1 of 2

স্বর্ণলিপ্সা – ১০

দশ

এইমাত্র ছুটতে ছুটতে পুলিশ স্টেশনের রিসেপশন এরিয়ায় এসে বেন হ্যাননকে ধরতে পেরেছে জেসিকা থমসন। মেয়েটা পাশাপাশি হতেই থেমে দাঁড়িয়ে বেন বলল, ‘ভাল ব্যবহার করিনি বলে ছুটে এসেছ বকাঝকার জন্যে?’

জবাবে মাথা নাড়ল জেসিকা। চোখে কৌতূহল। নিচু গলায় বলল, ‘ভাবতেও পারিনি পুলিশের বড় অফিসারের সঙ্গে এই সুরে কেউ কথা বলবেন—মোটা পাছা আর শুঁটকি পাছা?’

‘শুনতে ওদের ভাল লাগেনি, তাই না?’

‘আপনার কথায় মনে হচ্ছিল নিজের চোখে তাঁদের লালচে… ইয়ে… দেখেছেন।’

‘লালচে পাছা না দেখে উপায়ই বা কী ছিল আমার?’

‘স্যামন মাছ পোচিঙের ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি।’ বেশিরভাগ সময় মানুষকে বিশ্বাস করে না বেন হ্যানন। তবে জেসিকা থমসনকে কেন যেন ভাল লাগছে তার। তাই রবার্টের শেষকৃত্যের রাতে পিটারের কাছে কল করা সেই লোকের কথাগুলো সংক্ষেপে জানাল সে।

‘ওই লোক সত্যি কথা বলেছে বলে ভাবছেন?’ বলল জেসিকা।

‘পিটার কোনদিনই মিথ্যুক ছিল না।’

‘সত্যিই পোচিং করছিল? মিথ্যাও তো বলতে পারে। পারে না? হয়তো খুঁচিয়ে মজা পাওয়ার জন্যে এসব বলেছে?’

‘আমার তা মনে হয় না। পিটারের কাছে লোকটার গলা খুব চেনা চেনা লেগেছিল, মনে হয়েছিল লোকটাকে চেনে।’

বিস্ময় নিয়ে হ্যাননকে দেখল জেসিকা। ‘ওই লোককে চিনতে পেরেছে পিটার? কোথাকার লোক সে? নাম কী?’

‘নাম-পরিচয় মনে পড়েনি ওর,’ বলল হ্যানন। ‘আমরা শুধু এটুকু জানি, রবার্টের খুনের ব্যাপারে জরুরি তথ্য আছে তার কাছে। গোপন কিছু চলছে কিনলোকার্ড গ্রামে। সেজন্যেই পিটারকে বলেছিলাম সাবধানে থাকতে।’

আনমনে মাথা নাড়ল জেসিকা। ‘সব অদ্ভুত লাগছে। কিনলোকার্ড গ্রামে মানুষ খুন? আগে কখনও এমন কিছু ঘটতে শুনিনি।’.

‘তবে কেউ না কেউ খুন করেছে রবার্টকে,’ বলল হ্যানন। ‘সোনার কয়েনের ব্যাপারটা কী? ওটাও বুঝতে পারিনি।’

‘আমিও জানি না, ল্যাসি। ওই ব্যাপারে আমাকে কিছুই বলেনি পিটার।’

‘গোটা ব্যাপারটা আমার ভাল ঠেকছে না। তাই আপনাকে অনুরোধ করব: বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নিন। দেখা যাক তদন্ত করে কী খুঁজে বের করে পুলিশ।’

গ্র্যানিটের মত কঠিন হলো বেন হ্যাননের মুখ। চাপা স্বরে . বলল, ‘এসেছি ভাতিজাকে সাহায্য করতে। পরে দেখলাম দেরি হয়ে গেছে। তবে পিটারকে যারা এভাবে মেরেছে, তাদেরকে খুঁজে না বের করে স্কটল্যাণ্ড ছেড়ে কোথাও যাব না এক পা-ও।’

প্রৌঢ় মানুষটার গম্ভীর চেহারা দেখে জেসিকা বুঝে গেল, মনোভাব বদলাবেন না তিনি। চট করে একবার কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনের করিডোর দেখল জেসিকা। তারপর প্যান্টের পকেট থেকে ছোট্ট একটা কাগজ নিয়ে গুঁজে দিল বেন হ্যাননের হাতে। ওটা গ্রোসারি দোকানের রিসিট। কাগজের উল্টো পিঠে টেলিফোন নম্বর। ‘আমার ফোনের নম্বর, প্রয়োজনে কল দেবেন।’

‘তখন তুমি কী করবে?’ জানতে চাইল বেন হ্যানন।

কাঁধ ঝাঁকাল জেসিকা। ‘বন্ধুদের কাছে শুনেছি, আপনাকে বাবার মতই শ্রদ্ধা করত পিটার। তাই চাই না আপনার কোনও ক্ষতি হোক। আজ এখানে যা ঘটল, এরপর সতর্ক থাকবেন। যদি মনে করেন আমার কোনও সাহায্য লাগবে, দ্বিধা করবেন না ফোন দিতে।’

মৃদু মাথা দোলাল বেন। জেসিকার আন্তরিক কথাগুলো মন ছুঁয়ে গেছে তার। নিজের মেয়ে থাকলে সে বোধহয় এভাবেই ভাবত। জেসিকা জেনে গেছে, সঠিকভাবে ওই দুই কেস নিয়ে তদন্ত করছে না ঊর্ধ্বতন অফিসাররা। তবে অন্য প্রসঙ্গে গেল বেন, ‘তোমার মনটা খুব নরম, ল্যাসি। টেলিফোন নম্বর দিলে বলে অনেক ধন্যবাদ।’

‘এখানে-ওখানে খোঁজ নিতে গিয়ে দয়া করে বিপদে পড়বেন না।’

‘তুমি কি ভাবছ ওই দুই ক্লাউন আমার ক্ষতি করবে?’

‘না, তা ভাবছি না। তবে আপনাকে ভাল মানুষ বলে মনে হয়েছে, তাই সতর্ক করছি। খুব খারাপ একদল লোক বেআইনি কিছু করছে। তারা আপনারও ক্ষতি করতে পারে।’

হাসল বেন। ‘জীবনে খারাপ বেশকিছু মানুষকে দেখেছি। তবুও বেঁচে আছি। ওরা কিন্তু জগতে নেই। আমার জন্যে দুশ্চিন্তা কোরো না, ল্যাসি।’

খুলে গেল করিডোরের একটা দরজা। বের হলো ইউনিফর্ম পরা দু’জন অফিসার। কী নিয়ে যেন আলাপ করছে তারা। জেসিকার দিকে চেয়ে হাসল তাদের একজন। দ্বিতীয়জন সন্দেহ নিয়ে দেখছে বেন হ্যাননকে। নিচু গলায় বলল জেসিকা, ‘আমার শিফট শুরু হয়ে গেছে। আপনি এখন কোথায় যাবেন ভাবছেন, মিস্টার হ্যানন? ‘

‘ফিরব কিনলোকার্ড গ্রামে।’

ওদিকে তো প্রায় কোনও বাসই যায় না।’

‘আমার সমস্যা হবে না।’

‘সতর্ক থাকছেন তো?’

মাথা দোলাল বেন হ্যানন। বিদায় নিয়ে ডিউটিতে যোগ দিতে ফিরে চলল জেসিকা থমসন। কেউ তাকে পছন্দ করুক বা না করুক, সোজাসাপ্টা কথা বলা মানুষগুলোকে পছন্দ করে বেন। তাই বুঝে গেছে, ওই মেয়ে ভালদের একজন।

বাসের ব্যাপারে ঠিকই বলেছে জেসিকা। পুরো দু’ঘণ্টা পর শেষমেশ কিনলোকার্ড গ্রামে ফিরতে পারল বেন। শহর ছাড়ার আগে আরেক দফা গেছে হাসপাতালে। তখন রিসেপশন ডেস্ক থেকে নিকটাত্মীয় হিসেবে তাকে দেয়া হয়েছে পিটারের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র। কোনটাই মূল্যবান কিছু নয়: ওয়ালেট, খুচরো কয়েন, চাবি এসব। মোবাইল ফোনটা নেই। গোয়েন্দারা বোধহয় ওটা নিয়ে গেছে তদন্তের জন্যে।

পিটারের বাড়ির দরজা খুলে বেনের মনে হলো, এখানে তার একা থাকার কথা নয়। তখনই ভাবল, ভাতিজার বাড়ি অগোছাল করবে না। যদি ক’দিন থেকেও যায়, বেডরুমের বদলে ব্যবহার করবে লিভিংরুমের সোফা। কিচেনও লাগবে না। আসলে এ বাড়িতে থাকতেই হবে এমনও নয়। প্রয়োজনে মাটিতে শুয়ে পার করে দেবে রাতের পর রাত। বছরের পর বছর লুকিয়ে থাকতে পারবে জঙ্গলে, পাহাড়ে বা মরুভূমিতে। কারও সাধ্য নেই খুঁজে বের করবে তাকে। কঠোর ট্রেইনিঙের গুণে বহু দেশের শত শত কমাণ্ডোকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে পুরো ছাব্বিশ বছর ধরে। স্বয়ং মৃত্যু ছাড়া অন্য কিছু তাকে ভুলিয়ে দিতে পারবে না ওই ট্রেইনিং।

ঘরে ঢুকেই বেন বুঝল, বাড়িতে ঢুকেছিল অচেনা কেউ। তচনচ করেছে সামনের ঘরের আসবাবপত্র। আগেও লুঠতরাজ হতে দেখেছে বেন। অবশ্য লুঠপাট নয়, তন্নতন্ন করে কিছু খোঁজা হয়েছে এ বাড়িতে। বেশকিছু ড্রয়ার পড়ে আছে মেঝেতে। ছুরি দিয়ে চেরা হয়েছে সোফার কুশন। ফ্লোরবোর্ড দেখতে উল্টে ফেলেছে কার্পেট। এসব কীর্তি একাধিক লোকের—ঝড়ের বেগে বাড়ি সার্চ করে বিদায় নিয়েছে তারা।

একটু ঘুরতেই বেন বুঝল, গুদামের কাঁচের ভাঙা জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকেছে তারা। জানালার ওদিকে বাড়ির পেছন উঠান। সেখানে জন্মেছে আগাছা ও ঝোপঝাড়। এখানে ওখানে গার্বেজ বিন ও আবর্জনা। সারি সারি বাড়ির পেছনের গলি দিয়ে এনে উঠানে পিটার রেখেছে ওর ক্যাম্পার ভ্যান। ভাঙা জানালা বন্ধ করে লিভিংরুমে

করে লিভিংরুমে ফিরল বেন। অনুপ্রবেশকারীরা জরুরি কিছু খুঁজতে গিয়েই বেশি ক্ষতি করেছে এই ঘরের আসবাবপত্রের।

ডাইনিং এরিয়ার একটু দূরেই লিভিংরুম। ওটাকে হোম অফিস হিসেবে ব্যবহার করত পিটার। একদিকের দেয়াল- ঘেঁষা ডেস্কের ওপরে চারকোনা ফাঁকা জায়গার কিনারায় ধুলো। পড়ে আছে গোল পাকানো কিছু তার। বেন বুঝে গেল, চলে যাওয়ার সময় কমপিউটার, প্রিন্টার ও স্ক্যানার নিয়ে গেছে তস্কররা। আপাতত বোঝার উপায় নেই তারা কারা, বা কী খুঁজছিল।

পুলিশের সঙ্গে কথা বলবে কি না ভাবল বেন। তারপর সিদ্ধান্ত নিল, জানাবে না কিছুই। রবার্ট ও পিটারের দুই কেসের দায়িত্বে আছে নিরেট মগজের দুই গাধা। সুযোগ পেলে ওর প্রতিটা পদক্ষেপে বাধা দেবে তারা। কাজেই সেধে ঝামেলায় যাওয়ার দরকার নেই। তা ছাড়া, জানা হয়ে গেছে এরপর কী করতে হবে।

তিক্ত মনে ঘর গোছাবার কাজে নামল বেন। কিছুক্ষণ পর ঘরের কোণে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটের কাছে পেল মুচড়ে ফেলা একটা কাগজ। ওটা তুলে নিয়ে খুলে চোখ বোলাল সে। কাগজে রয়েছে পিটারের লেখা কিছু কথা।

ইতালিতে চশমা ফেলে এসেছে বেন। ভাস্তের হাতে লেখা ছোট অক্ষরগুলো পড়তে গিয়ে চোখ কুঁচকে গেল তার। কিছু নোট নিয়েছে পিটার। Louis d’or শব্দদুটো, কিছু ডেটা ও এদিকের আঠারো শতকের ইতিহাস থেকে কয়েকটা নাম উল্লেখ করেছে। তথ্যগুলো কেন টুকে নিল, বুঝতে পারল না বেন। কাগজে আছে আরডাইক লকে গোপনে স্যামন মাছ শিকারের ওপরে লেখা কয়েকটা বাক্য। নিচে আণ্ডার লাইন করেছে পিটার: কে এই স্যামন মাছ পোচার?

কাগজটা ভাঁজ করে প্যান্টের পকেটে রাখল বেন। ঘুরে দেখল বিধ্বস্ত ঘর। ফলে আবারও রেগে গেল। মনের চোখে দেখতে পেল ভাস্তের মার খাওয়া অচেতন মুখ। হয়তো আর কখনও জ্ঞান ফিরবে না ওর। বেনের বুকে টগবগ করে বলকে উঠল আগ্নেয়গিরির লাভার মত প্রচণ্ড রাগ। বিড়বিড় করে বলল, ‘দাঁড়া, শুয়োরের বাচ্চারা!’

রাগ আরও বেড়ে যাওয়ায় হঠাৎ শুরু হলো পাঁজরের ভেতর চিনচিনে ব্যথা ও বিশ্রী চাপ। বেনের মুখ চিরে বেরোল মৃদু গোঙানি। টলে গেল ঝড়ের কবলে পড়া গাছের মত। নিজেকে সামলে নিতে কাছের চেয়ারের পিঠে হাত রেখে অপেক্ষা করল ব্যথা চলে যাওয়ার জন্যে। কয়েক মিনিট পর ধীরে ধীরে কমল অস্বস্তি। কিচেনে গিয়ে গ্লাস নিয়ে জগ থেকে পানি ঢালল। পকেট থেকে নিল ওষুধের ছোট্ট বোতল। ওটায় আছে শেষদুটো ট্যাবলেট। ও-দুটো মুখে ফেলে ঢক-ঢক করে পানি দিয়ে গিলে নিল। ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলল খালি বোতল। প্যান্টের পকেটে রয়েছে আনকোরা আরেক ফাইল ওষুধ।

একটু পর লিভিংরুমে ফিরে ল্যাণ্ডফোনের রিসিভার তুলে স্ত্রী মিরাণ্ডাকে কল দিল। ওদিক থেকে হ্যালো শুনে বলল, ‘আমি পৌঁছে গেছি। তুমি ঠিক আছ তো?’

স্বামীর কণ্ঠস্বর শুনে স্বস্তির শ্বাস ফেলল মিরাণ্ডা। বিয়ের পর কখনও আলাদা থাকেনি তারা। সে কথাই বলল বেচারি : ‘তোমাকে খুব মিস করছি।’

‘খারাপ খবর আছে, মিরাণ্ডা,’ বলল বেন। ‘বাজেভাবে . আহত হয়েছে পিটার।’ সংক্ষেপে সব খুলে বলল সে। এ-ও জানাল, তার ধারণা রবার্টকে যারা খুন করেছে, তারাই মারাত্মক জখম করেছে পিটারকে। পুলিশ স্টেশনে কী ঘটেছে, তা-ও বাদ পড়ল না। শেষে বলল, ‘নিজেই এবার তদন্ত করব।’

এই কথায় দুশ্চিন্তা বাড়ল মিরাণ্ডার। ভাল করেই জানে, ভাস্তে পিটারকে কতটা ভালবাসে বেন। এখন কোনও কথায় বেনকে নিরস্ত করতে পারবে না সে। একটু চুপ করে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘কথা দাও, খুব সাবধানে থাকবে।’

‘নিশ্চয়ই। তুমি তো জানো, কোনও ঝুঁকি নিই না।’

‘শরীর এখন কেমন? ঠিক সময়ে ওষুধ খাচ্ছ তো?’

‘আমি ঠিক আছি, ভেবো না,’ বলল বেন। ‘গুঁতো দিতে এলে ষাঁড়ের শিঙের বারোটা বাজিয়ে দেব।’

স্বামী অন্তর থেকে তাকে ভালবাসলেও ভীষণ একগুঁয়ে মানুষ, জানে মিরাণ্ডা। বিশেষ করে পিটার আর মাসুদ রানার ক্ষেত্রে বেন অন্ধ। ইতালিতে ফিরতে বললে যে শুনবে না, তা পরিষ্কার। তাই অন্য প্রসঙ্গে গেল মিরাণ্ডা, ‘গতরাতে ই-মেইল করেছিল পিটার। মেইল চেক করতে গিয়ে একটু আগে ওটা দেখেছি।’

‘পিটার? কী লিখেছে?’

‘একমিনিট, পড়ছি।’ কয়েক মুহূর্ত পর কমপিউটারের কাছে নেয়া হলো টেলিফোন। ‘ঠিক আছে। পিটার লিখেছে: ‘রবার্ট এটা পেয়েছিল। সব অদ্ভুত লাগছে। আশা করি দ্রুত চলে আসবে তুমি, চাচা।’

‘রবার্ট কী পেয়েছিল?’

‘ই-মেইলের সঙ্গে অ্যাটাচমেন্ট আছে। খুলে দেখেছি। পুরনো একটা কয়েনের ছবি। মনে হয় সোনার। তোমার কাছে এই ছবি পাঠিয়ে দিয়েছিল কেন পিটার? ওটার জন্যেই কি খুন হয়েছে রবার্ট? আর এরপর ডাকাতগুলো হামলা করেছে পিটারের ওপর?

স্ত্রীকে দুশ্চিন্তায় ফেলতে চাইল না বেন। নরম সুরে বলল, ‘দু’চার দিনের ভেতরে সবই বুঝতে পারব।’

‘তুমি পাশে নেই ভাবতে গিয়ে খুব খারাপ লাগছে,’ কান্না আড়াল করতে গিয়ে নাক টানন মিরাণ্ডা।

‘মাত্র কয়েকটা দিন, ডার্লিং, তারপর চলে আসব। একদম ভাববে না। আমি ভাল আছি। খুব সাবধানে আছি।’

‘কথা দাও প্রতিদিন ফোন দেবে? একা থাকলে ভয়ের সব চিন্তা এসে চেপে ধরছে আমাকে।’

‘প্রতিদিন দু’বার করে ফোন দেব, সোনা, কথা দিলাম।’

মিরাণ্ডাকে অন্তর থেকে ভালবাসে বেন। প্রথমদিন ওকে দেখেই মনে মনে আছাড় খেয়ে পড়েছিল মাটিতে। কখনও ভালবাসায় সামান্যতম কমতি হয়নি তার তরফ থেকে। আর সেটা বুঝে ফেলেছে বলেই কখন যেন নিজের চেয়ে বেশি ভালবেসে ফেলেছে মিরাণ্ডা রাগী, যোদ্ধা মানুষটাকে।

ফোন রেখে সোফায় বসে ভাবতে লাগল বেন। আকাশ ফুঁড়ে হাজির হয়নি সোনার মোহর। ওগুলোর জন্যেই পাকিয়ে উঠেছে এতবড় বিপদ। পিটারের নোট থেকে জানা গেছে, রবার্টের হত্যাকাণ্ড দেখেছিল এক স্যামন-পোচার। এখন তাকে খুঁজে পেলে জেনে নেয়া যাবে সবই। আপাতত এ বাড়িতে আবারও ফিরবে তস্কররা, সে সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। কাজেই এখানে ফাঁদ পেতে লাভ হবে না। আরও কিছুক্ষণ পর বেন মনস্থির করল, আপাতত বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। তবে সেক্ষেত্রে প্রথমেই চাই নির্ভর করা যায় এমন একটা গাড়ি।

গুদামঘরে গিয়ে ভাঙা জানালা দিয়ে ক্যাম্পার ভ্যানটা দেখল বেন। ওটা বহু পুরনো ও ধুলোভরা হলেও হয়তো কাজে লাগবে। একবার ক্যাম্পার ভ্যান চালু হলে পোচারের খোঁজে যে-কোনও জায়গায় যেতে পারবে সে।

আর্মির চাকরির সময়ে নানান প্রতিভার বিকাশ হয়েছে বেনের ভেতর। রেজিমেন্টের পুরনো গাড়ি নিজেই মেরামত করত। যুদ্ধের সময় ভিন দেশে ঢুকে দখল করে নিত শত্রু যানবাহন। হলওয়ের এক হুকে ক্যাম্পার ভ্যানের চাবি পেয়ে গাড়িটা পরীক্ষা করতে পেছনের উঠানে গেল বেন।

গাড়িটা বহু পুরনো হলেও যা ভেবেছে, তা-ই ঠিক। ক্যাম্পারের ভেতরে আছে দুটো বার্থ, স্লিপিং ব্যাগ, ব্ল্যাঙ্কেট, চুলা, হিটার আর ছোট কেমিকেল ক্যাসেট টয়লেট-কাম ওয়াশরুম। প্রচুর ধুলো থাকলেও গাড়িটাকে রীতিমত বিলাসবহুল বলেই মনে হলো বেনের। এর চেয়ে হাজার গুণ খারাপ জায়গায় থেকেছে। অবশ্য প্রথমে চালু হলো না ভ্যানের ইঞ্জিন। পরের বিশ মিনিটে ব্যাটারির করাগেটেড কানেকশন ঠিক করে, বাড়ি থেকে আনা পরিষ্কার, চকচকে প্লাগের গুণে, ইগনিশনে চাবির প্রথম মোচড়ে কাশতে কাশতে জেগে উঠল বুড়ি মহিলা। ব্যাটারি চার্জ করতে ইঞ্জিন চালু রাখল বেন। ফিরে গেল বাড়ির ভেতর।

মাঝদুপুরেই ফিকে হয়ে বিদায় নিচ্ছে হালকা রোদ। গত কয়েক বছর ইতালিতে ছিল বেন। তাই মনে ছিল না শীতে খুব চট্ করে সন্ধ্যা নামে উত্তর দিকের দেশে। লিভিংরুমে বসে একটা খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করল সে। এতে সফল হতে হলে দরকার হবে কিছু জিনিসপত্র। ঘর সার্চ করতে গিয়ে পেল পুরনো এক ইয়েলো পেজ। ওটার পাতায় পাতায় আছে এদিকের মানুষের টেলিফোন নম্বর ও ঠিকানা। বইটা একটু ঘাঁটতেই বেন বুঝল, একঘণ্টা দূরের এক জায়গা হওয়া উচিত ওর প্রথম গন্তব্য। কোনও ঝামেলা না হলে সন্ধ্যার আগেই ওখানে পৌঁছে যাবে ও।

বাড়ির দরজা লক করে পেছন উঠানে এসে ক্যাম্পার ভ্যানের ড্রাইভিং সিটে উঠল বেন। তিন মিনিট পর গাড়ি নিয়ে পৌছে গেল গ্রাম্যপথে। ভাবছে, সময় লাগবে না দরকারি সব জিনিস জোগাড় করতে। আর এরপরই শুরু হবে ওর শিকারি জীবন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *