নারী ও সংখ্যালঘু
শুধুই মুসলমান
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর তিরানব্বইয়ের গোড়ার দিকে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান থেকে নিউইয়র্কে আগত ও বসবাসরত কিছু লোক (আমাদের মতো দু- একজন ছাড়া যারা প্রায় সকলেই বয়সে তরুণ) একটি সংগঠন তৈরি করেছিল। নাম Concerned South Asians ।
সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সচেতনতা তৈরি ও অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা ও বিকাশই মূল উদ্দেশ্য। এই সংগঠন আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে (নিউইয়র্কে) অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেছেন ভারতের আসগর আলি ইঞ্জিনিয়ার ও শাবানা আজমি। জ্যাকসন হাইটসের একটি রেস্টুরেন্টে এক বাসন্তী সন্ধ্যায় আয়োজিত অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে সম্পূর্ণ কালো কাপড়ে আচ্ছাদিত শাবানার একটি উক্তি আজও আমার মনে গেঁথে আছে। বলেছিলেন, ‘বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও পরবর্তীকালের দাঙ্গার সবচেয়ে বড় কুফল আমার জীবনে এই যে, এক সময় আমার একই সঙ্গে যে অনেকগুলো পরিচয় ছিল যেমন আমি একাধারে একজন সচেতন ভারতীয় নাগরিক, একজন আধুনিক নারী, একজন ফেমিনিস্ট, অভিনেত্রী, একজন সমাজসেবক, একজন এক্টিভিস্ট, একজন মুসলমান— আমার সেইসব পরিচয় রাতারাতি মুছে গিয়ে শুধু একটি পরিচয়ই অবশিষ্ট রইল আর সেটা হল আমি একজন মুসলমান। অথচ আজও আমাদের বাড়িতে আমরা উদ্দীপনা নিয়ে দেওয়ালি ও ঈদ উদযাপন করি।
শুধুই মেয়েমানুষ
একটি শিক্ষিত, কর্মজীবী, স্বাবলম্বী তরুণী ব্যক্তিগত জীবনে যে কারওর কন্যা, কারওর প্রেমিকা বা স্ত্রী বা ভগিনী, পথ চলতে গিয়ে অথবা কর্মস্থলে কিংবা একা ঘরে বা জঙ্গলে যখন কোনও অবিবেচক, কামুক অথবা মারাত্মক অপরাধীর দ্বারা ধর্ষিত হয়, তখন তার সমস্ত পরিচয় নিমেষে মুছে গিয়ে একটি পরিচয়ই বড় হয়ে ওঠে। আর সেটা হল সে একটি ‘মেয়েমানুষ’। অন্য পক্ষে সেই মেয়েটি হতেও পারে অশিক্ষিত, গ্রাম্য অথবা শহুরে; হতে পারে সে গৃহবধূ বা অবিবাহিত বালিকা; কিছু আসে যায় না তাতে। তার প্রতি সংঘটিত নির্যাতন, ধর্ষণের পরিবর্তে অ্যাসিড নিক্ষেপ, মারাত্মক মারধর অথবা গলা টিপে হত্যাও হতে পারে যদি না কারও শারীরিক ক্ষুধা অথবা যৌতুকের লোভ মেটাতে সমর্থ হয় মেয়েটি। তখনও তার আর অন্য কোনও পরিচয় থাকে না। সে শুধুই মেয়েমানুষ।
ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও নারীসমাজ
এ উপমহাদেশে বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বাদ দিলে আর যে দুটো উল্লেখযোগ্য মানব সম্প্রদায় সবচেয়ে নিপীড়িত, সবচেয়ে অসহায়, সামাজিক সকল কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকা সত্ত্বেও সবচেয়ে অবহেলিত, তারা নিঃসন্দেহে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও নারীসমাজ। আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রাপ্য বা ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনে উভয় সম্প্রদায়ই যথেষ্ট তৎপর। তবে সংখ্যায় পর্যাপ্ত হওয়ায় এবং রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ের কাঠামোগত কিছু সুযোগ-সুবিধার কারণে গত দু-দশকে নারী আন্দোলন যতটা বেগবান হতে পেরেছে, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী অথবা সংখ্যালঘু অধিকারের আন্দোলন ততটা এগিয়ে যেতে পারেনি। এ দেশের এনজিওসমূহও নারীর অধিকারসচেতনতা ও ক্ষমতায়নে বিগত দু যুগে অনেকটাই প্রভাব ফেলেছে; কিন্তু অসাম্প্রদায়িকতার আন্দোলনে ততটা পারেনি।
একটু গভীরভাবে ভাবতে গেলে দেখা যাবে অন্তত চারটি মৌলিক ব্যাপারে এই দুটি অবহেলিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে যথেষ্ট মিল রয়েছে।
১. নারী ও সংখ্যালঘু উভয়েই মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু, যার মূলে রয়েছে কোনও ধর্মীয় উপাদান, ধর্মের অপব্যাখ্যা, অথবা শিক্ষার অভাব।
২. সংখ্যালঘু ও নারী উভয়েই সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার; সমঅধিকার ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত।
৩. কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণত সংখ্যালঘু ও নারী, প্রবলভাবে প্ররোচিত না হলে, হিংসাত্মক ও বিধ্বংসী কাজে, দাঙ্গায়, হত্যায়, নিপীড়নে অংশগ্রহণ করে না। তারা মূলত শান্তিপ্রিয় ও সহাবস্থানে বিশ্বাসী।
৪. অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ বা জিঘাংসা প্রকাশে, বিশেষত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা আক্রমণের লক্ষ্য হলেও এরই ভেতর সেই ধর্মের নারী আবার বিশেষভাবে টার্গেট।
নারী নেতৃত্ব ও নারীর অবস্থা
ভারত উপমহাদেশের মতো সর্বোচ্চ পর্যায়ে নারী নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত পৃথিবীর যে- কোনও অঞ্চলে বিরল। ইন্দিরা গান্ধী, সোনিয়া গান্ধী, শ্রীমাভো বন্দরনায়েক, বেনজির ভুট্টো, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা, চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা—এঁরা সকলেই আমাদের স্মরণকালের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। শুধু রাজনৈতিক দলের নেত্রীই নন বা ছিলেন না তাঁরা, রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন অথবা আছেন। বাংলাদেশের মতো দেশেও বর্তমানে নারী প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও সর্বজনশ্রদ্ধেয়া এককালের অগ্নিকন্যাসহ একাধিক অত্যন্ত শক্তিশালী নারী মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন ও হচ্ছেন। এসব সত্ত্বেও এই অঞ্চলের নারীর অবস্থান বিশ্বের নারীকূলের মধ্যে নিকৃষ্টতম পর্যায়ে। এরাই সবচেয়ে বেশি বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার (পরিসংখ্যান দিয়ে এ সত্যকে প্রতিষ্ঠিত বা মজবুত করারও আর প্রয়োজন হয় না)। “দক্ষিণ এশিয়ার মানব উন্নয়ন ‘৯৭-এর তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আজ তাই অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে, যে দেশে একজন মহিলা রাজনৈতিক নেতা ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছেন, কেমন করে সেখানকার অধিকাংশ নারী একেবারে প্রান্তিকীকরণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে? তা হলে এই তথ্য এটাই প্রমাণ করে যে ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলে এইসব নারীনেত্রীরা তাঁদের নিজস্ব গোষ্ঠীর বিশেষ দুরবস্থার কথা আর পৃথকভাবে ভেবে দেখার সুযোগ পান না। তখন এই নারী নেতৃত্ব কি আসলে পুরুষ সংস্কৃতির প্রতিভূ হয়ে ওঠে? তা না হলে বাংলাদেশের আজকের নারী নির্যাতনের হার ও মাত্রা এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছোবার পরও কেমন করে আমাদের নারী-মন্ত্রী, নারী-সংসদ সদস্যদের মধ্যে অন্তত একজনও এই বিশেষ ইস্যুগুলো নিয়ে চরম তোলপাড় করছেন না। এটা করলে কি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে অথবা তাঁদের বিশেষ পোর্টফোলিওর কাজের সঙ্গে কোনও বিরোধ বাধত? অন্তত সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াসেও তাঁরা বছরের বিশেষ বিশেষ দিনের জনসভাগুলোতে এইসব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারতেন। তাও করেন না তাঁরা। অথচ এ সরকার, শোনা যায়, জবাবদিহিতার সরকার। যে সত্য ও তথ্য সর্বজনবিদিত, যা ঐতিহাসিক সূত্রে পাওয়া, তার অস্তিত্ব মেনে নিয়ে, তার দায়ভার গ্রহণ করে কিছু শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার ঝুঁকি কেন তা হলে তারা নিতে পারছেন না?
স্থানীয় সরকার গঠনে ‘বাধ্যতামূলক মহিলাদের অংশগ্রহণের ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে একটি শুভ পদক্ষেপ। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও তারা একটি সার্বভৌম দেশে সকল নাগরিকের জন্যে প্রযোজ্য ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড চালু করার সাহস পাচ্ছেন না আজও। নারী ধর্ষণ এবং নারী ও শিশু পাচারের বিরুদ্ধে কঠিন আইন প্রণয়নই যথেষ্ট নয়। প্রশাসনিক ও বিচার বিভাগীয় দুর্নীতি, ত্রুটি ও জটিলতা এড়ানোর ব্যাপারে সরকারের আরও সরাসরি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। প্রয়োজন নারীর নিরাপত্তা (বিশেষত গার্মেন্টসকর্মী ও গৃহপরিচারিকাদের) ও স্বাস্থ্যসেবার (বিশেষত গর্ভবতী ও স্তন্যদায়ী নারীদের) নিশ্চয়তা বিধানে সত্ত্বর কিছু কর্মসূচি গ্রহণ
নারী সংস্থাগুলোও নারীদের জন্যে, বাস্তব ও গঠনমূলক কাজ কতখানি করছে— আর কতটা করছে নিজেদের প্রচার ও সুনামের জন্যে সেটা বলা শক্ত। বিরানব্বইয়ের ডিসেম্বরে ধর্মীয় গোলযোগে নারী ধর্ষণের প্রতিবাদে মহিলা পরিষদ একটি প্রতিবাদ মিছিল বের করবে কি করবে না সে সিদ্ধান্ত নিতে নেত্রীগণের এত বেশি তর্ক-যুক্তি ও বৈঠকের প্রয়োজন হয়েছিল যে, শেষ পর্যন্ত সেই মিছিল আদৌ বের হয়েছিল কি হয়নি, আমি আজও মনে করতে পারি না। আর একটি ঘটনা। অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের পুনর্বাসনে নিবেদিত একটি নারী সংস্থার শীর্ষনেত্রীর সঙ্গে একবার কথা বলেছিলাম। আমার পরিচিত এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা একটি অ্যাসিডদগ্ধ নারীর সামগ্রিক চিকিৎসা (প্রয়োজনে বিদেশে গিয়ে প্লাস্টিক সার্জারিসহ) ও পুনর্বাসনের সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করতে চেয়েছিলেন—পুরোপুরি গোপনে ও বেনামিতে। ওই নারী সংস্থাই মেয়েটিকে বেছে নেবে এবং তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। প্রায় ডজনখানেক ফোন নম্বর ও নাম দেওয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত সেই নারীনেত্রী এ ব্যাপারে কোনও যোগাযোগ করেননি। হয়তো অ্যাসিডদগ্ধ মেয়েটি তার সুস্থতা ও চেহারা ফিরে পেলেও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের টাকার গন্ধে মূর্ছা যেত এ ভয়েই এটা করা হয়নি। এ ছাড়া এই আচরণের অন্য কোনও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।
বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের অসাম্প্রদায়িকতার চালচিত্র
অসাম্প্রদায়িকতার আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী আমাদের উপমহাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ (মূলত পুরুষ লেখক, সাংবাদিক, পেশাজীবী) রয়েছেন আরেক চরম অবস্থানে। তাঁদের বক্তৃতায়, লেখায়, স্লোগানে কতগুলো শব্দের (জার্গন) এবং বাক্যের পুনঃ পুনঃ ও জোরালো ব্যবহারে আর সেইসঙ্গে কার্যত বা ব্যবহারিক জীবনে সেসব কোনও কিছু প্রতিফলন না ঘটাবার কারণে, এ সকল শব্দাবলী এতটাই গুরুত্ব ও ব্যঞ্জনা হারিয়ে ফেলেছে যে, আজকাল অনেক প্রগতিশীল লোকও এ গালভরা ‘মৌলবাদ’ ও ‘সাম্প্রদায়িকতা’র বিরুদ্ধে কথা শুনতে কেমন অস্বস্তি ও বিরক্তি বোধ করেন। আসলে ‘সাম্প্রদায়িক’ ও “নারী প্রগতি”র কথা বলা অনেকটা আধুনিক যুগের পোশাক ও চুলের সর্বশেষ ফ্যাশানের মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরকম কিছু বাক্যাবলি না বললে আধুনিক ও শহুরে জীবনে— সাংস্কৃতিক অঙ্গনে গৃহিত হওয়ার সম্ভাবনা বুঝি কমে যায়। কিন্তু মুখে বা লেখায় প্রকাশিত এ সকল শব্দের প্রকৃত স্বরূপ, তাদের ব্যাপকত্ব, এইসব ব্যবহৃত শব্দাবলীর নির্মম শিকারদের আসল দুরবস্থা উপলব্ধি করার প্রয়োজনও কেউ বোধ করে না।
আমাদের দেশের কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও অন্য বুদ্ধিজীবীরা বক্তৃতা ছাড়া মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও নারী স্বাধীনতার ব্যাপারে যদি প্রকৃতই কিছু করে থাকেন তার প্রায় সবটাই সীমিত উঁচু পর্যায়ের পরিশীলিত সংস্কৃতির বিকাশে; যেমন চারুকলায়, নৃত্যে, সঙ্গীতে, সুবেশ এবং সুন্দর প্রসাধনে সজ্জিত নারীর নান্দনিক উপস্থাপনায়, প্রদীপে, আল্পনায়, আনুষ্ঠানিকতায়, আর তাদের প্রকাশিত রচনাসম্ভারে, পুস্তকে, ক্যাসেটে, রেডিও, টেলিভিশনে। ব্যবহারিক দিক দিয়ে, দৈনন্দিন জীবনচর্চায়, সার্বক্ষণিক জীবনযুদ্ধে তার প্রতিফলন একেবারেই ঘটছে না। স্বীকার করি লেখক-কবিরা সমাজসংস্কারক নন। সমাজের অসামাঞ্জস্য, বৈপরীত্য, সমস্যা ও অন্যায়গুলোই কেবল তারা তুলে ধরবেন। এর সমাধান আনবে অন্যজনেরা। কিন্তু তারা কারা?
অপর দিকে বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও এবং বাংলাদেশের মতো দেশের মোট জনসংখ্যা এক-অষ্টমাংশের বেশি হওয়া সত্ত্বেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্য থেকে একাধিক পূর্ণমন্ত্রী নেই, নেই কোনও রাষ্ট্রদূত পৃথিবীর কোথাও। যেখানে জনৈক সংখ্যালঘু আধামন্ত্রীকেও তার আসন সুরক্ষিত রাখার জন্যেই হয়তো অনর্থক জোরেজোরে প্রচার করতে হয় (এমনকী ঘরোয়া বৈঠকেও), বাংলাদেশের কোথাও সাম্প্রদায়িকতার কোনও অস্তিত্ব নেই, সেখানে সরকারের কাছে সংখ্যালঘুরা খুব বেশি কিছু আশা করতে পারে না। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের এক সময়কার প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী মন্ত্রীও এখন ধর্মের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আপসকামী— বিশেষ করে সাম্প্রদায়িকতার উৎখাতে। সংবিধানের বেশ কিছু অশুভ সংযোজন ও পরিবর্তন বাতিল করার জন্যে জাতীয় সংসদে ও মন্ত্রণালয়ে তাঁরা যথেষ্ট তৎপর থেকে সফল হলেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক পরিবর্তনের ব্যাপারে, যেমন ধর্মনিরপেক্ষতার পুনর্বাসনে, রাষ্ট্রধর্ম ও শত্রু সম্পত্তি আইন বাতিলের প্রসঙ্গে অথবা সরকারি নিয়োগের জন্যে সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন ও কার্যকর করার ক্ষেত্রে, তেমন উৎসাহ দেখান না। ফলে বিকল্প পথের অনুসন্ধান একান্তই জরুরি হয়ে পড়েছে।
অসাম্প্রদায়িকতা চর্চা ও নারী আন্দোলন : যৌথ প্ৰয়াস
উপরে উল্লিখিত বিভিন্ন বিষয় বিবেচনা করলে এমন একটা ধারণা করা যায় যে, নারী আন্দোলন ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনকে যদি একত্রিত করে যোগ্য নেতৃত্বের হাতে ছেড়ে দেওয়া যেত, এ আন্দোলন আরও বেগবান, আরও ফলপ্রসূ হত। হয়তো এই অবহেলিত দুটি সম্প্রদায়েরই শুভ কিছু ঘটতে পারত—পারত তাদের অবস্থার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটাতে। এ কাজটি করা দরকার কেবল নারী ও সংখ্যালঘু স্বার্থে নয়, দেশের স্বার্থে–আপামর জনসাধারণের স্বার্থে— উপমহাদেশের অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের স্বার্থে! কিন্তু কারা নিতে পারে এ দায়িত্ব? তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন সচেতন নাগরিক, যারা এই দু- সম্প্রদায়ের প্রতি বৈষম্য ও অবিচারে প্রকৃতই সমব্যথী এবং এর প্রতিকারে গঠনমূলক ও বাস্তব কর্মসূচি গ্রহণে পুরোপুরি সৎ, নিবেদিত এবং তৎপর। এর জন্যে যে পরিমাণ চিন্তা, সময় ও পরিশ্রম দেওয়া দরকার, যে তৃণমূল পর্যায়ে এর কার্যক্রম শুরু করা প্রয়োজন, যে মৌলিক তথ্যসমূহ ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া জরুরি, তার জন্য চাই শুধু কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নয়-ভালো নেটওয়ার্কিংসহ এক বা একাধিক জনহিতকর সংস্থার অবদান। আমরা লক্ষ করেছি গতানুগতিক নারী সংগঠনসমূহ, বুদ্ধিজীবীবৃন্দ, রাজনীতিবিদগণ এবং সরকার এই দুটি সমস্যার ব্যাপারেই “ধরি মাছ না ছুঁই পানি” নীতিমালা মেনে চলেছেন। ফলে এর জন্যে তৃতীয় ধারার নেতৃত্ব খুঁজে বের করতে হবে—যাতে দুটো সমস্যাকেই একসঙ্গে মোকাবিলা করা যায়। তৃণমূল পর্যায়ে বাস্তব কর্মসূচির মধ্যে থাকবে :
১. নারীর ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার সঙ্গে তাদের মূল্যবোধে এই বিশ্বাস জাগ্রত করা যে, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে শুধু অন্য ধর্মাবলম্বীকেই নয়, নারীর সামগ্রিক উন্নয়ন, নারীর স্বার্থও খাটো করে দেখা হচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতাজনিত সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার পরিণামে নারীই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্ৰস্ত।
২. নারী ও সংখ্যালঘুদের উদ্দেশ্য করে নিন্দার্থে এবং তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উচ্চারিত ‘মেয়েমানুষ’ বা ‘মালাউন’ জাতীয় কিছু শব্দাবলীকে পুরোপুরি অকেজো ও গুরুত্বহীন করে দেওয়ার একমাত্র উপায় এগুলোর ব্যাপারে অতিরিক্ত স্পর্শকাতরতা কাটিয়ে ওঠা। শওকত ওসমান দারুণ একটা ভালো ও সাহসী কাজ করেছেন রণেশ দাশগুপ্তের মতো “মালাউন” হতে চেয়ে। এভাবেই জনসম্মুখে এগুলোর অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়ে, প্রয়োজনে পরস্পরকে এমনকী নিজেদেরকে ওইসব শব্দে সম্বোধন করে এগুলো সম্পর্কে সকলকে পরিপূর্ণভাবে স্পর্শকাতরতাহীন করে দিতে হবে। এর ফলে কাউকে তুচ্ছ বা অপমান করার জন্যে আড়ালে-আবডালে ওগুলো বলে কেউ আর বিজাতীয় আনন্দ পাবে না—অন্যের মনকে কলুষিত করতে উৎসাহ বোধ করবে না। পুরোপুরি ‘ডিমিস্টিফাইড’ হয়ে যাবে শব্দগুলো।
৩. সন্তান পালনে এ উপমহাদেশে আজও যেহেতু মায়ের ভূমিকার বিকল্প নেই, মায়ের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক ও আধুনিক মূল্যবোধের যোজনা ভবিষ্যৎ নাগরিকের মানসিক বিকাশ ও জীবনবিশ্বাসে প্রতিফলিত হবে বলে আশা করা যায়।
৪. নারীরা দাঙ্গাতে প্রায় কখনওই অংশগ্রহণ করে না। কিন্তু দাঙ্গা প্রতিরোধেও তারা তেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয় না। সাম্প্রদায়িকতাকে যদি নারীসমাজ পুরুষতান্ত্রিক শোষণেরই একটি প্রকাশ বলে মেনে নিতে পারেন, তা হলে সাম্প্রদায়িক বৈষম্য ও দাঙ্গার সময় তারা আরও গঠনমূলক কর্মসূচি, এমনকী দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন।
৫. আর মেয়েরা যদি নিজেরা অর্থোপার্জনে সক্ষম হন, স্বাবলম্বী হন, তা হলে তাদের স্বামী, পিতা বা পুত্রকে সংখ্যালঘুর সম্পত্তি জবরদখলের মাধ্যমে সহজ পদ্ধতিতে রাতারাতি ধনী হওয়ার লোভ সংবরণ করতেও বাধা দিতে পারেন। সৎভাবে পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থে জীবনকে সুন্দরতর করার স্পৃহা, যদি একবার দানা বাঁধে নারীকুলে, সেইসঙ্গে যদি তাদের চোখে সমাজের বাস্তব জলছবিটা পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়, তা হলে তারা সংখ্যালঘুর সম্পত্তি বা নারীর প্রতি পুরুষদের লোলুপ দৃষ্টিকে নিজেরাই প্রতিহত করার চেষ্টা করবেন।
৬. অন্যদিকে সংখ্যালঘু সমাজও যদি উপলব্ধি করে সংখ্যায় লঘু না হওয়া নারীরাও তাদের মতোই বঞ্চিত, শোষিত ও নির্যাতিত, তা হলে তাদেরও আর আগের মতো নিজেদেরকে একমাত্র অসহায় ও সমাজচ্যুত সম্প্রদায় বলে মনে হবে না। একত্রে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শরিক হওয়ার সদিচ্ছা জাগবে তাদের মধ্যেও। আরও বেশি সম্পৃক্ত হবে তারা জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে।
কিছুসংখ্যক কর্মঠ ও এই বিশেষ যৌথসংগ্রামে নিবেদিত নারী ও সংখ্যালঘু নারীদের নিয়ে (বিশেষ করে শাবানা আজমীর মতো সাহসী, সৎ ও দেশপ্রেমিক সংখ্যালঘু নারীদের নিয়ে) প্রথমে নিজের নিজের দেশে এবং পরে আঞ্চলিক পর্যায়ে একটি ফোরাম গঠন করতে হবে। এই ফোরাম প্রথমে পারস্পরিক মতবিনিময়ের মাধ্যমে এই অঞ্চলের নারী ও সংখ্যালঘুদের প্রধান প্রধান সমস্যা চিহ্নিত করবে, তারপর তার জন্যে আশু ও দীর্ঘমেয়াদি কিছু বাস্তব কর্মসূচি গ্রহণ করবে। এ পর্যায়ে কিছু বিশেষজ্ঞ ও সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের নীতিনির্ধারকের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু মূল সমস্যা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের অর্থাৎ নারী ও সংখ্যালঘুদের অভিজ্ঞতাকেই সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হবে—তারাই পারবে সমস্যার গভীরতা, প্রকার, ব্যাপ্তি এবং সূক্ষ্ম বঞ্চনার দিকগুলো উন্মোচন করতে। বেসরকারি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত করবে তারাই। অন্যথায় এ প্রচেষ্টা আবারও বুদ্ধিজীবীদের একাডেমিক এক্সারসাইজই হয়ে পড়বে।
কয়েকশো বছর ধরে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে পুরুষরা। সাম্প্রদায়িকতা উৎখাতের পরিবর্তে তাকে আরও জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠাই করেছে এ উপমহাদেশে। সাম্প্রদায়িকতার মুখ্য বলি নারীসমাজ যদি এর নেতৃত্ব কাঁধে নেয়, হতেও পারে একদিন শাবানা আজমী আবার তার মুসলমান পরিচয় ছাড়াও অন্য সকল পরিচয় ফিরে পাবেন— যে পরিচয়গুলো তিনি চেষ্টা করে, পরিশ্রম করে, শিক্ষা ও অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জন করেছেন— নেহাত প্রাকৃতিক কারণে উত্তরাধিকারী হননি। আমরা সে আশাই করব।