বাঙালি পরিবারে নারী-অধিকার : চার মৌলিক উপাদান
দীর্ঘকালের অবদমন ও বৈষম্যমূলক সামাজিক আচরণের বিরুদ্ধে লড়াই-এর মাধ্যমে নারী যে আংশিক স্বাধিকার ও স্বাবলম্বিতা আজ অর্জন করেছে, তা কোনো সমাজেই রাতারাতি ঘটে নি। পর্যায়ক্রমে, ধাপে ধাপে ঘটেছে তা, যার সঙ্গে মিলে মিশে আছে সমাজ উন্নয়নের আরো বেশ কিছু উপাদান ও প্রক্রিয়া। কেননা, নারীর অবস্থা বা অবস্থানের উত্তরণ স্বতন্ত্র বা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকে অন্যান্য সামাজিক উন্নতির ধারা। নারীর প্রাপ্য মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আইন, প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সচেতনতা, ধর্মীয় ও পারিবারিক মূল্যবোধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জাতিসংঘের সনদ ও অধিকাংশ রাষ্ট্রের সংবিধান অনুযায়ী নারীর মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি ও তার বাস্তবায়ন, ব্যক্তি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন এবং আপামর সমাজ ব্যবস্থার বড় ধরনের এক বিবর্তনের মাধ্যমেই কেবল সম্ভব নারীর কাঙ্খিত এবং প্রকৃত সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সেটাই চূড়ান্ত লক্ষ্য। আইনের শাসন, ক্ষমতার ভিত্তিতে ও ন্যায্যভাবে প্রশাসনিক কার্যকলাপের সুষ্ঠু পরিচালনা, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-জীবিকার সুষম বণ্টন ও সুব্যবস্থা, মানবসম্পদ উন্নয়নের এবং নারী স্বাধীনতার সাফল্যের মূল কথা। কিন্তু যেহেতু প্রতিটি সমাজই মূলত আলাদা এবং তাদের নিয়মকানুন, মূল্যবোধ, শিক্ষার মান, আচার-আচরণ, চলাফেরার পরিধি, ধর্মীয় সংস্কার যথেষ্ট স্বতন্ত্র, এটা অনস্বীকার্য যে গণউন্নয়নের তথা নারী স্বাধীনতার বিভিন্ন স্তরে, বিভিন্ন ধাপে, বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে এই সকল বিভিন্ন সমাজের অবস্থান। ফলে দেশে-দেশে, সমাজে-সমাজে নারী যে অসুবিধে বা বাধাবিপত্তির মোকাবিলা করে তার মাত্রা ও ধরন যথেষ্ট আলাদা এবং এই বাধা ও প্রতিকূলতা উত্তরণের পথও ভিন্ন এবং বৈচিত্র্যময়। পশ্চিমের তুলনায় আমাদের দেশের কিছু অনগ্রসর সম্প্রদায় ও নারীসমাজ যে তাদের মৌলিক অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ অবস্থায়, অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এবং সামাজিক স্তরে নারীপুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত, আমার ধারণা, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে অন্তত চারটি মৌলিক ব্যাপারে নারী নিজে উদ্যোগী হয়ে যদি তার অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে, তাহলে বৃহত্তর সমাজে ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও এর সুফলের প্রতিফলন ঘটবে। যে চারটি বিষয় আমি উল্লেখ করব, যার সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ নারীর হাতে থাকলে তার আত্মপ্রত্যয়ই শুধু বাড়বে না, ব্যক্তিগত জীবনে, পরিবারে এবং সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে তার ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করার সুযোগও অনেকটা বৃদ্ধি পাবে। এই চারটি বিষয় যা মূলত জৈবিক হবে তার স্বাধীনতা, স্বাবলম্বিতা, আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মানের স্তম্ভ। এগুলোর প্রতিটিই এত জীবনঘনিষ্ঠ, বাস্তব, সাধারণ ও দৈনন্দিন ব্যাপার যে অনেকেই হয়ত এগুলোকে অতি সামান্য ও সহজে করণীয় বলে বিবেচিত করবেন। এমন কি এগুলোর গুরুত্ব অস্বীকার করে এ বিষয়গুলো নিয়ে ঠাট্টা রসিকতা করার প্রচেষ্টাও চালাবেন কেউ কেউ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এবং ব্যাপক অর্থেই এগুলো অত্যন্ত মৌলিক ও জরুরি বিষয়—অন্তত আমাদের দেশের নারীর জীবনে। প্রচলিত মূল্যবোধ ভেঙে দিয়ে যথেষ্ট অনুশীলনের মধ্য দিয়েই এ বিষয়গুলো সম্পর্কে সামাজিক ধারণা পাল্টানো দরকার। আর সঠিকভাবে এগুলো নিয়ন্ত্রণ বা আয়ত্ব করার ভার নারীর নিজের হাতে গ্রহণ করাটা মোটেই সহজসাধ্য কাজ নয়। নীচে নারীর জীবনের এই মৌলিক চারটি বিষয় উল্লেখিত হলো।
১. মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা : বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাস্থ্য সেবামূলক বিভিন্ন কর্মসূচির ফলে আমাদের দেশে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে আগের চাইতে অনেক সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে-বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। পরিবার পরিকল্পনা এবং যৌনবাহিত সংক্রামক রোগ নিয়ে পল্লীবধূরাও আজকাল খোলামেলা আলোচনা করেন স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে, সেতো এক বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হবার সুযোগে নিজের চোখে দেখেই তারিফ করেছি! কিন্তু তারপরও অধিকাংশ মানুষ, এমন কি মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীরাও ভুলে যান বা অস্বীকার করেন পল্লীবালা অথবা গ্রাম্যবধূরা প্রতি মাসে মাসিকের সময় পাঁচ থেকে সাত দিন কেমন করে কাটায়, কতটা ব্যস্ত সন্ত্রস্ত থাকে তারা তখন। কতটা ব্ৰিত, সংকোচিত, ভীত ও লজ্জিত থাকতে হয় তাদের প্রকৃতির খেয়ালে মাস শেষে নির্ধারিত এই রক্তপাতের জন্যে। এগারো, বারো বা তেরো বছর বয়স থেকে শুরু করে আটচল্লিশ, পঞ্চাশ বা বাহান্ন বছর পর্যন্ত প্রতি মাসে রজস্বলা নারীরা কী দুর্ভোগের ভেতর দিয়ে যায় আমাদের দেশে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে, তার খবর কেউ রাখে না। শহরে অপেক্ষাকৃত অবস্থাসম্পন্ন ঘরের মেয়েদের পক্ষে গরীব পল্লীবালাদের এ বাস্তব সমস্যাটার ব্যাপকতা বোঝা দুষ্কর। গ্রামের পারিবারিক গঠন, বাসস্থানের কাঠামো, শৌচাগারের অবস্থা বা অনুপস্থিতি, ডাস্টবিনের অভাব বা অপ্রতুলতা মেয়েদের স্বাস্থ্যসম্মতভাবে মাসিক ব্যবস্থাপনার বিরাট অন্তরায়। এছাড়া তাদের না আছে কোন নিভৃতি বা নির্জনতা, না আছে নিজস্ব ঘর, পরিচ্ছন্ন কাপড় বা প্রয়োজনীয় অন্যান্য উপাদান। ফলে মাসের ঐ প্রত্যাশিত দিনগুলো তাদের কাছে আবির্ভূত হয় বিভীষিকার মতো, বিশেষ করে অল্প বয়সী সদ্য রজস্বলা নারীদের জন্য। ভারত ও শ্রীলঙ্কায় বেশ কয়েকটা গবেষণায় দেখা গিয়েছে মেয়েদের স্কুলে অনুপস্থিতি ও স্কুল থেকে ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ মাসিক মোকাবিলা করার উপাদান বা সামগ্রীর অপ্রতুলতা অথবা মাসিক সংক্রান্ত জটিলতা এবং এ ব্যাপারে সঙ্কোচ, ভয়, দুর্ভাবনা। অনেক নিম্নবিত্ত ঘরের মেয়েদের নিজের একান্ত ব্যবহৃত রঞ্জিত কাপড়খণ্ড ধোবার জন্যে জীবাণুনাশী সাবান, প্রয়োজনীয় জলাশয় কিংবা জলের ব্যবস্থা কিংবা নির্জন গোপন জায়গাও থাকে না। অনেকেরই হয়ত ব্যবহৃত কাপড় ফেলে দেবারও কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। থাকলেও প্রতি মাসে নতুন করে ব্যবহারযোগ্য পুরাতন কাপড় যোগাড় করাও কারো কারো জন্যে অসাধ্য। কিন্তু সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে ধুয়ে রৌদ্রে হাওয়ায় খোলামেলা অথচ একান্ত কোনো জায়গায় তা শুকিয়ে নেবার ব্যবস্থাই বা ক’জনের আছে? ব্যবহারযোগ্য কাপড়ের অভাব ও ফেলে দেবার জায়গার অপ্রতুলতার কারণে একই বা কয়েকটি বস্ত্রখণ্ডই ধুয়ে শুকিয়ে বারবার ব্যবহার করে আমাদের দেশের অধিকাংশ নারী। আর অন্ধকারে, স্যাঁতস্যাতে জায়গায় গোপনে শুকানো আর ভালোভাবে সাবান সহকারে পরিচ্ছন্ন করার ঘাটতির কারণে এইসব পুনঃপুন ব্যবহৃত বস্ত্রখণ্ড হয়ে পড়ে বিভিন্ন রোগজীবাণুর ঘাঁটি। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় দেখা গেছে দেশের মেয়েদের যৌনাঙ্গের ও মূত্রাশয়ের বিভিন্ন রকম সংক্রামক ব্যাধির জন্যে মাসিকের সময় তাদের ব্যক্তিগত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে মাসিক-উপাদান ব্যবহারের অপ্রতুলতাই দায়ী। ফলে দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশের নারীদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যের সঙ্গে মাসিক ব্যবস্থাপনার একটা সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। যোগাযোগ রয়েছে তাদের আত্মপ্রত্যয়, আত্মসম্মান, সমভাবে এবং নিঃসঙ্কোচে মাথা উঁচু করে সোজা হয়ে দাঁড়াবার শক্তি অর্জনের সঙ্গেও।
সংক্রামক ব্যাধির উপদ্রব ছাড়াও এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অল্প বয়সী মেয়ে মাসিকের সময় মারাত্মক ও উদ্বেগজনক শারীরিক কষ্টের শিকার হয়। প্রচণ্ড পেটে ব্যথা থেকে শুরু করে তলপেটে প্রবল খিঁচুনি এবং তারই ধারাবাহিকতায় তাদের অর্ধাহার বা অনাহার—ফলশ্রুতিতে স্কুল বা কাজে যাবার অপারগতার কথা কে না শুনেছে? নিয়মিত প্রতি মাসেই এমন ঘটে, তেমন নারীর সংখ্যাও নগণ্য নয়। অথচ এসবই নিরাময়যোগ্য চিকিৎসাযোগ্য ব্যাধি। হরমোনের গোলমালের জন্যে অথবা অঙ্গপ্রতঙ্গের সামান্য ত্রুটির জন্যে উঠতি বয়সী অনেক মেয়েদের মাসিক অনিয়মিত, অপ্রত্যাশিত ও অসময়ে ঘটে। ফলে সার্বক্ষণিকভাবে তারা নিজের শরীর ও শরীরজনিত সম্ভবপর বিব্রতকর অবস্থা কথা ভেবে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। অথচ এসব সমস্যাকে নেহায়েত ‘মেয়েলি’ ব্যাপার বলে গোপনীয় বা আড়াল করে না রেখে, অগ্রাহ্য না করে, প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে এই সাময়িক দুর্ভোগ কাটিয়ে অনেক মেয়েই তাদের পড়াশুনা, বাইরের কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারে অনায়াসে। তাদের আত্মবিশ্বাসও বাড়ে তাতে। নানান কুসংস্কার, ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রচলিত ধ্যান-ধারণার কারণে মাসগত প্রকৃতির এই স্বাভাবিক নিয়মটাকে অনেক মেয়েই সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। বিশেষত প্রতিটি ধর্মেই যেহেতু রজস্বলা নারীকে ধর্মস্থানে যেতে বা ধর্মেকর্মে অংশীদার হতে বারণ করা হয়েছে, অধিকাংশ নারীই এ সময় নিজেকে অপরিচ্ছন্ন, অস্পৃশ্য ও নোংরা ভাবতে শুরু করে। এমন কি চিকিৎসাশাস্ত্রে কোনো বাধা না থাকা সত্ত্বেও এবং পরিবার পরিকল্পনার কথা চিন্তা করলে সময়টা সবচেয়ে ‘নিরাপদ’ হলেও, এই সময় নারীদেহ “পঙ্কিল” ভাবার কারণে, নারী বা তার সঙ্গী সাধারণত এই সময় যৌনমিলনেও আগ্রহী হয় না। এছাড়া কোনো কোনো সম্প্রদায়ে এবং কোনো কোনো অঞ্চলে এসময় মেয়েদেরকে আলাদা জায়গায় শুতে দেয়া হয়, আলাদা পাত্রে এবং আলাদাভাবে রন্ধিত নিম্নমানের খাদ্য পরিবেশন করা হয়। কোনো কোনো সম্প্রদায় এ সময় মেয়েদের রান্না ঘরে ঢুকতে দেয় না, এমন কি আচাড় নাড়তেও দেয় না রোদে। এ সবই কুসংস্কার। এ সবই নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। কিন্তু এর ফলে যে হীনমন্যতা জন্ম নেয় তা শুধু মাসিকের কয়েকটা দিনেই সীমাবদ্ধ থাকে না, নারী জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং জীবনের সম্পূর্ণ পরিধি পর্যন্তই প্রসারিত হয়। নারী মেনে নেয় এবং সমাজ দাবি করে নারীর অধঃস্তন।
রজস্বলা হওয়া মাত্রই নারীকে ঘরবন্দী করে পুরুষ ও সমাজ। কেননা মাসিকের আবির্ভাব ঘোষণা করে, নারী সৃষ্টিশীল হয়ে উঠেছে— সন্তান উৎপাদনে সক্ষম সে এখন। ফলে তার চলাচলের পরিধি সঙ্কোচিত করে নেয়া হয়, তার চারণক্ষেত্র নির্দিষ্ট সীমানার ভেতর সীমিত করে দেয়া হয়। কিন্তু পুরুষ নয়, নারী নিজে স্থির করবে কোথায়, কখন যাবে সে মাসিকের সময় এবং অন্য সময়। রজস্বলা হবার কারণে পুরুষ ও সমাজের ইচ্ছানুযায়ী বাহির মানে শিক্ষালয় ও কর্মক্ষেত্র থেকে সরে এসে নারী যদি অন্তপুরে নিজেকে নিক্ষেপ করে, তাহলে পুরুষের আজীবনের খায়েশ, তার বংশের পবিত্রতা—তার জিনসের ধারাবাহিকতা রক্ষা পাবে ঠিকই। নারী হবে তার হাতের পুতুল। বন্দী। অন্তরীণ।
আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠান নানান ধরনের স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছে আজকাল। রোগবালাই নিরাময় থেকে শুরু করে, টিকা, ওরস্যালাইন, ফুটনো পানি খাবার পরামর্শ, পরিবার পরিকল্পনা-সামগ্ৰী, স্ল্যাবের পায়খানা—কী না সরবরাহ করা হচ্ছে! কোনো কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অল্প খরচে স্যানিটারি ন্যাপকিপ তৈরির প্রকল্পও গ্রহণ করেছে জানি। সেইসব প্রকল্প আরো উপযোগী, উন্নতমানের এবং কম ব্যয় সাপেক্ষ হওয়া দরকার। সেই সঙ্গে ব্যবহৃত সামগ্রীর নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করাও জরুরি। মাসিক সম্পর্কে প্রচলিত চিন্তাধারা পাল্টানো দরকার। এটা যে প্রকৃতিদত্ত স্বাভাবিক ও জৈবিক একটি প্রক্রিয়া, এত গোপন করার, লজ্জা পাবার, সংকুচিত হবার বা নোংরা ভাবার কোনো কারণই যে নেই, এই মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। এ সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি একটি উপায়। মনে পড়ে, পশ্চিমের এক বিশাল জনসম্মেলনে এক নারীবাদী যখন বক্তৃতা করতে উঠবেন মঞ্চে, হঠাৎ তিনি টের পেলেন তার মাসিক সদ্য শুরু হয়েছে—অসময়ে। এ অবস্থায় বিচলিত নেত্রী কী দিয়ে কথা শুরু করবেন ভাবতে গিয়ে হঠাৎ কোথা থেকে এক প্রবল শক্তির সন্ধান পেলেন নিজের ভেতরে। মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে সোজা সাপ্টা বলে বসলেন তার শারীরিক অবস্থা। শুরু করলেন এই বলে যে “I am menstruating.” গ্লোরিয়া স্টেইনাম একইভাবে লিখেছিলেন তার প্রখ্যাত প্রবন্ধ, “If men could menstsuate!” গ্লোরিয়ার সেই হাস্যরসাত্মক লেখায় বারবার উল্লেখিত হয়েছে, নারীর বদলে পুরুষ যদি রজস্বলা হতো, কত গর্বের সঙ্গেই না তারা তাদের শারীরিক অবস্থা বর্ণনা করে বেড়াত। মাসিক মোকাবেলা করার বিভিন্ন বাণিজ্যিক উপাদানের ব্র্যান্ড নাম নিয়ে কতরকম মুখরোচক আলোচনা চলত রাস্তায়, ঘাটে, ক্লাবে, ট্রেনে। নারী নাই বলে বেড়ালো সে রজস্বলা, রাখলোই না হয় আড়াল করে তার মাসিকের উপকরণ, কিন্তু সে যখন রজস্বলা হয়, নিজেকে যেন অস্পৃশ্য বা আলাদা না ভাবে সে। তার দৈনন্দিন রুটিনে, ব্যক্তিগত, শিক্ষা বা কর্মজীবনে যাতে কোনোভাবে কোনো নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে প্রতি মাসে এই নির্ধারিত রক্তক্ষরণ। প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়াল (অন্য সকল জীবের বেলায় এটা ঘটে না) মেনে নিয়ে সকল হীনমন্যতা ঝেরে ফেলে স্বাভাবিক জীবনযাপন করে যেতে হবে নারীকে এই সময় এবং সকল সময়। আর এজন্যে ঘরে, পরিবারে, কর্মস্থলে নারীর প্রয়োজনীয় নিভৃতি ও মাসিকের উপকরণের (হোক তা স্যানিটারি ন্যাপকিন অথবা পরিচ্ছন্ন পুরনো বস্ত্রখণ্ড ও সাবান কিংবা তুলো) প্রতুলতার নিশ্চয়তা দিতে হবে। এটা কোন মেয়েলি ব্যাপার নয়। মৌলিক মানবিক অধিকার। কর্মক্ষেত্রেও, বিশেষ করে পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানের মতো জায়গায় যেখানে অনেক অল্পবয়সী মেয়ে একসঙ্গে কাজ করে, নারীদের জন্যে নির্দ্দিষ্ট ও সংখ্যায় যথেষ্ট বাথরুম, বাথরুমের ভেতর পয়সার বিনিময়ে মাসিক মোকাবেলার সামগ্রীর ব্যবস্থা এবং ব্যবহৃত সামগ্রীর পরিত্যাগ ও নিষ্পাশদের ব্যবস্থা করা একান্তই জরুরি। নারী শ্রমিকদের সুবিধে অসুবিধে, তাদের প্রাইভেসী, এবং অন্যান্য প্রয়োজন মেটাবার জন্যে বিশেষ করে মাসের এই বিশেষ সময়টাতে তাদের শরীর ও স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয় তদারকির জন্যে, পোশাক শিল্প কারখানায় নারী সুপারভাইজার নিয়োগও কাম্য।
২. রন্ধন : গল্পটা এরকম। এক ভোরে ঘুম থেকে উঠে এক গ্রাম্য গৃহবধূ হঠাৎ মনস্থির করে আজ সে রাঁধবে না। সে অসুস্থ নয়—তার সন্তান, স্বামীও সুস্থ। প্রাত্যহিক জীবনে এমন কিছু অঘটন ঘটে নি, যার জন্যে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে। স্বামী, শাশুড়ি, ননদ কারো সঙ্গেই বচসা বা বিতণ্ডা হয় নি। সে স্রেফ ঠিক করেছে, সেদিন—অর্থাৎ একদিন সে রান্না করবে না, যা বছরের পর বছর প্রতিদিন করে আসছে। এই সামন্য একটা ইচ্ছা বা সখ কী অসামান্য হয়ে দেখা দেয় পরিবারের প্রতিটি সদস্যের কাছে। আর এটি যে কোনোমতেই কাম্য বা গ্রহণীয় নয়, সেটাই বর্ণিত হয় গল্পে। মজার ব্যাপার হলো, এক নারী সমালোচক এই গল্পের আলোচনা করতে গিয়ে মহা বিরক্তি প্রকাশ করেছেন এই বলে যে কেন এই নারী আজ রাঁধবে না, এটার কারণ ব্যাখ্যা করা বা অন্য কথায় তার এই অবাধ্যতার পক্ষে যুক্তি স্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি ছিল লেখকের জন্যে। বলাবাহুল্য, সমাজ বিজ্ঞানী সেই সমালোচক মহিলা অনেক ভেবেচিন্তে, গবেষণা ও বিশ্লেষণ করে আবিষ্কার করেছেন যে এই গ্রাম্যবধূ আসলে হিন্দু ধর্মমতে অরন্ধন ব্রত যাপন করছিল বলেই সেদিন রান্না না করার সংকল্প নেয়। এই না বলা কথাটা ধরে ফেলেছেন বলে সমালোচক এতটাই নিশ্চিত ও গর্বিত যে এই সোজা কথাটা লেখক কেন খোলসা করে না বলে রহস্য করলেন, কেন পাঠকদের ধোঁকা দিলেন, জানতে চাইলেন তিনি। সেই সঙ্গে প্রশ্ন রাখলেন, লেখক কি তাহলে পাঠকদের সঙ্গে তামাশা করেছেন? প্রকৃতপক্ষে, এই গৃহবধূ কোনো পূজা অর্চনা করছিল না। ওধরনের কোন ব্রত খুব প্রচলিত রয়েছে বলেও শোনা যায় না বাংলাদেশে। তাছাড়া বধূটি ওরকম কিছু করলে স্বভাবতঃই তার শাশুড়ি, ননদ, স্বামীও তা জানত। আসলে, নেহায়েত একদিন তার ইচ্ছা জেগেছিল, প্রতিদিনের মত হাঁড়ি না ঠেলে, একটিদিন নিজের মতো করে একটু সময় কাটাতে—প্রকৃতির কাছাকাছি আসতে। গাছপালা, ফুল, পাখি, মাছ, সূর্য, ঘাট, জলের সঙ্গে একাত্ম হতে। কিন্তু তার এই ইচ্ছা শুধু প্রথাগত বা প্রাচীন পারিবারিক আবহাওয়াতেই নয়, দেখা যাচ্ছে শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনা শহুরে মানুষদের মধ্যেও, এমনকি মেয়েদের মধ্যেও, গ্রহণযোগ্য বা স্বীকৃত নয় (সমালোচক মহিলার বিশ্লেষণ যার প্রমাণ)।
“বৌ ভাত” অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নববধূকে নতুন গৃহে বরণ করে নেবার নামে, তার হাত দিয়ে অতিথিদের প্রতীকি অন্ন পরিবেশনের মাধ্যমে, তাকে সেই যে হাঁড়ির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে দেওয়া হয়, সে বন্ধন আর কোনোদিন ঘোচে না, মৃত্যু নামক মহা শক্তিধর এসে হাত ধরে তাকে পরিত্রাণ না দেওয়া পর্যন্ত। আমাদের দেশে কোনো বিবাহিতা নারী ভাবতেই পারে না, যে রান্না করা না করার ইচ্ছে তারও থাকতে পারে। সংসারের সকল মানুষের মুখে রন্ধিত অন্ন যোগাড় করে দেবার দায়িত্ব সার্বক্ষণিকভাবে তার নাও হতে পারে। কখনো কখনো তারও সাধ হতে পারে, হাত পা ছড়িয়ে দিয়ে একটু আরাম করার, রান্না ঘরে একবেলা বা এক দিন ভাতের হাঁড়ি না ঠেলার। স্বামী বা অন্য পারিবারিক সদস্যরাও সেই দায়িত্ব নিতে পারে মাঝে মাঝে। গত শতকে জন্ম নেওয়া মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী পর্যন্ত তাঁর নরনারী প্রবন্ধে বলেছেন, “গৃহস্থালির কাজকর্ম নারীও করতে পারে, নরও করতে পারে। অবসর ও অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। রান্নাবান্না, কাপড় কাচা প্রভৃতি ব্যাপার নারীর জন্য নির্দিষ্ট নয়। পরিবার-সংগঠনের ভেতর পুরুষও এগুলো করতে পারে।” সভ্যদেশে রান্নার যোগাড়যন্ত্র এবং প্রকৃত রান্না করার দায়িত্ব অধিকাংশ পরিবারেই ভাগবাটোয়ারা করে নেওয়া হয়। যেভাবে নেয়া হয় সংসারের অন্যান্য কাজ, যেমন ঘরবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, কাপড় ধোয়া, বাজার করা, সন্তানদের খাওয়াপরা, যত্নাদি। অনেকে বলতে পারেন, অনেক স্বচ্ছল শহুরে পরিবারেই মাসোহারার বিনিময়ে নির্ধারিত রান্নার লোক থাকে। সেখানে গৃহকর্ত্রীর তো এ সমস্যা নেই। প্রথমত দেশের মোট জনসাধারণের তুলনায় সেরকম বাড়ির সংখ্যা নগণ্য। দ্বিতীয়ত, এটা সত্য যে সেইসব স্বচ্ছল পরিবারে চুলার পাশে বসে আয়েসী গৃহকর্ত্রীর হয়ত আগুনের তাপ সবসময় সরাসরি সইতে হয় না। কিন্তু কোন বেলা কী খাবার তৈরি হবে, কার জন্যে বিশেষ করে কী রাঁধতে হবে, কে কখন খাবে সব কিছুর দায়িত্ব তাকেই নিতে হয় এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া থেকে শুরু করে রান্না ও পরিবেশনের তদারকি করতে হয় তাকে নিজের হাতেই, ফলে রান্নার জন্যে নির্দিষ্ট লোক থাকলেও রান্নাঘরের কাজকর্মে একরকম করে লেগে থাকতেই হয় কর্ত্রীকে। পুরুষরা বরাবর এ দায়িত্ব এড়িয়ে এসেছে। এর স্বপক্ষে যুক্তি হিসেবে তারা বলেছে, যেহেতু পুরুষকুল রোজগার করে এবং রোজগারের জন্যে তাদের বাইরে বেরুতে হয, পরিশ্রম করতে হয়, শ্রমের সুঠম বণ্টন ও ন্যায্যতার খাতিরেই রান্নাবান্নার দায়িত্ব নারীকে নিতে হয়। কিন্তু যুগ পাল্টিয়েছে। পাল্টিয়েছে দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনধারা। শহুরে অনেক পরিবারেই এখন অর্থনৈতিক ও নৈতিক কারণে পুরুষ নারী দু জনেই অর্থকরী কর্মকাণ্ডে জড়িত—দু জনেই বেরিয়ে এসেছে পরিবারের গণ্ডি ছেড়ে জীবিকার সন্ধানে। তারপরও সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পরিশ্রম করে দু জনেই ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরলেও রান্নাবান্নার দায়িত্ব প্রায় অবধারিতভাবেই স্ত্রীর কাঁধেই নিতে হয়। গ্রামেও নারীরা বরাবর ঘরের বাইরে বিভিন্ন ধরনের কৃষিকাজে ব্যস্ত থাকে। ধান বোনা থেকে শুরু করে শস্য রোপণ, পাকা শস্য কর্তন, ধান, মরিচ, সরষে, ইত্যাদি শুকনো, পাকা ধান মাথায় বয়ে ঘরে আনা, ধান মাড়ানো আর কত কি করে সর্বক্ষণ! সেই সঙ্গে করে রান্নাবান্না, সন্তান ধারণ, প্রতিপালন সব। আজকাল কৃষিকাজ ছাড়াও পল্লীবালারা যুক্ত হয়েছে আরো বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ডে। মাটি কাটা, মাটি বহন করা থেকে শুরু করে নির্মাণশিল্পের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হয়েছে গ্রামের ও শহরের গরীব মেয়েরা। এছাড়া কুটির শিল্পের প্রধান অংশটারই কারিগর নারী—বিশেষ করে পল্লীনারী। আর শহরে পোশাকশিল্পে কাজ করছে তো লাখ লাখ অল্পবয়সী নারী। তাহলে, বাইরের পরিশ্রম একইরকম করলে ঘরের কাজে তাদের সহযোগিতা কেন মিলবে না স্বামীর কাছ থেকে? বিশেষ করে সারাদিন পরিশ্রম করে ঘরে ফেরার পর মেয়েদেরও তো সাধ হয়, তৈরি গরম গরম খাদ্য গ্রহণের? তাদের সে সাধ বরাবরই কি অপূর্ণ থেকে যাবে? সেটা কোন যুক্তিতে চলবে? শুধু তাই নয়, দৈনন্দিন এই রান্না করার মহা দায়িত্বটা মাথার ওপর খড়্গের মতো ঝুলতে থাকায় আমাদের দেশের বধূরা কখনো একবেলা বা দুটো দিন নিজের মতো করে কারো বাড়িতে গিয়ে সময় কাটাতে পারে না, সে বাড়ি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাড়ি হোক, মা, বোন বা নিকট আত্মীয়ের বাড়ি হোক। একসময় বিবাহিত মেয়েরা দীর্ঘদিনের জন্যে মায়ের বাড়িতে নায়র আসত নিজের শরীর ও মনের ক্লান্তি ঘোচাতে। একান্নবর্তী পরিবার থাকায় তখন তার এই সাময়িক অনুপস্থিতি বাড়ির অন্যান্য বউয়েরা মিলে মিশে ভাগ করে নিত। অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমানে যৌথ পরিবার প্রথা প্রায় ভেঙে পড়ায় বিবাহিত মেয়েদের পক্ষে একা স্বামী সন্তান ফেলে দুটো দিনের জন্যেও আরাম করতে কোথাও যাবার উপায় নেই। অথচ এই নিভৃতি এই নিস্তার—এই অব্যাহতি শুধু শরীরের জন্যে নয়, মানসিক প্রশান্তির জন্যেও অত্যাবশ্যকীয়। আমি লক্ষ্য করেছি, শহরে উচ্চ পদে আসীন মহিলারাও এক রাত গৃহের বাইরে থাকলে, যাবার আগে রান্না করে রিফ্রেজারেটরে থরে থরে সাজিয়ে রেখে যান খাবার, যাতে স্বামী, পুত্রকন্যার কোনোই অসুবিধে বা ঝামেলা করতে না হয়। দেখেশুনে মনে হয় প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ যেন প্রতিবন্ধী। নিজের খাবার নিজে তৈরি করার সামর্থ্য পর্যন্ত তাদের নেই। তবে খাবার তৈরি করে রেখে যাবার জন্যে সকলের ঘরে ঘরে রিফ্রেজারেটর নেই। আর যদি তা থাকতও, তাহলেও কেন স্বামী বা পরিবারের অন্য সদস্যরা দুটো দিন রান্না করে নিতে পারবে না? আর যদি রান্না একান্তই করতে না পারে, ফলমূল, সেদ্ধ তরিতরকারী, খেয়ে নিতে পারে তারা। ভাত রাঁধার সামর্থ্য না থাকলে, মুড়ি, চিড়া, খই, পাউরুটি, আলু সেদ্ধ, দুধ, দই কত কিছু আছে খাবার! প্রতিদিন যে সপ্তম ব্যঞ্জন না হলেও তিন ব্যঞ্জন দিয়ে গরম গরম ভাতই খেতে হবে, এ বাধ্যবাধকতা কে চাপিয়ে দিয়েছে? পৃথিবীর কত দেশে তো মানুষ ভাত খায় না—অন্তত নিয়মিত ভাত খায় না, এমন দেশের সংখ্যাই তো বেশি। তারা কি কোনো অংশে কম শক্তিধর বা তারা কি বুদ্ধিহীন আমাদের থেকে? মোট কথা, হাড়ির সাথে নিত্যবন্ধন শুধু প্রতিদিন রান্না করতেই বাধ্য করায় না মেয়েদের। এই অচ্ছেদ্য বন্ধন তাদের অনেক সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে নিরুৎসাহ করে—তাদের স্বাধীনভাবে চলাফেরার অন্তরায় হয়— তাদের জীবিকা নির্বাচনে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। মজার ব্যাপার হলো, এই রান্না করার সঙ্গে আমাদের বাড়ির বৌদের এমন করেই গাঁটছড়া বেঁধে দিয়েছে সমাজ যে, কোনো পুরুষ বিপত্নীক হলে (এমন কি বৃদ্ধ বয়সেও) সমস্ত সমাজের সমবেদনা ও করুণা উপচে পড়ে তার ওপর। “আহারে! কেমন করে খেয়ে পড়ে এখন বাঁচবে লোকটা?” অন্তত রান্না করে খাওয়াবার মতো “মানবিক কারণেও” তাকে আবার বিয়ে দিতে উৎসাহী ও উদ্যত হয়ে পড়ে পরিবার ও সমাজ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে শুধু পেটের ক্ষুধা নয়, পুরুষ মানুষটির যৌন চাহিদার জন্যেও তার পুনরায় বিবাহ প্রায় অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু যদি কোনো নারী বিধবা হয়, তার আবার বিবাহের ব্যাপারে কারোরই তেমন মাথাব্যথা নেই। প্রথমত সে নিজের রান্নাই শুধু নয়, ঠিক আগের মতোই পরিবারের অন্য সকলের রান্নাবান্না ও পরিবেশন ঠিকমত চালিয়ে যেতে পারবে। বরং নিজের স্বামীর অনুপস্থিতিতে অন্যদের ওপর এখন নজর আরো বেশি দিতে পারবে। আর যৌনক্ষুধা? আরে, নারীর আবার ওসব আছে নাকি? সে তো শুধু পৃথিবীতে এসেছে পুরুষের আকাঙ্ক্ষা ও অভিলাষ মেটাতে। ভাবতে অবাক লাগে, আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগে মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলীর মত ধর্মীয় আদর্শের অনুসারী লেখকও তাঁর যুক্তিবাদের মাধ্যমে স্বীকার করেছিলেন, “নারীর দেহ পুরুষের কাছে লোভনীয় সামগ্রী, একথা যতোটা সত্যি, পুরুষের অবয়ব নারীর কাছে লোভনীয় বস্তু এটাও তার চাইতে কম সত্য নয়।” অথচ আধুনিক ও প্রগতিশীল বলে দাবি করেন, এমন অনেকেই এ সত্যকে অস্বীকার করতে চান।
সে যাই হোক, মোট কথা, পুরুষকেও আস্তে আস্তে রান্নার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে এবং তা শুরু হবে শুধু বিয়ের পর নয়, আগে থেকেই। ঠিক যেমন করে মেয়েরা মায়ের পাশে পাশে থেকে ও দেখে, মাকে রান্নাঘরে সাহায্য করার মাধ্যমে, বিভিন্ন অনুশীলনের মধ্য দিয়ে কাজ চালাবার মতো ন্যূনতম রান্নার জ্ঞান অর্জন করে বিয়ের আগেই। কোনো নারী বিনা কারণে, বিনা অসুখে, অত্যাচারিত বা শোকাতপ্ত না হয়ে, কোনোরকম ধর্মীয় অনুশাসন ছাড়াই কখনো কখনো রান্না ঘরে যেতে না পারে। সেটা পূর্ব নির্ধারিত হলে উত্তম। না হলেও পরিবারে সকল সদস্যের প্রচেষ্টা থাকবে তার ইচ্ছাকে সম্মান করা। আর সেটা করে স্বামী বা পরিবারের অন্য সদস্য সেদিন রান্নার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। রান্নার দক্ষতা বা সহজাত ক্ষমতা যে নারীর একচেটিয়া সম্পত্তি নয়, সেই মেধা যে তার জিনসে লুকিয়ে নেই, তার বড় প্রমাণ পৃথিবীর সকল দেশেই পেশাদারী পাঁচকরা প্রায় সকলেই পুরুষ। জীবিকার জন্যে যে কাজ পুরুষ বাইরে করতে পারে, স্ত্রীর প্রতি সহমর্মিতার খাতিরে সে কাজ ঘরে করতে বাধা কোথায়? এরকম মূল্যবোধ ও বোঝাপড়া সংসারে প্রচলিত থাকলে তা শুধু রান্না করার ব্যাপারেই নয়, নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা, অধিকার, স্বাবলম্বিতার অন্যান্য অনেক দিকই আলোকিত করবে নিঃসন্দেহে। রান্না করার ব্যাপারটাকে সরাসরি জৈবিক বলা না গেলেই যেহেতু নারীর কায়িক পরিশ্রমের এক সিংহভাগ রান্নার অনুষঙ্গে কাষ্ট, এটি নিঃসন্দেহে তাঁর জৈবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম।
৩. একত্রে আহার গ্রহণ : একটা অতি সাধারণ পদক্ষেপ পরিবারের ও সমাজের অনেক বৈষম্য ঘোচাতে পারে। আর সেটা হলো, পরিবারের সকল সদস্যদের একসঙ্গে বসে খাদ্য গ্রহণ করা। আমাদের দেশের অধিকাংশ পরিবারে শিশুদের ও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের আগে খাবার পরিবেশন করা হয়। পরে নিভৃতে রান্না ঘরে একা একা বসে পরিত্যক্ত বা অবশিষ্ট খাদ্য কণা দিয়ে আহার সারেন গৃহিণী। এটা এতটাই চলতি, এতটাই স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য হয়ে পড়েছে যে কেউ এই ব্যাপারটির ভেতর কোনো দোষ, অবহেলা বা বৈষম্যের আভাস দেখেন না। এর ফলে দিনের পর দিন বড় মাছটি, অথবা মাছের বড় পেটিটি কিংবা মাংসের সেরা টুকরোগুলো বেছে বেছে স্বামীর পাতে পড়ে। আর দিন শেষে হেঁসেলে এক গাদা ঝোলের মধ্যে ভেসে থাকা ল্যাজা অথবা পিঠের ছোট্ট এক টুকরো কাঁটাওয়ালা মাছ কিংবা মুরগির গলা অথবা পাখা দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করেন ঘরের গৃহিণী। এই গৃহবধূই যখন আবার শাশুড়ি হন, পুত্রবধূর কাছেও আবার একই প্রত্যাশা থাকে তার। শুধু পারিবারিক সদস্যের খাওয়াদাওয়ার ব্যাপার নয় এটা। বাড়িতে অতিথি এলেও সাধারণত একই ব্যাপার ঘটে। অতিথি পুরুষরা আগে ভাগে খেয়ে নেয়। পরে নারীরা খাদ্য গ্রহণ করে। অথবা অতিথি পুরুষ ও নারীরা একত্রে খাওয়াদাওয়া করে। পরে যেটুকু অবশিষ্ট থাকে তাই ভাগবাটোয়ারা করে খেয়ে নেয় বাড়ির মেয়েরা। শহরে মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত কোনো কোনো পরিবারে একসঙ্গে এক টেবিলে বসে খাদ্য গ্রহণের রেওয়াজ রয়েছে। কিন্তু গোটা দেশের চিত্র এটা নয়। পর্যায়ক্রমে খাবার পরিবেশনের ফলে শুধু উন্নতমানের খাবারই নয়, মুখরোচক খাবারও যথেষ্ট পরিমাণে গ্রহণ করার সুযোগ পান শুধু পরিবারের পুরুষ সদস্যরাই যাদের প্রথম খাদ্য পরিবেশিত হয়। নারী কতখানি সময় ধরে রান্নার যোগাড় করে, কতখানি সময় রান্নায় ব্যয় করে, আর বিনিময়ে সে কতটুকু বা কী মানের আহার গ্রহণ করে এই খোঁজ কেউ নেয় না—পুরুষরা তো নয়ই। অথচ এই বোধ বা উপলব্ধি যতদিন না পুরুষের মধ্যে জাগ্রত হচ্ছে, তারা ক্রমাগত চিতলের পেটি অথবা মুরগির বুকের মাংস খেয়ে দেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে দিবানিদ্রা দেবে। আর তার স্ত্রী তখন সবে হেঁসেল গুছোতে গুছোতে শুধু ডাল অথবা মাছের ঝোলের সঙ্গে লঙ্কা মাখিয়ে এক গাদা ভাত খেয়ে ক্ষুধা নিবারণের চেষ্টা করবে। চিতলের বদলে চাপিলা অথবা নলা মাছ হলেও চিত্রটা ঠিক পাল্টায় না। শুধু রকমটা একটু ভিন্ন হয়। বাইরের জগতে নারীর বিরুদ্ধে যে দীর্ঘ অবিচার চলে এসেছে—বৃহত্তর সমাজে পুরুষ ও নারীর অধিকারের মধ্যে যে বিশাল বৈষম্য রয়েছে, তার গোড়ায় রয়েছে নিজের ঘরের একান্তে একসঙ্গে বসে না খাওয়া থেকে উদ্ভূত বৈষম্য। ঘরের ভেতর সহমর্মিতা, সহানুভূতি, ন্যায্যতার বোধ যদি ঘুমিয়ে থাকে, বাইরের জগতে এসে হঠাৎ করে তার জেগে ওঠার কোনো সম্ভাবনাই নেই। ভাবতে অবাক লাগে, কতটা স্বার্থপর, কতটা আত্মপ্রেমিক হলে পুরুষ সবার আগে ঘুম থেকে উঠে সবার শেষে ঘুমুতে যাওয়া মানুষটির—অর্থাৎ বাড়ির গৃহিণীটির খাবারদাবারের খোঁজ পর্যন্ত নেয় না। পুরুষ নিজে রাঁধে না এবং রান্নাজনিত আনুষঙ্গিক কাজকর্মে অংশগ্রহণ করে না বলে অতি অসংবেদশীল মানুষটির মতো অসময়ে ভর দুপুরে অথবা বিকেলে হঠাৎ এক গাদা তাজা পুঁটি বজুরী কিনে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। তার এই আকস্মিক সিদ্ধান্ত বা সখ ঘরের বধূটির দৈনন্দিন কাজ কতটা বাড়িয়ে দেবে, সে এখনো দ্বিপ্রাহরিক খাবার খেয়েছে কি খায় নি, এসবের কোনো খোঁজ নেওয়াই প্রয়োজন বোধ করে না গৃহস্বামী। একসঙ্গে বসে না খাবার কারণে, এবং রান্নার পরিমাণ ও রকম সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকায় আস্তে আস্তে পুরুষ এতটাই অসংবেদনশীল হয়ে পড়ে যে সেটা শুধু নিজের ব্যাপারেই সীমাবদ্ধ থাকে না। কখনো সখনো না বলে কয়ে দুপুরে বা রাতে খাবার খেতে সঙ্গে নিয়ে আসে এক বা একাধিক বন্ধু বা সহকর্মী। তাদের খাবার যুগিয়ে ঘরের বধূটি আদৌ কিছু খেতে পেল কি না, তার খবর কেউ রাখে না। ফলে, একত্রে বসে খাদ্যগ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। সকাল সন্ধ্যা যে কঠিন শরীরিক ও মানসিক পরিশ্রম করতে হয় গৃহকর্ত্রীকে, তাতে তার নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্য খাওয়া একান্তই দরকার। নারী শুধু সব তৈরি করবে, আর দান করবে, বিনিময়ে নিজের জন্যে কিছুই রাখবে না, গ্রহণ করবে না কোনো কিছুই, নারীর এই রকম এক আত্মঘাতী রূপকে আদর্শ বলে প্রতিষ্ঠিত করার কোনো যুক্তিই নেই। ফলে তার দিকে ফিরে তাকাবার জন্যে শুরু হোক পরিবারে একত্রে খাদ্য গ্রহণ, প্রতিবেলা সেটা সম্ভব না হলেও অন্তত দুপুরে বা রাতে একবেলা একসঙ্গে বসে সকলকে খেতে হবে। এতে খাদ্য বৈষম্য শুধু কিছুটি দূর হবে তাই নয়, নারীর স্বার্থত্যাগ, নিষ্ঠা ও অন্যের প্রতি দরদ সম্পর্কে সচেতন হবে পুরুষ শ্রদ্ধা করতে শিখবে সেসব গুনাবলিকে। নিজেরা শিখবেও কিছু কিছু। এতে করে তার মধ্যে সহমর্মিতার বোধ জাগ্রত হওয়াও স্বাভাবিক। এছাড়া একসঙ্গে বসে খেতে খেতে পরিবারের সদস্যরা পরস্পরের সঙ্গে ভাব বিনিময়, আলোচনা, সমস্যা ও ভুল বোঝাবুঝির ব্যাপারে নিষ্পত্তি, প্রাত্যাহিক জীবনের ছোটখাট ঘটনা, টুকিটাকি নিয়ে কথাবার্তা বা পরামর্শ অনেক কিছু করারই সুযোগ পায়, যা হয়ত অন্য সময়ে সম্ভব হয় না, কেননা সংসারে সকলের অবসর একই সময় বের করা দুরূহ বটে।
৪. যৌন-সংযোগ ও সন্তান ধারণ : বিবাহিত জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যৌনতা, যা মানবিক অন্যান্য অনেক সম্পর্ক থেকে একে আলাদা করে। কিন্তু আমাদের সমাজে যৌনসঙ্গী নির্বাচনে যেমন নারীদের হাত নেই, যৌন পরিতৃপ্তির ব্যাপারটাও অধিকাংশের কাছে অপরিচিত। যদিও বাঙালির যৌনজীবন সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা যায় না, তবু হুমায়ুন আজাদের এ ব্যাপারে মন্তব্য সঠিক বলেই মনে হয়। তিনি তাঁর ‘নারী’ গ্রন্থে লিখেছেন, “বাঙালি নারীর যৌনজীবন বলাৎকার ও চরম বিরক্তি অবসাদের সমষ্টি। উচ্চ শিক্ষিত কিছু নারী জানিয়েছেন, তাঁরা পুরুষ সম্পর্কে কিছু জানেন না, তাঁদের স্বামীরা লাফ দিয়ে উপসংহারে পৌঁছেন, এই তাদের কাম জীবন। দরিদ্র অশিক্ষিত নারীরা সাধারণত ভোগ করে স্বামীর বলাৎকার। বাংলাদেশের প্রতিটি শয্যাকক্ষ, যদি থাকে, নারীর জন্যে বলাৎকার বা বিরক্তি অবসাদ কক্ষ।” ভারতীয় Population Council এর কর্মকর্তা এম. ই খানের বাংলাদেশের ওপর গবেষণাও অনুরূপ সাক্ষ্য দেয়। তিনি তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, বাঙালি পুরুষদের নারীর যৌনতা নিয়ন্ত্রণ করার অন্যতম কৌশল, নারীদের এ সম্পর্কে কিছু জানতে না দেওয়া অজ্ঞতাই আশীৰ্বাদ দর্শন এটাই। খান দেখিয়েছেন যে অধিকাংশ নারী তার যৌন জীবন অর্থাৎ বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করে যৌনতা সম্পর্কে নেহায়েত অজ্ঞ হিসেবেই। সম্পূর্ণ যৌনজীবনের তৎপরতা ও তার কর্মকাণ্ড পরিচালনার ভার পুরুষের হাতে। নারীর ইচ্ছা অনিচ্ছা মতামত সেখানে গ্রাহ্য নয় মোটেই। পরিবার পরিকল্পনার ব্যাপারে পুরুষরা বাস্তবিক কারণেই আগ্রহী হলেও কখন এবং কী ধরনের পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে, সেটাও তারাই নির্ধারণ করে দিতে চায়। এই হলো বাস্তব অবস্থা। অথচ ছ’ দশক আগে মোঃ ওয়াজেদ আলী নারী-পুরুষ সম্পর্কে বলে গেছেন, “উভয় উভয়ের দৈহিক মানসিক ও যৌন শান্তি বিধানে অক্ষম বা অপ্রচুর অনুভূত হওয়া মাত্র তারা বা তাদের যেকোনো এক পক্ষ বিবাহ সম্পর্ক ছেদন করতে পারবে। নর বা নারী কেউ কারো অধীন হবে না।” যারা সৌভাগ্যবতী, যারা নিজেরা, পছন্দ করে জীবনসঙ্গী নির্বাচন করেছেন (তাদেরও অধিকাংশই যৌনতার সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন বিয়ের পরই) অথবা পরিবারে নির্ধারিত বিয়ের পরও যৌনজীবনে পরিতৃপ্ত, তাদের কথা আলাদা, সংখ্যায় যারা অতি অল্পই। বৃহত্তর বিবাহিত নারীসমাজে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত যখন শুধু স্বাধীর কাম চরিতার্থ করার জন্যেই নারীর যৌনসংযোগ ঘটে, এবং সেটাই জীবনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলে তারা গ্রহণ করে নেয়, তখন অন্তত এটুকু স্বাধীনতা তাদের দরকার যে তার একান্ত ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সঙ্গে যৌন কর্মে লিপ্ত হবে না স্বামী। কিন্তু বেশির ভাগ সময়েই সেটা ঘটে না। স্বামীর কাম ভাব জাগ্রত হয়েছে অথচ স্ত্রী তা চায় না, নিস্তার পাবে কি সে? এটা শুধু আমাদের দেশে বা উন্নয়নশীল দেশের নারীদেরই সমস্যা নয়। জগৎজুড়েই রয়েছে এ সমস্যা—কম বেশি। কিন্তু দুঃখের বিষয় কোনো দেশেই স্বামী বা প্ৰেমিক কর্তৃক ধর্ষণের অভিযোগ শেষমেশ আইনে টেকে না। ফলে বাধ্য হয়ে কোনো কোনো বিচলিত ও নিরাশ নারী নিজের হাতে বিচার তুলে নেয়। স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করে সম্পূর্ণ বা আংশিক পুরুষাঙ্গ খুইয়েছে একাধিক ব্যক্তি। কিন্তু সমস্যার সমাধান এটা নয়। পুরুষ বরাবরই নারীকে তার ভোগের সামগ্রী মনে করে। সেই সঙ্গে তাদের অনেকের ধারণা, নারীর যৌন চাহিদা বা ইচ্ছা-অনিচ্ছা বলে কিছু নেই। যৌন জীবনে আমাদের দেশের পুরুষরা কখনো নারীকে সমান অংশীদার মনে করে না। তারা মনে করে, যৌনকর্মে নারীর একমাত্র ভূমিকা পুরুষকে পরম পুলকের আস্বাদ দেয়া অর্থাৎ কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরে নিশ্চুপে নিজেকে সঁপে দিয়ে কেবল স্বামীর স্খলনের অপেক্ষা করা। এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। নারীরও যে যৌন আকাঙ্ক্ষা রয়েছে—তারাও যে জাগ্রত হয়-পুরুষের সঙ্গ কামনা করে তাদেরও যে চরম পুলক অনুভব করার ক্ষমতা রয়েছে— দীর্ঘদিন ধরে তাদের অবদমন করে রাখা সে অমানবিক ও অস্বাস্থ্যকর, এ বোধ করে আসবে আমাদের পুরুষদের মধ্যে? যতদিন তা না আসে, যতদিন নারীকে তার হাজারো কর্তব্যের মতো——–দৈনন্দিন রুটিনের মতো—ছেলেকে ভাত খাইয়ে স্কুলে পাঠাবার মতো করে স্বামীর বাসনার কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হচ্ছে, ততদিন অন্তত এটুকু আশা করা যাক, যে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে তার সঙ্গে যৌনসম্পর্ক পাতাবার চেষ্টা করবে না স্বামী। নারী যদি তার শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, কখন সে যৌন সংযোগে অংশগ্রহণ করবে, কখন নয়, তাহলে তাদের দাম্পত্য জীবনই যে উন্নততর হবে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধই যে শুধু বৃদ্ধি পাবে, তা নয়, তাদের অবাঞ্ছিত সন্তানের সংখ্যাও হ্রাস পাবে, নারীর নিজের প্রতি আস্থা বাড়বে। মার্গারেট স্যাংগার বলেছিলেন, যে নারী নিজের শরীরের মালিক ও নিয়ন্ত্রক নয়, সে নারী কখনো নিজেকে স্বাধীন বলতে পারে না।” নারী যেহেতু নিজের শরীর দিয়ে সন্তান ধারণ করে, প্রসব করে, স্তন্যদান করে, সন্তানের প্রতিপালন করে, যৌন সংযোগ ও সন্তান ধারনের স্বাধীনতা ও মতামত তার থাকতেই হবে। এই অধিকার অস্বীকার করা মানে মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘন করা। সেটা মহা অপরাধ।
পরিশেষে, অনেক চড়াই উৎরাই পার করে দেশ আজ আমাদের এক কঠিন ক্রান্তিলগ্নে এসে দাঁড়িয়েছে। ছোট্ট ভূখণ্ডে অনেক বেশি মানুষ থাকার কারণে স্বাভাবিক যে সকল সমস্যা দেখা দেয়, তার বেশিরভাগ সমস্যাই আমাদের রয়েছে। তা সত্ত্বেও বাঙালি জাতির অক্ষয় অদমনীয় মনোবল, পরিশ্রমী দেহ, উদ্ভাবনী ক্ষমতা, প্রযুক্তির আমদানি, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দ্রুত অগ্রগতি আজ আমাদের গোটা জাতিকে অর্থনৈতিকভাবে অনেক সম্ভাবনার দ্বার প্রান্তে এনে দিয়েছে। এ অবস্থায় নারীর জীবনেও ঘটে চলেছে বিপ্লব। শিক্ষাক্ষেত্রে, বিনা বেতনে বা অতিসামান্য বেতনে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে, টিকা, জীবাণুমুক্ত পানীয় জল, ওরস্যালাইন, স্ল্যাবের পায়খানা, পরিবার পরিকল্পনার সামগ্রী ও উঁচু মানের শস্যের বীজ ও মুরগি ছানার ব্যবস্থা, ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে ছোটখাট বিভিন্ন অর্থকরী কাজে বিনিয়োগের সুযোগ বাংলাদেশের নারীর আত্মপ্রত্যয় যেমন বাড়িয়েছে, পরিবারে তার অবস্থানও কিছুটা হলেও দৃঢ়তর করেছে সন্দেহ নেই। পোষাক শিল্পের অগ্রগতি, মহল্লায় মহল্লায় বড় বড় মুরগির খামার, কুটির শিল্পের প্রসার ও বাজারজাতের ব্যবস্থা, নির্মাণ শিল্পে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ সাধারণ এবং নিম্নবিত্তের নারীদের অর্থ উপার্জনের পথও সুগম করেছে। এছাড়া শিক্ষাও সেবামূলক পেশা ছাড়াও শহরের শিক্ষিত নারীরা আজ বাণিজ্যিক ও ব্যবস্থাপনার কাজেও লিপ্ত। সমস্ত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাঙালি নারী হাঁটি হাঁটি পা পা করে একটু একটু করে স্বাবলম্বিতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এটি সর্বজনবিদিত যে, কোনো দেশের উন্নয়নের অন্যতম মাপকাঠি হচ্ছে নারীর অবস্থা ও অবস্থান। সেই বিচারে আমাদের নারীরা তাদের চলাচলের পরিধি আজ অনেকটাই বিস্তৃত করেছে। এই অবস্থায় পারিবারিক পর্যায়ে উপরে উল্লেখিত চারটি মৌলিক বিষয়ে নারীর সচেতনা ও তার অধিকার/নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা দেশের সামগ্রিক নারী সমাজের স্বাধীনতা ও স্বাবলম্বিতার সাফল্যকে অনেকটাই এগিয়ে দেবে।