যুগলবন্দীর ইতিকথা
Social monogamy, where you’ve got a pair bond, is not the same as genetic monogamy. Genetic or sexual monogamy appears to be the exception rather than the rule among pairs in the animal kingdom.
-Stephen Elman
একগামিতা বা বহুগামিতা কি প্রাণিজগতের সাধারণ একটি প্রবণতা? এটা কি জিনস বা বংশ দিয়ে নির্ধারিত? নাকি পরিবেশ বা সামাজিকভাবে অর্জিত অন্য অনেক কিছুর মতো এটিও স্বভাবগত একটি বৈশিষ্ট্য? বিজ্ঞানীরা আজকাল অবশ্য মানুষের আচরণ ও প্রবণতার অনেক কিছুর ভেতরেই জেনেটিক কারণ আবিষ্কার করেছেন। মদ্যপানের নেশা থেকে শুরু করে বহুগামিতা, ঘন ঘন দুর্ঘটনার শিকার হওয়া, ধর্ষণ বা খুনের প্রবণতা, দাঁতের পোকা লাগা থেকে শুরু করে বহুমূত্র, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের প্রকোপতা, বার্ধক্য, জরা, রুচি, স্মরণশক্তি, প্রসন্ন কি উৎফুল্ল মানসিকতা, বিষণ্ণতা, স্নেহশীলতা, মেজাজ, যুক্তিবাদ—প্রায় সবকিছুর ভেতরই কোনো বিশেষ জিনের কর্মতৎপরতা বা প্রভাব লক্ষ করেছেন তাঁরা। আর গায়ের, চুলের বা চোখের রং, চেহারা, স্থূলত্ব, বিশেষ কোনো বিষয়ে মেধা, মাথায় টাক পড়ে যাওয়া ইত্যাদি ব্যাপারে বংশের ধারার কথা তো বহুদিন ধরেই সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত। প্রাণিজগতের বিভিন্ন পশুপাখির স্বভাব ও আচরণ পর্যালোচনা করে ও তাদের জিনসের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে একগামিতা বা বহুগামিতার প্রবণতাও অনেক ক্ষেত্রেই পূর্বনির্ধারিত অর্থাৎ বিশেষ বিশেষ জিনসের কর্মকাণ্ডেই পরিচালিত। কখনো কখনো তা সামাজিকভাবেও অর্জিত। তাই এ ব্যাপারে একেক প্রাণীতে একেক ধরনের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।
তবে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, মানুষসহ যেসব প্রাণীর মধ্যে একগামিতা লক্ষ করা গেছে, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা রক্ত বা ‘জিনস’ দিয়ে পরিবাহিত নয়। পরিবেশগত কারণে ও সামাজিক প্রয়োজনে বা চাপে তারা একগামিতার চর্চা করে থাকে। প্রাণীকুলে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে দু রকম একগামিতা রয়েছে। ১. যৌন সংক্রান্ত বা বংশগত একগামিতা (জেনেটিক একগামিতা); ২. সামাজিক একগামিতা। এমন অনেক পশুপাখি আছে যারা যৌন আচরণে একগামী নয়। কিন্তু বাচ্চাদের রক্ষণাবেক্ষণে, গৃহনির্মাণে ও একসঙ্গে বসবাসে, চলাফেরা করার ক্ষেত্রে অর্থাৎ সামাজিকভাবে একগামী। ফলে সাধারণভাবেই প্রশ্ন এসেছে, একগামিতা কি তাহলে সমাজ ও পরিবারের স্বার্থে, জীবকুলের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে, আরো পরিষ্কার করে বললে সন্তানের কল্যাণের প্রয়োজনে, তার সুস্থ লালন-পালনের নিশ্চয়তা বিধানে পিতামাতার ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বা তাদের স্বেচ্ছায় ঘাড়ে নেওয়া একটি বাড়তি দায়িত্ব? এ ব্যাপারে বিভিন্ন প্রাণীর ওপর গবেষণা করে যা পাওয়া গেছে, তা সংক্ষেপে নিচে উল্লেখ করা হলো।
এক
স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোয় ওয়াবলার নামে একরকম পাখি রয়েছে যাদের মেয়ে- পাখিগুলো সেসব পুরুষ-পাখিকেই বেশি পছন্দ করে যারা বিভিন্ন সুরে নানারকম করে গান গাইতে পারে। কিন্তু যেসব পুরুষ-পাখির গানের স্টক খুব কম, মেয়েরা পারতপক্ষে তাদের সঙ্গে মেশে না। জেনেটিক বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব অতি সুরেলা বহুবিধ-গান-গাইয়ে পাখিগুলোর জিনস খুব মজবুত ও সেরা প্রকৃতির। এদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার ফলে যে সন্তানদের জন্ম হয়, জীবনের দৈর্ঘ্য ও অন্যান্য গুণগত বিচারে আসলেই তারা সেরা। ফলে মেয়ে-পাখিগুলো যদি একবার ওই সুরেলা ‘সুপার পুরুষ-পাখির সন্ধান পায়, তাহলে তারা একগামী থেকে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে যদি তারা ‘স্বল্পপুরুষ’ অর্থাৎ কেবল একটি বা দুটি-গান-গাইয়ে সঙ্গীর কবলে পড়ে, যাদের সঙ্গে নিকৃষ্টতর সন্তানের জন্ম দিয়ে থাকে তারা, তা হলে মেয়ে-পাখিদের চোখ সবসময় ঘুরে বেড়ায় আরো বেশি পুরুষালি স্বভাবের সুকণ্ঠ সেই সঙ্গীর সন্ধানে যাকে দিয়ে তাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জন্ম দেওয়া সম্ভব হবে। ফলে এখানে একগামিতা ও বহুগামিতা নির্ভর করছে কোন ধরনের পুরুষের সংসর্গে ছিল মেয়ে-পাখিটি। আর এর ভিত্তি হিসেবে মেয়ে-পাখির আকাঙ্ক্ষিত সুস্থ, সবল, দীর্ঘজীবী সন্তানের নিশ্চয়তাকেই চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা।
দুই
কাটা বা নষ্ট ফলের ওপর উড়ন্ত মাছিদের ভেতর একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। পুরুষ-মাছিগুলো নিজের বংশ বৃদ্ধির নিশ্চয়তা দিতে সঙ্গমের সময় বীর্যের সঙ্গে কিছু বিষাক্ত পদার্থ ঢেলে দেয় মেয়ে-মাছির শরীরে যা মেয়েটির কামস্পৃহা দাবিয়ে রাখে। শুধু তাই নয়, এই বিষ অন্য পুরুষ-মাছির শুক্রাণুকে ধ্বংস করে দেয়। সেইসঙ্গে মেয়ে- মাছিটিও কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি কৃত্রিমভাবে এ প্রজাতিকে একগামী করার একটা প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তারা জোড়ায় জোড়ায় এ মাছিদের ভিন্ন ভিন্ন পাত্রে রেখে কয়েক প্রজন্ম ধরে অনুসরণ করে দেখেছেন যে, এ বিশেষ প্রজাতির মাছিদের কোনোমতে যদি একগামী করা যায়, অর্থাৎ পুরুষ-মাছিদের যদি নিশ্চয়তা দেওয়া যায় যে তার নিজস্ব বংশেরই শুধু ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে তার সঙ্গিনী, অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে মিলিত হবে না, তা হলে তার বীর্যের ভেতর সেই বিষাক্ত পদার্থের পরিমাণ আস্তে আস্তে কমতে কমতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। অর্থাৎ একগামী সঙ্গীর বীর্যের প্রকৃতি বহুগামীর বীর্যের মতো হিংসুটে, স্বার্থপর, ক্ষতিকর ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির নয়। একগামী স্ত্রী-মাছিকেও দেখা গেছে তার একগামী সঙ্গীর (বহুগামী সঙ্গীর তুলনায়) প্রেম নিবেদন ও যৌন আচরণে অনেক বেশি উৎসাহী, আগ্রহী ও সক্রিয় হতে। একগামী মাছি-দম্পতির জীবিত সন্তানের সংখ্যাও গড়ে ২৮ শতাংশ বেশি বহুগামী দম্পতির তুলনায়।
তিন
ব্লু বার্ড বা নীল পাখির কথা অনেকেই জানেন। সামাজিকভাবে এরা জুটি বাঁধে খুব গভীরভাবে। নীড় রচনা, ডিমে তা দেওয়া, শিশুসন্তানকে সঙ্গ দেওয়া, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, খাবার যোগাড় করা, খাইয়ে দেওয়া——–—সব ব্যাপারেই এ দম্পতি পরস্পরকে সহযোগিতা করে। কিন্তু জেনেটিক বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এদের মধ্যে প্রায় শতকরা ১৫-২০ টি বাচ্চার সামাজিকভাবে স্বীকৃত পিতা আসলে জেনেটিক পিতা নয়। অর্থাৎ এত ঘনিষ্ঠতা, এরকম পারস্পরিক নির্ভরতা, একত্রে সন্তান লালন-পালন, চলাফেরার পরেও দেখা যায় স্ত্রী ব্লু বার্ড কখনোসখনো এদিক-সেদিকে নজর দিয়ে ফেলে। অবশ্য পুরুষ ব্লু বার্ডের যদি এ ব্যাপারে মনে কোনো সন্দেহ বিঁধে থাকে, যদি তার ধারণা হয়, এ ডিম বা শিশুপাখি তার নিজের সন্তান নয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সে পরিত্যাগ করবে সেই নীড়, তার সঙ্গিনী এবং সন্তানদের। এমনকি পরসন্তানদের কখনো কখনো মেরেও ফেলে সে। তবু জেনেটিক একগামিতা একেবারে পুরোপুরি না থাকা সত্ত্বেও সামাজিক একগামিতার যে-চিত্র দেখা যায় ব্লু বার্ডের সমাজে, তাকে বিজ্ঞানীরা এভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তারা দেখেছেন, প্রায় সব পাখিকুলেই এবং বিশেষ করে ব্লু বার্ড প্রজাতির ভেতর সন্তান লালন-পালনের জন্যে পিতামাতার উভয়ের অবদানই প্রয়োজন— অর্থাৎ দু জনের সক্রিয় ভূমিকাই দরকার। যেহেতু পাখিদের বাসা বাঁধতে হয়, ডিমে তা দিতে হয়, ছোট্ট শিশুদের খাবার যোগাড় করে এনে মুখে পুরে দিতে হয়, একা মায়ের পক্ষে সেটা করা সম্ভব হয় না। ফলে খুব নিবিষ্ট মনে তারা সন্তানের জন্য জুটি বাঁধে। এ জুটি মূলত সামাজিক জুটি। কিন্তু এরই মাঝে পুরুষ ব্লু বার্ড ফাঁকতালে অর্থাৎ মেয়ে ব্লু বার্ড খাবারের সন্ধানে গেলে কখনোসখনো পাশের বাড়ির মেয়ে সঙ্গিনীর সঙ্গে লীলাকলায় মেতে ওঠে। আর মেয়ে সঙ্গিনীও অনুরূপভাবে কখনো কখনো এখানে-সেখানে মন ও দেহ দেওয়া- নেওয়া করে আবার গুটিগুটি পায়ে ঘরে ফিরে আসে। দাম্পত্য জীবনের বাইরে এ ধরনের সম্পর্ক পুরুষ পাখি করে পুরুষ জাতির মৌলিক প্রবৃত্তি চরিতার্থ করতে অর্থাৎ যতগুলো সম্ভব ততগুলো সন্তান উৎপাদন করতে। কিন্তু মেয়ে-পাখিরাও কেন এমন করে ফেলে মাঝে মধ্যে? প্রথম প্রথম মেয়ে- পাখিগুলোর বহুগামিতাকে অন্য পুরুষ-পাখি কর্তৃক ধর্ষণ বলেই বিজ্ঞানীরা মনে করত। কিন্তু পরে দেখা গেল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্ত্রী পাখিদেরও এরকম সংক্ষিপ্ত সম্পর্কে সক্রিয় সমর্থন রয়েছে। অর্থাৎ এটি স্বেচ্ছাকৃতই। তা না হলে তারা ইচ্ছে করলেই অনাকাঙ্ক্ষিত বীর্য শরীর থেকে উপড়ে ফেলতে পারে। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হিসেবে বলা হয়েছে, মেয়ে-পাখিরা অন্য পুরুষের সঙ্গে সাময়িক এ সম্পর্ক করে বৈচিত্র্যময় প্ৰজন্ম সৃষ্টি করার জন্য যাতে তার প্রজাতির অস্তিত্ব বজায় থাকে। একই রকম সন্তান ধারণ করার ফলে যাতে কোনো প্রাকৃতিক বা পরিবেশগত পরিবর্তনে তার সম্পূর্ণ প্রজাতি একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে না যায়।
চার
ক্যালিফোর্নিয়ার একরকম ইঁদুর আছে যারা ভীষণভাবে একগামী। যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার অনেক আগে থেকেই তারা জুটি বাঁধে এবং আমৃত্যু এ জুটির বাঁধন অটুট রয়ে যায়। এই ইঁদুরকে বিজ্ঞানীরা বিরলের চেয়েও বিরল বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ প্রজাতির ভেতর পুরুষ-ইঁদুররা এতই দৃঢ়চেতা যে যৌনতাড়িত মেয়ে-ইঁদুররা পাশাপাশি ঘোরাঘুরি করলেও, যৌন আমন্ত্রণ জানালেও, নিজের সঙ্গিনীকে ছেড়ে সে ওইসব ডাকে কখনো সাড়া দেবে না। একই রকমভাবে একবার জুটি বাঁধার পর স্ত্রী-ইঁদুরটিও অন্য কোনো পুরুষ-ইঁদুরের দিকে ফিরে তাকায় না। এদের জীবনযাত্রা ও পরিবেশ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, এ বিশেষ ইঁদুরদের জীবন বড়ই সংগ্রামময়। খাদ্যের দারুণ অভাব। সর্বোপরি শীতকালে এত বেশি ঠাণ্ডা যে সেখানে সেই পাখিদের মতো এ ইঁদুরদেরও সার্বক্ষণিকভাবে নিজেদের শারীরিক উষ্ণতা দিয়ে সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখতে হয়। আর সেটা মা বা বাবা একার পক্ষে কোনোমতেই করা সম্ভব নয়। একজনকে সন্তানদের উষ্ণতা বিলাতে হলে আরেকজনকে যেতে হয় খাদ্যের সন্ধানে। আর তাই পাখির মতোই এ প্রাণীরাও জুটি বাঁধে। শুধু সামাজিক জুটি নয় যৌন জুটি বা জেনেটিক জুটিও বটে।
পাঁচ
সামাজিক ও জেনেটিক ভিত্তি ছাড়াও জুটি বাঁধার ‘নিউরোহরমোনাল’ একটি কারণ রয়েছে বলে ইদানীং বিজ্ঞানীরা কেউ কেউ মনে করছেন। তাঁরা ‘প্রেইরী’ ভোলস বলে একরকম ‘ছুঁচো’ জাতীয় প্রাণীর ওপর পরীক্ষা করে এ তথ্য বের করেছেন। এ প্রজাতির ভেতর পুরুষ ও স্ত্রী একবার জুটি বাঁধার পর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অসংখ্যবার যৌন মিলনে অংশগ্রহণ করে থাকে। এদের এ অতিরিক্ত যৌনক্রিয়া ও প্রগাঢ় জুটি বন্ধনের সম্পর্ক খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করলেন, অল্প সময়ের ভেতর এতবার যৌন মিলনের ফলে এদের উভয়ের শরীরের ভেতরেই এক বিশেষ রকম হরমোন নিৰ্গত হয়। পুরুষদের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত নির্গত এ হরমোনটি হলো ভেসোপ্রেসিন (পুরুষের আগ্রাসী স্বভাব ও পিতৃসুলভ আচরণের জন্য দায়ী হরমোন)। আর মেয়েদের মধ্যে নির্গত হরমোনটি হলো অক্সিটোসিন (যে হরমোন মাতৃত্বের বিকাশ ও দুগ্ধদানে সাহায্যকারী)। রক্তে এসব হরমোনের ঊর্ধ্বমাত্রাই পরস্পরের সঙ্গে জুটি বাঁধাকে এতটা মজবুত এতটা প্রগাঢ় করে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। মানুষ বা অন্য কোনো প্রাণীর শরীরেও যৌন মিলনের ফলে এ ধরনের কোনো রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে কি না, যা তাদের যুগলবন্দী রচনায় সহায়ক, তা এখন পর্যন্ত জানা যায় নি।
ছয়
বেশ কয়েক বছর আগে আমেরিকান এক নৃতাত্ত্বিক লক্ষ করলেন যে, বিবাহিত দম্পতির মধ্যে বিচ্ছেদের হার সবচেয়ে বেশি যাদের সাত বছরের অধিককাল হলো বিয়ে হয়েছে অথচ সন্তান হয় নি। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কও ঘটে এ সময়েই সবচেয়ে বেশি। তিনি আরো দেখলেন, যেসব দম্পতির প্রথম সন্তানের বয়স ছয় বা সাত পেরিয়ে যাবার পরও দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হয় নি, তাদের মধ্যেও বিচ্ছেদের হার খুব বেশি। অথচ পাঁচ বছরের মধ্যে যাদের আরেকটি সন্তান হয়েছে, তাদের বিয়ে ভেঙেছে খুব কম। অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রথমেই যেটা সাধারণভাবে মনে আসে তা হলো, সন্তান হয়তো একটি সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। দু জনের সম্মিলিত সৃষ্টি এ সন্তান হয়তো তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নত ও সুখকর করতে সাহায্য করে। কিন্তু এ নৃতাত্ত্বিকের মতে ব্যাপারটা অত সহজ নয়। সন্তান পিতামাতার সম্পর্কে এক ধরনের সেতুবন্ধন সৃষ্টি করে সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটাই শেষ বা একমাত্র কথা নয়। আসল কথা হলো জন্মের পর মানবশিশুর লালন-পালন ও পরিচর্যার প্রয়োজন হয় জীবজগতের অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ গবেষক উল্লেখ করেছেন, একজন ষাট কেজি ওজনের মায়ের নবজাত সন্তানের ওজন হয় মাত্র আড়াই থেকে সাড়ে চার কেজি। অর্থাৎ মানবশিশু তুলনামূলকভাবে আকৃতিতে অত্যন্ত ছোট ও কাঠামোগতভাবে বেশ নাজুক হয়ে জন্মায়। ফলে গরু, ছাগল, বাঘ বা কুকুরের বাচ্চারা জন্মের কয়েক মিনিট থেকে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই যেমন হেঁটে-চলে বেড়াতে পারে ও নিজে নিজে খেতে পারে, সেখানে মানবশিশুর লাগে বেশ কয়েক বছর সেই অবস্থায় পৌঁছাতে। আর তাই জন্মের প্রাথমিক বছরগুলোয় তাদের পরিচর্যায় এতটাই ব্যস্ত থাকতে হয় পিতামাতাকে যে, নিজেদের জীবনের অন্য সমস্যাবলি, অভাব অথবা দুর্বলতাগুলো ততটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না তখন। মোট কথা প্রকৃতিগতভাবে অসহায়, পরমুখাপেক্ষী ও নির্ভরশীল মানবশিশু পিতামাতাকে একত্র করে রাখে তার লালন-পালনের ব্যস্ততায়। এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে গবেষক বলেছিলেন, যখন থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে চার হাতে-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলার বদলে দু পায়ে নির্ভর করে লম্বা হয়ে চলতে শুরু করল মানুষ, তখন থেকেই হয়তো এ পরিবর্তনের সূচনা। কেননা পায়ের ওপর দণ্ডায়মান অবস্থায় সোজা হয়ে চলার জন্য মানুষের জরায়ুর আয়তন গেছে কমে। ফলে তাদের গর্ভজাত সন্তানের আনুপাতিক ওজনও হয় অন্যান্য জীবজন্তুর তুলনায় কম- যার জন্যই তারা অনেক বেশি নির্ভরশীল ও অসহায়। পরিশেষে বলা যায় :
১. প্রাণীকুলে একগামিতার প্রবণতা বা চর্চা স্বাভাবিক কোনো প্রক্রিয়া বা নিয়ম নয়। এটা ব্যতিক্রম।
২. একগামিতা (জেনেটিক না হলেও সামাজিক একগামিতা) সন্তানের জীবনরক্ষা, লালন-পালন ও কল্যাণের জন্যই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। যে-প্রজাতির শিশু যত অসহায় ও পিতামাতা উভয়ের ওপর যত নির্ভরশীল সে-প্রজাতির পিতামাতার জুটির বাঁধন তত মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী।
৩. প্রাণিজগতে বহুগামিতার ভিত্তি হিসেবে পুরুষদের দ্রুত বংশবৃদ্ধি ও মেয়েদের বৈচিত্র্যময় প্রজন্ম সৃষ্টিকে (যা পরবর্তী বংশধরদের টিকে থাকা বা প্রতিকূল পরিবেশে জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার নিশ্চয়তা দেয়) চিহ্নিত করা হয়েছে।
৪. মানুষের যৌনাচার বা যৌনপ্রবণতা অনেকটা নীল পাখিদের মতো। সামাজিক একগামিতা রয়েছে। কিন্তু মাঝে মধ্যে দৃষ্টি ও মনোযোগ এখানে-সেখানে নিবদ্ধ হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ও আগ্রহ। আমেরিকান এক বিজ্ঞানীর মতে, যুক্তরাষ্ট্রে যদি কখনো সঠিক পিতৃত্ব নির্ণয় করা হত, তাহলে দেখা যেত অন্তত ১০ শতাংশ সমাজিক পিতা তাদের সন্তানদের জেনেটিক পিতা নন।