পুরুষ ও প্রকৃতি—নারীর দুই চিরন্তন প্রতিপক্ষ

পুরুষ ও প্রকৃতি—নারীর দুই চিরন্তন প্রতিপক্ষ

নারীর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের বড় বাধা কেবল পুরুষ বা পুরুষতন্ত্র নয়। প্রকৃতি নিজেই নারীর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে সৃষ্টির সেই আদিকাল থেকে। প্রকৃতির এই অসম বিভাজন—এই চরম বৈষম্যের প্রতিফলন নারীর শরীর ও তার জীবনচক্র। চতুর পুরুষ এই দৃশ্যত শারীরিক বিভাজনকে পুঁজি করেই নানারকম নারী অবদমনের হাতিয়ার তৈরি করেছে যেমন সামাজিক রীতিনীতি, ধর্মীয় অনুশাসনের নাগপাশ, পারিবারিক বিধিনিষেধ ও মূল্যবোধ, ইত্যাদি। ফলে পুরুষতন্ত্র থেকে মুক্তি আন্দোলনের সময় এ-কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, আরো একটি মহাপরাক্রমী শক্তির বিরুদ্ধেও প্রতিনিয়ত লড়তে হবে নারীকে। শুধু মানুষের তৈরি বাধানিষেধ, বৈষম্য, অনাচার, অত্যাচারের বিরুদ্ধে নয়, প্রকৃতিদত্ত ও জন্মগতভাবে প্রাপ্ত নারীশরীরের জন্যেও দ্বিগুণ প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তাকে যুদ্ধ করে যেতে হবে।

বিবর্তনবাদ আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, বেঁচে থাকার লড়াইয়ের মাধ্যমে প্রাণীর শরীরে অতি ধীরে একরকম রাসায়নিক ও জৈবিক পরিবর্তন ঘটে যা আস্তে আস্তে তাকে প্রয়োজনীয় শারীরিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকার ও বংশরক্ষা করার সামর্থ্য জোগায়। ফলে কয়েক কোটি বছর পর ধর্ষণ, প্রহার, খুন, অনাহারের মতো বৈষম্য বা অত্যাচারের প্রতিরোধে নারীর শরীর ঠিক কীরকম চেহারা নেবে আমরা জানি না। তবে আজকে নারীর যে দেহের গড়ন বা জীবনচক্র, তা দেখে মনে হয়, একমাত্র ‘আদর্শ পরিবেশ’ ছাড়া পুরুষ ও সমাজের কাছে নারী সমঅধিকার বা মর্যাদা আশা করতে পারে না। এখন দেখা যাক, বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রকৃতি কেমন করে নারীর বিরুদ্ধে পুরুষকে তার স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দিয়েছে, যা পদে পদে নারীকে অবদমনের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।

পরিবারে একটি কন্যাসন্তান যখন জন্মগ্রহণ করে, সেই ঘটনাটি প্রাথমিকভাবে কোনো কোনো সংসারে যতই আশাভঙ্গ বা নিরানন্দ সৃষ্টি করুক না কেন, আস্তে আস্তে তা সামলে উঠে প্রায় প্রতি পরিবারই কন্যাটিকে পুত্রসন্তানের মতোই আদর-যত্ন, স্নেহে লালন করতে থাকে। ফলে জীবনের প্রথম দশকটিতে কন্যাশিশুটিকে বিশেষ তেমন বাধানিষেধ বা বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হয় না। নয়-দশ বছর বয়স পর্যন্ত একটি মেয়েশিশু আর ছেলেশিশুর চলাফেরা, আচরণের মধ্যে পারিবারিক বাধা বা নিষেধে তেমন পার্থক্য দেখা যায় না। যদিও কিছু প্রান্তিক ও দুস্থ পরিবারে খাদ্যবন্টন, স্বাস্থ্যসেবা ও সংসারের কাজকর্ম বণ্টনের ব্যাপারে কিছুটা বিভাজন ও বৈষম্য লক্ষ করা যায়। কিন্তু গোল বাধে মেয়েটির শরীরে যখন থেকে কন্যাসুলভ বিভিন্ন সমাহার বিকশিত হতে শুরু করে। অর্থাৎ যখন থেকেই তার স্তনের আবির্ভাব ঘটে, নিতম্ব ভারী হতে শুরু করে, হাতে, পায়ে, গলায়, মুখমণ্ডলে হালকা, মসৃণ, পেলব মেদের স্তর জমতে থাকে নরম ত্বকের ঠিক নিচের ভাঁজে, যা তাকে দৃশ্যত মোহনীয় করে তুলতে শুরু করে, তখনই তার হাতে-পায়ে বেড়ি বেঁধে দেয় পরিবার। ফলে প্রকৃতি এখানে নারীর যৌনতাকে বহিরঙ্গে প্রতিস্থাপন করে পুরুষ ও সমাজকে সাহায্য করে নারীকে ঘরের ভেতর অবরুদ্ধ করে রাখার ব্যাপারে। পোশাকে-আশাকে ঘোমটায় সর্বাঙ্গ ঢেকেঢুকে ঘরে বন্দী হয়ে থাকতে অথবা আনত নয়নে পথ চলতে নারীকে তখন বাধ্য করে পুরুষ। এটা সত্য, নারীকে অন্তঃপুরে ঢুকিয়ে দিয়ে পুরুষ তার পিতৃত্বের পবিত্রতা রক্ষার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে চায়। কিন্তু বিবাহের অনেক আগে, সন্তান জন্মদানের ক্ষমতা পুরোপুরি অর্জনের আগে থেকেই যে ঘরবন্দী করে রাখা হয় মেয়েদের তার বড় কারণ মেয়েদের যৌন অনুষঙ্গের বহিরঙ্গে উপস্থিতি। স্তন ও নিতম্ব যদি বহিরঙ্গে স্থান না পেত, কার্যত এমন দৃশ্যমান ও লোভনীয় না হয়ে উঠত, নারীকে ঘরের ভেতর আবদ্ধ করে রাখার জন্যে, পোশাকে-আশাকে তাকে ঢেকেঢুকে রাখার ব্যাপারে আরো জোরালো যুক্তি খুঁজতে আরো হন্যে হয়ে বেড়াতে হতো পুরুষকে। শিশ্ন ও যোনির মতো স্তন ও নিতম্বও শরীরের এমন স্থানে অনায়াসে জায়গা পেতে পারত, যা সরাসরি দৃষ্টিগোচর নয়।

স্তন ও নিতম্বের পর নারী শরীরে এসে যোগ দেয় আরো একটি অবদমনের হাতিয়ার। মাসিক। নারীকে স্বতন্ত্র করে রাখা বা দেখা এবং তার চলাফেরায় বিধিনিষেধ আরোপের ব্যাপারে এর চেয়ে বড় ভূমিকা আর কোনো কিছু নিয়েছে কি না সন্দেহ। মাসিকের সময় বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় কার্যকলাপে অংশগ্রহণের সীমাবদ্ধতা ও নিষেধাজ্ঞা মেয়েদের অধস্তন অবস্থা নির্ধারণে ও তাদের নিজেদের মধ্যে হীনমন্যতাবোধ জাগ্রত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মোটকথা, যে-মুহূর্তে নারী প্রজনন ক্ষমতার অধিকারী হতে শুরু করে, তার বাহ্যিক এই সকল পরিবর্তন এমন করে বিকশিত হতে থাকে যে, পুরুষ তাকে অন্তঃপুরে রেখে শুধু যৌনানন্দ ও সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে গণ্য করতে শুরু করে।

প্রাণীর কাছে প্রকৃতির একটিই প্রত্যাশা—প্রজননের মাধ্যমে সৃষ্টির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। সেই প্রত্যাশা পূরণ যত সহজে এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে ঘটবে ততই মঙ্গল—প্রকৃতির জন্যে। ফলে নারীর সম্ভ্রম বা আত্মপ্রত্যয় নয়, পরবর্তী প্রজন্ম সৃষ্টির হাতিয়ার হিসেবেই বরাবর নারীকে দেখে এসেছে প্রকৃতি।

সৃষ্টির ধারাবাহিকতা রক্ষার ব্যাপারে নারীর কাঁধে তুলে দেওয়া হয়েছে এক অসম বোঝা। নারীর দৈহিক গঠন, বিশেষ করে তার প্রজনন কাঠামো ও কার্যকলাপ নারী অবদমনের মূল হাতিয়ার। প্রকৃতি যদি নারীর প্রতি সদয় হতো, সৃষ্টির ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে নারীকে পুরুষের সমান করে দেখত, তাহলে নারীর যৌনতাকে, তার শরীরের বিকাশকে এমনভাবে উপস্থাপন করতো না। মাসিক ও তার ব্যবস্থাপনার ঝক্কি-ঝামেলা ও ভয়, উন্নয়নশীল দেশে মেয়েদের স্কুল কামাই ও স্কুল থেকে ঝরে পড়ার একটি প্রধান কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে বেশকিছু বড় বড় গবেষণায়। শরীরে হরমোনের যে ওঠানামার জন্যে প্রতিমাসে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণুর নির্গমন ঘটে এবং পরবর্তীকালে মাসিকের আবির্ভাব হয়, জৈবিক কারণে সেই চক্র বজায় রেখেও প্রকৃতি এই বাহ্যিক রক্তপাতের ব্যাপারটায় নারীকে ছাড় দিতে পারত। প্রতিমাসে তার জরায়ুর পর্দা ছিঁড়ে বহিরঙ্গে রক্ত ক্ষরণের কি আদৌ প্রয়োজন ছিল? অন্যান্য সমস্ত প্রাণিকুলে এই প্রক্রিয়া তাহলে জরুরি নয় কেন? আমরা পরবর্তী সময়ে আলোচনা করব, প্রাকৃতিকভাবে অথবা প্রযুক্তির মাধ্যমে সংখ্যায় কমবেশি মাসিক হওয়া অথবা পুরোপুরি মাসিকের নিবৃত্তির সঙ্গে নারীস্বাস্থ্যের যোগাযোগ কতখানি, আদৌ কোনো সম্পর্ক রয়েছে কি না, থাকলে এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এ-ব্যাপারে কী এবং কতটুকু জানা গেছে।

প্রকৃতি আরো যেভাবে নারী-অবদমনের সুযোগ করে দেয় পুরুষকে তা হলো নারীর যৌন অঙ্গের গঠন ও কার্যপ্রণালি। নারীর প্রধান যৌনাঙ্গ যদি এমন না হতো, যে তার ইচ্ছা-অনিচ্ছায় কিছুই যায় আসে না, তার প্রবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও পুরুষ তার জৈবিক বাসনা ও যৌনলিপ্সা চাপিয়ে দিতে পারে নারীর ওপর, তাহলে ধর্ষণ নামক জগৎজুড়ে প্রচণ্ড কুৎসিত অপরাধটি—নারীজীবনের এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাটি ঘটার সুযোগ হতো না। প্রকৃতি এমনভাবেই নারীর যৌনাঙ্গ তৈরি করেছে যাতে পুরুষের ইচ্ছার কাছে নারীকে সহজেই সমর্পিত হতে হয়। এতে করে মানুষ হিসেবে তার মৌলিক অধিকার বা আত্মসম্মান যতটাই লুণ্ঠিত হোক না কেন, প্রকৃতির খায়েশ — সৃষ্টির ধারবাহিকতা, ঠিকই রক্ষা পায়—পরিতৃপ্তি পায় পুরুষের যৌনাকাঙ্ক্ষা ও যৌন অনাচার। অথচ উল্টোটি অর্থাৎ নারীকে দিয়ে পুরুষের ওপর বলাৎকারের ঘটনা প্রায় কোথাও শোনা যায় না, যার অন্যতম কারণ পুরুষের যৌনাঙ্গের প্রকৃতি ও কার্যাবলি। পুরুষের নিজের ইচ্ছা ছাড়া নারী তাকে যৌনক্রীড়ায় অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করতে পারে না। এখানেও প্রকৃতি পুরুষকে অধিকতর আধিপত্য দিয়েছে, সন্দেহ নেই। এছাড়াও প্রকৃতি পুরুষকে দিয়েছে অপেক্ষাকৃত বেশি গায়ের জোর, শক্তিশালী মাংসপেশি, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণে পুরুষ এই প্রকৃতিদত্ত উপহারের অপব্যবহার করে।

এছাড়া প্রধানত যেভাবে প্রকৃতি নারী অবদমনের সুযোগ করে দেয়, তা হলো সন্তান ধারণ, প্রসব, সন্তান প্রতিপালন ও দুগ্ধদানের মতো জৈবিক ব্যাপারগুলো সম্পূর্ণ নারীর ওপর চাপিয়ে দিয়ে। সন্তান উৎপাদন, প্রতিপালন ও দুগ্ধদানের জন্যে পেশাজীবী নারীকে তার কর্মক্ষেত্রের পরিধি সঙ্কুচিত করতে হয়, অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের পেশা বেছে নিতে হয়, কাজে উন্নতির ব্যাপারে স্বার্থত্যাগ করতে হয়, কখনো কখনো অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও জীবিকাকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করে ঘরবন্দী হতে হয়। শরীরে ভ্রূণের আকারে জন্ম নেয়া সন্তান যখন নিজের রক্তে, মাংসে, পুষ্টিতে শরীরের ভেতর দীর্ঘ ন’মাস ধরে তিলতিল করে বেড়ে ওঠে, তারপর প্রবল প্রসব-যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে স্বপ্নের মতো আবির্ভূত হয় একদিন, যার মুখে তুলে দেওয়ার মতো আদর্শ খাদ্যও যখন নিজের শরীর থেকেই নিঃসৃত হয় নারীর, তখন সেই সন্তানের সঙ্গে তার যে স্থায়ী বন্ধন রচিত হয়, তা আর কোনো জাগতিক সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। একটি নারী যখন সন্তানসম্ভবা হয়, অথবা সন্তান প্রসব করে কিংবা দুগ্ধদান করে, তার শরীরে হরমোনের প্রচণ্ড ওঠানামা ঘটে। এস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টারোন হরমোন যা নারী যৌন অনুষঙ্গ ও আকাঙ্ক্ষা বিকশিত করে, নারীর যৌনতাকে পুরুষের চোখে আকর্ষণীয় করে তোলে, যে দুটি হরমোন প্রধানত নারীত্বের হরমোন বলে সুপরিচিত, সেগুলো ছাড়াও গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী নারীর শরীরে অন্য হরমোনগুলো যেমন অক্সিটসিন, ভ্যাসোপ্রেসিন, প্রোল্যাকটিনের পরিমাণ বেড়ে যেতে থাকে। এই শেষোক্ত হরমোনগুলো প্রসবে সহযোগিতা করে, স্নেহে আর্দ্র করে, দুগ্ধবতী করে নারীকে। ফলে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, সন্তান যদিও পিতামাতার যৌথ সৃষ্টি এবং সন্তানের জন্মে মাতা- পিতা উভয়েই বাৎসল্যবোধে প্লাবিত হয়, নারী যেমন নিজ শরীরে সন্তানকে ধারন করে এবং নানা ধরনের জৈবিক ও রাসায়নিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে সন্তানকে নিজের দেহে আশ্রয় দিয়ে বড় করে তোলে, দুগ্ধদান করে, তাতে সন্তানের সঙ্গে মায়ের যে অটুট ও জৈবিক সম্পর্ক রচিত হয়, পিতার সঙ্গে ঠিক তেমনটি ঘটে না। গর্ভবতী স্ত্রী ও শিশুসন্তানের সান্নিধ্যে পিতার শরীরেও স্নেহশীলতার হরমোন কিছুটা প্লাবিত হয়, কিন্তু নারীশরীরে কিছু কিছু হরমোনের প্রচণ্ড প্রস্রবণ ও প্রবল তোলপাড়ের তুলনায় তা সামান্যই। ফলে পিতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক গড়ে ওঠে ধীরে ধীরে— মূলত পারস্পরিক সান্নিধ্যে পারিবারিক ও সামাজিক অন্যান্য ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক যেমন করে গড়ে ওঠে, সেভাবেই।

নারীর বিরুদ্ধে প্রকৃতির আরেক অবদমনের নজির নারীজীবনে রজঃনিবৃত্তি। নারীকে যে প্রকৃতি পুরুষ আর সমাজের মতোই শুধু পরবর্তী প্রজন্মের স্রষ্টা হিসেবেই দেখে এসেছে, এর বেশি কিছু নয়, তার বড় প্রমাণ যখন একটি নারীর সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা হ্রাস পায়, তখন রজঃনিবৃত্তির মাধ্যমে নারী হরমোনগুলো এতটাই ঘাটতি শুরু হয় নারীশরীরে যে, তার যৌনাকাঙ্ক্ষা লোপ পায় অথবা প্রচণ্ডভাবে স্তিমিত হয়ে আসে। তার শারীরিক বিভিন্ন অস্বাচ্ছন্দ্য, উপসর্গ তীব্রভাবে দেখা দেয়—যেমন হঠাৎ হঠাৎ শরীরে প্রচণ্ড গরমের দমক লাগা, যৌনাঙ্গ শুকিয়ে যাওয়া, মাথা ঝিমঝিম করা, সমস্ত অস্থিগ্রন্থিতে ব্যথা, হাড় ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া, স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়া, স্তনের ও জরায়ুর ক্যান্সারের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাওয়া। এসবই প্রমাণ করে, প্রকৃতির কাছে নারীজীবনের প্রয়োজনীয়তা তখন প্রায় শেষ। কেননা সন্তান জন্ম ও প্রতিপালনের মৌলিক দায়িত্ব সমাপ্ত করে ফেলেছে নারী। এখন সে ইহলোক পরিত্যাগ করলে জীব বা জগতের কিছু আসে-যায় না। প্রকৃতির এই খামখেয়ালি, ইচ্ছা বা অবহেলা পুরুষ তার বিভিন্ন আচরণের মাধ্যমে ব্যক্তিজীবনে প্রতিফলিত করে। বার্ধক্যের সঙ্গে সঙ্গে পুরুষের শরীরেও যৌন হরমোনের নিম্নগতি লক্ষ করা যায়, যৌনাকাঙ্ক্ষাও আগের মতো তীব্র থাকে না। কিন্তু এর মাত্রা এবং বহিঃপ্রকাশ তেমন প্রচণ্ড নয়, যেমনটি দেখা যায় নারীর বেলায়। যার জন্যে আশি বা নব্বই বছর বয়সেও পুরুষ সন্তানের জন্ম দিতে সমর্থ, নারী নয়। পুরুষের শরীরেও বৃদ্ধ বয়সে প্রোস্টেটের ক্যান্সারের হার বেড়ে যায়, কিন্তু প্রথমত এই ক্যান্সার বৃদ্ধি পায় অতি ধীরে, ছড়ায় কম, এর চিকিৎসাও অপেক্ষাকৃত সহজ এবং এটি নিরাময়যোগ্য। পুরুষের স্তিমিত যৌনক্ষমতাকে চাঙ্গা করে তোলার জন্যে বাজারে কতরকম ওষুধ, টনিক ও পুষ্টি-সম্পূরকের ব্যবস্থা! আরো কত গবেষণা চলছে নতুন নতুন ও উন্নতমানের পুরুষের যৌন-উত্তেজক ওষুধ আবিষ্কারের। নারীর জন্যে এ-ধরনের প্রায় কিছুই নেই। জাপানে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি আবিষ্কারের পর পঁয়ত্রিশ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও তা বাজারজাত করার ছাড়পত্র দেওয়া হয় নি। অথচ ভায়াগ্রার মতো ওষুধ আবিষ্কৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জাপানের বাজার ছেয়ে গেছে, ভায়াগ্রাকে বাজারজাত করার ছাড়পত্র পেতেও একটু দেরি হয় নি জাপানে। জগৎজুড়ে এই নিয়ে প্রবল বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে অবশ্য শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ পুরুষের যৌন-উত্তেজক বড়ির ছাড়পত্র দেওয়ার পর জাপানে অবশেষে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ির বাজারজাত করার অনুমতি পাওয়া গিয়েছে।

ফলে দেখা যাচ্ছে, প্রকৃতিদত্ত জৈবিক বৈষম্যকে পুঁজি করে পুরুষ ও সমাজ বরাবর নারীকে দাবিয়ে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। আগেই বলা হয়েছে, জীবনের প্রথম দশকে নারী ও পুরুষশিশুর মধ্যে তেমন পার্থক্য বা বিভেদ লক্ষ করা যায় না। কিন্তু প্রথম দশকের পর থেকেই নারী-পুরুষ সম্পর্কে সবসময়েই একটা অসমতা বিরাজ করে, যা জীবনের শেষপ্রান্তে না আসা পর্যন্ত কোনো সমঝোতায় পৌঁছায় না, বিশেষ করে আমাদের দেশে, যেখানে স্ত্রীর চাইতে স্বামীর বয়স অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিছুটা বেশি হয়। জীবনের দ্বিতীয় দশকে মেয়েরা যখন কিশোরী বা কৈশোরোত্তীর্ণ, তাদের মনে পুরুষ সম্পর্কে আগ্রহ জাগে। মনের ভেতর নানা ধরনের রোমান্টিক চিন্তা ও প্রত্যাশা জন্মায়। প্রেম ও প্রেমিক সম্পর্কে রোমান্টিক সব স্বপ্ন দেখতে শুরু করে মেয়েরা। হরমোনের বিচিত্র কাণ্ডকারখানা তাদের শরীরে কাঁপন তোলে—শিহরণ জাগায়। হৃদয় আর্দ্র হয়ে ওঠে। পুরুষের চিন্তা ও পুরুষসঙ্গ ভালো লাগতে শুরু করে। পুরুষের কাছাকাছি আসা, এক-আধটু আলতো ছোঁয়া, পাশাপাশি বসে কথা বলা ইত্যাদি ব্যাপারে আগ্রহ বাড়ে মেয়েদের; কিন্তু তখন এই বয়সের পুরুষসঙ্গী প্রচণ্ড যৌন তাড়নায় ভোগে। রোমান্টিক চিন্তা-টিন্তা নয়, সরাসরি যৌনকেলিতে অংশগ্রহণ করতে মরিয়া হয়ে ওঠে পুরুষ। ফলে প্রেমে হাবুডুবু খেতে-থাকা প্রেমিকা বা সদ্য বিবাহিত স্ত্রী হতাশ হয় স্বামীর আগ্রাসী আচরণে—তার একরৈখিক জৈবিক চাহিদায়। কেননা, নারীর যৌন-আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা তখনো ততটা প্রকট হয় নি, যেমন হয়েছে তার রোমান্সের ধারণার, আদর ও নরম সোহাগের আকাঙ্ক্ষার। এসব আকাঙ্ক্ষা ও আকর্ষণের পরিণতিতেই কেবল যৌন-সংসর্গ উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দশকের মেয়েদের জীবনে। এছাড়া নয়। এরপরের দুই দশকে, অর্থাৎ ত্রিশ ও চল্লিশের কোঠায়, নারীর যৌনতা আস্তে আস্তে জেগে ওঠে। পুরুষসঙ্গীর জন্যে আকুল হয় মন। কামভাবে কাতর নারী স্বামী বা প্রেমিকের শারীরিক সান্নিধ্য কামনা করে প্রবলভাবে। কিন্তু ততদিনে পুরুষ তার সঙ্গিনীর শরীর সম্পর্কে এতটাই অবগত ও পরিচিত হয়ে পড়েছে যে, তার দেহ-সম্পর্কে আগের সেই আগ্রহ আর থাকে না তার। পুরুষ বরাবরই জয় করতে ভালোবাসে। নারীকে বশে এনে তাকে উপভোগ করার পর বিজয়ীর আনন্দ যতটা না সে উপভোগ করে, তার চেয়ে বেশি বোধ করে সে পুরাতনের প্রতি ক্লান্তি ও একঘেয়েমি। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকের পুরুষ তার পেশা, কর্মক্ষেত্র, বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব, ব্যবসা গোছানো—বলতে গেলে তার পেশায় প্রতিষ্ঠা বা সাফল্য লাভেই বেশি মনোযোগী, বেশি উদ্যোগী হয়ে ওঠে। ঘরের চাইতে বাইরেই সময় কাটে বেশি তার। এইসময় শিশুসন্তান ও বাড়ন্ত সংসারে বন্দী নারী নানানভাবে মুক্তি খোঁজে। কেউ তার যাপিত জীবনের ক্লান্তি ও একঘেয়েমি দূর করতে ফুলের বাগান করে, কাঁথা সেলাই করে, ছেড়ে দেওয়া গানের অনুশীলন শুরু করে, কবিতা পাঠ করে, সাহিত্য রচনার চেষ্টা চালায় অথবা নিজের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্যে সমমনা মানুষ খোঁজে। সেই মানুষটি আরেকটি নারী হলে সমস্যা তেমন হয় না। পুরুষ হলে, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে, না গড়ে উঠলেও অপবাদের ঝড় ওঠে।

এর পরের দশকে সন্তানরা আরো যখন বড় হয়, মায়েরা সন্তানের পড়াশোনা, চাকরি-বাকরি ও সর্বাঙ্গীণ কল্যাণে এতটাই ব্যস্ত থাকে যে, সন্তান ও স্বামী ছাড়া বাকি যেটুকু সময় থাকে তার সবটাই প্রায় কাটে দৈনন্দিন রান্নাবান্না, আতিথেয়তা ও লৌকিকতায়, সঙ্গে জীবিকা অর্জনের দায়িত্ব থাকলে তো কথাই নেই। এইসময় রজঃনিবৃত্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় নারীশরীরে। যৌনতার আগ্রহ হারাতে বসে নারী। আর সেই সময় পেশায় প্রতিষ্ঠিত ও পরিতৃপ্ত অথবা পেশা কিংবা ব্যবসায় ব্যর্থ এবং হতাশ পুরুষ বাইরের দিকে ঝুঁকে পড়ে আরো বেশি। স্বামী, সন্তান ও সংসারে সমর্পিত প্রাণ, নিবেদিত জীবনের অধিকারী স্ত্রীর প্রতি আগ্রহ আরো কমে যায় তার। অনাসক্ত হয়ে পড়ে পুরুষ অনুত্তেজক একঘেয়েমিতে ভরা অতিপরিচিত স্ত্রীর প্রতি। অনেক পুরুষই এসময় অন্য নারী বিশেষ করে অল্পবয়সী নারীদের প্রতি দারুণ আগ্রহ, আসক্তি ও আকর্ষণ বোধ করে। নিজের পড়াশোনা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও রুচি দিয়ে কোমলমতি অল্পবয়সী তরুণীদের মুগ্ধ করার প্রতি, তাদের মনে দাগ কাটার প্রতি তীব্র আকর্ষণ জন্মে তখন পুরুষের। সবসময় যৌন-সম্পর্ক পর্যন্ত তা না গড়ালেও যৌন অনুষঙ্গ ও যৌন ফ্যান্টাসি থেকেই যায়। আর থাকে জয়ের বাসনা। এছাড়া তাস বা দাবা খেলা, ক্লাবে যাওয়া, রাজনীতি বা খেলা নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা কিংবা স্রেফ বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে রাত করে ঘরে ফেরা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। মোটকথা, ঘরের চাইতে বাইরে সময় কাটাতেই বেশি আগ্রহী হয়ে পড়ে পুরুষ এসময়। সংসার ও স্ত্রীর প্রতি তার এই উদাসীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে সে বলবে, সারাজীবন এ- সংসারের ঘানি টেনেছে সে। এখন এ বয়সে, একটু নিজের দিকে তাকানো দরকার, একটু আনন্দ-ফুর্তি করা দরকার। জীবন তো একটাই। কিন্তু নিজের দিকে তাকানো বা আনন্দ-ফুর্তি করার অধিকার কি কেবল পুরুষেরই রয়েছে? ঘরের নারীটির কথা কে ভাবে? তার কি সেই অধিকার কোনোদিনই থাকবে না? সে যাই হোক, বাইরের দিকে ঝুঁকেপড়া স্বামী আর সংসারে আরো বেশি নিবেদিত স্ত্রী আস্তে আস্তে দুই পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে পড়ে। পুত্র-কন্যা উচ্চশিক্ষার্থে, কর্মোপলক্ষে অথবা বিবাহোত্তরকালে ঘর ছেড়ে চলে গেলে সংসারে বিরাট যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তাকে মাঝে মধ্যে ভেঙে দেয় কেবল পরস্পরের প্রতি তিক্ত অভিযোগ, অনুযোগ, তর্ক ও ঝগড়া। এসবের অধিকাংশই তাৎক্ষণিক কোনো ঘটনা বা কর্মের সঙ্গে সবসময় সম্পর্কিত হয় না। হয়তো সারাজীবনের আহরিত অভিজ্ঞতা থেকে সঞ্চারিত যে ক্ষোভ, কোনো ছোটখাট বা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে হঠাৎ তা বিস্ফোরিত হয়ে পড়ে মাত্র। যৌন-আকর্ষণ ও যৌন- আকাঙ্ক্ষা স্তিমিত হয়ে আসায় এ-ধরনের মনোমালিন্য ঘোচাবার মহৌষধ হিসেবে আগের মতো যৌন-সংযোগের ব্যবহারও প্রায় অনুপস্থিত হয়ে পড়ে। ততদিনে তাদের জীবন হয়ে পড়ে অনেকটা ভাইবোনের মতো, প্রায়শই অযৌন।

পাশ্চাত্যে একটা মজার বিষয় লক্ষ করা যায়। প্রথম বয়সে পুরুষ-নারী যখন উভয়েই তরুণ ও স্বাস্থ্যবান, তখন স্বামী-স্ত্রীর যৌথ বিছানা হয় ডাবল অথবা কুইন সাইজের। কিন্তু বয়স যত বাড়ে, যত বৃদ্ধ হয় দম্পতি, ততই দেখা যায় তাদের যৌথ বিছানার পরিধির বিস্তার অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। বেশিরভাগ বয়স্ক স্বামী-স্ত্রীই ঘুমোয় কিং সাইজের বিশাল বিছানায় যা দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে সমান, অথবা দুটি ভিন্ন টুইন সাইজ বিছানায়। এ শুধু একজনের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে আরেকজন, এই সহানুভূতি বা আশঙ্কা থেকেই নয়। অথবা শারীরিকভাবে অশক্ত এবং অপেক্ষাকৃত কম সতর্ক বয়স্ক দম্পতির খাট থেকে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বা ভয় থেকেও নির্ধারিত নয়। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে অনেক স্বামী-স্ত্রীই পরস্পরের কাছ থেকে শারীরিকভাবে যতটা সম্ভব দূরে থাকতেই পছন্দ করে। এ অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ও উন্নতি লক্ষ করা যায়——যখন তাদের সন্তানদের ঘরে ছেলেপুলে আসতে শুরু করে, যখন নাতি-নাতনি বড় হতে থাকে। আরেকটি নতুন প্রজন্মের আগমনে অর্থাৎ নাতি-নাতনিকে পেয়ে তাদের আদর করতে গিয়ে—নিজেদের রক্ত চোখের সামনে চলতে ফিরতে লাফাতে দেখে——বৃদ্ধ- বৃদ্ধা আবার নতুন করে নিজেদের আবিষ্কার করতে শুরু করে। নাতি-নাতনির মাধ্যমে নিজেদের সন্তানদের শিশুকালের কথা স্মরণ করে তারা। এই স্মৃতি রোমন্থন ও তুলনা তাদের পুলকিত করে, উত্তেজিত করে। তাছাড়া শিশুসন্তানের সঙ্গে শিশু নাতি-নাতনির বড় পার্থক্য এখানে যে, নাতি-নাতনিকে ইচ্ছামতো আদর করা যায়, চটকানো যায়, যা খুশি করতে দেওয়া যায়, প্রচণ্ড প্রশ্রয় দেওয়া যায়, নিজের সন্তানের মতো তার প্রতি তেমন দায়দায়িত্ব থাকে না, তাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার জন্যে কঠোরও হতে হয় না। ফলে চোখের সামনে নিষ্পাপ শিশুর বেড়ে-ওঠা পর্যবেক্ষণ করে নির্মল আনন্দ পাওয়া যায়, অথচ কোনো দায়িত্ব বা কর্তব্য ঘাড়ে নিতে হয় না। আর তাই জীবনের প্রথম দশকের পর পুরুষ ও নারী আবার একটা সাধারণ খেলার মাঠের সন্ধান পায় একেবারে শেষ বয়সে এসে। জীবনের শেষ দশকে, বা শেষ দুই দশকে–তৃতীয় প্রজন্মকে নিয়ে।

ফলে সব মিলিয়ে দেখাই যাচ্ছে, প্রকৃতি ও পুরুষ উভয়েই নারীকে বরাবর তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করে এসেছে—পুরুষ তার যৌনলিপ্সায় ও তার বংশরক্ষার খাতিরে এবং প্রকৃতি তার সৃষ্টির ধারাবাহিতা বজায় রাখার জন্যে। কিন্তু পুরুষ-প্রকৃতি কেউই নারী আসলে কী চায়—নারীর প্রকৃত কল্যাণ কোনভাবে আসতে পারে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন নয়। এই অবস্থায় নারীকেই তুলে নিতে হবে দায়িত্ব এই দুই মহাশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিজের অধিকার, ইচ্ছা-অনিচ্ছার সামাজিক স্বীকৃতি আদায়ের।

নারী জানে, সন্তান এবং নাতি-নাতনি শুধু প্রজন্ম রক্ষার খাতিরেই নয়, নির্মল আনন্দ পাওয়ার জন্যে, নিজের জীবনের পরিধি বিস্তৃত করার জন্যেও দরকার। কিন্তু প্রজন্ম সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে বা তার বদলেও (যদি কোনো নারী সন্তানহীন হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়) দরকার মানুষ হিসেবে তার মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। কীভাবে তা করবে নারী? প্রধানত, তিন উপায়ে : শিক্ষা, জীবিকা ও প্রযুক্তির মাধ্যমে। পুরুষ ও প্রকৃতির কাছে অসহায়ভাবে সমর্পিত হওয়ার বদলে জ্ঞান, অর্থোপার্জন ও প্রযুক্তি নারীর সামনে তুলে ধরে একাধিক পথের সন্ধান। কিছু কিছু ব্যাপারে নিজের ইচ্ছামতো পছন্দ করার, বেছে নেওয়ার, বিকল্প খোঁজার, সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পায় নারী যা আগে পেত না সে। শিক্ষা নারীকে শুধু কর্মক্ষম ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতেই সাহায্য করে না, শিক্ষার আলোতে অনেক কুসংস্কার এবং ভ্রান্ত বা বিভ্রান্তিকর তথ্যের অসারতা সম্পর্কেও সচেতন হয় নারী। সেইসঙ্গে পরিচিত হয় সভ্যতা ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে। নারী-অবদমনের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার, তথ্য এবং প্রযুক্তির সঙ্গে নারীকে সম্পৃক্ত হতে না দেওয়া—সভ্যতা ও জ্ঞানের আলো থেকে তাকে আড়াল করে রাখা। শিক্ষা এবং জীবিকার মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে ও নীতিগতভাবে নারী যদি স্বাবলম্বী হয়, পুরুষ ও প্রকৃতির অবমূল্যায়নের ও বৈষম্যের ধাক্কা অনেকটাই সামলে উঠতে পারবে সে। বিজ্ঞানের আবিষ্কার আর প্রযুক্তির ব্যবহারে নারী তার দৈহিক অনেক সীমাবদ্ধতাই কাটিয়ে উঠতেও সমর্থ হবে। আগেই বলেছি, শিক্ষা এবং প্রযুক্তি নারীর অসহায়ত্ব ঘুচিয়ে তার সামনে পছন্দ করে নিজের মনমতো বেছে নেওয়ার মতো কিছু জরুরি উপকরণ ও পথের সন্ধান দেয়। যেমন দিয়েছে পিল।

বৈজ্ঞানিক তথ্য থেকেই আমরা জানতে পারি, উন্নয়নশীল দেশের মেয়েদের জীবনে গড়ে যতবার মাসিক মোকাবিলা করতে হয়, তারচেয়ে অনেক বেশি মাসিক মোকাবিলা করতে হয় উন্নত দেশের মেয়েদের। এর প্রধান কারণ, প্রথমোক্ত মেয়েরা ঘন-ঘন গর্ভবতী হয় এবং দীর্ঘদিন স্তন্যদান করে। এমনো দেখা যায় যে, দুই সন্তান জন্মের মাঝখানে কোনো কোনো তৃতীয় বিশ্বের নারী একবারও মাসিকের মুখ দেখে না। এছাড়া পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের জন্যেও মাসিকের আবির্ভাব থেকে তিরোধানের সময়টা কম তৃতীয় বিশ্বে। কিন্তু মাসিক কম বা বেশি সংখ্যায় হওয়ার সঙ্গে স্বাস্থ্যের সরাসরি কোনো যোগাযোগ আজো আবিষ্কৃত হয় নি। পিলের আবিষ্কার নারীকে যৌনকর্মে অংশগ্রহণ করেও অনিবার্যভাবে সন্তানবতী হওয়ার সম্ভাবনা থেকে মুক্তি দিয়েছে। ইদানীং এমন পিলও বাজারে এসেছে যার ব্যবহারে শুধু গর্ভধারণ রোধ হবে না, তিন বা চার মাস অন্তর অন্তর একবার মাত্র মাসিক দেখা দেবে। এই বছরেই বাজারে এসেছে এমন একটানা পিলও, যা স্থায়ীভাবে মাসিক বন্ধ করে দেবে। কথাটা শুনে অনেকেই চমকে উঠবেন এই বলে যে, এটা অস্বাভাবিক এবং প্রকৃতি-বিরুদ্ধে কাজ এবং স্বভাবতই হয়তো স্বাস্থ্যের পরিপন্থী। এই বড়ি গ্রহণ স্বাস্থ্যসম্মত কি না, দীর্ঘ ব্যবহারে কোনো বড় রকম ঝুঁকি রয়েছে কি না জানতে আরো সময় লাগবে। তবে বর্তমান গবেষণার ফল অনুযায়ী এটি নিরাপদ।

একটা কথা অনেকেরই জানা নেই, আর সেটি হলো, গতানুগতিক জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খাওয়ার পর মাসশেষে নির্ধারিত দিনে যে মাসিক হয়, তার সঙ্গে প্রাকৃতিক মাসিকের কোনো তুলনাই হয় না। মেয়েদের স্বাভাবিক জৈবচক্রে মাসে একবার ডিম্বকোষ থেকে ডিম্বাণুর নির্গমন ঘটে এবং জরায়ু প্রস্তুত হয় ভ্রূণকে আশ্রয় দেওয়ার জন্যে; কিন্তু সেই মাসে শুক্রাণুর সঙ্গে মিলে ভ্রূণের সৃষ্টি যদি না হয়, মাসশেষে জরায়ুর পর্দা ছিঁড়ে রক্তপাত হয়, যাকে আমরা মাসিক বলি। কিন্তু জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খেলে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণুর নিষ্কাশনই ঘটে না (অর্থাৎ ওভুলেশনই হয় না)। ফলে ভ্রূণের সৃষ্টি বা তার প্রত্যাশায় জরায়ুর বিশেষ প্রস্তুতির প্রশ্ন আসে না। মাসশেষে যে মাসিকের মতো রক্তপাত হয়, সেটা কেবল এজন্যেই ঘটে যে, মাসশেষে কয়েকদিন হরমোন পিল খাওয়া হয় না। যারা পিল খায় না মাসজুড়ে স্বাভাবিকভাবে তাদের হরমোনের যে ওঠানামা চলে শরীরে, পিলের প্রভাবে তা ঘটে না। প্রতিদিনই একই রকম একই সমান হরমোন শরীরে থাকে পিল-গ্রহণকারীদের। আর তাই হঠাৎ করে মাসশেষে কয়েকদিন ওই হরমোন তুলে নেওয়ার ফলে জরায়ু ছিঁড়ে রক্তপাত হয়—যা প্রাকৃতিক মাসিকের মতো দেখায়; কিন্তু আসলে তা নয়। সর্বশেষ জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি, যা মাসিককে স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেয় (যতদিন এই বড়ি ব্যবহার করা হয়), তৈরি করা হয়েছে বিশেষত সেসব নারীর কথা চিন্তা করে, যারা মাসিকের সময় বিশেষ শারীরিক যন্ত্রণার শিকার হন, অথবা যারা কর্মোপলক্ষে অথবা জীবনের অন্য কোনো প্রয়োজনে মাসিকের বিড়ম্বনা এড়াতে চান। প্রতিমাসে একবার মাসিক যে নারীস্বাস্থ্যের জন্যে জরুরি নাও হতে পারে তার সপক্ষে দেওয়া যায় বেশ কয়েকটি অবস্থার উদ্ধৃতি : (১) অন্তঃসত্ত্বাকাল, (২) জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ির ব্যবহার, (৩) জরায়ু বা ডিম্বকোষের অস্ত্রোপচার ও অপসারণ, (৪) দুগ্ধদানকাল। শুধু মাসিক ব্যবস্থাপনা ও জন্মনিয়ন্ত্রণই নয়, শিক্ষা ও প্রযুক্তি আরো অনেকভাবেই নারীর স্বাবলম্বিতা ও ক্ষমতায়ন ঘটিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে সন্তানবতী হতে অপারগ নারীরাও প্রযুক্তির মাধ্যমে আজকাল সন্তানবতী হচ্ছে—এমনকী রজঃনিবৃত্তির বহু পরেও তাদের গর্ভবতী হওয়ার প্রযুক্তি এখন আয়ত্তের ভেতর। পাম্পের মাধ্যমে দুগ্ধ নিষ্কাশন ও রেফ্রিজারেটরে তা জমা রেখে পরবর্তীকালে শিশুকে পান করাবার ব্যবস্থাও দুগ্ধবতী নারীকে কর্মক্ষেত্র থেকে দীর্ঘদিনের বিরতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দিয়েছে। রজঃনিবৃত্তির নানান উপসর্গের জন্যে হরমোন প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা ও গবেষণা ক্রমাগত উন্নততর ফলাফল দিচ্ছে। শরীরচর্চা, যোগব্যায়াম ও কারাতের মাধ্যমে শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি ও আত্মরক্ষার ব্যাপারেও অনেক নারী আজ সচেতন হয়েছে।

সবশেষে, ধর্ষণের মতো অপরাধ এবং এ-ব্যাপারে দৈহিক গঠনের কারণে নারীর অসহায়ত্ব নিয়ে কিছু না বললে নয়। ধর্ষণ এমন একটি অপরাধ যা দুর্ভাগ্যক্রমে ধনী- দরিদ্র সমস্ত সমাজেই রয়েছে—সর্বকালেই রয়েছে। পুরুষের এই বলাৎকার বন্ধ করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে দেশের আইন ও প্রশাসন। ডিএনএ-র বিশ্লেষণ অপরাধীকে সঠিকভাবে শনাক্ত করতেও সাহায্য করে উন্নত দেশগুলোতে। কিন্তু ধর্ষণের জন্যে যথোপযুক্ত বিচার ও শাস্তির ব্যাপারে যেমন আমরা সোচ্চার হবো, তেমনি ধর্ষণ-সম্পর্কে সামাজিক ধারণা ও মূল্যবোধ পাল্টনোর ব্যপারেও আমাদের সচেতন হতে হবে। বাংলাদেশে আজ ধর্ষণের জন্যে প্রায়শই এখানে-ওখানে অল্পবয়সী মেয়েদের আত্মহত্যার সংবাদ শোনা যায় গণমাধ্যমগুলোতে। এটা নিদারুণ দুঃখজনক ও লজ্জাকর ব্যাপার। ধর্ষণকে শারীরিক অন্য যে-কোনো প্রচণ্ড প্রহার বা নির্যাতনের সমকক্ষ ভাবার মানসিকতা গঠন করার চেষ্টা করলে, এ-ধরনের আত্মহত্যা হয়তো ঠেকানো যেত। ধর্ষণ যে-করেছে সে-ই শুধু অপরাধী, যাকে ধর্ষণ করা হয়েছে, সে সম্পূর্ণ নিরপরাধ ও নিষ্পাপ। এ বিশ্বাসে, কর্মে, ব্যবহারে প্রমাণ করতে হবে ধর্ষিতা ইজ্জত হারায় নি, হারিয়েছে সমাজ—যদি ধর্ষককে শনাক্ত করে বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা না করতে পারে। যে-দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে দুই থেকে তিন লাখ নারী ধর্ষিত হয়েছে, সে-দেশে ধর্ষণ-সম্পর্কে আমাদের এত বাড়াবাড়ি রকম স্পর্শকাতরতা বজায় রাখা ঠিক নয়, যা আমাদের অবুঝ নিষ্পাপ মেয়েগুলোকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করেছে। প্রকৃতিদত্ত শারীরিক গঠন আমরা পরিবর্তন করতে না পারি, আমাদের মানসিকতা ও মূল্যবোধ অবশ্যই পারি পাল্টাতে। আর পারি চেষ্টা করতে ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠার, যে- শাসন ধর্ষণের মতো অপরাধে লিপ্ত অপরাধীর গুরুতর শাস্তি দেবে, কিন্তু ধর্ষণের শিকারকে গ্রহণ করবে সম্পূর্ণ নিঃশর্তভাবে —– সর্বোচ্চ সহমর্মিতার সঙ্গে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *