রজস্বলা নারী

রজস্বলা নারী

একটি জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের আতিথ্যে দেশের বিভিন্ন জেলায়—বেশ কয়েকটি গ্রামে যাবার সুযোগ হয়েছিল আমার। গ্রামীণ মেয়েদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, তাদের সামাজিক সচেতনতা এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের নবঅর্জিত ক্ষমতা দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত গ্রাম্য নারীদের ভেতর এই বিশাল পরিবর্তনের ধারা। শত শত এনজিও, বহু নারী প্রতিষ্ঠান ও সরকার বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে নারীর দৈনন্দিন ও বাস্তব নানারকম সমস্যার সমাধানে সদা ব্যস্ত। নারীর শিক্ষা, কর্মসংস্থান, ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা এবং বিভিন্ন আইনগত সমস্যায় এসব প্রতিষ্ঠান কম-বেশি সবাই কাজ করে যাচ্ছে। এসব দেখেশুনে খুব ভালো লাগে। একসময় যে গ্রাম্যবধূ বিশাল ঘোমটা মাথায়, মুখে আঁচল চাপা দিয়ে, পরপুরুষের সামনে বের হতে লজ্জা বোধ করত, আজ সে জড়তাহীনভাবে বাইরে বেরিয়ে এসে কাজ করছে, পরিবার পরিকল্পনার বিভিন্ন পদ্ধতির সুবিধে-অসুবিধে নিয়ে খোলামেলাভাবে কথা বলছে, নিজের শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে নিজের গরজেই চলে আসছে স্বাস্থ্যসেবা নিতে। মাত্র দুই যুগের ভেতর আমাদের দেশে এ ধরনের বিশাল পরিবর্তন অন্য কোনো ক্ষেত্রে ঘটেছে কি না সন্দেহ।

এরপরেও নারীর প্রত্যহিক জীবনের মৌলিক একটি প্রয়োজন—গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক নিয়ে আজো কেউ মুখ ফুটে কথা বলছে না, বা এ ব্যাপারে বিশেষ কোনো কর্মসূচি. নিচ্ছে না দেখে আমি বিস্মিত হই। তেরো থেকে পঁয়তাল্লিশ বছরের নারীদের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে সর্বস্তরে যে উদ্বেগ এবং যে কারণে এই মহিলারা বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আলাদা মনোযোগ দাবি করছে, তা হলো এই বয়সী মহিলাদের সন্তান গ্রহণের ক্ষমতা ও সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনাকে ভিত্তি করেই তাদের দেওয়া হচ্ছে পরিবার পরিকল্পনার বিভিন্ন উপদেশ ও উপকরণ, প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে প্রসূতি মায়ের পরিচর্যার, বিতরণ করা হচ্ছে আয়রন ট্যাবলেট, নিরাপদ মাতৃত্বের অঙ্গীকার। কিন্তু এর সঙ্গে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত এসবের চাইতেও মৌলিক, বাস্তব ও ব্যাপক একটি সমস্যার কথা কেউ কিন্তু উত্থাপন করছে না। বস্তুত প্রায় সকলেই অগ্রাহ্য বা অস্বীকার করছেন এ ব্যাপারটা অর্থাৎ চূড়ান্ত এক বাস্তবতা। আর সেই বাস্তবতাটা হলো এই যে, কোটি কোটি রজস্বলা নারী, যাদের নিয়ে আমাদের সকলের এত মাথাব্যথা, যাদের মাসিক একবার বন্ধ হলে সম্ভাব্য নতুন প্রাণের সংযোজনের আশঙ্কায় এবং এর অর্থনৈতিক পরিণামের ভয়াবহতায় সকলে শঙ্কিত হয়ে ওঠে, তারা প্রতি মাসে একটি করে সপ্তাহ কেমন করে কাটায়, শরীর নিয়ে কতটা ব্যস্ত, বিব্রত ও সংকুচিত থাকে, তার খবর কেউ রাখি না আমরা। এ বিষয়টি যে আলাদা কোনো গুরুত্ব পেতে পারে তাও কেউ মনে করি না। অথচ এটি একটি বাস্তব ও কঠিন সমস্যা। আপনাআপনি এর সমাধান হবে না। কেননা সে ধরনের পারিবারিক কাঠামো, বাসস্থান, বাথরুম, ডাস্টবিন আমাদের গ্রামে নেই। নেই মেয়েদের কোনো প্রাইভেসি : নির্জন একখানি ঘর, পরিচ্ছন্ন একটু জায়গা। ফলে মাসের প্রত্যাশিত ওই দিনগুলো আসে তাদের কাছে বিভীষিকার মতো। এমনিতেই নিজের শরীরের বিভিন্ন অনুষঙ্গ নিয়ে ব্যস্ত ও বিব্রত পল্লীনারী। তার ওপর এই বিশেষ সময়ে তারা পড়ে মহা বিপদে। তার একান্ত ব্যবহৃত রঞ্জিত কাপড়খণ্ড ধোওয়ার জন্য না আছে কোনো গোপন জায়গা, না আছে সবসময় প্রয়োজনীয় এক টুকরো সাবান, না আছে সূর্যালোকে উজ্জ্বল প্রাইভেট অথচ খোলামেলা কোনো স্থান যেখানে রোদে সেঁকে জীবাণুমুক্ত করে নিতে পারে তার ব্যক্তিগত ব্যবহারের সামগ্রী। সবচেয়ে বড় কথা—ইচ্ছে থাকলেও, সামর্থ্য হলেও, কেবল ফেলে দেবার উপযোগী জায়গার অভাবেও গ্রামীণ মেয়েদের দিনের পর দিন বা মাসের পর মাস মাত্র কয়েক টুকরো কাপড়খণ্ডই ব্যবহার করতে হয়—যা থাকে অন্ধকার স্যাতস্যাতে জায়গায় মেলে দেওয়া, হাজার রকমের জীবাণুযুক্ত, অপরিচ্ছন্ন।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের প্রসেফর লতিফা শামসুদ্দিনের এক গবেষণার ফলাফলে জানা গেছে, আমাদের দেশের মেয়েদের মধ্যে মূত্রাশয় ও যৌনাঙ্গের বিভিন্ন সংক্রামক অসুখের একটা বড় কারণ মাসিকের সময় তাদের ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার অক্ষমতা ও অস্বাস্থ্যকর উপায়ে মাসিক মোকাবিলা করা। ফলে আমাদের মনে হয় এই বিশেষ ব্যাপারটির সুষ্ঠু সমাধানের ব্যবস্থা করলে তা গ্রামীণ ও শহরের গরিব নারীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য খাতে একটি বড় রকমের ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।

নানান কারণে এ দেশের মেয়েরা প্রাকৃতিক এই অতি স্বাভাবিক নিয়মটাকে সহজ ও স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে না। প্রথমত, প্রায় প্রতিটি ধর্মেই রজস্বলা নারীদের ধর্মস্থানে যেতে বা ধর্মীয় আচরণ করতে বারণ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে অধিকাংশ নারীই নিজের শরীরকে এ সময় পঙ্কিল, অস্পৃষ্য ও নোংরা ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। তার ওপর ধর্মীয় বা সামাজিক কারণে এ বিশ্বাসও অনেকের মধ্যে কাজ করে যে এ সময় স্বামীসঙ্গও অপবিত্র বা অনুচিত। অর্থাৎ এই সময় যৌন সম্পর্কের জন্যও সে অনুপযোগী। ডাক্তারি শাস্ত্রে এই ধরনের কোনো বিধিনিষেধ যদিও নেই, এবং পরিবার পরিকল্পনার বিবেচনায় সময়টি যদিও সবচেয়ে নিরাপদ, তবু বাস্তব অসুবিধার কারণেই অধিকাংশ দম্পতি এ সময় যৌন সংসর্গ এড়িয়ে চলে। এ কারণেও কোনো কোনো মেয়ের নিজেকে এ সময় অপাঙ্ক্তেয় মনে হয়। এ ছাড়া মাসিকের সময় সামাজিক ও পারিবারিক নানান বিধিনিষেধ যেমন খাবারদাবার, চলাফেরায় বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা, খাবার তৈরি ও আচার নাড়তে বারণ করার মতো ব্যাপারগুলো মেয়েদের মধ্যে এমনিতেই একরকম হীনম্মন্যতার জন্ম দেয়।

আরো একটি ব্যাপার নিয়ে মাঝে মাঝে আমি ভাবি। এটা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত ভাবনা। আমাদের সমাজে মেয়েদের সম্পর্কে একটি বড় দুর্নাম, তারা অনেকেই ব্যক্তিগত আচরণে খুব খোলামেলা নয়। খানিকটা লুকোচুরি করতে অভ্যস্ত। তারা সোজাসাপটা কথা বলে না বা চিন্তা করে না। অপবাদ আছে, নারীরা রহস্যময়ী, সবসময়েই আলোছায়ায় তাদের চলাচল, চিন্তাভাবনাও তেমনি খুব সহজ-সরল নয়। অর্থাৎ মুক্তমনা তারা নয়। কথাটা পুরুষরা নিন্দাচ্ছলে পুনঃপুন বলে এর সামাজিক একটি স্বীকৃতি মোটামুটি আদায় করে নিলেও ব্যাপারটি মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। তবু, আমার মনে হয় আমাদের দেশের সাধারণ মেয়েদের যদি শরীর নিয়ে, তার স্বাভাবিক বেড়ে ওঠে নিয়ে সদা সতর্ক, বিব্রত ও সংকুচিত থাকতে না হত, যদি তার যৌনতার প্রতিটি অনুষঙ্গকে গোপন বা আড়াল করতে সর্বদা ব্যস্ত থাকতে না হত, যদি সহজভাবে তা গ্রহণ করতে পারত, নিজের শরীর নিয়ে কোনোরকম দুর্ভাবনা না করে তাকে বিকশিত হতে দিতে পারত, তা নিয়ে গর্বিত বোধ করতে পারত, তা হলে অনেক বেশি সহজ, খোলামেলা, দৃঢ়চেতা ও আস্থাশীল তারা হয়তো হতে পারত।

ফলে নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন ও কর্মকাণ্ডে যে সকল নেত্রী বা সংগঠন দিবারাত্র কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁদের সকলকে নতুন করে আরেকবার মনে করিয়ে দিতে চাই : প্রতিটি দিনেই আমাদের দেশের কয়েক কোটি নারী রজস্বলা থাকছেন; তাঁদের এই বিশেষ সময়টার রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার দায়িত্ব এড়িয়ে তাঁদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য, তাঁদের পরিবার পরিকল্পনা, কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়ন কখনো পূর্ণাঙ্গতা পাবে না। ফলে অন্যান্য কর্মসূচির সঙ্গে প্রতি মাসে এই নারীদের প্রত্যেকের হাতে তুলে দেওয়া যাক বেশ কিছু পরিষ্কার পুরোনো কাপড় বা তুলো আর এক টুকরো গায়ে মাখার ও এক টুকরো কাপড় ধোওয়ার সাবান। তবে গ্রামের মহিলাদের যদি আমি জেনে থাকি, বুঝে থাকি, এটাও জানি——তাঁরা ধবধবে পরিচ্ছন্ন পুরোনো কাপড় পেলে নিজের জন্য তা ব্যবহার না করে হয়তো সন্তানের কাঁথা সেলাই করতে লেগে যাবেন। ফলে তুলো বা টুকরো কাপড় নয়, সম্মিলিত উদ্যোগে তাদের নিজেদের হাতেই তৈরি করে নিতে হবে আজকের যুগোপযোগী কম খরচের স্যানিটারি টাওয়েল। যেমন করে তাঁরা আজ তৈরি করেন ওরস্যালাইন। আর রিং এবং স্ল্যাব দিয়ে গ্রামে যেরকম এবং যেই হারে স্যানিটারি পায়খানা তৈরি হচ্ছে, তারপর আর কিছুদিন বাদে ব্যবহৃত ও পরিত্যাজ্য বস্তুগুলোর নিষ্কাশনেরও চিন্তা থাকার কথা নয়।

আমি আমাদের গাঁয়ের মেয়েদের তখনো দেখেছি যখন তাঁরা সায়া-ব্লাউজহীন শরীরে একখানা দশহাতি শাড়ি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কোনোমতে লজ্জা নিবারণ করতেন। আর সবসময় জবুথবু হয়ে এককোণে দাঁড়িয়ে থাকতেন। সেই মেয়েদেরই আমি এখন দেখি সায়া ও ব্লাউজের ওপর শাড়ি পরে কত সাবলীলভাবে কত স্বচ্ছন্দে গৃহনির্মাণের কাজে মাটি কাটায়, ইট ভাঙায় অংশ নিতে। আমি আশা করে আছি সেই সুদিনের যেদিন তাদের প্রত্যেকের দৈনন্দিন পরিধেয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে এক সেট অন্তর্বাস ও সেইসঙ্গে প্রতিমাসের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যকর সরঞ্জাম। আমি যেন চোখ বুজে দেখতে পাই কী গভীর পরিতৃপ্তি নিয়ে, কতখানি সাহস ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দৃঢ় পায়ে সোজা কর্মস্থলে হেঁটে যাচ্ছে আমার সেই গ্রামীণ সহোদরারা। অবশিষ্ট দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, জড়তা কাটিয়ে নিজের সুগঠিত শরীর ও যৌনতার ব্যাপারে পুরোপুরি সচেতন ও গর্বিত নারী আত্মপ্রত্যয়ের আলাদা ঔজ্জ্বল্য নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে মাঠে, কারখানায়, অফিসে, হাসপাতালে, স্কুলে, আদালতে, দোকানে, ট্রেনে বাসে— সর্বত্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *