ঘর ও নারী

ঘর ও নারী

লেখার জন্যে ঘর

সত্তর বছর আগে লেখা ভার্জিনিয়া উল্‌ফের বিখ্যাত রচনা ‘A room of one’s own’ অনুযায়ী একজন নারীর সার্থক লেখক হওয়ার জন্যে চাই দুটো জিনিস : (১) নির্দিষ্ট উপার্জনের নিশ্চয়তা, (২) একখানা ঘর। অর্থ এবং নিভৃতি ছাড়া সৃজনশীলতার বিকাশ সম্ভব নয়, মনে করতেন ভার্জিনিয়া উল্ফ। তাঁর মতে: লেখক যদি স্বস্তিতে, সুখে না থাকে, তার লেখা, তার সৃজনশীলতা ব্যাহত হয়।

কল্পনা ও বাস্তবতা, যুক্তি ও কৌতুক মিলিয়ে লিখিত এ রচনা মূলত একটি কলেজের লেকচার সিরিজের জন্যে তৈরি হলেও পরবর্তীকালে নারী আন্দোলনের অন্যতম মুখপত্রে পরিণত হয়। ভার্জিনিয়ার কল্পনাপ্রসূত শেক্সপিয়ারের বোনের অকালমৃত্যুর জন্যে দায়ী ও তাঁর কাব্যপ্রতিভার বিকাশের অন্তরালে ছিল যেসব বাধা ও সীমাবদ্ধতা, সেসব অতিক্রম করার জন্যেই নারীদের অনুপ্রাণিত করেছেন তিনি তাদের মধ্যেই বেঁচে থাকবেন শেক্সপিয়রের ভগিনী-তাঁর কবিসত্তা (যদিও ভার্জিনিয়া নিজেই স্বীকার করেছেন প্রতিশ্রুতি থাকলেও সেই শেক্সপিয়রের বোন জীবনে একটি শব্দও লেখেননি)।

এ রচনার জন্য যতই ভার্জিনিয়াকে ভোগবাদী, পার্থিব ও বস্তুসচেতন বলে নিন্দা করুক না লোকে, উল্ফের ধারণা, চিন্তার স্বাধীনতা ও চিন্তার উৎকর্ষ ছাড়া কালজয়ী রচনা বা সফল কবিতা নির্মাণ সম্ভব নয়। আর চিন্তার সেই স্বাধীনতারই পূর্বশর্ত— নির্ধারিত আয় ও একখানা নিভৃত কক্ষ। ভার্জিনিয়া মনে করেন মেয়েরা সে সুযোগ, মুক্তি ও স্বাধীনতা কখনও ভোগ করেনি। আর তাই পুরুষ যেখানে অনবরত ক্ষমতা, আধিপত্য, সম্পদ এবং খ্যাতি লাভ করেছে, নারী ক্রমাগত লাভ করেছে সন্তান। ভার্জিনিয়ার আশা—যদি মেয়েরা সেই স্বাধীনতা, সেই সাহস অর্জন করতে পারত, তারা ঠিক যা ভাবছে, যেমন করে ভাবছে সেই ভাবনা ঠিক তেমনিভাবে প্রকাশ করতে পারত। যদি একবার তারা তাদের পারিবারিক বৈঠকখানা পেরিয়ে বাইরের পৃথিবী, তার অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্ভার আর কোলাহলে চোখ ফেলতে পারত তাহলে পারস্পরিক সম্পর্কের পরিবর্তে বাস্তবতার আলোকে বৃহত্তর মানব সমাজকে তারা নিরীক্ষণ করতে পারত।

ভার্জিনিয়া বিশ্বাস করতেন একটি মেয়ে যদি এটা মেনে নিতে পারে যে, তার হাত ধরে কেউ তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে না, তাকে একাই এগুতে হবে, জগতের সঙ্গে তার সম্পর্ক কেবল নারী-পুরুষের সম্পর্কে সীমাবদ্ধ নয়, শাশ্বত বাস্তবতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত, তা হলেই সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারত। শেক্সপিয়রের ভগ্নী আবার বেঁচে উঠত, তাঁর কবিতা বিকশিত হত।

কান্নার জন্যে ঘর

নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ঔপন্যাসিক টনি মরিসনের বিখ্যাত উপন্যাস ‘Sula’ (১৯৭৩) মরিসনের অন্যান্য উপন্যাসের মতো এটিও কৃষ্ণকায় মার্কিনী জীবনের জাগ্ৰত প্ৰতিচ্ছবি। দুই বাল্যসখীর অম্লমধুর ভালোবাসা, প্রতারণা, হিংসা-দ্বন্দ্ব আর নির্ভরতার জটিল অনবদ্য মানবগাথা।

নেল ও সুলার জন্ম ও শৈশব অতিক্রান্ত হয় একই ছোট্ট শহরে। পরে জীবনের নানাবিধ মোহ, সুযোগ, বিভিন্ন মোড়ে আর ঘাত-প্রতিঘাতে দুজন পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুরকমভাবে বেড়ে ওঠে। নেল সেই মধ্যপশ্চিম অঞ্চলের আটপৌরে ছোট্ট শহরেই থেকে যায়। ঘর-সংসার, স্বামী-সন্তান নিয়ে কালো মেয়ের গতানুগতিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ওদিকে সুলা যায় বড় শহরে। কলেজে পড়ে। কর্মজীবী, স্বাবলম্বী হয়ে ওঠে। বিয়ে বা সংসার নয়, বহু পুরুষের আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা মিটিয়ে আরও তৃষ্ণা বুকে নিয়ে আবার ফিরে আসে জন্মস্থানে— সেই ছোট্ট শহরে। পুনরায় দেখা হয় দু-সখীর। নতুন করে শুরু করে তাদের পারস্পরিক আবিষ্কার, সংঘাত আর গভীর বিশ্বাস ও আস্থাভঙ্গের বিচিত্র সম্পর্ক।

এই উপন্যাসে একটি অধ্যায় রয়েছে যেখানে নেল হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে একটা ছোট্ট জায়গা—একটুখানি নিভৃতি। বেলা আড়াইটে বাজে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার বাচ্চারা স্কুল থেকে ফিরে আসবে। হাতে আর সময় নেই। এখন যদি সম্ভব না হয়, ওরা ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত অর্থাৎ গভীর রাতের আগে তার আর কোনও সুযোগ হবে না। নেল তার চারদিকে তাকায়। ছোট্ট, ব্যক্তিগত একটি জায়গার জন্যে। প্রথমে সে ভাবে তার বিছানার কথা। পরক্ষণেই এই বিছানার সঙ্গে সম্পর্কিত যাবতীয় স্মৃতি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। একবার ভাবে ক্লজেটের কথা। কিন্তু ক্লজেটে বড় অন্ধকার। অতঃপর মনে আসে ওয়াশরুম। হ্যাঁ, এ জায়গাটি বেশ ছোট্ট এবং আলোকিত। তার দুঃখ ও বেদনাকে ধরে রাখার জন্যে যথেষ্ট সীমিত। আবার তাকে শান্ত সমাহিত করাবার জন্যে যথেষ্ট উজ্জ্বল। সবচেয়ে বড় কথা সন্তানদের, প্রতিবেশীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে এই একটি জায়গাতে এসেই সে কিছুক্ষণের জন্যে নিজেকে উন্মুক্ত করতে পারে। অবশেষে নেল ওয়াশরুমকেই বেছে নেয়। কিন্তু কীসের জন্যে? কী করতে চায় সে? এই নিভৃতি, এই আড়াল, এই ছোট্ট ঘরটির কী প্রয়োজন তার? প্রয়োজন আছে। নেলের খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। তার বুক উজাড় করা, পেটের গভীর তলদেশ থেকে উঠে আসা, কণ্ঠনালীতে আটকে থাকা এই কান্নার দমক আলগা করে হালকা হতে চায় নেল। এ কান্না পিতার মৃত্যুর শোকের কান্না নয়। এ কান্না ছোট্ট ছেলেটির গা পুড়ে গেছে সেই দুঃখে নয়, এ কান্না অত্যন্ত ব্যক্তিগত, নিজস্ব কান্না। একান্ত নিজের যন্ত্রণা ও গভীর কষ্ট থেকে উৎসারিত কান্না। এ জন্যেই তার এ নিভৃতির প্রয়োজন।

কিন্তু কেন কাঁদতে চাইছে নেল। কালো সম্প্রদায় অধ্যুষিত এই ছোট্ট শহরে স্বামী, সন্তান, ঘর নিয়ে আর দশটি মেয়ের মতো বেশ পরিপূর্ণ জীবন যাপনই তো করছিল নেল। তা হলে কেন সে আজ কাঁদতে চাইছে, গলা পরিষ্কার করতে চাইছে? চাইছে কারণ মাত্র কিছুক্ষণ আগে সে একটি টাই আবিষ্কার করেছে তার শোওয়ার ঘরের ক্লজেটে। তার স্বামী জুড তাকে ছেড়ে সম্প্রতি চলে গেছে। চলে গেছে তারই বাল্যবন্ধু গুলার সঙ্গে। চলে গেছে— কেন না নেল নিজের চোখে ওদের দুজনকে একত্রে বিবস্ত্র ও চুম্বনরত অবস্থায় আবিষ্কার করেছিল তারই নিজের ঘরে।

জুড চলে গেছে। ফিরে এসে প্রথাগতভাবে তার যাবতীয় ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিসও নিয়ে গেছে। কিন্তু ভুলে ফেলে রেখে গেছে অতি পরিচিত এই টাইখানা—নীল রঙের ভেতর একটি দিকে যার হলুদ রেখা। দীর্ঘ বিবাহিত জীবনের—এই গৃহে, নেলের জগতে তার অবস্থানের আর কোনও চিহ্ন রেখে যায়নি জুড। এই টাই নেলকে মনে করিয়ে দিচ্ছে জুড এখানে ছিল। যেভাবে ক্লজেটে ওটা ঝুলছে, তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক জুড যে-কোনও মুহূর্তে ফিরে আসবে। কিন্তু নেল জানে সেটা হওয়ার নয়। জুড কোনওদিন ফিরবে না। এভাবে চলে গেলে কেউ ফিরে আসে না।

স্বামী এবং সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বাল্যবন্ধুকে একসঙ্গে হারানোর শোকে যে কান্না, ‘Why me’ বলে যে আফসোস ও বিলাপ তার জন্যে নিভৃতির প্রয়োজন হয় বইকি!

মৃত্যুর জন্যে ঘর

সিলেটের অভিজাত হোটেল পলাশের নিভৃত কক্ষে আত্মহত্যা করেছেন মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়। মৈত্রেয়ীকে আমি চিনি না। তার স্বামী জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়কেও নয়, যদিও তার আবৃত্তি শুনেছি ক্যাসেটে। ওদের কথা অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের মুখে যারা কাছ থেকে দেখেছেন ওদের, ভালোবেসেছেন। মৈত্রেয়ীর এরকম অসময়ে অস্বাভাবিক মৃত্যুতে যারা গভীরভাবে শোকাহত, নির্মলেন্দু গুণ, শফি আহমেদের কাছে এই সাহিত্যনুরাগী দম্পতির কথা শুনেছি আমি। ওদের অতি স্নেহের সঙ্গে মৈত্রেয়ীর স্মৃতি রোমন্থনের মধ্য দিয়ে এই সংস্কৃতিমনা মেয়েটিকে আমি বোঝার চেষ্টা করেছি, জীবন্ত অবস্থায় যাকে কোনওদিন চোখে দেখিনি। মৈত্রেয়ী আমাকে শিখিয়েছেন শুধু লেখার জন্যে নয়, শুধু কাঁদার জন্যে নয়, মৃত্যুর জন্যেও নিভৃতির প্রয়োজন, অন্তত কোনও কোনও গভীর সংবেদনশীল স্পর্শকাতর মানুষের জন্যে তো বটেই।

নিজস্ব একখানা ঘর যদি কেবল লেখা অথবা অন্য যে-কোনও সৃজনশীল চর্চার জন্যেই প্রয়োজন হয়, যদি কাঁদার জন্যে প্রয়োজন হয়, মৃত্যুর জন্যে কেন নয়? কর্মজীবী নারী ছিলেন মৈত্রেয়ী। প্রাত্যহিক জীবনে না হলেও কর্মোপলক্ষে, মন খুলে কাঁদার জন্যে একখানি নিরিবিলি ঘর তো তিনি ইচ্ছে করলেই পেতে পারতেন। পেয়েছিলেনও। তবু তাঁকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হল। তবে কি আমরা এটাই মনে করব নিজস্ব উপার্জন আর একখানা ঘরই (তা সৃজনশীলতার বিকাশ কিংবা কান্না যে-কোনও প্রয়োজনেই ব্যবহৃত হোক না কেন) যথেষ্ট নয়। জীবনে আরও কিছু প্রয়োজন? যে প্রয়োজন ও তার অভাব অনুভব করেছিলেন মৈত্রেয়ী, অনুভব করেছিলেন ‘নিজস্ব কামরা’র প্রবক্তা ভার্জিনিয়া উল্ফ নিজেও, যিনি মৈত্রেয়ীর মতোই স্বামী এবং ঘর ফেলে, নিজস্ব আয় ফেলে নিজের হাতে জীবনের সমাপ্তি ডেকেছিলেন। কোটের পকেটে ভারী ভারী পাথর ভরে ধীরে স্থিরে নেমে গেছিলেন গভীর সলিলে। আত্মহননের কি বিস্তৃত আয়োজন দু-ক্ষেত্রেই।

অথচ এমন একটি দুঃখজনক, অত্যন্ত হৃদয়বিদারক ব্যক্তিগত ঘটনাকে একটি জাতীয় দৈনিক (দলীয় দৈনিকও বটে) কী কুৎসিতভাবে, কী ভয়াবহ বিকৃতভাবে প্রথম পাতায় বক্স আকারে পরিবেশন করে! হোটেলের নিভৃত কক্ষে একাকী কোনও মেয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যু, কেবল এই সংবাদটিই হয়তো মুখরোচক গল্প জন্ম দেওয়ার জন্যেই যথেষ্ট অন্তত এই কাগজটির ক্ষেত্রে। তার ওপর যোগ হয়েছে মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায়, নাম। আর যায় কোথায়: মৈত্রেয়ীরা শুধু জীবদ্দশাতেই ভারতের চর নয়? মৃত্যুর পরও ভারতীয় নাগরিক থেকে যায়। আর তারপর তার চল্লিশোত্তীর্ণ শরীর যদি যৌবনাতিক্রান্ত না হয়, তা হলে হোটেলের নিভৃত কক্ষে এ আত্মহননের ঘটনার পর তার কোনও সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচিতি জানারও প্রয়োজন হয় না আর। তার ব্যক্তিগত জীবনাচরণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য ও কটূক্তি করতেও বাধা থাকে না। ভারতীয় কলগার্ল আর এনজিও কর্মীর মধ্যে পার্থক্য ঘুচে যায়— মনে হয় একই ধরনের জীবিকা এ দুটো। হবেই বা না কেন, ওরা সকলেই যে সমান এ কাগজটির চোখে।

গত মাসে একটি বিদেশি ছবি দেখার সুযোগ ঘটেছিল। নাম ‘ক্রুসিবল’। আমেরিকার ম্যাসাচুয়েটস্ অঙ্গরাজ্যের ছোট্ট শহর সালেমের উইচহান্টের সেই কুখ্যাত কাহিনি নিয়ে ছবি। কয়েকটি কিশোরীর দুষ্টুমি, অ্যাডভেঞ্চার ও মিথ্যে কথার পরিপ্রেক্ষিতে শয়তানের দোসর সাজিয়ে বহু নিরপরাধ লোককে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল সালেমে। এ ছবির নায়ককে যখন শয়তানের দোসর শনাক্ত করা হয়, তাকে একবার শেষ সুযোগ দেওয়া হয় তার দোষ স্বীকার করার। যদি সে বলে শয়তানের সঙ্গে তার কথোপকথন ঘটেছে, তা হলে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে। স্বীকার না করলে মৃত্যু। সুহৃদের পরামর্শে আর জীবনের প্রতি প্রবল ভালোবাসায় অনীহার সঙ্গেও অবশেষে সে মিথ্যে কথা বলে। মৌখিক স্বীকারোক্তি দেয় যে, সে শয়তানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। কিন্তু যখন তাকে এই ঘটনাটি স্বীকার করে নিয়ে নিজের নাম স্বাক্ষর করে রাখতে বলা হয়, যে স্বাক্ষরিত দলিল স্থায়ীভাবে সালেমের নগরভবনে রেখে দেওয়া হবে, সম্পূর্ণ বেঁকে বসে লোকটি। সবাই অবাক। কিন্তু কেন? সে তখন চিৎকার করে বলে, ‘কেন না ওটা আমার নাম। আর আমার একটাই শুধু নাম।’ জীবনের চাইতেও নিজের পরিচিতি বড় তার কাছে। মৃত্যুকে বেছে নিলেও নিজের সুনামকে বিনষ্ট হতে দিতে রাজি নয় সে। অথচ মৃত্যুর পরও তার যোগ্য সুনাম-তার সম্মান, সম্ভ্রম পেতে ব্যর্থ হল মৈত্রেয়ী— জীবনেও যা সে বা তার স্ব-গোত্রীয়রা কখনও পায়নি এই কাগজের সমর্থকদের কাছে।

ঘর ও মানুষ

লেখার জন্যে, কান্নার জন্যে, মৃত্যুর জন্যে যদি নিভৃত ঘরের প্রয়োজন হয়, বাঁচার জন্যে, সুস্থতা ও মানসিক ভারসাম্যতা রক্ষার জন্য প্রয়োজন কোনও মানুষ অথবা প্রকৃতির সান্নিধ্য। সেই মানুষ নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ, বালক, দেশি-বিদেশি যে কেউ হতে পারে। প্রকৃতির যে-কোনও রূপ, হোক না বিস্তীর্ণ বালুভূমি, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্রসৈকত, জঙ্গল, অথবা নক্ষত্রখচিত রাত— সেই ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রয়োজন শুধু আত্মঅবলোকনের স্পর্ধা ও সৎ ইচ্ছার। জীবদ্দশায় খুব অল্প সময়ই আমরা নিজের জন্যে বাঁচি। যাপিত জীবনের প্রায় পুরোটিই কাটে অন্যের চোখে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার অবিরাম চেষ্টায়। আর তাই সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিভৃতি ও স্বাবলম্বিতার সঙ্গে কখনও কখনও কারও হাত ধরে পথ চলার মধ্যে কোনও গ্লানি দেখি না আমি, যতক্ষণ এই চলা দুজনকেই শক্তি যোগায়, আলো দেখায়। যতক্ষণ নির্ভরশীলতা থাকে পারস্পরিক, যতক্ষণ তা স্বেচ্ছায় একাকী পথ চলার সুযোগ এবং সাহসের পরিপূর্ণ বিকল্প না হয়। ফলে ভার্জিনিয়া উলফের সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘If we face the fact, for it is the fact, that there is no arm to cling to, but that we go alone and that our relation is to the world of reality and not to the world of man and woman, then the opportunity will come and the dead poet who was Shakespeare’s sister will put on the bodz which she has so often laid down.’ পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করতে পারি না। আর মৃত্যুর কথা যখন চিন্তা করি, নিভৃতি নয়, প্রিয়জনের মমতাময় মুখই চোখে ভাসে আমার। দূর কোনও অপরিচিত স্থানে নিভৃতে একাকী মৈত্রেয়ীর মতো আমি মরতে চাই না, প্রিয়জনের সান্নিধ্যে আমি নিঃশেষিত হতে চাই। সে প্রিয়জন স্ত্রী-পুরুষ যে কেউ হতে পারে, হতে পারে জাগতিক বিচারে আমার আত্মীয় অথবা অনাত্মীয়। যে প্রিয়জন বেঁচে থাকতে আমার জীবনকে আলোকিত, সমৃদ্ধ ও উজ্জীবিত করেছে, আমি চাই তার উপস্থিতিতেই আমার দেহ অসার হয়ে পড়বে। প্রাণ হবে নিশ্চল-নিশ্চুপ।

নিজের জন্যে সময়

কিছুদিন আগে আমার মেয়ের কাছ থেকে একটা ই-মেইল পেলাম। লিখেছে, “ভাবতে পারো আমার বয়স তিরিশ হয়ে গেল?” না, ভাবতে পারি না। তবে হঠাৎ করেই প্রায় তিন দশক আগের কিছু স্মৃতি মনে পড়ে যায়। আমার মেয়ে জয়ীষার বয়স তখন ছ-সাত মাস। আমেরিকান সোসাইটি ফর ফার্মাকোলজি অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল থেরাপিউটিক্স-এর বার্ষিক সম্মেলনে আমার একটা পেপার দিতে যাওয়ার কথা। সেবার কনফারেন্স হচ্ছিল পোর্টল্যান্ড, ওরেগনে। যুক্তরাষ্ট্রের ঠিক উত্তর-পশ্চিম কোনায়। আর আমরা থাকি তখন একেবারে দক্ষিণ-পূর্বের এক উপকূলবর্তী শহর মোবিল, অ্যালাবামায়। গাল্ফ অব মেক্সিকোর ওপর উষ্ণ, সবুজ, ছিমছাম শহর মোবিল। এতটুকু মেয়েকে এতদূরে ফেলে কেমন করে বিজ্ঞান সম্মেলনে যোগ দিতে যাব ভেবে পাচ্ছিলাম না। এ প্রসঙ্গে একটু পেছনের দিকে ফিরে যাই।

ক্লাস ওয়ান থেকে শুরু করে একটানা বাইশ বছর পড়াশুনা করে ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করি। আমার বিয়ে হয়েছিল আঠারো বছর বয়সে। বিয়ের পর ন’বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও পড়াশুনো ও রিসার্চের কাজের চাপে সন্তান গ্রহণের সুযোগ হয়নি তখনও। ফলে ১৯৭৭ সালের গোড়াতে যখন প্রথম পোস্ট-ডক্টরাল ফেলোশিপ নিয়ে ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ অ্যালাবামার মোবিলে এলাম, আমি তখন সদ্য অন্তঃসত্ত্বা। কয়েক মাস আগে “সায়েন্স” ম্যাগাজিনে এই শূন্য পদটির জন্যে যখন বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল, লক্ষ করেছিলাম প্রফেসরের নাম দেওয়া হয়েছে— সৈয়দ জামাল মোস্তাফা। ফার্মাকোলজি বিভাগ। চারদিকে এতরকম ফেলোশিপ থাকা সত্ত্বেও গভীর দক্ষিণাঞ্চলে এত দূরে এ বিশেষ পদটির জন্যে আমার আবেদনের প্রধান কারণ ছিল, আমি ভেবেছিলাম ভদ্রলোক বাঙালি। কূপমণ্ডুকত্ব এ চিন্তায় প্রকাশ পেলেও, স্বীকার করি একজন বাঙালি প্রফেসরের কাছে কর্মজীবনের শুরুতে বিজ্ঞান গবেষণার হাতেখড়ি হবে ভাবতে আমার ভালো লেগেছিল। পরে অবশ্য জেনেছি (চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগেই) যে ডঃ মোস্তাফা আসলে লক্ষ্ণৌর লোক। স্বভাবতই খুব ভালো উর্দু বলেন। বাংলা জানেন না। অত্যন্ত সহৃদয় ও বন্ধুবৎসল ব্যক্তি। তাঁর স্ত্রী সীমাও লখনৌর মেয়ে। চমৎকার দেখতে—ব্যবহারেও। একমাত্র শিশুপুত্র জিশান। তরুণ দম্পতি। আমাদের নতুন শহরে প্রাথমিকভাবে সংসার গোছাতে সাহায্যের কোনও ঘাটতি রাখেননি তাঁরা কিন্তু বিপাক বাধল যখন আমার সন্তানসম্ভাবনার কথা জানালাম ডঃ মোস্তাফাকে। অসম্ভব রেগে গেলেন তিনি আমার ওপর। তাঁর কথা থেকে এটা প্রচ্ছন্ন যে, তিনি এ ব্যাপারটা তাঁকে ঠকানোর পর্যায়ে ধরে নিয়েছেন।

আমি তাঁকে বলতে পারতাম, জানুয়ারিতে যখন তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম ও প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলাম, আমি তখনও অন্তসত্ত্বা ছিলাম না। কিছু লুকোবার প্রশ্ন তাই আসে না। দ্বিতীয়ত, এটা আমার নাগরিক, মানবিক ও রাষ্ট্রীয় অধিকার। এ ব্যক্তিগত ব্যাপারটি জানানো না-জানানো সম্পূর্ণ আমার নিজস্ব সিদ্ধান্ত। আমি তাঁকে বলতে পারতাম, তাঁর মন্তব্যগুলোকে ভিত্তি করে আমি যদি কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করি, তাঁর শুধু চাকরির সংশয় দেখা দিতে পারে তা নয়, শাস্তিও পেতে হতে পারে। তিনি নিজেও জানেন যে সম্পূর্ণ রীতি ও আইনবহির্ভূত আচরণ করছেন। চরম বৈষম্যের শিকার করছেন আমায়। আমি নিশ্চিত উপমহাদেশের মেয়ে যদি আমি না হতাম, তিনি এত সহজে তার আশাহত হওয়ার ক্ষোভটা এভাবে প্রকাশ করতে পারতেন না। সেইসঙ্গে আমি এও বুঝতে পারছিলাম, ভারত থেকে আগত মেধাবী এই তরুণ বিজ্ঞানী এদেশে তাঁর প্রতিষ্ঠার জন্যে স্বাভাবিকভাবেই কত আগ্রহী ও সংগ্রামী। আমিই তাঁর প্রথম পোস্টডক। যাই হোক আমি এরপর যা করলাম, সেটা আজ হলে করতাম কি না সন্দেহ। ডঃ মোস্তাফার কাছে তখন প্রাণপণে প্রমাণ করতে শুরু করলাম যে, আমার গর্ভাবস্থা বিজ্ঞান সাধনার অন্তরায় কোনওমতেই নয়। ফলে দ্বিগুণ পরিশ্রম ও অধ্যবসায় নিয়ে গভীর রাত পর্যস্ত ল্যাবে পড়ে রইলাম। মাঝে মাঝে, বিশেষ করে গর্ভাবস্থার শেষের দিকে, পা টনটন করে ব্যথা করতে থাকত সারাদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করার জন্যে। শরীর ভেঙে আসতে চাইত। কিন্তু নিজেকে দমতে দিতাম না!

আমার রিসার্চের বিষয়টিও ছিল বেশ চমৎকার। হার্ট অ্যাটাক হলে অর্থাৎ করোনারি রক্তনালী বন্ধ হয়ে গেলে হৃৎপিণ্ড থেকে স্বাভাবিকভাবেই এডিনোসিন নামে একটি পদার্থ নিসৃত হয়, যা করোনারি রক্তনালীকে প্রসারিত করে রক্ত চলাচলের সুযোগ এনে দেয়। এটা শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। জরুরি অবস্থায় রক্তনালী ও হৃৎপিণ্ডকে চালু রাখার স্বতঃস্ফূর্ত প্রচেষ্টা। এই এডিনোসিন কেমন করে কাজ করে, তার জন্যে নির্দিষ্ট রিসিপ্টর প্রোটিন আছে কি না করোনারি রক্তনালীর জীবকোষের আচ্ছাদনে, থাকলে সেগুলো কেমন প্রকৃতির সেটা জানাই আমার গবেষণার বিষয় ছিল। ল্যাবরেটরির জন্তু অর্থাৎ ইঁদুর কিংবা গিনিপিগ দিয়ে কাজ করতে গিয়ে লক্ষ করলাম, এসব ছোট জন্তুর করোনারি রক্তনালীর পরিমাণ এতই অকিঞ্চিৎকর যে তা দিয়ে আমার প্রয়োজনীয় কাজ করা সম্ভব নয়। ফলে তখন বাধ্য হয়ে যেতে শুরু করলাম স্লটার হাউজে অর্থাৎ কসাইখানায়। শহরের অপরপ্রান্তে অবস্থিত স্লটার হাউজে নিজেই ড্রাইভ করে যেতাম। আমার চোখের সামনে বিশাল বিশাল গরুদের সার করে দাঁড় করিয়ে বন্দুক দিয়ে গুলি করে মারা হত। মৃত বা অর্ধমৃত এই পশুগুলো মাটিতে পড়ে গেলে ছুরি দিয়ে ওদের বুকের পাঁজর ভেদ করে সেখান থেকে তখনও প্রচণ্ডভাবে স্পন্দনরত হৃৎপিণ্ডগুলো নিজ হাতে খুলে আনতাম। সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হৃৎপিণ্ডগুলো বরফের ভেতর ঢুকিয়ে না রাখলে রিসিপ্টরের গুণগত মান, লোপ পেয়ে যেতে পারে। তাই রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ডগুলো বরফের বাকেটে ভরে আবার গাড়ি চালিয়ে ফিরে আসতাম ল্যাবে। সারাদিন ধরে ওই হৃৎপিণ্ড থেকে, সূক্ষ্ম কাঁচি ও ফোরসেপের সাহায্যে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছোট ছোট করোনারি রক্তনালীগুলো আলাদা করে সংগ্রহ করতাম। তারপর সেগুলো গুঁড়ো করে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জীবকোষের আচ্ছাদন আলাদা করে সংগ্রহ করা যখন শেষ হত, অনেক রাত হয়ে যেত তখন। সেগুলো ভবিষ্যতে এক্সপেরিমেন্ট করার জন্যে ফ্রিজ করে রেখে ক্লান্ত ক্ষুধার্ত শরীরে ঘরে ফিরতাম। রাতে ঘুমের মাঝেও স্বপ্ন দেখতাম সেসব বীভৎস দৃশ্য। গুলিবিদ্ধ হয়ে পশু ও মানুষ পাশাপাশি খুন হত। প্রচণ্ডভাবে হাত-পা ছুড়তে থাকত ওরা। গর্ভবতী মেয়েদের সুন্দর দৃশ্য, সুন্দর স্বপ্ন দেখার ও সু-খাবার গ্রহণের পরামর্শ দেয় লোকে। অথচ গর্ভাবস্থায় সপ্তাহে অন্তত দুদিন স্লটার হাউজের এই অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হত আমায়। যার ফলাফল রাতভর দুঃস্বপ্ন। আর সু-খাবার? ক্লান্ত শরীরে রান্না করার আগ্রহ বা শক্তি একেবারেই থাকত না। কোনওমতে কিছু রেঁধে ক্ষুধার নিবৃত্তি করতাম। সে সময় আমার শরীরে বসবাসরত কন্যা আজও যে সুন্দর জিনিস দেখে মুগ্ধ হয়, সুন্দর চিন্তা করে, স্বপ্ন দেখে, এ জন্যে আমি অত্যন্ত প্ৰীত, ধন্য।

জন্মের আগে-পরে মিলে মাত্র চার সপ্তাহ ছুটি নিয়েছিলাম আমি। ‘ম্যাটার্নিটি লিভ’ বলে আমেরিকায় তখন কোনও ছুটি বরাদ্দ ছিল না। নতুন চাকরি বলে আমার বাৎসরিক ছুটি সামান্যই ছিল। ‘সিক লিভ’ও নেওয়া যেত না, কেন না ‘গর্ভাবস্থা’ অসুস্থতা নয়। কেবল তখন কোনও বিশেষ জটিলতা দেখা দিলেই “সিক লিভ” নেওয়া চলত। ফলে সন্তান জন্মের তিন সপ্তাহ পরেই আবার কাজে যোগ দিয়েছিলাম। এত পরিশ্রমের ফলস্বরূপ অবশ্য কিছু স্বীকৃতিও পেয়েছিলাম। এডিনোসিন রিসিপ্টরের অস্তিত্ব করোনারিতে প্রথম আবিষ্কারের কৃতিত্ব অর্জন করি আমরা। একই বছর পরপর তিনটি জাতীয় বিজ্ঞান সম্মেলনে আমার পেপার গৃহিত হয়। এ ছাড়া পরবর্তী তিন বছর এ বিষয়ে গবেষণা করার জন্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ থেকে একটা ফেলোশিপ পাই। আমার বিজ্ঞানসাধনার জীবনে ওই বছরটি সবচেয়ে ফলপ্রসূ— সবচেয়ে সার্থক হয়ে থাকে। কিন্তু আমি শুধু আমিই জানি এ জন্যে কী অসীম মূল্য আমায় দিতে হয়েছে। যদি ওই সময়টিতে আবার ফিরে যাওয়ার উপায় থাকত, আমি ব্যাপারটাকে অন্যভাবে মোকাবিলা করতাম। গর্ভাবস্থা পঙ্গুত্বের সমকক্ষ নয়—এটা প্রমাণ করার চেষ্টা বা হীনমন্যতা থেকে যে বিশাল গুরুদায়িত্ব নিজের ওপর চাপিয়ে দিয়ে বাড়াবাড়ি করেছিলাম, আমি কখনও তা করতাম না। প্রতিটি মেয়ের জীবনেই এ সময়টা একটা বিশেষ সময়। একটু আরাম করার, একটু আয়েশ অবসর করার অধিকার আছে তার–এ সময়ে যা নিজের বেলায় আমি পুরোপুরি অস্বীকার করেছি। সবচেয়ে বড় কথা, আমার জীবনের সবচেয়ে ক্রিটিকেল সময়ে অর্থাৎ গর্ভাবস্থার শেষ অর্ধেক ও কন্যার জন্মের প্রথম ছ’মাস আমার স্বামীকে কর্মোপলক্ষে সাড়ে তিন শো মাইল দূরে অন্য অঙ্গরাজ্যে থাকতে হত। আমার সঙ্গে তখন ছিল কেবল সদ্য দেশ থেকে আসা আমার ছোট ভাই। ভাগ্য ভালো জয়ীষার জন্ম হয়েছিল রোববার। ফলে অন্তত দীর্ঘ আটচল্লিশ ঘণ্টা প্রসব বেদনা ও মেয়ের জন্মলগ্নে জ্যোতি ছিল পাশে। প্রার্থনায় বিশ্বাস না থাকলেও আমি খুব আশা করতাম জয়ীষা উইকএন্ডে জন্মাবে যাতে ওর বাবা কাছে থাকতে পারে তখন। সেটা ঘটেছিল বলে সত্যি খুশি হয়েছিলাম আমরা।

তা যা বলছিলাম। শিশু সন্তানকে তিন হাজার মাইল দূরে রেখে বিজ্ঞান সম্মেলনে যেতে হচ্ছে। বিমানবন্দরে স্বামীর কোলে মেয়েকে তুলে দিয়ে প্লেনে উঠতে সত্যি খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমার সঙ্গে একই কনফারেন্সে যোগ দিতে যাচ্ছিল আরও একটি মেয়ে। গীতা ঘাই। দক্ষিণ ভারতীয়। বিয়ে হয়েছে এক পাঞ্জাবি বিজ্ঞানীর সঙ্গে। গীতাও পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেও এক নাবালক পুত্র ও শিশুকন্যাকে স্বামীর কাছে রেখে যাচ্ছে। আমাদের দুজনেরই খুব মন খারাপ। সারাটা পথ প্লেনে প্রায় চুপচাপ বসে রইলাম আমরা পাশাপাশি। যেন কোনও আত্মীয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে যাচ্ছি অন্তিমদর্শনে। আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলের সময় পূর্ব উপকূল থেকে তিন ঘণ্টা পিছিয়ে আছে। ফলে দুপুরের ভেতরেই আমরা পোর্টল্যান্ড পৌছে গেলাম। অত্যন্ত সুন্দর ও পাহাড়ি শহর পোর্টল্যান্ড। হোটেলে ঢুকে আমরা সঙ্গে সঙ্গেই ফোন করি বাসায়। সব ভালো আছে। বাচ্চারা ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেছে। জয়ীষা তখন ঘুমুচ্ছে। জ্যোতি আমায় নিশ্চিত করতে চায়, মেয়ের কোনওই অসুবিধে হবে না। সে আমি নিজেও জানি। রাতে মেয়ে জাগলে আমার চেয়ে ওরই ঘুম আগে ভাঙে–সে-ই প্রথম সন্তানের শিয়রে গিয়ে দাঁড়ায়, এ কথা আর কেউ না জানুক আমি তো জানি। তবে জাগ্রত সময়ে মেয়ের দেখাশুনো আমিই করি মূলত। ঘুমকাতুরে বলে রাতে উঠতে একটু আলস্য। তার ওপর রয়েছে সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটুনি— ঘরে ও অফিসে। কিন্তু তাই বলে মেয়েকে এত দূরে ফেলে আসা! বেলা পড়ে আসতে থাকে। আমি ও আমার সঙ্গিনী একটু একটু করে কথা আদানপ্রদান শুরু করি। প্রথম প্রথম সবটাই ঘিরে থাকে আমাদের সন্তান-ঘর- মোবিল। তারপর আমরা কথা বলি আমাদের কর্মজীবন সম্পর্কে। আমাদের নানাবিধ আগ্রহ ও অবসর যাপনের ব্যাপারে। কতকিছু করার কথা একসময় মনে হত, কত ছোটখাটো আনন্দ নেওয়ার উপকরণ ছিল জীবনে। এখন এই মুহূর্তে বাড়ন্ত সংসার আর উঠতি কেরিয়ার নিয়ে হিমশিম খেতে খেতে সেসবে মোটেও দৃষ্টিপাত করতে পারি না আমরা। বিশেষ করে আমাদের তো ‘ডাবল জিয়োপার্ডি’। এক মেয়ে—তার ওপর বিদেশী। অথচ ঢুকতে চাইছি অত্যন্ত কঠিন, পুরুষ অধ্যুষিত, প্রতিদ্বন্দ্বিতাময় এক কর্মময় জীবনে।

গীতা ও আমি তৎক্ষণাৎ ঠিক করলাম আজ বিকেলে আমরা দুজনে বেরিয়ে পড়ব। যতক্ষণ সম্ভব বাইরে বাইরে ঘুরব। খুব হালকাভাবে সময়টা কাটাব। যেই ভাবা সেই কাজ। স্নান করে নিজেদের একটু যত্ন করে সাজাই আমরা। সুন্দর দুটো সিল্কের শাড়ি পরি। হালকা সুগন্ধি মাখি গায়ে। মুখে ক্রিম। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। আয়নার সামনে দাঁড়াতে অনেকদিন পর আবার নিজেকে নারী বলে মনে হয়। দৈনন্দিন ব্যস্ততা, বিবিধ কাজের চাপে কবে যে শেষ ভালো করে চুল আঁচড়িয়েছি, আয়নায় নিজেকে ভালো করে চেয়ে দেখেছি, মনে নেই। আমরা বেরিয়ে প্রথমেই গেলাম একটি জাপানিজ রেস্টুরেন্টে। হোটেলের নির্দেশানুযায়ী শহরের নামকরা জাপানিজ রেস্টুরেন্ট ওটা। সব কিছুই সেদেশের কায়দায়। জুতো খুলে ঢুকতে হয় ভেতরে। তারপর সেখানে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসতে হয়। চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থা নেই। চোখের সামনে খাবার রান্না করে দেয় কাঁচা উপকরণ থেকে। আমরা বেছে দিলাম কী খেতে চাই— কেমন করে খেতে চাই। ওরা মুহূর্তের মধ্যে সেসব রান্না করে টেবিল সাজিয়ে দিল চোখের সামনে। গরম গরম এই খাবার বেশ সুস্বাদু লাগছিল আমাদের। এক সময় ওয়েটার জানতে চাইল সাকি চলবে কি না। কোনওদিন খাইনি। পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে সম্মতিসূচক ইশারা করলাম। গরম জলের পাত্রের ভেতর পানীয়ের ডিকান্টার বসিয়ে, দুটো হাতলবিহীন ছোট ছোট কাপসহ একটি ট্রে নিয়ে এসে টেবিলে রাখল ওয়েটার। প্রথমে মুখে দিতে মনে হল হালকা গরম নির্দোষ জল। একটু একটু খেতে খেতে আস্তে আস্তে কিছুটা আমেজ এল। তখন সবকিছু বেশ হালকা ও মনটা কেমন খুশি খুশি হয়ে উঠল।

রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এসে আমরা ঠিক করলাম একটা ছবি দেখব। পাশে সিনেমা হলে একটা দারুণ অ্যাকশন মুভি চলছিল। টিকিট কেটে বসে খানিকক্ষণ দেখার চেষ্টা করলাম। ভালো লাগল না। বেরিয়ে এসে ঠিক করলাম শহরটি ঘুরে দেখা যাক। যেহেতু কিছুই চিনি না শহরের, ট্যাক্সি নিয়ে লাভ নেই। কোথায় যেতে হবে কোনও ধারণাই নেই যেখানে। ফলে আমরা ঠিক করলাম বাস নেব। এক জায়গা থেকে উঠে অন্য জায়গায় বদল করে যতটা পারা যায় শহর দেখব বাসে করে। কিন্তু বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে রয়েছি তো দাঁড়িয়েই রয়েছি। দু-একটা বাস চলে গেল। থামল না। পোর্টল্যান্ডের প্রাক্তন মেয়র শহরটাকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন তার আমলে। সব বাসস্ট্যান্ডই আধুনিক ডিজাইনে কাচে ঘেরা। খুব আকর্ষণীয়। বাসগুলোও নতুন— ঝকঝকে। রাস্তাঘাট প্রশস্ত—পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। হোটেলের রিসেপসনিস্ট বলছিল এসব কারণেই নাকি এই মেয়রকে ট্রান্সপোর্ট সেক্রেটারি করে ওয়াশিংটন নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

আমাদের, সামনে দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিল একটা চাইনিজ চেহারার লোক। আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে চিন-জাপান থেকে আগত মানুষের সংখ্যা প্রচুর। জিগ্যেস করলাম, “বাসকে থামাতে কী করতে হবে? কোনও বাসই যে এখানে থামছে না!”

ভাঙা ইংরেজিতে লোকটি বলল, ‘ওপরের দড়ি ধরে টান দেবে। তবেই বাস থামবে।’ বলেই শূন্যের দিকে আঙুল দেখিয়ে নীচের দিকে টানার ভঙ্গি করে দ্রুত চলে যায় লোকটি। আমরা হাঁ করে মাথার ওপর দড়ি খুঁজতে থাকি। পাই না। মনে প্রশ্ন জাগে— পোর্টল্যান্ডের যাতায়াত ব্যবস্থা এতই ভালো নাকি যে সমস্ত শহরে সংকেত দেওয়ার জন্যে ওপর দিয়ে দড়ি টেনে দেওয়া হয়েছে? পরে বুঝলাম লোকটি আমাদের প্রশ্ন বুঝতে পারেনি। বাসের ভেতর থেকে ড্রাইভারকে থামার জন্যে দড়ি টেনে সংকেত দেওয়ার কথা বোঝাতে চেয়েছিল। (আজকাল অবশ্য অধিকাংশ বাসেই ‘টাচ টেপ’—অটোমেটিক সংকেত দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।)

যাই হোক, পরে বুঝতে পারলাম আমাদের বাসস্ট্যান্ডটিতে এক্সপ্রেস বাস থামে না। সেগুলোই এতক্ষণ না থেমে চলে গেছে। একটি বাস জানতে চায় আমরা কোথায় যেতে চাই। আমরা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ফিক করে হেসে ফেলি। বাস ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে। আমরা একেবারে সামনের সিটটিতে, অর্থাৎ ড্রাইভারের ডানদিকে গিয়ে বসি। নিজের পাগলামি ও সন্ধ্যার অন্ধকারে এ আ্যাডভেঞ্চারের কথা ভেবে আপন মনেই হেসে উঠি। ড্রাইভার বারবার আড়চোখে আমাদের দিকে তাকায়। শাড়িপরিহিত এই দুই মহিলাকে তার কাছে হয়তো অদ্ভুত ও কিছুটা সন্দেহজনক মনে হয়। বাসের ভাড়া কয়েন অর্থাৎ খুচরো পয়সায় দিয়ে, দিতে হত তখন। কাগজের নোট চলত না। আমাদের কাছে যথেষ্ট ভাঙতি ছিল না। দু-একজনের কাছে নোট ভাঙাতে চাইলাম। না পেয়ে বোকার মতো চুপচাপ ভাড়া না দিয়েই বসে থাকি আমরা। প্রায় আধঘণ্টা পর বাসটা আস্তে আস্তে খালি হয়ে যায়। ততক্ষণে আমরা ড্রাইভারকে জানিয়েছি যে আমরা একটা বিজ্ঞান সম্মেলনে এসেছি এ শহরে এবং আজকের রাতের এই অভিযাত্রার উদ্দেশ্য কেবলই শহর দেখা। ভদ্রলোক মনে হয় হাফ ছেড়ে বাঁচেন।

আমাদের সম্পর্কে আগে যাই ধারণা হোক, এখন তিনি আমাদের অতিথির মতো সমাদর শুরু করেন। ততক্ষণে অপেক্ষাকৃত একটা নির্জন জায়গায় এসে থেমেছে বাসটি। পেছনের সিট থেকে এক মহিলা দুটি বাচ্চা ছেলে ও একটি মেয়েকে নিয়ে এগিয়ে আসে ড্রাইভারের কাছে। জানতে পারি তারা তার স্ত্রী, পুত্রকন্যা। গ্রীষ্মের ছুটি বলে ছেলেমেয়েদের স্কুল বন্ধ। তাই মাঝে মাঝে এসে বাবার বাসে ঘুরে বেড়ায় বাচ্চারা। ভদ্রলোকের পদবি ‘Bosse’, আমার শেষ নামের সঙ্গে খুব মিল। জানালেন এখন তার পনেরো মিনিটের বিরতি। খাওয়াদাওয়া করে নতুন পথে যাবে এই বাসটি। উঁচু পাহাড়ের ওপরে নির্মিত ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস হয়ে ফিরবে। ফলে শহরের সুন্দর অঞ্চলটা দেখতে পাব আমরা অপেক্ষা করলে। আমরা তো মহাখুশি। মিসেস বোসে টিফিন কেরিয়ারে খাবার নিয়ে এসেছে সকলের জন্যে। ওদের অনুরোধে ওদের সঙ্গে আমরাও খাই এটা-ওটা। সমস্ত বাসে তখন এই পরিবারের পাঁচ জন ছাড়া শুধু আমরা দুজন। খাওয়াদাওয়া করে নতুন রুটে চলতে শুরু করে বাস। ততক্ষণে আমরা এই গোটা পরিবারটির সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেছি। ঠিকানা ও ফোন নম্বর আদানপ্রদান করেছি। এরপর বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত এই পরিবারটির সঙ্গে আমাদের চিঠিপত্র ও কার্ডে যোগাযোগ ছিল।

পুরো এক ঘণ্টা ধরে শহরের সবচেয়ে সুন্দর অঞ্চল ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘুরে বাসটি আবার ফিরে আসে আমাদের হোটেলের কাছে। নামার সময় হঠাৎ মনে হয়, তাই তো, ভাড়া দেওয়া হয়নি। ড্রাইভারকে কথাটা বলতেই ভদ্রলোক গম্ভীরভাবে বলে ওঠেন, ‘তোমরা ভুল বাসে উঠে পড়েছিলে, তাই তো! ফলে পয়সা লাগবে না।’ তাড়াতাড়ি নেমে পড়ো দেখি! ততক্ষণে নতুন যাত্রীরা বাসে উঠতে শুরু করেছে। আমরা হেসে, হাত নেড়ে পরিবারটিকে বিদায় দিয়ে হোটেলে ফিরে আসি। একটি অদ্ভুত ভালোলাগায় মনটা ভরে যায়। ভাষা, গায়ের রং, জাতিগত পার্থক্য সব ঘুচিয়ে কখনও কখনও অল্প সময়ের জন্যে হলেও আমরা কোথাকার কোন মানুষ কত কাছাকাছি চলে আসি আরেকজনের! ওরেগনের এই পারিবারটির সঙ্গে এই জীবনে আর যে দেখা হবে না তা তো প্রায় অবধারিত। তবু সেই অবিস্মরণীয় রাতের অভিজ্ঞতা তো মিথ্যে হয়ে যাবে না!

পরদিন আমাদের দুজনের পেপারই বেশ ভালো হল। অন্যান্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপস্থাপনাও শুনলাম। সন্ধ্যায় আমাদের সোসাইটির ডিনার ছিল। আবার দুজনে সুন্দর করে সাজলাম। ডিনারে গেলাম। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরের কী- নোট. স্পিচ শুনলাম। খেলাম সকলের সঙ্গে। বেশ কিছু নতুন নতুন বিজ্ঞানীর সঙ্গে আলাপ হল। পরিতৃপ্ত মনে ফিরে এলাম হোটেল কক্ষে। এরই মাঝে সুযোগ পেলেই বাসায় ফোন করে সন্তান-স্বামীর খোঁজ নিয়েছি আমরা।

রাতে শুয়ে শুয়ে আমরা প্রথমবারের মতো পরস্পরের কাছে স্বীকার করি, আমাদের এই দূরে আসা, স্বামী-পুত্র-কন্যা ফেলে রেখে একান্ত নিজের জন্যে নিজেকে কিছুটা সময় দেওয়া প্রচণ্ডভাবে উপভোগ করছি আমরা। কোনও অপরাধবোধ কোনও পিছুটান নেই এতে। অচিরেই এই সিদ্ধান্তে এলাম যে নিজেদের মানসিক প্রশান্তির জন্যে, আমাদের যে একটি আলাদা অস্তিত্ব আছে— একেবারে নিজস্ব ভালোলাগা মন্দলাগার ব্যাপার রয়েছে তা বোঝার জন্যে মাঝে মাঝে এভাবে একা কোথাও আসতে হবে। অফিসের কাজে, বিজ্ঞান সম্মেলনে অথবা কেবল বেড়াতেই।

পরদিন সন্ধ্যায় ফেরার পালা। পোর্টল্যান্ড বিমানবন্দর থেকেই প্লেনে চড়ার কথা। কিন্তু এবার সবকিছুই অন্যরকম। তাই রাতে কথা বলতে বলতে আমরা হঠাৎ ঠিক করলাম আরেকটু অ্যাডভেঞ্চার করব। ভোরবেলা উঠে বাসে করে চলে যাব ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের সিয়াটল শহরে। এ প্লেনটি পোর্টল্যান্ড থেকে সিয়াটল হয়েই যায় মোবিল। ফলে পোর্টল্যান্ডের বদলে সিয়াটল থেকে আমরা প্লেন ধরব। আমার পি.এইচ.ডি-র গাইড প্রফেসর ইয়ামানাকা তখন সিয়াটল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। মিজৌরী বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন তার অধীনে আমি কাজ করেছিলাম গবেষণার। ডঃ ইয়ামানাকা বহুবার যেতে বলেছেন সিয়াটল। তক্ষুনি তাঁর বাসায় ফোন করলে মিসেস ইয়ামানাকা খুব আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের সিয়াটল হয়ে যেতে বললেন। দুপুরে তাঁদের সঙ্গে তাঁদের প্রিয় রেস্টুরেন্টে সিয়াটলের বিখ্যাত খাবার ‘স্মোক্ড স্যামন’ (smoked salmon) খাবার আমন্ত্রণও জানালেন। আমরা সঙ্গে সঙ্গে এয়ারলাইন্সে ফোন করে টিকিটের পরিবর্তন করে নিলাম এইভাবে যে, পোর্টল্যান্ডের বদলে সিয়াটল থেকে আমরা উঠব। এতে ভাড়ার কোনও হেরফের হবে না।

পরদিন খুব ভোরে উঠে দূরপাল্লার বাসে করে উত্তরে যেতে থাকলাম। যুক্তরাষ্ট্রের একেবারে প্রান্তিক পশ্চিম সীমা বরাবর, প্রশান্ত মহাসাগরের তীর ঘেঁষে। কী অপূর্ব সুন্দর এ যাত্রা! একদিকে ধূ-ধূ সমুদ্র, অন্যদিকে সুউচ্চ পাহাড়। ওরেগন থেকে ওয়াশিংটন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের তুলনা হয় না এ দেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের। বাস স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ইয়ামানাকা দম্পতি। রেস্টুরেন্টে যাওয়ার আগে বহুবর্ণের গোলাপশোভিত তাঁদের বসতবাটিতে নিয়ে গেলেন। চা খেয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে তাঁদের প্রিয় রেস্টুরেন্টে স্মোক্ড স্যামন খেয়ে সিয়াটলের ল্যান্ডমার্ক স্পেস নিডল-এর সুউচ্চ স্তম্ভের ঘূর্ণায়মান রেস্তোরাঁয় কফি পান করে যখন নীচে নেমে এলাম তখন সন্ধ্যা হয় হয়। ডঃ ও মিসেস ইয়ামানাকা আমাদের বিমানবন্দরে রেখে এলেন।

ফেরার পথে সারাটা পথ আবার চুপচাপ কেটে যায় আমাদের। আমরা ঘরে ফিরে আসি। বিমানবন্দরে স্বামী-সন্তান অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্যে। আমরা তখন কেবল ভাবছি, আসলেই কি সত্যি- গত দুটো দিনে যা ঘটল?.আরও পরে বুঝেছি এ শুধু সত্য নয়-এ বাঁচার রসদ। সুস্থতা আর স্থিরতা রক্ষার কবচ। একান্ত নিজের জন্যে নিজেকে কিছুটা সময় দিতেই হবে। জীবনের প্রায় সবটা সময়ই তো আমরা কাটাই অন্যের পরিচর্যায়, ইচ্ছায়, খুশিতে। প্রাত্যহিক জীবনে পুরুষরা যদিও বা পায়, নারীরা একেবারেই পায় না, নিজস্ব কোনও সময়, নিজের মতো করে কাটাতে। ফলে কখনও কখনও এই দূরত্ব—এই নিভৃতির বড় প্রয়োজন হয়ে পড়ে তাদের। এই প্রয়োজনবোধ বা তা মেটানোর মধ্যে কোনও গ্লানি বা অপরাধবোধ থাকা উচিত নয়। কেউ যদি এতে স্বার্থপরতা বা উড়নচণ্ডী মনোভাবের প্রকাশ দেখতে পান, তাদের কাছে একটাই নিবেদন: এমন প্রয়োজনীয় স্বার্থপরতা আরও ব্যাপকভাবে আক্রমণ করুক সম্পূর্ণ নারীকুলকে। কেন না এ স্বার্থপরতা সুস্থতারই নামান্তর, যা একটি নারীকে উজ্জীবিত করে; জটিলতামুক্ত নির্মল আনন্দ দেয়; শক্তি, সাহস ও উৎসাহ যোগায় প্রাত্যহিক, সাংসারিক সহস্র দায়িত্ব কর্তব্য করে যেতে— নিরবধি বৈষম্যমূলক জীবনাচরণের শিকার হয়েও মাথা তুলে দাঁড়াবার সামর্থ্য অর্জন করতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *