1 of 2

স্বর্ণলিপ্সা – ৪১

একচল্লিশ

খামারবাড়ি পেছনে ফেলে ছুটছে মরিস মাইনর। কিছুক্ষণ পর পৌছে গেল জালের মত গ্রাম্যপথের জটলার ভেতর। উত্তর দিক লক্ষ্য করে চলেছে ওরা। মোটামুটি হিসেব করে দেখেছে রানা, কিনলোকার্ড গ্রাম এখনও কমপক্ষে পঞ্চাশ মাইল দূরে। অর্থাৎ নষ্ট করার মত সময় ওদের হাতে নেই।

চোরাই গাড়ি ঠিকঠাক চললেও আধুনিক টয়োটার তুলনায় ওটা প্রাচীন ঠেলাগাড়ি। বাজে রাস্তায় ঠাসঠাস শব্দে আওয়াজ করছে শক্যাজাম্পার (শক অ্যাব্যবার), তা ছাড়া বরফে মুহুর্মুহু পিছলে যাচ্ছে রাবার ক্ষয়ে যাওয়া টায়ার। কোঁ- কোঁ করছে পুরনো সাসপেনশন। অ্যাক্সেলারেটর চেপে রেখেছে রানা। তেলের মিটারের লাল অংশ দেখিয়ে চলেছে, ফুরিয়ে এসেছে টাঙ্কির ফিউল। দক্ষিণ থেকে এ৯২ হাইওয়েতে ওঠার আগেই পেট্রল চাই। তবে কপাল ভাল, রানা ও জেসিকা ব্ল্যাক মাউন্ট এলাকাতেই পেয়ে গেল সার্ভিস স্টেশন। পরের ঘণ্টায় পৌছুল শ্বাসরুদ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্যের এলাকা গ্লেনকোতে। পাহাড়ি এলাকায় হাজির হওয়ার পর বহু নিচে রয়ে গেল বিশাল সবুজ অরণ্যের এলাকা র‍্যানোচ মুর। এরপর গ্লেনের মাঝ দিয়ে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক উচ্চতায় নেমে এল ওরা।

‘এত সুন্দর মনোমুগ্ধকর দেশেও কীসব ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে,’ আনমনে বলল জেসিকা। কয়েক মুহূর্ত পর তাকাল রানার দিকে। ‘আমরা একটা ব্যাপারে আলাপ করিনি। পাব ঠিক আছে, তবে ওখানে না-ও যেতে পারে স্টুয়ার্ট। তাই দ্বিতীয় জায়গা আগে থেকেই ঠিক করে রাখা উচিত।’

‘জায়গাটা হতে হবে নির্জন,’ বলল রানা, ‘যেন চট্ করে ওদিকে কেউ যেতে না পারে। এরকম ভাল কোনও জায়গা চেনো তুমি?’

‘ভাবছি গ্রামের ছয় মাইল উত্তরে পরিত্যক্ত এক স্যানাটোরিয়ামের কথা। গত শতকে ওখানে যক্ষ্মা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হতো। পরে ওটা ব্যবহার করেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিকরা। এরপর থেকেই পড়ে আছে। কেউ কেউ বলে জায়গাটা খুব ভুতুড়ে। একবার কেউ গেলে আর ফেরে না।’

‘আমার তো মনে হচ্ছে চমৎকার জায়গা,’ বলল রানা।

‘তো ওখানে যেতে পারো স্টুয়ার্টকে নিয়ে। কিন্তু তাকে বন্দি করলেও, সহজ হবে না বেন হ্যাননকে ছুটিয়ে নেয়া।’

‘গ্রামে গিয়ে স্টুয়ার্টকে বলব, গোপন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছি সমস্ত সোনার মোহর,’ বলল রানা, ‘পরে স্যানা টোরিয়ামের কোনও ঘরে চেয়ারে বসিয়ে হাত-পা-মুখ বেঁধে রাখব। তাতে মাথা-ব্যথা শুরু হবে তার। এদিকে তার লোক জানবে না কোথায় হারিয়ে গেছে সে।’

‘বুঝলাম। কিন্তু তারপর?’

‘এখনও ঠিক করিনি,’ বলল রানা। ‘অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেব।’

‘আমি তোমার মত আত্মবিশ্বাসী হতে পারলে ভাল হতো।’

জেসিকার কথায় রানা বুঝল, নিজে ও আত্মবিশ্বাসী নয়। যদিও মুখে কিছু বলল না।

একটু পর লোহার তৈরি বলাচুলিশ সেতু পেরিয়ে সরু লক লেভেন পেছনে ফেলল ওরা। ওখান থেকে বেশি দূরে নয় হাইল্যাণ্ডের লক লিনহে। চারপাশে সফেদ চূড়া নিয়ে জঙ্গুলে এলাকা। একদিকে হাইওয়ে, অন্যদিকে স্লেটের মত ধূসর পানির বিস্তার। সামনেই উত্তরে ফোর্ট উইলিয়াম। নিয়মিত হাইওয়ে ধরে চলেছে যানবাহন। তবে শীতের প্রকোপে সংখ্যায় বেশ কম। ওদের এই যাত্রায় একটু পর পর হাতঘড়ি দেখলেও একটু পর রানা বুঝল, কিনলোকার্ড গ্রামের পাবে পৌছে যাওয়ার পরেও হাতে পাবে কমপক্ষে আরও আধঘণ্টা।

‘গ্রামে পৌঁছে কী করতে চাও?’ জানতে চাইল জেসিকা।

‘স্যানাটোরিয়ামের পথ দেখাও,’ বলল রানা, ‘ওখানে থাকবে তুমি। তারপর গ্রাম থেকে স্টুয়ার্টকে তুলে পৌঁছে যাব। সব ঠিক থাকলে আমার সঙ্গে তাকে দেখতে পাবে।

‘তুমি পাগল নাকি? আধঘণ্টারও বেশি ওই ভুতুড়ে বাড়ির ভেতর একা বসে থাকব?’ ঘন ঘন মাথা নাড়ল জেসিকা।

‘আমি তো ভেবেছিলাম তুমি ভূতে ভয় পাও না।’

‘আমি খিদেয় মরছি। আগে তো নাস্তার ব্যবস্থা করবে, নাকি?’

‘এখন নাস্তা?’ বলল রানা। ‘ওটার জন্যে তো বেশ দেরি হয়ে গেছে।’

‘তা হলে আর্লি লাঞ্চ চাই।’

‘হাতে সময় নেই।’

‘কী বলো! খেতে লাগবে বড়জোর দশমিনিট। শীতের ভেতর ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে এখন খেতেও না পেলে নিজের হাত কামড়ে খেয়ে নেব। শরীরটাও গরম করা দরকার।’

‘গতকালকের মত আবারও সয়া মিট দেয়া সালাদ?’

‘এবার আর অতটা সহ্য হবে না। আমার চাই বেকন, ডিম আর বিন। ‘দেখে তো মনে হচ্ছে তোমারও খুব খিদে লেগেছে।’

জেসিকার কথায় রানা টের পেল, পেটে ছুটোছুটি করছে একাধিক ছুঁচো। দৃঢ় মানসিকতার দেয়াল ধসে গেল ওর। নরম সুরে বলল, ‘দশমিনিট নাস্তার জন্যে। ঠিক আছে?

‘তো আগে আমার বাড়িতে চলো। কিচেনে সবই আছে।’ ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল রানা। ‘ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না। হয়তো এখনও অপেক্ষা করছে স্টুয়ার্টের লোক। তবে তারা চেনে না মিসেস ক্লার্কের কটেজ।’

‘তো তোমার কটেজ,’ রাজি হলো জেসিকা। ‘তবে ওটা এখন ডিপ ফ্রিযের মত ঠাণ্ডা। আমাকে ওখানে নামিয়ে দাও। আগুন জ্বেলে নেব। ততক্ষণে গ্রামের দোকান থেকে খাবার নিয়ে ফিরবে। ঠিক আছে?’

তর্কে না গিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘যা ভাল মনে করো।’

মিসেস ক্লার্কের কটেজের সামনে থামল রানা। জেসিকা গাড়ি থেকে নেমে যেতেই ওর হাতে কটেজের চাবি ধরিয়ে দিল। লাজুক হাসল মেয়েটা। ‘ফিরতে দেরি কোরো না। আর রান্নার তেল আনতেও ভুলে যেয়ো না।’

জেসিকার মিষ্টি হাসির রেশ রয়ে গেল রানার মনে। দেরি না করে চলল গ্রামের মুদি দোকানের উদ্দেশে। আকাশে নতুন করে জমেছে সাদা মেঘ। একটু পর হয়তো আবারও ঝরবে তুষার। মুদি দোকানের সামনে মরিস মাইনর রেখে ভেতরে ঢুকল রানা। আগের মতই কাউন্টারের ওদিকে বসে আছেন ঝোপের মত গোঁফওয়ালা সেই বৃদ্ধ দোকানি। পরস্পরের দিকে চেয়ে মৃদু মাথা দোলাল ওরা। তাক থেকে দরকারি জিনিস নিয়ে কাউন্টারে রাখতে লাগল রানা। বেকন, এক বাক্স ডিম, বড় এক টিন বেক করা বিন আর এক বোতল অলিভ অয়েল। দুই পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া পাউণ্ড পকেটে রয়ে গেছে। বিশ পাউণ্ডের একটা নোট দোকানির হাতে দিল রানা। খুচরো ভাংতি পকেটে পুরে মালপত্র নিয়ে বেরিয়ে এল। আবারও ঝরছে তুষার।

রানার পকেটে দ্বিতীয়বারের মত বাজল পিসি গ্রাহামের মোবাইল ফোন। গাড়ির দিকে পা বাড়িয়েও থেমে গেল রানা। ওর চুল ও কাঁধে জমছে তুষারের কণা। কেন যেন কোনও কারণ ছাড়াই শিরশির করে উঠল ওর মেরুদণ্ডের ভেতর। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকল রানা। বেজে চলেছে গ্রাহামের ফোন। কে হতে পারে কলার! কেমন যেন বাজে অনুভূতি হচ্ছে রানার মনে। পকেট থেকে নিয়ে কল রিসিভ করে কানে মোবাইল ফোনটা ঠেকাল। ‘হ্যালো?’

ওদিক থেকে এল রন স্টুয়ার্টের কণ্ঠ: ‘প্ল্যানটা একটু পাল্টে নিতে হলো, মিস্টার রানা।’

ধক করে উঠল ওর বুক। ‘তা হলে সোনার কয়েনগুলো আপনার আর লাগবে না?’

‘না-না, তা নয়। তবে আমি আসলে আপনার প্রস্তাবে ঠিক রাজি হতে পারছি না।’

‘সেক্ষেত্রে আমিও পারছি না। মুহুর্মুহু পল্টি খাওয়া লোক আমার পছন্দ নয়। অন্যের কাছেই কয়েন বিক্রি করব।’

খুশির হাসি হাসল রন স্টুয়ার্ট। তাকে খুব আত্মবিশ্বাসী মনে হলো রানার। কেমন যেন কু ডাকছে ওর মন।

‘আসলে আমার দিকটা এবার একটু অন্যভাবে দেখবেন আপনি,’ বলল স্টুয়ার্ট। ‘এখন আমার হাতে এমন কিছু রয়েছে, যেটা আপনার খুব বেশি পছন্দ। ওটার ক্ষতি হোক তা চাইবেন না আপনি। তা হলে খুলেই বলি। মিস থমসন আর আপনি তো… আ… বেশ অন্তরঙ্গ সময় কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব নয়। এবার যুক্তিসঙ্গত একটা চুক্তিতে আসার চেষ্টা করুন, মিস্টার রানা। আপনি দেরি না করে আমার হাতে তুলে দেবেন সোনার কয়েন। বদলে ফেরত পাবেন অক্ষত জেসিকা থমসনকে। এর এদিক-ওদিক হলে শত শত টুকরো করে মেয়েটাকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে।’

চুপ করে আছে রানা। হঠাৎ বড় ক্লান্ত বোধ করছে। শুকিয়ে গেছে গলা। অর্থাৎ ওর ভাড়া করা বাসার ঠিকানা জেনে নিয়েছে ওরা।

হাসল স্টুয়ার্ট। ‘হ্যালো? আপনি লাইনে আছেন তো?’

চাপা শ্বাস ফেলল রানা। তপ্ত স্রোত বয়ে গেল ওর ধমনীর ভেতর। নিচু গলায় জানতে চাইল ও, ‘জেসিকা এখন কোথায়?’

‘পথে। ধরে আনা হচ্ছে আমার বাড়িতে,’ হাসল স্টুয়ার্ট। ‘আমার দুই লোক তাকে ধরেছে আপনার কটেজের ভেতর থেকে। একটু হাত-পা ছড়ে গেছে, তবে এ ছাড়া ভালই আছে মেয়েটা। ওর উচিত হয়নি বাধা দেয়া।’

‘ওর কোনও ক্ষতি হয়ে থাকলে প্রাণে বাঁচবে না, স্টুয়ার্ট’ চাপা স্বরে বলল রানা।

‘বেশ, তুমি যখন ভদ্রতার মুখোশ খুলে ফেললে, আমিও খুলে ফেলছি মুখোশ। সোজাসাপটাই বলি—তোমার প্রস্তাব মেনে নিলে মস্ত ক্ষতি হতো আমার, তাই না, মেজর? তুমি কি আমাকে বোকা মনে কর? থমসনকে কুকুরের খাবার হতে দিতে না চাইলে নতুন প্রস্তাবটা মন দিয়ে শুনে নাও। যত দ্রুত সম্ভব হাজির হও আমার দুর্গে। চেনো তো…’

‘জানি তুমি কোথায় আছ,’ শুকনো গলায় বলল রানা।

‘গুড। বলাবাহুল্য, আসবে একা। সঙ্গে কেউ এলে খুন হবে জেসিকা। সোনার মুদ্রাগুলো হাতবদল হওয়া মাত্রই তোমার হাতে তুলে দেব ওকে। তোমাকেও ছেড়ে দেব। রাজি? মুক্ত বিহঙ্গের মত উড়ে যেতে পারবে যেদিকে খুশি।

‘আমার আর কোনও উপায় আছে বলে তো মনে হচ্ছে না,’ বলল রানা।

‘ঠিক বলেছ। এবার তা হলে রওনা হয়ে যাও। আমি আবার খুব ধৈর্যশীল মানুষ নই। ইতিমধ্যেই অনেক বেশি দেরি হয়ে গেছে, আর সহ্য করতে পারছি না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *