1 of 2

স্বর্ণলিপ্সা – ৫

পাঁচ

সোনার কয়েনের গায়ে খোদাই করে লেখা: LVD. XV. D. G. FR. ET NAV. REX. উল্টোপিঠে রাজকীয় চেহারার দাড়ি- ওয়ালা এক লোকের মুখ। মাথায় কারুকাজ করা মুকুট। নিচে কিছু অক্ষর। ভুরু কুঁচকে পড়ল পিটার: CHRS. REGN. VINC. IMPER. 1747. আগে কোনদিন এমন কিছু দেখেনি ও। কয়েনের গায়ে ধুলোবালি। অর্থাৎ, বেশি দিন হয়নি মাটি খুঁড়ে তোলা হয়েছে। মোহরটা সতেরো শ’ সাতচল্লিশ সালের। জিনিসটা তামার নয়। সোনার কয়েন কীভাবে রবার্টের কাছে এল, ভেবে পেল না পিটার। চট্ করে গাড়ি থেকে নেমে বসে পড়ল ড্রাইভিং দরজার পাশে। হাত ভরল সিটের নিচে। হাতড়ে দেখছে আর কিছু আছে কি না। কয়েক মুহূর্ত পর বিস্মিত হলো দ্বিতীয় মোহর পেয়ে। আরে! দীর্ঘক্ষণ চেয়ে রইল ওটার দিকে। আগেরটার মত হলেও এটা তৈরি করা হয়েছে আরও একবছর আগে সতেরো শ’ ছেচল্লিশ সালে।

পিটারের মনে জেগে উঠল জরুরি প্রশ্নঃ এসব মোহর কোথায় পেল রবার্ট? সে যতই বোকা হোক, গাড়ির মেঝেতে এসব ফেলে রাখবে তা হতে পারে না! গায়ের কাদা জানিয়ে দিচ্ছে, গত ক’দিনের ভেতরই মোহরগুলো পড়েছে গাড়ির মেঝেতে। সেক্ষেত্রে ধরে নেয়া চলে, এগুলো পেয়েছে রবার্ট জঙ্গল বা লকের তীরে।

স্কটল্যাণ্ডের ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ আর ঘটনাবহুল। দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশি ইতিহাস তৈরি করেছে এদিকটা। বড়লোক হওয়ার আশায় বহু বছর ধরেই লক আরডাইকের তীরে পাইন জঙ্গল, পাহাড়-টিলা ও উপত্যকায় আতিপাতি করে গুপ্তধন খুঁজেছে শত শত মানুষ। কারও কাছে ছিল কোদাল বা শাবল, কারও কাছে মেটাল ডিটেক্টর, কিংবা ডিভাইনিং রড। অবশ্য আজও মেলেনি ঐতিহাসিক কোনও সম্পদ। স্বর্ণসন্ধানীরা বড়জোর পেয়েছে জংধরা তীরের ডগা বা পচা কাঠির মত ক্ষয়ে যাওয়া একটা-দুটো স্কটিশ ক্লেমোর তলোয়ার। ফলে ধীরে ধীরে কমে গেছে গুপ্তধন শিকারিদের আনাগোনা। আজকাল বিশাল এলাকা খুঁজেও ওদের একজনকেও পাওয়া যায় না। বহুকাল ধরেই এদেরকে নিয়ে ঠাট্টা-মস্করা করেছে গ্রামের মানুষ। হাসতে হাসতে বলেছে: ‘যতই খোঁজো, গুপ্তধন আর পাবে না! সব আমরা হজম করে ফেলেছি!’

আনমনে মাথা নাড়ল পিটার। এখন দেখা যাচ্ছে, ভুল জানে গ্রামের মানুষ! কিন্তু রবার্ট কেন ওকে জানাল না, কী পেয়েছে? কেন যেন নিজেকে বঞ্চিত লাগল পিটারের। ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেও স্বর্ণমুদ্রা পাওয়ার তথ্যটা ওর কাছ থেকে গোপন করেছে রবার্ট। অর্থাৎ, ওকে বিশ্বাস করেনি। রবার্ট হয়তো ভেবেছে, এ-কথা জানলে ওর কাছ থেকে সোনার কয়েন চুরি করবে পিটার! বা হয়তো ভেবেছে, ফার্মের অফিস টাইমে ওগুলো পেয়েছে বলে মোহরের ভাগ চাইবে পিটার!

‘ধ্যাৎ, এসব কী যা-তা ভাবছি,’ বিড়বিড় করল পিটার।

মাথায় কিছুই খেলছে না ওর।

ভ্যানের ভেতর এগুলো রয়ে গেল কী করে?

যে-কেউ চাইবে গোপনে সব লুকিয়ে রাখতে। অর্থাৎ, জ্ঞাতসারে ভ্যানের সিটের নিচে কয়েন ফেলে রাখেনি রবার্ট। আসলে জানত না মেঝেতে পড়ে গেছে সোনার এই দুই মোহর। ওর বন্ধু অলস ও বোকা ছিল। জানত না কখন হাত বা পকেট থেকে পড়ে গেছে সোনার মোহর। তার মানে এ-ও ধরে নিতে হবে, সে-সময়ে অন্যদিকে মনোযোগ ছিল ওর।

কিন্তু সে-সময়ে কী ঘটেছিল যে মন অন্যদিকে থাকবে? যৌক্তিক চিন্তা এল পিটারের মনে। আসলে আরও কয়েন পেয়েছিল রবার্ট। মনের চোখে দৃশ্যটা দেখল পিটার। স্বর্ণজ্বরে আক্রান্ত রবার্টের মাথা খারাপ হয়ে গেছিল লোভে। কয়েন পেয়ে মুঠো মুঠো তুলেছে মাটির নিচ থেকে। খেয়ালই করেনি কখন গাড়িতে ওঠার সময় হাত থেকে ফস্কে মেঝেতে পড়েছে দুটো মোহর।

এখন, কথা হচ্ছে, কয়টা কয়েন পেয়েছিল রবার্ট?

অনেকগুলো?

এত বেশি যে গুনতে যায়নি। ভেবেছে বাড়ি ফিরে গুনবে।

কিন্তু সবমিলে রবার্টের কাছে তা হলে কয়টা মোহর থাকতে পারে?

এক ডযন? বিশটা? ত্রিশটা? কে জানে!

আরেকটা চিন্তা আসতেই হিম হয়ে গেল পিটারের বুক। এই দুই মোহর বলে দিচ্ছে, অনেকগুলো পেয়েছিল রবার্ট। সেক্ষেত্রে সেসব এখন কোথায়? হয়তো নিজের কাছেই রেখেছিল রবার্ট। তারপর ওকে ধরল খুনির দল। তা হলে তো সব সব পেয়ে গেছে তারা। হয়তো আরও সোনার মোহর পারে সে-লোভেই খুন করেছে রবার্টকে! কিংবা চেয়েছে চিরতরে ওর মুখ বন্ধ করে দিতে।

হঠাৎই রবার্টের মৃত্যুর আসল কারণ বুঝে গেল পিটার। সোনার মোহরদুটো পকেটে রেখে মোবাইল ফোন বের করল সে। কল দিল ওর চাচা বেন হ্যাননকে। কিন্তু ওদিক থেকে ধরছে না কেউ। ইতালিয়ান ল্যাণ্ডফোন। মেসেজিং সার্ভিস নেই যে ভয়েসমেইল পাঠাবে। মোবাইল ব্যবহার করে না চাচা-চাচী। তাদের ই-মেইল ঠিকানা আছে পিটারের কাছে। কিন্তু ওদিক থেকে কখনও ই-মেইল চেক করা হয় না বলে আগেই হাল ছেড়ে দিয়েছে।

এখন চুপচাপ বসে থাকার সময় নয়, ভাবল পিটার। কিছু না কিছু ওকে করতেই হবে। মানুষকে জানাতে হবে, কীভাবে মারা গেছে রবার্ট। খুনের সাক্ষীও আছে। আর এটাও পরিষ্কার, সোনা লুঠ করতে গিয়েই খুন করা হয়েছে বেচারাকে।

কিনলোকার্ড গ্রামে একটি চার্চ, পাব, গাড়ি মেরামতির গ্যারাজ, বিশজন ছাত্র-ছাত্রী সহ ছোট্ট এক প্রাথমিক স্কুল থাকলেও কোনও পুলিশ স্টেশন নেই। আর তাতে যথেষ্ট ফুর্তি এবং স্বস্তিতে আছে গ্রামের মানুষ। এই এলাকায় পুলিশ বলতে রয়েছে জেসিকা থমসন। তার কথা মনে পড়তেই আবারও ভ্যানে উঠল পিটার। গ্রামের মূল বসতি থেকে একটু দূরে ছোট এক কটেজ ভাড়া নিয়েছে মেয়েটা। একাই থাকে ওখানে। কিছুক্ষণ পর ওই কটেজের সামনে পৌঁছে গেল পিটার। জেসিকার সঙ্গে শেষবার ওর কথা হয়েছিল অন্তত ষোলো বছর আগে। কয়েক মাস আগে মেয়েটা গ্রামে ফিরেছে জানলেও, জরুরি কোনও কারণ ঘটেনি বলে দেখা করেনি। এখন নার্ভাস লাগছে ওর।

আজ অবশ্য নার্ভাস না হলেও চলত। কটেজের দরজায় তালা দিয়ে কোথায় যেন গেছে জেসিকা। এখন পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে যেতে হবে দক্ষিণ-পুবে ত্রিশ মাইল দূরের ফোর্ট উইলিয়ামে। আঁকাবাঁকা পথের হাজার ঝক্কি সয়ে একঘণ্টা পর দূরের সেই শহরে গিয়ে পৌঁছুল পিটার।

কুয়াশামাখা ঝুঁকে আসা টিলার কোলে চারকোনা থান ইঁটের মত পুলিশ স্টেশন বিল্ডিংটা শহর থেকে দূরে লক এইলের তীরে। রিসেপশন ডেস্কে পৌঁছে হড়বড় করে ডিউটি অফিসারকে সব জানাল পিটার। অবশ্য অপ্রাসঙ্গিকভাবে হঠাৎ কথা বলতে শুরু করেছে বলে কিছুই বুঝল না পুলিশ অফিসার। প্রথমে পিটারকে শান্ত হতে অনুরোধ করল সে, তারপর নিয়ে গেল জানালাহীন এক ইন্টারভিউ রুমে। ঘরে একটা টেবিল আর চারটে প্লাস্টিকের চেয়ার ছাড়া আর কিছু নেই। পিটারকে অপেক্ষা করতে বলে ঘরে তালা মেরে উধাও হলো পুলিশ অফিসার। তাতে কেন যেন পিটারের মনে হলো, ও বন্দি হয়েছে পুলিশ স্টেশনে। ঘরের কোণে দেখল, নিষ্পলক ওকে দেখছে ভিডিয়ো ক্যামেরার কালো চোখ।

অপেক্ষায় পেরোল আধঘণ্টা, তারপর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল সাধারণ পোশাকের মধ্যবয়স্ক দুই লোক। নিজেদেরকে পরিচয় দিল ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর জন মুরে ও ডিটেকটিভ সার্জেন্ট ডানকান রিড হিসেবে। দানবাকৃতি লোক জন মুরে, মোষের গর্দানের মত মোটা ঘাড়। আপেলের মত লালচে দুই গাল। তার সঙ্গী ডানকান রিড ছোটখাটো, হালকা-পাতলা লোক। মাথার চুল বালির মত ধূসর রঙের। ঠোঁটের ওপরে পুরু গোঁফ। অস্থির ধরনের লোক সে, সর্বক্ষণ নাড়ছে দুই হাত। পিটারের উল্টোদিকের চেয়ার টেনে বসল তারা। ডিউটি অফিসারকে বলা পিটারের কথাগুলো আবারও জানতে চাইল।

প্রথম থেকে সব বলল পিটার। বাদ পড়ল না কিছুই। বুকপকেট থেকে নোটবুক আর কলম নিয়ে গম্ভীর চেহারায় খস খস করে জরুরি তথ্য টুকল সার্জেন্ট রিড। তবে সোনার মোহরের প্রসঙ্গ উঠতেই ওগুলো দেখতে চাইল দুই ডিটেকটিভ।

‘মাত্র একটাই এনেছি,’ অপেক্ষাকৃত নতুন মোহরটা পকেট থেকে বের করে তাদেরকে দেখাল পিটার। মিথ্যা বলেছে। পকেটে রয়ে গেছে অন্য মোহরটা। কেন যেন মনে হয়েছে, এদেরকে বিশ্বাস করা উচিত হবে না। ওর কাছ থেকে নিয়ে নিস্পৃহ চেহারায় সোনার মোহর দেখল ইন্সপেক্টর মুরে। তারপর ফেরত না দিয়ে জানাল, আপাতত প্রমাণ হিসেবে ওটা রেখে দিচ্ছে। এমনটা হবে আগেই ধারণা করেছে পিটার। কোনও তর্কে গেল না। ইন্সপেক্টর মুরে মোহরটা ডানকান রিডের হাতে দেয়ায় প্লাস্টিকের ছোট্ট ব্যাগে পুরল সে ওটা। জন মুরে জানাল, পিটারের দুশ্চিন্তার কিছু নেই, মোহরটা পুলিশের কাছে নিরাপদেই থাকবে।

‘আবার যখন আসবেন, দ্বিতীয়টা আনতে ভুলবেন না, ‘ বলল সার্জেন্ট ডানকান রিড।

‘তা তো বটেই,’ জবাবে বলল পিটার। মনে মনে বলল, জীবনেও না!

‘এবার আরেকবার বলুন ওই পোচারের কথা, যে-লোক বলেছে সে দেখেছে আপনার বন্ধুকে খুন হতে,’ থলথলে দুই হাত টেবিলে রেখে পিটারের দিকে ঝুঁকল মুরে।

ইন্সপেক্টরের কথা অস্বাভাবিক লেগেছে পিটারের কাছে। তবুও আবার প্রথম থেকে বলল: ‘আগেই বলেছি, আমার মনে হয়েছে তাকে চিনি। তবে মনে পড়ছে না নাম। চেহারাটাও মনে নেই। ওই লোক দেখেছে চারজন লোক ঠেলে নিয়ে গিয়ে রবার্টকে ফেলে দিয়েছে লকের পানিতে। সাঁতার জানত না রবার্ট। তাই ডুবে মারা গেছে।’

‘সাঁতার জানত না বলে ডুবে মরেছে?’ ঊর্ধ্বতন অফিসারের দিকে তাকাল সার্জেন্ট রিড। তার ভার দেখে পিটারের মনে হলো, ওই তথ্য পেয়েই কেস সমাধান করে ফেলেছে সে। এরা যে ব্যাপারটা গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে না, সেটা বুঝে গেল ও।

ভারী দুই কাঁধ তুলে শ্রাগ করল ইন্সপেক্টর মুরে। ‘সত্যি বলতে, মিস্টার হ্যানন, আমাদের হাতে জরুরি কোনও সূত্র নেই। আপনি যেটা বলছেন, সবই কান-কথা। অথচ, এই ধরনের অভিযোগ সবসময় অত্যন্ত গুরুতর। এবং তাই এ ক্ষেত্রে চাই নিরেট প্রমাণ। আর সেটা না থাকলে এই ধরনের কেস ধোপে টিকবে না।’

‘আপনারা চাইলে খুঁজে বের করতে পারবেন সেই সাক্ষী আসলে কে,’ বলল পিটার।

‘সত্যিই যদি কোনও সাক্ষী থেকে থাকে,’ বলল সার্জেন্ট রিড।

‘হ্যাঁ, সত্যিই সে সাক্ষী হয়ে থাকলে,’ ফাঁপা স্বরে বলল পিটার। অধৈর্য লাগছে ওর। মনে হচ্ছে, এখানে এসে সময় নষ্ট করেছে।

‘কিন্তু, মিস্টার হ্যানন, বলুন দেখি আমরা কীভাবে খুঁজে বের করব সেই অদৃশ্য লোকটাকে?’

‘আপনারা জানেন, লকে গোপনে বেআইনিভাবে স্যামন মাছ ধরে সে। ওই লোককে খুঁজে বের করতে তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমাকে বলেছে, আগেও তাকে জেল- জরিমানা করেছে পুলিশ। অর্থাৎ, আপনাদের ফাইলে তার নাম থাকবে। ডেটাবেস দেখলেই পাবেন সে আসলে কে। কাজটা খুব কঠিন হওয়ার কথা নয়।

‘আপনার এই তথ্যের জন্যে হয়তো ঝামেলা একটু কম হবে,’ বলল ডানকান। ‘তবে আমরা জানি না, কবে বা কখন সে ধরা পড়েছে। এখন কী কাজ করে বা কোথায় থাকে, তা-ও জানা নেই। ডেটাবেসে আছে শত শত মানুষের নাম, তাদের পেশা ও বাড়ির ঠিকানা। তাই এতজনের ভেতর থেকে নির্দিষ্ট কাউকে খুঁজে নেয়া অতটা সহজ নয়। এজন্যে যেমন সময় দিতে হবে, তেমনি চাই জনবল।’

বিস্ময় নিয়ে পুলিশ অফিসারকে দেখল পিটার। ভাবছে: পুলিশের তো জনবলের অভাব নেই! আর তাদেরকে তো বেতন দেয়াই হয় অপরাধীকে খুঁজে বের করার জন্যে! কেন যেন তিক্ত হয়ে গেল ওর মন। এরা কেন যেন তদন্ত করতে চাইছে না রবার্টের খুনের ব্যাপারে। শুকনো গলায় বলল পিটার, ‘আপনারা নিশ্চয়ই খুঁজে বের করতে পারবেন ওই সাক্ষীকে। আর সেক্ষেত্রে সমস্যা হবে না তার কাছ থেকে সব জেনে নিতে। স্যামন মাছ ধরে বলে আপনারা তাকে গ্রেফতার না করলে, তাতেই হয়তো মুখ খুলবে সে।’

‘কাজটা অত সহজ নয়,’ চালিয়াতি হাসি হাসল সার্জেন্ট রিড।

‘এটা খুনের কেস, কিছু না কিছু তো করতে হবে, তাই না?’ বলল পিটার।

দুই ঠোঁট প্রসারিত করে বড় করে শ্বাস নিল ইন্সপেক্টর মুরে। ‘বুঝতে পেরেছি। আপনি তা হলে সবই বুঝে গেছেন, তাই না, মিস্টার হ্যানন? তো আমাদের হয়ে আপনি নিজেই তদন্তের কাজে নেমে পড়ুন না!’

‘আমিও তা-ই ভাবছি,’ তিক্ত সুরে বলল পিটার। পরক্ষণে ওর মনে হলো, অনুচিত হলো পুলিশের লোককে চেতিয়ে দেয়া।

এরপর কোনও দিকেই গেল না ইন্টারভিউ। বিশ মিনিট পর বিরক্তি নিয়ে পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে এল পিটার। এত কষ্ট সহ্য করে খামোকা এখানে এসেছিল বলে রাগ লাগছে। বাড়ি ফেরার দীর্ঘ পথে বারবার মনে হলো, মাঝখান থেকে লুট হলো সোনার মোহরটা। অস্বাভাবিক কোনও কারণে রবার্টের খুনের ব্যাপারে তদন্ত করতে চাইছে না দুই পুলিশ অফিসার। বিষয়টা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি তারা।

আনমনে ভাবল পিটার, যাক গে, আজ বা আগামীকাল পৌঁছে যাবে চাচা। তখন সবই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তদন্ত করবে।

বাড়ি ফিরে ফোনে কোনও মেসেজ পেল না পিটার। তাতে দমে গেল ওর মন। চিন্তা অন্যদিকে সরাতে গিয়ে দিনের বাকি সময় বাড়ির পাঁচিলের ভাঙা অংশ মেরামত করল। সন্ধ্যার দিকে বসল কমপিউটারের সামনে। ইন্টারনেটে ঢুকে সার্চ কি-ওঅর্ড হিসেবে ব্যবহার করল গোল্ড কয়েন… আরডাইক… পাইন জঙ্গল। তাতে যে ধরনের তথ্য পেল, সব টুকে নিল নোটপ্যাডে। এরপর পুরনো মোহরের যেসব সাইট আছে, সেগুলো একে একে দেখল।

সতেরো শ’ ছেচল্লিশ সালের স্বর্ণমুদ্রা ইণ্টারনেটে সার্চ দিতেই এল তথ্য: CHRS. REGN. VINC. IMPER. 1746. ওই মোহরের নাম: Louis d’or. অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রচলিত ছিল ফ্রান্সে। লোকে বলত ফ্রেঞ্চ ফ্র্যাঙ্ক। বর্তমান মূল্য প্রতিটি কমবেশি পাঁচ হাজার পাউণ্ড। টাকার অঙ্ক জেনে গলা শুকিয়ে গেল পিটারের। আনমনে ভাবল, ফ্রান্সের ওই সোনার মোহর কী কারণে এসেছিল এই স্কটল্যাণ্ডে?

আরও কিছু ডেটা পেয়ে নোটপ্যাডে টুকে নিল পিটার। কাজ শেষ করে ইণ্টারনেটে সার্চ করল স্যামন মাছের বেআইনি শিকার আর শিকারিদের ওপর। এবারও পেল টুকটাক কিছু খবর। তবে সেসব জরুরি কিছু নয়। তা-ও নোটপ্যাডে লিখল। কাজটা শেষ করে হাতঘড়ি দেখল। রাত হয়ে গেছে। অথচ যোগাযোগ করেনি চাচা। বিরক্ত করবে না ঠিক করেছে, তাই ইতালিতে আবারও ফোন দিল না। একবার ভাবল, পাঠিয়ে দেবে কি না ই-মেইল। চাচাকে সোনার মোহরের ব্যাপারটা জানিয়ে রাখা উচিত।

স্মার্টফোন দিয়ে মোহরের ছবি তুলল পিটার। ছবির নিচে মেসেজও দিল: ‘রবার্ট এটা পেয়েছে। সব অদ্ভুত লাগছে। আশা করি দ্রুত চলে আসবে তুমি, চাচা।’

মেসেজ পাঠিয়ে দেয়ার পর নিজেকে ভীষণ একা আর অসহায় লাগল ওর। মন ছেয়ে গেল চরম হতাশা ও রাগে। ফড়াৎ করে নোটপ্যাড থেকে কাগজটা ছিঁড়ে গোল পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলল ঘরের কোণে ওয়েস্টপেপার বাস্কেট লক্ষ্য করে। ওটা ঠিক জায়গায় না পড়ে গড়িয়ে গিয়ে থামল এক চেয়ারের পাশে। পিটারের মন এতই বিক্ষুব্ধ যে, উঠে গিয়ে গোল পাকানো কাগজটা ঠিক জায়গায় ফেলল না। মন কু ডাকছে ওর। বারবার মনে হচ্ছে, চাচা হয়তো আসবেই না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *