবে বা একটি টিমের মাধ্যমে। ঘরে বসে একা একা সাহিত্য রচনার মতো কাজ এটা নয়। সত্যিকারের এবং উন্নত মানের বৈপ্লবিক বিজ্ঞান সাধনার জন্যে প্রয়োজন একটি সুঠাম, পরিণত এবং এক সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করার মতো একটি দল ও উন্নতমানের গবেষণাগার। যে সকল নারী এ পর্যন্ত বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন দুজন (বারবারা ম্যাকক্লিনটক ও ডরোথি হজকিন) ছাড়া সকলেই পুরস্কারটি পেয়েছেন তাদের সেই কাজের জন্যে যেখানে একজন পুরুষ বৈজ্ঞানিক তাঁদের সঙ্গে কাজ করেছেন যৌথভাবে। এ ব্যাপারেও নারী বিজ্ঞানীরা অনেক সময় অন্যায়ভাবে সমালোচিত ও অবমূল্যায়িত হয়েছেন। অনেকেই লিখেছেন বা মন্তব্য করেছেন এসকল উদ্ভাবন বা আবিষ্কারের জন্য মস্তিষ্কের কাজটা করেছেন পুরুষ বিজ্ঞানীই—নারী বিজ্ঞানীটি শুধু পরিশ্রমের কাজটা করেছেন। কথাটার ভেতর যুক্তি এবং সত্যতা কোনোটাই যে নেই, তার বড় প্রমাণ, মেরি কুরী তাঁর দ্বিতীয় পুরস্কারটি পান একা পিয়ের কুরী মারা যাবার পর। রোজালিন ইয়োলোর পেশাগত সঙ্গী মারা যাবার বেশ কিছু বছর পর তিনি তাঁর কাজের জন্যে নোবেল পুরস্কার পান। তবে তিন স্বামী-স্ত্রী নোবেল বিজয়ী জুটি ছাড়াও অন্তত চার জন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী নারীর কথা জানা যায়, যাঁদের গবেষণার সঙ্গী অন্তত আংশিককালেও তাদের প্রণয়ী ছিলেন। বহুকাল ধরে দীর্ঘ দিনরাত্রি পাশাপাশি একই বিষয়ের ওপর গবেষণা করতে করতে ব্যক্তিগতভাবেও তারা অনেকেই কাছাকাছি চলে আসেন। এদের মধ্যে ডরোথি হজকিন (রসায়ন ১৯৬৪), রোজালিন ইয়ালো (শরীরবিদ্যা/ চিকিৎসা ১৯৭৭), রিতালেভি-মন্ডালচিনি (শরীরবিদ্যা/চিকিৎসা ১৯৮৬) ও ক্রিস্টিয়ানে-নুসলাইনজ ফোলহার্ড (শরীরবিদ্যা/চিকিৎসা ১৯৯৫)-এর নাম উল্লেখযোগ্য।
বিজ্ঞানে মৌলিক অবদান রাখার জন্যে যে পরিমাণ সাধনা, সময় এবং পরিশ্রম ব্যয় করতে হয়, যে ত্যাগ ও তিতিক্ষার পরিচয় দিতে হয়, তা অনেক নারীর পক্ষেই সম্ভব হয় না বাস্তব কারণে। কেননা সন্তানের জন্ম দেয়া শুধু নয়,– স্বামী, সন্তান এবং সংসারের দেখাশুনাও তাদেরই করতে হয় যা পুরুষ বিজ্ঞানীদের জন্যে প্রযোজ্য হয় না। ফলে যেই সময়টাতে একজন নারী বিজ্ঞানী সবচেয়ে বেশী কর্মক্ষম এবং সৃজনশীল, তখনই তাকে সন্তান ধারণ ও প্রতিপালন করতে হয়। অর্থাৎ বিজ্ঞান গবেষণার ঘড়িটি, তার জৈব ঘড়ির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ফলে উচ্চতর বিজ্ঞান সাধনার পূর্বশর্ত যে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পেশাগত সাফল্য ও স্থায়ীভাবে উচ্চমানের পদলাভ, তা অনেক নারীরই ভাগ্যে জোটে না। সামাজিক বৈষম্য এবং জৈবিক দায়িত্ব পালন দুটোই দায়ী এজন্যে। স্টিফেন ব্রাস যিনি বিজ্ঞানের ইতিহাসের অধ্যাপক তিনি ঠিকই বলেছিলেন— “By the time a woman lands an assistant professorship, she is likely to be in her late twenties or early thirties. She then has five or six years to turn lands enough first-rate publications to gain tenure. It she has children, she must fulfill her family obligations while competing against other scientists who work at best six hours a week. It she postpones childbearing, the biological clock will run out at about the same time as the tenure clock.”
জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো বিজ্ঞান গবেষণায়ও নারীকে বরাবর এভাবে ছোটাছুটি করতে হয় ঘর ও বাহির দুটোই ঠিক রাখার জন্যে। একটা জিনিস লক্ষ্য করলে চমৎকৃত হতে হয় যে বারো জন বিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ীর ভেতর প্রথম ছয় জন বিবাহিত এবং সন্তানের জননী। শেষ ছয় জনের মধ্যে চার জন কখনো বিয়ে করেন নি। একজন স্বল্পকালীন সময়ে বিবাহিত ছিলেন এবং পরবর্তীকালে ডিভোর্স করেছেন এবং সর্বশেষ বিজ্ঞানী বিধবা। শেষ ছয় জনের কারোরই সন্তান নেই। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক হবে যদি বিজ্ঞান সাধনায় উৎকর্ষ লাভ করার পূর্বশর্ত হয় নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিবাহ ও সন্তানলাভের আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করা। কোনো নারীকেই কোনো ব্যাপারে এ ধরনের কঠিন বিকল্পের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া ঠিক নয়। তবে দেখা যাচ্ছে, নারী যত অধিকার সচেতন হচ্ছে, যতই আইনগতভাবে তার অবস্থানের স্বীকৃতি পাচ্ছে, ততই কোনো কোনো ক্ষেত্রে—বিশেষ করে বিজ্ঞান গবেষণার মতো পেশাগত জীবনে উপরের পর্যায়ে একা হয়ে পড়ছে। গত বিয়াল্লিশ বছরে ভৌত বিজ্ঞানে কোনো নারী যে নোবেল পুরস্কার পান নি তার অন্যতম কারণ হতে পারে পুরুষ-প্রধান ও বিষয়গুলোতে নিজেদের স্থান করে নেবার জন্যে বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে নারীরা যে বৈষম্য, যে নিপীড়ন, যে অবহেলা ও অবমূল্যায়ন সহ্য করেও মুখ বুজে বিজ্ঞান সাধনা করে গেছেন, আজকের যুগে নারীরা তা করবেন না। তাদের অধিকার সচেতনতা, সমমানের-সমআয়তনের গবেষণাগারের সুযোগসুবিধার চাহিদা, সমবেতন ও সমপর্যায়ের চাকরির নিশ্চয়তার দাবি তাঁদের অন্য সকল দুরবস্থা ভুলে নিবিষ্ট মনে একত্রে বিজ্ঞান গবেষণায় মনোনিবেশ করার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকের নারী চায় একজন পরিপূর্ণ মানুষ হতে– সমঅধিকার ও সম্মানের সঙ্গে জীবন কাটাতে, কেবল বিজ্ঞানী, বা কেবল মা বা গৃহিণী হতে নয়। তবে আমার প্রশ্নের জবাবে চিকিৎসাবিদ্যায় সদ্য নোবেল বিজয়ী ফ্রাঁসোয়া বারে-সিনোসি যা বলেছেন, তার সঙ্গে আমি একমত এবং আশাবাদী। তিনি বলেছেন— “Since the last decade, there is clearly an evolution regarding women’s recognition in science globally, and in our society. Thus, I would not be surprised to see more and more women Nobel Laureates in the future.”
এছাড়া আজকাল কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি উদ্যোগ নিয়েছে, নারীর চিরন্তন ছন্দ নিরসনের মাধ্যমে তাঁর বিজ্ঞান সাধনায় সহযোগিতা করতে। নোবেল বিজয়ী জার্মান বিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ানে নুস্লাইন্ ফোলহার্ড তাঁর নোবেল পুরস্কারের অর্থ দিয়ে তৈরি করেছেন এক ফান্ড যা অল্পবয়সী মেধাবী নারী বিজ্ঞানীদের গর্ভধারণ ও শিশু সন্তান প্রতিপালনের সময় কর্মক্ষেত্র থেকে দীর্ঘদিনের জন্যে বিরতি নেবার বদলে তাদের সাংসারিক কাজে সাহায্যকারীর অর্থ যোগান দেবে। অথবা তাদের ঘরে বসে কাজ করতে কিংবা কিছুটা সময় ঘরে থেকে কিছুটা গবেষণাগারে থেকে মাতা এবং গবেষক দুটো ভূমিকা পালন করারই সুযোগ দেবে। একইরকম ভাবে, ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালেও অল্প বয়সী মায়েরা যারা বিজ্ঞান গবেষণায় নিয়োজিত, তাদের জন্যে একটা ফান্ড তৈরি করেছে, যাতে এই মায়েদের সন্তান ধারণ প্রতিপালনের জন্যে সাময়িক অনুপস্থিতির সময়টাতে তাদের গবেষণার কাজ চালিয়ে নেয়া সম্ভব হয় এবং যাতে তারা অনায়াসে স্বস্থানে ফিরে আসতে পারে আবার। ঠিক একইরকম আরেকটি ফান্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে রকেফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ে নোবেল বিজয়ী পল গ্রীনগার্ডের নোবেল পুরস্কারের অর্থ দিয়ে। পল গ্রীনগার্ডকে জন্ম দিতে গিয়ে তার মা মারা গিয়েছিলেন। তাই তিনি তাঁর মায়ের নামে এই ফাউন্ডেশন করেছেন যাতে নারী বিজ্ঞানীরা তাদের জৈব ভূমিকা পরিত্যাগ না করেও বিজ্ঞান গবেষণা চালিয়ে যেতে পারেন। এ ধরনের সুযোগ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে এটাই আশা ও কামনা আর তা যদি হয়, ভবিষ্যতে আমরা আরও অনেক নোবেল বিজয়ী নারী বিজ্ঞানীর যুগান্তকারী আবিষ্কারে আলোকিত ও সমৃদ্ধশালী হব।