একটি নারী-রাষ্ট্রের সন্ধানে
“Violence, be it individual, structural, or cultural, has been described as a preventable disease’ by the world Health Organization. To cure it, we need to transform our culture of violence to culture of Non – Killing. Non-Violence and Peace.”
-Corrigan Maguire,
Nobel Peace Laureate (1974)
তীব্র সামাজিক ভেদ, বিভেদ এবং অযৌক্তিকভাবে ও অবলীলায় একদল কর্তৃক আরেক দলের অধিকার হরণের নির্লজ্জ প্রবণতা ও প্রতিযোগিতায় আজকের সুশীল সমাজ প্রতিনিয়ত ক্ষত-বিক্ষত ও মর্মাহত। প্রচণ্ডতা ও রকমের হেরফের হলেও, আমার ধারণা, প্রায় সব বিভাজন ও বৈষম্যের জন্যই দায়ী পৌরুষতন্ত্র ও গোষ্ঠীপ্রেম- গোষ্ঠীবৈরিতা। একই দেশে পাশাপাশি বাস করা সত্ত্বেও একদলকে দিয়ে অন্য দলের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করার ও অত্যাচারের বহু নজির আমরা দেখেছি জীবদ্দশায়। ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মীয় বিভাজন থেকে শুরু করে একাত্তরে পাকবাহিনীর বাঙালি নিধন ও ধর্ষণ, আমেরিকায় ও দক্ষিণ আফ্রিকায় যুগ যুগ ধরে শ্বেতাঙ্গদের হাতে কৃষ্ণাঙ্গদের অবদমন, নাইজেরিয়ায় বায়াফ্রা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ইবোদের ওপর অত্যাচার, রাওয়ান্ডায় টুটসি সম্প্রদায়ের ওপর জেনোসাইড, বসনিয়ায় মুসলমান নিধন, দারফুরে গণহত্যা এবং পৃথিবীর সর্বত্র নারীর প্রতি গভীর অবহেলা ও অবিচার বারবার প্রমাণ করে যে মানুষে মানুষের বিভেদ ও বৈষম্য অতি জটিল ও বহুমাত্রিক একটি প্রক্রিয়া। কেবল রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক উন্নতি এ সমস্যা সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়।
আজ পৃথিবী জুড়ে যে হিংসা, দ্বেষ, অবিশ্বাস, সন্ত্রাস, যুদ্ধ, খুন, ধর্ষণ অবিরামভাবে ঘটে চলেছে, তাতে আমার বিশ্বাস-নারীর চিরন্তন গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্যের প্রতি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের আনুগত্য ও সম্মান প্রদর্শন এবং রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় সেই সব বৈশিষ্ট্যের প্রয়োগ ও প্রতিফলন, এই সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থির অবস্থাকে অনেকটাই প্রশমিত করতে পারে। শুধু দৃশ্যত শারীরিক বা জৈবিক বিভাজনই তো নয়, কেবল হরমোনের হেরফেরই তো নয়, জৈবরসায়নের মৌলিক ভিত্তি থেকে উৎসারিত এবং নিয়ন্ত্রিত সামাজিক পরিবেশে তিল তিল করে গড়ে ওঠা মেয়েদের চরিত্রের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি তাদের স্পষ্টতই আলাদা করে রাখে। সাধারণ মানবিক গুণাবলি বলে চিহ্নিত হলেও এসব বৈশিষ্ট্য প্রধানত ও বিশেষত নারীরাই ধারণ করে থাকে। এসবের মধ্যে রয়েছে—–ধৈর্য, সহনশীলতা, নিষ্ঠা ও একাগ্রতা, অন্যের প্রতি মমতা, সহানুভূতি ও সমবেদনা, ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি, দয়া, দাক্ষিণ্য, কোমলতা, কষ্টসহিষ্ণুতা, প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সহমর্মিতা, স্বার্থত্যাগের স্পৃহা, ভিন্নতার সঙ্গে বসবাসের ক্ষমতা, সমঝোতার মনোভাব ও বিনয়। চারদিকে যখন সন্ত্রাস, শত্রুতা, যুদ্ধ, বৈষয়িক অর্জনের নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা, লোভ-লালসা, সেখানে এখন বড় বেশি প্রয়োজন মেয়েদের শাশ্বত গুণাবলির বিকাশ। আর তা শুধু নারী প্রজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই চলবে না, এর উন্মেষ ও বিস্তার ঘটাতে হবে সমস্ত মনুষ্য সমাজে। অর্থাৎ পুরুষদের মধ্যেও।
ইদানীং Geert Hafstede-সহ কিছু গবেষক ও চিন্তাবিদ দুনিয়ার তাবৎ রাষ্ট্রকে নারী রাষ্ট্র অথবা পুরুষ রাষ্ট্র বলে আখ্যায়িত করেছেন। পুরুষ রাষ্ট্রের মধ্যে প্রথমেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালি। এছাড়া রয়েছে জাপান। নারী রাষ্ট্রের মধ্যে রয়েছে স্কেন্ডেনেভিয়ান দেশগুলো, যেমন——– সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক। এছাড়াও রয়েছে নারী রাষ্ট্র নেদারল্যান্ডস। নারীসুলভ দেশগুলোতে সাধারণ মানুষের মধ্যে সামাজিক কল্যাণমূলক অনেক বেশি প্রকল্প থাকে, যেমন—সাধারণ নাগরিকদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিনোদন, স্যানিটেশন, বাসস্থান ও নিরাপত্তার ভার সরকার সরাসরি গ্রহণ করে থাকে, যাতে জনসাধারণের মৌলিক চাহিদাগুলো অনায়াসে পূর্ণ হয়। অন্যদিকে পুরুষ রাষ্ট্রগুলোতে শ্রেণীবিভাজন প্রগাঢ় এবং সহমর্মিতার চেয়ে প্রতিযোগিতার প্রভাব সেখানে অনেক বেশি। এসব পুরুষ দেশে একদল লোক অনেক বেশি সম্পদের মালিক হয় এবং সমাজের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। অন্য দল লোকের তেল আনতে নুন ফুরোয়। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও প্রধানত অসুখ-বিসুখের চিকিৎসা ও রোগ নিরাময়ের দিকে লক্ষ রাখে পুরুষ রাষ্ট্র। নারী রাষ্ট্র তৈরি করতে চেষ্টা করে সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় গোটা পরিবেশ। স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা যে শুধু ওষুধ আর অস্ত্রোপ্রয়োগ নয়, স্বাস্থ্যের সঙ্গে যে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে শিক্ষা, বাসস্থান, বিশুদ্ধ বায়ু ও জল, ন্যূনতম জীবিকার নিশ্চয়তা, নারী রাষ্ট্র তা শুধু স্বীকার করে তা-ই নয়, সে ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় নীতিও তৈরি করে। ইদানীং তাই সেসব দেশে ‘healthcare’-এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘health promotion’-এর বিশেষ প্রকল্প, যেগুলো বিভিন্ন ক্ষেত্রের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি ব্যাপক ও ফলপ্রসু স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করে ও তা বাস্তবায়িত করার প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে, যাতে সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীও স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা মেটানোর সুযোগ পায়। নারী রাষ্ট্রে শিশু, প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ, উপার্জনহীন ও তুলনামূলকভাবে দুর্বল, অক্ষম অথবা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সামাজিক প্রকল্প থাকে। সম্পদের পরিমাণ নয়, জীবনের গুণগত মান ও মানবিক সম্পর্কের ওপর জোর দেয়া হয় নারী রাষ্ট্রে। অন্যদিকে পুরুষ রাষ্ট্রগুলোতে সম্পদ ও তার পরিমাণ এবং কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। জীবনের সার্থকতার সবচেয়ে বড় মাপকাঠি সেখানে চাকরি বা ব্যবসায়ে সাফল্য। সহমর্মিতার চেয়ে অনেক বেশি জোর দেয়া হয় পারস্পরিক প্রতিযোগিতার ওপর। কর্মজীবনকে ব্যক্তিজীবন থেকে আলাদা করে রাখে পুরুষ রাষ্ট্র। পক্ষান্তরে নারী রাষ্ট্র মনে করে, ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য, নিরাপত্তা ও স্বস্তি কর্মজীবনকে ফলপ্রসু করে তোলে। নারী রাষ্ট্র স্বীকার করে, ব্যক্তিজীবন ও পারিবারিক অবস্থা কর্মজীবনকে সরাসরি প্রভাবিত করে। ফলে নারী রাষ্ট্রের কর্মস্থানের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ অনেক বেশি উদার, নমনীয় ও সহনশীল। নারী রাষ্ট্র যেখানে সমাজে সমতা বিধান করে, পুরুষ রাষ্ট্র সেখানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণীবিভাগ ও অসমতা সৃষ্টি করে। পুরুষ ও নারী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধান পুরুষ না কি নারী হলেন, সেটা কিন্তু কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় কোন বৈশিষ্ট্য বা গুণাবলিকে ধারণ করা হচ্ছে সেটাই মূল কথা। ভারত উপমহাদেশের মতো পৃথিবীর অন্য কোথাও এত বেশি নারী সরকার প্রধানের অস্তিত্ব দেখা যায় না। কিন্তু তাই বলে কি এই উপমহাদেশের কোনো একটি রাষ্ট্রকেও নারী রাষ্ট্র বলে বিবেচনা করা যেতে পারে? মনে হয় না। আমরা আশা করব, আমাদের রাষ্ট্রের প্রতিটি নীতি ও কর্মসূচিতে নারীর শুভ ও কল্যাণময়ী রূপ প্রতিফলিত হবে।
একটি ব্যাপার লক্ষ করলে আমরা দেখব, পৃথিবীতে যত বড় বড় যুদ্ধ, যত রেষারেষি, যত সন্ত্রাস, যত দাঙ্গা, অপরাধ, এসিড নিক্ষেপ, খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ—— তার সিংহভাগ কর্মকাণ্ডের সঙ্গেই নারীর সরাসরি কোনো যোগাযোগ নেই। শুধু তাই নয়, এ ধরনের অপরাধের, অর্থাৎ, যুদ্ধের, দাঙ্গার এক মুখ্য শিকার নারী নিজে। লক্ষ করলে আমরা আরও দেখব, যুদ্ধবাজ বলে কুখ্যাত যেসব দেশ, আগ্রাসী বলে যারা বিশেষ পরিচিত, তারা সবাই পুরুষ রাষ্ট্র। নারী রাষ্ট্রগুলো সাধারণত যুদ্ধবিমুখ। সেখানে অপরাধের সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে অনেক কম, যেমন – সাধারণভাবে অপরাধের সংখ্যা ব্যক্তি পুরুষের চেয়ে ব্যক্তি নারীর মধ্যে অনেক কম। অপরাধের সঙ্গে নারীর সম্পৃক্ততা যেহেতু কম, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা যেহেতু তারা করে না, বলিষ্ঠতম প্রমাণ করার জন্য আগ্রাসী মনোভাব যেহেতু তাদের নেই, অথচ তাদের শরীরেই যেহেতু অঙ্কুরিত হয়-জন্ম নেয় পরবর্তী প্রজন্ম, তাদের হাতেই ভবিষ্যৎ নাগরিকরা প্রথম অক্ষর ও জাগতিক জ্ঞান লাভ করে, আজকের এই প্রবল হানাহানির জগতে ব্যক্তি নারীর একটি বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো, আগামী প্রজন্মকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা। তাদের মধ্যে পারস্পরিক প্রেম, ভালোবাসা, দয়া, দাক্ষিণ্য, ক্ষমা ও সহমর্মিতার বোধ জাগ্রত করা। নারীর দায়িত্ব এখন, যৌক্তিক মন ও বিজ্ঞানমনস্কতা দিয়ে মৌলিক সত্য ও সঠিক ইতিহাসকে নিজের মনে ধারণ করা ও পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে তা সঞ্চারিত করা। মানুষে মানুষে পার্থক্যের বদলে পারস্পরিক মিল ও অভিন্নতা খুঁজে দেখার আগ্রহ সৃষ্টি করা ও পরস্পরের প্রতি ক্ষমতা ও সহানুভূতির ভাব উদ্রেক করা। ভিন্নতার সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের মনোভাব এবং ব্যতিক্রমের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা নারীই শেখাতে পারে তার সন্তান ও পরবর্তী প্রজন্মকে। এটা সম্ভব এ কারণেও যে শুধু জননী হিসেবেই নয়, পেশাগত জীবনেও গৃহকর্ম, বেবি সিটিং, শিক্ষকতা, নার্সিং, চিকিৎসা ও সমাজসেবার মতো সেবামূলক জীবিকায় যেহেতু তুলনামূলকভাবে বেশি নারী অংশগ্রহণ করে থাকে, তাদের পক্ষে নিরপরাধ ও কৌতূহলী শিশুদের সঠিক পথে পরিচালনা করার সুযোগ অনেকটাই রয়েছে। স্থান, কাল, জাতি, ভাষা, ধর্ম নির্বিশেষে নারী নিজেই যেহেতু বিভেদের শিকার, অন্য সব বিভাজন ও বৈষম্য দেখে তার সহানুভূতির উদ্রেগ ও উপলব্ধি বেশি হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। ফলে মানুষে মানুষে ভেদাভেদজনিত এ দুঃসহ অবস্থা থেকে উত্তরণের পন্থা হিসেবে একটি নারী রাষ্ট্রের সন্ধান করা যেতেই পারে, যেখানে নারীর চিরন্তন গুণাবলিকে আত্মস্থ করবে জনগণ—রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নারীর যথার্থ মূল্যায়ন ঘটবে— আর জাতীয় কর্মসূচিতে প্রতিফলিত হবে নারীর সনাতন মূল্যবোধ। আমাদের মনে রাখতে হবে, একটি নারী যখন সন্তানসম্ভবা হয় এবং সন্তান প্রসব করে, সে শুধু ব্যক্তিগতভাবে একটি সন্তানের জননীই হয় না, সে সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য, পৃথিবীর মানবকুলের জন্য একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সন্তান ধারণ ও প্রসবের মধ্য দিয়ে সে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নাগরিক সৃষ্টি করে—তাবৎ মনুষ্য সমাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। আর এ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কর্মটি সম্পন্ন করার ক্ষমতা রয়েছে একমাত্র নারীরই। ফলে এই অতি প্রয়োজনীয় ও মহামূল্যবান দায়িত্ব পালনে রত একজন সন্তানসম্ভবা নারীকে বিশেষ সমাদর ও যত্ন করতে এবং তার সুবিধা-অসুবিধার দিকে লক্ষ রাখতে ও সব রকম প্রয়োজন মেটাতে বাধ্য শুধু তার পরিবার নয়—রাষ্ট্র নিজেও। কিন্তু এ দায়বদ্ধতা নারী রাষ্ট্রগুলো আক্ষরিক অর্থে যেভাবে পালন করে, পুরুষ রাষ্ট্ররা তা করে না। নারী অবশ্য প্রজন্ম সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হয় না। ভবিষ্যৎ নাগরিককে সুস্থভাবে বড় করে তোলার জন্য সে তার দ্বিতীয় অভিনব ও বিশেষ ক্ষমতানুযায়ী শরীর নিঃশেষিত দুগ্ধ দান করে। জননী নিঃসৃত সেই দুগ্ধ কেবল শিশুর শ্রেষ্ঠ খাদ্য আর পুষ্টিই নয়, তা তাকে জন্মলগ্নে এবং জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে নানারকম রোগবালাই থেকেও রক্ষা করে। নারী রাষ্ট্রগুলো রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ মজবুত করার অভিপ্রায়ে শিশুসন্তানের কর্মরত জননীদের প্রয়োজনীয় পরিবেশের নিশ্চয়তা দেয়, যেখানে তারা সন্তানকে নিশ্চিন্ত মনে দুগ্ধদানের সুযোগ ও সময় পায়। অধিকাংশ পুরুষ রাষ্ট্রে এ ধরনের সুযোগ থাকে না। এ দুগ্ধদানের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নারী ও শিশুর শরীরে যে জৈবিক ও রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে, হরমোনের যে ওঠানামা চলে, তাতে সন্তানের সঙ্গে মায়ের এক অচ্ছেদ্য ও গভীর সম্পর্ক নির্মিত হয়। সেই সঙ্গে সন্তানের মধ্যে জন্ম নেয় আত্মপ্রত্যয় ও প্রশান্তি।
যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে নারী ও নারী রাষ্ট্র বরাবরই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রবর্তন করার জন্য আলফ্রেড নোবেলকে প্রণোদনা দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার নারী ব্যারোনেস বার্থা ভন সাটনার। তিনিই প্রথম নারী, যিনি শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন ১৯০৫ সালে। এরপর শান্তির অন্বেষণে কাজ করতে গিয়ে আরও ১১ জন নারী নোবেলে শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন। গত ১০৭ বছর ধরে, নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনের পর এ পর্যন্ত, শান্তিতেই সবচেয়ে বেশি পুরস্কার পেয়েছেন নারীরা। এই থেকেও প্রমাণিত হয়, শান্তিতে নারীর আগ্রহের ব্যাপারটা। শুধু তাই নয়, জীবিত ৭ জন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নারীর মধ্যে ৬ জন মিলে (সপ্তম জন মিয়ানমারের অং সান সুকি মুক্ত না থাকায় এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না) ‘Nobel Woman’s Initiative’ নামে একটি আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। এ ৬ জনের এক জন কালো আফ্রিকান, ১ জন ইরানি মুসলমান, ১ জন ল্যাটিন আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান, ১ জন সাদা আমেরিকান ও ২ জন ক্যাথলিক আইরিশ। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নারীরা সব মহাদেশ থেকে এসেছেন, প্রায় সবকটি ধর্ম ও সব বর্ণের নারী রয়েছেন এ ১২ জন বিজয়ীর মধ্যে, যা প্রমাণ করে সব নারীই শান্তিকামী, যতই বৈচিত্র্যময় হোক না তাদের পারিবারিক ধারা অথবা জীবনচক্র। Nobel Woman’s Initiative-এর লক্ষ হলো ন্যায় ও সমতার মাধ্যমে মূলত পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাঁরা আন্দোলন করছেন—সেই সঙ্গে পরিবেশ রক্ষায়ও সচেষ্ট থাকছেন। অবিচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁরা সোচ্চার হচ্ছেন। তাঁদের আন্দোলনের মূল কথা—কোথাও কোনো শারীরিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ধর্মীয়, লৈঙ্গিক বা পরিবেশজনিত হুমকি বা আগ্রাসন থাকবে না; নারীর বিরুদ্ধে তো নয়ই, অন্য কোনো মানুষের বিরুদ্ধেও নয়।
এ ছাড়া পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে, জল ও ভূমিতে বর্জ্য ও আবর্জনার স্তুপ জমা ও শূন্যে ওজোন স্তরের মাত্রা কমে যাওয়াজনিত যেসব পরিবেশ দূষণ ঘটে চলেছে, সেসব ব্যাপারে সত্যিকারভাবেই নারীর সরাসরি হাত কমই রয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রকৃতিকে নারীর সঙ্গে তুলনা করে নারী ও প্রকৃতি উভয়েই যে অবহেলিত এবং দূরদৃষ্টিহীন পুরুষের লোভের ও স্বার্থপরতার শিকার এ কথা মনে রেখে ইদানীং ‘ইকোফেমিনিজম’ বলে একটি আন্দোলন ক্রমে দানা বেঁধে উঠছে। নারী মুক্তির সঙ্গে পরিবেশ মুক্তিকে একত্র করে এ আন্দোলন। যেহেতু সমাজের সবচেয়ে মৌলিক ইউনিটে অর্থাৎ পরিবারের খাদ্য, জল ও জ্বালানির ব্যবহার ও বণ্টন নারীই প্রধানত করে থাকে, প্রয়োজনে তাকেই সংগ্রহ করতে হয় বেঁচে থাকার এসব মৌলিক উপকরণ, স্বাভাবিকভাবেই এ প্রাকৃতিক সম্পদের দেখাশোনা ও সঠিকভাবে রক্ষা করার দায়িত্ব আস্তে আস্তে তুলে নিতে চাইছে নারী নিজের হাতে। এটা করা এ কারণেও জরুরি কেননা খরা, বন্যা, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ অথবা সন্ত্রাসের বড় শিকার নারী এবং তার শিশুসন্তান।.
সব শেষে একটা আশার কথা বলে শেষ করছি। এক বিজ্ঞানী কিছু দিন আগে আবিষ্কার করেছেন পুরুষ ও নারী যখন প্রেমে পড়ে, তখন তারা তাদের চিরন্তন স্বভাবের কিছুটা বিপরীতধর্মী আচরণ শুরু করে। এর কারণ তখন মেয়েদের শরীরে পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টারনের পরিমাণ বেড়ে যায়। আর পুরুষের শরীরে মেয়েলি হরমোন এস্টোজেনের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং সেই সঙ্গে পুরুষালি হরমোন টেস্টোস্টারনের পরিমাণ কিছুটা কমে যায়। এর ফলে প্রেমে পড়লে পুরুষ খানিকটা মেয়েদের মতো আচরণ করে। সে নমনীয়, স্নেহশীল ও যত্নবান হয়ে পড়ে। অন্যের প্রতি আগের তুলনায় বেশি খেয়াল রাখে। উল্টোদিকে মেয়েরা প্রেমে পড়লে কিছুটা বেপরোয়া কখনো অতি সাহসী হয়ে পড়ে। কাজকর্মে অগ্রণী ভূমিকা নেয় এবং নিজের আনন্দ ও ভোগবিলাসের প্রতি সচেতন হয়। ফলে তারা অর্থাৎ প্রেমে পড়া নারী ও পুরুষ পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসে তখন।
মানব সমাজে ভেদ-বিভেদের পরিবর্তে প্রেমের বন্যা বইয়ে দিতে নারী-পুরুষ উভয়কেই তাই নিজের সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থা থেকে কিছুটা সরে আসতে হবে। পুরুষকে তার আগ্রাসী ভূমিকা ছেড়ে অনেকটা নারীর মতো ধৈর্যশীল, পরমতসহিষ্ণু ও কল্যাণময় হয়ে উঠতে হবে। আর নারীকেও সেই সঙ্গে হতে হবে আরও বেশি অধিকার সচেতন, আত্মপ্রত্যয়ী ও সাহসী। নিজের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে এবং অন্যের ন্যায্য অধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে- সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য, তাকে নিতে হবে আরও বলিষ্ঠ ভূমিকা। আর সেটা সম্ভব হবে পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, সহানুভূতি ও শ্রদ্ধাবোধ থেকে, প্রতিহিংসা, ঘৃণা বা যুদ্ধংদেহী মনোভাব থেকে নয়। আর একটি নারী রাষ্ট্রই কেবল পারে নারী ও পুরুষের জন্য সে রকম কাঙ্ক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টি করতে।