সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার নারী
একবিংশ শতাব্দীকে আমরা বরণ করেছি রাজধানী ঢাকায় প্রকাশ্যে নারী-লাঞ্ছনার মধ্য দিয়ে। যে-আনন্দোৎসব নতুন বছর, নতুন শতক, নতুন সহস্রাব্দকে স্বাগত জানাবার জন্যে আয়োজিত হয়েছিল, সে-উৎসবে যোগ দিতে এসে একদল সমবয়সী পুরুষের হাতে নির্যাতিত হলো একটি মেয়ে। ম্যাজিস্ট্রেট থেকে শুরু করে পুলিশের বড়কর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক ও অন্যান্য বড় বড় কর্মকর্তারা অপরাধীর চেয়ে অপরাধের শিকারকেই দোষী করতে চাইলেন সর্বাগ্রে। এ দেশে, এ সমাজে নারীর চলার গণ্ডি যে সীমিত তা কি মেয়েটি জানত না? হয়তো জানত, হয়তো নয়। হয়তো জেনেও মানতে চায় নি। আর এই না-মানাজনিত লাঞ্ছনার মধ্য দিয়েই নারীর স্বাধীন চলাচল—মুক্ত ও স্বচ্ছন্দ গতি একদিন স্বীকৃতি পাবে। যেমন পেয়েছে তার শিক্ষার অধিকার, জীবিকা অর্জনের অধিকার। এর জন্যে এক জন দু জনকে দিতে হবে আত্মাহুতি অথবা চরম মূল্য।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশে নারীর ওপর সহিংসতা ও নির্যাতন দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ বিষয়ে আইনের কিছু সংযোজন ও কড়াকড়ি কিছুটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেও প্রশাসনিক দুর্নীতি ও অদক্ষতা, আপামর জনসাধারণের অসচেতনতাজনিত অস্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি ও অন্য্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মানসিক দৃঢ়তার ঘাটতি, বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতা ও পক্ষপাতিত্ব দিনের পর দিন এ অবস্থার অবনতি ঘটাচ্ছে। নারীর ওপর সহিংস আচরণ শুধু বাইরে অপরিচিত পুরুষ দ্বারাই ঘটছে না, নিজের ঘরে পরিচিত পরিবেশেও অহরহ সেটা ঘটে চলেছে স্বামী অথবা শ্বশুরবাড়ির অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের দ্বারা যাদের মধ্যে পুরুষ-নারী উভয়েই রয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকারে’র রিপোর্ট অনুযায়ী নারীর ওপর প্রধান প্রধান সহিংসতা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে এদেশে। তথ্যগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে নিচে পরিবেশিত হলো :
সাল | ধর্ষণ | যৌতুকজনিত মৃত্যু | এসিড নিক্ষেপ |
১৯৯৭ | ৭৪৯ | ৬৬ | ১১০ |
১৯৯৮ | ১০২৭ | ৮৩ | ১০১ |
১৯৯৯ | ৯৫২১ | ৯৬ | ১৭৮ |
সাম্প্রতিক কালের (দ্যা বাংলাদেশ টুডে, জুলাই ৭, ২০০৮) এক তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নারীর প্রতি নৃশংসতা ভয়াবহভাবে বেড়ে গিয়েছে। কেবল বিগত ছয় মাসেই ৫৬৭ জন নারীকে বিভিন্নভাবে হত্যা করা হয়েছে। এর ভেতর ৬৬ জন নারীকে ধর্ষণের পর খুন করা হয়েছে। ৯৯ জনকে মারা হয়েছে যৌতুকের জন্যে। বাকি ৪০২ জন বিবিধ কারণে জীবন দিয়েছে। জাতীয় প্রেসক্লাবে বিভিন্ন নারী সংগঠনের নেত্রীদের দ্বারা আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য প্রকাশিত হয়। তাঁরা জানান, এই ৫৬৭টি হত্যা ছাড়াও ৫৭ জন নারীর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে যার কোনো কারণ জানা যায় নি। এছাড়া ১৩৫ জন নারী আত্মহত্যা করেছে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়ে। হত্যা ছাড়াও, এসময় বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় যে মেয়েরা তার একটা আংশিক তথ্য তুলে দেয়া হলো নিচে :
নির্যাতনের রকম – নারীর সংখ্যা
যৌন নির্যাতন – ১৯০
গণধর্ষণ ৭৩
মারধোর – ৫৮
এসিড নিক্ষেপ – ৪৯
আগুন দিয়ে পোড়ানো – ২২
অপহরণ – ৫৫
জোর করে যৌন কর্মে নিয়োগ – ১০
যৌতুকের জন্যে অত্যাচার – ৪৯
প্রচণ্ড শারীরিক নির্যাতন – ১৫৫
পুলিশ কর্তৃক নির্যাতন – ৮
জোর করে বিয়ে দেয়া – ২
ফতোয়ার শিকার – ১৩
গৃহকর্মীর ওপর অত্যাচার – ২৭
এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলেজে ও স্কুলে নারীদের ওপর যৌন অবদমন ও অত্যাচারের ঘটনা ঘটে অহরহ। এসব অত্যাচার সইতে না পেরে ৩০ জন ছাত্ৰী গত পাঁচ বছরে আত্মহত্যা রয়েছে। এ সবই ঘটেছে যখন প্রত্যাখ্যাত পুরুষদের প্রদর্শিত ভয়, হুমকি, ও অপমান অসহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। কোনো কোনো ছাত্রী তাদের শিক্ষকদের লালসার শিকার করতেও বাধ্য হচ্ছে। অন্যান্য জায়গাতেও নারীরা স্বচ্ছন্দে কাজ করতে পারছে না—প্রায়ই তারা যৌন নির্যাতনের ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশের প্রখ্যাত নারী নেত্রীরা এই সংবাদ সম্মেলনে যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে শক্ত ও কার্যকরী নীতিমালা গ্রহণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও কর্মস্থানে যৌন নির্যাতনের শিকারদের অভিযোগ লিপিবদ্ধ করার জন্যে নির্ধারিত কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার দাবি করেন। এছাড়া সাংবাদিক, সামাজিক কর্মী, নেতা ও সুশীল সমাজের কাছে দাবি করেন যাতে তারা সকলে সমাজে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করতে, প্রতিবাদী হতে সাহায্য করে।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, ধর্ষণকারীদের ভেতর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পুলিশ বিভাগে কর্মরত সরকারি কর্মচারী। এদের সংখ্যা ১৯৯৭ সালে ছিল ছয়, ১৯৯৮তে ষোল ও ১৯৯৯-এ দশ। এসিড নিক্ষেপের মতো বর্বর ও হিংস্র একটি অপরাধ, ভয়াবহতার দিক দিয়ে অন্য কোনো কিছুর সঙ্গে যার তুলনা করা যায় না—ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে সর্বত্র। এসিড সংক্রান্ত প্রায় প্রতিটি অপরাধই ঘটে ব্যর্থ, পরাজিত প্রেমিকের হিংস্রতা ও প্রতিশোধস্পৃহা থেকে। হত্যা না করেও মুহূর্তের মধ্যে ফুটফুটে একটি নারীর গোটা চেহারাকে স্থায়ীভাবে কতটা বিকৃত করে ফেলা চলে, তার দৃষ্টিশক্তিসহ অন্য কত ক্ষমতা ও সম্ভাবনা হরণ করা যায়, তার ব্যাপকত্ব চিন্তার বাইরে। সাম্প্রতিককালে এসিড সারভাইভার ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এরকম কয়েকটি মেয়ে স্পেন থেকে চিকিৎসাশেষে দেশে ফিরে এসেছে। ছয় থেকে ন’ মাস একের পর এক প্লাস্টিক সার্জারির পরও তাদের চেহারায় যেরকম স্থায়ী বিকৃতি রয়ে গেছে, তাতে তাদের ওপর সহিংসতার প্রাথমিক পর্যায়ে কী হয়েছিল অনুমান করতে কষ্ট হয় না। ব্রিটেনের সাধারণ মহিলাদের অর্থানুকূল্যে এইসব হতভাগা মেয়ের জন্যে একটি নিরাপদ চিকিৎসালয় ও বিশ্রামাগার করা হয়েছে রাজধানীর একটি অভিজাত অঞ্চলে, যেখানে থেকে তারা দীর্ঘ চিকিৎসা পেতে পারবে। কোনো প্রেস নয়, মন্ত্রী নয়, টেলিভিশন ক্যামেরা নয়—নিতান্ত ঘরোয়াভাবে এই প্রতিষ্ঠানটি চালু হলো কদিন আগে শুধু তাদের নিয়ে যে-সব প্রতিষ্ঠান সরাসরি এসিড নিক্ষেপের শিকারদের নিয়ে কোনো না কোনোভাবে কাজ করে। মেয়েদের নিরাপত্তার খাতিরে বাড়িটির সামনে কোনো সাইনবোর্ড রাখা হয় নি। এইসব এসিডে পোড়া ক্ষতবিক্ষত মেয়েদের জন্যে শুধু চিকিৎসার সুন্দর ও উন্নত ব্যবস্থা এবং পরিচ্ছন্ন বিছানাসহ থাকা-খাওয়ার জায়গাই করা হয় নি, বিষণ্নতায় যাতে তারা না ভোগে সেজন্যে সাদা দেয়াল জুড়ে এঁকে দেওয়া হয়েছে বড় বড় দেয়ালচিত্র—উজ্জ্বল অথচ স্নিগ্ধ রঙে। আমরা বাঙালিরা যা পারি নি বা করি নি, ওরা বিদেশিরা তাই করছে আমাদের এই দুর্ভাগা মেয়েগুলোর জন্যে। অথচ অপরাধটা একেবারেই দেশীয়। কবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কোন ব্যর্থ প্রেমিক একদিন রাগের মাথায় প্রেমিকার মুখে এসিড ছুঁড়ে দিয়েছিল, তারপর থেকে এটা আজ মহামারীর মতো, দাবানলের মতো, ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্র। প্রতি বছর এর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। অপরাধীর শাস্তিবিধানের ব্যবস্থা থাকলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। এসিডের ব্যবহার ও বিতরণ নিয়ন্ত্রিত করলে কিছুটা সুফল পাবার সম্ভাবনা থাকলেও সে ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না।
নারীর ওপর সহিংসতার স্বরূপ আবিষ্কার করতে গিয়ে দেখা গেছে, এর একটি বিরাট অংশই ঘটে চলেছে পরিবারের অভ্যন্তরে। গৃহে সংঘটিত অর্ধেকেরও বেশি মারাত্মক অপরাধের কথা কখনো কেউ জানতে পারে না। নীরবে চলে এই নির্যাতন—দিনের পর দিন। ঘরের ভেতর নির্যাতিতদের অধিকাংশই নারী, বেশির ভাগের বয়স তিরিশের নিচে। এর একমাত্র ব্যতিক্রম জায়গা-জমিন দখল সংক্রান্ত মারামারি ও হত্যা—যেটা পুরুষদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে বেশি। গৃহে নির্যাতিত নারীরা অধিকাংশই বিবাহিত (৮৫%)। শহরের চেয়ে গ্রামে গৃহের ভেতর নির্যাতনের আনুপাতিক হার বেশি। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের মধ্যে তুলনামূলকভাবে এর উপস্থিতি কম হলেও অনুপস্থিত নয়। অশিক্ষা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অপরিসর জায়গায় বসবাসের সঙ্গে পারিবারিক নারী-নির্যাতনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ দেখা গেছে। যে-পরিবারের নারীরা নির্যাতিত, বিয়ের অব্যবহিত পর থেকেই সাধারণত সেই নির্যাতন শুরু হয়। লরি হেইস ও মেরি এবার্গের একটি গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে, পারিবারিক সহিংসতায় শারীরিক নির্যাতন প্রায় কখনো বিচ্ছিন্নভাবে আসে না। এর সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে আরো গভীরে প্রোথিত মানসিক ও অনেক ক্ষেত্রেই যৌন নির্যাতন। শারীরিক নির্যাতিতদের ৫০ ভাগই যৌন নির্যাতনেরও শিকার, শতকরা ৯৭ ভাগ মানসিক নির্যাতনের শিকার। বহুজাতিক এ গবেষণায় তাঁরা দেখিয়েছেন, জগৎ জুড়ে ১৬%- ৫০% মেয়েরা তাদের পুরুষসঙ্গী দিয়ে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হচ্ছে। সন্তানসম্ভবা মেয়েদের একটা বিরাট অংশ (৩%-২০%) শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। আমাদের দেশেও মাতৃত্বজনিত মৃত্যুর একটি উল্লেখযোগ্য (১৪%) কারণ গর্ভাবস্থায় সহিংসতা। মেয়েরা কেন গর্ভাবস্থায় এ ধরনের শারীরিক নির্যাতনের বিশেষভাবে শিকার হচ্ছে তা বলা শক্ত। তবে এ সময় শারীরিক অবস্থার কারণে ঘর-সংসারে ও ক্ষেতে- খামারে তার কাজের শ্লথ গতি, বিশ্রামের আকাঙ্ক্ষা, যৌন সম্পর্কে অনুৎসাহ, নতুন প্রাণ সংযোজনের আশঙ্কায় গৃহস্বামীর দুশ্চিন্তা ইত্যাদি অনেক কারণ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, যখন মেয়েদের সবচেয়ে যত্নের ও বিশ্রামের দরকার তখনই তারা সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হচ্ছে। একটি নতুন জীবন আনতে গিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিচ্ছে।
গৃহে নির্যাতন শুধু যে গরিব অশিক্ষিত পরিবারে বা অনুন্নত সমাজে ঘটছে তা নয়। বহু শিক্ষিত ও সচ্ছল পরিবারেরও তা অবিরাম ঘটে চলেছে। জাপানের মতো উন্নত ও ধনী দেশেও এর প্রকোপটা খুব বেশি। একটি গবেষণায় পাওয়া গেছে, শতকরা ৫৭% জাপানি মেয়ে-জীবনে কোনো না কোনো সময়ে শারীরিক, যৌন ও মানসিক—এই তিন নির্যাতনেরই শিকার হয়েছে। আমেরিকাসহ পশ্চিমা অনেক দেশেও এর প্রকোপ বিস্ময়কর। ফলে শুধু অবস্থার নয় অবস্থানেরও পরিবর্তন দরকার। অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি কেবল বাহ্যিক অবকাঠামো তৈরি করে। এতে প্রাণ সঞ্চার করতে হলে চাই সামাজিক মূল্যবোধের আমূল পরিবর্তন–নারীকে সম্মান ও মূল্য দেবার দৃষ্টিভঙ্গির সংযোজন।
হেইস ও এবার্গের গবেষণায় আরো দেখা গেছে, প্রজনন-স্বাস্থ্যের ওপর সহিংসতার কী নিদারুণ বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে। যে-সব ক্ষেত্রে বিশেষভাবে এর কুফল পরিলক্ষিত হয় তা হলো, জন্মনিরোধকের ব্যবহার, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হার, কিশোরীদের বিশেষ করে অবিবাহিত কিশোরীদের গর্ভধারণের হার, ঝুঁকিপূর্ণ যৌন আচরণের প্রকোপ, এইচআইভি/এইড্সসহ অন্যান্য যৌন রোগের প্রকোপতা, অবাঞ্ছিত সন্তান ধারণ ও প্রসবের হার ও স্বল্প ওজনের সন্তান প্রসবের আধিক্য। ফলে দেখা যায়, সহিংসতা শুধু সরাসরি শারীরিক জখমই করে না, ধূমপান ও অতিরিক্ত মদ্যপানের মতো একটি বাড়তি ঝুঁকি হিসেবে সাধারণ স্বাস্থ্যে ও বিশেষ করে প্রজনন-স্বাস্থ্যে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে। শারীরিক নির্যাতনের শিকার মেয়েরা বিষণ্ণতা ও হতাশার কারণে জীবনবিমুখ হয়ে পড়ে, যার সবচেয়ে বড় প্রতিফলন ঘটে প্রজনন-স্বাস্থ্যে তাদের অবহেলার মধ্য দিয়ে। হয়তো নির্যাতনকারীর সঙ্গে এক্ষেত্রেই সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আবিষ্কার করে মেয়েরা।
একবিংশ শতাব্দীতেও পুরুষসঙ্গী কর্তৃক নারীর ওপর এই যে শারীরিক নির্যাতন আজো চলছে, চলতে পারছে তার বড় কারণ—আশেপাশের লোকদের দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতা ও দায়িত্বশীল প্রতিবেশীসুলভ আচরণ গ্রহণে দ্বিধা বা অনাগ্রহ। অধিকাংশ সমাজেই আজো এই ধরনের অত্যাচারকে ‘পারিবারিক অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’ বলে মেনে নেওয়া হয়। কোনো কোনো সমাজে আবার একে শাসনের জন্যে অথবা সংশোধনের জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বলে ধরে নেওয়া হয়। কোন কোন গাফিলতি, অন্যায় বা বেয়াদবির জন্যে স্বামী কর্তৃক স্ত্রী পেটানো মেনে নেওয়া যায় এই প্রশ্ন করলে মিসরের স্বয়ং মেয়েদেরই ৭০% বলেছে যৌন সঙ্গমে রাজি না হওয়া তেমন একটি কারণ। এদের মধ্যে ৬৯% বলেছে অবাধ্য হলেও পেটানো চলে। ঘানার মেয়েরাও বলেছে (৪৩%) যৌন সঙ্গমে আপত্তি করলে স্ত্রীকে পেটানো যুক্তিসঙ্গত। অন্যদিকে নিউজিল্যান্ডে পুরুষ-নারী উভয়ের মধ্যেই মাত্র ১% বলেছে যৌন সঙ্গমে অনীহা বা অবাধ্য হওয়ার জন্যে বউ পেটানো চলে। নিকারাগুয়াতেও অপেক্ষাকৃত কম লোক (১০%) এসব কারণে বউকে মারার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। ফলে দেখা যায় শুধু পুরুষ নয়, নারীরাও নারীদের অবস্থান উন্নয়নের ব্যাপারে সর্বদা সচেতন বা মুখর নয়।
যে-সব মেয়ে শিশু যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার, তারা দেখা গিয়েছে বড় হয়ে ঝুঁকিপুর্ণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের ওপর পুনঃপুনঃ নির্যাতন—বিশেষ করে তা যখন ঘটে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের দ্বারা—তাদের ভালোমন্দের বোধকে ধোঁয়াটে ও মলিন করে দেয়। নিজেদের ওপর বিশ্বাস, শ্ৰদ্ধা আস্তে আস্তে কমে যায়, নিজেদের ক্ষমতায়, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারে হয়ে পড়ে তারা দ্বিধাগ্রস্ত-সংশয়ী। অতি সহজেই তারা অন্য আরো অনেকের নির্যাতনের শিকার হয়ে পড়ে। এক গবেষক মন্তব্য করেছেন, “এইসব মেয়েরা জানে না কখন এবং কার জন্যে কাপড় খুলবে সেটা তাদের নিজেদেরই ঠিক করার কথা। তারা মনে করে, অন্য যে- কেউ যখন খুশি তাদের কাপড় খুলতে পারে। এ ব্যাপারে তাদের যেন কিছুই করার নেই।” ফলে শেষ পর্যন্ত দেখা যায় এদের কেউ কেউ চলে যায় পতিতালয়ে, কারো কারো ভাগ্যে জোটে পাচার হওয়া ও পরবর্তী পাশবিক নির্যাতন। গৃহে ও গৃহের বাইরে সহিংসতা ও লাঞ্ছনা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নারীর এই চরম সামাজিক অবমূল্যায়ন অর্থাৎ পতিতাবৃত্তি ও পাচারকৃত হবার জন্যেও অনেকাংশে দায়ী।
কেন ঘটে গৃহে এই সহিংসতা? এর পেছনে বহু আর্থসামাজিক, মনোজাগতিক বিশ্লেষণ হয়েছে—থিয়োরি রয়েছে। কোনোটিই এককভাবে জনসমর্থন পায় নি। আক্রমণকারী এক বিশেষ রোগের শিকার এই মতবাদ বহুল প্রচারিত হলেও অনেক সময় মেডিক্যাল শাস্ত্র আক্রমণকারীর শরীরে বা মনে অন্য কোনো জটিলতার সন্ধান দিতে পারে না। দ্বিতীয় থিয়োরিটি দিয়েছেন ফ্রয়েড নিজে। তাঁর মতে, মেয়েদের শিশ্নহীনতাজনিত হীনম্মন্যতার কারণেই তারা স্বামীদের প্ররোচিত করে নিজেদের লাঞ্ছিত করার জন্যে, কেননা তারা মনে করে এটা তাদের প্রাপ্য। অন্যদিকে পুরুষরা আক্রমণকারীর ভূমিকা নেয় তার শিশ্ন রক্ষা ও নিরাপত্তার খাতিরে। এই থিয়োরিকে এখন প্রায় কেউ স্বীকার করে না। আরেকটি মতবাদ বলে, হতাশাজনিত কারণে কখনো কখনো মানুষ আক্রমণকারীর ভূমিকা নেয়। কিন্তু হতাশার বহিঃপ্রকাশকে বউ পেটানোতেই কেন ঘটতে হবে সে-প্রশ্নের জবাব নেই। সত্তরের দশকে স্ট্রস একটি থিয়োরি দেন; তাঁর মতে দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপের মতো নেতিবাচক বিষয়গুলো মানুষকে প্ররোচিত করে গৃহে নির্যাতন ঘটাতে। অন্যদিকে পারিবারিক সদস্য ও প্রতিবেশীদের সহমর্মিতা, সহযোগিতা, পরামর্শ ও পারস্পরিক মঙ্গলের জন্যে উন্মুখ আচরণ সহিংসতার বিপক্ষে কাজ করে অর্থাৎ ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। ফলে পারিবারিক সহিংসতা শুধু একটি ব্যক্তি-আচরণ নয়, এটি একটি সমষ্টিগত ও সামাজিক অবকাঠামোর ব্যাপার। সত্তরের দশকে বান্দুরার আরেকটি থিয়োরি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তা হলো—মানুষ নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে যা শেখে, সেই রকম আচরণেই সে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে যে-পুত্র বাবাকে ছোটবেলায় দেখেছে মাকে ধরে মারতে, সে সেই সময় মায়ের জন্যে যতই দরদী থাক না কেন, ভবিষ্যতে স্বামী হয়ে স্ত্রীকে পেটাতে সে কোনোই দ্বিধা করে না, বরং তার কাছে এটা অতি গ্রহণযোগ্য ও যৌক্তিক মনে হয়। কেননা সে জানে এবং সে দেখেছে কত তুচ্ছ কারণে তার বাবা তার মাকে ধরে অনায়াসে পিটিয়েছে। এই থিয়োরি অনেকেই মেনে নিলেও এটি কখনো উত্তর দেয় না—কেন এই পরিবেশে বড় হওয়া সত্ত্বেও সকল পুরুষই স্ত্রীকে ধরে পেটায় না। অন্য একটি থিয়োরির মতে, পুরুষ যেহেতু কর্তৃত্ব করতে চায়, আর সেটা করতে চায় পরিবারের জন্যে প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণের মাধ্যমে, যখন সে সম্পদ সংগ্রহে ব্যর্থ হয় তখন সে তার শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করে স্ত্রীর বশ্যতা আদায় করতে চায়। পিতৃতান্ত্রিক আরেকটি থিয়োরি অনুযায়ী অবশ্য পুরুষতন্ত্রের স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ নারীর অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট সামাজিক অবস্থিতিকে প্রতিষ্ঠার জন্যেই নারীর প্রতি পুরুষের শারীরিক নির্যাতনের এই সূচনা। গেলেস ১৯৭৪ সালে বিনিময় থিয়োরি প্রবর্তন করেন। এই থিয়োরি অনুযায়ী—প্রতিটি সম্পর্ক এক ধরনের দেওয়া- নেওয়ার ওপর প্রতিষ্ঠিত; বেশিরভাগ সময়েই এই বিনিময় ভাব-ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সমর্থন ইত্যাদি অবৈষয়িক বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু কখনো কখনো তা পূর্ণ বৈষয়িক ব্যাপার নিয়েও ঘটে থাকে। প্রত্যাশিত যৌতুকের জন্যে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বধূনির্যাতন বা বধূহত্যা অথবা যথেষ্ট যৌতুক পেলে বউকে সমীহ করা এই থিয়োরি দিয়ে ব্যাখ্যা করা চললেও অন্য অনেক নির্যাতনের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়। সবশেষে ১৯৭১ সালে ওয়াকারের বৃত্তাকার থিয়োরি অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে ভালোভাসা ও ঘৃণা বৃত্তাকারে ক্রমাগত ওঠানামা করে বলেই ঘটে এই পারিবারিক সহিংসতা। এই বৃত্তাকার পরিমন্ডলে প্রথমে দুজনের সম্পর্কের মধ্যে ধীরে ধীরে বিরোধ জমাট বাঁধতে থাকে। দ্বিতীয় পর্যায়ে তার বিস্ফোরণ ঘটে। তখন স্বামী কর্তৃক স্ত্রী নিগৃহীত হয়। তৃতীয় পর্যায়ে স্বামী অনুতপ্ত ও প্রবল ক্ষমাপ্রার্থী। ধীরে ধীরে ভালোবাসা ঘৃণার জায়গা দখল করে। তখন স্বামী অতি কাতর, অতি নরম হয়ে পড়ে। স্ত্রীও ক্ষমার মধ্য দিয়ে শান্ত হয়ে আসে। একটা স্থিতিশীল সমাহিত পরিস্থিতি চলে কিছুকাল। তারপর আবার বৃত্তাকারে পূর্বের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। এই থিয়োরি সহিংসতার প্রকাশ ও স্বরূপ বর্ণনা করলেও ভালোবাসা ও ঘৃণার ক্রম উত্থান-পতন ও বৃত্তাকারে চলাচলের কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যাখ্যা দেয় না।
তবে কারণ যেটাই থাক, শারীরিক-মানসিক নির্দিষ্ট কোনো রোগ এর জন্যে দায়ী হোক বা না হোক, মেয়েদের ওপর এ লাঞ্ছনা, এ নির্যাতন ও সহিংসতার অবসান একান্তই জরুরি। নীরব সংস্কৃতির সভ্য সেজে পরিবারের বা প্রতিবেশীদের এই যে নিশ্চুপ আচরণ, একে আমরা সমর্থন করি না। এ ধরনের সমস্যা পাশ কাটিয়ে যাওয়া আমাদের অনুচিত। একজন দায়িত্বশীল নাগরিকের যেমন কর্তব্য এই অন্যায়ের বিরোধিতা করা (শারীরিক নির্যাতন কোনো অপরাধেরই শাস্তি বা সংশোধনের উপায় বলে বিবেচিত হতে পারে না), তেমনি দায়িত্বশীল চিকিৎসকের উচিত সৎসাহসের সঙ্গে সময়মতো নির্যাতিতকে পরীক্ষা করে সঠিক রিপোর্ট পেশ, আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত ও বিচার বিভাগীয় লোকের উচিত সততা, সদিচ্ছা ও সহমর্মিতার সঙ্গে প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তিপ্রদান। তদন্তে অপরাধ প্রমাণিত হবার পর অপরাধী অসুস্থ হলে তার চিকিৎসা চলবে, অন্যথায় সে জেলে বসবাস করবে। ঘরে বা বাইরে থেকে ক্রমাগত নারী-নির্যাতনে অংশগ্রহণ করার সুযোগ তাকে দেওয়া যায় না—–দেওয়াটা গুরুতর অপরাধ। আমাদের নীরব থাকার দিন শেষ হয়ে এসেছে। নারীর প্রতি সহিংসতা এখন আমার-আপনার সকলের সমস্যা।