অফুরন্ত যৌবনের সন্ধানে

অফুরন্ত যৌবনের সন্ধানে

চিরস্থায়ী যৌবনের আকাঙ্ক্ষা মানুষের চিরন্তন। যৌবন সে-অর্থে কোনো অর্জন নয়। তবু কোনো প্রচেষ্টা ছাড়াই প্রাকৃতিক উপায়ে লব্ধ যৌবনকে আজীবন ধরে রাখার জন্য কি সাংঘাতিক ও প্রাণপণ লড়াই-না করে যাচ্ছে মানুষ সেই আদিকাল থেকে। মৃত্যুর অনিবার্যতার মতো যৌবনের অবসানও অমোঘ বুঝতে পারার পরও অন্তত এ তারুণ্যকে প্রলম্বিত করার চেষ্টার ঘাটতি নেই তার। অনবরত সে খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই মহৌষধ বা কলাকৌশল যার মাধ্যমে বয়সকে ঢেকে অথবা অস্বীকার করে যৌবনের দেহাবরণে অন্যের সামনে সে আবির্ভূত হতে পারবে। মহাভারতে আছে মহারাজ যযাতি তাঁর অসীম কামস্পৃহা চরিতার্থ করার জন্য নিজের কনিষ্ঠ পুত্র পুরুর কাছ থেকে এক হাজার বছর তারুণ্য ধার করেছিলেন। কিন্তু এক হাজার বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও তাঁর যৌনতাড়না প্রশমিত হয় নি উপলব্ধি করে যযাতি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, অনিয়ন্ত্রিত কাম-কাতরতা আগুনে ঘি ঢালার সমকক্ষ, যা কেবল বেড়েই চলে, নেভার ধার ধারে না। গ্রিক পুরাণে আছে, ইয়স তার প্রেমিক রাজকুমার টিথোনাসের জন্য অমরতা প্রার্থনা করেছিল দেবতা জিউসের কাছে। জিউস ইয়সের প্রার্থনা মঞ্জুর করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে (নাকি আফ্রোদিতের অভিশাপের ফলে?) ইয়স টিথোনাসের জন্য চিরস্থায়ী যৌবনের প্রার্থনা করতে ভুলে গিয়েছিল। ফলে টিথোনাস অমর হলো ঠিকই, কিন্তু জবুথবু বৃদ্ধ হয়ে বেঁচে থাকল। আর ইয়স, যে আফ্রোদিতের প্রেমিককে ভাগিয়ে তার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করার অপরাধে আফ্রোদিতের অভিশাপের শিকার হয়ে অনবরত কেবল তরুণ প্রেমিক খুঁজে বেড়ায়, শিগগিরই বৃদ্ধ টিথোনাসের প্রতি বিরক্ত হয়ে পড়ল। সে রাগে, বিরক্তিতে, ঘেন্নায় টিথোনাসকে লুকিয়ে রাখল ক্লজেটের ভেতর, যেখানে টিথোনাস একদিন ফড়িংয়ে রূপান্তরিত হয়ে গেল। আর আইরিশ পুরাণে রয়েছে অফুরন্ত যৌবনের দেশ তীর-না-নগের কাহিনী। আয়ারল্যান্ডের অয়সিন একদিন বনে শিকার করতে গিয়ে সাক্ষাৎ পায় সুন্দরী স্বর্ণকেশী নিয়ামের। তারা তাৎক্ষণিকভাবে প্রেমে পড়ে যায় এবং নিয়াম তার জাদুর ধবল ঘোড়াতে চড়িয়ে অয়সিনকে নিয়ে আসে তীর-না-নগে। অফুরন্ত যৌবনের দেশ তীর-না-নগ। সেখানে অয়সিন তিন শ’ বছর ধরে সুখে আনন্দে জীবন কাটায় নিয়ামের সঙ্গে। তার একদিনও বয়স বাড়ে না, যেমন বাড়ে না নিয়াম অথবা তীর-না-নগের অন্য বাসিন্দাদের। কিন্তু তবু, দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অস্থির, উন্মনা হয়ে পড়ে অয়সিন। তার মাতৃভূমি, নিজের পরিচিত পরিবেশের জন্য সে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। নিয়াম বুঝতে পারে অয়সিনের অবস্থা সমব্যথী হয়ে সে অয়সিনকে তার জাদুর শ্বেত ঘোড়াটিতে চড়িয়ে আয়ারল্যান্ডে পাঠায়। যাওয়ার সময় নিয়াম সাবধান করে দেয় কখনও যেন আয়ারল্যান্ডের মাটি স্পর্শ না করে অয়সিন। যদি করে, তাহলে আর কোনোদিন এ অফুরন্ত যৌবনের স্বপ্নময় দেশে ফিরে আসতে পারবে না সে। অয়সিন ফিরে আসে তিন শ’ বছর পর তার নিজস্ব ভূমিতে। কিন্তু সেখানে এসে সে যা দেখে, তা আদৌ সুখকর নয়। তার পরিচিত সবাই মারা গেছে এবং তাদের গোষ্ঠী ও বংশধরদের কথা কেউ কেউ হয়তো কেবল কল্পকাহিনীর মতো কোনোমতে মনে করতে পারছে। অয়সিনের এসব দেখেশুনে ভালো লাগল না। সে তীর-না-নগে তার প্রেয়সীর কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু ফেরার পথে কয়েক জন লোককে বহু কষ্ট করে একটি বিরাট ও ভারী পাথরখণ্ড সরাতে দেখে সে। অয়সিন যেই তাদের সাহায্য করার জন্য পাথরে হাত লাগিয়েছে, অসাবধানতাবশত ঘোড়া থেকে তার পা-খানি সরে গিয়ে মাটি স্পর্শ করে ফেলে। আর সঙ্গে সঙ্গে এ মরণশীল দুনিয়ার আবার ফিরে আসে অয়সিন। সে দেখে—সে আর যুবক নেই, একজন অতি বৃদ্ধ ও অন্ধ লোক হয়ে গেছে।

যৌবনের জন্যে হা-পিত্যেশ শুধু বিভিন্ন সংস্কৃতির পুরাণ-কাহিনীতেই সীমাবদ্ধ নয়। জানা যায়, ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকায় দ্বিতীয়বার যাত্রার সফরসঙ্গী হুয়ান পন্স ডি লিয়নও সারা জীবন খুঁজে বেড়িয়েছেন সেই জাদুময় যৌবনের ফোয়ারাকে যার জল পান করলে বা সেই জলে স্নান করলে মানুষ চিরস্থায়ী যৌবন লাভ করবে। পঞ্চদশ শতাব্দীর অভিযাত্রিক লিয়ন স্পেনের সেই বিখ্যাত ঔপনিবেশিক শক্তি যিনি জীবিতাবস্থায় দক্ষিণ স্পেনে অগুণতি মুসলমান নিধন করতে যেমন পিছপা হন নি, আমেরিকায় এসে সেখানকার মাটিতে স্পেনের আধিপত্য বিস্তার করার জন্য স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ানদের কচুকাটা করতেও দ্বিধা করেন নি। তা সত্ত্বেও এসবের মাঝে মাঝে এবং জীবনের শেষ পর্যায়ে প্রায় সবটা সময়ই তিনি কাটিয়েছেন আমেরিকার দক্ষিণ- পূর্ব দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে সেই কাল্পনিক বামিনী দ্বীপ আবিষ্কারের নেশায়, যে দ্বীপে অত্যাশ্চর্য সেই যৌবনের ফোয়ারা আছে বলে তিনি শুনেছেন— যার প্রভাবে অফুরন্ত যৌবন লাভ সম্ভব। বলা বাহুল্য, স্পেন সরকারের দেয়া নৌবহর ও আর্থিক সহযোগিতা পাওয়া সত্ত্বেও লিয়নের পক্ষে সেই বামিনী দ্বীপ বা চিরন্তন যৌবনের ফোয়ারা আবিষ্কার সম্ভব হয় নি। বরং ফ্লোরিডায় রেড ইন্ডিয়ানদের সঙ্গে যুদ্ধে আহত হয়ে শেষ পর্যন্ত কিউবায় গিয়ে মারা যায় লিয়ন। লিয়নের সেই জাদুময় যৌবন-ফোয়ারাকে ভিত্তি করে রন হাওয়ার্ডের ছবি ‘কোকুনে’ও দেখা যায় কিছু বৃদ্ধ অনা গ্রহের অধিবাসীদের মধ্যস্থতায় এক বিশেষ সুইমিং পুলে সাঁতার কেটে যৌবন ফিরে পায়। কিন্তু তাদের আসল অগ্নিপরীক্ষা শুরু হয় যখন তাদের কাছে কেবল দুটি পথ খোলা থাকে হয় চিরঞ্জীব হয়ে অফুরন্ত যৌবন ভোগ করবে, কিন্তু সে ক্ষেত্রে ভিন্ন গ্রহে চলে যেতে হবে; অথবা পৃথিবীতে নিজ পরিবারের সঙ্গেই থাকবে কিন্তু যৌবনকে ফিরিয়ে দিতে হবে এবং সময়মতো মৃত্যুকেও মেনে নিতে হবে। এ হলো মানবজন্মের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। একদিকে জীবন ও তারুণ্যের দুর্নিবার স্পৃহা, সেইসঙ্গে অমোঘ নিয়ম—বার্ধক্য ও মৃত্যুকে মেনে নেয়ার মানসিকতা অর্জন। তারুণ্যকে ধরে রাখা, নিদেনপক্ষে দীর্ঘায়িত করার জন্য আদিকাল থেকে মানুষ নানারকম ব্যবস্থা কলাকৌশল, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আসছে। গাছগাছালি থেকে আহরিত নির্যাস থেকে শুরু করে নানারকম প্রসাধনী সামগ্রীর ব্যবহার এমনকি প্লাস্টিক সার্জারি করেও জীবন থেকে কয়েকটি বছর ছেঁটে ফেলার চেষ্টা করে মানুষ। আর এ অদম্য স্পৃহাকে কেন্দ্ৰ করে জগৎজুড়ে চলছে কতরকম ব্যবসা! ভিটামিন-মিনারেলের ব্যবসা তো রয়েছেই। নানারকম লতাগুল্মের তৈরি ওষুধ, বিশেষ বিশেষ খাদ্য বা মশলা, চামড়ার তারুণ্য ও মসৃণতা রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ক্রিম ও মেকআপ, হাকিমী দাওয়া, কবিরাজি ও আয়ুর্বেদিক ওষুধের ছড়াছড়ি বাজারে। এই বয়স-না-বাড়ার প্রতিযোগিতাকে আবার একটু বেশি মাত্রায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে নারীর ওপর। আদিকাল থেকে সব সমাজেই নারীর যে দুটি বৈশিষ্ট্য সবচেয়ে জরুরি, সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বলে বিবেচিত হয় পুরুষের কাছে, তা হলো নারীর দৈহিক সৌন্দর্য ও তারুণ্য। অন্যদিকে পুরুষের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য, শারীরিক সামর্থ্য ও পার্থিব যোগ্যতা সবচেয়ে বড় বিবেচনার বিষয়।

তবে তারুণ্য, রোমান্স, যৌনতা— এসবই নারী-পুরুষ নির্বেশেষে নিয়ন্ত্রিত হয় অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে, প্রধানত মেয়েলি হরমোন এস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন এবং পুরুষালি হরমোন টেস্টোস্টারনের সরাসরি প্রভাবে। হরমোন হলো এক রকমের রাসায়নিক পদার্থ যা শরীরে বিশেষ কোনো অঙ্গ বা গ্ল্যান্ড থেকে খুব নিয়মমাফিক ও নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে নিঃসৃত হয় রক্তে। রক্তের ধারা সেই হরমোনদের যথাসময়ে পৌঁছে দেয় নির্দিষ্ট অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। সেখানে গিয়ে তারা নানাধরনের শারীরিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। হরমোন সরবরাহ করে তারুণ্য বজায় রাখা তাই নতুন কোনো ঘটনা নয়।

আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে বিজ্ঞানীরা দেখলেন, যে-সব মেয়ের শরীরে এস্ট্রোজেনের মাত্রা বেশি তাঁরা বয়স হলেও দেখতে অপেক্ষাকৃত তরুণ থাকেন, আর যাঁদের শরীরে এস্ট্রোজেনের মাত্রা কম, তাঁদেরকে বয়সের তুলনায় আট-দশ বছর পর্যন্ত বেশি বয়সী বলে মনে হতে পারে। এছাড়া রজঃনিবৃত্তির পর শারীরিক শ্লথতা অস্বাচ্ছন্দ্য ও কামস্পৃহার ঘাটতি কাটাতে ষাটের দশক থেকেই শরীরে হরমোন পুনঃস্থাপিত করার প্রচেষ্টা চলেছে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের শরীরে এস্ট্রোজেনের পরিমাণ যে হারে কমে যায়, পুরুষদের শরীরে টেস্টোস্টেরন কমে যাওয়ার হারের চাইতে তা অনেক বেশি দ্রুত। এ কারণে নারীর শরীরে তারুণ্যের উপস্থিতির সামাজিক বিপুল চাহিদার জন্য হরমোন নিয়ে নারীর তারুণ্য রক্ষার পরীক্ষা-নিরীক্ষা বহুদিন ধরেই চলে আসছে। একমাত্র এস্ট্রোজেন থেরাপির ফলে বিভিন্ন অসুখ-বিসুখের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় এস্ট্রোজেনের সঙ্গে সামান্য প্রজেস্টেরন মিশিয়ে প্রাকৃতিক হরমোনের আবহ সৃষ্টি করার চেষ্টাও চলছে নারীদেহে। এ হরমোন-পূরণের প্রাথমিক সাফল্যের ধারা অবশ্য শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কেউ বলতে পারে না।

এটা অনস্বীকার্য যে, মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। প্রায় প্রতিটি দেশে, প্রতিটি সমাজে, এখন মানুষ বাঁচে অনেকদিন। ভালো খাদ্য, উন্নত চিকিৎসা ও জীবনযাপনের উন্নত মানের জন্য দিন দিন তাদের আয়ু আরও বেড়ে যাবে বলেই ধারণা। এ অবস্থায় মানুষের পরিণত জীবনের দৈর্ঘ্যও অনেকটাই বেড়ে গেছে এবং ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। আগে সন্তানরা সাবালক হতে না হতেই পিতামাতার মৃত্যু হতো। ফলে একটি প্রজন্ম প্রজননশীল হলেই আরেক প্রজন্মের চলে যাওয়ার সময় হয়ে আসত। মনে হতো মানবসন্তানের সৃষ্টি ও লালন-পালনের জন্যই কেবল মানুষের জন্ম। আজ মানুষ বুঝে গেছে, প্রজন্ম দাঁড় করানো তার অস্তিত্বের ও বেঁচে থাকার মূল ভিত্তি হলেও সামগ্রিক জীবনের আবেদন আরও ব্যাপক, আরও বৈচিত্র্যময়। আজকাল মানুষ অনায়াসে বেঁচে থাকে তার দুই বা তিন প্রজন্মের সদস্যসহ। এ দীর্ঘ বেঁচে থাকা শুধু বাঁচার জন্যই হতে পারে না। কেবল পর্যাপ্ত মুখরোচক খাবার আর সুচিকিৎসার বন্দোবস্তই যথেষ্ট নয়। জীবনকে অর্থবহ ও আনন্দকর করে তোলার জন্য জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের মান উন্নয়নও প্রয়োজন। প্রাণিজগতের সব প্রাকৃতিক ও মৌলিক প্রবৃত্তি এবং প্রবণতাগুলোর মধ্যে যৌনতার বোধই হয়তো সবচেয়ে দেরিতে আসে এবং সবচেয়ে আগে হ্রাস পায়। অথচ মানবজগতের সবচেয়ে যে প্রগাঢ় ও শক্তিশালী সম্পর্ক বা বাঁধন, তা হলো নরনারীর সম্পর্ক, যার ভিত্তি যৌনতা। ফলে যৌনজীবনকে আরও দীর্ঘায়িত, সচল ও আনন্দদায়ক করে তোলা মানুষের দীর্ঘ আয়ুর সুফল ভোগ করার বড় ধরনের শর্ত প্রৌঢ়ত্বে ও বার্ধক্যে এসে মানুষের, বিশেষ করে নারীর, যৌনাকাঙ্ক্ষা কমে যায়, পুরুষের যৌনক্ষমতাও হ্রাস পায়। পড়তি বয়সে যৌনবাসনা সঞ্চালন ও আনুষঙ্গিক শারীরিক অস্বাচ্ছন্দ্য দূর করার জন্য রজঃনিবৃত্তির পর বাইরে থেকে মেয়েলি হরমোন গ্রহণ করা শুরু করেছিল মেয়েরা প্রায় তিন-চার দশক আগে থেকে। প্রথম প্রথম মনে হয়েছিল প্রকৃতির কাছে হার মানতে নারাজ মানুষের জয় বোধহয় অনিবার্য। যে- হরমোন প্রাকৃতিক নিয়মে আস্তে আস্তে নিঃশেষিত হয়ে যায় সন্তান সৃষ্টির ক্ষমতা লোপ পাওয়ার পর, বাইরে থেকে তা সরবরাহ করে মেয়েদের শরীর ও মন বোধহয় প্রায় আগের মতোই চাঙ্গা করে দেয়া সম্ভব। এটা সর্বজনবিদিত যে, পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের হার্ট এটাক কম হয়। কিন্তু লিঙ্গভেদে এ রোগের প্রকোপতার যে তারতম্য তা প্রায় দেখাই যায় না। যখন মেয়েদের বয়স বাড়ে, অর্থাৎ তাঁরা পঞ্চাশোর্ধ্ব অথবা ষাটের কোঠা পার হন, তাঁদের মধ্যে আরও কতগুলো জরার চিহ্ন স্পষ্ট হয়- যেমন হাড় ভঙ্গুর হয়ে আসে, কারও কারও স্তনে বা জরায়ুতে ক্যান্সার হয়। তাছাড়া মাঝে মাঝে প্রবল ঘাম আর গরম লাগা, সেই সঙ্গে স্মৃতিবিভ্রম, যোনির শুষ্কতা ও সঙ্কোচন এবং যৌনসংযোগে অনীহা ইত্যাদি অনেক কিছু ঘটে। হরমোন রিপ্লেসমেন্ট (প্রতিস্থাপন) থেরাপির প্রথম দিকের গবেষণায় মনে হয়েছিল এসব শারীরিক অস্বাচ্ছন্দ্যগুলোর প্রায় সবই ঠিক করে ফেলা যাচ্ছে, শরীরে কমে যাওয়া মেয়েলি হরমোনগুলোকে বুদ্ধিমানের মতো বাইরে থেকে সরবরাহ করে। কিন্তু দু বছর আগে দীর্ঘ কয়েকটি গবেষণার ফল প্রকাশ পেলে সমস্ত আশা ও স্বপ্নের সলিলসমাধি ঘটল। দেখা গেল—হৃদপিণ্ডের অসুখ, স্মৃতিশক্তি লোপ, স্তনের ক্যান্সার কোনো ব্যাপারেই হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি কোনো কল্যাণকর ভূমিকা নেয় না, বরং এ তিনটি অসুখের সম্ভাবনাকেই বাইরে থেকে দেয়া এস্ট্রোজেন এবং এস্ট্রোজেন/প্রজেস্টেরন বাড়িয়ে দেয়। শুধু হাড় মজবুত করতে ও রজঃনিবৃত্তির পরপর দৈনন্দিন শারীরিক অস্বাচ্ছন্দ্য দূর করতেই এ হরমোন সাহায্য করে।

আমরা সবাই জানি, স্মৃতিশক্তি যা মানববন্ধনের এক শক্তিশালী ভিত্তি তা হরমোন ও বার্ধক্য দ্বারা প্রভাবিত। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিশক্তি ও এস্ট্রোজেন উভয়ই কমে। অথচ বিজ্ঞানীদের প্রত্যাশা অনুযায়ী এস্ট্রোজেনের সংযোজন স্মৃতিশক্তি বাড়ায় নি। ফলে অন্য বিজ্ঞানীরা যে আজ সরব হয়ে দাবি তুলছেন, টেস্টোস্টেরন হরমোনের সংযোজন (টেস্টোস্টেরন প্রতিস্থাপন থেরাপি) হারাতে-বসা স্মৃতিশক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করবে— এ আশাও আর করা যায় না। (বৃদ্ধ বয়সে স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়ার অবশ্য আরেকটি কারণ শরীরে কর্টিসান হরমোনের ঊর্ধ্বমাত্রা)। শুধু স্মৃতিশক্তি পুনর্নির্মাণেই নয়, শ্লথ ও নির্জীব যৌনজীবনকে চাঙ্গা করার জন্য হলেও টেস্টোস্টেরেন থেরাপির কথা ভাবছেন কোনো কোনো বিজ্ঞানী ও চিকিৎসক। আর এ থেরাপি তারা শুধু পুরুষ- দেহেই নয়, নারীদেহে সংযোজন করার কথাও চিন্তা করছেন। কোনো স্বল্প পরিমাণের টেস্টোস্টেরন নারীর যৌন আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করতে ও যৌনসুখ উপভোগ করতে সাহায্য করে। তবে তিন-চার দশক ধরে মেয়েদের শরীরে এস্ট্রোজেনের সংযোজনের সব মাহাত্ম্য সব জাদু যখন ধুম করে ধসে পড়ল বেশ কয়েকটি বড় ও দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার ফল প্রকাশ পেলে, টেস্টোরেস্টরন থেরাপিও যে একই ফল বয়ে আনবে না, তা কেউ জোর করে কিছু বলতে পারে না। ইদানীংকালে ভায়াগ্রাসহ প্রধানত হরমোনবিহীন বহু যৌন-উদ্দীপক ওষুধে বাজার ছেয়ে গেছে—যা প্রধানত পুরুষের জন্য, কিন্তু কিছু কিছু নারীর জন্যও বাজারজাত হয়েছে। এসব ওষুধ যৌনজীবন, নারী- পুরুষ সম্পর্ক ও সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি কি প্রতিক্রিয়া ফেলবে, এখুনি তা বলা যাচ্ছে না।

সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিকভাবে শরীরে ওঠানামা করা এসব হরমোনের নিশ্চয়ই একটা বৃহত্তর ভূমিকা রয়েছে। হয়তো-বা এর কোনো অন্তর্নিহিত কারণ আছে, হয়তো কোনো সুফল রয়েছে, যেটা এখনও পরিষ্কার নয়। শরীরে নিঃশেষিত বা হ্রাসকৃত একটি হরমোনকে বাইরে থেকে সরবরাহ করলেই হয়তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না, বরং এ কৃত্রিম আবহে শরীরের অন্যান্য ক্ষতি হতে পারে। আমরা সবাই জানি, শরীরে কোনো হরমোনই এককভাবে কাজ করে না। একটি হরমোন অন্যটিকে প্রভাবিত করে। আমরা এও জানি, হরমোনগুলো জীবকোষের আচ্ছাদনে বসে থাকা তাদের জন্য নির্ধারিত কতগুলো রিসিপ্টরের মাধ্যমে কাজ করে। খেয়ালখুশিমতো শুধু একটি হরমোনকে শরীরে প্রবেশ করিয়ে দিলেই হয়তো প্রার্থিত ফল আসবে না। মানুষের বিরাট রক্তভাণ্ডারে অজস্র যে-রাসায়নিক পদার্থ থাকে, তাদের মধ্যে একটা বোঝাপড়া ও সামঞ্জস্য রয়েছে। মাত্রাতিরিক্ত একটি পদার্থের উপস্থিতি এ সামগ্রিক অবস্থাকে ওলোটপালট করে দিতে পারে— প্রাকৃতিক ব্যালেন্স নষ্ট করে দিতে পারে। তাছাড়া বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হরমোন বা তার পরিমাণ নয়, আমাদের প্রতিটি জীবকোষ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কার্যক্ষমতারও বহু পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তিত অবস্থায় কোনটা যে কারণ আর কোনটা ফলাফল তা সবসময় নির্ণয় করা যায় না। যতক্ষণ পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে শরীরে বিভিন্ন হরমোন ও অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্যের পারস্পরিক সংযোগ এবং সম্পর্ক আবিষ্কার করা না যাবে, ততদিন পর্যন্ত বিগত যৌবন নিয়ে দুঃখ না করে যৌবনাক্রান্ত জীবনের অন্যান্য রসদ থেকে জীবনকে অর্থবহ ও সুখী করার চেষ্টা করাই বুদ্ধিমানের কাজ। যে পরিণত জীবন একদিন যৌনতাড়না ও একটি বিশেষ মানুষকে কেন্দ্র করে শুরু হয়, তা-ই আস্তে আস্তে মহীরুহের মতো ডালপালা মেলে অন্য অনেক মানববন্ধনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। এসব বন্ধন আমাদের অন্তরকে স্নিগ্ধ ও স্থির করে মনকে প্রসারিত করে, নিশ্চয়তা দেয়, জীবনকে সমৃদ্ধ করে অন্যের কাছে নিজেকে প্রয়োজনীয় করে তোলে, ভালোবাসায় সিক্ত করে মন। এ বৃহত্তর জীবন ও তার বোধ—যা অক্সিটসিন, ভেসোপ্রেসিন, নরএপিনেফ্রিন, এন্ডরফিনের মতো সহস্র পদার্থ নিয়ে চালিত, যা আমাদের অর্জিত অভিজ্ঞতা ও যাপিত জীবনের সার্বিক পরিবেশ দিয়ে পরিচালিত, সেই জীবনের সমস্ত ভাণ্ডারকে কী সাধ্য যে এস্ট্রোজেন বা টেস্টোস্টেরন এক হাতে কাত করে দেবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *