1 of 2

স্বর্ণলিপ্সা – ৪৭

সাতচল্লিশ

নিজের কোয়ার্টারের দিকে যেতে যেতে বাক ওয়াকি বুঝতে পারল, আসলেই খুব খারাপ ওর অবস্থা। দু’বার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়েছে। অতীতে আগেও দু’বার গায়ে গুলি লাগলেও এত যন্ত্রণা পেতে হয়নি। এবার আসলে বাজেভাবে আহত হয়েছে সে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে বলে চলেছে: আর যাই হোক, সামান্য একটা নাইন এমএম বুলেট ঠেকাতে পারবে না আমাকে।

অন্যান্য কাজ করার আগে একবার নিজের ঘরে ফিরতে হবে। কারণ ওখানেই আছে কিট ব্যাগ। ওটার ভেতরেই আছে দরকারি কিছু ড্রাগ্‌স্‌। কিছুক্ষণ পর হাঁফাতে হাঁফাতে ঘরে ঢুকে কিট ব্যাগ খুলে ওটা থেকে নিয়ে দুই সায়রেট মরফিন ইঞ্জেক্ট করল। তারপর কয়েক দফায় শ্বাসের সঙ্গে নাক দিয়ে নিল টুকরো ক্রিস্টাল মেথামফেটামিন। এরপর নিল বিশেষ সিরিঞ্জ। ওটার ভেতর ভরল এক্সটেণ্ডেবল সেলিউলোস স্পঞ্জ। সেগুলো ক্ষতের ভিতর ছিটিয়ে দিলেই আঠার মত আটকে দেবে ক্ষত। তখন আর রক্ত ঝরবে না। দুর্বলতা না বাড়লে বেশ কিছুক্ষণ লড়তে পারবে। আপাতত মেরামত হবে না বামহাত। তবে, একবার দুই মিলিয়ন পাউণ্ড হাতে পেলে দুনিয়ার সেরা চিকিৎসা নিতে পারবে।

কিছুক্ষণ নিজের চিকিৎসা করার পর আগের চেয়ে সুস্থ বোধ করল বাক ওয়াকি। ঘড়ি দেখে বুঝল, হাতে রয়েছে বাড়তি কয়েকটা মিনিট। তাই স্থির করল, দলের লোক পৌঁছে যাওয়ার আগে নিজেই খুঁজে দেখবে হারামি ওই পুলিশ জেসিকা থমসনকে। পরে সবাই এলে খুঁজে নেবে মাসুদ রানাকেও। এরই ভেতর মরফিন আর মেথামফেটামিন মিলে একটা আমেজের মত তৈরি করেছে তার মনে। কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আবারও বাটারি রুমের সামনে পৌছে গেল। চারপাশে চেয়ে দেখল, কোথায় যেন চলে গেছে স্টুয়ার্ট। ‘আমার টাকা বুঝিয়ে দিয়ে তারপর মরুক শালা,’ বিড়বিড় করল বাক ওয়াকি। মেঝেতে বেনেটের লাশ দেখে সিদ্ধান্ত নিল, পরে ওটার চিরস্থায়ী ব্যবস্থা নেবে।

আধঘণ্টা আগে ফোনে বেনেট বলেছে, হাত ফস্কে বেরিয়ে গেছে শয়তান মেয়েটা। করিডোরে তার ফেলে যাওয়া মরচের মত রক্তের শুকনো পদচিহ্নের পিছু নিল বাক ওয়াকি। করিডোরে বাঁক নেয়ার পর বিশফুট যেতেই মিলিয়ে গেল রক্তের দাগ। তবে হাল ছাড়ল না বাক ওয়াকি। কপাল ভাল, একটু পর খাটো এক সিঁড়ির ধাপে পেল পায়ে চটকানো রক্তের দাগ। সে বুঝে গেল, মেয়েটা গেছে পাথুরে খিলান পেরিয়ে রেসিডেনশিয়াল এরিয়ার দিকে। বাক ওয়াকির মন বলল, সামনে নিশ্চয়ই রক্তের আরও ফোঁটা থাকবে। বাটারি রুমের রক্ত জুতোয় নিয়ে ছুটে গেছে বোকা মেয়েলোকটা। পোশাক, হাত, মুখ আর চুলেও নিশ্চয়ই রক্ত লেগেছে। আরও কয়েক গজ যেতেই করিডোরে বাঁক নেয়ার আগে দেয়ালে দেখল লাল আঠালো চিহ্ন। বাক ওয়াকি তিক্ত স্বরে বিড়বিড় করে বলল, ‘কুত্তী, তুই শেষ!’

মেথ আর মরফিনের গুণে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে তার মগজ। ফাইটার প্লেনের পাইলটের মত তীক্ষ্ণ হয়েছে চোখ। কোমর থেকে পিস্তল নিয়ে শক্ত হাতে ধরল সে। সামনে কিছু নড়লে সরাসরি গুলি করবে। বুঝে গেছে, তুষারঝড়ের ভেতর ভুলেও বেরোবে না মেয়েটা। অর্থাৎ, নিশ্চয়ই কোথাও লুকিয়ে আছে দুর্গেরই ভেতর!

ধীর পায়ে করিডোর ধরে চলল সে। মার্বেলের মেঝেতে ক্লিক-ক্লিক আওয়াজ তুলছে বুট। একটু পর একটা দরজার হাতলে রক্তমাখা হাতের চিহ্ন দেখল। একটু আগেও ওখানে ছিল স্টুয়ার্ট। মজা করে খেয়েছে ভাজা স্যামন মাছ। ওই ঘরেই দলের করপোরেট গাধাদেরকে নিয়ে দামি খাবার আর শ্যাম্পেন সাবাড় করে সে।

ডাইনিং রুমে জেসিকা আছে ধরে নিয়ে কুমিরের মত এক কান থেকে আরেক কানে গেল বাক ওয়াকির চওড়া হাসি। কান পাতল দরজায়। তবে ওদিকে কোনও আওয়াজ নেই। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল সে। সুরেলা কণ্ঠে বলল, ‘কই, বেরিয়ে এসো, ডার্লিং! তুমি কোথায়?’

টেবিলের দিকে চোখ গেল তার। টেবিলক্লথটা প্রায় তাঁবুর মত স্পর্শ করেছে মেঝে। সামনে বেড়ে টেবিলের পাশে থেমে ঝটকা দিয়ে কাপড়টা তুলল সে। পিস্তল হাতে ঝুঁকে দেখল টেবিলের নিচে। বিড়বিড় করল, ‘যাশালা!’

টেবিলের নিচে নেই জেসিকা। কাপড়টা হাত থেকে ফেলে জানালার দিকে তাকাল বাক ওয়াকি। জানালার দু’দিকে মুড়িয়ে রাখা পর্দা নেমে এসেছে মেঝেতে। ‘ওরে, বোকা শালী, তুই তা হলে ওখানে?’ দ্রুত হেঁটে ডানদিকের জানালার সামনে থামল সে। ঝটকা দিয়ে সরাল পর্দা কিন্তু কাঠের প্যানেল ছাড়া ওদিকে কিছুই নেই। পরের জানালাও পরখ করল। কেউ নেই। ‘আরেহ্, শালী তো মহা হারামির বাচ্চা! নিশ্চয়ই এখানেই কোথাও আছে!’

সত্যিই ঘরে আছে জেসিকা। মার্বেলের মেঝেতে পদশব্দ শুনেছে। এরপর খুলে গেল দরজা। টেবিলের কাপড়টা সরাল কেউ। সরানো হলো জানালাদুটোর পর্দাও। তবে লোকটা ঘরে ঢোকার আগে জেসিকার মনে হয়েছে, টেবিলের নিচে লুকিয়ে থাকলে যখন-তখন ধরা পড়বে। তাই সোজা গিয়ে ঢুকেছে ফায়ারপ্লেসের ভেতর। চিমনির দু’দিকে হাত রেখে গায়ের জোরে নিজেকে তুলে নিয়েছে ওপরে। চিমনির কালিঝুলি মেখে ভূত হয়ে গেছে। পায়ের নিচে একগাদা জ্বালানি কাঠ। একবার আগুন জ্বেলে দিলে জীবন্ত শিক কাবাব হয়ে যাবে ও।

লোকটার কথা শুনেই বুঝেছে, প্রলাপ বকছে ভয়ঙ্কর এক নেশাখোর। ভয়ে শুকিয়ে গেছে ওর গলা। অন্ধকার চিমনির ভেতর ঝুলে থেকেছে। নড়তেও ভুলে গেছে। হাত বা পায়ে লেগে চিমনি থেকে ঝরঝর করে নিচে পড়তে পারে কালিঝুলি। তার চেয়েও খারাপ হবে হাত ফস্কে লোকটার পায়ের কাছে গিয়ে পড়লে। তখন আর ওকে খুঁজে নিতে হবে না তার।

একমিনিট ধরে বিড়বিড় করে ওকে গালি দিল লোকটা, তারপর তিক্ত স্বরে বলল, ‘ঠিক আছে, কুত্তী! ভাবিস না যে রেহাই পেলি! একবার ধরতে পারলে ছোরা দিয়ে মুখে এমনই ডিযাইন করে দেব, তোর বাপ-মাও লাশ চিনবে না!’

একটু পর খুলে গেল দরজা। ধুপ করে বন্ধ হলো। করিডোর ধরে দূরে চলে গেল পদশব্দ।

আরও একটু পর ধীরে ধীরে ফায়ারপ্লেসে নেমে এল জেসিকা। সোনাপানি করা প্রকাণ্ড আয়নায় নিজেকে দেখল। আগের মতই দুর্বল ও অসহায় দেখাচ্ছে ওকে। শরীরে মেখে আছে ঝুলকালি। হেঁটে কোথাও গেলেই ঝরবে কয়লার গুঁড়ো। ছুটে গিয়ে দরজা ফাঁক করে করিডোরে উঁকি দিল জেসিকা। আশপাশে কেউ নেই। বড় করে শ্বাস নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। জানে না, মস্ত এই দুর্গের কোথায় লুকিয়ে পড়তে পারবে।

একটু দূরেই চওড়া সিঁড়ি ওপরে গেছে। ওটার দু’পাশের ভিত্তির ওপর শিরস্ত্রাণ পরা দুটো মূর্তি। চকচকে দস্তানায় গুঁজে রাখা আছে দীর্ঘ দুটো তলোয়ার। কাছের মূর্তির দস্তানা থেকে তলোয়ারটা খুলে নিল জেসিকা। ওটা দৈর্ঘ্যে প্রায় ওর সমান। তেমনই ভারী। তবে ছোরা নিয়ে কেউ ওর মুখে ডিযাইন করতে এলে এক খোঁচায় তার পেট ফাঁসিয়ে দেবে ও। দু’হাতে তলোয়ারের হাতল ধরে ঝড়ের বেগে সিঁড়ি বেয়ে ওপরের গ্যালারিতে উঠল জেসিকা। একমুহূর্ত দ্বিধায় পড়ল। ডানে যাবে, নাকি বামে?

দ্বিধা এলে বামে যাই, বলেছিল রানা। ওর পরামর্শ মেনে নিল জেসিকা। বামে ল্যাণ্ডিং সরু হয়ে মিশে গেছে এক করিডোরে। দু’দিকে বার্নিশ করা অপূর্ব সুন্দর ওক কাঠের দরজা। পর পর তিনটে দরজা পেছনে ফেলে চতুর্থ দরজার কাছে গিয়ে দেখল, সামান্য ফাঁক হয়ে আছে কবাট। সাবধানে ভেতরে উঁকি দিল জেসিকা। ঘর খালি এবং খুব বিলাসবহুল। দরজার তালায় ঝুলছে বড় একটা চাবি। নীরবে ঘরে ঢুকল জেসিকা। চাবি ঘুরিয়ে আটকে দিল দরজার তালা। এতক্ষণ পর একটু স্বস্তির শ্বাস ফেলতে পারল। চারপাশে খুঁজছে আরও ভাল কোথাও লুকিয়ে পড়ার জায়গা। ঘরের একদিকে পাঁচজন ঢুকে পড়তে পারবে এমন বড় এক ওয়ারড্রোব। আরেকদিকে রাজকীয় পালঙ্ক। ওটার নিচে লুকিয়ে পড়া যেতে পারে।

খাটের পাশে সাইড টেবিলে আছে পুরনো আমলের একটা টেলিফোন। ওটার বুকে আঙুল ঢুকিয়ে ডায়াল করতে হয়। ক্লথ কর্ড সংযুক্ত করেছে সেটের সঙ্গে রিসিভারটাকে। জাদুঘর ছাড়া আজকাল অন্য কোথাও এ জিনিস দেখা যায় না। ছোটবেলায় ওদের বাড়িতে এমন একটা ফোন ছিল। তলোয়ার বিছানায় রেখে কানে রিসিভার ঠেকাল জেসিকা। ডায়ালারে আঙুল ভরে ডায়াল করল হাইল্যাণ্ড এবং আইল্যাণ্ড ডিভিশনাল পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। কয়েক মুহূর্ত পর কল রিসিভ করল কেউ।

সময় নষ্ট না করে বলল জেসিকা, ‘আমি পিসি জেসিকা থমসন, ফোর্ট উইলিয়াম থেকে। জরুরি ভিত্তিতে ডিটেকটিভ চিফ সুপারইণ্ডেণ্ট কানিংহ্যামের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’

‘সরি। তিনি এখন জরুরি মিটিঙে আছেন।’

দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরল জেসিকা। ‘তা হলে তাঁর ডেপুটির সঙ্গে কথা বলতে চাই।’

‘দুঃখিত, আপনি আসলে কী বিষয়ে বলতে চান?’

‘সেটা তাঁকেই বলব। প্লিয, দেরি করবেন না। খুব জরুরি।’

‘একমিনিট অপেক্ষা করুন।’

অপেক্ষা করল জেসিকা। সময় যেন পেরোতে চাইল না। ওদিক থেকে কথা বলছে না কেউ। বারবার ঘরের দরজার দিকে তাকাচ্ছে জেসিকা। মনে হচ্ছে, যে-কোনও সময়ে ধুমধাম আওয়াজে ধাক্কা শুরু হবে। আরও কয়েক মুহূর্ত পর ডিসিএস বা তাঁর ডেপুটি নয়, লাইনে এলেন ইনভার্নেসের সিআইডি চিফ। চেইন অভ কমাণ্ড অনুযায়ী তিনি জেসিকার উচ্চপদস্থ অফিসার।

রন স্টুয়ার্টের দুর্গ কোথায়, এবং ওখানে এসে কী ধরনের বিপদে পড়েছে, শান্ত স্বরে সিনিয়র অফিসারকে জানাল জেসিকা। আরও বলল, গোটা ব্যাপারটাতে জড়িয়ে আছে মানুষ খুন আর কিডন্যাপিং। ঘুষখোর পুলিশের ক’জনকে নিয়ে বিলিয়নেয়ার রন স্টুয়ার্টের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর জন মুরে আর সার্জেন্ট ডানকান রিড। জেসিকার কথা শুনে প্রথমে সন্দেহের ভেতর পড়লেন সিআইডি চিফ। তবে একটু পর বুঝলেন একটা কথাও মিথ্যা বলছে না জেসিকা।

‘আমি মজা করতে ফোন করিনি, স্যর,’ কথা শেষ করার আগে বলল জেসিকা। ‘মিথ্যা বলার কোনও আগ্রহও নেই। জরুরি ভিত্তিতে আপনাদের সাহায্য না পেলে একটু পর হয়তো খুন হয়ে যাব একদল ডাকাতের হাতে।’

কথা শেষ করে রিসিভার নামিয়ে রাখল জেসিকা, ভাবল হয়তো আধঘণ্টার ভেতর পৌঁছে যাবে পুলিশ বাহিনী। পা টিপে টিপে গিয়ে দরজায় কান পাতল। বাইরের করিডোরে কোনও আওয়াজ নেই। একটু পর জানালায় গিয়ে থামল। পরিষ্কার দিনে হয়তো দেখত দূরে পাহাড় আর সুউচ্চ পর্বত। তবে আকাশ কালো করে পৃথিবীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে তুষারঝড়। ঘড়ি দেখে জেসিকা বুঝল, পৌনে একঘণ্টারও বেশি হলো ধর্ষক লোকটার হাত থেকে ছুটে এখানে-ওখানে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে ও। দিনের আলো নিভিয়ে ঘনিয়ে এসেছে সন্ধ্যার আবছা আঁধার। দুর্গের আঙিনায় দমকা হাওয়ায় একদিক থেকে আরেকদিকে ছুটছে বরফকণা। এরই ভেতর উঠানে জমে গেছে হাঁটু সমান তুষার। তারই মাঝ দিয়ে এক সারিতে আসছে তিনটে জিপগাড়ি। জ্বলছে হেডলাইট। কয়েক মুহূর্ত পর আঙিনায় এসে থামল ওগুলো।

জেসিকা চট্ করে বুঝে নিল: যারা এসেছে, তারা পুলিশ নয়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *