আরো কয়েকটি ‘পিল’

আরো কয়েকটি ‘পিল’

‘কখন তোমাকে ঘেন্না করতে শিখলাম আমি?’

ঠিক কখন? যে তোমাকে আমি দিনে দিনে, প্রতি বসন্তে একবার করে সাজাতাম, সেই তোমাকে কখন ঘেন্না করতে শিখলাম? অথচ সেই লোকটা প্রতিবার তোমাকে নিয়ে নারকীয় তৃপ্তি পেতে তোমার প্রশংসা করত যখন, তখন তোমাকে আরো ভালোবাসতাম। আরো সাজাতাম। তাহলে তোমাকে ঘেন্না করতে শিখলাম কখন? অমূল্য যখন কোলে এলো, তখন? অতুল যখন কোলে এলো, তখন? অনিমা, অনিতা যখন কোলে এলো, তখন? সাত-দুগুণে চৌদ্দ বছরে আরো কতগুলো কোলে এলো যখন, তখন? না, তা নয়। প্রতিবার তোমাকে বেশি করে ভালোবেসেছি আমি। নাকি অমূল্য স্কুল ছেড়ে দিল, গাঁজা খেতে শিখল, বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল, চুরি করে হাজত খাটল, আর এখন চোখের ওপর ছোট ভাইয়ের বিয়ে দেখতে পারবে না বলে দুদিন বাড়ি নেই যখন, তখন?… কখন তোমাকে ঘেন্না করতে শিখলাম তাহলে? ঠিক কখন? ঠিক কখন? ঠিক কখন?

ওপরের কথাগুলো ষাটের দশকের এক প্রখ্যাত গল্পকারের একই দশকের শুরুতে লেখা ‘আরো কয়েকটি পুতুল’ গল্প থেকে উদ্ধৃত। বলা বাহুল্য, আমার এ-লেখার শিরোনামটিও সেখান থেকেই ধার করা। বহু সন্তানের জননী যৌবনাতিক্রান্ত সরোজিনী, যাঁর স্বামী মনমোহন উপার্জনে যথেষ্ট সক্ষম নন এবং কর্তৃত্বে অপারগ, যাঁর সংসারে নিদারুণ দারিদ্র্য, যাঁর সন্তানেরা বাউণ্ডুলে হয়ে পড়েছে, যাঁর আইএ-ফেল ছোট ছেলে এক শ টাকার চাকরি পেয়ে আহ্লাদে-ফুর্তিতে বড় ভাইকে ফেলেই বিয়ে করতে যাচ্ছে,— আজ নিজের সঙ্গে, নিজের শরীরের সঙ্গে, নিজের জীবনের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিতে চাইছেন। ওদিকে বড় পুত্র অমূল্যকে ফেলে রেখে ছোট পুত্র অতুলের বিয়েতে যেতে কিছুতেই মন চাইছে না মনমোহনের। কিন্তু কোথায় অমূল্য? ক্ষোভে- দুঃখে-অপমানে আর অভিমানে অমূল্য পালিয়েছে বাড়ি ছেড়ে। এখন করেন কী মনমোহন? গল্পকারের ভাষায়, ‘ওদিকের দরজার কাছে চৌকির ওপরে কী যেন একটা দেখলেন মনমোহন। ছায়া। ছায়া। নাকি অমূল্য? ও যাই হোক, ও অমূল্য। ছুটে ওর কাছে গেলেন মনমোহন। ওকে এমনি করে রেখে যাবো না। ওকে নিয়েই যাই। রুমাল পেতে অমূল্যকে তাতে বাঁধলেন মনমোহন। সবটা অমূল্য ঢুকলো না। হাত দুটো বেরিয়ে রইলো। তারই একটা হাত থেকে আরো দশটা অমূল্য বেরিয়ে এসে দুজনের গলা ধরে ঝুলতে লাগলো। আর একটা হাতে একটা মুগুর গোঁজা, সেটা দুজনের বুকে পড়তে লাগলো।‘

এই প্রতীকী গল্পকে সাদামাটা দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গনে টেনে নামালে আমরা দেখব, মনমোহন-সরোজিনী দুজনেই নিশ্চিত তাঁদের সার্বিক দুরবস্থার জন্যে এতগুলো সন্তানের জন্মই দায়ী এবং তার জন্যে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই উভয়কে দোষারোপ করছেন মনে মনে। ভাবটা এমন, যেন একে অন্যকে প্রলোভিত না করলে, ‘লোভ দেখিয়ে আঁধারের পাঁকে টেনে নিয়ে’ না-গেলে এমনটি হতো না। যৌনমিলনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি যে সন্তানের জন্ম, এ-অনিবার্যতাকে মেনে নিয়েছেন তাঁরা দুজনেই। বস্তুত, এ-গল্প সমাজবাস্তবতার চিহ্ন। গেল শতকে আমাদের সাহিত্যের প্রধান উপাদান ছিল দারিদ্র্য। শিল্প ও সাহিত্যের একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল অনটন ও বৃহৎ পরিবার। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা দেখি দারিদ্র্য এখনো যথেষ্ট পরিমাণেই বিদ্যমান সমাজে। তবে দারিদ্র্যের পরিসর না কমলেও তার প্রকোপ নিশ্চয়ই কমেছে। অনাহারে মৃত্যু কিংবা ক্ষুধাজনিত ক্লিষ্ট কঙ্কালসার চেহারার শিশু অথবা তাদের পিতামাতা যত্রতত্র তেমন চোখে পড়ে না আর। শিল্পোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে গত অর্ধ-শতাব্দীর পরিবার পরিকল্পনার সাফল্যও এর জন্যে অবশ্যই দায়ী।

নারী-নিয়ন্ত্রিত জন্মনিরোধে তথা নারীর স্বাধিকার ও স্বাবলম্বিতা অর্জনে জন্মনিয়ন্ত্রণ-বড়ি বা ‘পিলের’ ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছি অব্যবহিত পূর্বের রচনাটিতে। সন্দেহ নেই, ষাটের দশকের পিলের আবিষ্কার নারী-আন্দোলনের সাফল্যের এক বিরাট জয়যাত্রা। যৌনতাকে প্রজনন থেকে আলাদা করে দেখার সুযোগ এনে দিয়েছে ‘পিল’, যার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নারীর নিজের হাতে। পিল বাজারজাত-হওয়া অন্যান্য জন্মনিয়ন্ত্রণ-পদ্ধতির বা পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত-পদ্ধতির, যেমন কনডম ব্যবহারের প্রতি নিরুৎসাহ প্রদানের সমার্থক নয়। বরং এটি নতুন দিগন্ত উন্মোচনকারী একটি অভিনব পন্থা, যা ভবিষ্যতে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আরো অনেক রকমের হরমোনজাতীয় পছন্দসই জন্মনিয়ন্ত্রণ-পদ্ধতির আবিষ্কারের পটভূমি।

মেয়েদের শরীরের দুই হরমোন, এস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টারোনের সমন্বয়ে তৈরি গতানুগতিক পিলকে ভিত্তি করে আজ বাজারে বিভিন্ন রকম জন্মনিয়ন্ত্রণ-পদ্ধতি পাওয়া যাচ্ছে, যার সবগুলো আবার মুখে খাবার বড়িও নয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো মিনি পিল, একটানা পিল, পরদিন সকালের পিল, গর্ভপাতের পিল ইত্যাদি। এছাড়া রয়েছে হরমোনভিত্তিক চামড়ার ওপরে লাগাবার জন্যে প্যাচ, ডিপোপ্রভেরার মতো ইনজেকশন, যোনিতে প্রতিস্থাপনযোগ্য রিং। ছিল নরপ্ল্যান্ট নামক চামড়ার নিচে বসাবার ক্যাপসুল।

হরমোনজাতীয় সব জন্মনিরোধক সামগ্রী, সেটি পিলই হোক অথবা প্যাচ, ইনজেশকন বা আইইউডি-ই (ইন্ট্রা-ইউটেরাইন ডিভাইস অথবা জরায়ুর ভেতরে প্রতিস্থাপিত যন্ত্র) হোক, গর্ভ নিরোধ করে কিন্তু অভিন্ন উপায়েই। সাধারণত চাররকমভাবে গর্ভসঞ্চারে বাধা দেয় এই হরমোনসামগ্রী :

১. ওভুলেশন, যা ডিম্বাশয় থেকে প্রতি মাসে একটি করে পরিণত ডিম্বাণুর বেরিয়ে আসাকে বোঝায়—তা রোধ করে। মেয়েদের ডিম্বাণুর সঙ্গে পুরুষের শুক্রাণু মিললেই যেহেতু সন্তানের জন্ম হয়, ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু বেরুতে না পারলে গর্ভধারণ সম্ভব নয়। তবে কখনো কখনো হরমোনজাতীয় গর্ভনিরোধক সামগ্রী ওভুলেশনকে পুরোপুরি বন্ধ করতে সমর্থ হয় না। সেক্ষেত্রে নিম্নলিখিত অন্যান্য উপায়েও তারা গর্ভসঞ্চারে বাধা দেয়।

২. জরায়ুর ভেতরে যে তরল পদার্থ থাকে, তা এইসব গর্ভনিরোধে ব্যবহৃত হরমোনের প্রভাবে খুব ঘন হয়ে পড়ে, যার ফলে শুক্রাণু সহজে সাঁতরে ডিম্বাণুর কাছে পৌঁছতে পারে না।

৩. যদি কোনো অলৌকিকভাবে শুক্রাণুর সঙ্গে ডিম্বাণুর মিলন ঘটেও যায় (সেক্ষেত্রে অবশ্যই ওভুলেশন হয়েছে ধরেই নিতে হবে), তাহলেও হরমোন গর্ভনিরোধকের উপস্থিতিতে গর্ভসঞ্চার ঘটবে না এজন্যে যে, জরায়ুর দেয়াল, যেখানে সন্তান বেড়ে উঠবে, তা এই হরমোনের প্রভাবে যথেষ্ট মাংসল ভারী ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে না সন্তান ধারণের সামর্থ্য অর্জন করার জন্যে।

৪. পিল বা হরমোনজাতীয় গর্ভনিরোধক সামগ্রীর উপস্থিতিতে ফেলোপিয়ান টিউব ঠিকমতো কাজ করে না। ফেলোপিয়ান টিউব হলো সেই দুটি টিউব, যার মধ্য দিয়ে ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু জরায়ুতে এসে থাকে। গর্ভনিরোধক হরমোনের প্রভাবে এই টিউব স্বাভাবিকভাবে নড়াচড়া করতে পারে না। ফলে ডিম্বাণু যদি নির্গত হয়ও ডিম্বাশয় থেকে, তা শুক্রাণুর সঙ্গে মেলার তেমন সুযোগ পায় না।

গতানুগতিক দৈনন্দিন জন্মনিয়ন্ত্রণ-বড়ি ছাড়াও আজকাল বাজারে হরমোনের তৈরি বিভিন্ন রকম জন্মনিয়ন্ত্রণ-পদ্ধতি পাওয়া যাচ্ছে। এগুলো সবই মেয়েদের জন্যে তৈরি। কোনো কোনোটি মেয়েরা নিজেরাই নিতে পারে, কোনোটার জন্যে লাগে স্বাস্থ্যকর্মী বা ডাক্তারের সাহায্য। আবার সব পদ্ধতি সকল দেশে পাওয়া না-ও যেতে পারে, অথবা অনুমোদিত না-ও হতে পারে। এসকল পদ্ধতিই মেয়েদের শরীরের স্বাভাবিক হরমোনের ওঠানামা বিঘ্নিত করে। ফলে এ-ধরনের পদ্ধতি ব্যবহারের আগে ডাক্তারের পরামর্শমতো এর উপযোগিতা এবং গ্রহণযোগ্যতা যাচাই করে নেওয়া একান্তই প্রয়োজন। নিচে এমনি কয়েকটি পিলের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো।

মিনি পিল : মিনি পিল বলতে সাধারণত প্রজেস্টারোন-সমেত জন্মনিয়ন্ত্রণ-বড়ির কথা বোঝায়। এ-ধরনের বড়িতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এস্ট্রোজেন থাকে না এবং যে- স্বল্পপরিমাণ প্রজেস্টারোন থাকে, তা জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্যে কোনোমতে যথেষ্ট। এ-বড়ি দুগ্ধদানকারী মায়েদের জন্যে বিশেষ উপযোগী। এস্ট্রোজেনের মতো প্রজেস্টারোন দুধ শুকিয়ে দেয় না, যার ফলে দুধের পরিমাণ এবং গুণগত মান প্রায় অপরিবর্তিত থাকে। যেসব মহিলা এস্ট্রোজেনের প্রতি স্পর্শকাতর, অথবা যাদের কোনো কারণে এস্ট্রোজেন গ্রহণ করা বারণ, তারা এই মিনি পিল বেছে নিতে পারেন। এর কার্যকারিতা গতানুগতিক জন্মনিরোধ-বড়ির চাইতে খানিকটা কম (৯৭%)। তবে যেহেতু দুগ্ধদানকারী মায়েরা প্রাকৃতিক উপায়েও জন্মনিরোধের সুযোগ পান খানিকটা, সেহেতু সার্বিকভাবে ‘মিনি পিলে’র কার্যকারিতা প্রসবোত্তীর্ণ সময়ে খুব কম নয়। এই পিলের প্রধান সমস্যা মাঝে-মধ্যে অসময়ে মাসিকের মতো, কিন্তু পরিমাণে কম, রক্তক্ষরণ। শুধু প্রজেস্টারোন-সমেত ‘মিনি পিল’ ছাড়াও কৃত্রিম উপায়ে তৈরি (সিনথেটিক) অল্প পরিমাণের এস্ট্রোজেনসহ (৩০-৪০ মিলিগ্রাম) এক ধরনের প্রজেস্টারোনের ‘মিনি পিল’ও পাওয়া যায় বাজারে। ‘মিনি পিল’ ব্যবহারকারীদের মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধার অসুখ (ব্লাড ক্লট), মাইগ্রেইন মাথাধরা বা ওজন বৃদ্ধির প্রকোপ অনেক কম গতানুগতিক জন্মনিয়ন্ত্রণ-বড়ি ব্যবহারকারীদের তুলনায়। এর কারণ এস্ট্রোজেনের অনুপস্থিতি বা স্বল্পমাত্রার এস্ট্রোজেনের উপস্থিতি।

একটানা পিল : ইদানীং কোনো কোনো দেশে আরেক রকম জন্মনিয়ন্ত্রণ-বড়ি বেরিয়েছে, যা খেলে মেয়েদের বছরে মাত্র চার বার মাসিক হবে। এ-বড়ির উপাদান গতানুগতিক জন্মনিয়ন্ত্রণ-বড়ির মতোই। তবে প্রতি মাসের শেষদিকে হরমোনবিহীন চিনির বা ভিটামিনের যে-সাতটি পিল থাকে, তা এখানে অনুপস্থিত। তার বদলে এগারো সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন এস্ট্রোজেন-প্রজেস্টারোনসহ জন্মনিরোধ-বড়ি খেয়ে যেতে হবে। গতানুগতিক জন্মনিয়ন্ত্রণ-বড়ির বেলায় মেয়েরা পরপর ২১ দিন হরমোন-বড়ি খায়। তারপর সাত দিন খায় চিনি বা ভিটামিনের বড়ি, যার ভেতর কোনো হরমোন থাকে না। আর এই শেষোক্ত বড়ি খাবার সময়েই হরমোনের অভাবে জরায়ুর গায়ে বেড়ে-ওঠা মাংসল দেয়াল ভেঙে পড়ে এবং মাসিকের আবির্ভাব ঘটে। দীর্ঘমেয়াদি জন্মনিরোধ-বড়ির বেলায় যেহেতু এগারো সপ্তাহ ধরে হরমোনসহ জন্মনিয়ন্ত্রণ-বড়ি খেয়ে যেতে হবে, এই পুরো সময়টায় ব্যবহারকারীর কোনো মাসিক হবে না। এগারো সপ্তাহ পরে এক সপ্তাহ হরমোনবিহীন চিনির বড়ি বা ভিটামিন বড়ি খাবেন তাঁরা, যখন মাসিক হবে। এখন প্রশ্ন এবং দুশ্চিন্তা হলো, বারো মাসে তেরো বারের বদলে এই চার বার মাসিক কি স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর? আমেরিকার ইস্টার্ন ভার্জিনিয়া মেডিক্যাল স্কুলে ১৮ থেকে ৪০ বছরের মহিলাদের ওপর গবেষণা করে দেখা গেছে, একটানা পিলের কার্যকারিতা যেমন গতানুগতিক পিলের মতোই প্রায় এক শ ভাগ নির্ভরযোগ্য, তেমনি স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও এই দুই পিলের ভেতর একটার চেয়ে আরেকটা বেশি নিরাপদ বা ঝুঁকিপূর্ণ নয়। অর্থাৎ রক্ত জমাটবাঁধা বা স্ট্রোকের যে-বাড়তি কিছুটা সম্ভাবনা জন্মনিয়ন্ত্রণ-বড়ির সঙ্গে সম্পৃক্ত, এই একটানা বড়িতেও একইরকম সম্ভাবনা রয়েছে। তবে যেহেতু এই বড়ির প্রচলন বাজারে নেহাতই নতুন, এর দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া এখনো জানার সুযোগ হয় নি। প্রতি মাসে মাসিকের উৎপাতে যাঁরা বড়ই বিব্রত, তেমন অনেক মহিলা এই ধরনের বড়িকে (আমেরিকা-বাজারে ‘সিজনাল’ বলে খ্যাত) স্বাগত জানিয়েছে। যেসব নারী মাসিকের সময়ে বিশেষভাবে শারীরিক অস্বাচ্ছন্দ্য ও তীব্র ব্যথার শিকার হন, তাঁদের জন্যে এ-ব্যবস্থা গ্রহণে ডাক্তাররা নিজেরাই ইদানীং উৎসাহ দিচ্ছেন। তাছাড়া বিজ্ঞানীরা এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, প্রাকৃতিক উপায়ে যে- মাসিক হয় মেয়েদের, যা একটা ঋতুচক্রের পুনরাবৃত্তি এবং শরীরে কতকগুলো হরমোনের বিশেষ নমুনায় ওঠানামার ফল, জন্মনিয়ন্ত্রণ-বড়ি ব্যবহারকারী মেয়েদের মাসিকের সঙ্গে তার তুলনা চলে না। যেসব মেয়ে হরমোনজাতীয় জন্মনিয়ন্ত্রণের ওষুধ খান, তাঁদের এস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টারোনের ওঠানামা তেমন ঘটে না মাসের বিভিন্ন সময়ে। কৃত্রিম উপায়ে পুরো মাসেই প্রায় একইরকম মাত্রায় সেসব হরমোন থেকে যায় রক্তে (অবশ্য ইদানীং এমনও কিছু জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি আবিষ্কৃত হয়েছে, যা মাসের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাত্রার হরমোন সরবরাহ করে নারীদেহে)। ফলে স্বাভাবিক ঋতুচক্রের মাঝামাঝি সময়ে যে-ওভুলেশন (ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণুর বেরিয়ে আসা) ঘটে মেয়েদের শরীরে, হরমোন-জন্মনিয়ন্ত্রণ-বড়ি খেলে সেই ওভুলেশন ঘটে না। তাই মাস শেষে পিল ব্যবহারকারী মেয়েদের যে-রক্তপাত ঘটে, তা ডিম্বাণুর সঙ্গে শুক্রাণুর মিলনের ব্যর্থতায় ‘জরায়ুর কান্না’ বা ভ্রূণের অনুপস্থিতিতে পুষ্ট জরায়ুর ঝরে-পড়া নয়। কৃত্রিম উপায়ে হঠাৎ হরমোন বন্ধ করে দেওয়ায় প্রজেস্টারোনের অভাবে জরায়ুর দেয়াল ভেঙে পড়ে কেবল। আর তাই, কোনো কোনো বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকের মত এই কৃত্রিম রক্তপাত বছরে তেরোবার না চার বার হলো, তাতে হয়তো তেমন কিছু আসে যায় না। কেবল মানসিক স্বস্তি তৈরি করা অথবা সবকিছু স্বাভাবিক আছে বলে এক ধরনের নিশ্চয়তা ও নিরাপদ বোধের জন্ম দেওয়া ছাড়া, জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি ব্যবহারকারীদের মাস শেষের নির্ধারিত মাসিকের সঙ্গে প্রাকৃতিক মাসিকের খুব বেশি মিল নেই। এছাড়া যারা খেলোয়াড়, নৃত্যশিল্পী, পর্যটক, কিংবা যাদের ধর্মীয় বা পেশাগত কারণে যাত্ৰা অনিবাৰ্য, তাদের ক্ষেত্রে এই একটানা জন্মনিরোধ-বড়ি বেশ সুবিধাজনক বলে বিবেচিত হতে পারে বলে অনেকের ধারণা। এছাড়া কোনো কোনো গবেষক ইদানীং এমন প্রশ্নও করতে শুরু করেছেন যে, মেয়েদের প্রতি মাসে মাসিক হবার কোনো বৈজ্ঞানিক যৌক্তিকতা রয়েছে কিনা। কোনো কোনো বিজ্ঞানী এমনও দেখিয়েছেন যে, সারা জীবন ধরে ঘটে যাওয়া মোট মাসিকের সংখ্যার সঙ্গে কোনো কোনো ক্যান্সার, বিশেষ করে স্তনের ক্যান্সারের একটা যোগাযোগ রয়েছে। তাঁরা দেখিয়েছেন উন্নত দেশের মেয়েদের, যাঁদের প্রথম মাসিক হয় কম বয়সে, কিন্তু রজঃনিবৃত্তি ঘটে বেশি বয়সে, যাঁরা নিঃসন্তান, এক বা দুই সন্তানের জননী, যাঁরা দীর্ঘদিন সন্তানকে স্তন্যদান করেন না, তাঁদের তুলনায় উপজাতীয় অথবা অনুন্নত দেশের নারীদের মোট মাসিকের সংখ্যা অনেক কম। শেষোক্ত নারীদের প্রথম মাসিক দেরিতে আসে এবং মাসিক বন্ধও হয় অপেক্ষাকৃত আগে (এর সঙ্গে তাদের পুষ্টির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক)। এছাড়া বহু সন্তানের জননী হওয়ায় এবং সন্তানদের দীর্ঘদিন স্তন্যদান করায় তাঁদের জীবনে মাসিকের সংখ্যা স্বাভাবিকভাবেই কম হয়। আর এইসব নারীর, যাঁদের মাসিকের সংখ্যা কম, তাঁদের মধ্যে স্তনের ক্যান্সারের প্রকোপও কম দেখা যায়। এর আগেও অনুরূপ গবেষণায় দেখা গেছে যে, যৌনসচল ও জননীদের তুলনায়, চিরকুমারীদের (যেমন নানা সন্ন্যাসিনী) মধ্যে স্তনের ক্যান্সারের আধিক্য রয়েছে। এ-ব্যাপারে বহু অনুসন্ধানের পর বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা হলো, প্রতিটি ওভুলেশনের (যার পরিণতিতে মাসিক স্রাব হয়) সময়, প্রচুর এস্ট্রোজেন তৈরি হয় ডিম্বাশয়ে। আর রক্তে এই অতিমাত্রার এস্ট্রোজেনের উপস্থিতিই স্তন-ক্যান্সারের আধিক্যের কারণ।

মাসিক বিহীন পিল (লাইব্রেল) : অবশেষে ২০০৭ সালের মে মাসে এসেছে বাজারে সেই পিল যা খেলে শুধু জন্মনিয়ন্ত্রণই হবে না, মাসিকও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। ওয়াইয়েন্স ফার্মাসিউটিক্যালস বাজারজাত করেছে এ অভিনব পিলটি। এই পিলে অতি অল্পমাত্রায় এস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টাবোন থাকে এবং তা প্রতিদিন খেতে হয়। এফডিএ ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে এ পিলকে। যেসব মেয়েরা মাসিকজনিত যন্ত্রণা ও নানাবিধ অসুখে ভুগছে, তাদের জন্যে এ পিল বেশ উপকারী। এছাড়া এমন মহিলার সংখ্যাও নগণ্য নয়, যারা কর্মোপলক্ষে, অথবা জীবনযাত্রার কারণে মাসিকের মোকাবিলা করতে চান না। অনেকে অবশ্য মাসিকহীনতাকে অস্বাভাবিক বা অপ্রাকৃতিক ভেবে এই পিলকে অগ্রাহ্য, নাকচ বা পরিত্যাগ করতে পারেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, গতানুগতিক পিল খাবার পর মাস শেষে যে মাসিকের মতো রক্তপাত হয়, সেটা প্রাকৃতিক মাসিকের সঙ্গে কোনোভাবেই তুলনীয় নয়। প্রাকৃতিক মাসিক হয়, ওভুলেশনের (ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণুর নির্গমন) পর শুক্রাণুর সঙ্গে ডিম্বাণু। মলে ভ্রুণের জন্ম দিতে না পরার কারণে জরায়ুর পর্দা ছিড়ে রক্তপাত। আর আঠাশ দিন হরমোন পিল খাবার পর কয়েকদিন হরমোন পিলের বিরতি দেওয়ায় break through রক্তপাত হয়। সেটা প্রাকৃতিক মাসিক নয়। ফলে শিক্ষিত নারীরা আজ অনেকেই ভাবে, এই অস্বাভাবিক নকল মাসিকের আসলেই কোনো প্রয়োজন রয়েছে কি না নারী জীবনে। অযথা অসুবিধে, অস্বস্তি ও হয়রানি থেকে কেউ কেউ মুক্তি চায়, মাসিকজনিত যন্ত্রণা বা বিশেষ অসুবিধা না থাকলেও। জগত হবে প্রায় আড়াই হাজার নারীর ওপর গবেষণা করে দেখা গিয়েছে যে কিছু বিচ্ছিন্ন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া ছাড়া গতানুগতিক পিলের সঙ্গে লাইব্রেল সব ব্যাপারেই তুলনীয়। তবে যেহেতু বাজারে সদ্য এসেছে, আরো অনেক বছর লাগবে জানতে ও বুঝতে যে দীর্ঘ এ ব্যবহারেও পিল পুরোপুরি নিরুদ্ধে ও কার্যকরী কি না।

পরদিন সকালের পিল বা প্ল্যান-বি পিল : নামটা যদিও ‘পরদিন সকালের পিল’ অথবা ‘মর্নিং আফটার পিল’, এর মানে এই নয় যে, যৌনমিলনের পরদিন সকালেই এটা খাওয়া জরুরি। এই পিলের আবিষ্কার হয়েছে এই কারণে যে, কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে অথবা আবেগের তাড়নায় কোনোরকম জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রস্তুতি ছাড়া যৌনমিলন ঘটে গেলেই যাতে অনিবার্যভাবে গর্ভধারণকে মেনে নিতে না হয়। যৌনমিলনের তিন দিনের মধ্যেই এই বড়ি খেতে হবে, যাতে গর্ভসঞ্চার না ঘটে। পরদিন সকালের পিলে খুব বেশিমাত্রার এস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টারোন থাকে, যা গর্ভধারণের উপযোগী নয়। যেহেতু এটি একটি জরুরি ব্যবস্থা মাত্র এবং মাত্রাতিরিক্ত হরমোন দিয়ে তৈরি, এ-বড়ি খেয়ে নিয়মিত গর্ভনিরোধ করার কথা ভাবা একান্তই অনুচিত। কোনো কোনো দেশে এ-বড়ি ‘জরুরি জন্মনিয়ন্ত্রণ-বড়ি’ বলেও পরিচিত। নিউইয়র্কের পমোনা শহরের বার ল্যাবরেটরিতে তৈরি ‘প্ল্যান-বি’ বলে খ্যাত এই ওষুধ আমেরিকায় আজ যত বিতর্কের সূচনা করেছে, কম ওষুধই তা করেছে। এর প্রধান কারণ ‘প্ল্যান-বি’ বা ‘পরদিন সকালের পিলকে প্রেসক্রিপশনের আওতা থেকে বের করে নিয়ে খোলাবাজারে বিক্রি করার অনুমতি নিয়ে মতানৈক্য। আমেরিকার ওষুধ-নিয়ন্ত্রক এফডিএ-র কিছু বিজ্ঞান-বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা মত দিয়েছিলেন যে, এই ওষুধ যথেষ্ট নিরাপদ এবং যেহেতু এটি জরুরি অবস্থায় নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে গ্রহণ করা আবশ্যক, একে সহজলভ্য করার জন্যে প্রেসক্রিপশনের বাধ্যবাধকতার বাইরে রাখা প্রয়োজন। তাঁরা মনে করেন, এই জরুরি পিল সহজলভ্য হলে গর্ভপাতের প্রয়োজনীয়তা ও মোট সংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণে কমে যাবে। অন্য উপদেষ্টাদের মতে, এই ওষুধের জন্যে প্রেসক্রিপশনের প্রয়োজন না-হলে, এর যথেচ্ছ ব্যবহার শুরু হয়ে যাবে, বিশেষ করে কিশোরীদের মধ্যে, যারা অপরিকল্পিতভাবে অথবা অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রায়শই তাৎক্ষণিকভাবে যৌনকর্মে লিপ্ত হয়। এই বিতর্কের সূত্র ধরে সম্প্রতি এফডিএ-র এক কর্মকর্তা পদত্যাগ করেছেন, যিনি ‘প্ল্যান-বি’কে প্রেসক্রিপশনের বাইরে রাখার কট্টর সমর্থক ছিলেন। ‘প্ল্যান-বি’ এই নামটাই প্ৰমাণ করে, এই পদ্ধতি সাধারণ এবং সবসময় ব্যবহারের উপযোগী কোনো পদ্ধতি নয়। ‘প্ল্যান-এ’ বা প্রাথমিক পদ্ধতি কোনো কারণে ব্যর্থ হলে, তা তাড়াহুড়ো বা যৌনতাড়নায় কাতর হয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করার জন্যেই হোক, অথবা কনডম ফেটে যাবার জন্যেই হোক, কিংবা ধর্ষণ বা ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মধ্যে অননুমোদিত যৌন- সম্পর্কের (ইনসেস্ট) কারণেই হোক, ‘প্ল্যান-বি’ হলো দ্বিতীয় পর্যায়ের বা শেষ সম্বল জন্মনিয়ন্ত্রক, যা কেবল জরুরি অবস্থার জন্যে প্রযোজ্য।

আমেরিকার মতো দেশে যেখানে গতানুগতিক জন্মনিয়ন্ত্রণ-বড়ি এখনো প্রেসক্রিপশনের আওতায়, সেখানে এত বেশিমাত্রার হরমোনসহ ওষুধ খোলা কাউন্টারে বিক্রির জন্যে অনুমতি দেওয়া কতটা যুক্তিপূর্ণ, তা ভাবার বিষয়। এ-অনুমতি অল্পবয়েসি মেয়েদের শরীর ও মনের ওপর একটা বাড়তি চাপ প্রয়োগ করবে বলে অনেকের ধারণা। এই বয়সে, বিশেষ করে পাশ্চাত্যে, নারীদের ওপর সবসময়েই একটা চাপ থাকে পুরুষের আগ্রহ-অনুসারে যৌন-সম্পর্ক স্থাপন করার জন্যে। সম্ভাব্য গর্ভসঞ্চারের ভীতি এবং সময়মতো গর্ভনিরোধ-সামগ্রীর অপ্রতুলতা এই দাবিকে সবসময় না মানার পক্ষে কাজ করে। তাছাড়া কনডম ব্যবহারে অনিচ্ছুক, প্রচণ্ড হরমোন-তাড়িত যৌনসম্ভোগে আকুল কিশোররা ‘প্ল্যান-বি’র প্রতুলতা টের পেলে মেয়েদের ওপর মানসিক বোঝা চাপিয়ে দেবে এই বলে যে, রক্ষাকবচ হিসেবে ‘পরদিন সকালের পিল’ তো রয়েই গিয়েছে। তাছাড়া কনডম ব্যবহারে পুরুষকে বাধ্য করা, তার যৌনাচারের (একগামিতার) প্রতি অবিশ্বাস বা কটাক্ষ বলেও তারা খোঁটা দিতে শুরু করবে। এর ফলে এইচআইভি ও এইডসের যুগে যখন কনডম ব্যবহার একান্ত জরুরি, ‘প্ল্যান-বি’ হয়তো তার বিরুদ্ধশক্তি হিসেবে কাজ করবে। কিশোরীদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে ও মাত্রাতিরিক্ত হরমোন থেকে তাদের রক্ষা করার উপায় হিসেবে ওষুধটির বিক্রির নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতির ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন কেউ কেউ। যেমন সতেরো বছরের নিচে ছেলে বা মেয়ের কাছে এ-ওষুধ বিক্রি না করা। অথবা কাউন্টারের পেছনে ফার্মাসিস্টদের আওতায় ওষুধটি রাখা, যাতে গ্রাহককে এসে তা চাইতে হয়। যদিও পরদিন সকালের এই পিলকে যথেষ্ট নিরাপদ বলা হচ্ছে, এটা এখনো ভালোমতো জানা যায়নি—কোনো কারণে গর্ভরোধ করতে ব্যর্থ হলে, এই পিলের প্রভাবে গর্ভজাত সন্তানের কোনো ক্ষতি হবে কি না। প্রায় তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে আরেকরকম ‘পরদিন সকালের পিল’ খেয়ে যে-মহিলারা গর্ভরোধে ব্যর্থ হয়ে সন্তান প্রসব করেছেন, তাদের সন্তানদের কেউ কেউ বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মেছে, কারো-বা পরবর্তীকালে ক্যান্সারসহ অন্যান্য জটিলতা দেখা দিয়েছে। ‘প্ল্যান-বি’তে সাধারণত দুটো বড়ি খেতে হয়। যৌনমিলনের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তা খেতে হয়, তবে যত তাড়াতাড়ি তা খাওয়া সম্ভব, তত বেশি কার্যকর হয় তা। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে খেতে পারলে সবচেয়ে ভালো। ‘প্ল্যান-বি’ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম ‘পরদিন সকালের পিল’ পাওয়া যায়। আমেরিকার অঙ্গরাজ্যগুলোর নিয়ম-কানুন যেহেতু সবসময় কেন্দ্রীয় নিয়ম দিয়ে পরিচালিত হয় না, এফডিএ প্রাথমিক পর্যায়ে অনুমতি না দিলেও সাতটি অঙ্গরাজ্যে অনেক আগেই এই ওষুধ প্রেসক্রিপশনবিহীন বিক্রির ছাড়পত্র পেয়েছে। এখন অবশ্য এফডিএও অনুমতি দিয়েছে। তবে তা সতের বছরের অনুর্ধদের জন্যে নয়। গতানুগতিক জন্মনিয়ন্ত্রণ-বড়ি যেভাবে কাজ করে, ‘পরদিন সকালের বড়ি’ও সেভাবেই কাজ করে। বিশেষ করে এই বড়ি শুক্রাণুর সঙ্গে ডিম্বাণুর মিলনে সৃষ্ট ভ্রূণের বেড়ে-ওঠার জন্যে আবশ্যক জরায়ুতে বিদ্ধ হওয়াতে বাধা দেয়। গর্ভধারণ হয়ে যাবার পর এ-বড়ি ব্যবহার করলে তা আর কার্যকর হয় না।

গর্ভপাতের পিল (যেমন আরইউ ৪৮৬) : এ-ধরনের ওষুধে সাধারণত দু রকম বড়ি থাকে, যা গর্ভসঞ্চারের পর আট সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভপাত করতে সক্ষম। প্রজেস্টারোন-বিরোধী প্রথম বড়িটি (মিনি প্রিস্টোন) খাবার পর তা শরীরের প্রজেস্টারোন হরমোনের কার্যাবলি প্রতিরোধ করে। প্রজেস্টারোন হলো সেই হরমোন, যা গর্ভসঞ্চার হলে জরায়ুকে যথেষ্ট পরিমাণে মাংসাল ও শক্তিশালী করে তোলে, যাতে সেখানে শিশুটি সুস্থভাবে বেড়ে উঠতে পারে। প্রজেস্টারোনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কারণে প্রথম পিলটি খাবার পর জরায়ুর দেয়াল ও বাঁধন ভেঙে পড়তে শুরু করে। এই বড়ি খাবার দেড় থেকে দু দিনের মধ্যে অন্য আরেকটি বড়িকে (মিসোপ্রোস্টল) যোনির ভেতর প্রবেশ করাতে হয়, যেটা প্রস্টাগ্লেন্ডিন জাতীয় হরমোন। এ-বড়ি জরায়ুর সঙ্কোচন (কন্ট্রাকশন) বাড়িয়ে দেয় এবং ভ্রূণকে জরায়ু থেকে উৎখাত করে। গর্ভপাতের বড়ি সবসময় ডাক্তারের পরামর্শে ও তত্ত্বাবধানে গ্রহণ করতে হয়। কেননা, কোনো কারণে (যার সম্ভাবনা খুবই কম) পুরো গর্ভপাত যদি না ঘটে, তাহলে এ-বড়ির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে যেতে পারে গর্ভজাত সন্তানের ওপর। সেক্ষেত্রে এ ব্যর্থ রাসায়নিক গর্ভপাতকে অপারেশনের মাধ্যমে কার্যকরী করে তুলতে হবে। এছাড়া গর্ভপাতের বড়ি খেলে অনিয়ন্ত্রিত ও প্রবল রক্তপাতের সম্ভাবনা থাকে, যার ফলে মেয়েদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। ফলে কোনোভাবেই এ-ওষুধ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধান ব্যতীত গ্রহণ করা উচিত নয়।

সপ্তাহে একদিন পিল (যেমন আর ২৩২৩) : সপ্তাহে একদিন ৫ মিলিগ্রাম সিনথেটিক প্রজেস্টারোন হরমোন পিল খেয়ে গর্ভনিরোধ সম্ভব। জন্মনিরোধে এর উপযোগিতা যাচাই করা ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে, কিন্তু এই পিলের অন্যান্য প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া যাচাই করা এখনো শেষ হয়নি। সুস্থ আটাশ জন নারীর শরীরে মোট ১৩৮ ঋতুচক্রের জন্যে এই ওষুধ ব্যবহার করে দেখা গেছে যে, এসময় কোনো গর্ভসঞ্চার হয়নি। প্রধান উপসর্গ হলো অনিয়মিত রক্তস্রাব, মাথাধরা ও ওজন বৃদ্ধি। অন্য একটি গবেষণায় চুয়াল্লিশজন নারীর দেহে এটি প্রয়োগ করে দেখা গেছে, রক্তে সুগার, কোলেস্টরল বা ট্রাই-গ্লিসারাইডের পরিমাণও বাড়ায় না এই ওষুধ। প্রতিদিনের বদলে সপ্তাহে একদিন জন্মনিয়ন্ত্রণ-বড়ি গ্রহণ করার সম্ভাবনাকে অনেক নারীই স্বাগত জানিয়েছেন।

সেন্টক্রোমেন : সপ্তাহে একদিন হরমোনবিহীন পিল : ভারতের সেন্ট্রাল ড্রাগ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (লখনৌ) আবিষ্কৃত সেন্টক্রোমেন ‘সাহেলী’ ও ‘সেন্ট্ৰন’ ট্ৰেড নামে ভারতে বাজারজাত। সেন্টক্রোমেন এস্ট্রোজেন বা প্রজেস্টারোনের মতো কোনো স্টেরয়েড হরমোন দিয়ে তৈরি নয়। এটি একটি সিনথেটিক রাসায়নিক পদার্থ, যেটির রাসায়নিক আকৃতি কিছুটা স্টেরয়েড হরমোনের মতো। সেন্টক্রোমেন ওভুলেশন বন্ধ করে না। কিন্তু ভ্রূণের জরায়ুতে বিদ্ধ হওয়া ও তার বেড়ে-ওঠা রোধ করে। তিরিশ মিলিগ্রাম সেন্টক্রোমেন প্রাথমিকভাবে সপ্তাহে দু দিন এবং পরে সপ্তাহে কেবল একবার গর্ভনিরোধের জন্যে যথেষ্ট। অসময়োচিত মাসিক বা কখনো কখনো ফোঁটা ফোঁটা রক্তপাত ছাড়া অন্য কোনো জটিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সাধারণত হয় না সেন্টক্রোমেন ব্যবহারের ফলে।

হরমোনজাতীয় জন্মনিয়ন্ত্রণের ওষুধ মুখে খাবার বড়ি দিয়ে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। প্রতিদিন মনে করে পিল খাবার বিড়ম্বনা এড়াতে, মুখে ওষুধ গ্রহণ করার আপত্তিতে, খরচ কমাতে অথবা জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে, আজ বাজারে ‘পিল’ ছাড়াও বিভিন্নরকম হরমোনের তৈরি জন্মনিয়ন্ত্রণ-পদ্ধতি পাওয়া যায়। নিচে সংক্ষেপে সেসব কয়েকটির কথা উল্লেখ করা হলো-

এক. প্রজেস্টারোন ইনজেশকন (ডেপোপ্রভেরা) : ডেপোপ্রভেরা বলে খ্যাত সিনথেটিক প্রজেস্টারোন দিয়ে তৈরি জন্মনিয়ন্ত্রণের ইনজেকশন দীর্ঘমেয়াদি জন্মনিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। অনিয়মিতভাবে অল্প অল্প রক্তপাত এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। এছাড়াও বেশকিছু অসুবিধার কথা উল্লেখ করেন কোনো কোনো ডেপোপ্রভেরার গ্রহীতারা। তিন মাসে একটি করে ইনজেকশন জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্যে যথেষ্ট এ-পদ্ধতিতে।

দুই. চামড়ার নিচে দীর্ঘমেয়াদি জন্মনিয়ন্ত্রণের ক্যাপসুল (নরপ্ল্যান্ট) : এই পদ্ধতিতে হরমোনের জন্মনিয়ন্ত্রক ওষুধ চামড়ার নিচে ছয়টি ছোট ছোট ম্যাচের কাঠির মতো ক্যাপসুলের মাধ্যমে শরীরে সরবরাহ করা হতো। স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত কোনো ডাক্তার বা বিশেষজ্ঞরা অপারেশনের মাধ্যমে এটিকে চামড়ার নিচে বসিয়ে দিতেন। এই ক্যাপসুল বা পাম্প থেকে অল্পমাত্রায় হরমোন অবিরত বেরিয়ে আসত আপনাআপনি। ফলে গ্রহীতার নিজের কিছু করতে হয়নি। তবে নরপ্ল্যান্ট ব্যবহারের সঙ্গে অনিয়মিত মাসিকসহ বেশকিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সংশ্লিষ্টতা আবিষ্কৃত হয়েছে। নরপ্ল্যান্ট ক্রমাগত পাঁচ বছর ধরে কাজ করে যেতে সক্ষম। তবে এই পদ্ধতি বর্তমানে আর বাজারজাত করা হয় না। পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হবার পর অন্য পদ্ধতি বেছে নিতে হচ্ছে। তবে নরপ্ল্যান্টের পরিবর্তে বাজারে এসেছে এখন ছয়টির বদলে একটি ম্যাচের কাটির মতো চামড়ার নিচের ক্যাপসুল, যা তিন বছর পর্যন্ত কার্যকরী।

তিন. হরমোন-সমেত আইইউডি অথবা যোনি-রিং : হরমোন-সমেত আইইউডি ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে জরায়ুতে স্থাপন করে জন্মনিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অন্যদিকে হরমোনসহ যোনির রিং নিজে নিজেই ব্যবহার করা চলে। শরীরের ভেতরে ব্যবহারযোগ্য এই দুইরকম জিনিসই বাজারে পাওয়া যায়। যোনির রিং তিন সপ্তাহ পর বের করে নিতে হয়, আবার মাসিকের পর নতুন একটি ঢোকাতে হয়। হরমোন-সমেত আইইউডি কয়েক বছর ধরে কাজ করতে পারে।

চার. হরমোনের প্যাচ : (অর্থোএভরা) এস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টারোনের তৈরি চামড়ার ওপরে ব্যবহারযোগ্য একরকম প্যাচ আবিষ্কৃত হয়েছে, যা মেয়েরা শরীরের যে-কোনো জায়গায় চামড়ার ওপর বসিয়ে গর্ভনিরোধ করতে পারেন। সপ্তাহে মাত্র একবার প্রায় দুই ইঞ্চি দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের ছোট্ট কাপড়ের টুকরোর মতো প্যাচটি চামড়ার ওপর বসিয়ে রাখতে হবে। প্যাচের পেছনে আঠার মতো পদার্থ থাকে, যা প্যাচটিকে শরীরের সঙ্গে আটকে রাখে। স্নান করা, সাঁতার কাটা, খেলাধুলাসহ প্রাত্যহিক স্বাভাবিক কাজকর্মে কোনো কিছুতেই বাধা নেই। প্যাচ থেকে হরমোন আস্তে আস্তে বেরিয়ে চামড়ার ভেতর দিয়ে শরীরে প্রবেশ করে। এক সপ্তাহ পরে পুরনো প্যাচটি ফেলে দিয়ে একটি নতুন প্যাচ বসাতে হয়। পরপর তিন সপ্তাহ প্যাচ ব্যবহার করার পর এক সপ্তাহ প্যাচ ব্যবহার করা হয় না, যার ফলে তখন মাসিক হয়। খাবার বড়ি যোনি-রিং ছাড়া এটাই একমাত্র বাজারজাতকৃত হরমোন তৈরির জন্মনিয়ন্ত্রণ-পদ্ধতি, যেটা মেয়েরা নিজেরা ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। চামড়া থেকে তোলার সময় সামান্য ব্যথা পাওয়া ও জন্মনিয়ন্ত্রণ- বড়ির অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া প্যাচের বিশেষ কোনো অসুবিধার কথা জানা যায় না।

পাঁচ. হরমোনের স্প্রে ও জেল : এখনো বাজারে আসেনি, কিন্তু গবেষণা করে সফল ফল পাওয়া গেছে এমন হরমোনের তৈরি জন্মনিয়ন্ত্রণ-পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে স্প্রে ও জেল। ইনহেলার পাম্পের মতো হরমোন স্প্রে করে, অথবা হরমোনের তৈরি ক্রিম বা জেলি ত্বকের ওপর প্রয়োগ করে জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্ভব। এই পদ্ধতি খুব শীঘ্রই বাজারজাত করবে অস্ট্রেলিয়ান একটি কোম্পানি।

জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্যে ব্যবহৃত গতানুগতিক হরমোন ‘পিল’ ছাড়াও হরমোনভিত্তিক যে- সকল বড়ি ও অন্যান্য উপকরণ বাজারে চালু রয়েছে বা শীঘ্রই চালু হতে যাচ্ছে, তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো ওপরে। এগুলোর প্রধান সমস্যা ও সুবিধাগুলো সম্পর্কেও সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে। তবে এ-রচনায় কোনো একটি বিশেষ পদ্ধতির প্রতি সমর্থন যেমন দেখানো হয়নি, মানগত দিক দিয়ে কোনো বিশেষ পদ্ধতি যে অন্য পদ্ধতির চাইতে উন্নততর, এমন কথাও বলা হয়নি। প্রচলিত ও আশু সম্ভাবনাময় সকল হরমোনভিত্তিক জন্মনিরোধকেরই উল্লেখ করা হয়েছে, যাতে কেউ যদি ইচ্ছা করে, তাহলে পছন্দমতো ও ব্যক্তি-স্বাস্থ্যের সঙ্গে উপযোগী সম্ভাব্য একটিকে বেছে নিতে পারে। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গিয়েছে, যখনই কোনো জন্মনিয়ন্ত্রণ-পদ্ধতি কোনো তৃতীয় পক্ষ বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যবহৃত বা নিয়ন্ত্রিত হয়, তখনই অনেক অপব্যবহার ঘটে এবং অনেক সময় জোরজবরদস্তিও চলে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। কোনো একটি বিশেষ পদ্ধতিকে জনপ্রিয় করে তোলার অভিপ্রায়ে অথবা পরিবার পরিকল্পনার টার্গেট রক্ষা করতে ব্যক্তি-নারীর সুবিধা বা স্বাস্থ্যকে অনেক সময় অস্বীকার করা হয়। অন্যদিকে যে-পদ্ধতিগুলো নারীরা নিজে নিজে এবং স্বেচ্ছায় গ্রহণ করতে পারে, যেমন পিল, প্যাচ বা যোনির রিং, সেখানে অপব্যবহার ও জোরাজুরির আশঙ্কা কম থাকে। জন্মনিরোধের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার না করেও বলা যায়, এ-ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার বেলায় নারীকে তার যোগ্য অধিকার ও মর্যাদা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। প্রতিটি পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধা ও ঝুঁকিগুলো খোলাখুলি আলোচনা করে গ্রহীতা ও চিকিৎসকের যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার, কোনটি ব্যক্তি-নারীর জন্যে সবচেয়ে উপযোগী অথবা আদৌ উপযোগী কি না।

নারী-নিয়ন্ত্রিত জন্মনিবারণের পিল আবিষ্কার নিঃসন্দেহে নারী-মুক্তি আন্দোলনকে বেগবান করেছে। নিজের ইচ্ছায়, নিজ গৃহের নিভৃতিতে, কোনো ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মীর সরাসরি হস্তক্ষেপ ব্যতীত খাবার বড়ির মাধ্যমে গর্ভরোধ করার সামর্থ্য অর্জন করে নারী সমাজ নির্ধারিত বেশকিছু সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পেরেছে। নারীর অধিকার আন্দোলনের সুদীর্ঘ পথযাত্রায় ‘পিলে’র আবিষ্কার একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ও বিরাট মাইলফলক, সন্দেহ নেই। কিন্তু এ-কথার মানে এই নয় যে, নারীর স্বাধীনতা অর্জনে ‘পিল’ ছাড়া অন্য সকল আন্দোলন বা অবদানকে কোনোভাবে খাটো করে দেখা যায়। আসলে নারীর স্বাধিকার আন্দোলনের বিবিধ পথ ধরেই তার মন্থর অথচ নিরন্তর অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। এদের কোনোটির ভূমিকাই আরেকটির বিকল্প নয়। আসলে বিভিন্ন সূত্র থেকে উৎসারিত এবং বিভিন্ন দিকে ধাবিত এই সকল আন্দোলনের স্রোত শেষ পর্যন্ত এক জায়গাতেই এসে মিশেছে, একটি মূলধারাকেই প্লাবিত করেছে, যা নারীকে একজন মানুষের সার্বিক অধিকার ও সম্মান অর্জনে সাহায্য করেছে এবং অবিরাম করে যাচ্ছে। নারী-নিয়ন্ত্রিত জন্মনিরোধ-প্রক্রিয়ার আবিষ্কার, পুরুষকে এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেবার অঙ্গীকার নয়। বরং তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় একটি নতুন সংযোজন মাত্র। এইচআইভি ও এইডসের যুগে এই সত্য অবশ্যই ভুলে গেলে চলবে না যে, পিলের মাধ্যমে নারী নিজের হাতে জন্মনিয়ন্ত্রণের ভার গ্রহণ করতে সমর্থ হলেও, এইচআইভি বা এইডস থেকে নিরাপদ থাকতে কনডমের বিকল্প নেই। এইচআইভি-র সংক্রমণ থেকে হরমোন-নিয়ন্ত্রিত কোনো জন্মনিয়ন্ত্রণের উপকরণই কাউকে নিরাপত্তা দেয় না। এছাড়াও, বাইরে থেকে সরবরাহকৃত এইসব হরমোন (যা দিয়ে পিল তৈরি হয়) কোনো কোনো নারীর শরীরে দীর্ঘমেয়াদি বা স্বল্পমেয়াদি কোনো ক্ষতিকর প্রভাব যে ফেলবে না, এ কথাও হলপ করে বলা যাবে না। দীর্ঘকালীন পিল ব্যবহারের সঙ্গে রক্তের জমাটবাঁধা ও স্ট্রোকের প্রকোপ বৃদ্ধির আভাস পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা এ-ব্যাপারে এখনো অনবরত গবেষণা করে যাচ্ছেন। এইসব গবেষণার ফলাফল-অনুযায়ী চিকিৎসক ও গ্রহীতা উভয়ে মিলে যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন, হরমোনজাতীয় জন্মনিয়ন্ত্রণ-পদ্ধতি গ্রহণ করা তার পক্ষে উচিত অথবা উচিত নয় এবং তা গ্রহণীয় হলে কোন বিশেষ ধরনের উপকরণ তার জন্যে বেশি উপযুক্ত। যেহেতু একই ওষুধের প্রতি একইরকমভাবে সকলে প্রতিক্রিয়া করে না, প্রত্যেককেই ভিন্ন ভিন্নভাবে যাচাই ও বাছাই করে দেখতে হবে, কোন বিশেষ পদ্ধতি তার জন্যে সবচেয়ে উপযোগী, আর এ-ব্যাপারে তাকে প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান পরামর্শ দিতে পারেন তার চিকিৎসক অথবা জন্মনিয়ন্ত্রণ-বিশেষজ্ঞ।

একটি গল্প দিয়ে আমার এই লেখা শুরু করেছিলাম। একটি চলচ্চিত্রের খণ্ডাংশ দিয়ে শেষ করছি। বহু বছর আগে তপন সিংহের এক অনবদ্য ছবি দেখেছিলাম। নাম আপনজন। সবটা ছবি মনে নেই, কিন্তু এটুকু মনে আছে, জাগতিক বিচারে সম্পৃক্ত নয় তেমন কিছু অসম চরিত্র, যারা সমাজের বিভিন্ন জায়গা থেকে উঠে এসেছে, যাদের কেউ গৃহজীবী ও বৃদ্ধ, কেউবা জীবনযুদ্ধে বিপন্ন রাস্তায় পোড় খাওয়া যুবক, শেষ পর্যন্ত এক গভীর ও অভিনব মানববন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। বোঝা যায়, আসলে ‘আপনজন’ কারা—যারা আত্মার আত্মীয়, তারাই। জগৎ ও জীবনের বিচারে অর্থাৎ কেবল জন্ম কিংবা বিবাহসূত্রে আবদ্ধ সম্পর্কের মানুষজনই নয়। সেই আপনজন ছবিতে এক বৃদ্ধার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ছায়া দেবী। যতদূর মনে পড়ে, এক অপেক্ষাকৃত তরুণ দম্পতির ঘরে একটি সন্তানের পর বহু বছর আর কোনো সন্তান জন্মগ্রহণ না করায় ছায়া দেবীর প্রশান্ত মন্তব্য ছিল, রামপ্রসাদ বা বিবেকানন্দের নির্দেশানুযায়ী বিবাহের বেশকিছু বছর পর তারা অর্থাৎ এই দম্পতিটি নিশ্চয়ই তাহলে ভাইবোনের মতো জীবনযাপন শুরু করেছেন এখন। সন্তান উৎপাদনে সক্ষম, সুস্থ-সবল তরুণ দম্পতির আরো সন্তান জন্ম না হওয়ার মানে যে কেবল যৌনসম্পর্ক স্থগিত করাই নয়, সেটা সেই সহজ-সরল সেকেলে বৃদ্ধার পক্ষে জানার কথা ছিল না। কেননা, তখন বিবাহিত জীবন ও যৌনসম্ভোগের অনিবার্য পরিণতি যে ক্রমাগত সন্তানলাভ, এ-সত্য প্রায় সকল নারীই মেনে নিত।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক নিয়মে নানান অসামর্থ্য দেখা দেয় শরীরে। হরমোনের মাত্রা কমে যাওয়ায় তখন যৌন-তাড়নাও প্রশমিত হয়ে আসে। যৌন ক্ষমতা হ্রাস পায়। তখন হয়তো-বা দীর্ঘদিনের বিবাহিত স্বামী-স্ত্রী আর তেমন যৌন-সচল থাকেন না। আরো বয়স বাড়লে হয়তো-বা একসঙ্গে বেড়ে-ওঠা সহোদর-সহোদরার মতোই বিস্তীর্ণ জীবনের বহু যৌথ অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে একে অপরের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে অযৌন-জীবনই কাটান অনেকে, যেমনটি আশা করেছিলেন ছায়া দেবী। কিন্তু যতক্ষণ তা না হচ্ছে, যতদিন তারা সন্তান উৎপাদনে সক্ষম, আবার শারীরিক ভালোবাসা উপভোগেও আগ্রহী, ততদিন পিলের মতো জন্মনিয়ন্ত্রণ-সামগ্রীই নারীকে সুযোগ করে দেয় তার যৌন-জীবনকে প্রজননের দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত করতে। তবে এই সুযোগ ও সুবিধাগুলো যাতে স্বাধীনভাবে এবং নিজের পছন্দ ও কল্যাণ-অনুযায়ী তাঁরা বেছে নিতে পারেন, তার নিশ্চয়তা দরকার।

একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, গত দশকে আমাদের সাহিত্য ও শিল্পের প্রধান উপাদান যেখানে ছিল দারিদ্র্য ও বহু-সন্তানময় যৌথ পরিবার, এ-শতকে সেখানে হয়তো কেন্দ্রীয় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হয়েছে নারীর অবস্থানগত সচেতনতা এবং অর্থনীতিতে ও পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণ—– এক কথায় সার্বিকভাবে নারীর ক্ষমতায়ন। ষাটের দশকের আবিষ্কৃত ‘পিলে’র হাত ধরে সারা বিশ্বে যে-বৈচিত্র্যময় জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রী আজ সহজলভ্য হয়েছে, তার সঙ্গে এই নারী- প্রগতির সম্পর্ক কোনোমতেই অস্বীকার করা যাবে না।

অক্টোবর ২০০৫

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *