মানুষ বানাবার মেশিন : প্রযুক্তি ও জরায়ু নিয়ে ব্যবসা

মানুষ বানাবার মেশিন : প্রযুক্তি ও জরায়ু নিয়ে ব্যবসা

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের জ্ঞানের পরিধি বাড়ায়। প্রাত্যহিক জীবনকে সহজ ও সুখকর করে তোলে। রোগ, জরা থেকে রক্ষার ব্যবস্থা তো বটেই, অনেক অনভিপ্রেত ঘটনা, দুর্ঘটনা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকেও বাঁচতে সাহায্য করে বিজ্ঞান। সতর্ক করে দেয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে। কিন্তু কখনো কখনো এই নবঅর্জিত জ্ঞান বা কারিগরি শিক্ষার বিকাশ সূক্ষ্মভাবে নানান সামাজিক সমস্যারও সৃষ্টি করে। এক মানবগোষ্ঠী দ্বারা অন্য গোষ্ঠীকে শোষণ ও নিপীড়ন করার হাতিয়ার তৈরি করার সুযোগ করে দেয় কোনো কোনো প্রযুক্তি। দোষটি অবশ্য বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির নয়। এর ব্যবহারের অসাফল্যই এ সকল মানবিক ও সামাজিক সমস্যার জন্য দায়ী।

ষাটের দশকের জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ির আবিষ্কার নারী-স্বাধীনতার এক বিশাল মাইলফলক। আলী কুবরার মতে, ‘The contraceptive revoultion of the sixties freed women from the problem of uncontrolled fertility with its many physical and social disadvantanges.’ (Practitioner, ২35, 878, 1991)

এটা অনস্বীকার্য যে, গর্ভধারণের প্রাকৃতিক দায়িত্ব মেয়েদের ওপর অর্পিত; শুধু এই কারণে বহু সামাজিক বিধিনিষেধ ও বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হতে হয় তাদের। যৌন জীবনকে প্রজনন-জীবন থেকে আলাদা করা এবং স্বনিৰ্বাচিত সন্তান ধারনের মতো বৈপ্লবিক চিন্তাগুলো মেয়েদের মধ্যে বিকাশ ঘটাতে অভূতপূর্ব সাহায্য করেছিল এই ‘পিল’। প্রকৃতি, পরিবার ও সমাজের কাছে নারীর অসহায়ত্ব ও দায়বদ্ধতা থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পেয়েছিল তারা।

ষাটের দশকের এই পিলের প্রবর্তন মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত নারী-সমাজে (যা সর্বত্র নারী-আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে বরাবর) যেমন আশা ও উদ্দীপনা এনেছিল, খুলে দিয়েছিল এক উজ্জ্বল সম্ভাবনার জগৎ, তেমনি অতি সম্প্রতি প্রজনন-প্রযুক্তির কিছু উন্নতি ও আবিষ্কার মেয়েদের আবার মুখ্যত প্রজনন-যন্ত্রের ভূমিকায় নিক্ষেপ করছে। শুধু তাই নয়, এই নব্য প্রজনন-প্রযুক্তি সনাতন পারিবারিক কাঠামো, সামাজিক সম্পর্ক বা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া ছাড়াও সন্তান উৎপাদনের পদ্ধতির সন্ধান দিচ্ছে। এই ধরনের প্রজ্ঞা ও প্রক্রিয়া নারীকে বিশেষ করে সেসব নারীকে যারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে ইতোমধ্যেই বঞ্চনার শিকার, নতুনভাবে ও অত্যন্ত পরিশীলিত উপায়ে শোষণ করতে শুরু করেছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মহলের সজাগ ও নির্মোহ দৃষ্টি এবং গভীর সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ না থাকলে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে এর পরিণতি ভয়ঙ্কর হবার আশঙ্কা রয়েছে। প্রজনন-বিজ্ঞানকে ব্যক্তিজীবনে যথোচিতভাবে ব্যবহারের ব্যাপারে প্রশাসক, আইনজ্ঞ, চিকিৎসক ও সমাজসেবীর একত্র প্রয়াসে একটি সুষ্ঠু নীতি নির্ধারণ ও তার সঠিক প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি।

নিচে সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন দেশের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হল, যার মাধ্যমে সমস্যাটির ধরন ও ব্যাপকতা সম্বন্ধে জানার অবকাশ হবে। তার আগে সনাতন বা প্রাকৃতিক উপায় অর্থাৎ যৌনসঙ্গম ব্যতীত সন্তানধারণের নব প্রযুক্তিগুলোর নামকরণ প্রয়োজন, যা নিচে সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ হল :

১. কৃত্রিম উপায়ে জরায়ুর অভ্যন্তরে শুক্র স্থাপন করা (artificial

২. insemination) : স্বামী যদি প্রাকৃতিকভাবে সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হয় তা হলে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে স্ত্রীকে গর্ভবতী করা যায় তার নিজের বা অন্য কোনো ব্যক্তির বীর্যের সাহায্যে। এতে দম্পতিটির মধ্যে অন্তত একজনের অর্থাৎ স্ত্রীর রক্ত ও বংশজাত প্রকৃতির অস্তিত্ব থাকে সন্তানের মধ্যে। কোনো অবিবাহিতা অথবা কুমারী মেয়েও এই পদ্ধতিতে পুরুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়াও সন্তান ধারণে সক্ষম। ইদানীং অবশ্য এই বিশেষ প্রযুক্তিটির মাধ্যমে বন্ধ্যা অথবা সন্তান ধারণে অনিচ্ছুক মহিলাদের স্বামীরা তাদের বীর্য অন্য কোনো মহিলার জরায়ুতে স্থাপন করে সন্তান লাভ করে (surrogate motherhood)।

টেস্টটিউবে সন্তান ধারণ (in vitro fertilization) : শরীরের বাইরে ডিম্ব ও শুক্রের মিলনে (নিষেকক্রিয়া) সৃষ্ট প্রাথমিক পর্যায়ের ভ্রূণকে এই পদ্ধতির মাধ্যমে জরায়ুর ভেতর স্থাপন করা হয়। সাধারণত যেসব মেয়ের ডিম্বকোষ থেকে ডিম্বাণু জরায়ুতে আসার পথে বাধা পায় এবং তার জন্য গর্ভবতী হওয়া সম্ভব হয় না, তারা এই পদ্ধতি প্রয়োগে গর্ভবতী হতে পারেন। ১৯৭৮ সালে ইউরোপে লুইস ব্রাউন বলে মেয়েটি প্রথম এই পদ্ধতির মাধ্যমে জন্মলাভ করে। অর্থাৎ লুইসের জন্মের সূচনা মায়ের শরীরের ভেতর হয় নি — হয়েছিল টেস্টটিউবে। আজকাল আবার টেস্টটিউবে সৃষ্ট ভ্রূণকে সঙ্গে সঙ্গে নারীদেহে স্থাপন না করেও দীর্ঘদিন ফ্রিজ করে রাখা চলে (cryopreservation technique)। ফলে এই প্রযুক্তির ব্যবহারের সম্ভাব্য প্রয়োগ ও ব্যাপকতা অসীম।

স্বামী-স্ত্রী যদি মনস্থির করে এটি তাদের সন্তান গ্রহণের সঠিক সময় নয়, তা হলে তারা তাদের শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর নিষেকক্রিয়া টেস্টটিউবে ঘটিয়ে (অবশ্যই প্রযুক্তির সাহায্যে ল্যাবরেটরিতে), ভ্রূণটিকে ফ্রিজ করে রেখে দিতে পারে ভবিষ্যতের জন্যে। এভাবে একই সঙ্গে ফ্রিজ করে রাখা দুটি ভ্রূণকে এক স্ত্রী গ্রহণ করেছিলেন সাত বছরের ব্যবধানে। ফলে, একই সময় প্রাণ সঞ্চারিত হলেও বাচ্চা দুটির জন্ম ও বয়সের তফাত থাকে সাত বছর। আবার একই প্রক্রিয়ায় ফ্রিজ করে রাখা এক দম্পতির ভ্রূণ সময়মতো জরায়ুতে প্রতিস্থাপনের আগেই স্বামী মারা যাওয়ায় স্ত্রীটি পরে আইনগত ও নীতিগত এক বিশাল জটিলতায় পড়েছিল। স্বামীর অবর্তমানে সেই ভ্রূণ প্রতিস্থাপন করা ন্যায়সঙ্গত কি না স্থির করতে আদালতে বহুদিন তর্ক-বিতর্ক চলেছে। স্ত্রীটি পড়ে তখন মহা বিপাকে।

৩. এ ছাড়া ডিম্বাণু ও শুক্রাণু ব্যাংকের মাধ্যমে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু কিনে সন্তান-জন্মে- অপারগ অনেক নারী-পুরুষ সন্তান লাভে সমর্থ হচ্ছে। এক সময় বলা হত মেয়েদের সন্তান ধারণের সময়সীমা নির্দিষ্ট বয়সে সীমাবদ্ধ। যেন একটি প্রাকৃতিক ঘড়ি (biological clock) তাদের শরীরে বসানো আছে যা প্ৰতি মাসে ঋতুস্রাবের মধ্য দিয়ে ঘণ্টা বাজিয়ে জানিয়ে যায় তার প্রজনন-ক্ষমতার সীমা শেষ হয়ে আসছে। চল্লিশ বা পঞ্চাশ দশকের কোনো এক সময় সেটা তারা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে। কিন্তু ডিম্বাণু ব্যাংক থেকে অল্পবয়সী মেয়েদের প্রদত্ত ডিম্বাণুকে টেস্টটিউবে শুক্রাণুর সঙ্গে মিলিয়ে যে ভ্রূণের সৃষ্টি হয় তাকে যদি পঞ্চাশোর্ধ্ব বা ষাটোর্ধ্ব কোনো মহিলার জরায়ুতে স্থাপন করে তাকে বাইরে থেকে প্রয়োজনীয় হরমোন সরবরাহ করা হয়, তা হলে সেই মহিলার পক্ষে অনায়াসে সন্তান ধারণ ও জন্মদান সম্ভব। আর সেটা ঘটছেও। তাই একটি মেয়ের পক্ষে এখন যে-কোনো বয়সে গর্ভবতী হওয়া সম্ভব। গর্ভাবস্থা, শারীরিক উপসর্গ, প্রসবের যন্ত্রণা ও সন্তান প্রতিপালনের মতো বাস্তব কষ্টগুলো গ্রহণ করার ক্ষমতা রয়েছে কি না সেটাই বিবেচ্য। মেয়েটির বয়স কত, তার ডিম্বাশয় ক্রিয়াশীল কি না, সে রজস্বলা কি না—এগুলো আর জরুরি ব্যাপার নয়। কনসেতা দিতেসা বলে দক্ষিণ ইটালির বাষট্টি বছর বয়সের এক মহিলা একটি পুত্র সন্তান প্রসব করেছে। কনসেতার তেপ্পান্ন বছর বয়সের স্বামীর বীর্যের সঙ্গে একটি তিরিশ বছরের মেয়ের নিঃসৃত ডিম্বাণুর মিলন ঘটিয়ে ভ্রূণটাকে কনসেতার জরায়ুতে স্থাপন করা হয়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে প্রজনন-ক্ষেত্রে এ ধরনের নব প্রযুক্তি মানবজীবনে, বিশেষ করে মেয়েদের প্রজনন-প্রক্রিয়ায় নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। তাদের অকল্পনীয় সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে। একটি মেয়ে গর্ভধারণের মতো কষ্টকর ও অস্বাচ্ছন্দ্যকর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে না গিয়েও মা হতে পারে—কিছু অর্থের বিনিময়ে গর্ভধারণের জন্য সাময়িকভাবে অন্য একটি মেয়েকে ভাড়া করে। সে যদি ইচ্ছা করে তা হলে মা হওয়ার সময় পিছিয়ে দিতে পারে তথাকথিত বায়োলজিক্যাল ক্লক অস্বীকার করে। বন্ধ্যা মেয়েদের স্বামীরাও অন্য নারীর ডিম্বাণুর সাহায্য নিয়ে নিজের শুক্রের সঙ্গে মিশিয়ে সন্তান উৎপাদন করতে পারে। যদি তার স্ত্রীর জরায়ু সন্তান গ্রহণে সমর্থ হয় তাহলে ভ্রূণটি তার স্ত্রীর মধ্যেই স্থাপন করা যায়। আর যদি ডিম্বকোষের মতো তার জরায়ুও থাকে অনুপস্থিত অথবা অকার্যকর, তা হলে সে-ভ্রূণটিকে ডিম প্রদানকারী মেয়ের বা সম্পূর্ণ অন্য একটি মেয়ের জরায়ুতে প্রবেশ করিয়েও সন্তানের বৃদ্ধিলাভ সম্ভব।

এই সকল কারিগরি ও প্রজনন-প্রযুক্তি যতই সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিক না কেন একই সঙ্গে তা নানা রকম পারিবারিক ও সামাজিক জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। সনাতন পদ্ধতির বাইরে জন্মগ্রহণ করা সন্তানদের অনেকেরই থাকে দুইয়ের অধিক পিতামাতা। ফলে সন্তানের মালিকানার প্রশ্নে প্রায়শই আইনগত নানান সমস্যা দেখা দিচ্ছে। প্রকৃত মাতাপিতা কে তা নির্ণয় করে দিতে হচ্ছে কোর্টকে। এ ধরনের জটিলতার শিকার হচ্ছে প্রধানত মেয়েরাই, কেননা গর্ভধারণ করার ব্যাপারটা পরিপূর্ণভাবে তাদের দায়িত্ব। এই নব্য প্রযুক্তি পারিবারিক কাঠামো, মানব-সম্পর্কের গতানুগতিক ধারাকেও কখনো কখনো চ্যালেঞ্জ করে বসতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা—নিষেকক্রিয়া ও গর্ভধারণকে আলাদা করা সম্ভব হওয়ায় অনেক অর্থশালী ব্যক্তি স্রেফ টাকার লোভ দেখিয়ে গরিব মানুষের বিশেষ করে দরিদ্র মেয়েদের শরীর অথবা শরীর-নিঃসৃত কোষকে কিনে নিয়ে সন্তান উৎপাদনের মাধ্যমে নিজেদের বাৎসল্যবোধ তৃপ্ত করতে অথবা ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি প্রমাণ করতে সক্ষম হচ্ছে। নিচে বহুল আলোচিত ও সাম্প্রতিককালে প্রবল আলোড়নকারী এই ধরনের কয়েকটি ঘটনার উদ্ধৃতি দিচ্ছি :

১. আমেরিকার অঙ্গরাজ্য নিউজার্সির ছোট্ট এক শহরের ট্রাক ড্রাইভারের স্ত্রী মিসেস মেরি বেথ হোয়াইটহেড। দুই সন্তানের জননী। অত্যন্ত স্নেহশীল। আর্থিক অনটন রয়েছে সংসারে। একদিন হোয়াইটহেডরা খবর পেলেন এক নিঃসন্তান দম্পতির কথা, যারা একটি সন্তান উৎপাদনের বিনিময়ে একজন মহিলাকে দশ হাজার ডলার দিতে রাজি। দুই সুস্থ সন্তান রয়েছে হোয়াইটহেডদের। মোটামুটি শান্তির সংসার। আর সন্তান তাঁদের দরকার নেই। কিন্তু সংবাদপত্রে পঠিত এই সন্তানবুভুক্ষু পেশাজীবী দম্পতির স্ত্রী পড়াশুনো ও কাজের ব্যস্ততার কারণে বহুদিন সন্তান ধারণ স্থগিত রাখতে গিয়ে এখন সম্পূর্ণভাবেই গর্ভধারণে অসমর্থ হয়ে পড়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী। তাঁর স্বামীও ডাকসাইটে ব্যক্তি—খুব সম্ভবত ডাক্তার। দু জনে মিলে তাই ঠিক করেছেন স্বামীর বীর্য সন্তান-উৎপাদনক্ষম কোনো শরীরে স্থাপন করিয়ে সেই নারীর গর্ভে বেড়ে ওঠা সন্তানই হবে তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম। স্বামী-স্ত্রী দু জনে মিলে না হোক অন্তত স্বামীর জিস্‌ তো থাকবে শিশুটির শরীরে। অত্যন্ত সন্তানবৎসলা মিসেস হোয়াইটহেড ভাবলেন, একটি পরিবারকে যদি সন্তান দিয়ে তিনি তৃপ্ত করতে পারেন তো ক্ষতি কী। বিনিময়ে নিজের সংসারেও আসবে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য—দশ হাজার ডলার। আইনজ্ঞের মাধ্যমে একটা চুক্তি হল। বিশদ সে-চুক্তি, বিস্তর বিধিনিষেধ। যতদিন পর্যন্ত মিসেস হোয়াইটহেড এই সন্তানবুভুক্ষু স্বামীর অর্থাৎ ডক্টর এক্স-এর শুক্র দ্বারা গর্ভবতী না হচ্ছেন ততদিন তিনি স্বামীর সঙ্গে যৌন জীবন যাপন করতে পারবেন না। কেননা তা হলে পিতৃত্বের স্থিরতা থাকবে না। প্রতি মাসে নির্ধারিত কয়েকটি দিনে ক্লিনিকে যেতে হয় মিসেস হোয়াইটহেডকে। সেখানে ডাক্তার কৃত্রিম উপায়ে পরপুরুষের বীর্য স্থাপন করেন তাঁর জরায়ুতে। যথাসময়ে মিসেস হোয়াইটহেড গর্ভবতী হলেন। নির্দিষ্ট গতিতে ও স্বাভাবিকভাবে গর্ভাবস্থা কাটাবার পর তিনি একটি সুস্থ কন্যাসন্তানের জন্ম দিলেন। কিন্তু গোল বাধল সন্তান-জন্মের পর। কন্যার মুখদর্শন করে মিসেস হোয়াইটহেড বেঁকে বসলেন। দশ হাজার ডলার তিনি চান না—কোনো চুক্তি মানতে রাজি নন। এই কন্যা তাঁর গর্ভজাত। তিনি মা এবং তাঁর সন্তানকে তিনি রাখতে চান। ওদিকে ডক্টর ও মিসেস এক্স কিছুতেই তা হতে দেবেন না। ডক্টর এক্স-এর ঔরসজাত সন্তান এটি। সবচেয়ে বড় কথা—চুক্তিতে স্বাক্ষরিত দলিল রয়েছে তাঁদের কাছে। হোয়াইটহেডদের বাড়ি থেকে শিশুটিকে জোর করে নিয়ে যাবার জন্য কোর্ট থেকে অর্ডারসহ যখন পুলিশ এসে হাজির দরজায়, তখন মিসেস হোয়াইটহেড তাঁর স্বামীর (যার সঙ্গে সন্তানটির কোনোই সংযোগ নেই রক্তের) সাহায্যে শিশুসহ জানালা দিয়ে পালিয়ে চলে গেলেন ফ্লোরিডা। অনেক চাঞ্চল্যকর ঘটনার মধ্য দিয়ে বহুদিন ফেরারি থাকার পর মিস্টার ও মিসেস হোয়াইটহেড ধরা পড়লেন এবং বিচারের রায় অনুযায়ী শিশুটিকে তুলে দিতে হল ডক্টর ও মিসেস এক্স-এর হাতে। মিসেস হোয়াইটহেড এ সন্তানের মা নন। কেবল ভাড়া-করা জন্মদাত্রী (surrogate mother)। অর্থের বিনিময়ে তাঁর মাতৃত্বকে তাঁর সন্তানকে কিনে নিয়েছেন এক ধনী দম্পতি। ফলে কিছুই করার নেই তাঁর। ইতোমধ্যে হোয়াইটহেডদের শান্ত রুটিন জীবনে ঝড় উঠে গেছে। কোথা থেকে একটি শিশু এসে সমস্ত কিছু ওলটপালট করে দিয়ে গেল। এতসব ঘটনার অস্বাভাবিক অবস্থার চাপ এবং মিস্টার হোয়াইটহেডের চাকরি হারানো পরিবারের দুর্গতি বয়ে আনে। তাঁদের এতদিনকার সুখের সংসার ভেঙে যায়। বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে হোয়াইটহেডদের। আর ডাক্তার স্বামী ও আইনজ্ঞ স্ত্রী মিসেস হোয়াইটহেডের গর্ভজাত সন্তান নিয়ে সুখে ঘর-সংসার করতে থাকেন।

ব্যাপারটা তা হলে কী দাঁড়াল? শুধু সন্তান ধারণে অক্ষম স্ত্রীরাই artificial insemination-এর সুবিধা ভোগ করেন না। এ পদ্ধতির মাধ্যমে যে-কোনো সচ্ছল দম্পতিও স্থির করতে পারেন——–সন্তান উৎপাদনের মতো ঝামেলার ব্যাপার, কষ্টকর অভিজ্ঞতা ও দীর্ঘ শারীরিক উপসর্গ তাঁরা সহ্য করতে চান না। অতএব ক্যাটালগ দেখে জামা কেনার মতো করে কোন মহিলার ডিম্বাণুর সঙ্গে স্বামীর শুক্র মেশালে কাঙ্ক্ষিত সন্তানের জন্ম হতে পারে, তা বেছে নিতে পারেন তাঁরা ঘরে বসে ছবি দেখে, ভিডিও চালিয়ে অথবা ইন্টারভিউর মাধ্যমে। অর্থের অভাবে কত মিসেস হোয়াইটহেড এরকম করে সন্তান উৎপাদনে রাজি হবেন। ডক্টর এক্সরাই নির্ধারণ করবেন বাদামি চুল না খয়েরি চুল চান, খাড়া নাক না ছোট নাক, বড় টানা চোখ না ছোট অথচ ধারালো চোখ দরকার। সন্তান উৎপাদনের ব্যবসায় সব রকম মহিলাই প্রতুল। আর এ পদ্ধতি ও প্রযুক্তির প্রয়োগে ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, ডাক্তার অথবা আইনজ্ঞের মতো সমাজের ওপরতলার লোকরা যে চিরকাল ট্রাক ড্রাইভার, মেথর ও তাদের স্ত্রীদের ব্যবহার করবে তা তো বলাই বাহুল্য। কেননা যারা দরিদ্র তাদের পেটে যেহেতু খিদে, বাৎসল্যবোধের কী বোঝে তারা? টাকার বিনিময়ে সন্তান হস্তান্তর করতে তাদের তো আপত্তি করার কথা নয়। মিসেস হোয়াইটহেডের মতো বোকা আর কজন? অকাট্য যুক্তি বটে! একজন সমাজসচেতন বিজ্ঞানী এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছিলেন, Surrogate motherhood was, effectively, sale of a child, the only mitgating factor being that one of the purchasers was the father, and he had no constitutional right to procreate and retain custody of the child. The custody, care, companionship and nurturing that follow birth are not part of the right to procreate.

২. ক্রিসপিনা ক্যালভার্ট সন্তান ধারণে অক্ষম। কেননা তাঁর হিস্টারেক্টমি (জরায়ু অপসারণ) হয়ে গিয়েছে। এ অবস্থায় ক্রিসপিনা ও তাঁর স্বামী চুক্তি করলেন এক অবিবাহিত যুবতী নার্স অ্যানা জনসনের সঙ্গে। চুক্তি অনুযায়ী ক্রিসপিনার স্বামীর শুক্রাণুর সঙ্গে ক্রিসপিনার ডিম্বাণু মিলনে টেস্টটিউবে নিষেকক্রিয়া সমাপনে যে-ভ্রূণের সৃষ্টি হবে, তা অ্যানা বহন করবে তার জরায়ুতে। অর্থাৎ ডাক্তারের ক্লিনিকে ক্যালভার্ট সম্পতি তাঁদের শুক্রাণু ও ডিম্বাণু দান করবেন যার মিলনে সৃষ্ট ভ্রূণকে ডাক্তার অ্যানার জরায়ুতে স্থাপন করবেন। নির্ধারিত সময়ে সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে অ্যানা সন্তানকে ক্যালভার্ট দম্পতিকে হস্তান্তর করবেন, বিনিময়ে তিনি পাবেন দশ হাজার ডলার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কৃত্রিম উপায়ে সন্তান ধারণ করলে যে-মহিলা ডিম্বাণু সরবরাহ করে, সে-ই জরায়ুতে সন্তান ধারণ করে। যেমন ঘটেছে মেরি বেথ হোয়াইটহেডের বেলায়। কিন্তু এক্ষেত্রে এক মহিলা ডিম্বাণু দিয়েছে আর গর্ভবতী হয়েছে অন্য মহিলা। যা হোক গর্ভাবস্থার শেষের দিকে অ্যানার কী যে হল! হঠাৎ তিনি স্থির করলেন অনাগত সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর একজন মা হিসেবে সেই বাচ্চার সাক্ষাৎলাভের বৈধতা তাঁর রয়েছে এবং কোর্টের কাছে সে-দাবি মঞ্জুর করার জন্য আবেদন করলেন। ১৯৯০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর জন্ম হল ক্রিস্টোফারের। রক্ত পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া গেল যে, অ্যানা জনসনের সঙ্গে ক্রিস্টোফারের কোনো জেনিটিক সম্পর্ক নেই। বিচারক তখন রায় দিলেন যেহেতু অ্যানা আর ক্রিস্টোফারের মধ্যে কোনো জেনেটিক সম্পর্ক নেই সেহেতু মা হিসেবে ক্রিস্টোফারকে নিয়মিতভাবে দেখতে পারার অধিকার অ্যানার নেই। জজ রিচার্ড পার্সলোর মতে, অ্যানার ভূমিকা এখানে ফস্টার মাতার মতো যিনি সাময়িকভাবে প্রকৃত মাতার (ক্রিসপিনা ক্যালভার্ট) অনুপস্থিতিতে অথবা অক্ষমতায় সন্তানের দেখাশোনা করেছেন— খাইয়েছেন মাত্র। যমজ সন্তানদের উদ্ধৃতি দিয়ে বিচারক বলেন যে, পরিবেশের চাইতে বংশগত সত্তার (জিনসের) প্রভাব অনেক বেশি। তা ছাড়া অ্যানা জনসন চুক্তিবদ্ধ এই দম্পতির কাছে। সবচেয়ে বড় কথা—ক্রিস্টোফারের মঙ্গলের জন্য তাকে তিন জন মাতাপিতার বদলে স্বাভাবিক পরিবারের মতো দুই মাতাপিতার সঙ্গেই বসবাস করতে দেওয়া সঙ্গত। কোর্টের এই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে অ্যানা আপিল করলেন। আপিল কোর্টও আগের সিদ্ধান্ত বহাল রাখে। তারা অবশ্য চুক্তি বা ক্রিস্টোফারের কল্যাণের কথা উল্লেখ না করে কেবল নির্ণয় করতে চেষ্টা করেছেন কে ক্রিস্টোফারের প্রকৃত মা—যে ডিম্বাণু দান করেছে সে, না যে তাকে গর্ভে ধারণ করেছে ও ন’ মাস পর প্রসব করেছে সে? কোর্ট ঠিক করল যেহেতু পিতৃত্বের ব্যাপারে প্রশ্ন বা সন্দেহ জাগলে রক্ত পরীক্ষা করেই তা নিষ্পত্তি করা হয়, মাতৃত্বের ব্যাপারেও অনুরূপ নীতি অনুসরণ করতে হবে। অবশ্য আমেরিকায় সাধারণ অবস্থায় অবৈধ সন্তানের সামাজিক সমস্যা এড়াতে একটা নিয়ম চালু আছে। একত্রে বসবাসকারী বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর ঘরে সন্তান জন্মগ্রহণ করলে, স্বামীটি যদি impotent অথবা sterile না হন, তা হলে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সে-ই স্বীকৃত হবে সন্তানের বাবা হিসেবে (প্রকৃত অবস্থায় তা না হলেও)। কিন্তু সন্তানের পিতৃত্বে যদি প্রশ্ন জাগে এবং স্বামী বা স্ত্রী দু জনের কেউই যদি চায় পিতৃত্ব নির্ণয় করতে, তা হলে যে-পদ্ধতিতে তা নির্ণয় করা হয় সেটা রক্ত পরীক্ষা। ফলে, বিচারকের বিবেচনায় একই নিয়ম প্রযোজ্য হওয়া উচিত এক্ষেত্রেও এবং সেখানে তাই অ্যানা জনসনের কোনো ভূমিকা নেই। জেনেটিক উপায়ে পরীক্ষা করলে তাকে মা বলা যায় না। অ্যানা সেটা কখনো দাবিও করে নি। ফলে অ্যানার মাতৃত্ব আইনে গ্ৰাহ্য নয়।

অ্যানা জনসন তখন ক্যালিফোর্নিয়াতে প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য আইনের মাধ্যমেই তার দাবি পেশ করতে চেষ্টা করেন। আইনানুযায়ী একজনকে মাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রমাণ করতে হয় যে, সে সন্তানকে জন্ম দিয়েছে- যেমন অ্যানা সন্তান ধারণ করেছেন এবং জন্ম দিয়েছেন। অ্যানা আরো একটি বিষয়ের উদ্ধৃতি দিলেন। তিনি জানালেন কোনো লোক যদি বীর্য দান করে আর যদি সেই বীর্য কৃত্রিম উপায়ে তার স্ত্রী ব্যতীত অন্য কোনো মহিলার জরায়ুতে স্থাপন করে তাকে গর্ভবতী করা হয়, তা হলে আইনানুযায়ী সেই লোক সেই সন্তানের পিতৃত্বের দাবি করতে পারে না। সেই মহিলার প্রকৃত স্বামীই আইনানুসারে সে-সন্তানের জনক। কিন্তু অ্যানা জনসন অবিবাহিতা। ফলে তার দুটো যুক্তিই টেকনিক্যাল কারণে অগ্রাহ্য করেন বিচারক।

আপিল কোর্ট অবশেষে বলতে বাধ্য হলো যে, আসল কথা— সমাজ কখনো ভাড়া-করা মায়ের স্বার্থ দেখার চেষ্টা করে না, সন্তান ও পারিবারিক সম্পর্ককেই গুরুত্ব দেয়। শুধু তাই নয়, বিচারক এও বললেন যে, জীবজগতে জিনসই (Gene) সবকিছুর মূল। শুধু চেহারা, শারীরিক প্রতিটি অঙ্গ ও তার কার্যকারিতাই নয়, চারিত্রিক লক্ষণ এমনকি কথা বলার ধরন, মুদ্রাদোষ, পছন্দ-অপছন্দ, ব্যক্তিত্ব সবকিছু নির্ণয় করে জিনস। ফলে সেই জিস্‌ যেহেতু দিয়েছে মিসেস ক্যালভার্ট তাই তিনিই ক্রিস্টোফারের মা, অ্যানা জনসন নন। অ্যানা জনসন ফস্টার হোমের মতো তাঁর জরায়ু ভাড়া দিয়ে শুধু ভ্রূণটিকে বিকাশ ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছেন, তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। ব্যাপারটি আরো ঊর্ধ্বতন কোর্টে গেলে প্রচলিত আইনের আওতায় যেহেতু ঘটনাটি পড়ে না, বিচারক এই বলে রায় দিলেন যে অ্যানা জনসন ও ক্যালভার্ট দম্পতি যদি নিজেদের মধ্যে ব্যাপারটার ফয়সালা করে নিতে না পারেন তা হলে ক্রিস্টোফারকে দু পক্ষের কাউকেই দেওয়া হবে না, সরাসরি ফস্টার হোমে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। রাজা সলোমনের পদ্ধতি আর কি! কিন্তু এই ব্যবস্থায় জেনেটিক পিতামাতা রাজি হলেও অ্যানা জনসন যে সন্তানটিকে ন’ মাস গর্ভে ধারণ করেছেন ও প্রসব করেছেন তিনি কিন্তু রাজি হলেন না। পরিবর্তে তিনি তাঁর দাবি প্রত্যাহার করে নিলেন সন্তানের কল্যাণের কথা ভেবে।

এই কেসে কোর্টের উল্লিখিত যুক্তিগুলোর মধ্যে একাধিক শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে : (ক) প্রাকৃতিক মা বলতে কেন কেবল জেনেটিক মাকে বোঝানো হবে? অ্যানা জনসনের জরায়ুতে ন’ মাস ধরে যেখানে সন্তান বেড়ে উঠেছে এবং তিনিই যেখানে সন্তানকে প্রসব করেছেন সেখানে কেমন করে অ্যানা অপ্রাকৃতিক মা হতে পারেন? (খ) পুরুষদের সঙ্গে নারীর প্রজনন-প্রক্রিয়ার তুলনা করা হয়েছে কোর্টে। কিন্তু এ তুলনা চলে না। কেননা পিতা কেবল জিনস প্রদান করেন, কিন্তু মা শুধু জিন দিয়ে রেহাই পান না, তাঁকে গর্ভধারণ ও প্রসব করতে হয়। একটি জীবকোষ থেকে তিল তিল করে পরিপূর্ণ একটি মানুষ সৃষ্টি করতে হয় নিজের শরীরের ভেতর। এমন এক সময় ছিল যখন জিনস দান ও গর্ভধারণ দুটোই অবধারিতভাবে করত একই মা। কিন্তু এখন প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বিকাশে মায়েদের এ দুটো কাজকে আলাদা করা সম্ভব। এখন অনায়াসে এক মা জিনস দিতে পারে তো অন্য মা জরায়ুতে সন্তান ধারণ ও প্রসব করতে পারে। আর এই বিভাজনের ফলে সৃষ্টি হচ্ছে নানান সামাজিক সমস্যা। কে মা আর কে নয় সেটা ঠিক করার দায়িত্ব কার? মিসেস কালভার্টকে প্রাকৃতিক মা বলে আখ্যায়িত করে অ্যানা জনসনকে ভাড়া- করা মা বলে অ্যানার ভূমিকাকে ছোট করে দেখানো হয়েছে কোর্টে। ‘প্রাকৃতিক’ বলতে কী বোঝায়? যে অ্যানা জনসনের শরীরের ভেতর তাঁর রক্ত মাংসে পুষ্টিতে বেড়ে উঠেছে একটি শরীর তিনি কেমন করে প্রাকৃতিক মা না হয়ে অন্য কিছু হতে পারেন? আসল কথা হলো—কোর্ট যাই বলুক বিচারক নিজেও জানেন যে, দু জন মহিলাই ক্রিস্টোফারের মা এবং তাঁরা দু জনেই সমানভাবে প্রাকৃতিক। যে-কোনো একজনকে প্রাকৃতিক ধরে নিয়ে অন্যজনকে অগ্রাহ্য করা বা তার ভূমিকাকে অস্বীকার করা অত্যন্ত অমানবিক। কোর্টের এই সিদ্ধান্ত গর্ভধারণ ও সন্তানপ্রসবকে ছোট করে দেখছে। অসম্মান করছে। অথচ উল্টোটি মেনে নিলে জিনস এবং জেনেটিক্সকে অপমান করা হত (New Engladnd Journal of Medicine, 3২6: 417-4২0, 199২)

৩. আমেরিকার অঙ্গরাজ্য টেনেসিতে এক দম্পতির কাছ থেকে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু সংগ্রহ করার পর প্রতিষ্ঠিত এক ক্লিনিকে এক ডাক্তার টেস্টটিউবে সাতটি ভ্রূণের সৃষ্টি করল। আজকাল যেহেতু এইসব ভ্রূণ বহুদিন পর্যন্ত ফ্রিজ করে রাখা চলে তারা সাতটি ভ্রূণকে আপাতত ওইভাবেই রেখেছিল— পরবর্তীকালে সময়- সুযোগমতো জরায়ুতে স্থাপন করার ইচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু ইতোমধ্যে দম্পতিটির বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে যায়। ফলে এখন সোনার কাঠি রুপোর কাঠি ছোঁয়া ঘুমন্ত এই সাতটি রাজপুত্র-কন্যার দায়িত্ব নেবে কে? মা-বাবা দু জনেই ভিন্ন ভিন্নভাবে সন্তানের অধিকার দাবি করেন। কিন্তু কোর্ট দু জনের যৌথ অধিকারই স্বীকার করে নিয়ে দু জনকেই রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেয়। কিন্তু এ ব্যবস্থায় সদ্য বিচ্ছেদপ্রাপ্ত দম্পতির কেউই রাজি নয়। ফলে সাতটি সন্তান হয়তো সাত ভাই চম্বার মতো অনির্দিষ্টকাল—হয়তো চিরকাল – আলো- বাতাসহীন পরিবেশে ঘুমন্ত অবস্থায় জীবন কাটাবে ঠিক মাটির নিচে নয়, ফ্রিজারের ছোট অন্ধ কুঠুরিতে গভীর শীতলতায় আর অন্ধকারে ( New England Journal of Medicine, 3২3 : 1২00-1২0২. 1990) ।

৪. দক্ষিণ আফ্রিকার ঘটনা এটি। মেয়েটি জরায়ু হারিয়েছে অল্প বয়সেই শারীরিক জটিলতার শিকার হয়ে। সন্তানহীন এ দম্পতি একটি সন্তানের জন্য এতটাই উন্মুখ যে, মেয়েটির মা এক অভিনব উপায়ে কন্যাকে একটি সন্তান উপহার দিতে রাজি হলেন। তিনি তাঁর মেয়ে ও মেয়ের জামাই থেকে সংগৃহীত ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মাধ্যমে টেস্টটিউবে সৃষ্ট ভ্রূণকে নিজের জরায়ুতে স্থাপন করিয়ে গর্ভবতী হলেন এবং যথাসময়ে কন্যাটির জন্যে একটি সুস্থ সন্তান প্রসব করলেন। মায়ের জন্য এ এক বিরাট দান সন্তানের মনোবাঞ্ছা পূরণে। কিন্তু প্রশ্ন হল —— এই সন্তানটির সঙ্গে এই সন্তানধারণকারী ও প্রসবকারী মহিলার সম্পর্কটা কী হবে? তিনি কি তার দিদিমা, নাকি মা? জামাইয়ের সঙ্গেই-বা শাশুড়ির সম্পর্কটা কী হবে? এই বিশেষ ক্ষেত্রে মা, মেয়ে ও মেয়ের জামাই তিন জনে মিলেই একটি সন্তানের জন্ম দিয়েছেন এবং ভিন্ন ভিন্নভাবে তিন জনেই মাতৃত্ব ও পিতৃত্বের দাবিদার। অবশ্য ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মধ্যে ঘটনাটা ঘটায় হয়তো অধিকার নিয়ে আইনগত টানাহেঁচড়া চলবে না। কিন্তু সামাজিকভাবে এদের সম্পর্কের নমুনা কী হবে?

প্রজনন-প্রক্রিয়ায় এ ধরনের প্রযুক্তির উন্নতিতে বহু নিঃসন্তান দম্পতি সন্তানলাভে সমর্থ হচ্ছে এটা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক। কিন্তু অর্থনৈতিক কারণে কারিগরি ও প্রযুক্তির পর্যাপ্ততার অভাবে এখন পর্যন্ত এই সকল পদ্ধতি মুষ্টিমেয় কয়েকটি দেশের বিত্তবান সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ, এ পর্যন্ত সমস্ত পৃথিবীতে মাত্র অনূর্ধ্ব এক লক্ষ শিশু জন্মগ্রহণ করেছে টেস্টটিউবে নিষেকক্রিয়ার মাধ্যমে। সন্তানহীনা কোনো নারীকে অন্য এক নারী যদি মানবিক কারণে সন্তানবতী করতে এগিয়ে আসেন, তাঁর শরীর থেকে নিঃসৃত ডিম্বাণু সরবরাহের মাধ্যমে অথবা জরায়ুতে ধারণ করে ও প্রসব করে, প্রশংসা ছাড়া তার এই মহতী কর্ম অন্য কোনো বিতর্কের সূচনা করে না। কিন্তু যখন টাকার বিনিময়ে ধনী এক দম্পতি অভাবী একটি মেয়েকে ভাড়া করে আনে সন্তান গ্রহণ করার কাজে, শুধু তাই নয় পরবর্তীকালে তার মানবিক সকল অনুভূতিকে অস্বীকার করতে বাধ্য করে তখন তাকে কোনোমতেই শুভ বা মহৎ কাজ বলে মেনে নেওয়া যায় না। অবশ্য টাকার বিনিময়ে অন্য দম্পতির জন্য যাঁরা সন্তান ধারণ ও প্রসব করেছেন তাঁরা সকলেই যে মানসিকভাবে ভূমিষ্ঠ শিশুটির সঙ্গে তৎক্ষণাৎ আত্মিকভাবে জড়িয়ে পড়েন অথবা পরবর্তীকালেও এ কারণে সবসময়ে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে এমন নয়। তবে আংশিকভাবেও যদি তা ঘটে, সেই বিশেষ নারীটির কষ্ট ও যন্ত্রণা সমগ্র পদ্ধতিটির নৈতিক যথার্থতা সম্বন্ধে আমাদের ভাবিয়ে তোলে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তার নিজস্ব গতিতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন আবিষ্কার ও নতুন উদ্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে। তার গতি থামিয়ে রাখা যাবে না, রাখা উচিতও নয়। কিন্তু বিজ্ঞান আহরিত জ্ঞান ও নব প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হবে গভীর বিবেচনার সঙ্গে যাতে মানবজাতির সমষ্টিগত কল্যাণের পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়, সামাজিক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি না করে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার organ transplantaiori (অঙ্গ সংযুক্তি)-এর ব্যাপারে যে-নীতি, অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অনুদান এবং গ্রহণ সম্বন্ধে যে- ধরনের কড়াকড়ি রয়েছে রক্ত, রক্তজাতদ্রব্য ও প্রজনন-প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয় টিস্যুর ব্যাপারে তা প্রযোজ্য করা হয় নি। রক্ত ও রক্তাণুর ব্যাপারে এ শিথিলতা অনুমেয় ও গ্রহণযোগ্য। রক্তদান জীবনদানের নামান্তর এবং এই দান বা গ্রহণ যথার্থভাবে করা হলে দাতা ও গ্রহীতা দু পক্ষের কারোর জন্যই শারীরিক বা মানসিক কোনো জটিলতার সৃষ্টি করে না। কিন্তু আমরা একই কথা কি বলতে পারি ডিম্বাণু, শুক্রাণু বা ভ্রূণের ব্যাপারে? এগুলো তো কেবল পুনঃপুনঃ সৃষ্ট ও নিঃসৃত শারীরিক কতকগুলো কোষই নয়, হৃৎপিণ্ডের ধুকধুকানি ও অনুভূতি, এবং চিন্তাসমেত পরিপূর্ণ একটি মানুষ তৈরি করতে সক্ষম এগুলো—–সক্ষম পারিবারিক ও সামাজিক নানান জটিলতা সৃষ্টি করতে। ফলে এগুলোর দান ও গ্রহণে যথেচ্ছাচার কোনোমতেই বরদাশত করা যায় না। ডিম্বাণু, শুক্রাণু ও ভ্রূণের বণ্টন সম্পর্কে খুব সুচিন্তিত নীতিনির্ধারণ একান্ত জরুরি। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রদান ও প্রতিস্থাপনের ব্যাপারে যে-ধরনের সুনির্দিষ্ট নিয়মকানুন বর্ণনা করেছে তার থেকে অব্যাহতি দিয়েছে প্রজনন-প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয় বিভিন্ন অঙ্গ, কোষ এমনকি ভ্রূণকেও। ‘Organ’-এর সংজ্ঞাতে পরিষ্কার লেখা রয়েছে : “The term human organ is used there to cover organs and tissues with the exception of reproductive tissues, namely ova, spermatoza, ovaries, testicles and embryos, and of blood and blood constituents for transfusion purposes (World Health Forum. page 310. 1991)। যুক্তরাষ্ট্রে যকৃত, বৃক্ক অথবা হৃৎপিণ্ডের মতো অঙ্গ বিক্রি আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু শুক্রাণু বা ডিম্বাণু সরাসরি কেনাবেচায় কোনো বাধা নেই। বাধা নেই ডিম্বাশয় অথবা জরায়ু ভাড়া করতেও। সুখের বিষয়, ইদানীং কোনো কোনো দেশে প্রজনন-অঙ্গ অথবা কোষ দান-গ্রহণের ব্যাপারেও কিছুটা সচেতনতা, কড়াকড়ি ও আইন প্রয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সম্প্রতি অস্ট্রিয়াতে টেস্টটিউবে নিষেকক্রিয়ার মাধ্যমে সন্তান লাভ করতে সক্ষম হবে কেবল বিবাহিত দম্পতি অথবা যে-দম্পতি অন্তত তিন বছর একসঙ্গে বসবাস করেছে। ডিম্বাণু ও শুক্রাণু কেনাবেচা আইন অবহির্ভূত বলে বিবেচিত হবে। শুক্রাণু ব্যাংকে শুক্রাণু দানের জন্য দাতা কোনো অনুদান পাবে না এবং সেই শুক্রাণু-সৃষ্ট সন্তানে তার কোনো অধিকার থাকবে না। ডিম্বাণু দান নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়, যেহেতু সংগ্রহের পদ্ধতি মেয়েদের জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ-এ ছাড়া এ পদ্ধতি প্রয়োগে মেয়েকে শোষণ করা হয়। ব্যবসায়িক ভিত্তিতে শুক্রাণু, ডিম্বাণু ও ভ্রূণের লেনদেন, surrogate motherhood সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে অস্ট্রিয়ায়। এ আইনকে চ্যালেঞ্জ করে কিছু ডাক্তার ইতিমধ্যেই আপিল করেছেন। ডিম্বাণু, শুক্রাণু ও প্রজনন-অঙ্গের বিকিকিনি ও ভাড়ার মাধ্যমে আজ শুধু বন্ধ্যা নারীই নয়, যে-কোনো বিত্তবতী মহিলা সন্তান ধারণ করার শারীরিক অসুবিধার জন্য অথবা নান্দনিক কারণে অনায়াসে দেখেশুনে একটি মেয়েকে ভাড়া করে নিতে পারে সন্তানের জন্মদাত্রী হিসেবে। আমাদের দেশে কাজের মেয়েকে নিয়োগ করার আগে যেমন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নেওয়া হয় মেয়েটি যথেষ্ট স্বাস্থ্যবতী ও কর্মক্ষম কি না, এই ভাড়াটে মা’টিকে ও স্বামী-স্ত্রী মিলে দেখে নিতে পারেন—তার কোনো জীবাণুবাহী বা পারিবারিক রোগ আছে কি না, অতীতে কোনো সমস্যা ছিল কি না, মেয়েটির এর আগে কোনো সন্তান থেকে থাকলে তারা কী রকম হয়েছে দেখতে, তাদের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা রয়েছে কি না ইত্যাদি। মানুষ বানাবার মেশিনের আর কী বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার—বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও আমেরিকা-ইংল্যান্ডের মতো দেশের আইনপ্রণয়নকারী বিভাগ-হয়তো ফর্দ বানাবে এখন। এই পদ্ধতিগুলোর অপপ্রয়োগ ও গরিব অসহায় নারীকে শোষণ করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে তারা, এ আশা কি করা যায়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *