ভালোবাসার রসায়ন
প্রেম ও মানববন্ধনের জৈবিক ভিত্তি
বুক ধড়ফড়। গলা শুকনো। চোখে বাষ্প। হাতের তালু ভেজা ভেজা। উষ্ণ ও দ্রুত নিশ্বাসপ্রশ্বাস। শরীরে উত্তাপ। আসন্ন প্রিয়সান্নিধ্যের সম্ভাবনায় উত্তেজিত, উল্লসিত, আলোকিত হৃদয়। যেন বিশাল সমুদ্র আছড়ে পড়ছে পাড়ে অথবা প্রচণ্ড তেজে ঘটছে ক্রমাগত জলপ্রপাতের পতন। যে মানুষ কখনো গান গায় না, সে হঠাৎ করে গুনগুন করে গান গেয়ে ওঠে অমৃতা প্রীতমের গল্পের অঙ্গুরীর মতো। যে লোক কখনো কবিতা পড়ে না, তার কণ্ঠে বিশেষ বিশেষ পঙ্ক্তির আবৃত্তি অথবা আড়ালে দু’চার লাইন কবিতা লেখা। উন্মনা চিত্ত। ফাঁকা দৃষ্টি। মনের ভেতর অস্থির দোলা। এলোমেলো পায়চারি। সাক্ষাতে জাদুর উন্মাদনা, স্মরণে শিহরণ, বিচ্ছেদে কাতর। সহস্র মানুষের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে সারাক্ষণ শুধু একটি মুখের হাতছানি— প্রত্যাশা। পৃথিবীর যাবতীয় ব্যক্তি, বস্তু, ঘটনা ছাড়িয়ে শুধু একজনের চিন্তায় আচ্ছন্ন ও উন্মুখ মন। অন্তরে অনুক্ষণ যার আনাগোনা, তারই পরিচিত পদশব্দের আশায় সর্বদা উদগ্রীব কর্ণযুগল। রাতে অনিদ্রা, নিরন্তর দিবাস্বপ্ন। কোনো কাজে বা চিন্তায় মনোনিবেশ প্রায় অসম্ভব। পত্র লেখা, পত্ৰ ছেঁড়া, পত্র পাঠ এবং তার পুনরাবৃত্তি।
সামগ্রিকভাবে ওপরের এই লক্ষণগুলো কীসের আলামত? আর কিছু নয়। একটি মানুষ আরেকজনের প্রেমে পেড়েছে। সৃষ্টির আদিকাল থেকে যে-আকর্ষণ একটি নারী ও একটি পুরুষকে পরস্পরের কাছে টেনে এনেছে, সেই মহাশক্তি প্রেমের কাছে বাঁধা পড়েছে নরনারী।
প্রেম ও তার স্বরূপ নিয়ে বরাবরই মেতে আছে সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, নাটক ও চলচ্চিত্র। আমাদের সকলেরই ধারণা প্রেমের রকম, ধরন, ক্ষমতা সম্পর্কে অথবা ভালোবাসার মহিমা, ব্যাপকত্ব ও তীব্রতার ব্যাপারে শিল্পী-সাহিত্যিকরা যে ব্যাখ্যা বা বর্ণনা দিয়ে এসেছেন তার বাইরে আর কিছু থাকতে পারে না। তাঁরাই প্রেম সম্পর্কে সবচেয়ে অভিজ্ঞ, তাঁরাই এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ। তা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের কবিতা / গান, লোকসংগীতের কথা, মানিক বন্ধ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু কিংবা সমরেশ বসুর উপন্যাস, অথবা সুবোধ ঘোষ বা প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প পড়ে প্রেমের বৈচিত্র্য ও জটিলতা সম্পর্কে যতই আমরা সচেতন হই-না কেন, তবু প্রেমকে বরাবরই মনে হয় কেমন যে বায়বীয় অপার্থিব-অবর্ণনীয়। দৈনন্দিন ধরাছোঁয়ার বাস্তব জিনিসের মতো তাকে যেন বোঝা যায় না, ব্যাখ্যা করা যায় না। কিন্তু যদি বলা যায় প্রেমের চিরন্তন সব লক্ষণ ও প্রকাশের পেছনেই রয়েছে সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত কতকগুলো কারণ যেগুলির প্রধান ভিত্তি সৃষ্টির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা, তাহলে হয়তো কেউ কেউ চমকে উঠবেন। ফ্রয়েড বা রীচ যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, আমরা পুরোপুরি সেদিকে যাব না। ফ্রয়েড মানুষের প্রায় সকল কর্ম ও চিন্তার মধ্যেই যৌন অনুষঙ্গ আবিষ্কার করলেও, এর পেছনের আরো মৌলিক কারণগুলো ও আণবিক পর্যায়ে এর জৈবিক ভিত্তিটি খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেন নি, কেননা তাঁর বিষয় ছিল মনোবিজ্ঞান। আমরা যদি আরো গভীরে যাই, মানুষের শরীরের মৌলিক রসায়ন ও জীবকোষ পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব, যে দু’টি মানব-সম্পর্ক পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি জোরালো এবং মানববন্ধনের ভিত্তি, সেই নারী-পুরুষ সম্পর্ক এবং সন্তানের সঙ্গে পিতামাতার সম্পর্কও সৃষ্টির ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্যে অপরিহার্য। আর এই দুটি সম্পর্কই নিয়ন্ত্রিত হয় শরীরের কতগুলো হরমোন ও ঐ জাতীয় পদার্থের ওঠানামার মাধ্যমে। হরমোনের তারতম্য ও মস্তিষ্কে তার প্রভাব শুধু এ দুটি সম্পর্ক নয়, অন্যান্য সম্পর্কও—যেমন বৃহত্তর পারিবারিক সম্পর্ক, বন্ধুত্বের সম্পর্ক, সহকর্মী বা প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক, এমন কি সাধারণ মানবসম্পর্ককেও প্রভাবিত করে। সামাজিক বন্ধন মানেই বাছাই ও ছাঁটাই করার মাধ্যমে কাউকে কাউকে কাছে টানা এবং সুখে-দুঃখে তাদের সঙ্গে নিজেকে বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িয়ে ফেলা। আর এই জড়িয়ে ফেলার ক্ষমতা বা অনুভূতিটি মস্তিষ্কের বিশেষ স্থানের সচলতা, অচলতা অথবা হরমোনের তারতম্যের জন্যে ঘটে থাকে। এর ভিত্তি সবটাই পরিবেশগত বা অর্জিত নয়।
নরনারীর প্রেম
নরনারীর প্রেমের তিনটি ধাপ বা পর্যায় আছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। এই তিন রকমের প্রেম মস্তিষ্ককে তিন রকম রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে পরিচালিত করে : (১) প্রেমের প্রথম ধাপ হলো যৌন তাড়না ও যৌন আকাঙ্ক্ষা। এই পর্যায়ের প্রেম সাধারণত পুরুষদের মধ্যে পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টারোন ও মেয়েদের মধ্যে মেয়েলি হরমোন এস্ট্রোজেন দিয়ে প্রভাবিত। যৌন তাড়না থেকে যে-প্রেমের জন্ম, তা সবসময় খুব যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায় না। অনেক ক্ষেত্রেই তা ব্যক্তিনিরপেক্ষ এবং বিপরীত লিঙ্গের প্রতি প্রচণ্ড জৈবিক আকর্ষণ থেকে উৎসারিত। ফলে সঠিক ও মানানসই সঙ্গীর সঙ্গে পরিচয় না ঘটলেও এ পর্যায়ের প্রেমে অনেক সময় সহজলভ্য কোনো একজনের সঙ্গে অন্ধ হয়ে ঘর বাঁধতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে তরুণ-তরুণীরা। এর ফলে পরবর্তীকালে অনেক বিয়েরই বিবাহ-বিচ্ছেদে সমাপ্তি ঘটে। (২) দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রেম হলো রোমান্টিক বা প্যাশোনেট প্রেম যা দু’টি বিশেষ নরনারীর মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণের জন্ম দেয়। এই পর্যায়ের প্রেমের পাত্রপাত্রী পরস্পরকে কাছে পাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। প্রিয় ব্যক্তিটি কাছে থাকলে উচ্ছল আনন্দঘন হয় জীবন। বিরহে তীব্র যন্ত্রণা। মনমেজাজ, মতিগতির প্রায়ই পরিবর্তন ঘটে এ সময়। ব্যবহার হয় কিছুটা উল্টোপাল্টা, অবোধ্য। জীবন হয়ে পড়ে পুরোপুরি একমুখী ও আচ্ছন্নতাময়। এই পর্যায়ের প্রেম নিয়ন্ত্রিত হয় পুরুষ ও নারী দু’য়ের ক্ষেত্রেই ডোপামিন ও নরএপিনেফ্রিনের আধিক্য ও সেরোটনিসের অভাবজনিত কারণে : (৩) তৃতীয় পর্যায়ের প্রেমে যুগলবন্ধন ঘটে এবং তা পারস্পরিক গভীর টান ও মানসিক নির্ভরতার জন্ম দেয়। এই পর্যায়ের প্রেমে প্রথমে চরম উত্তেজনা কিন্তু শেষে মন স্থির ও শান্ত হয়ে আসে। যখন স্থায়ী ও গভীর আস্থা ও নির্ভরশীলতার জন্ম হয় তখন এই পর্যায়ের প্রেম অক্সিটোসিন ও ভেসোপ্রেসিন নামক হরমোন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। এছাড়া বেটা এন্ডরফিন বলে একরকম পদার্থও নির্গত হয় যা মানুষকে দুশ্চিন্তামুক্ত করে এবং একরকম ভালোলাগার জন্ম দেয়। অক্সিটোসিন হরমোন মানববন্ধন ও ভালোবাসার সবচেয়ে জরুরি ও মৌলিক হরমোন বলে বিবেচিত। জীবজন্তু ও মানুষের মধ্যে গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে নরনারী যখন যৌন মিলনে শীর্ষসুখ উপভোগ করে, তখন দু জনের শরীরেই প্রচুর পরিমাণে অক্সিটোসিন নির্গত হয়। এই অক্সিটোসিন তখন এই যুগলবন্ধনকে আরো মজবুত করে। আসলে হরমোনরা কখনো এককভাবে বা স্বাধীনভাবে কাজ করে না। একে অন্যের সহায়ক শক্তি বা শত্রুর মতো কাজ করে। অক্সিটোসিন যদিও পুরুষ-নারী দু জনের শরীরেই প্রবাহিত হয়, নারীর শরীরে অক্সিটোসিনের প্রভাব অনেক বেশি, কেননা নারী-হরমোন এস্ট্রোজেনের সঙ্গে সম্মিলিত অক্সিটোসিন অনেক বেশি কার্যকর। পুরুষ-হরমোন টেস্টোস্টারোনের সঙ্গেও অক্সিটোসিনের বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক রয়েছে, কিন্তু এস্ট্রোজেনের মতো তা শক্তিশালী নয়। অক্সিটোসিন শরীরে এস্ট্রোজেন ও টেস্টোস্টারোন নির্গত করতে সাহায্য করে যা মানুষকে যৌনাকাঙ্ক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে, ফলে দেখা যায়—যৌন চাহিদা ও মানববন্ধন একে অন্যকে প্রতিনিয়ত সহযোগিতা করে চলেছে। এস্ট্রোজেন ও টেস্টোস্টারোন যৌন চাহিদা বা আকাঙ্ক্ষাকে জাগ্রত করে। পরিণতিতে নরনারীর যে যৌন মিলন ঘটে, তাতে সৃষ্টি হয় অক্সিটোসিন যা তাদের বন্ধনকে দৃঢ় করে এবং আরও এস্ট্রোজেন, টেস্টোস্টারোন তৈরি করতে সাহায্য করে। অক্সিটোসিন কিন্তু শুধু যৌন মিলনের সময়েই নির্গত হয় না। সাধারণ আদরের স্পর্শেও অক্সিটোসিনের মাত্রা বেড়ে যায় শরীরে। আর যেহেতু এস্ট্রোজেন দিয়ে বিশেষভাবে প্রভাবিত অক্সিটোসিন, স্পর্শে শিহরণ নারীরা যতটা অনুভব করে, পুরুষরা ততটা করে না। শুধু তাই নয়, সারা দিনের কোনো এক সময়েও নারীশরীরে পুরুষরা যদি সাধারণভাবে বা আদরের সঙ্গে কিছুটা স্পর্শ বুলিয়ে যায়, তা নারী-শরীরে যথেষ্ট পরিমাণে এস্ট্রোজেন ও অক্সিটোসিন তৈরি করে—যা তাকে যৌনতায় চালিত করে এবং পরবর্তীকালে তা যৌন মিলনের সহায়ক হয়। আমরা পরের অধ্যায়ে দেখব এই ভালোবাসার যাদুকরী হরমোন অক্সিটোসিন যা এস্ট্রোজেনের সঙ্গে মিলে যৌনাকাঙ্ক্ষা ও যৌনসুখ তৈরি করে, প্রলেক্টিনের সঙ্গে মিশে এই একই হরমোন মাতৃত্ববোধের জন্ম দেয় ও যৌনাকাঙ্ক্ষা দমন করে। অক্সিটোসিনের আরেকটা কাজ হলো—মনে রাখার ক্ষমতা ও ব্যথার বোধ কমিয়ে দেয়া, যার ফলে সঙ্গীর সাথে তর্ক-ঝগড়া করলেও অথবা সন্তানজন্মের পর শারীরিক ব্যথা থাকলেও নারী তা সহজে ভুলে যেতে পারে।
যদিও প্রেমের তিনটি সুস্পষ্ট ধারা রয়েছে, তবু এমন দেখা গেছে যে, এক জন মানুষ একই সঙ্গে তিনরকম প্রেমেই আসক্ত। এক জনের সঙ্গে হয়তো তার দীর্ঘদিনের মানসিক নির্ভরতা ও গভীর টানের সম্পর্ক, যার সঙ্গে হয়তো জাগতিক বহু বিষয়ে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। একই সাথে আরেক জনের সঙ্গে হয়তো রয়েছে রোম্যান্টিক প্রেমের সম্পর্ক। আবার সম্পূর্ণ আরেক জনের সঙ্গে আছে শুধুমাত্র যৌনাকাঙ্ক্ষা মেটাবার সম্পর্ক। আবার কখনো কখনো—বিশেষত মেয়েদের বেলায়— যৌনাকাঙ্ক্ষা বা যৌনতাড়না পর্যায়ের প্রেমের আগেই হয়তো আবির্ভূত হয় রোম্যান্টিক প্রেম এবং পরে রোম্যান্টিক প্রেমের পথ ধরেই জন্মায় যৌন আকর্ষণ। অথবা কখনো কখনো এই দুই পর্যায়ের প্রেম সমান্তরালভাবে একই সঙ্গে একই ব্যক্তির জন্যে নিবেদিত হয়। বিশেষ করে আমাদের মতো অবদমিত, রক্ষণশীল ও সংস্কারাচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থায় যৌন আকর্ষণ ও যৌন অনুভূতি প্রায়শই সুপ্ত থাকে বলে এর উপস্থিতি সম্পর্কে আমরা অনেক সময় অসচেতন থাকি অথবা স্বীকার করতে নারাজ হই। ফলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যেন প্রাথমিকভাবে প্রথম পর্যায়ের প্রেমের অর্থাৎ যৌন তাড়নার কোনো স্থানই নেই এখানে, দ্বিতীয়টিও ছিল না এই কিছুকাল আগে পর্যন্তও। তৃতীয়টিরই জয়গান গাওয়া হয় সর্বত্র। তবে সমাজস্বীকৃত নয় বলেই সার্বজনীন এই বোধ আকাঙ্ক্ষা বা আকর্ষণ যে পুরোপুরি কখনো আমাদের ভিতরে অনুপস্থিত ছিল তা বলা যায় না।
সন্তানের প্রতি পিতামাতার স্নেহ
অক্সিটোসিন যা ‘ভালোবাসার হরমোন’ বলে খ্যাত, তা বাৎসল্যবোধেরও জন্ম দেয়। অন্তঃসত্ত্বা নারীর শরীরে এস্ট্রোজেনের প্রভাবে প্রচুর পরিমাণে অক্সিটোসিন নির্গত হয়। শুধু তাই নয়। এস্ট্রোজেন মস্তিষ্ককে অক্সিটোসিন গ্রহণ করার জন্যেও প্রবলভাবে তৈরি করে। সন্তানজন্মের অব্যবহিত আগে পেটে ব্যথা (জরায়ুর সঙ্কোচন) যখন শুরু হয় পিটুইটারি থেকে প্রচুর পরিমাণে তখন অক্সিটোসিন বেরোতে থাকে। বাচ্চা যখন জন্মনালী দিয়ে বেরোবার চেষ্টা করে, তখনো অক্সিটোসিন নির্গত হয়। মায়ের সাথে সন্তানের বন্ধন রচনায় ও যোগাযোগে অক্সিটোসিন সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী সেতু হিসেবে কাজ করে। শিশু নিজেও অক্সিটোসিন তৈরি করে; এছাড়া বেশ কিছুটা পায় মায়ের কাছ থেকেও। দু জন দু জনের শরীরের গন্ধের সঙ্গে পরিচিত হয় এবং তাদের মধ্যে বন্ধন বাড়ে। সন্তানকে যখন মার বুকের দুধ খাওয়াতে চেষ্টা করে, তখন অক্সিটোসিনের প্রভাবে প্রলেক্টিন হরমোন নির্গত হয় যা শিশুকে দুগ্ধ পরিবেশনে সাহায্য করে। প্রলেক্টিন শুধু দুধ দান করেই ক্ষান্ত হয় না, মায়ের শরীরে এস্ট্রোজেনের মাত্রাও কমিয়ে দেয়। মা ও শিশুর এই বন্ধনে বাবাও বাদ যায় না অথবা নির্বিকার থাকে না। তার শরীরেও ভেসোপ্রেসিন বলে এক রকম হরমোন নির্গত হয়, যা পিতৃসুলভ স্নেহ ও ভালোবাসার জন্যে দায়ী। ভেসোপ্রেসিন পুরুষকে কোমলতা দান করে এবং তাকে মমতাশীল করে তোলে। জীবনসঙ্গিনী ও সন্তানের মঙ্গলবাসনায় সিক্ত হয়ে ওঠে তার মন। এই হরমোন তার সন্তান ও গর্ভধারিণীকে রক্ষা করা ও তাদের নিরাপত্তার জন্যে প্রয়োজনীয় শক্তি ও সামর্থ্য যোগাড় করতে সাহায্য করে। বিশেষ করে জন্তুজানোয়ারের মধ্যে এই হরমোনই পুরুষ জন্তুটিকে অন্যান্য জন্তু থেকে ও তার সঙ্গিনী ও তার গর্ভজাত সন্তানকে রক্ষা করার সাহস ও শক্তি যোগায়। এছাড়া ইদানীংকালে এক বিজ্ঞান-গবেষণায় দেখা গেছে যে, যেসব বাবা গর্ভবতী মায়ের পাশে থাকেন এবং তার খোঁজখবর নেন, তাদের শরীরে সঙ্গিনীর গর্ভকালীন সময়ের শেষভাগে এবং সন্তানজন্মের অব্যবহিত পরে টেস্টোস্টারোনের পরিমাণ কিছুটা কমে যায়, যা তার যৌনাকাঙ্ক্ষাকে দমন করে এবং সন্তানের তথা মানবপ্রজাতির ধারাবাহিকতা রক্ষায় সাহায্য করে। কানাডার কিংস্টনে এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, হবু পিতাদের শরীরে শুধু টেস্টোস্টারোন কমে না, অস্থিরচিত্ত ও দুর্ভাবনার হরমোন কর্টিসলের পরিমাণও কমে যায়। সেই সঙ্গে বাড়ে এস্ট্রোজেনের পরিমাণ যা তাকে আরও স্নেহময় ও সহনশীল করে তোলে। বলা বাহুল্য, টেস্টোস্টারোন ও এস্ট্রোজেন যথাক্রমে পুরুষ ও নারী-হরমোন বলে পরিচিত হলেও পুরুষের শরীরেও সাধারণভাবে খানিকটা এস্ট্রোজেন থাকে এবং নারীর শরীরেও কিছুটা টেস্টোস্টারোন থাকে এবং স্বল্পমাত্রায় হলেও এদের প্রত্যেকেরই একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। অক্সিটোসিন যে বাৎসল্যবোধের জন্যে দায়ী, বিজ্ঞানীরা তা ইঁদুরের ওপর বিভিন্নরকম গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন। তাঁরা কুমারী মেয়ে-ইঁদুরের শরীরে অক্সিটোসিন ইনজেকশন দিয়ে দেখেছেন যে অক্সিটোসিনের প্রভাবে মা না হওয়া সত্ত্বেও হঠাৎ করে ইঁদুরগুলো মাতৃসুলভ আচরণ শুরু করে দেয়। অর্থাৎ খড়কুটো দিয়ে তারা সন্তানের জন্যে ঘর বানাতে শুরু করে। এছাড়া কাছাকাছি শিশু-ইঁদুর দেখলে তারা তার গা চেটে দিয়ে আদর করে এবং দুধ খাওয়াতে চায়। অন্যদিকে ওষুধ দিয়ে অক্সিটোসিনের ক্রিয়াকলাপ বন্ধ করে দিতে পারলে ইঁদুরের বাৎসল্যবোধ, হোক-না সে নতুন মা, রোধ করা সম্ভব।
জীববিজ্ঞানী ও বিবর্তনবাদীদের মতে মানবিক বা সামাজিক যে-বন্ধন, বিশেষ করে মায়ের যে-অন্ধ টান ও আবেগ, তা মানবপ্রজাতির ধারাবাহিকতা রক্ষা এবং ব্যক্তিমানুষের জিনসকে অমরত্ব দানের আকাঙ্ক্ষা থেকেই উদ্বুদ্ধ। নরনারীর যৌন তাগিদ ও প্রেম থেকে উৎপত্তি হয় মানবশিশু। তার প্রতি মায়ের প্রচণ্ড টান, মমত্ববোধ, দুগ্ধদান, আদর ও শুশ্রূষা থেকে মানবশিশু আস্তে আস্তে সবল হয়ে উঠে বেড়ে ওঠে এক জন সাবালক হিসেবে যে আবার প্রজননের মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলে। শিশুর জন্মের পর পিতার শরীরে যেমন টেস্টোস্টারোনের পরিমাণ সাময়িকভাবে কমে যায়, মায়ের শরীরেও প্রলেক্টিনের প্রভাবে এস্ট্রোজেনের মাত্রাও বেশ খানিকটা কমে যায়। ফলে নতুন মা-বাবার শরীরে যৌনাকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি ঘটে কিছুকালের জন্যে। এই সাময়িক যৌনবিমুখতা পরোক্ষভাবে সন্তানের বেঁচে থাকার নিশ্চয়তার উদ্দেশ্যেই ঘটে থাকে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। এই সময়ের যৌন আকাঙ্ক্ষাহীনতা বাবাকে তাদের জীবনসঙ্গীর চাইতে সন্তানের প্রতি অধিক মনোযোগী হতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয়, যৌনসম্পর্কের ঘাটতি বা অনুপস্থিতি পরবর্তী সন্তান আগমনের সম্ভাবনাকে পিছিয়ে দিয়ে এই নবজাত শিশুটির বেঁচে থাকার জন্যে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করে। এছাড়া প্রলেক্টিনের প্রভাবে সন্তানকে দুগ্ধদানের ফলে মায়ের মাসিক সাময়িকভাবে বন্ধ থাকে। অর্থাৎ বেশ কয়েক মাস তার ওভুলেশন (ডিম্বাশয় থেকে পরিণত ডিম্বাণুর নির্গমন) হয় না। তার ফলে যৌন মিলন ঘটলেও মায়ের পক্ষে সঙ্গে সঙ্গেই অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ থাকে। এসবই ঘটে শিশু সন্তানটির বেঁচে থাকার ও সুস্থ থাকার প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্যে।
প্রেম কী, কেন ও কেমন?
প্রশ্ন করা যেতেই পারে—প্রেম বা ভালোবাসার আসল প্রয়োজনটা কী জীবনে বা জগতে। সবটাই কি যৌন তাড়না? প্রেম এবং মানববন্ধন প্রজননে সাহায্য করে, বাৎসল্যবোধে উদ্বেল করে, মানুষকে দুশ্চিন্তা ও হতাশামুক্ত করে, জীবনে নিশ্চয়তা দেয়, অস্থিরতা কমায়, রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ায়, শরীর ও মনকে উল্লসিত ও উৎফুল্ল রাখে এবং সুস্বাস্থ্য ও সুস্থ মনের অধিকারী করে মানুষকে। ফলে দেখা যাচ্ছে ভালোবাসা শুধু যৌন সুখ ও সন্তানই দেয় না, মানুষের একাকীত্ব ঘোচায়, সঙ্গ দেয়, তার আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয় বাড়ায় ও তাকে দীর্ঘজীবী হতে সাহায্য করে। জীবনে যত প্রতিষ্ঠা বা সুনামই অর্জন করুক না কেন মানুষ, প্রেমহীন ও বন্ধনহীন জীবনে সে নিজেকে অবহেলিত বোধ করে, অনুক্ষণ জীবনকে অর্থহীন মনে হয় তার। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হওয়া বা প্রেমার্জনে ব্যর্থ হওয়া, সাবালক নারীপুরুষের বিষণ্নতাজনিত মানসিক ব্যাধির সবচেয়ে বড় কারণ। আমেরিকাতে যত নারী খুন হয়, তার ৫০%- ৭০% খুন হয় নিজ স্বামী বা প্রেমিকের হাতে প্রেমবিষয়ক সংকটে। প্রেমের জৈবিক ভিত্তির সপক্ষে ইদানীংকালের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার ফলাফল দেওয়া হল নিচে :
১. বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে, প্রেমে পড়লে মস্তিষ্কের যেসকল স্থান উদ্দীপিত হয়, সচল হয়, কোনো বিশেষ দ্রব্য দিয়ে নেশা করলেও ঠিক সেই অঞ্চলগুলোই সচল হয়। ফলে প্রেম ও নেশা জৈবিকভাবে প্রায়ই একই রকম। নেশা করলে মানুষ যেমন বাস্তবতা ভুলে যায়, ভালো-মন্দ বাছ- বিচারের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং এক অবোধ্য অবর্ণনীয় ভালোলাগা আর উত্তেজনায় উদ্বেল হয়ে ওঠে মন, প্রেমে পড়লেও ঠিক তাই ঘটে। এছাড়াও প্রেমের ধারা ও লক্ষণের সঙ্গে কয়েকটি মানসিক রোগ, যেমন ম্যানিক ডিপ্রেশন ও স্কিজোফ্রেনিয়া রোগেরও যথেষ্ট মিল রয়েছে। প্রেমে পড়া এবং এই মানসিক বৈকল্য উভয় ক্ষেত্রেই সেরোটনিনের মাত্রা কমে যায় শরীরে স্বভাবতই অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি ড্রাগের নেশা বা মানসিক রোগের মতো প্রেমে পড়ার লক্ষণগুলোকেও চিকিৎসা করে সারিয়ে ফেলা যায়? যখন কোনো কিশোর বা কিশোরী গভীর প্রেমে মত্ত হয়ে পৃথিবী ভুলে গিয়ে সব কাজ পড়াশুনা ছেড়ে বিশেষ একজনের ধ্যানধারণায় সম্পূর্ণ উতলা হয়ে নিজেকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়, তখন কি ডাক্তার বা পিতামাতা তার প্রেমের চিকিৎসা করাতে পারেন? ল্যাবরেটরি পর্যায়ের গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো কোনো রসায়ন পদার্থের নির্গমন বন্ধ করে অথবা তাদের কার্যাবলী প্রতিরোধ করে কিংবা অন্য কোনো পদার্থের সংযোজন করে প্রেমের অনুষঙ্গ এবং তার তীব্র লক্ষণগুলোকে দমন করা সম্ভব। কিন্তু সেটা করা কি সঙ্গত? প্রেমের মতো স্বাভাবিক, সহজাত ও প্রয়োজনীয় একটি অনুভূতি বা তা প্রকাশের বাড়াবাড়ি ঠেকাতে কোন মানুষ তার সন্তানকে এক বা একাধিক ওষুধের ওপর নির্ভরশীল করতে চাইবে? সেটা কি তার জন্যে মঙ্গল বয়ে আনবে?
২. কিছুদিন আগে স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্ক, স্টোনিব্রুকের বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, সঙ্গমের পর মেয়েরা যে খুব উচ্ছল ও হাসিখুশী থাকে তার পেছনেও সরাসরি হরমোনের প্রভাব রয়েছে। এই মিলনের আনন্দ বা সন্তুষ্টি শুধু আরেকজনের প্রেম ও ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য উপভোগ করার জন্যেই হয় না, বীর্যের মধ্যে টেস্টোস্টারোন হরমোন ও অন্যান্য উদ্দীপক পদার্থ যে রয়েছে, তা মেয়েদের শরীরে শোষিত হয়ে তার রক্তপ্রবাহে সঞ্চালিত হয় বলেই মেয়েরা খুশিতে টগবগ করে। স্টোনিব্রুকের বিজ্ঞানীরা অবশ্য এই তথ্য প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এই বলেও সতর্ক করে দিয়েছেন যে, এই বিজ্ঞান- গবেষণার ফল কোনোমতেই কনডমবিহীন যৌন সম্ভোগের পক্ষে রায় দিচ্ছে না। কনডম শুধু যে পরিবার পরিকল্পনায় সহায়ক তাই নয়, যৌনবাহিত বিভিন্ন রোগ, বিশেষ করে এইডস থেকেও রক্ষা করে।
৩. ড. বারটেল ও ড. জেকি নামক দুই বিজ্ঞানী কিছুদিন আগে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক গবেষণার ফল প্রকাশ করেছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন যে, নরনারীর প্রেম আর বাৎসল্যবোধ এই দুই রকমের ভালোবাসাই মস্তিষ্কের একই জায়গা থেকে উৎসারিত ও প্রায় একইভাবে নিয়ন্ত্রিত। মস্তিষ্কে এমআরআই পরীক্ষার মাধ্যমে তাঁরা দেখিয়েছেন যে, মানুষ যখন ভালোবাসায় হাবুডুবু খায় (সে ভালোবাসা নরনারীর প্রেমই হোক অথবা সন্তানের প্রতি ভালবাসা বা অপত্যস্নেহই হোক) মস্তিষ্কের বিশেষ বিশেষ কতগুলো জায়গা তখন সচল হয়ে ওঠে। সেই সঙ্গে মস্তিষ্কের কিছু কিছু অঞ্চল যেগুলো কোনো অপ্ৰিয় ব্যাপার বা অনুভূতি দ্বারা উদ্দীপিত হয়, সেগুলো অচল হয়ে পড়ে। ফলে ভালোবাসায় আচ্ছন্ন হলে মানুষ শুধু প্রিয়জনের ভালো দিকটিই দেখে, তার মন্দ স্বভাব, অশোভন আচরণের প্রতি অন্ধ হয়ে যায়। শরীরের এন্ডরফিনের আধিক্যও এই ভালোলাগার বোধের তীব্রতা ও মন্দ দিকটির প্রতি ঔদাসীন্যের জন্যে দায়ী। পরবর্তীকালে এন্ডরফিনের পরিমাণ কমতে শুরু করলে প্রিয়জনের খারাপ দিকগুলো চোখে পড়তে শুরু করে। বিজ্ঞানীরা এটাও দেখতে পেয়েছেন— মস্তিষ্কের যে-সকল স্থান সচল হলে মানুষ বিবেচক ও যুক্তিবাদী হয়, সমালোচনা করার ক্ষমতা অর্জন করে, ভালোবাসায় মত্ত হলে মস্তিষ্কের যেসব অঞ্চল অকেজো ও অচল হয়ে পড়ে। এর ফলে প্রেমে পড়লে বা বাৎসল্যবোধে আপ্লুত হলে মানুষ তার প্রিয়জনের কোনো দোষত্রুটি চোখে দেখে না, মনে ধারণ করে না—সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও অন্ধ হয়ে পড়ে। মস্তিষ্কের যে-সব স্থান প্রচণ্ড প্রেম বা বাৎসল্যবোধে সচল হয়ে ওঠে, দেখা গিয়েছে সেই একই স্থানগুলো সচল হয় যখন আমরা কোনো প্রিয় খাদ্য গ্রহণ করি, যখন বড় একটি আর্থিক বা অন্য কোনো পার্থিব প্রাপ্তির সুযোগ ঘটে, যখন কোনো উত্তেজনাকর ড্রাগ বা অন্যান্য দ্রব্য গ্রহণ করি। নরনারীর প্রেম আর বাৎসল্যবোধ মস্তিষ্কের একই জায়গা থেকে উৎসারিত হলেও দুটি ব্যাপারে এদের ভেতর কিছুটা ভিন্নতা লক্ষ করা গিয়েছে।
(১) মস্তিষ্কের ভেতর মটরদানার মতো একটা ছোট্ট জায়গা রয়েছে যাকে বলে হাইপোথেলামাস। নরনারীর প্রেমে হাইপোথেলামাস সচল হয় এবং তা এস্ট্রোজেন ও টেস্টোস্টারোন নির্গত করতে এবং শরীরকে যৌন-উদ্দীপিত করতে সাহায্য করে। সন্তানের জন্যে যে মমত্ব বা বাৎসল্যবোধ, তাতে হাইপোথেলামাস সচল হয় না। (২) মস্তিষ্কের যে অঞ্চল মানুষের মুখমণ্ডল চিনতে ও তার পার্থক্য নির্ণয় করতে সাহায্য করে, সেটা বাৎসল্য বোধে খুব সচল হয়ে পড়ে, নরনারীর প্রেমে ততটা হয় না। এর কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, যেহেতু শিশুর চেহারা দ্রুত পাল্টায় পিতামাতার মস্তিষ্কের এই অঞ্চলটির সচলতাই স্বাভাবিক। প্রাপ্তবয়স্ক প্রেমিক- প্রেমিকার চেহারা যেহেতু পরিবর্তনশীল নয়, মস্তিষ্কের এই বিশেষ অঞ্চলটি নরনারীর প্রেমে তেমন উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে না।
৪. কয়েক বছর আগে আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলনে রাডগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ফিশার একটা গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাপত্র পাঠ করেন। তিনি চল্লিশ জন তরুণ-তরুণী যারা গভীরভাবে প্রেমে পড়েছে তাদের সামনে একবার তাদের প্রেমাস্পদের এবং পরবর্তীকালে তাদের পরিচিত সাধারণ একজনের ছবি উপস্থাপনার পর উভয়বারই তাদের মস্তিষ্কের পরিবর্তনগুলো এমআরআই পরীক্ষা করে নির্ণয় করেন। তিনি অবাক হয়ে লক্ষ করেন, মস্তিষ্কের যে-যে অংশ প্রেমের পাত্র বা পাত্রীর ছবি দেখে উদ্দীপিত হয়েছে, সেই একই স্থানগুলো উদ্দীপ্ত হয় জীবনে বড় কিছু পাবার আগ্রহে অথবা বিশালভাবে পুরস্কৃত হবার পর। সাধারণ পরিচিতের ছবি দেখে এ স্থানগুলো সচল হয় না। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ড. ফিশার বলেন, প্ৰেম সে-অর্থে অনুভূতি নয়, এটা একটা তাড়না, অভিলাষ, প্রত্যাশা। গভীর ও অতি প্রয়োজনীয় এই প্রাপ্তির ইচ্ছা, আগ্রহ ও অভিপ্রায় থেকেই আস্তে আস্তে অনুভূতির জন্ম হয়। প্রেম মানুষের চূড়ান্ত প্রাপ্তি——চরমভাবে পুরস্কৃত হবার অভিজ্ঞতা।
৫. ইটালিয়ান বিজ্ঞানী মারাজিতি কিছুদিন আগে একটি অভিনব ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, গভীরভাবে প্রেমে পড়লে পুরুষ ও নারীর সহজাত স্বভাব ও প্রবৃত্তির মৌলিক কিছু ওলোটপালোট ঘটে। পুরুষ হয়ে যায় কিছুটা নারীর মতো, নারী হয়ে যায় কিছুটা পুরুষের মতো। প্রেমে পড়লে পুরুষের শরীরে টেস্টোস্টারোন কিছুটা কমে যায় এবং সেই সঙ্গে এস্ট্রোজেনের পরিমাণ খানিকটা বাড়ে। অন্যদিকে নারীর শরীরে টেস্টোস্টারোনের পরিমাণ বেড়ে যায় প্রেমে পড়লে—যা তার যৌন উত্তেজনা ও যৌন পরিতৃপ্তির সহায়ক। প্রেমে পড়লে শরীরে টেস্টোস্টারোন খানিকটা কমে যাওয়ায় এবং এস্ট্রোজেনের পরিমাণ কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় পুরুষ তার চিরাচরিত আধিপত্যবাদী ও আগ্রাসী ভূমিকা ছেড়ে কিছুটা শান্ত, সমাহিত, ধৈর্যশীল ও মমতাময় হয়ে ওঠে। জোর করে দখল করার মনোভাব পাল্টে সে সঙ্গিনীর কথা ভাবতে শেখে। আর নারী—যে চিরকাল শান্তশিষ্ট, ধৈর্যশীল, যে যৌনাকাঙ্ক্ষা প্রকাশে বা তা মেটাবার বেলায় বরাবরই লজ্জাশীল ও আনতনয়ন, সে প্রেমে পড়লে টেস্টোস্টারোনের প্রভাবে হঠাৎ বেপরোয়া ও সাহসী হয়ে ওঠে। নিজের ভালোবাসা ও আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করতে ও তা মেটাবার জন্যে সচল ও অগ্রণী হয়ে পড়তে দ্বিধা করে না। ফলে প্রেম ও আনুষঙ্গিক হরমোনের ওঠানামা পুরুষ ও নারীকে স্বভাবগতভাবে পরস্পরের কাছে টেনে আনে যা তাদের যুগলবন্ধনের উৎস ও পরিবর্ধক হয়।
যুগলবন্ধনের ভিত্তি
বিজ্ঞানীরা যুগ যুগ ধরে নরনারীর বা পুরুষ এবং স্ত্রীজাতীয় জন্তু জানোয়ারের যুগলবন্দীর রহস্য ও ভিত্তি আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন। তাঁরা জানতে চেয়েছেন একগামিতা বা বহুগামিতা কি প্রাণীজগতের সাধারণ একটি প্রবণতা? এটা কি জিনস দিয়ে নির্ধারিত? নাকি পরিবেশ বা সামাজিকভাবে অর্জিত অন্য অনেক কিছুর মতো এটিও একটি পরিশীলিত ও স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য? সমস্ত জীবজগতে মাত্র ৩% প্ৰাণী একগামী। অর্থাৎ শতকরা তিন ধরনের প্রাণীর মধ্যে একটি পুরুষ আরেকটি স্ত্রী প্রাণীর সঙ্গে জুটি বেঁধে সন্তানের জন্ম দেয়, তা প্রতিপালন করে ও একসঙ্গে সারা জীবন বসবাস করে। অন্য সকল প্রাণীই বহুগামী। বিজ্ঞানীরা এতদিনে এ ব্যাপারেও নিশ্চিন্ত হয়েছেন যে, একগামিতা শুধুমাত্র বিরল নয়, একধরনের অস্বাভাবিক আচরণও বটে। এটা যতটা-না প্রাকৃতিক, তার চেয়েও বেশি পরিবেশগত ও অর্জিত বৈশিষ্ট্য। তবু এর পেছনে জেনেটিক বা বংশগত প্রভাবও রয়ে গেছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। তাঁরা অবিকল যমজ সন্তানদের জীবনপ্রবাহ বহু বছর ধরে অনুসরণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, যমজদের একজন বহুগামী হলে অন্যজনেরও হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। বিজ্ঞানীরা এটাও দেখেছেন যে, যে-ধরনের প্রাণীদের মধ্যে একগামিতা লক্ষ করা যায়, তারাও সুযোগ পেলে এদিক-ওদিক মনোনিবেশ বা শারীরিক সম্পর্ক করে ফেলে মাঝে মাঝে। তারপর আবার গুটিগুটি পায়ে নিজের ঘরে, নিজের স্থায়ী সঙ্গীর কাছে ফিরে আসে। একগামী বলে পরিচিত নীল পাখি ও মানুষ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আমেরিকায় বসবাসরত দম্পতিদের সন্তানের জন্মদাতা পিতার সত্যিকার পরিচয় যাচাই করার চেষ্টা করলে দেখা যেত, অন্তত ১০% পরিবারেই পিতা বলে পরিচিত ব্যক্তিটি আসলে জৈবিক পিতা নন। তা সত্ত্বেও একগামিতাকে কেন্দ্র করে মনুষ্য প্রজাতি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে মত্ত হয়ে আছে। শুধু ধর্মগ্রন্থই একে দাবি করে না, সমাজের বিভিন্ন নিয়মাবলিও তা চাপিয়ে দেয়। স্বামী বা স্ত্রীর বিশ্বস্ততার অভাব বা অন্যজনে আসক্তি সমাজ ও সংসারে নানান জটিলতাই শুধু নিয়ে আসে না, এ কারণে আজ পর্যন্ত বহু রাজরাজত্ব ধ্বংস হয়ে গিয়েছে—অনেক রাজনৈতিক নেতানেত্রী রাতারাতি তাঁদের আসন ও জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন।
একগামিতার বিচ্যুতি যত মুখরোচক গালগল্প ও মজাদার আলাপের সৃষ্টি করে মানুষের অন্য কোনো আচরণের ঘাটতি বা গলদ হলে তা করে না। তা সত্ত্বেও কম মানুষই আছে, শুধু মানুষ কেন, জীবজগতের খুব কম প্রাণীই আছে যারা সারা জীবন একগামী থাকাকে মনে-প্রাণে-দেহে জরুরি বলে মনে করে বা তা মেনে চলে। বিজ্ঞানীরা তাই একমত যে, প্রাণীকুলে একগামিতার প্রবণতা বা চর্চা স্বাভাবিক কোনো প্রক্রিয়া বা নিয়ম নয়। এটা ব্যতিক্রম। একগামিতার সংজ্ঞাও তাই পাল্টে গিয়েছে। এখন একগামিতার সংজ্ঞা বহুমাত্রিক। কেবল একজন যৌনসঙ্গী থাকাই একগামিতার বৈশিষ্ট্য নয়। একসঙ্গে জীবনযাপন, একসঙ্গে সন্তানের লালন-পালন, একই ঘরসংসার সামলানো এবং একত্রে সামাজিক ওঠাবসা করাও একগামিতা। জীবজগতে বহুদিন ধরেই যৌন একগামিতা ও সামাজিক একগামিতা এ দুভাবে একগামিকতাকে ভাগ করা হয়েছে। নীল পাখির ডিম বা ছানা তার শুক্রাণুর ফসল নয় জানলে সঙ্গে সঙ্গে সে তা ছুঁড়ে ফেলে দিত নিচে। সৃষ্টির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্যে সেটা খুব সুখবর হতো না নিশ্চয়ই। জীবজগতের সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে দেখা গিয়েছে যে যখন সম্পদ ও খাদ্য অপ্রতুল ও নিয়ন্ত্রিত, পরিবেশ বিরূপ কিংবা সদ্যভূমিষ্ঠ সন্তানের আকার বা অবস্থা এতটাই ছোট, অসহায় অথবা অরক্ষিত যে পিতামাতা দুজনের যৌথ চেষ্টা ও যত্ন ছাড়া সন্তানের প্রতিপালন ও খাদ্য যোগাড় করা সম্ভব নয়, তখনই প্রাণীরা জোড়ায় জোড়ায় জুটি বাঁধে- অর্থাৎ একগামী হয়। পাখিরা যেহেতু ডিম পাড়ে, ডিমকে তাদের তা দিতে হয় এবং বসবাস ও সন্তান প্রতিপালনের জন্যে তাদের বাসা বানাতে হয়, আবার খাদ্যও যোগাড় করতে হয়, সেহেতু পাখিদের মধ্যে জানোয়ারদের তুলনায় একগামী হবার যা যুগলবন্দী ঘটার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
ক্যালিফোর্নিয়ায় এক বিশেষ রকমের ইঁদুর আছে যারা আমৃত্যু জুটি বাঁধে। এদের জীবন এতই সংগ্রামময়, খাদ্যসংকট এতটাই প্রকট ও শীতকালে এত বেশি ঠাণ্ডা যে মা বা বাবার পক্ষে একা সন্তানদের রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব নয়। প্রেইরী ভোল বলে অন্য এক ইঁদুর জাতীয় জন্তুর কথা অবশ্য আলাদা। এরা একবার যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে আপাত কোনো কারণ ছাড়াই সারা জীবন পরস্পরের সাথে বিশ্বস্তভাবে জীবনযাপন করে, শত প্রলোভনেও অন্যের দিকে ফিরে তাকায় না। এই জুটি-বাঁধা সম্পূর্ণ জেনেটিক—জৈবিক। কেননা প্রকৃতিগত প্রেইরী ভোলের খুব কাছাকাছি জন্তু মোন্টানা ভোলের শতকরা ৯৯% জিনস অবিকল প্রেইরী ভোলের মতো। মাত্র ১% জিনসের পার্থক্যের জন্যে প্রেইরী ভোল পুরোপুরি একগামী ও মোন্টানো ভোল পরিপূর্ণভাবে বহুগামী।
মানুষের ওপরও নৃতাত্ত্বিকেরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, সদ্যপ্রসূত মানব-শিশুর ওজন মায়ের তুলনায় এত কম যে খুব কম জীবজন্তুর মধ্যেই তা দেখা যায়। যখন থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে চার হাত-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলার বদলে দুপায়ে ভর করে আনুলম্বিক হাঁটতে শুরু করল মানুষ, তখন থেকেই মানুষের জরায়ুর আয়তন ছোট হয়ে গেল—যার ফলস্বরূপ তুলনামূলকভাবে ছোট মানবশিশুর জন্ম। শুধু আনুপাতিক অল্প ওজনের জন্যেই নয়, অন্যান্য বহু ব্যাপারেই জীবজগতের বিভিন্ন প্রাণীর তুলনায় মানবশিশু অনেক অসহায় ও অন্যের মুখাপেক্ষী। গরু, ছাগল, কুকুর আর বাঘের বাচ্চারা জন্মের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যেখানে উঠে দাঁড়ায় হাঁটতে পারে, নিজের খাবার নিজে গ্রহণ করতে পারে, সেখানে মানবশিশুর তা করতে লেগে যায় বেশ কয়েক বছর। এই কারণেই সন্তানের পরিচর্যার জন্যে মানব-পিতামাতার জুটিবাঁধা আবশ্যকীয় হয়ে পড়ে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, আমেরিকায়, যেখানে অর্ধেক বিয়ে ভেঙে যায়, সেইসব দম্পতির মধ্যেই বিবাহ-বিচ্ছেদের হার সবচেয়ে বেশি (বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের হারও বেশি) যাদের সাত বছরেরও বেশি বিয়ে হয়েছে অথচ সন্তান হয় নি অথবা প্রথম সন্তানের বয়স ছয় বা সাত পেরিয়ে যাবার পরও দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয় নি। মানবশিশুর পরিচর্যায় পিতামাতা এতটাই ব্যস্ত থাকে যে, যখন সন্তান ছোট থাকে পারস্পরিক দোষত্রুটি ও বাকবিতণ্ডা তখন তেমন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না।
ভালোবাসার একই ভাষা
আকর্ষণ, ভালোবাসা ও মানববন্ধনের যে জৈবিক ভিত্তি রয়েছে, তার বড় প্রমাণ হলো দেশ-কাল, সংস্কৃতি, ভাষা, শিক্ষার মান, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ প্রেমে পড়ে। প্রেমের অনুষঙ্গ সার্বজনীন : প্রেমে পড়লে সকলে একইরকম ব্যবহার করে থাকে, একই লক্ষণসমূহ প্ৰকাশ পায়। পুরুষ প্রধানত আকৃষ্ট হয় স্ত্রী জাতির দুটি বৈশিষ্ট্যে। প্রতিটি পুরুষের আকাঙ্ক্ষিত নারী হবে সুন্দরী ও যৌবনবতী। প্রতিটি সমাজে সর্বকালে পুরুষের কাছে নারীর শরীরের বাঁক, তার নিতম্ব ও বক্ষের আনুপাতিক মাপ তার প্রতি আকর্ষণের কেন্দ্র। আর নারীর কাছে সে-ই সবচেয়ে প্রার্থিত পুরুষ যে শারীরিকভাবে শক্তসমর্থ ও পার্থিবভাবে সংসারের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত ও যোগ্য। প্রত্যাশা বা আকাঙ্ক্ষার এই যে বিভাজন, এটা সবটাই অর্জিত বা পরিবেশগত নয়। এর পেছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। বিবর্তনবাদীদের মতে, যেহেতু পুরুষের শরীরে কোটি কোটি শুক্রাণু রয়েছে এবং এর উৎপাদন সীমিত নয়, তার অন্তর্নিহিত ইচ্ছা বা শখ সে তার জিনস যতখানি সম্ভব ছড়িয়ে দেবে বিভিন্ন জায়গায় যাতে তার প্রজন্ম ও উত্তরাধিকার বজায় থাকে প্রবলভাবে। এর ফলে পুরুষের যৌনতা সর্বকালেই সর্বত্রই খোঁজে একাধিক নারীসঙ্গ। অন্যদিকে মেয়েরা মাসে কেবল একটি করে ডিম্বকোষ তৈরি করে। তাও আবার পরিণত বয়সের বিশেষ একটা পর্যায়েই ঘটে কেবল, যার দৈর্ঘ্য তিন থেকে চার দশকের বেশি নয়। শুধু অপ্রতুল ও মূল্যবান ডিম্বকোষ তৈরি করেই ক্ষান্ত হয় না নারীর শরীর। একবার এ ডিম্বকোষের সঙ্গে শুক্রাণুর মিলন ঘটলে যে- মানবশিশুর জন্ম হবে, নারীর শরীর জানে সেই সন্তানকে জন্ম দিতে, দুগ্ধদান করতে ও লালনপালন করতে তার অনেক বছর লেগে যাবে। ফলে নারী তার সঙ্গী নির্বাচনে বড়ই সতর্ক ও সচেতন। যে-সঙ্গী তার সন্তানের রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে, যে-সঙ্গী শারীরিকভাবে সক্ষম, পার্থিবভাবে দায়িত্বশীল, নারীরা সাধারণত সেদিকেই ঝোঁকে। যত্রতত্র মন বা শরীর খোয়াতে নারীর তাই আগ্রহ কম, অপরপক্ষের শত প্ররোচনা সত্ত্বেও। ভালোবাসা ও যৌন অনুভূতির জৈবিক ভিত্তি আরও একটি ব্যাপারেও স্পষ্ট হয়। মাসিক চক্রের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ ওভুলেশনের কাছাকাছি বা ঠিক পরবর্তী সময়ে যখন মেয়েরা গর্ভধারণে সবচেয়ে বেশি সক্ষম, তখন শরীরে অতিরিক্ত এস্ট্রোজেনের প্রভাবে নারীর যৌনাকাঙ্ক্ষা সবচেয়ে তীব্র হয়। এ থেকেও প্রমাণিত হয় প্রেম ও যৌনমিলনের অন্তর্নিহিত অভিপ্রায় প্রজনন এবং ধারাবাহিকভাবে সৃষ্টিকে এগিয়ে দেয়াই এর উদ্দেশ্য। যৌনসঙ্গী বা সন্তানের পিতা নির্বাচনে বিশ্বের নারীকুল যতই সংযম ও বাছবিছার করুক না কেন, বৃহত্তর জীবজগতে কিন্তু স্ত্রীজাতির এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যটি বড় একটা দেখা যায় না। এমনকি একগামিতার উদাহরণ যে নীল পাখি, তাদের মধ্যেও স্ত্রী-পাখিকে দেখা যায় কখনো কখনো সুযোগ সুবিধামতো অন্য পুরুষের সঙ্গে যৌনমিলনে অংশগ্রহণ করতে। প্রথম প্রথম বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, সঙ্গী পুরুষ নীল পাখিটির অনুপস্থিতিতে অন্য পুরুষ-পাখিরা মেয়ে-পাখীটিকে ধর্ষণ করছে। পরে তাঁরা লক্ষ করেছেন, যদিও স্ত্রী নীল পাখি ইচ্ছে করলেই বীর্য উপড়ে ফেলতে পারে, তবু তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই শরীরে পরপুরুষের বীর্য ধারণ করে সন্তান উৎপন্ন করে। বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা—নারী নীল পাখী এটা করে তার প্রজাতির বৈচিত্র্য বাড়াতে — তার কুলের অস্তিত্ব রক্ষার্থে। একই রকম জিনসের সন্তান জন্মালে কোনো প্রাকৃতিক বা পরিবেশগত মহা দুর্যোগে সম্পূর্ণ প্রজাতি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। বৈচিত্র্যময় প্রজাতি হলে সেটা ঘটবে না। ফলে নারী-প্রাণীর সবসময়েই আকাঙ্ক্ষা থাকে বৈচিত্র্যময় প্ৰজাতি সৃষ্টির—পুরুষ প্রাণীর যেমন ইচ্ছা থাকে যত বেশি সম্ভব তার নিজস্ব সন্তান তৈরি করার। মানব-প্রজাতির নারীর মধ্যে বহুগামিতার প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্বের অভাবও যে কতটা প্রাকৃতিক, কতটা ধর্ম, সমাজ ও পরিবারের মূল্যবোধ ও আচরণবিধি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত, তা বলা মুশকিল। নরনারীর প্রেমের মতোই সন্তানের প্রতি মা-বাবার স্নেহ ও মমতাও সর্বকালীন। প্যান্টশার্ট-স্কার্ট পরা মা-ই হোক, আর শাড়ি-শালোয়ার কামিজ কি গাছের বাকল বা পাতা পরা মা-ই হোক, সন্তানের প্রতি বাৎসল্যবোধ ও জীবন দিয়ে তাকে আগলে রাখার বাসনা সর্বত্রই সমান। সামাজিক মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক বিভাজন, রাজনৈতিক আদর্শ, ধর্মীয় বিধান কিছুই এই অপত্যস্নেহ, জোরালো মানববন্ধনকে দ্বিখণ্ডিত করতে পারে না। এই বন্ধনের শক্তি ও মমতার প্রকাশ সর্বত্রই প্রায় একই রকম।
বৃহত্তর মানবিক সম্পর্ক
শুধু নরনারীর সম্পর্ক বা বাৎসল্যবোধই নয়, শরীরের ভেতরের হরমোনগুলো বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর সম্পর্ক, সহকর্মী বা প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক, বৃহত্তর পরিবারের সঙ্গে পারিবারিক সদস্যদের সম্পর্ক এবং আরো ব্যাপক অর্থে সামগ্রিক মানবিক সম্পর্ক ও বন্ধনেরও ভিত্তি। স্পর্শ–যা মানব-সম্পর্কের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ–অক্সিটোসিন নির্গত করে স্পর্শ—যা শরীরে। বন্ধুর গায়ে বন্ধুসুলভ স্পর্শও অক্সিটোসিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। শরীরে হরমোনের বিভিন্ন মাত্রার উপস্থিতি এবং নানারকম হরমোনের সংশ্লিষ্টতা ও পারস্পরিক যোগাযোগ মানব সম্পর্কের ভিত্তি। যেমন ধরা যাক, এটা সর্বস্বীকৃত যে পুরুষে-পুরুষে বন্ধুত্ব ও মেয়েতে-মেয়েতে বন্ধুত্বের রকম ও প্রকাশ ভিন্ন। মেয়েলি হরমোনের প্রভাবে, বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মেয়ে-মেয়ে বন্ধুরা বিপদে বা সমস্যায় পড়লে পরস্পরের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলে, একে অন্যের পরিচর্যা করে, সাহায্য প্রার্থনা করে ও সাহায্য বিতরণ করে। এই সময় তারা পরস্পরের অনেক কাছে চলে আসে। অন্যদিকে পুরুষ- পুরুষ বন্ধুত্বে এই ধরনের সমস্যাসংকুল সময়ে দুঃসময়ে নিজেদের আড়াল করতে দেখা যায়। পুরুষরা তখন নিজেদের গর্তে বা খোলসে ঢুকে যায়, পরস্পরের কাছে নিজেদের খুলে ধরার বদলে এই সকল অনভিপ্রেত সময়ে পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে ভালোবাসে। আমরা সকলেই জানি, স্মৃতিশক্তি মানববন্ধনের একটা মস্ত বড় ভিত্তি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে আসে। বৃদ্ধ বয়সে ক্ষয়ে যাওয়া এই স্মৃতিক্ষমতার সঙ্গে শরীরের এস্ট্রোজেন বা টেস্টোস্টারোনের ঘাটতির সম্পর্ক রয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন।
এছাড়া, মানুষের মধ্যে দুটি পুরোপুরি বিপরীতমুখী প্রবণতা দেখা যায়। এক দল যারা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে নিঃস্বার্থভাবে অন্যের উপকার করে যায় এবং আরেক দল যারা মানসিক রোগে আক্রান্ত (যেমন অটিজম, Autism) হওয়ার কারণে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে, কারো সঙ্গে মানসিক বন্ধন অনুভব করতে অপারগ। এই উভয় বোধেরই একটা জৈবিক ভিত্তি রয়েছে এবং হরমোনের প্রভাবে এর অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হয়। অটিজমের অন্যতম কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে, যে-সব শিশু গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত টেস্টোস্টারোন হরমোনের সংস্পর্শে আসে, তাদের এই রোগে আক্রান্ত হবার বেশি সম্ভাবনা। বিজ্ঞানীরা অবশ্য এখনো নিশ্চিত নন, শত শত অপেক্ষমাণ দর্শকের মধ্যে হঠাৎ কেন একজন অপরিচিত ব্যক্তি নিজের জীবনের সম্পূর্ণ ঝুঁকি নিয়ে জ্বলন্ত আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্য এক আগন্তুককে রক্ষা করার জন্যে! অন্যরা কেন ঝাঁপিয়ে পড়ে না? শরীর বা মনের ভেতর কী সেই বস্তু যা তাকে প্রণোদিত করে এমন একটি মহৎ ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে? এটা সবটাই কি অর্জিত গুণাবলি? নাকি তার শরীরের ভেতর হঠাৎ করে বেড়ে ওঠা মাত্রাতিরিক্ত কোনো হরমোনের প্রভাব? এছাড়া, বহুগামিতা অথবা ব্যভিচারী হবার প্রবণতা, সমকামিতা, মাত্রাতিরিক্ত যৌন তাড়না, সামাজিকভাবে নিষিদ্ধ ঘনিষ্ঠ রক্তসম্পর্কের আত্মীয়ের মধ্যে যৌন সম্পর্ক স্থাপন (incest), ধর্ষণ, যৌন ঈর্ষা ও সন্দেহপরায়ণতা, যৌনতাজনিত অন্যান্য অপরাধের সঙ্গেও হরমোনের সম্পর্ক থাকতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। অবশ্য এ সব কিছুরই কেবলমাত্র জৈবিক ব্যাখ্যা যথেষ্ট নয়। পরিবেশ, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, সাধনা ও সুস্থ জীবনচর্চাও অনেক অন্তর্নিহিত জৈবিক প্রবণতাকে হ্রাস করতে বা উদ্দীপ্ত করতে সাহায্য করতে পারে। একইরকমভাবে, প্রাকৃতিকভাবে সন্তানের জনক-জননী না হওয়া সত্ত্বেও যে পালক-পিতামাতার মধ্যে সম পরিমাণ বাৎসল্যবোধের জন্ম হয়, সেটাও প্রমাণ করে—শুধু জরায়ুতে সন্তান গ্রহণ বা দুগ্ধদানই নয়, সন্তানের স্পর্শ ও তার প্রতি আগ্রহও সেইসব হরমোন সৃষ্টি করতে পারে যা মানুষকে বাৎসল্যবোধে সিক্ত করে। তাই ভালবাসার জৈবিক ভিত্তি যতই শক্তিশালী হোক-না কেন, পারস্পরিক সাহচর্য ও আদান-প্রদানের মাধ্যমে যে গভীর ও বহুমাত্রিক মানব-সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তার পেছনে দেহজ ও পরিবেশগত হয়তো আরও অনেক কারণ রয়েছে যার সন্ধান আমরা এখনও পাই নি।