নারীদেহে অপ্রয়োজনীয় ও বিপজ্জনক অস্ত্রোপচার

নারীদেহে অপ্রয়োজনীয় ও বিপজ্জনক অস্ত্রোপচার

নারীর যৌনতাকে নিয়ে পুরুষের বড় ভয়। ভয় নানা কারণে। প্রথমত নারীর যৌন আবেদন, তার শরীরের বিভিন্ন যৌন অনুষঙ্গ যতটা দৃশ্যমান, যতটা বিস্তৃত ও প্রচ্ছন্ন, পুরুষের তা নয়। নারীর স্তন, নিতস্ব, ওষ্ঠদ্বয় পুরুষদের প্রতিনিয়ত উন্মনা করে, উত্তেজিত করে, আকর্ষিত করে। এর থেকে নিস্তার পেতে এবং নারীকে ভোগের সামগ্রী ছাড়া অন্য কিছু ভাবার যৌক্তিকতা মনে ধারণ করতে পুরুষ বরাবরই আশা করেছে নারী তার যৌন আবেদনকে সবসময় পাহারা দেবে, লুকিয়ে রাখবে। এটা সম্পূর্ণই তার একক দায়িত্ব। নারীর যৌন আবেদনে পুরুষ যেন অবুঝ শিশুর মতোই সম্পূর্ণ অসহায় ও অন্ধ। দ্বিতীয়ত পুরুষ তার শারীরিক শক্তি, টেস্টোস্টারন হরমোন ও সবল মাংসপেশির জোরে যৌনতার ব্যাপারে বরবারই থাকে এক ভিন্ন অবস্থানে। প্রাণিজগতের অন্যান্য জীবের মতোই যৌনতার ক্ষেত্রে পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি, ভাবপ্রকাশ আচরণ ও ভূমিকা নারীর চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। নারীকে চিরাচরিতভাবে পুরুষ তার বিশেষ ও তীব্র এক ধরনের আনন্দের উৎস বলেই বিবেচনা করে এসেছে। অথচ এ বিষয়ে নারীর আগ্রহ, মতামত বা চাহিদার ব্যাপারে সে থেকেছে পুরোপুরি উদাসীন। যৌন উদ্যোগ ও আচরণে পুরুষ তাই সক্রিয় ও অগ্রণী। নারীকে থাকতে হয়েছে নীরব, প্যাসিভ সহযোগী হয়ে। তৃতীয়ত, পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পুরুষই যেহেতু সবকিছুর কর্ণধার, সর্বক্ষমতা ও সম্পদের অধিকারী, সর্ববিষয়ের সিদ্ধান্তদাতা, নারীকেও সে তার অন্যান্য সম্পদের মতোই নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। আর সেজন্যই বিভিন্ন সমাজে কালে কালে নারীর বিরুদ্ধে বহু অনিয়ম, বিকৃতি, নিষ্ঠুরতা, দৈহিক পীড়ন ও নারীদেহ বিকলাঙ্গ করার উদাহরণ রয়েছে।

রক্ষণশীল সমাজে একটি মেয়েকে যখন একটি পুরুষ নিজের ভোগের জন্য নির্বাচন করবে, সে-মেয়েটিকে হতে হবে ফুটন্ত ফুলের মতো পবিত্র, অনাঘ্রাত আছোঁয়া। একবার গ্রহণ করার পরও তার একনিষ্ঠ কর্তৃত্ব যাতে মেয়েটির ওপর বজায় থাকে তার নিশ্চয়তায় একেক সমাজে একেক ধরনের বাড়তি সংযোজন, বর্জন বা বিকৃতি হয়েছে নারীদেহে। পুরুষের সেই বহুবিধ দাবি পূরণ করতে কোনো কোনো সমাজে আজও বিভিন্ন ধরনের সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ও ভয়াবহ অস্ত্রোপচার করা হয় নারীর যৌন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। সমাজের, বিশেষ করে পুরুষের, প্রত্যাশা পূরণ করতে কখনো নারী করে তা স্বেচ্ছায়, কখনো পরিবারের মুখ রক্ষা করতে, কখনো সমূহ মৃত্যুর হাত থেকে অব্যাহতি পেতে। নিচে সংক্ষেপে এরকম দুটি অনর্থক অস্ত্রোপচারের উল্লেখ করা হলো। সমাজের অযৌক্তিক রীতিনীতি, প্রত্যাশার চাপে পড়ে নারীর শরীর কীভাবে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হচ্ছে, তারই দলিল এই অস্ত্রোপচার। (যদিও এ ধরনের রীতি আমাদের দেশে চালু নেই, তবুও আফ্রিকা এবং আরব দেশের মেয়েদের সামগ্রিক অবস্থান বোঝার জন্য এ তথ্য সাহায্য করতে পারে)।

১. মেয়েদের খৎনা : আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এবং কোনো কোনো আরবীয় অঞ্চলে মেয়েদের মধ্যে খত্না করাবার রেওয়াজ রয়েছে। এ পদ্ধতিতে একটি মেয়ে শিশু বা কিশোরীর যোনির বহিরাঙ্গে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ক্লাইটরিস ও তার আশপাশের অংশবিশেষ পুরোপুরি বা আধাআধি কেটে ফেলে দেওয়া হয়। এটি একটি সামাজিক নিয়মে পরিণত হলেও এর উৎস এবং কারণ সম্পর্কে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। জর্ডান বলে এক বিজ্ঞানী এক সময় প্রচার করেছিলেন, ছেলেদের খত্নার মতোই এটি মুসলমান ধর্মের গৃহীত একটি পদ্ধতি। তাঁর মতে ইসলামের আবির্ভাবের সময় থেকে এই নিয়ম প্রচলিত। কিন্তু পরবর্তীকালে গডউইন মেনিরু এবং অন্যান্য বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক একমত হয়েছেন যে, এ রীতির উৎপত্তিকে কোনো বিশেষ ধর্ম, বর্ণ, দেশ বা সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায় না। ইসলামের আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই এর প্রচলন ছিল এবং যেসব জায়গায় ইসলাম প্রচার হয় নি সেসব অনেক জায়গাতেও এ রীতি বহাল রয়েছে। নাইজেরিয়া ও সোমালিয়ায় এর প্রচলন সবচেয়ে বেশি। এ পদ্ধতি সংযোজনের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, মেয়েরা যাতে যৌনানন্দ ভোগ করতে না পারে এ জন্যই এ পদ্ধতির উৎপত্তি ঘটেছিল। যৌন-আস্বাদ গ্রহণ করতে সক্ষম নারী যদি অন্য পুরুষে মনোযোগ স্থাপন করে, এ আশঙ্কায় সমাজ তাকে নিশ্চিত বেঁধে দিতে চেয়েছে তার দায়িত্ব বা কর্তৃত্ব গ্রহণকারী কোনো পুরুষের সঙ্গে। আফ্রিকার ২৮টি দেশে এই ভয়াবহ ও নিষ্ঠুর রীতিটি চালু রয়েছে। প্রায় বিশ লাখ নারীকে প্রতি বছর এই অমানবিক অস্ত্রোপচারের শিকার হতে হয়। বহু আন্তর্জাতিক নারীসংস্থা, চিকিৎসক সমিতি, সামাজিক সংগঠন, সামাজিক সংগঠন, সংবাদমাধ্যমের সমালোচনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মেয়েদের ওপর এই খত্না পুরোদমে চলছে বহু দেশে। ১৯৯৪ সালে কায়রোতে অনুষ্ঠিত আইসিপিডি সম্মেলনে মেয়েদের খত্নাকে মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ ও ভয়ঙ্কর বলে অভিহিত করে সত্ত্বর এর পরিসমাপ্তি দাবি করা হয়েছে। এই ভয়াবহ পদ্ধতি প্রয়োগে শুধু যে মেয়েরা যৌন আনন্দ গ্রহণ করতে অসমর্থ হচ্ছে অথবা তীব্র ব্যথা বা অন্য জটিলতায় সহজ যৌন জীবনযাপন করতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তাই নয়, এই অস্ত্রোপচারের ফলে অতিরিক্ত রক্তপাত বা সংক্রামক রোগের ছড়াছড়িতে অনেক মেয়ে মারাও যায় বা সারাজীবনের জন্য পঙ্গু বা কর্মে অনুপযোগী হয়ে পড়ে। গর্ভাবস্থায় চিকিৎসা সেবা পেতেও তাদের অসুবিধা হয়। প্রসবকালীন বিভিন্ন রকম সমস্যাও দেখা দেয়। আমেরিকার বিখ্যাত জার্নাল ‘আমেরিকান জার্নাল অফ অবস্ট্রেটিক্স অ্যান্ড গাইনোকলজি’তে এ ধরনের বেশকিছু কেস স্টাডি দেওয়া হয়েছে। আফ্রিকা থেকে আমেরিকায় আগত ইমিগ্রেন্টদের প্রসবকালীন অনেক জটিলতার মধ্যে অন্যতম হলো সিজারিয়ান সেকশনের প্রকোপ। মেয়েদের খৎনা এর জন্যে বিশেষভাবে দায়ী। ডাক্তারদের মতে, এই খত্নার ফলে মেয়েদের গোপনাঙ্গের মাংসপেশী এমন খাবলা খাবলা করে উপড়ে ফেলা হয় যে, অবশিষ্ট অংশ একটির সঙ্গে আরেকটি বেখাপ্পাভাবে জোড়া লেগে যৌনাঙ্গের এক বীভৎস চেহারা নেয় এবং তা তার স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক কার্যকলাপে বাধা দেয়। ডাক্তারদের জন্যে গর্ভাবস্থায় সন্তানের অবস্থান যাচাই করার মতো পরিবেশও সেখানে আর থাকে না। একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ছত্রিশ বছর বয়স্ক এক সুদানিজ মহিলা আমেরিকার ডাক্তারের কাছে এসেছিলেন তার তৃতীয় সন্তান জন্মবার আগে। তার আগের দুটো সন্তান সিজারিয়ান পদ্ধতিতে সুদানেই হয়েছে এবং এ জন্য শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে যথেষ্ট গালমন্দ খেতে হয়েছে বউটিকে। তাদের ধারণা, তাদের পুত্রবধূ অত্যন্ত দুর্বল মানসিকতার মানুষ, তাই স্বাভাবিক প্রসব ঘটে নি। এবার সে তাই আগেভাগেই চলে এসেছে আমেরিকা, যোনিপথে প্রসবের আশায়। ডাক্তারা তো তার যৌনাঙ্গ দেখে হতবাক। প্রসব করাবেন কী, একে পরীক্ষা করাও তো দুষ্কর। ডক্টর বেকার মহিলার ওপর আরেকবার অস্ত্রোচার করে তার স্কার টিস্যুগুলোকে আস্তে আস্তে সরিয়ে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা ও সন্তান প্রসবের ব্যবস্থা করেন। যথাসময়ে তার একটি সুস্থ সন্তান জন্ম নেয় যোনিপথে।

কিন্তু আফ্রিকার কোনো কোনো গ্রামাঞ্চলে যেখানে স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা আমাদের দেশের মতো বা তার চেয়েও খারাপ, সেখানে কত মা না জানি শুধু খত্নার মতো এ অনর্থক অস্ত্রোপচারের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। প্রসবপথ এলোপাথাড়ি স্কার টিস্যু দিয়ে দুর্গম হওয়ায় স্বাভাবিক প্রসব অনেক সময় দুরূহ হয়ে পড়ে। অথচ যথাসময়ে সিজারিয়ান করাও সব সময় হয়ে ওঠে না। এ জন্যও হয়তো অনেকে মারা যান। নাইজেরিয়ান ইবো, গোষ্ঠীর মধ্যে ৪৫ বছরের ঊর্ধ্বে মহিলাদের সবারই খৎনা করা রয়েছে। ছয় বছরের নিচে মেয়েদের মধ্যে এর হার ১৬.৫%। শতকরা ২০ জন মেয়ে এই অস্ত্রোপচারের ফলে কোনো না কোনো মারাত্মক জটিলতার শিকার হচ্ছে। তবু আজও আন্তর্জাতিক তীব্র বিরোধতার মুখেও দু ডজনের বেশি দেশে এ অমানবিক রীতি চালু রয়েছে।

২. সতীচ্ছদ মেরামত করার অস্ত্রোপচার : গত কিছুদিন ধরে মিসরের এক অন্যতম প্রধান ব্যবসা হলো সতীচ্ছদ মেরামত করার অস্ত্রোপচারের সেবাদান। আরব দেশগুলো থেকে বহু নারী আসে এখানে এ জরুরি কাজটি সেরে নিতে। বিয়ের রাতে রক্তে ভেজা চাদর না দেখাতে পারলে বিয়ের লগ্নে বধূর কুমারীত্ব প্রমাণিত হয় না এখানে। একবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় দাঁড়িয়েও এই অতি প্রাগৈতিহাসিক রীতিটি চালু রয়েছে ওসব দেশে। বিয়ের সময় মেয়ে কুমারী ছিল না, এ সত্য উদ্ঘাটন হলে পরিবারের মাথা শুধু হেঁট হয়ে যায় না, এ বিশাল পারিবারিক লজ্জা ও অপমানের প্রায়শ্চিত্ত করতে এবং অবশিষ্ট পারিবারিক সদস্যের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার স্বার্থে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যভিচারী সদ্য বিবাহিত মেয়েটিকে তার ভাই বা বাবা নিজ হাতে খুন করেন। কখনো কখনো জেলে যাবার ঝুঁকি নিয়েও সমাজের প্রত্যাশা পূরণে তারা সেটা করেন। তাই অকুমারীটি কুমারী সাজার জন্য যদি সতীচ্ছদ জোড়া লাগাবার আশায় দেশান্তরে ছোটে, অবাক হবার কিছু নেই। মিসরে মেডিক্যাল এসোসিয়েশন তাদের সদস্যদের এ ধরনের অস্ত্রোপচার করতে বারণ করেছে। কেননা ডাক্তারি শাস্ত্রমতে এটি অনৈতিক এবং অপ্রয়োজনীয়। মিসরের স্বনামধন্য আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় এ ধরনের অপারেশনের বিরোধিতা করেছে। কেননা এটা ‘পরিপূর্ণ ঠকানো বা ‘বাটপাড়ি করা’। কিন্তু আসল কথা হলো, এই অস্ত্রোপচার চালু হবার পর আরব দেশে পূর্বে উল্লিখিত ‘পবিত্রতার জন্যে খুনের’ পরিমাণ ৮০% কমে গেছে। এই অস্ত্রোপচারের সময় সার্জন ছিঁড়ে যাওয়া সতীচ্ছদের বাকি অংশ টেনে এনে সম্পূর্ণটা আবার জুড়ে দেন। সেইসঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি টকটকে লাল রং ভর্তি ক্যাপসুলও ঢুকিয়ে দেন যোনিপথে যা প্ৰথম সহবাসে সহজেই ফেটে গিয়ে রক্ত হয়ে ঝরে পড়বে। স্বামী সেই রক্তে ভেজা রুমাল বা বিছানার চাদর গর্বের সঙ্গে বাসরঘরের বাইরে অপেক্ষারত কৌতূহলী গ্রামবাসীদের হাতে ছুঁড়ে মারবেন। কুমারীত্বের পরীক্ষায় পাস করে যাবে মেয়েটি।

একটি নিবন্ধে জানা গেছে, এ ধরনের সার্জারির চাহিদা মিসরের গ্রামের মেয়েদের মধ্যেও কম নয়। সামিয়া সালাত বলে এক মিসরীয় ডাক্তার জানিয়েছেন, তাঁর এক গ্রামের রোগী বিয়ের পরও দীর্ঘদিন স্বামী সহবাস থেকে বিরত থেকেছেন স্রেফ পাগল সেজে থেকে। আসলে রোগীটি অপেক্ষা করছিলেন একটা সুযোগের জন্য, সেই ফাঁকে এসে তিনি এই জরুরি অস্ত্রোপচারটি করিয়ে নিতে পারবেন।

এই বিশেষ সার্জারি নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে পশ্চিমা জগতে অনেক তর্ক- বিতর্ক, তোলপাড় চলছে। প্রশ্ন উঠেছে আমেরিকা বা হল্যান্ডের মতো দেশে এ ধরনের অপ্রয়োজনীয় একটি অস্ত্রোপচার সার্জনরা করবেন কি না। এটা করা আদৌ ন্যায়সঙ্গত কি না। অথচ আরব দেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের অধিবাসীরা যারা পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে জীবনযাত্রার প্রতিপদে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বে ভুগছেন, তাদের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক জীবনের কথা চিন্তা করে তাদের এ অনুরোধ উপেক্ষা করাও কতটা যুক্তিসঙ্গত হবে সেটাও ভেবে দেখা দরকার। নৈতিকতার প্রশ্নে ডাক্তার সমাজ দ্বিধাবিভক্ত। যাঁরা এই ঐচ্ছিক অস্ত্রোপচারের বিরোধিতা করেন তাঁরা বলেন, এটি সুচিন্তিতভাবে লোক ঠকানো। যা সঠিক নয়, সত্য নয় সেটা প্রমাণ করতে এবং অন্যকে ধোঁকা দিতে চিকিৎসক সমাজ এগিয়ে আসতে পারে না। অন্য দল যাঁরা এই অস্ত্রোপচারের প্রতি সমব্যথী তাঁরা বলেন, ডাক্তারের প্রধান দায়বদ্ধতা ও কর্তব্য তার রোগীর প্রতি। সেটা শুধু তার শারীরিক সুস্থতার ব্যাপারে নয়, মানসিক প্রশান্তি ও কল্যাণের জন্যও বটে। রোগী যদি চায় অথবা তার জীবনের মান উন্নয়নে, বিশেষ করে তার জীবন রক্ষায়, এ অস্ত্রোপচার যদি সহায়তা করে, এটা অবশ্যই করা দরকার।

এ প্রসঙ্গে আরো একটা তথ্য দিয়ে রাখা ভালো। যেসব মেয়ে এ বিশেষ সার্জারির জন্য সার্জনদের কাছে আসেন, তাঁদের ৫০% বলেছেন, তাঁদের কুমারীত্বের অবসান ঘটেছে ধর্ষণের মাধ্যমে এবং তার অধিকাংশই ঘটেছে পারিবারিক সদস্যের দ্বারা। ডাক্তাররা এর সত্যতা বিচার করতে পারেন নি। ব্রিটিশ জার্নাল অফ মেডিসিনের সূত্র ধরে জানা যায়, যদি কিছু কিছু মেয়ে এ ব্যাপারে মিথ্যা বলেও থাকে, তবু কিশোরী ও বালিকাদের ওপর এ ধরনের বলাৎকারের ধর্ষণ ঘটনা রক্ষণশীল সমাজে বা পরিবারে হয়তো যথেষ্টই বিদ্যমান। এ ব্যাপারটিও আরো তলিয়ে দেখা দরকার। এ বালিকাদের আত্মরক্ষার উপায় ও কৌশল শেখানোই উচিত অভিভাবকের প্রধান কাজ। হয়তো অনেক সতীচ্ছদই অক্ষত থেকে যেতে পারে তা হলে।

সবশেষে ডাক্তারদের অভিমত—সতীচ্ছদ মেরামত নয়, ব্যক্তিমানসিকতার পরিবর্তন এবং সমাজ-বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার ক্ষমতা অর্জনই এর সমাধান। শিক্ষার প্রসার ও সচেতনতা বৃদ্ধির বিভিন্ন প্রয়াসেই তা সম্ভব। সেইসঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, সতীচ্ছদ শুধু যৌনমিলনের কারণেই ছিঁড়ে যায় না, খেলা, দৌড়ঝাঁপ, ট্যাম্পন ব্যবহারেও তা ঘটতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আপনাআপনিও তা ছিঁড়ে যেতে পারে। এই বিশেষ পর্দাটির অস্তিত্ব আছে বলেই নারীকে তার কুমারীত্বের অগ্নিপরীক্ষা পার হয়ে একজনের জীবনসঙ্গী হতে হবে, এর কোনো মানে হয় না। একইরকমভাবে কিন্তু কোনো পরীক্ষা পুরুষকে দিতে হয় না। শত নারীর সঙ্গসুখ উপভোগ করেও পরিপূর্ণ কুমার সেজে অনায়াসে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে পারে সে। কোনো চিহ্নই থাকে না। অথচ অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, মানুষ হিসেবে, জীবনসঙ্গী হিসেবে একজন নারীর মূল্যায়নে বা নির্বাচনে কুমারীত্বকে আজো দুঃখজনকভাবে প্রধান বিবেচনায় রাখা হয়।

এ দুটি অস্ত্রোপচার ছাড়াও নারীদেহে প্রতিদিন বহু অপ্রয়োজনীয় সার্জারি করা হচ্ছে। অনবরত চলছে প্রত্যঙ্গচ্ছেদ। নিরাপদ মাতৃত্বের নামে কত যে অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান করা হচ্ছে জগৎজুড়ে, তার হিসেব নেই। অর্থের লোভে ও মানুষের সন্তানের ব্যাপারে দুর্বলতা (বিশেষ করে অনেক সাধ্যসাধনার পর যে শিশুর জন্ম) ও অহেতুক ভয়কে পুঁজি করে পৃথিবীজোড়া এক বিশাল ব্যবসায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে স্বাস্থ্যব্যবস্থা। অথচ যাদের সত্যিকার অর্থেই প্রয়োজন সিজারিয়ান, যাদের অবস্থা এই অপারেশন ছাড়া মরণাপন্ন, তারা কিন্তু অনেকেই পাচ্ছে না এই প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা। সিজারিয়ান সেকসনের পুরো ব্যাপারটাকেই ইচ্ছাকৃতভাবে রহস্যাবৃত (মিস্টিক) করে রাখা হয়েছে। কোনো কোনো নারী তার এই অক্ষমতাকে (যোনিপথে প্রসবে ব্যর্থতা) নিয়ে গর্ববোধও করে। তার কাছে মনে হয় তার তারুণ্য ও যৌন আবেদনের প্রতীকই এই সিজারিয়ান। আসলে এটা অনেকেই জানেন না যে শরীরের কাঠামোগত কারণে সিজারিয়ানের প্রয়োজনীয়তা হয় খুবই কম। বেশিরভাগ সময়েই এটা হয় শেষ মুহূর্তে শিশুর অবস্থান পরিবর্তনের কারণে অথবা অন্য কোনো জটিলতার আবির্ভাবে। আর কাঠামোগত কারণে যখন সেটা হয়ও, প্রধানত তা হয় পেলভিক হাড়ের গড়নের জন্যে— মাংসল কোনো অঙ্গের যেমন জরায়ু বা যোনির ইলাসটিসিটি বা অন্য কোনো গুণাগুণের জন্যে নয়। একবার সিজারিয়ানে বাচ্চা প্রসব করলে পরবর্তী প্রসবেও সেভাবেই তা ঘটতে হবে, ডাক্তারদের এককালের এই মতামতকেও আর গ্রাহ্য করা যাচ্ছে না। পশ্চিমের দেশগুলোতে এখন দ্বিতীয় বা তৃতীয় সন্তানকেও স্বাভাবিকভাবে প্রসব করানো হয়, প্রথম বা দ্বিতীয় সন্তান সিজারিয়ানে হওয়া সত্ত্বেও। এদেশেও এই ধরনের মনোভাব ও চর্চা প্রসার পাবে বলে আমরা আশা করব। প্রয়োজনে সিজারিয়ান অপারেশন জীবনরক্ষাকারী একটি পদক্ষেপ। সেটা সেভাবেই সংরক্ষিত থাক। ব্যথাহীন প্রসব, প্রসব-প্রস্তুতিপর্বের সুবিধে এবং ডাক্তার বা ক্লিনিকের আর্থিক লাভ যেন এর কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। অযথা একটি নারীর দেহেও যেন কখনো অস্ত্রোপচার না ঘটে, বিশেষ করে স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় তার পরিহার সম্ভব হলে।

এ ছাড়া কথায় কথায় হিস্টারেক্টমি (জরায়ু ফেলে দেওয়া), জোর করে স্টেরিলাইজেশন (বন্ধ্যাত্বকরণ), অপ্রয়োজনীয় এপিসিওটমি (প্রসবের সময় যোনি ও মলদ্বারের মাঝখানটা কেটে ফেলে সন্তান প্রসবের সহায়তা করা), স্তনক্যান্সারে ক্যান্সারের অংশটুকুর পরিবর্তে প্রায় সর্বদাই পূর্ণ মাস্টেক্টোমি (স্তন ফেলে দেওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বিশেষ করে নারী যদি যৌবনাতিক্রান্ত হয়, তার সন্তান ধারণের প্রয়োজনীয়তা যদি আর না থাকে, তাহলে তার শরীরের এই বিশেষ দুটি প্রত্যঙ্গ অর্থাৎ স্তন ও জরায়ু যেন গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে সমাজের চোখে। শুধু শারীরিক ব্যথা, অস্বাচ্ছন্দ্যই নয়, জরায়ুহীন বা স্তনহীন একটি নারী যে প্রবল মানসিক যন্ত্রণার ভেতর বসবাস করে তার খবর কে রাখে? ভাবখানা এমন যে নারীদেহ যদি কেবল সন্তান বানাবার যন্ত্র ও সন্তানের খাদ্য যোগাবার বস্তু না হয়ে থাকে, তাহলে তা শুধুই পুরুষের আনন্দ যোগাবার রসদ। প্রৌঢ়া ও বৃদ্ধা নারী যেহেতু পুরুষের নজর কাড়তে ততটা সফল নয়, তার এই প্রত্যঙ্গগুলো তাই তখন মূল্যহীন ও অবহেলিত হয়ে পড়ে সমাজের চোখে। অনেক নারীই তার জীবনচক্রের এই স্বাভাবিক গতিকে, ধীরে ধীরে বার্ধক্যের দিকে এগুনোকে মানতে পারে না। কোনো কোনো নারী আবার তার ওপর পুরুষ- আরোপিত সেই বিশেষ ভূমিকায় নিজেকে সম্পূর্ণ উৎসর্গীকৃত করে স্তন উত্তোলন ও বর্ধনে চামড়া কেটে বুকের ভেতর সিলিকা জেলের ব্যাগও ঢুকাচ্ছে, একটি সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় ও মারাত্মক (সিলিকা জেল শরীরে শোষিত হয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া করতে পারে) অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে।

শেষ হোক নারীদেহের ওপর অমানবিক, অপ্রয়োজনীয় এ ধরনের সকল উৎপাত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *