মা হওয়া কি মুখের কথা?
না, মুখের কথা মোটেও নয়। খুব কঠিন একটি কাজ মা হওয়া। আমার মাকে ছোটবেলা একটা গান গাইতে শুনতাম : “শুধু প্রসব করলেই হয় না মাতা, মা হওয়া কি মুখের কথা?” একই গান মার মুখে শুনে শুনে একদিন হঠাৎ দেখি আমার ঠাকুমা স্বয়ং গুনগুন করে গেয়ে উঠেছেন, “শুধু প্রসব করলেই হয় না ব্যথা, মা হওয়া কি মুখের কথা?” আমি তখন অনেক ছোট। কিন্তু ঘটনাটি নাটকীয় মোড় নেওয়ার জন্যে খুব স্পষ্ট মনে পড়ে সে দিনটির কথা। ঠাকুমার মুখে মায়ের গাওয়া গানের এই ধরনের শব্দের বিকৃতিতে (সম্পূর্ণই অনিচ্ছাকৃত) মা একেবারে রেগে আগুন। বড় ঘর থেকে দৌড়ে ঠাকুরঘরে ঢুকে সোজা ঠাকুমার কাছে গিয়ে জানতে চেয়েছিল— “মা, আচ্ছা, আপনি না মা? কেমন করে তা হলে বলেন প্রসব করলেই হয় না ব্যথা? ব্যথা তা হলে হয় কিসে?” ঠাকুমা থতমত খেয়ে যান। নিজের ভুল টের পেয়ে কিছুটা বিব্রতও। আমি তখন সব কথা তেমন বুঝি নি। পরে নিজে সন্তান প্রসব করার পর, বাচ্চা বড় করার পর আজ মনে হয়, বুঝে হোক না-বুঝে হোক মা-ঠাকুমা যে গান গেয়েছিলেন দু জনের গানের কথাই ঠিক ছিল। শুধু সন্তান প্রসব করলেই মায়ের দায়িত্ব যেমন সম্পন্ন হয় না, সন্তান প্রসবের শারীরিক যন্ত্রণাই মায়ের একমাত্র যন্ত্রণাও নয়। জীবনভর সন্তান সম্পর্কিত আরো অনেক শারীরিক-মানসিক ব্যথা সইতে হয় মাকে। তবু আমার মা- ঠাকুমা যে প্রবল উৎসাহে মায়ের দায়িত্ব-কর্তব্য, স্বার্থত্যাগ ও তিতিক্ষা বর্ণনায় এতটা মুখর ছিলেন, তা পরোক্ষে বুঝি নিজেদের কিছুটা হলেও সান্ত্বনা দেবার জন্যেই। বোঝাবার জন্যে যে, মায়ের জীবন এমনই হয়। শাশ্বত মাতৃভূমিকায় নিজেকে সঁপে দেওয়াই তাই বুদ্ধিমানের কাজ। এ ছাড়া জীবনের আর কোনো পরিণতির কথা তাঁরা ভাবতে পারতেন না। আরো পরে আজ বুঝি—শুধু প্রসব করাই মা হওয়ার জন্যে যদিও যথেষ্ট নয়, তবু কেবল এই চিরন্তন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াটির ভেতর দিয়ে যাবার জন্যেও প্রতিদিন কত শত নারী প্রাণ হারাচ্ছে।
জগৎ জুড়ে প্রতি মিনিটে ৩৮০টি নারী সন্তানসম্ভবা হচ্ছে। এর ভেতর প্রায় অর্ধেকই অর্থাৎ ১৮০টি গর্ভধারণই অনাকাঙ্ক্ষিত অথবা অপরিকল্পিত। প্রায় এক- তৃতীয়াংশ (১১০টি) গর্ভধারণ কোনো না কোনো জটিলতার মুখোমুখি হয়। আর কমপক্ষে চল্লিশটির সমাপ্তি ঘটে গর্ভপাতে। মৃত্যু হয় অন্তত একজনের। এক মিনিটের এই হিসেব যদি কাউকে নাড়া দিতে অসমর্থ হয়, তার জন্যে রয়েছে প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যার একটা নমুনা। ওই যে প্রতি এক মিনিটে একটি নারী মাতৃত্বজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করছে, তার মোট সংখ্যা বছরে ৫৮৫ হাজার। পূর্ণবয়স্ক নারীদের এক- তৃতীয়াংশই ভুগছে মাতৃত্বজনিত কোনো বিশেষ অসুবিধে বা প্রসব-পরবর্তী জটিলতায়। পাঁচ কোটিরও বেশি নারী এই ধরনের শারীরিক জটিলতায় প্রতি বছর নিদারুণ স্বাস্থ্যসঙ্কটে পড়ে। প্রত্যেক বছর সাড়ে সাত কোটি অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের সমাপ্তি ঘটায় নারী। এর ভেতর পঞ্চান্ন হাজার গর্ভপাতই (প্রধানত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে) ঘটে অনিরাপদ, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, অশিক্ষিত প্রশিক্ষণহীন গ্রাম্য হাতুড়ে ডাক্তার অথবা দাইয়ের মাধ্যমে। সন্তানের জন্মের সময় মা ও শিশুর যে মৃত্যু ঘটে, তার এক- তৃতীয়াংশই রোধ করা যায় গর্ভবতী মায়ের পুষ্টি ও স্বাস্থ্য পরিচর্যার দিকে লক্ষ রাখলে।
বাংলাদেশে প্রতি এক শ হাজার জ্যান্ত শিশুর জন্মের জন্যে ৪৫০টি নারীকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। তার মানে প্রতি বছর শুধু মা হতে গিয়ে বিশ হাজারেরও বেশি নারী প্রাণ হারাচ্ছে। কোনো কোনো আফ্রিকান দেশে প্রতি এক শ হাজার জীবিত শিশুর জন্মের জন্য এক হাজার মাও মারা যায়। অথচ উন্নত দেশে মারা যায় প্রতি এক শ হাজার জীবিত শিশুর জন্মের জন্যে গড়ে শূন্য থেকে ২৭জন নারী। উন্নয়নশীল সমাজে প্রধানত তিনটি কারণে মাতৃত্বজনিত মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি হয় : (১) নারীদের ভগ্নস্বাস্থ্য ও অপুষ্টি, (২) উন্নতমানের প্রসূতি-স্বাস্থ্যসেবার বিশেষ করে প্রসবকালীন জরুরি ব্যবস্থার অভাব, (৩) বারবার গর্ভধারণ। প্রতিটি গর্ভধারণই যেহেতু একটি মেয়ের জন্যে মৃত্যুর ঝুঁকি বয়ে আনে, যে দেশের মেয়েরা যত ঘন ঘন এবং যত বেশিবার গর্ভবতী হয়, সে দেশের মেয়েদের মাতৃত্বজনিত মৃত্যুর আশঙ্কা তত বেশি থাকে। উদাহরণস্বরূপ আফ্রিকায় গর্ভধারণ ও প্রসব সংক্রান্ত কারণে আজীবন মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে প্রতি ষোল জনে এক জন, এশিয়ায় প্রতি পঁয়ষট্টি জনে এক জন, উত্তর আমেরিকায় প্রতি তিন হাজার সাত শ’তে এক জন ও উত্তর ইউরোপে প্রতি দশ হাজারে এক জন। বাংলাদেশে মাতৃত্বজনিত কারণে সারা জীবনে মৃত্যুর ঝুঁকি উন্নত দেশগুলোর তুলনায় অন্তত এক শ গুণ বেশি। জরুরি প্রসূতি-সেবার অভাব শুধু মায়ের মৃত্যু নয়, সেই সঙ্গে মৃত্যু বয়ে আনে নবজাত সন্তানেরও। প্রতি বছর আশি লাখ মৃত সন্তান জন্ম নেয় অথবা জন্মের অব্যবহিত পর নবজাতকের মৃত্যু ঘটে কেবল পর্যাপ্ত প্রসূতি-সেবার অভাবে।
মাতৃত্বজনিত মৃত্যুর প্রধান কারণ, তিনটি দেরি। (১) সিদ্ধান্ত নিতে দেরি : এর অন্যতম কারণ পরিবারে নারীর নিচু অবস্থান। তার নিজের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা নেই। স্বামী-শাশুড়ির মতো ব্যক্তিরাও প্রসূতি মরণাপন্ন না হওয়া পর্যন্ত হাসপাতালে নেবার কথা ভাবে না। এ ছাড়া খরচ, দূরত্ব, যানবাহনের দুষ্প্রাপ্যতা, হাসপাতালের প্রতি অনাস্থা, ধর্মীয় গোঁড়ামিও সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করার জন্যে দায়ী থাকে। (২) হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেরি : এই দেরি হয় প্রধানত রাস্তা- ঘাটের অবস্থা (যানজট, পাকা রাস্তার অভাব), যানবাহনের সঙ্কট ও অর্থের অভাবজনিত কারণে। (৩) হাসপাতালে নেবার পর প্রয়োজনীয় ও জরুরি সেবা পেতে দেরি; এটা ঘটে হাসপাতালের গাফিলতি, মানসম্পন্ন সেবাদানের ব্যর্থতা ও দক্ষ স্বাস্থ্যসেবকদের অপ্রতুলতার কারণে। এ ছাড়া অতি অল্প বয়সে বা অনেক বেশি বয়সে, অথবা অতি ঘন ঘন কিংবা অনেক বেশিসংখ্যক সন্তান ধারণ করা মাতৃত্বজনিত মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। যেসব শারীরিক জটিলতার কারণে প্রসূতি মায়ের মৃত্যু ঘটে তা হল, প্রসবের পর অনিয়ন্ত্রিত রক্তপাত, একলাম্পশিয়া (উচ্চ রক্তচাপ, প্রসূতি মায়ের হাতে-পায়ে পানি আসা ও খিঁচুনি), গর্ভপাতের জটিলতা, যোনিপথে প্রসবের প্রতিবন্ধকতা, সেপসিস এবং সহিংসতা। বাংলাদেশে মাতৃত্বজনিত মৃত্যুর ১৪% ঘটে পারিবারিক (বিশেষ করে স্বামী কর্তৃক) সহিংসতার কারণে এবং এক-চতুর্থাংশ মাতৃত্বজনিত মৃত্যুর কারণ গর্ভপাতের জটিলতা। প্রতি বছর সাত লাখ তিরিশ হাজার গর্ভপাত ঘটানো হয়। এর ভেতর প্রায় অর্ধেকই ঘটে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অদক্ষ অশিক্ষিত কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে। এ সংখ্যা আরো ভয়াবহ বড় মনে হবে যদি ভাবা যায় পনের থেকে চুয়াল্লিশ বছরের সকল নারীর মধ্যে প্রতি এক হাজারে আটাশ জন এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবী জুড়ে প্রতি সাতটি জন্মের জন্যে একটি করে গর্ভপাত ঘটছে এবং মোট মাতৃত্বজনিত মৃত্যুর এক-অষ্টমাংশই ঘটছে গর্ভপাতের জটিলতায়। ঐচ্ছিক গর্ভপাতের বিভিন্ন কারণের মধ্যে প্রধান কারণ গর্ভনিরোধক ব্যবহার না করা (জগৎ জুড়ে ১২ থেকে ১৫ কোটি বিবাহিত নারী সন্তান না চাওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন কারণে কোনো গর্ভনিরোধক ব্যবহার করছে না) এবং গর্ভনিরোধকের ব্যর্থতা (প্রতি বছর আশি লাখ থেকে তিন কোটি গর্ভধারণ ঘটে গর্ভনিরোধকের ব্যর্থতার কারণে)। সন্তানবতী হতে না চাওয়া সত্ত্বেও গর্ভনিরোধকের ব্যবহার না করার মূল কারণ যৌন সম্পর্ক বা পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অনেক সমাজেই নারীর ভূমিকা অত্যন্ত গৌণ অথবা অনুপস্থিত। এ ছাড়া উন্নয়নশীল দেশে ২০%-৫০% নারী জীবনে কখনো না কখনো জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য হয় বলে জানা গেছে।
ফলে মাতৃত্বজনিত মৃত্যু রোধ করতে হলে তিনটি সুবিন্যস্ত স্তরে নারীকে পূর্ণাঙ্গ সেবা দিতে হবে এবং নিরাপদ মাতৃত্বের প্রতি একটি বিশেষ সহমর্মিতার পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে আপামর জনসাধারণের মধ্যে।
১. প্রাথমিক (তাৎক্ষণিক) স্তর : এই পর্যায়ে প্রসূতি নারীর জন্যে গর্ভকালীন সেবা, প্রসবের সময় দক্ষ ও জরুরি তত্ত্বাবধান ও প্রসব-উত্তর সেবাদানের নিশ্চয়তা দিতে হবে। গর্ভকালীন অন্তত তিনবার এবং জটিলতা দেখা দিলে আরো ঘন ঘন স্বাস্থ্য-সেবাদানকারীর সাহায্য নিতে হবে। এ সময় বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জানা যাবে গর্ভজাত শিশুর বেড়ে ওঠার ধরন এবং মা ও শিশুর স্বাস্থের বিভিন্ন জটিলতা সম্পর্কে। গর্ভবতীর যদি রক্তস্বল্পতা বা উচ্চ রক্তচাপ থাকে অথবা অন্য কোনো শারীরিক অসুবিধে হয়, সন্তানের অবস্থান যদি জরায়ুতে এমন থাকে যে স্বাভাবিক প্রসবের সম্ভাবনা কম, সেক্ষেত্রে আগের থেকেই হাসপাতালে বা ক্লিনিকে যাবার মানসিক ও আর্থিক প্রস্তুতি নেওয়া যায়। এ ছাড়া প্রসবকালীন সেবার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে আয়রন ও ফলিক এসিড খেতে দেওয়া, টিটেনাস ইনজেকশন দেওয়া, মূত্র পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া ডায়াবেটিস হয় নি- মূত্রে অ্যালবুমিন যাচ্ছে না। যদি যায়, সে ব্যাপারে সত্বর ব্যবস্থা নেওয়া, যাতে ভূমিষ্ঠ শিশু ও মায়ের মারাত্মক কোনো ক্ষতি হয়ে না যায়। মাতৃত্বজনিত অধিকাংশ মৃত্যুই ঘটে প্রসবকালীন জটিলতায়। প্রসবের সময় প্রয়োজনে যাতে জরুরি সেবা দেওয়া যায় তার প্রস্তুতি ও ব্যবস্থা করা দরকার আগে থেকেই। গর্ভকালীন পুরো সময়ে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক থাকা সত্ত্বেও শেষ মুহূর্তে প্রসব-পূর্বকালে হঠাৎ জটিলতা দেখা দিতে পারে। তাই নিকটবর্তী হাসপাতাল বা ক্লিনিক যেখানে সিজারিয়ান সার্জারি করা যায় এবং রক্তদানের ব্যবস্থা আছে তার ঠিকানা সংগ্রহ ও ভর্তির পদ্ধতি আগে থেকে জেনে রাখা, রক্তের গ্রুপ মিলানো আত্মীয়কে সঙ্গে নেবার প্রস্তুতি, প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করে রাখা (প্রয়োজনে মহল্লা থেকে সাহায্য নিয়ে) ও যানবাহনের ব্যবস্থা করে রাখা দরকার। চিকিৎসালয়ে গেলে জরুরি ভিত্তিতে প্রসব-সেবা প্রদানের নিশ্চয়তা থাকা একান্ত জরুরি। এসবই সম্ভব সামাজিক সচেতনতা ও প্রবল জনমত সৃষ্টির মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহ ও চাহিদা উদ্রেক করার মাধ্যমে। নাগরিক মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সজাগ থাকার মাধ্যমে। প্রসব-উত্তরকালে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা খুবই জরুরি। শিশুকে বুকের দুধ খাবার নিশ্চয়তা প্রদান, উষ্ণ রাখার ব্যবস্থা, তার নাভির পরিচর্যা ও মাকে ভিটামিন ক্যাপসুল ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার ব্যবস্থা করা দরকার। গর্ভকালীন ও প্রসব-সেবা ছাড়াও এই প্রাথমিক স্তরেই গর্ভপাতে ইচ্ছুক নারীদের নিরাপদ গর্ভপাতের ব্যাপারে পরামর্শ ও গর্ভপাত-সেবা প্রদান করার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। গর্ভপাতের পরপরই পরিবার পরিকল্পনার ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়াও জরুরি।
২. দ্বিতীয় (অন্তর্নিহিত) স্তর : নিরাপদ মাতৃত্বের নিশ্চয়তা বিধানে কেবল প্রসূতি- সেবার ব্যবস্থা করাই যথেষ্ট নয়। গর্ভনিরোধক দ্রব্যের প্রতুলতা নিশ্চিতকরণ ও গর্ভনিরোধের ব্যাপারে বিস্তারিত পরামর্শদান ও তথ্যের সরবরাহ জরুরি। সকল নারী ও পুরুষ যেন নিজেদের পছন্দমতো ও তাদের জীবনের সাথে মানানসই জন্মনিয়ন্ত্রণ-পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারে সে ব্যাপারে সরকার ও বেসরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। সন্তান ধারণ ও প্রসব কেবল নারীর জন্যে নির্ধারিত থাকলেও জন্মনিয়ন্ত্রণ হওয়া উচিত পুরুষ ও নারীর যৌথ উদ্যোগে ও সক্রিয় সহযোগিতায়। অথচ কার্যত এর সিংহভাগের দায়িত্ব একা মেয়েদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রতিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মী ও ডাক্তারদের নারীর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সহমর্মী ও যত্নবান হবার সংস্কৃতি লালন করার মানসিকতা গড়ে তোলা দরকার। “উইমেন ফ্রেন্ডলি” হাসপাতালে গেলে প্রসূতি নারীর শারীরিক অবস্থা লক্ষ করে কেউ কটাক্ষ বা বিরূপ মন্তব্য করবে না, সেবাদানে অহেতুক বিলম্ব ঘটাবে না অথবা কোনো অবহেলা/শৈথিল্য দেখাবে না। এসবের বিরুদ্ধে কঠিন নীতিমালা গ্রহণ ও তা কার্যকর করা দরকার। হাসপাতালের চত্বরে আসা একটি নারীরও জরুরি প্রসূতি-সেবা পেতে বিলম্ব হবে না— এ নিশ্চয়তা দিতে হবে। এ ছাড়া সফল জন্মনিয়ন্ত্রণ ও নিরাপদ মাতৃত্বের পূর্বশর্ত হিসেবে আসে শিশুমৃত্যুর হার রোধ করা। প্রতিটি টিকাদান কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করা, নিয়মিত ‘ভিটামিন এ’ খাওয়ানো, পেটের অসুখ ও নিউমোনিয়ার ব্যাপারে সচেতনতা ও জরুরি চিকিৎসার ব্যবস্থা শিশুমৃত্যু বন্ধ করার জন্যে খুবই জরুরি। এ ছাড়াও দ্বিতীয় স্তরের ব্যবস্থামালা বা কর্মসূচির মধ্যে আসে ভবিষ্যৎ মায়েদের জন্যে উপযুক্ত সাধারণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য-প্রজনন-শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা যাতে তারা ভবিষ্যতে দায়িত্বশীল ও সুস্থ মা হতে পারে নিরাপদ মাতৃত্বের অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে। কিশোর- কিশোরীদেরকে তাদের শারীরিক বিকাশসহ গর্ভধারণ, প্রসব, জন্মনিয়ন্ত্রণ, যৌন রোগ ইত্যাদি বিষয়ে অবহিত করলে ভবিষ্যতে তারা দায়িত্বশীল নাগরিক হতে পারে, যত্নবান স্বামী-স্ত্রী ও পিতামাতা হতে পারে। অল্প বয়সে বিবাহ ও সন্তান ধারণের কুফল প্রতিটি কিশোর-কিশোরী ও তাদের মা- বাবাকে বোঝানো জরুরি যাতে বিয়ে এবং প্রথম সন্তান ধারণকে বিলম্বিত করা যায়। কিছু কিছু বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে নববিবাহিতদের টার্গেট করা অনেক সময়েই ফলপ্রসূ হয় না। অন্তত প্রথম গর্ভধারণের বেলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় দেরি হয়ে গেছে। অনেক মেয়েই বিয়ের রাতে বা অব্যবহিত পরেই প্রথম গর্ভধারণ করে ফেলে এবং সন্তান গ্রহণ করার আগে যে নিজের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির দিকে লক্ষ রাখা দরকার, সে সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে। ফলে বিয়ের আগেই, যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার আগেই, তাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষাদান দরকার। আজকাল ব্র্যাকসহ কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারও যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে কিশোর- কিশোরীদের যৌনশিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ব্যাপারে।
৩. তৃতীয় (মৌলিক কাঠামোগত) স্তর : এ পর্যায়ে আসবে একটা সামাজিক বিপ্লব, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সকল কর্মকাণ্ডে নারীর সমান অংশগ্রহণ, তার সামগ্রিক ক্ষমতায়নের নিশ্চয়তা। এর জন্যে দরকার নারীর উপযুক্ত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও সমাজের অনুকূল পরিবেশ। যতদিন-না নারী তার অধিকার বুঝতে শিখবে, জানতে শিখবে তার মৌলিক অধিকার, স্বীকৃতি দেবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে তার সমান অংশগ্রহণের, ততদিন তাকে সংসারের ও সমাজের দশজনের দয়ার ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে হবে। নারী সেদিনই নিজের শরীরের দায়িত্ব নিজে নিতে পারবে, আর কেউ না এগিয়ে এলেও নিজেই নিজের সন্তানের জন্ম দিতে হাসপাতালে চলে আসবে, যেদিন তার অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা আসবে, তার মৌলিক অধিকার নিয়ে সে সচেতন ও মুখর হবে। তবে সুশীল সমাজের মানুষ হয়ে আমরা আশা করব সেই নিদারুণ দিন কখনো আসবে না, যেদিন প্রয়োজন হবে প্রসব করবার জন্যে নারীকে একা হাসপাতালে প্রবেশ করতে। পারিবারিক, সামাজিক, মানবিক যে- ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে নারী-পুরুষের যৌথ প্রয়াসে একটি প্রাণের সৃষ্টি, সেই প্রাণের মাহেন্দ্রক্ষণে, সেই শুভক্ষণে, একটি নতুন মানুষের জন্মলগ্নে, সৃষ্টির যন্ত্রণায় কাতর নারীটির পাশে অবশ্যই থাকা দরকার তার দরদী, সহমর্মী ও সচেতন প্রেমিক অথবা স্বামীটির।
মাতৃত্বজনিত মৃত্যু রোধ করা জরুরি কর্তব্য শুধু মানবিক কারণে নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণেও বটে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, শুধু নারীদের রক্তস্বল্পতাজনিত কারণে (পুনঃপুনঃ গর্ভধারণ যার অন্যতম কারণ) কৃষি খাতে দশ বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয় আমাদের দেশে। জন্মদান প্রক্রিয়াটিকে যদি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বলয় থেকে তুলে এনে একটি সামাজিক দায়িত্ব—জাতীয় জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা—বলে স্বীকার করে নেওয়া যায়, তা হলে এ ব্যাপারে মনোভাব পাল্টাতে বাধ্য। এ ছাড়া, ভুলে গেলে চলবে না একটি মায়ের মৃত্যু গোটা পরিবারে মারাত্মক অর্থনৈতিক ও পারিবারিক বিপর্যয় ডেকে আনে। মা যদি উপার্জনক্ষম হয় তা হলে তো কথাই নেই। সংসারে তার আয়ের পথ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। গৃহিণী মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে জ্যেষ্ঠা কন্যা বা সকল কন্যাদের, কখনো কখনো কন্যা-পুত্র সকলেরই স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। অসময়ে মায়ের মৃত্যুতে মেয়েরা স্বাভাবিক শিশুকাল/কিশোরকাল ভুলে গিয়ে সংসারে হাল ধরে। পিতারও কর্মস্থলে যেতে প্রায়ই দেরি হয়, অনুপস্থিতির হার বাড়ে, কাজের মনোযোগে অনিয়ম হয়। ছোট বাচ্চাদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও শিক্ষায় অবহেলা ঘটে। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, মায়ের অসময়ে মৃত্যু দুই বছরের সন্তানদের মৃত্যু ঝুঁকি তিন থেকে দশ গুণ বাড়িয়ে দেয়। মতলবের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাবার মৃত্যু ঘটলে দশ বছরের অনূর্ধ্ব বাচ্চাদের মৃত্যুর সংখ্যা প্রতি হাজারে ৬টি বেড়ে যায়। বাবার মৃত্যু কন্যাসন্তানের মৃত্যুর ওপর অবশ্য বিশেষভাবে বা ভিন্নভাবে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে না, ছেলেমেয়ে দু জনেই সমান ক্ষতিগ্রস্ত হয় বাবার মৃত্যুতে। বাবার চাইতে মায়ের মৃত্যুতে ছোট সন্তানদের জীবনসংশয় বেশি ঘটে। মায়ের মৃত্যু হলে দশ বছরের অনূর্ধ্ব ছেলেদের মৃত্যুর হার বেড়ে যায় হাজারে ৫০টি ও কন্যাসন্তানের জন্যে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় হাজারে ১৪৪টি।
এ ছাড়া গর্ভকালীন অপুষ্টি ও অবহেলার কারণে পৃথিবী জুড়ে শতকরা ২০টি শিশু জন্ম নেয় স্বল্প ওজন নিয়ে। এইসব শিশুর পরবর্তীকালে শারীরিক ও মানসিক বেড়ে ওঠায় প্রায়শই প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। এর মানে পৃথিবীতে প্রতি বছর ২ কোটি শিশু জন্ম নেয় স্বল্প ওজন (২.৫ কেজির কম) নিয়ে। অর্থনীতির ওপর এ যে কী ভয়ানক চাপ ফেলে, তা অনেকেই তলিয়ে দেখে না। বাংলাদেশে শতকরা প্রায় ৪০টি শিশুই জন্ম নেয় স্বল্প ওজন নিয়ে। এ ক্ষতি অনেক সময়েই আর পুষিয়ে নেওয়া যায় না। ভবিষ্যতে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ালেও অনেক ক্ষেত্রেই এটা থেকে যায় অপূরণীয়।
নিরাপদ মাতৃত্বের ব্যবস্থার অভাবে শুধু মায়েদের মৃত্যুই ঘটে না, অনেক মা-ই আজীবন পঙ্গু ও অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকে। যেসব স্থায়ী অসুস্থতা বা প্রতিবন্ধকতা মাতৃত্বজনিত কারণে মেয়েদের পঙ্গু করে রাখে, তার মধ্যে জরায়ুর বাইরে বেরিয়ে পড়া, ফিস্টুলা (প্রজনননালী ও মূত্রনালীর ভেতর ছিদ্র হয়ে যাওয়ায় প্রতিনিয়ত অনিয়ন্ত্রিততভাবে প্রস্রাব নির্গত হওয়া), সহবাসে প্রদাহ, তলপেটে যন্ত্রণা উল্লেখযোগ্য। এর ভেতর ফিস্টুলার (ভেসিকো ভেজাইনাল ফিস্টুলা) মতো শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণাদায়ক দুরবস্থা ও করুণ পরিণতির বোধহয় কোনো তুলনা নেই। এই বিশেষ শারীরিক অবস্থার মোকাবিলা করে গ্রামে-গঞ্জে, এমনকি শহরেও কত নারী যে স্বামী পরিজন পরিত্যক্তা হয়ে অমানবিক জীবন যাপন করছে, নিজেকে সর্বদা নোংরা, অপবিত্র ও তুচ্ছ ভেবে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে তার খবর কেউ রাখে না। প্ৰতি বছর আশি হাজার মেয়ের যোনিতে ফিস্টুলা হচ্ছে এবং বর্তমানে দশ লক্ষ মেয়ে এই মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অনেকেই এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে পারত। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে এবং অদক্ষ দাইয়ের হাতে ঘরে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে বাংলাদেশের এক-চতুর্থাংশ থেকে এক- তৃতীয়াংশ নারী প্রজননতন্ত্রে সংক্রামক রোগের শিকার হয়। অনেকেই মারা যায় টিটেনাসে যা গর্ভকালে দুটি মাত্র ইনজেকশন দিয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব। প্রসব- পরবর্তীকালে প্রজননতন্ত্রে সংক্রামক রোগের আরেকটি উৎস অপরিচ্ছন্ন ও জীবাণুযুক্ত ন্যাকড়া ব্যবহার করা, ঘন ঘন নিজেদের পরিচ্ছন্ন না করা, নিয়মিত গোসল না করা। প্রসবের জটিলতায় এত মৃত্যু, এত স্থায়ী প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আজো বাংলাদেশে মাত্র ৪% সন্তান জন্ম নেয় হাসপাতাল বা ক্লিনিকে। বাকি সবাই জন্ম নেয় ঘরে। জন্মদান যতই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া হোক না কেন, এটা অনস্বীকার্য যে শতকরা অন্তত ১৫টি প্রসবের ক্ষেত্রে গর্ভবতীর বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেয়, যার জন্যে তার উপযুক্ত সরঞ্জাম ও একজন দক্ষ স্বাস্থ্যসেবাদানকারীর প্রয়োজন হয়। প্রতিটি গর্ভধারণই জীবনের ঝুঁকি বয়ে আনে। বিশেষ করে জরুরি প্রসূতি-সেবাদানের ব্যবস্থা যেখানে নেই সেখানে এই ঝুঁকি আরো বেশি। নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশি বছর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও বাংলাদেশসহ বেশ কিছু দেশে এখনো যে গড় আয়ুতে তারা পুরুষের পেছনে পড়ে রয়েছে তার অন্যতম কারণ মাতৃত্বজনিত কারণে অতিরিক্ত মৃত্যু ও নারীর প্রতি যুগ-যুগান্তরের অবহেলা ও অবিচার।
আর তাই বাংলাদেশের বহু আলোচিত স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা কর্মসূচিতে মায়ের স্বাস্থ্য ও নিরাপদ মাতৃত্বের ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে দাতা গোষ্ঠীর চাপে পড়ে শুধু সুন্দর নথিপত্র তৈরি করলেই চলবে না, বাস্তবেও তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। আর সেটা সম্ভব শুধু স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন করেই নয়, গোটা সামাজিক কাঠামো ও মূল্যবোধের পরিবর্তনের মাধ্যমে, নারীর প্রতি মনোভাবে ও তাদের মূল্যায়নে আমূল পরিবর্তন এনে—নারীর মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতিতে, তার সামগ্রিক অবস্থানের উন্নয়নে। স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা কর্মসূচিতে বর্ণিত অঙ্গীকার ধরেই তাই বলতে fa, “No new discoveries are needed to save the lives of women from death due to pregnancy related causes… The same women who contribute to 4২ percent of the labor force of a country faces death and disability in the very process that brings forth life The need is for nurturing a sociocultural movement that reduces maternal mortality as a woman’s right, and also enhances woman’s self esteem and status… The improvement of Bangladesh women’s health is not just a social and moral necessity. It is also an economic imperative.”