গর্ভধারিণীর দণ্ড

গর্ভধারিণীর দণ্ড

সন্তান লালন-পালনে ব্যর্থ পিতামাতা সামাজিকভাবে ধিকৃত। সন্তান প্রতিপালন করতে গিয়ে অবহেলা, যত্নের ঘাটতি অথবা নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনের অভিযোগে পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রতিদিন বেশ কিছু মায়ের কারাদণ্ড ঘটে; তাদের গর্ভজাত সন্তানদের সমাজকল্যাণ সংস্থা ঘর থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে ফস্টার হোমে রেখে দেয় ভবিষ্যৎ নাগরিকদের সুষ্ঠু বিকাশের সুযোগ সৃষ্টির প্রয়াসে। কিন্তু গর্ভে বাড়ন্ত সন্তানের প্রতি যথেষ্ট নজর বা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়ে খুব বেশি মা দণ্ডিত হয়েছে বলে শোনা যায় নি। বছর কয়েক আগের এমনি একটি মামলার চমকপ্রদ কাহিনী শোনাব আজ আপনাদের।

ঘটনাটা ঘটেছে অস্ট্রেলিয়ায়। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় এক মহিলা একটি ঝুঁকিপূর্ণ ষাঁড়-দৌড়-প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। পেশাদারী এই দুর্ধর্ষ খেলায় তাঁকে চালাতে হয়েছিল একটি পিক-আপ ট্রাক। প্রতিযোগিতা চলাকালে মহিলা এক ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার শিকার হন। চার মাস পর যে কন্যাসন্তান তিনি প্রসব করেন, তার শরীরে ও মস্তিষ্কে ছিল স্থায়ী জখমের চিহ্ন। এই মেয়েটির যখন আঠারো বছর বয়স হল, তখন সে তার মায়ের বিরুদ্ধে আদালতে এক মামলা দায়ের করে বসে। তার অভিযোগ : গর্ভাবস্থায় তার মায়ের অবহেলা ও অবিবেচনার জন্যে তাকে সারাজীবন একটি পঙ্গু ও অস্বাভাবিক জীবন যাপন করতে হবে; ফলে এরকম পরনির্ভরশীল ও মানসিক যন্ত্রণাময় জীবনের দায়ভার তার মাকে গ্রহণ করতেই হবে। তার জীবনের দুর্দশাকে কিছুটা সহজতর ও সহনীয় করে তোলার অভিপ্রায়ে সে মায়ের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে ক্ষতিপূরণ হিসেবে। আদালতে মায়ের তরফ থেকে তাঁর উকিল যুক্তি দিলেন – যেহেতু গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীর থেকে সন্তানের শরীরকে আলাদা করা যায় না, অর্থাৎ ভ্রূণের কোনো ভিন্ন সত্তা নেই, সেহেতু তাকে বিশেষভাবে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব মায়ের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অযৌক্তিক। কিন্তু উকিলের এই অভিমত বিচারক মেনে নিতে পারেন না। তিনি তাঁর যুক্তি খণ্ডন করেন এই বলে যে, would hold that an injury to an infant suffered during its journey through life between conception and parturition is not injury to a person devoid of personality other than that of the mother to be. Nicole’s (Plaintiff) personality was identifiable and recognizable. আদালত মেয়েটির সামগ্রিক দুর্ভোগ ও স্থায়ী পঙ্গুত্বের জন্যে মাকে দায়ী করেন এবং সন্তানকে ২৮ লক্ষ ডলার প্রদানের আদেশ দেন।

জরায়ুতে অবস্থিত সন্তানের নিরাপত্তা ও মঙ্গলের জন্যে মা বা তৃতীয় ব্যক্তিকে দায়ী করা যাবে কি না এ ব্যাপারে নানান দেশে নানান রকম মত ও আইনের ব্যবস্থা রয়েছে। ব্রিটেনে গর্ভের সন্তানের বিভিন্ন কোনো অস্তিত্বকে মেনে নেওয়া হয় না। আর তাই জরায়ুতে ক্রমবর্ধমান ভ্রূণের প্রতি যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের অক্ষমতার কারণে পরবর্তীকালে কোনো সন্তান মাকে দায়ী করে মামলা করতে পারে না ওখানে। ব্রিটেন মনে করে, এরকম আইন মা ও সন্তানের চিরাচরিত গভীর সম্পর্কে চিড় ধরাতে পারে। তাছাড়া কোনো কোনো ব্যক্তি এটিকে ব্যবহার করে নিজেকে লাভবান করার কারসাজিও করতে পারে। স্কটল্যান্ডে এই ব্যাপারটা নিয়ে পরিষ্কার কোনো জনমত বা আইনগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় নি। সেখানে সন্তান ভ্রূণাবস্থায় তার প্রতি গাফিলতির জন্যে মাকে দায়ী করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভে অবস্থিত সন্তানের মঙ্গল ও নিরাপত্তা বিধানে মেয়েদের প্রতিনিয়ত সমাজের কাছে দায়ী থাকতে হয়। ফলে তার অনভিপ্রেত জীবনযাত্রা জরায়ুর সন্তানের জন্যে কল্যাণকর না হলে সে অবশ্যই সন্তান ও রাষ্ট্রের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। শুধু আইন, সমাজ বা রাষ্ট্রই নয়। অভূমিষ্ঠ সন্তানের নিরাপত্তা ও মঙ্গলের দায়িত্ব প্রাচীনকাল থেকে ঘাড়ে তুলে নিয়েছে আরেকটি সংস্থা—সেটা হল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও তার নিয়মকানুন। খ্রিস্টধর্মের মতানুসারে ক্যাথলিক খ্রিস্টান অধ্যুষিত আয়ারল্যাণ্ডে গর্ভপাত বেআইনি। কিছুদিন আগে ওখানে চৌদ্দ বছরের একটি মেয়ে তার ঘনিষ্ঠতম বান্ধবীর পিতা দ্বারা ধর্ষিতা হয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে মেয়েটির মা-বাবা আদালতে একটি মামলা দায়ের করে। আয়ারল্যান্ডে গর্ভপাত নিষিদ্ধ বলে মেয়েটি লন্ডনে যেতে চেয়েছিল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে। কিন্তু আইরিশ কোর্ট গর্ভপাতের জন্যে তার এই লন্ডনযাত্রায় বাধা দেয়। ব্যাপারটা আরো জটিল হয়ে পড়ে কোর্টের কাছে মেয়েটির মা-বাবার একটি লিখিত আবেদনকে কেন্দ্র করে। মেয়েটির অভিভাবকরা চান ধর্ষণকারীকে শনাক্ত করার উদ্দেশ্যে ভ্রূণ থেকে প্রয়োজনীয় জীবকোষ সংগ্রহ করে গবেষণাগারে তা পরীক্ষা করিয়ে নিতে। এর ফলে আদালতের অনুমতি না নিয়ে গোপনে লন্ডনে গিয়ে গর্ভপাত করিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। এদিকে গর্ভাবস্থা ১৭ সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পর গর্ভপাত করলে যে মায়ের জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যায়, সেটা ডাক্তারিশাস্ত্রে স্বীকৃত। ফলে ধর্মের অনুশাসন, আইন, সামাজিক মূল্যবোধ, পিতামাতার ক্রোধ ও অনুমেয় প্রতিশোধস্পৃহা, ডাক্তারি শাস্ত্রের নীতি, সর্বোপরি ভ্রূণের স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক বৃদ্ধির সঙ্গে মেয়েটির শরীরের অনিবার্য পরিবর্তন মিলে যে গোটা জৈবিক প্রক্রিয়ার ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি, সে সবকিছুর টানাপড়েনে পিষ্ট হচ্ছে চৌদ্দ বছরের ভীত, অপমানিত ও অসহায় একটি কিশোরী যে তার ঘনিষ্ঠতম সখীর পিতার বিশ্বাসঘাতকতা ও পাশবিক লালসার শিকার হয়ে গর্ভে অবস্থিত সন্তান বয়ে বেড়াচ্ছে।

মানব প্রজাতির অস্তিত্ব ও কল্যাণের স্বার্থে অভূমিষ্ঠ শিশুর নিরাপত্তা ও বাঁচার অধিকারকে ধর্ম তথা রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেবে, রক্ষণাবেক্ষণ করবে—এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মানবগোষ্ঠীর মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী আইনকানুন, বিধিব্যবস্থা ও মূল্যবোধ কখনো কখনো এতটাই নির্দয় ও এতটাই অমানবিক হয়ে পড়ে যে, তা ব্যক্তিজীবনে প্রচণ্ড দুর্দশা, দুঃখ ও লাঞ্ছনা বয়ে আনে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বৃহত্তর মানবসমাজের কল্যাণে রচিত আইনকানুন সন্তানের জীবন, সন্তানের কুশলের ব্যাপারে যতটা সজাগ, মায়ের কল্যাণ, মায়ের স্বার্থরক্ষার জন্যে ততটা নয়। আয়ারল্যাণ্ডের মতো আরো যে সকল ক্যাথলিক দেশ রয়েছে (যেমন ইটালি, স্পেন), সেখানে সাম্প্রতিককালে গর্ভপাত সংক্রান্ত নিয়মকানুন বেশ কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। কোনো কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে ও বিশেষ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গর্ভপাত আইনগতভাবে মেনে নেওয়া হচ্ছে। ধর্ষণজনিত গর্ভধারণ ও জীবনের হুমকিস্বরূপ গর্ভধারণ থেকে মেয়েদের পরিত্রাণ দেবার ব্যবস্থা রয়েছে সেসব দেশে। কিন্তু মায়ের জীবনের ঝুঁকি বা হুমকি নির্ণয় করবে কে? জৈবিকভাবে প্রাণধারণ করাটাই কি বেঁচে থাকা? জীবন রক্ষা করা? মেয়েটির মানসিক সুস্থতা কি বেঁচে থাকারই অত্যাবশ্যকীয় উপাদান নয়? আইনের গ্যাড়াকলের চাপে অথবা আর্থিক দুর্গতির কারণে দেশের বাইরে যেতে অপারগ আয়ারল্যাণ্ডের এক লক্ষ মহিলা প্রতি বছর গোপনে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, হাতুড়ে ডাক্তরের কাছে গর্ভপাত করাতে গিয়ে নানারকম জটিলতার শিকার হচ্ছে, কেউ কেউ মৃত্যুবরণ পর্যন্ত করছে। অন্যান্য ক্যাথলিক দেশের তুলনায় আয়ারল্যাণ্ডে জরায়ুর সন্তানের অধিকার সম্পর্কে নিয়মকানুন একটু বেশি কড়া——প্রয়োজনীয় গর্ভপাতের বাস্তবায়ন তাই দুরূহ। আইরিশ সংবিধানের ৮ নম্বর সংশোধনীতে লেখা রয়েছে, The state acknowledges the right to life of the unborn child with due regard to the equal right of the life of the mother guaranteed in its laws to request and as far as practicable by its laws to defend and vindicate that right.

সব দেখেশুনে মনে হয়, সন্তান প্রতিপালন শুধু নয়, সন্তান ধারণ ও বহন করার ব্যাপারে যথার্থ ভূমিকা পালন করল কি না একটি মেয়ে, তা নির্ণয় করবে সে নিজে নয়; তার স্বামী, পরিবার ও সমাজ তো বটেই, তার ধর্মীয় সংস্থা ও সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় সংবিধান ও বিভিন্ন নিয়মকানুন। মা হিসেবে মেয়েটি কতখানি কৃতকার্য, তা মানবিকভাবে যতটা স্বীকৃত ও যাচিত, ততটাই বোধহয় আইনগতভাবেও পরীক্ষিত। তার শরীরকে কেবল নিজস্ব শরীর হিসেবে দেখার অধিকার থেকে বঞ্চিত একটি মেয়ে। সে যেন সন্তান নির্মাণের ছোটখাটো কারখানা একটি। শরীরের ভেতরে জরায়ু নামে সেই যন্ত্রটা স্থাপন করে ন মাসে একটি করে সন্তান সৃষ্টি করে সে। খরিদ্দার যেমন কোনো জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে তার নিখুঁতত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়, ফ্যাক্টরির কোনো দোষে ত্রুটিপূর্ণ কোনো পণ্য বেরুলে ফ্যাক্টরির মালিককে যেমন ক্ষতিপূরণ দিতে হয়, গর্ভাবস্থার কোনো দুর্ঘটনা অথবা অসতর্কতার জন্যে সন্তানের কোনোরকম মস্তিষ্কবিকৃতি অথবা বিকলাঙ্গতা সৃষ্টি হলেও মাকে তেমনিভাবে দায়ী থাকতে হবে। তাকে শাস্তি দিতে পারবে শুধু সমাজ বা রাষ্ট্রই নয়, তারা গর্ভজাত সন্তানও। শুধু তাই নয়, একবার জরায়ুতে প্রাণ সঞ্চার ঘটলে সে-প্রাণ সংযোজন যদি আয়ারল্যাণ্ডের সেই নরপশুর উন্মত্ত ও নির্মম আচরণের মধ্য দিয়েও ঘটে, তাকে রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রতিপালনের দায়িত্বও পড়বে সম্পূর্ণভাবে সেই ভ্রুণ বহনকারীর উপর।

আয়ারল্যাণ্ডের আইন ও আদালত যা ওই চৌদ্দ বছরের মেয়েটিকে লন্ডনে গিয়ে চিকিৎসকের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে গর্ভপাত করতে দেয় নি, কয়েক বছর পর হয়তো অনুরূপভাবে এই মেয়েটিকে আবার নাজেহাল করবে, দণ্ডিত করবে তার গর্ভজাত সন্তানের পক্ষ সমর্থন করে। এই মুহূর্তে মেয়েটি বা তার পিতামাতা হয়তো এই অবাঞ্ছিত সন্তানকে ভূমিষ্ঠ হতে দেবার সিদ্ধান্ত মেনে নেবে না। ইতোমধ্যে গর্ভাবস্থা অনেকটাই এগিয়ে যাবে। সেই অবস্থায় হাতুড়ে কোনো দাইয়ের রাস্তার পার্শ্ববর্তী ছোট্ট ঘরের নোংরা পরদার আড়ালে গর্ভপাতের অপচেষ্টা ব্যর্থ করে যদি মেয়েটি একটি বিকলাঙ্গ সন্তান প্রসব করে ফেলে, তা হলে আদালত বা আইরিশ সংবিধানের ৮ নম্বর সংশোধনীর গর্ভের সন্তানের জীবন-নিরাপত্তার সেই অনুচ্ছেদ মেয়েটিকে কোনোমতেই ক্ষমা করবে না। ক্ষমা করবে না বিকলাঙ্গ সেই সন্তানও। আঠারো বছর পর মেয়েটিকে আবার হয়তো এসে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে—এবারে তার প্রতিপক্ষ ধর্ষণকারী নয়, তার সন্তান এবং আইন প্রয়োগকারী সরকার। গর্ভধারণ ও মাতৃত্বের কী নিদারুণ পুরস্কার!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *