সুমাতা যদি হয় সুপিতা কেন নয়
কয়েক বছর আগে এক আমেরিকান নৃতাত্ত্বিকের গবেষণার তথ্য পড়েছিলাম এক জার্নালে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বিবাহ বিচ্ছেদের প্রকৃতি, প্রকোপ ও কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে আনুষঙ্গিক আরো কিছু তথ্য উদ্ঘাটন করেছিলেন যা কেবল এই দেশের জন্যেই প্রযোজ্য নয়— যার আবেদন সর্বজনীন। মানবজাতির শরীর, তার গঠন, প্রকৃতি এবং পরিচর্যা সম্বন্ধেও বেশ কিছু নতুন তথ্য জানা গিয়েছিল সেই নিবন্ধে।
এই নৃতাত্ত্বিক লক্ষ করেছেন যে, বিবাহিত দম্পতির মধ্যে বিচ্ছেদের হার সবচেয়ে বেশি যাদের সাত বছরের অধিককাল হলো বিয়ে হয়েছে অথচ সন্তান হয় নি। তিনি আরো দেখলেন, যেসব দম্পতির প্রথম সন্তানের বয়স ছয় বা সাত পেরিয়ে যাবার পরও দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয় নি, তাদের মধ্যেও বিচ্ছেদের হার বেশি। অথচ পাঁচ বছরের মধ্যে যাদের দ্বিতীয় সন্তান জন্মেছে, তাদের বিয়ে ভেঙেছে খুব কম। অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রথমেই যেটা সাধারণভাবে মনে আসে, তা হলো সন্তান হয়তো একটি সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। দু জনের সম্মিলিত সৃষ্টি এই সন্তান হয়তো তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নত ও সুখকর করতে সাহায্য করে। কিন্তু এই নৃতাত্ত্বিকের মতে ব্যাপারটা অত সহজ নয়। সন্তান পিতামাতার সম্পর্কে এক ধরনের সেতুবন্ধন সৃষ্টি করে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। আসল কথা হলো, জন্মের পর মানবশিশুর লালন-পালন ও পরিচর্যার প্রয়োজন হয় জীবজগতের অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ এই গবেষক উল্লেখ করেছেন, একজন ষাট কেজি ওজনের মায়ের নবজাত সন্তানের ওজন হয় গড়ে মাত্র আড়াই থেকে সাড়ে চার কেজি। অর্থাৎ মানবশিশু তুলনামূলকভাবে আকৃতিতে অত্যন্ত ছোট ও কাঠামোগতভাবে বেশ নাজুক হয়ে জন্মায়। ফলে গরু, ছাগল, বাঘ বা কুকুরের বাচ্চারা জন্মের কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যেমন হেঁটে-চলে বেড়াতে পারে ও খেতে পারে, মানবশিশুর লাগে বেশ কয়েক বছর সেই অবস্থায় পৌঁছাতে। আর তাই জন্মের প্রাথমিক বছরগুলোতে তাদের পরিচর্যায় এতটাই ব্যস্ত থাকতে হয় পিতামাতাকে যে, নিজেদের জীবনের সমস্যাবলি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না তখন। মোট কথা, প্রকৃতিগতভাবেই মানবশিশু বেশি পরমুখাপেক্ষী ও নির্ভরশীল। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে গবেষক বলেছিলেন, যখন থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে চার হাত-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলার বদলে দুই পায়ে ভর করে লম্বা হয়ে চলতে শিখল মানুষ তখন থেকেই হয়তো এই পরিবর্তনের সূচনা। কেননা সোজা হয়ে চলার জন্যে জরায়ুর আয়তন কমে গেছে মানুষের, যার ফলে তাদের গর্ভজাত সন্তানের ওজনও হয় অন্য জীবজন্তুর অনুপাতে তুলনামূলকভাবে কম। এ গবেষকের নামটাও আজ আর আমার মনে পড়ে না। তবে তাঁর এই থিয়োরির যথার্থতা কেউ চ্যালেঞ্জ করেছিল অথবা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল বলে শুনি নি। সেই যাই হোক, একটা কথা এই তথ্য থেকে পরিষ্কার, যে ব্যাপারে কারো দ্বিমত থাকবে বলে মনে হয় না, তা হলো মানবশিশুর প্রতিপালন ও পরিচর্যার প্রয়োজন জীবজগতে অন্যান্য পশুপাখির চাইতে অনেক বেশি— এর সবটাই সামাজিকভাবে আরোপিত বা অর্জিত জ্ঞান নয়, বাস্তব ও প্রাকৃতিক সত্য। কিন্তু কেবল এটুকু সত্যকে ভিত্তি করে যুগে যুগে দেশে দেশে প্রচুর কিংবদন্তি, প্রচুর কল্পকাহিনী, প্রচুর অপব্যাখ্যার সৃষ্টি হয়েছে। সমাজে এ কথা জোরেশোরে বোঝানো হয়েছে যে সন্তান পালনের দায়িত্ব একমাত্র মায়ের। এ ছাড়া প্রজনন-প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখাই নারীর সর্বপ্রধান ও সর্বপ্রথম কাজ। অর্থাৎ নারীর সবচেয়ে বড় কর্তব্য সন্তান ধারণ, প্রসব ও লালন-পালন। স্বীকার করি, এখন পর্যন্ত সন্তান ধারণ ও প্রসব কেবল মেয়েদের দ্বারাই সম্ভব। “এখন পর্যন্ত” ঐ কথাটা বললাম এ জন্যে যে, নব্য প্রজনন-প্রযুক্তির সাহায্যে টেস্ট টিউবে ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলনে সৃষ্ট ভ্রূণকে ষাটোর্ধ্ব মহিলাদের জরায়ুতে স্থাপন করে যেমন সন্তানের জন্ম সম্ভব হচ্ছে, একই পদ্ধতিতে কোনো একদিন পুরুষের পক্ষেও সন্তান ধারণ সম্ভব হতে পারে। আমি অন্তত তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিজ্ঞানসম্মত এ সম্ভাবনা সম্পূর্ণ নাকচ করে দিতে পারি না। এর জন্যে যা প্রয়োজন পুরুষের, তা হলো জরায়ুর মতো মাংসল, মজবুত ও ইলাস্টিক একটি অঙ্গ, বাইরে থেকে দেওয়া মেয়েলি হরমোন ও সিজারিয়ান অপারেশন। হরমোন অবশ্য পূর্বকথিত মাতা-হতে-ইচ্ছুক সেই ষাটোর্ধ্ব মহিলাদেরও সরবরাহ করতে হয়। কেননা তারা রজস্বলা নয় এবং তাদের ডিম্বাশয়ে যথেষ্ট পরিমাণে এই হরমোন তৈরি করতে পারে না। এইসব মায়েদের অধিকাংশই সিজারিয়ান পদ্ধতিতে সন্তানের জন্ম দেয়।
যেহেতু এ দুটি গুরুদায়িত্ব সন্তান ধারণ ও সন্তান প্রসব—–সম্পূর্ণভাবে পালন করছে মেয়েরা, সুষম ও ন্যায্য শ্রম তথা দায়িত্ব বণ্টনের কথা চিন্তা করলে এবং সভ্যতার স্বার্থে বাকি দায়িত্বটা (অর্থাৎ সন্তান লালন করা) এককভাবে ছেলেদেরই ঘাড়ে নেওয়া উচিত। কিন্তু কার্যত পুরুষরা এ দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিতেও নারাজ। সন্তান পরিচর্যার ব্যাপারটা একমাত্র মেয়েদেরই কর্তব্য, এ বিশ্বাস বা মূল্যবোধ যে সম্পূর্ণটাই সামাজিকভাবে অর্জিত ও আরোপিত এবং এর যে প্রাকৃতিক কোনো ব্যাখ্যা নেই বা বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি নেই এ কথা কেউ তলিয়ে দেখে না বা ভাবে না। সন্তান প্রতিপালনের একেবারে প্রাথমিক দিকে মায়ের একটি বিশেষ ভূমিকা অবশ্যই রয়েছে— আর তা হলো বুকের দুধ পরিবেশন, যা পিতার পক্ষে করা সম্ভব নয়। এই একটি মাত্র ব্যাপার ছাড়া সন্তান লালন-পালনে পিতামাতার দায়িত্ব বা ভূমিকায় কোনো পার্থক্য নেই, থাকা উচিত নয়। এটা সর্বজনবিদিত ও বিজ্ঞানশাস্ত্রমতে স্বীকৃত যে, মায়ের দুধের বিকল্প নেই। শিশুর স্বাস্থ্য ও রোগ-প্রতিরোধ এবং খরচের কথা চিন্তা করলে মায়ের দুধই সবচেয়ে উত্তম খাবার। বিশেষ করে প্রসবের অব্যবহিত পরে এ দুধের প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু প্রশ্ন হলো—কতদিন বুকের দুধ খাওয়াতে হবে, খাওয়ানো উচিত? উত্তর হলো—যতদিন সম্ভব ততদিনই—সেটা কয়েক সপ্তাহ থেকে দু বছর পর্যন্ত হতে পারে। সে সময়টা নির্ভর করবে অনেকগুলো বিষয়ের ওপর, যার সম্মিলিত যোগফলই মায়ের জীবন। সন্তান অবশ্যই মায়ের সবচেয়ে প্রিয় ধন, সবার চেয়ে আপন। কিন্তু সন্তানের বাইরেও তার একটা জীবন রয়েছে যা অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করার মতো সামান্য নাও হতে পারে সকল মায়ের জন্যে। সবচেয়ে বড় কথা, মানুষের একটাই তো জীবন। আত্মত্যাগ, স্বার্থহীনতা, উদারতা সবই খুব ভালো ও প্রশংসনীয় মানবিক গুণ— বিশেষ করে তা যখন সন্তানের ব্যাপারে প্রযোজ্য হয়। কিন্তু সন্তানের জন্যে নিজের পেশা, সুখ, পছন্দ, বিনোদন, সুকুমারবৃত্তির চর্চা সবকিছু বিসর্জন দিয়ে কোনো নারী যদি সুখী হতে না পারে, পরিতৃপ্তি না পায়, তার সে প্রতিক্রিয়াকে কি অস্বাভাবিক বলে গণ্য করা হবে? সমাজ ও পরিবারের চাপে আদর্শ মা সাজার আশায় এ ধরনের আত্মাহুতি দিয়ে কত সহস্ৰ মা যে নীরবে কেঁদে চলেছে, তাদের চোখের জল মুছিয়ে দেবে কে? সন্তান, স্বামী, না সমাজ? না, কেউ নয়। মায়ের স্বার্থত্যাগ ও যাবতীয় জাগতিক ভোগবিলাস পরিহার মানেই যে সন্তানের শুদ্ধি বা সাফল্যের নিশ্চয়তা নয়, এ কথাটাও কেউ বুঝতে চায় না। সবচেয়ে বড় কথা, পুত্রকন্যা সাবালক হয়ে তাকে ছেড়ে চলে যাবার পরও মাকে হয়তো বেশ কিছুকাল বেঁচে থাকতে হয়। তখন পরিপূর্ণভাবে সন্তানে নিবেদিতপ্রাণ মায়েরা, যারা স্বামীর সঙ্গে বয়সের স্বাভাবিক পার্থক্যজনিত কারণে ততদিনে অনেকেই হয়তো বিধবা, কেমন করে বাকি জীবনটা অর্থবহ করে তুলবে—সেটা বিবেচনায় আনা উচিত। আর তাই, কত দিন সন্তানকে দুগ্ধদান করা হবে, কত দিন কাজ থেকে অবসর নিতে হবে, এ ব্যাপারটায় প্রতিটি মা ও পরিবারকে নিজস্ব চাওয়া-পাওয়া, সুবিধে-অসুবিধে এবং সর্বোপরি সন্তানের মঙ্গল ও নিরাপত্তা চিন্তা করে একটি সামগ্রিক সিদ্ধান্তে আসতে হবে এবং তা কার্যকর করতে হবে। কোনো একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত বা পদ্ধতি সকলের জন্যে গ্রহণীয়, মঙ্গলকর বা চূড়ান্ত মানদণ্ড বলে ধরে নেওয়া ঠিক নয়। সেটা যারা করে, তাদের পক্ষেই বিনা দ্বিধায় চাকরিজীবী মায়েদের “খারাপ” বা “ব্যর্থ” মা বলে অভিহিত করা সম্ভব।
বস্তুত সন্তান প্রতিপালনের গোটা দায়িত্ব কেবল পিতা অথবা কেবল মাতার হতে পারে না। এটা একটা যৌথ দায়িত্ব। তবে প্রয়োজনে দু জনের যে কেউ সে দায়িত্ব গ্রহণ করতে ও যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম। জন্মের আগে পিতার মৃত্যু ঘটেছে কত জনের, তারা সকলেই ভেসে যায় নি। আমরা ওইসব উপজাতীয়দের কথা শুনেছি, যাদের একদল সন্তানদের জন্মের পর মাকে মেরে ফেলত — অন্যদল মেরে ফেলত বাপদের। সন্তানদের বড় করতে কোনো দলেই বিঘ্ন ঘটে নি, কেননা উভয় ক্ষেত্রেই সমাজ তাদের রক্ষণাবেক্ষণ করেছে। সে যাই হোক, মোট কথা, আদর্শ পরিবারে পিতামাতার উভয়েই বিদ্যমান থাকবে, তারা দু জন মিলেমিশেই সন্তান প্রতিপালন করবে। সে অবস্থায় সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর শুধু মায়ের নয়, পিতারও যথেষ্ট সময় দেওয়া উচিত। শিশুর দেখাশোনার জন্যে তো বটেই, প্রসূতির যত্নের জন্যেও। সন্তান ধারণ ও প্রসবের মতো দীর্ঘ কষ্টকর ও জটিল প্রক্রিয়া একটি মেয়ের শরীরের ওপর দিয়ে যে পরিমাণ তুফান বইয়ে দিয়ে যায়, তারপর তারও প্রয়োজন হয় খানিকটা নিরবচ্ছিন্ন বিশ্রাম—খানিকটা আয়েশের। অথচ শিশুর পরিচর্যা পুরোপুরি মায়ের ওপর ন্যস্ত বলে সে নিজের দিকে, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও, নজর দিতে পারে না। সুইডেনের মতো দেশে মা-বাবা দু জনেই সন্তান জন্মের পর বাধ্যতামূলক ছুটি ভোগ করে। অবশ্য সেসব দেশে জন্মের হার এত কম যে, সন্তানের জন্মের ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে অনুপ্রেরণা ও আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়। উল্টোদিকে আমেরিকার মতো দেশে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে এই কিছুকাল আগে পর্যন্তও বেতনসমেত কোনো ম্যাটার্নিটি লিভ ছিল না। আমার মনে আছে ওই দেশে আমার দুই সন্তানের জন্মের সময় আমি কেবল আমার অর্জিত ছুটি নিতে পেরেছিলাম। “সিক লিভ”ও নেওয়া যায় নি কেননা জন্মদান একটি স্বাভাবিক ও সুস্থ প্রক্রিয়া——অসুস্থতা নয়। শুনেছি “সিক লিভ” ব্যবহার করার জন্য কেউ কেউ নানান কলাকৌশল অবলম্বন করে। ডাক্তারদের কাছ থেকে এই মর্মে সার্টিফিকেট আদায় করে নেয় যে, কোনো বিশেষ জটিলতার কারণে তাদের পক্ষে এই অবস্থায় চাকরি করা ঝুঁকিপূর্ণ। অবশ্য সন্তান জন্ম দেবার জন্যে সাধারণত আজকাল কিছুদিন বেতন-ছাড়া ছুটি পাওয়া যায়। তবে তা দীর্ঘায়িত করতে গেলে চাকরি হারাবার সম্ভাবনাও থাকে যথেষ্ট। এখন কথা হলো, সন্তান প্রতিপালনের জন্যে যদি মাকে চাকরি হারাতে হয় অথবা মায়ের যদি এমন জীবিকা হয় যা থেকে দীর্ঘদিন অবসর গ্রহণ করলে কাজে ফিরে যাওয়া অসম্ভব, সেক্ষেত্রে তার করণীয় কী হবে? উত্তরটা কারো কারো কাছে সহজ হলেও অনেকের কাছে নয়। যাঁরা মনে করেন মায়েদের বা মেয়েদের প্রধান এবং একমাত্র দায়িত্ব সন্তান লালন-পালন, তাঁরা অবশ্যই বলবেন— চাকরি ছেড়ে দিয়ে সন্তান বড় করা উচিত। তাঁরা আরো বলবেন, চাকরিই যদি করবে, তবে মা হলে কেন? ভাবখানা এমন যেন মা হবার জন্যে সে একাই দায়ী ছিল। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে রাস্তায় বাচ্চা কোলে কোনো ভিখারিনী (বিশেষ করে যদি অল্পবয়সী হয়) সাহায্য চাইতে এলে অনেক পথচারী এ ধরনের অশ্লীল ও কটু মন্তব্য করেন। তাঁদের উক্তি বা চিন্তার পেছনে কি এই ধারণা কাজ করে যে, এই শিশুটির জন্মের জন্যে অথবা কেবলমাত্র নিজের শারীরিক আনন্দের জন্যে মেয়েটি হাতে পায়ে ধরে কাকুতিমিনতি করেছিল কোনো পুরুষ সঙ্গীর কাছে? মনুষ্যজাতির যৌন আচরণ ও মানজন্মের আসল রহস্য তো কারো অজানা নয়। তবু শিক্ষিত লোকেরা পর্যন্ত এ ধরনের অমানবিক ও অযৌক্তিক মন্তব্য কেমন করে করেন অনায়াসে! এসব উক্তি যে কী রকম অবিবেচনাপ্রসূত ও নিষ্ঠুর, তা তাঁরা একবারও ভেবে দেখেন না। কেবলমাত্র মাতৃত্বের কারণে প্রবল প্রতিযোগিতালব্ধ উচ্চশিক্ষা ও ট্রেনিং বিন্দুমাত্র কাজে না লাগিয়ে মেয়েরা সন্তানের বা সংসারের উপকার কতটা করছেন বলা মুশকিল। কিন্তু বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও শ্রমশক্তির উন্নয়ন ও দেশের সম্পদের সদ্ব্যবহারের কথা ভাবলে তাদের এ সিদ্ধান্ত যে বিশাল এক জাতীয় অপচয় এ কথা অস্বীকার করা যায় না।
সন্তানের পরিচর্যা ও লালন-পালন মায়ের দায়িত্ব এবং এই কাজে সে যথেষ্ট আনন্দ পায় এটা সত্য। আবার আত্মপ্রত্যয় ও স্বাবলম্বিতার জন্যে, তার ব্যক্তিসত্তার সাফল্য ও পরিপূর্ণতার জন্যে, তার চাকরিরও প্রয়োজন। এর সুষ্ঠু সমাধান কী করে সম্ভব? সম্ভব এভাবে যে, জন্মের পর প্রথম কয়েক সপ্তাহ মা সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াবে (যেহেতু গুণগতভাবে এ দুধের সঙ্গে অন্য কোনো খাদ্যের তুলনা হয় না), তার যত্নাদি করবে, নিজেকে সুস্থ করে তুলবে। সেটুকু সময়ের জন্যে সে কাজ থেকে অবসর নেবে। তারপর যদি তাকে কাজে ফিরে যেতে হয়, সে ফিরে যাবে শিশুর পরিচর্যার বিকল্প ব্যবস্থা করে, যার একটা বড় অংশ তার স্বামীকেই বহন করতে হবে। উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারে যাদের ঘরে রেফ্রিজারেটর রয়েছে, তারা পাম্প করে বুকের দুধ রেখে যেতে পারেন বোতলে তাদের অনুপস্থিতিতে শিশুদের খাওয়াবার জন্যে। কিছু কিছু কর্মক্ষেত্রে মায়ের পক্ষে কাজের মাঝখানে এসেও সন্তানকে অন্তত এক বা দু-বার খাইয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। পশ্চিমা দেশগুলোর বহু কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। কোনো কোনো মায়ের শরীরে শিশুর চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত দুধের সৃষ্টি হয়। অনেককে শারীরিক স্বস্তি ও সুস্থতার জন্যে এই বাড়তি দুধ স্তন থেকে চেষ্টা করে বের করে ফেলে দিতে হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে হাসপাতাল ও অন্যান্য ক্লিনিকগুলোতে সেই বাড়তি দুধ সংগ্রহ ও একত্রিত করে বিনামূল্যে বিতরণ করা হত সেইসব শিশুদের মধ্যে যাদের মায়েরা পেশাগত বা অসুস্থতার কারণে স্তন্যদান করতে অসমর্থ অথবা যেসব শিশুর মায়েদের বক্ষনিঃসৃত দুধের পরিমাণ সন্তানের প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।
স্বাস্থ্যসম্মতভাবে সংগৃহীত ও সংরক্ষিত মায়েদের দুধ অনুরূপভাবে বিতরণের ব্যবস্থা আমাদের দেশেও চালু করা যেতে পারে। পাশ্চাত্যের অনেক দেশে চাকরিজীবী মায়েদের জন্যে সেই কোম্পানির ভেতরই নার্সারি রয়ে গেছে—যাতে মা শিশুকে কাছাকাছি রেখে নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারে। এ ছাড়া কাজের ফাঁকে ফাঁকে শিশুকে দেখে আসতে ও খাওয়াতে পারে। কোম্পানির ভেতর নার্সারি খোলার এই ধারণাটি যখন প্রথম বিবেচনা করা হচ্ছিল, তখন অনেক শিল্পপতির মনে হয়েছিল এতে করে হয়তো মায়েরা কাজে মনোযোগ দিতে পারবে না, সন্তানের কাছেই মন পড়ে থাকবে তাদের। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা গেছে, যেসব কোম্পানিতে নার্সারি রয়েছে, সেখানে মায়েদের অনুপস্থিতির হার অনেক কম, তাদের কাজে পারদর্শিতা ও মনোযোগও অনেক বেশি। কয়েক বছর আগে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রেও এ ধরনের একটি নার্সারি খোলার কথা শুনেছিলাম। এ ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে অনুরূপ ব্যবস্থা রয়েছে বলে শুনি নি। আমাদের দেশে পশ্চিমা দেশের অনুকরণে কত কিছুই তো করছে আজকাল। অথচ নার্সারির ব্যাপারে এখনো প্রাগৈতিহাসিক চিন্তায় ডুবে আছে সকলে। ভাবখানা এমন—যেন মা ছাড়া সন্তান প্রতিপালন মানেই সন্তানের বারোটা বেজে যাওয়া। ব্যাপারটা যে সর্বাংশে সত্য নয়, তার প্রমাণ মেলে একটু ভাবলেই যে, জগতের বহু জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তির মাতৃবিয়োগ ঘটেছে শৈশবে। আমাদের আশেপাশে পরিচিতদের মধ্যে তাকালেও সেটা বুঝতে পারি আমরা। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যদিও কৈশোরে মাতৃহারা হয়েছিলেন, শিশুকাল থেকেই তাঁর এবং ঠাকুরবাড়ির অন্যান্য শিশুদের প্রতিপালনের ভার মুখ্যত ছিল বাড়ির অভিজ্ঞ পরিচারক-পরিচারিকার হাতে মায়েদের হাতে নয়। তাদের মানসিক বিকাশ বা উৎকর্ষ সাধন তাতে বাধাপ্ৰাপ্ত হয়েছে এমন কথা কেউ নিশ্চয়ই দাবি করবেন না। কথা হলো, আমাদের যুগ যুগ ধরে গড়ে ওঠা ও লালন করা স্টেরিওটাইপ্ড্ ধারণা বদলাতে হবে। কী করে সন্তান বড় করলে সে মানুষের মতো মানুষ হবে কেউ আগেভাগে তা বলতে পারেন না। পারিবারিক ধারা, পুষ্টি, অনুপ্রেরণা ও তথ্যের সরবরাহ, স্নেহ, স্বস্তি, গৃহ ও পারিবারিক পরিবেশ, বিদ্যালয়, শিক্ষক, বন্ধু, কোনো বিশেষ ব্যক্তিত্ব অথবা ঘটনা ইত্যাদি বহু কিছুর ওপর তার পরিণতি নির্ভর করে। মা জন্মের পর দু বছর পর্যন্ত দুগ্ধ দান না করতে পারলেই সন্তানের স্বাস্থ্য স্থায়ীভাবে খারাপ থাকবে অথবা মায়ের সঙ্গে তার বন্ধন শিথিল হয়ে পড়বে——–—এ কথা যেমন বলা যায় না, তেমনি মায়ের সর্বক্ষণ স্নেহের ছায়ায় থাকলে এবং তার হাতের ভালোটা মন্দটা খেয়ে তার আদর ও শাসনে বড় হলেই সে যে পরিপূর্ণ ও সার্থক মানুষ হয়ে উঠবে এ কথাও জোর দিয়ে বলা যায় না। সন্তান প্রতিপালনের মতো শিশুদের মানসিক গঠন ও বিকাশও জটিল একটি প্রক্রিয়া। এর নির্ধারিত কোনো পথ যেমন বাঁধা নেই, গাণিতিক সূত্রের মতো সহজ-সরল কোনো সমীকরণ আবিষ্কৃতও হয় নি। অনেককে এ কথা বলতে শুনেছি যে, মাতাপিতার বিচ্ছেদ ঘটলে সন্তান কোনোমতেই সুস্থ ও সার্থক মানুষে পরিণত হতে পারে না। এমন বদ্ধমূল ধারণায় বিশ্বাস স্থাপন একান্তই অযৌক্তিক। স্বাভাবিক ও বাহিত প্রক্রিয়ায় সন্তানের গঠন ও বিকাশে অবশ্যই মা-বাবা দু জনেরই প্রয়োজন আছে। কিন্তু আধুনিক জীবনের নানা জটিলতা ও আবর্তে এমন পরিস্থিতির যদি উদ্ভব হয়ই, যখন দুটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের একত্রে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে, সেখানে এক ঘরের ভেতর প্রতিনিয়ত ঝগড়া, দ্বন্দ্ব, অশান্তিতে থেকে যে-পরিবেশ তারা সন্তানকে দিতে পারবে, তার চাইতে ঢের বেশি সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন হয়তো তারা সন্তানকে দিতে পারে বিচ্ছেদ মেনে নিয়ে এককভাবে বা নতুন জীবনসঙ্গীর সঙ্গে শান্তিময় পরিবেশে সন্তানকে বড় করলে। অবশ্য সেক্ষেত্রেও সন্তানের সামনে পিতামাতার পরস্পরের সম্পর্কে কূটক্তি করা চলবে না। জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবে এ পরিস্থিতি মেনে নেবার পরামর্শই দিতে হবে সন্তানকে। সেইসঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে যাতে দু জনের স্নেহই ভোগ করতে পারে শিশুটি, তার উপযুক্ত ব্যবস্থাও করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, শিশুরা যতটা নাজুক, যতটা স্থায়ীভাবে পরিবেশ বা পরিস্থিতির শিকার বলে আমরা মনে করি, তারা ততটা নয়। আমাদের ধারণার চাইতে অনেক বেশি শক্ত ও সহনশীল তারা। বিশেষ করে সাময়িক ঝড়ঝাপ্টা ও বাধা ডিঙিয়ে আবার পুনর্জীবিত হয়ে উঠতে শিশুদের জুড়ি নেই।
গৃহিণী-মাতা ও কর্মজীবী-মাতার মধ্যে সন্তানের কল্যাণের কথা চিন্তা করলে সর্বাংশেই একজন ভালো এবং আরেকজন মন্দ এ কথা বলা যায় না। যাঁরা সার্বক্ষণিক গৃহিণী, বাইরের কাজ করেন না বা করতে চান না, ঘর ও বাইরে এই জটিল দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয় না তাঁদের। সংসারে কাজের বিভাজনে স্বামী সেখানে বাইরে যান, উপার্জন করে ঘরে আনেন। স্ত্রী ঘর-সংসার দেখেন, সন্তান ধারণ ও প্রতিপালন করেন। স্বেচ্ছায় যে-স্ত্রী এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন বা মেনে নিয়েছেন তিনি সমাজের দাবি পূরণ করেছেন। ফলে তাঁর মাতৃত্বের বিশুদ্ধতায় কেউ সন্দিহান নয়। আসলেই গৃহিণী মায়েরা এক অর্থে সৌভাগ্যবতী কেননা সন্তানকে বেশি সময় তাঁরা দিতে পারেন, নিজের হাতে তাদের খাওয়াতে পারেন, যত্ন করার সময়ও পান বেশি। কিন্তু কর্মজীবী মায়েরা অনেকে এ ঘাটতি পুষিয়ে দেন সন্তানের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও নিরাপত্তার ব্যাপারটায় যাতে অবহেলা না হয় তার যথাযথ ব্যবস্থা করে, তার মানসিক গঠনের জন্যে বাইরের নানান অভিজ্ঞতা ও তথ্য দিয়ে তাকে অনুপ্রাণিত ও সমৃদ্ধ করে। সবচেয়ে বড় কথা, মা হিসেবে সময়ের পরিমাণের চাইতে সময়ের মানগত দিকটার গুরুত্ব বেশি। কোনো মা সারাক্ষণ ঘরে থাকা সত্ত্বেও সন্তানের দিকে তেমন নজর নাও দিতে পারেন। যদি কোনো মা সর্বদা ঘরকন্না ও শিশুর আবদারে হাঁফ ছাড়ার সুযোগ না পেয়ে ক্লান্তিতে ও একঘেয়েমিতে শরীর টেনে বেড়ান, তাঁর পক্ষে সন্তানের সঙ্গে নিবিষ্ট সময়দান বা ফুর্তির আয়োজন করা সম্ভব নাও হতে পারে। অন্যদিকে যে মায়েরা সারাদিন পর কাজ থেকে ঘরে ফেরেন, তাঁদের অনেকেই, যেটুকু জাগ্রত সময় হাতে পান সন্তানের সঙ্গে সেটুকু সারাদিনের হয়ে ভরিয়ে দেবার চেষ্টা করেন। এই সময়টুকুতে যে একনিষ্ঠতা ও গভীরতা তাঁরা দান করেন শিশুকে, সার্বক্ষণিক সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হলে তা হয়তো সম্ভব নাও হতে পারত অনেকের জন্যে। সারাদিন সন্তানকে ফেলে কাজে যাবার অপরাধবোধ থেকেও সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে সন্তানের প্রতি কিছুটা অতিরিক্ত নজর দেন কর্মজীবী মায়েরা। তবে সতর্ক হতে হবে যাতে এ অপরাধবোধ তেমন পর্যায়ে চলে না যায় যা অনেক কর্মজীবী মায়েদের দুরবস্থা বা অপবাদের জন্যে বিশেষভাবে দায়ী। সমাজ-স্বীকৃত ও আরোপিত দায়িত্ব অগ্রাহ্য করে শিশুকে রেখে কাজে যাবার গ্লানি ও অপরাধবোধ থেকে অনেক মা সন্তানের যাবতীয় বাড়াবাড়ি আবদার ও জাগতিক চাহিদা বিনা শর্তে মেনে নেন। পেশাগত কারণে তাঁর অনুপস্থিতি যে ক্ষতি করে না, অপরাধজনিত এই বাড়তি উপহার অথবা প্রশ্রয় প্রদান সন্তানের মানসিক গঠন ও বিকাশলাভে সেই ক্ষতি করে। অতএব এই অপরাধবোধ জয় করতে হবে। নিজেকে বোঝাতে হবে যে বাইরে কাজ করতে গিয়ে সন্তানের প্রতি অবিচার তিনি করছেন না। সন্তানের কাছে তিনি আদর্শ দৃষ্টান্ত— অপরাধী নন। অনেক মাকে দেখা যায় আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, স্বামীর বেকারত্ব, অসুস্থতা অথবা মৃত্যুতে হঠাৎ করে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই সংসারের অর্থনৈতিক দায়িত্ব কাঁধে নিতে। একইভাবে অনেক পিতাও অসময়ে স্ত্রীর মৃত্যুতে বাধ্য হয়ে সন্তান পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাদের প্রাত্যহিক কাজের বিভাজন এত স্পষ্ট না হলে এবং দু জনেই সব কাজ আগে থেকেই ভাগাভাগি করে নিলে আকস্মিক পরিস্থিতিতে সন্তানদের জীবন ওলটপালট হয়ে যায় না। মনে পড়ে আমাদের এক তরুণ বন্ধু, যিনি একাধারে গল্পকার ও প্রকাশক, একদিন বলছিলেন চাকরিজীবী মায়েদের প্রতি সন্তানরা এতটাই বিমুখ হবে যে, মায়েদের মৃত্যুশিয়রে বসে থাকা দূরে থাক তাঁদের মৃত্যুসংবাদ সময়মতো নেবারও প্রয়োজন বোধ করবে না তারা। কিন্তু কার্যত দেখা যায়, পেশাজীবী বা কর্মজীবী মায়ের প্রতি বিরাগের পরিবর্তে তাঁদের নিয়ে অধিকাংশ সন্তানদের গর্বের অন্ত নেই। সমাজ বা পরিবার যাই বোঝাতে চাক তাদের, একটু বড় হলে নিজস্বভাবে চিন্তা করতে শিখলেই তারা গোটা ব্যাপারটা বুঝে ফেলে এবং মায়ের সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করে। মাতা এবং পিতার প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও বিকৃত মূল্যবোধের আরেকটা উদাহরণ দিই। নতুন কর্মসংস্থান অথবা বদলির কারণে যদি সন্তান ও স্বামীকে রেখে কোনো মহিলাকে সাময়িকভাবে দূরে যেতে হয়, তৎক্ষণাৎ তিনি নিষ্ঠুর মা এবং দায়িত্ব ও আনুগত্যহীন স্ত্রী হিসেবে সমাজে চিহ্নিত হয়ে যান। অথচ অনুরূপ পরিস্থিতিতে পিতাকে যখন স্ত্রী ও সন্তান রেখে কর্মস্থলে যেতে হয়, পুরোনো-নতুন উভয় স্থানেই তাঁর প্রতি সহানুভূতি ও সংবেদনশীলতায় মুখর হয়ে ওঠে প্রতিবেশী-সহকর্মী, আত্মীয়স্বজন— সকলে। নিষ্ঠুরতা নয়, পরিবারের প্রতি তাঁর দায়িত্বজ্ঞান ও স্বার্থত্যাগই প্রমাণিত হয় তাঁর এই আচরণে।
সবশেষে আরেকটি কথা। মাতাপিতার মধ্যে যদি মায়ের চাকরি বা পেশা বাবার তুলনায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয় এবং তার পক্ষে সন্তান পালনের জন্যে বেশিদিন ছুটি নেওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে মায়ের বদলে বাবাকেই ঘরে বসে সন্তান বড় করতে হবে। কারো কারো কাছে শুনতে অদ্ভুত শোনালেও পশ্চিমা দেশগুলোতে ‘House husband’-এর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বৈ কমছে না। এতে লজ্জার বা গ্লানির কোনো কারণ নেই। সন্তান যৌথ উদ্যোগে সৃষ্টি এবং তাকে বড় করে তোলা মাতাপিতার মিলিত দায়িত্ব। মাতার পক্ষে এ দায়িত্ব পুরোপুরি গ্রহণ করা সম্ভব না হলে পিতাকে যৌথভাবে এবং কখনো কখনো প্রয়োজনে এককভাবে এ কাজ করে যেতে হবে। “সন্তানের প্রতিপালন মায়ের একক দায়িত্ব”, “শিশুর জন্যে মায়ের দরকার”, “ন মাস গর্ভধারণ এ সেতুর ভিত্তি”, “মায়ের মতো করে সন্তান পালনে কেউ সক্ষম নয়”—ইত্যাদি সকল প্রচলিত বিশ্বাস বা প্রবাদই আরোপিত, এদের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। একটি মানবসন্তানকে যে-কোনো মানুষ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে, প্রতিপালন করতে সমর্থ। পালিত সন্তানদের বেলায় কালে কালে দেশে দেশান্তরে এই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। ন মাস গর্ভে ধারণ না করে, বুকের দুধ না খাইয়েও অনেকেই সার্থক পিতামাতা বলে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছেন। তাহলে মায়ের অবর্তমানে প্রাকৃতিক পিতাই-বা কেন সে দায়িত্ব নেবে না নিতে পারবে না? যদি ধরে নেওয়া হয় যে তার পৌরুষের ঘাটতি হয়েছে, তা হলে পৌরুষের সংজ্ঞাই পাল্টাতে হবে আমাদের। সন্তান লালন-পালনে পিতার দায়িত্বের অব্যাহতি অথবা সংকোচন এর কোনো সমাধান নয়, হতে পারে না।