বিশ
ক’দিন আগের কথা।
সংসার জীবনে প্রবেশ করে বেন হ্যানন প্রায় ভুলেই গিয়েছিল যুদ্ধের ময়দান কত ভাল লাগত তার। আর এজন্যেই মিলিটারি জীবনটাকে এত ভালবাসত। লড়তে গেলে যেভাবে উত্তেজিত হয় হৃৎপিণ্ড, তেমন মজা আর কোনও কাজে নেই। তার ওপর এবার লড়বে প্রিয় ভাতিজার জন্যে। বেচারা গুরুতরভাবে আহত হয়ে পড়ে আছে হাসপাতালে। এর পেছনে যারা দায়ী, এক এক করে সবার পাওনা সুদে-আসলে মিটিয়ে দেবে সে।
ইনভার্নেস শহর থেকে ফেরার সময় কিনলোকার্ড গ্রামে না গিয়ে সরাসরি লক আরডাইকের তীরে ঘন পাইনের জঙ্গলে ক্যাম্পার ভ্যান রেখেছে সে। সদ্য কেনা ছোরা দিয়ে গাছের ডালপালা কেটে ওগুলো দিয়ে ঢেকে দিয়েছে গাড়িটাকে। এতই নিখুঁত ক্যামোফ্লেজ, দু’ফুট দূর দিয়ে গেলেও কেউ বুঝবে না এদিকে ওঁৎ পেতে বসে আছে বেন।
দিনের বাকি সময় কমাণ্ড সেন্টারে বসে মনে মনে গুছিয়ে নিয়েছে সে তার রণকৌশল। বুঝে গেছে, যেখানে পাওয়া গিয়েছিল রবার্টের ভাসমান লাশ, পোচারকে খুঁজে বের করতে হলে যেতে হবে তার উল্টোদিকের তীরে। অবশ্য, ভয় পেয়ে এই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারে লোকটা। সেক্ষেত্রে হয়তো কোনদিনই সত্যটা জানবে না বেন।
এটা ভাবতে গিয়ে তিক্ত হয়ে গেল তার মন।
পিটারের বাড়ি ত্যাগ করার পর থেকে যোগাযোগ করা হয়নি মিরাণ্ডার সঙ্গে। এখন একা বসে আছে জঙ্গলে মানুষ শিকার করতে। বেচারি মিরাণ্ডা বোধহয় আছে খুব দুশ্চিন্তায়। এ-কথা ভাবতে গিয়ে বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরোল বেনের। স্থির করল, কাজ শেষ হলে আর কখনও স্ত্রীকে ফেলে কোথাও যাবে না। এক্কেবারে তিন সত্যি, মনে মনে শপথ নিল বেন।
ক্যাম্পার ভ্যানে বসে পার করল দিনটা। এরপর হঠাৎ করেই জঙ্গলে ঝুপ করে নামল ঘুটঘুটে কালো আঁধার রাত। সেদ্ধ শিমের বিচি আর পাউরুটি দিয়ে সেরে নিল ডিনার। পর পর দু’বার নিল দুই মগ কালো ঘন কফি। জ্বলন্ত গ্যাস স্টোভের গুণে ভ্যানে প্রবেশ করতে পারল না কনকনে শীত। মাঝরাত হওয়ার পর ক্রসবো আর ব্যাগ নিয়ে তৈরি হলো বেন। ক্ষুরধার ছয়টা তীর নিয়ে ধনুকের অনবোর্ড তূণে রাখল। তার ধারণা, বড় ধরনের বিপদ তৈরি করবে না পোচার। তবে সতর্ক থাকা ভাল। তাই সশস্ত্র হয়ে নিয়েছে। এবার পরল ঘিলি সুটের কোট-প্যান্ট। মাথায় নাইট-ভিশন গগলসের হেড হার্নেস আটকে নিল পোশাকের ওপরের অংশে। কাজ শেষ হলে নিঃশব্দে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। অন্ধকার জঙ্গলে এগিয়ে চলল লক আরডাইকের উত্তর-পশ্চিম তীর লক্ষ্য করে। গগলসের গুণে চারপাশ হয়ে গেছে সাগরের নিচের সবজেটে পরিবেশের মত। বরফে ঢাকা মাটিতে হাঁটলে বিশ্রী আওয়াজ হয়। তবে যাদেরকে ট্রেইনিং দিয়েছে বেন, তারা চলে নিঃশব্দে। বেশিরভাগ কমাণ্ডোর চেয়ে কম আওয়াজ তুলে চলল সে।
লক আরডাইকের সিকি মাইল দূরে পৌঁছে সরু এক ডাল ভাঙার আওয়াজে হঠাৎ করেই বরফের মূর্তি হলো বেন। শেওলা ও পাতা রঙের সুট মিশে গেছে অন্ধকার ঝোপঝাড়ের সঙ্গে। পেরিয়ে গেল কয়েক মুহূর্ত। তারপর বেনের কয়েক ফুট দূরে এসে থামল সবজেটে পটভূমিতে ছোট এক হরিণ। ওটা কমবয়সী মাদী। গাছের নিচে খাবার খুঁজতে খুঁজতে এগোচ্ছে। সম্পূর্ণ সতর্ক। কোথাও আওয়াজ হলে বা কিছু সামান্য নড়লেই মুহূর্তে চার পা চালিয়ে তীরবেগে উধাও হবে। বেন এতই স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছে, তার উপস্থিতি টের পেল না জন্তুটা।
হরিণটার দিকে চেয়ে আনমনে হাসল প্রাচীন যোদ্ধা। মিলিটারি জীবনে বহু হিংস্র মানব-জন্তুকে খতম করে দিয়েছে সে। কেউ বলতে পারবে না নিষ্পাপ কোনও প্রাণীকে কখনও কষ্ট দিয়েছে। সুতরাং এই কমবয়সী হরিণীরও ক্ষতি হবে না। চারফুট দূর দিয়ে গেল ওটা। ভয় যেন না পায় তাই চুপ করে অপেক্ষা করল বেন। ওটা বিদায় নেয়ায় আবার এগোল।
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আধঘণ্টা হেঁটে বেন পৌঁছে গেল লকের তীরে। পাইনের গাছের সারি ঝুঁকে গেছে জলাশয়ের দিকে। এখানে-ওখানে থোকা থোকা কুয়াশা। নাইট-ভিশনের জন্যে মনে হলো ওগুলো বিষাক্ত সবুজ গ্যাস। তীর ধরে আধমাইল হেঁটে আশপাশে কাউকে দেখল না বেন। তবে এসএএস ফোর্সে শেখানো হয়েছে ধৈর্য ধরতে। ধীরে ধীরে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আরও আধমাইল গিয়ে ভাবল, বৃথা হয়েছে আজ রাতের অভিযান। অবশ্য শতখানেক গজ যাওয়ার পর দূরে পানির ধারে হঠাৎ করেই দেখল সবজেটে ভুতুড়ে আলো। তা হলে সত্যিই কেউ আছে ওদিকে!
নিঃশব্দে এগিয়ে চলল বেন। সতর্ক হরিণ টের পায়নি কতটা কাছে ছিল সে। কাজেই সম্ভাবনা খুব কম যে কেউ ওকে দেখতে পাবে। ক্যামোফ্লেজ পোশাকে সে হয়ে গেছে ঝোপের মত। সামনের ওই লোক বড়সড়ো আকারের, শুয়োরের মতই মোটাসোটা। গায়ে ওঅটারপ্রুফ উইন্টার জ্যাকেট। মাথায় উলের ক্যাপ। পায়ে গামবুট। মাছ ধরার সরঞ্জাম গুছিয়ে নিচ্ছে। আরেকটু দেরি হলে তার সঙ্গে আর দেখাই হতো না বেনের। সাদা বরফে ছাওয়া ঝোপের ভেতর স্থির হয়ে দাঁড়াল ও। নিজের মালপত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে পোচার। লকের তীর থেকে একটু দূরে গাছের সারির ওদিকে সরু পথে দাঁড়িয়ে আছে পুরনো এক সুবারু ফোর-হুইল- ড্রাইভ পিকআপ। ওটার টেইল গেট খুলে সরঞ্জাম তুলল পোচার। আবারও ফিরল জলের ধারে। কুড়িয়ে নিল ছোটখাটো কিছু ইকুইপমেন্ট। গাড়ির কাছে ফিরে বেশ সময় নিয়ে খুলল পায়ের গামবুট। এদিকটা বোধহয় নিজের বাড়ি বলে মনে করে সে। আছে খুব নিশ্চিন্তে। জানে না, একটু দূর থেকে চোখ রেখেছে কেউ। হাঁসফাঁস করতে করতে তীর থেকে এনে গাড়ির পেছনে তুলল লম্বাটে একটা ক্রেট। বেন বুঝল, ওটার ভেতর আছে স্যামন মাছ। ক্রেট যতটা ওজনদার মনে হচ্ছে, আজ রাতে প্রচুর শিকার পেয়েছে লোকটা।
বেন স্থির করল, একটু পর চোরাই মৎস্য-শিকারি গাড়িতে উঠতে গেলেই কাজে নামবে সে।
.
চারঘণ্টা ধরে বরফ-ঠাণ্ডা পরিবেশে থেকে প্রায় জমে গেছে বিলি ম্যাকগ্রার দেহ। এখন ওর মন চাইছে উড়ে গিয়ে কেবিনে পৌঁছে যেতে। আগুন জ্বেলে গপগপ করে গিলবে কয়েক টুকরো র্যাবিট পাই। এরপর সিকি বোতল বেল’স উইস্কি গিলে সোজা শুয়ে পড়বে বিছানায়। কম্বলের ভেতর থাকবে গরম পানির বোতল। তাতে সময় লাগবে না ওম পেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে। নাহ্, আজ সত্যিই খুব ক্লান্ত সে। হয়তো স্বপ্নে দেখবে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ধরছে। আর ঘুম থেকে উঠে আরামসে পেট পুরে খাবে ভাজা স্যামন। তা ছাড়া, মাছ বিক্রি করেও পকেটে আসবে নগদ বেশ কিছু টাকা।
চাকরি নিয়ে কারও বকা খেতে হচ্ছে না তাকে। নানান লকে মৎস্য-শিকার করে ভালই কাটছে অলস জীবন। বহুদিন আগেই বুঝে গেছে, অন্যের হয়ে কাজ করার ধাত তার আসলে নেই। ছোটবেলা থেকেই মিশতে পারে না মানুষের সঙ্গে। তাতে বড় কোনও ক্ষতিও হয়নি। ভাল করেই চেনে এই এলাকা। ভালবাসে প্রকৃতির মাঝে বাস করতে। শহুরে ব্যস্ততা বা হৈ-চৈ নেই এমন জায়গা বেছে নেয়। লক থেকে ধরে নিশ্চিন্তে সাবড়ে দিচ্ছে দারুণ স্বাদের পেটমোটা বড় সব স্যামন মাছ। তার ওপর গোপনে বেআইনি কাজ করার ফলে মনে থাকছে নিষিদ্ধ এক আনন্দ। হয়তো সেজন্যেই বারবার ফিরছে প্রিয় এই লকে। ছোটবেলা থেকে এখানে মাছ ধরছে সে। এ যে কী নেশা, মৎস্য-শিকারি না হলে কেউ বুঝবে না।
এই নেশা মিশে গেছে আমার রক্তে, ভাবল ম্যাকগ্রা। সেজন্যেই আরডাইক লকে মানুষ খুন হলেও পাত্তা দিচ্ছি না। সাধারণ মানুষ হলে ভুলেও এদিক আর মাড়াত না।
ম্যাকগ্রার মনে আছে, লোকগুলো ধাক্কা দিয়ে লকে ফেলার সময় কী করুণ আহাজারি আর আর্তচিৎকার জুড়েছিল’ রবার্ট উইলসন। লগি দিয়ে বুক-পেটে গুঁতো মেরে পানির নিচে তাকে তলিয়ে দিল খুনিরা। বারবার ভেসে উঠতে চেয়েছে রবার্ট। বগ-বগ শব্দে গলা দিয়ে ঢুকছিল পানি। এরপর কয়েক মিনিটে ফুসফুসভরা পানি নিয়ে পচা লতাপাতার ভেতর ভেসে উঠল নিস্পন্দ লাশ।
ঝোপে ঘাপটি মেরে বসে সবই দেখল বিলি। চিনেও গেল খুনিদের দু’জনকে। যদি ওদের চোখে পড়ে যেত, নিজেও খুন হতো। এই ঘন জঙ্গল আর গভীর লক খুব বিপজ্জনক ও নির্জন। চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে খুনির দল। এজন্যেই আজকাল খুব সতর্ক থাকে ম্যাকগ্রা। রবার্টের লাশ যেখানে পাওয়া গেছে, সেখান থেকে বারো মাইল পশ্চিমে সরে ইদানীং মাছ ধরছে ও। ঝুঁকি কমাতেই এড়িয়ে গেছে কিনলোকার্ড গ্রাম। ওখানে পার্ক করা আছে তার ভাড়া নেয়া মোবাইল হোম। প্রতিমাসে পয়সা দিতে হচ্ছে ওটার মালিকটাকে। তা যাক! সবসময় তো আর জেতা যায় না! গত ক’দিন হলো জঙ্গলে পরিত্যক্ত পাথুরে এক কুটিরে উঠেছে সে। ছোটবেলায় ওখানেই উঠত বাবার সঙ্গে। মন দিয়ে শিখত কীভাবে চুরি করতে হবে স্যামন মাছ।
অতীত নিয়ে ভাবতেই তিক্ত হলো ম্যাকগ্রার মন। ভীষণ নিষ্ঠুর ছিল তার বাবা। আদর যেমন করত, তেমনি একটু এদিক-ওদিক হলেই বেধড়ক পেটাত। ঠোঁটের ক্ষতচিহ্নটা স্পর্শ করল সে। বাকি জীবন এটা নিয়েই বাঁচতে হবে তাকে।
গভীর জঙ্গলে কেবিনটা জরাজীর্ণ হলেও ওখানেই আছে সে। আগে বুঝে নেবে খুনিদের চোখ পড়েছে কি না ওর ওপর। তারপর পরিবেশ স্বাভাবিক বলে মনে হলে ফিরবে গ্রামের মোবাইল হোমে।
পিকআপের পেছনে বিন ব্যাগে গামবুট রাখল ম্যাকগ্রা। পরে নিল বুটজুতো। অভ্যেসবশত মোবাইল ফোন বের করে দেখল ফেসবুক পেজ। কোনকালেই তার কোনও বন্ধু ছিল না, তাই কেউ যোগাযোগও করে না। রিসেপশন খুব খারাপ জঙ্গলের ভেতর। বুকপকেটে ফোন রেখে আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলল সে। ক্লান্ত ভঙ্গিতে বন্ধ করল গাড়ির টেইল গেট। ধীর পায়ে পৌঁছুল ড্রাইভিং দরজার পাশে। ওটা খুলে উঠে পড়ল গাড়িতে। স্টিয়ারিং হুইলে প্রায় ঠেকে গেল ফোলা পেট। ক্রমেই আরও মোটা হয়ে উঠছে সে। তবে তাতে কোনও ক্ষতি নেই। সঙ্গিনী নেই যে ওজন নিয়ে টিপ্পনী কাটবে। দরজা খুললেও জ্বলেনি সুবারু পিকআপের ভেতরের বাতি। গাড়িটা এতই পুরনো, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সব যন্ত্রপাতি। সুইচ টিপে দিতেই ক্যাবের ভেতর জ্বলল হলদে মিটমিটে আলো। আর তখনই প্রথমবারের মত ম্যাকগ্রা দেখল, প্যাসেঞ্জার সিটে বসে আছে ভীষণ বিদঘুটে কোনও প্রাণী!
আঁৎকে উঠে গাড়ি থেকে নেমে পড়তে চাইল ম্যাকগ্রা। একপলকে বুঝে গেছে, ওটা মানুষ নয়, ভয়ঙ্কর কোনও জন্তু। বোধহয় উঠে এসেছে আরডাইক লকের গভীর থেকে। সারাশরীরে সবুজ লতাপাতা। ম্যাকগ্রার ধাঁ করে মনে পড়ল আরডাইক লক নিয়ে তার দাদার বলা ভীতিকর কাহিনী। কিন্তু ওই পৌরাণিক জন্তুর চোখে হাই-টেক নাইট-ভিশন গগল্স্ থাকার কথা নয়! হাতে আবার কক করা ক্রসবো! ক্ষুরের মত ধারাল তীরের ফলা চেয়ে আছে তার মোটা পেটের দিকে।
হ্যাণ্ডেল মুচড়ে দরজা খুলেই লাফ দিয়ে নেমে একদৌড়ে গভীর জঙ্গলে পালিয়ে যাবে, ভাবল সে। কিন্তু কিছু করার আগেই গ্লাসগো এলাকার উচ্চারণে বলল জন্তুটা: ‘ভুলেও ও- চেষ্টা কোরো না, খোকা। চুপ করে বসে থাকো।’
আরডাইক লকের হিমশীতল পানি যেন ঢুকল ম্যাকগ্রার রক্তনালীর ভেতর। ভয়ের চোটে ভুলে গেছে শ্বাস নিতে। দু’বার ঢোক গিলে হড়বড় করে বলল, ‘ক… ক্কা… কে আপনি?’
জবাবে অদ্ভুত জন্তু বলল, ‘আমি কে সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। নিজের কথা বলো। তুমি কে? নাম কী?’
এক শ’ ধরনের দুশ্চিন্তা চেপে ধরল ম্যাকগ্রাকে। প্রথমেই ভাবল, আমাকে খুন করতে পাঠানো হয়েছে একে। তা হলে সত্যি হয়ে উঠেছে দুঃস্বপ্ন! খুনিরা জেনে গেছে ওর কথা! ক্রসবোর দিকে তাকাল বিলি। এতই ভয়, গলার কাছে উঠে এল টক-টক বমি। তুতলে উঠে বলল, ‘জ… জ… জনি… জনি মি… মিচেল।’
জবাব শুনে ক’মুহূর্ত নীরব থাকল আরডাইক লকের পৌরাণিক জানোয়ারটা। কী যেন ভাবছে। শেওলাভরা হাত বাড়িয়ে ম্যাকগ্রার কোটের বুকপকেট থেকে নিল মোবাইল ফোন। একহাতে ম্যাকগ্রার পেটে তাক করেছে ক্রসবো। স্ক্রিন আনলক করে ফোন দেখছে। ঢোক গিলল দুর্ধর্ষ চোরা মৎস্য- শিকারি। মনে পড়ল খোলা আছে মোবাইল ফোনে ফেসবুকের পেজ।
‘ওটা দেখেই বীভৎস জন্তু জেনে গেল তার আসল নাম। গম্ভীর কণ্ঠে বলল ওটা, ‘আবারও মিথ্যা বললে, বাছা, ধরে নাও তুমি লাশ হয়ে গেছ।’
তাতে আবার বুকে একটু ভরসা পেল ম্যাকগ্রা। জন্তুটাকে বোধহয় খুন করতে পাঠানো হয়নি। ‘আচ… ঠিক আছে। আর মিথ্যা বলব না। আমার নাম বিলি ম্যাকগ্রা।’ সামান্য সাহস ফিরতেই জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি আসলে কে?’
লতাপাতাভরা হুড খুলল জানোয়ার। ম্যাকগ্রা দেখল ঘিলি সুটের ভেতর দাড়িওয়ালা বয়স্ক এক লোক। জানুয়ারি মাসে শীতল পানির স্যামন মাছের অস্বচ্ছ চোখের চেয়েও বেশি, নিস্পৃহ তার চোখ।
‘নামটা হ্যানন। আমি পিটারের চাচা।’
চমকে গেছে ম্যাকগ্রা। মুখ দিয়ে বেরোল, ‘সর্বনাশ!’ তবে পরমুহূর্তে বুঝল মুখ বন্ধ করে রাখা জরুরি ছিল।
‘রবার্ট খুন হওয়ার পর আমার ভাতিজার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলে,’ বলল পিটারের চাচা। ‘তখনও আহত হয়নি ও।’
‘আ…’
‘খবরদার, ভুলেও মিথ্যা বলবে না, ম্যাকগ্রা। তোমার চোখ বলে দিচ্ছে ভুল বলছি না। তুমিই সেই পোচার। নিজের চোখে দেখেছ রবার্টকে খুন হতে।’
মিথ্যা বলে লাভ হবে না, বুঝে গেল ম্যাকগ্রা। কেন যেন হালকা হয়ে গেল তার বুক। সহজ সুরে বলল, ‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। নিজের চোখে দেখেছি। খুনিগুলো খুব কষ্ট দিয়ে মেরেছে রবার্টকে। আমাকে যদি মেরেও ফেলেন, ওই দৃশ্য ভুলতে পারব না আমি।’
‘আমি ক্ষতি করতে আসিনি, ম্যাকগ্রা। তবে মিথ্যা বললে প্রচণ্ড ব্যথা পাবে। চিরকালের জন্যে হারিয়ে যাবে এই জঙ্গলের ভেতর। কেউ জানবে না কোথায় আছে তোমার কবর। আমার কথা কি বুঝতে পেরেছ?’
ভয় পেয়ে পিছাতে চাইল ম্যাকগ্রা। কিন্তু গাড়ির ভেতর যথেষ্ট জায়গা নেই। তিরতির করে কাঁপছে তার দুই হাত। ‘আপনি আমার কাছে কী চান?’
‘আমাকে জানাবে খুনিদের পরিচয়। তাদের নাম কী? কোথায় থাকে? কোথায় তাদেরকে পাব? এসব বলে দিলে তোমাকে ছেড়ে দেব আমি।’
‘তা যদি না করি?’ ঢোক গিলল ম্যাকগ্রা।
হ্যাননের মরা মাছের মত চোখে জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠল অদ্ভুত এক অশুভ আলো। ‘আমার মনে হয় নিজের স্বার্থেই মুখ খুলবে তুমি, বাছা।’
সঠিক ধারণা করেছে বেন হ্যানন।
প্রথম থেকে সব খুলে বলল বিলি ম্যাকগ্রা। তার ওপরের ঠোঁটে আছে পুরনো ক্ষতচিহ্ন। দেখতে মুচড়ে থাকা কেঁচোর মত। কথা বললে ওটার জন্যে বিকৃত হয় উচ্চারণ। রবার্ট খুন হওয়ার সময় কাদেরকে দেখেছে গড়গড় করে বলল সে। বেন জেনে গেল দুই খুনির নাম। কথা শেষ করতে গিয়েও বেনের ভ্রুজোড়া কুঁচকে উঠতে দেখে ম্যাকগ্রা জানাল আরও দুটো নাম। ওই দুই নাম শুনে বেন বুঝে গেল কেন এতটা ভয় পেয়েছে মোটা যুবক।
খুনিদের দলে ছিল ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর জন মুরে আর সার্জেণ্ট ডানকান রিড।
একটু আগেও শান্ত ছিল বেন। তবে লোকদুটোর নাম শুনে এখন রেগে উঠেছে। কঠোর গলায় বলল, ‘ভুলেও মিথ্যা বলবে না, ম্যাকগ্রা। পরে যদি জানতে পারি তারা জড়িত নয়, একেবারে মাটিতে পুঁতে ফেলব তোমাকে। আমার কথা কি বুঝতে পেরেছ?’
‘মিথ্যা বলছি না!’ বলল ম্যাকগ্রা, ‘নিজ চোখে তাদেরকে দেখেছি।’
সন্দেহ নিয়ে তাকাল বেন। ‘তাদেরকে কীভাবে চেনো তুমি?’
‘স্যামন পোচিং করতে গিয়ে ক’বার গ্রেফতার হয়েছি জানেন? ভাল করেই চিনি এদিকের কাদামাখা সবক’টা নোংরা শুয়োরকে। আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেন। দেখতে ভুল হয়নি আমার। রবার্ট খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল ইন্সপেক্টর মুরে আর সার্জেন্ট রিড।’
‘শপথ করে বলছ?’
‘মায়ের কবরের শপথ! আমি মিথ্যা বললে যেন নরকেও স্থান না পাই।’
ম্যাকগ্রার চোখে চোখ রেখে বেন বুঝে নিল, সত্যি কথাই বলছে যুবক। পিছিয়ে হেলান দিয়ে সিটে বসল সে। চুপচাপ ভাবছে দুই পুলিশ অফিসারের ব্যাপারে। তারা বলেছিল: ভাববেন না, যারা আহত করেছে আপনার ভাতিজাকে, আমরা ঠিকই তাদেরকে গ্রেফতার করব। অথচ, রবার্টকে খুন করেছে তারাই! পিটারকেও বোধহয় খুন করতে চেয়েছিল। এটা ভাবতে গিয়ে ভীষণ রেগে গেল বেন। ধুপ-ধাপ করে লাফ দিচ্ছে তার বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড। কনকনে শীতেও যেন আগুন ধরে গেল তার শরীরে। কেমন ঘোলাটে হয়ে গেছে চিন্তাগুলো। বুঝে গেল, দেরি না করে একটা বড়ি গিলতে হবে। তবে পকেট থেকে বোতলটা বের করল না সে।
‘এবার কী করবেন ভাবছেন?’ জানতে চাইল ম্যাকগ্রা।
দ্বিধাহীনভাবে বলল বেন, ‘এবার ওদেরকে খুঁজে বের করে মুখ খোলাব। ওরা বুঝবে নরকের চেয়েও বেশি কষ্ট আছে পৃথিবীতে। পুঁতে দেব ছয় ফুট নিচে। ওদের উচিত ছিল আগেই ওখানে সেঁধিয়ে যাওয়া।’
ঢোক গিলে ক্রসবো দেখল ম্যাকগ্রা। ‘না, মানে… আমার ব্যাপারে কী ভাবছেন সেটা জানতে চাইছিলাম।’
মৃদু মাথা দোলাল বেন। ‘নিজেকে রক্তপিশাচ মনে করি না, বাছা। তুমি মিথ্যা বলোনি। কাজেই ছেড়ে দেব। ফিরে যেতে পারবে নিজের বাড়িতে।’
খুশি আর স্বস্তিতে ছলছল করে উঠল ম্যাকগ্রার দুই চোখ। ‘একটা কথা বলব, মিস্টার হ্যানন?‘
‘কী?’
‘আমার খুব খারাপ লেগেছে পিটারের জন্যে। আমি ওকে সাবধান করে দিয়েছিলাম।’
‘তা বুঝতে পেরেছি, বাছা। সেজন্যে তোমাকে ধন্যবাদ।’
‘প্রার্থনা করি পিটার যেন সুস্থ হয়ে যায়।’
গম্ভীর চেহারায় মাথা দোলাল বেন। ‘ধন্যবাদ, বাছা। তুমি নিজেও বিপদমুক্ত নও—সাবধানে থেকো।
‘লুকিয়ে থাকব। কেউ জানবে না কোথায় আছি।’
‘আমার পরামর্শ চাইলে বলব: আপাতত এ এলাকা থেকে বহু দূরে চলে যাও। এদিকটা এবার হবে নরকের মত। প্যাসেঞ্জার দরজা খুলে পিকআপ থেকে নামল বেন। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে হারিয়ে গেল জঙ্গলের অন্ধকারে।