1 of 2

স্বর্ণলিপ্সা – ১৭

সতেরো

পরিচর্যা করা হয়নি বলে নিভু নিভু হয়ে এসেছে আগুন। আলাপের জন্যে ফায়ারপ্লেসের পাশের টেবিলটা বেছে নিল রানা ও জেসিকা। উইকার বাস্কেট থেকে কিছু কাঠ নিয়ে আগুনে গুঁজে দিল রানা। নতুন করে আবারও বড় হয়ে উঠছে শিখা। আগুনের দিকে বাড়িয়ে হাতদুটো গরম করতে চাইল জেসিকা। নিচু গলায় বলল, ‘আমাদের গ্রামে আগন্তুক একেবারেই আসে না। বিশেষ করে তোমার মত লোক।’

‘তুমি কি প্রশ্ন করলে, নাকি মন্তব্য?’ বলল রানা। ‘আমি কৌতূহলী, আর কিছু না।’

‘আমাকে নিয়ে ভেবো না। কাজ শেষ হলে দেরি করব না বিদায় নিতে।’

‘জানতে পারি আসলে কেন এসেছ?’

‘ব্যক্তিগত কাজে,’ বলল রানা।

‘অর্থাৎ বলবে না।’

‘তা নয়। আমি হ্যানন পরিবারের বন্ধু।’

ভুরু উঁচু করল জেসিকা। ‘পিটারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছ?’

‘সবাই দেখি ওকে চেনে,’ বলল রানা, ‘ম্যাকডোনাল্ডও ওর কথাই বলছিল। খুব অপছন্দ করে পিটারকে।’

হাত নাড়ল জেসিকা। ‘ছোট গ্রাম। পরস্পরকে চেনে সবাই। তাই সবার হাঁড়ির খবরও সবার জানা। কে ভাল বা মন্দ, সহজেই আমরা জেনে যাই। যেমন ওই ম্যাকডোনাল্ড। সে মাথাগরম একটা ষাঁড়। এমন কেউ নেই যে ওকে ভাল মানুষ বলবে। ওর কথা বাদ দাও।’

প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল রানা। ‘পিটার এখন কেমন আছে? সরাসরি গ্রামে এসেছি বলে হাসপাতালে যেতে পারিনি।’

‘ওর শরীরের অর্ধেক হাড় ভেঙে দিয়েছে। ক্ষতি হয়েছে মগজের। এখনও জ্ঞান ফেরেনি। আর কখনও না-ও ফিরতে পারে।’

‘জেনে খারাপ লাগছে।’

‘আমারও মন খুব খারাপ,’ জেসিকার চোখে সত্যিকারের দুঃখ দেখল রানা। কী যেন ভাবল মেয়েটা, তারপর বলল, ‘একেবারেই ছোটবেলার বন্ধু তো, তা-ই। ওর সঙ্গে কীভাবে তোমার পরিচয়?’

‘আমার সঙ্গে কখনও পরিচয় হয়নি। আসলে ওর জন্যে এখানে আসিনি। পিটারের চাচা আমার সিনিয়র ফ্রেণ্ড। তার খোঁজেই এদিকে এসেছি।’

ভুরু কুঁচকাল জেসিকা। ‘কেন খুঁজছ তাকে? সে কি হারিয়ে গেছে?’

‘এই গ্রামে থাকার কথা। তবে পরে জানলাম কোথায় যেন গেছে। খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’

ভুরু আরও কুঁচকে গেল জেসিকার। ‘তুমি তা হলে বলছ বেন হ্যাননের কথা?’

ওর কথায় অবাক হয়েছে রানা। চট করে জানতে চাইল, ‘তুমি তাকে চেনো কীভাবে?’

‘ভাল করে না চিনলেও পছন্দ করি। ফোর্ট উইলিয়ামের হাসপাতালে পরিচয়। গাড়িতে করে পৌঁছে দিয়েছিলাম পুলিশ স্টেশনে। আর তারপর ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর জন মুরে আর ডিটেকটিভ সার্জেন্ট ডানকান রিডের সঙ্গে যখন আন্তরিক আলাপ করলেন মিস্টার হ্যানন, সে-সময়ে ওই ঘরে আমিও উপস্থিত ছিলাম।’

‘পুলিশের সঙ্গে তো একদমই বনে না ওর। আসলে কী হয়েছিল ওখানে?’

‘আমার সুপিরিয়র অফিসাররা তাঁকে পাত্তা দিতে চাননি। আর তারপর যখন মিস্টার হ্যানন বললেন, পিটারকে পেটানোর কেসের ব্যাপারটা নিজেই তদন্ত করবেন, তখন ইন্সপেক্টর মুরে আর সার্জেন্ট রিডের সঙ্গে সম্পর্কটা আরও তিক্ত হয়ে গেল। তবে মিস্টার হ্যানন পুলিশ স্টেশন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর তাঁর সঙ্গে আর দেখা হয়নি আমার। মনে হয়েছে, কোনও সূত্র না পেয়ে হাল ছেড়ে ইতালিতে ফিরে গেছেন।’

মাথা নাড়ল রানা। ‘হাল ছেড়ে দেয়ার মানুষ বেন নয়।’ আগুনে দুটো চ্যালাকাঠ ফেলল ও। ভাবছে, আরও তথ্য দেবে মেয়েটাকে? ওর অন্তর বলছে: অনুচিত হবে কিছু বলা। অথচ, মন এটাও বলছে: তুমি বিশ্বাস করতে পারো জেসিকা থমসনকে। জরুরি তথ্যও হয়তো পাবে ওর কাছ থেকে। সামান্য দ্বিধা নিয়ে বলল রানা, ‘বেন ফিরে গেলে, পিটারের ক্যাম্পার ভ্যানটা উধাও হতো না।’

‘পিটারের ভ্যান নিয়ে গেছেন তিনি?’

মাথা দোলাল রানা। ‘পিটারের বাড়িতে গিয়েছিলাম। আমার আগে ওখানে গেছে বেন। ভ্যানটা এখন আর বাড়ির পেছনের উঠানে নেই। ফলে বুঝে গেছি, ইতালিতে ফেরেনি বেন। ওই গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের কাগজ এখন আমার কাছে। চাইলে নিতে পারো।’

মুচকি হাসল জেসিকা। ‘আমি পুলিশ, তুমি তো নও, মিস্টার রানা। কাগজপত্র দাও। কেসটা সলভ হলে পিটারের হাতে ওটা দিয়ে দেব।’

‘চাইলে আমাকে রানা বলে ডাকতে পারো,’ বলল রানা।

‘ঠিক আছে, রানা। বেন হারিয়ে গেছেন এমনটা ধরে নেয়ার কোনও কারণ নেই। সেজন্যে যথেষ্ট সময়ও পেরিয়ে যায়নি। তবে স্থানীয় অফিসারদের বলে দেব ক্যাম্পার ভ্যানের কথা। ওটা দেখলেই আটক করবে। রানা, তোমার কী ধারণা, ওই গাড়িটা কী কারণে নিয়ে গেছেন তিনি?’

‘ফোর্ট উইলিয়ামে তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ভাতিজার বাড়িতে ফিরেছে বেন। তারপর যখন স্থির করেছে কী করবে, তখন যানবাহন লাগবে বলে ক্যাম্পার ভ্যান নিয়ে গেছে।’

নড করল জেসিকা। ‘শেষবার যখন দেখলাম, গ্রামে আসবেন বলে বাসের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন।’

এবং এরপর থেকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না,’ বলল রানা। ‘এ থেকে মনে হচ্ছে, কয়েকটা কাজ করতে পারে বেন।’

‘যেমন?’

‘ওর হার্টের অবস্থা ভাল নয়।’

‘তাই? হায়, ঈশ্বর! জানতাম না। আমার মনে হয়েছিল, এই বয়সেও অনেক সুস্থ তিনি।’

‘গতকাল পর্যন্ত আমিও তাই ভাবতাম।’

‘তুমি কি তা হলে ভাবছ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি?’

‘হয়তো। এজন্যেই বেশি চিন্তিত ওর স্ত্রী মিরাণ্ডা। আমিও দুশ্চিন্তায় আছি। তা ছাড়া, অন্য বিপদেও পড়তে পারে। এই গ্রামে বাজে সব ঘটনা ঘটছে। প্রথমে মরল রবার্ট উইলসন। তারপর পিটিয়ে আহত করা হলো পিটারকে। এখন বেনের কী ঘটেছে, সেটা আমরা জানি না।’

গভীর চিন্তায় তলিয়ে গেল জেসিকা। একটু পর বলল, ‘বেন হ্যাননকে বলেছি, এদিকের মানুষের কাছে যেন রবার্ট বা পিটারের ব্যাপারে প্রশ্ন না করেন। তাঁকে বলেছি, তাঁর জন্যে দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার।’

‘কী কারণে দুশ্চিন্তা?’

‘কারণ, বেন হ্যানন ভেবেছিলেন রবার্ট আর পিটারের কেস একই শেকড় থেকে উঠে এসেছে। তাই আমার মনে হয়েছিল, পিটারকে যারা পিটিয়ে আহত করেছে, তাদেরকে পুলিশ ধরতে না পারলে যখন-তখন বেন হ্যাননের ক্ষতি করবে তারা।’

‘তা হলে কি ওই দুই কেস আসলে সম্পর্কিত?’

মাথা নাড়ল জেসিকা। ‘এগুলো পুলিশ তদন্তের বিষয়। তোমাকে এ বিষয়ে কিছু জানাতে পারব না।’

‘পিটারকে যারা আহত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে জরুরি কোনও সূত্র পেয়েছে পুলিশ?’

‘এই বিষয়েও জবাব দেব না। তা ছাড়া, ওই কেসে আমাকে কাজ করতে দেয়া হয়নি।’

‘তদন্তের দায়িত্ব তা হলে কার?’

‘বেন হ্যানন যে দুই অফিসারের সঙ্গে কথা বলেছেন, সেই ইন্সপেক্টর মুরে আর সার্জেন্ট রিড আছেন এই দুই কেসে।’

কেস তোমাকে না দেয়া হলেও তুমি কৌতূহলী। কারণ পিটিয়ে আহত করেছে তোমার ছোটবেলার বন্ধুকে। বুঝতে পেরেছি। আমার মনে হচ্ছে, অনেক কিছুই ভাবছ তুমি। সেগুলো শেয়ার করবে আমার সঙ্গে?’

‘এখন পর্যন্ত কাউকে সন্দেহভাজন বলে ধরে নেয়া হয়নি। আপাতত এর বেশি কিছু আমার জানা নেই।

‘আমিও আছি আঁধারে,’ বলল রানা। ‘এই দুই কেস সম্পর্কে ভুল কিছু বললে আমাকে শুধরে দিয়ো।’

‘তুমি তথ্য শেয়ার করলে, শুনতে আপত্তি নেই আমার।’

‘তার মানে, নিজে থেকে কিছু বলবে না।’

‘আমি পুলিশ আর তুমি সাধারণ মানুষ। এই সূত্র ধরে এগোতে পারো।’

‘ঠিক আছে,’ বলল রানা, ‘যুক্তির বাইরে যাচ্ছ না। এখন প্রথম কথা: বেন যদি পিটারের আহত হওয়ার বিষয়ে কোনও প্রমাণ পেয়ে থাকে, হয়তো সতর্ক হয়ে গিয়ে ওর ওপর হামলা করবে একদল বাজে লোক।’

‘তাতে কোনও সন্দেহ নেই।’

‘দ্বিতীয়ত: তুমি তো আর আমার মত করে বেনকে চেনো না। ভয় পেয়ে কোনও কিছু থেকে পিছিয়ে যায় না সে। হার্ট যেমনই হোক, বেন গ্র্যানিট পাথরের চেয়েও কঠিন।’

‘গ্লাসগোতে এ ধরনের মানুষ দেখেছি। চিনি কতটা শক্ত হয় এরা।’

‘কিন্তু বেনকে চেনো না,’ বলল রানা, ‘ও বোমার চেয়েও বিপজ্জনক দক্ষতার চূড়ায় ওঠা এক যোদ্ধা। ভাবতেও পারবে না কী করতে পারে সে।’

চোখ সরু করে ওকে দেখল জেসিকা। ‘বলতে থাকো। আমি শুনছি।’

‘পিটারকে যারা আহত করেছে, তারা জানে না যে নরক ডেকে এনেছে নিজেদের মাথার ওপর। তাদের মাথার ওপরে আছে বড় কেউ। হয়তো অর্গানাইড্ ক্রাইমের কোনও মাফিয়া ডন। এমন একজন, যে কি না দরকারে দলের লোক দিয়ে খুন করাতে দ্বিধা করবে না।’

‘এসব যৌক্তিক মনে হচ্ছে তোমার?’ জানতে চাইল জেসিকা।

‘না, তা মনে হচ্ছে না।’

‘যা বলছ, সবই আন্দাজে,’ বলল জেসিকা। ‘প্রথমেই কথা উঠবে: এসবের পেছনে মোটিভ কই? কিনলোকার্ড গ্রামে কী আছে যে বাইরের ক্রিমিনালরা হামলে পড়বে এখানে?’

‘কিছু সত্যিই আছে,’ বলল রানা। ‘এটা আন্দাজ নয়। আমার ধারণা: এদিকের জঙ্গল বা টিলায় আছে লাখ লাখ পাউণ্ডের সোনার কয়েন।’ মোবাইল ফোন বের করে সোনার মোহরের ছবি জেসিকাকে দেখাল রানা। ‘এটা পাওয়া গেছে এদিকে।’

‘ব্যাখ্যা করে বলো,’ বলল জেসিকা।

রবার্ট উইলসনের সোনার কয়েন পাওয়া থেকে শুরু করল রানা। তারপর রবার্ট খুন হওয়ায় পেটানো হলো পিটারকে। ধরে নেয়া হয়েছিল তার কাছে আছে সোনার কয়েনের হদিস। গড়গড় করে বলে গেল রানা, ‘শত শত বছর আগের এসব সোনার কয়েন সাধারণ সোনার চেয়ে ঢের বেশি দামি। ব্ল্যাক মার্কেটে যা দাম উঠবে, তাতে মানুষ খুন করতেও দ্বিধা করবে না কোনও সংগ্রাহক।’

‘চোরাই অ্যান্টিকুইটি? এই বিষয়ে কতটা জানো তুমি?’

‘যথেষ্ট জানি। এসব সোনার কয়েনের জন্যে খুন করবে বেশিরভাগ মানুষ।’

ছবিটা চিন্তিত চোখে দেখল জেসিকা। ‘বলা হয় এদিকে আছে বেশ কিছু গুপ্তধন। যদিও কখনও মনে হয়নি বাস্তবে ওসব আছে। রবার্ট সোনার কয়েন কোথায় পেয়েছিল? কতগুলো ছিল?’

‘কোথায় পেয়েছে বা কতগুলো তা আমি জানি না,’ বলল রানা। ‘তবে যথেষ্ট না পেলে গ্রামের পাবে এসে বগলবাজি করত না। ভেবেছিল, বড়লোক হয়ে গেছে সে। বাকি জীবন কাটাবে ইতালি বা ফ্রান্সের সৈকতের ধারে কোনও বাড়ি কিনে।’

‘তোমার কাছে আছে মাত্র একটা কয়েনের ছবি। আরও আছে বলে ভাবছ কেন?’

ললিপপ লিলি পুলিশি ঝামেলায় জড়িয়ে যাক, তা চাইছে না রানা। তাই তার কথা উল্লেখ করল না। ‘এই তথ্যটা গোপনীয়, অফিসার। সোর্স সম্পর্কে কিছুই জানাতে চাই না।’

‘পুলিশের কাছে তথ্য গোপন আইনের চোখে অপরাধ।’

‘তা হলে আমাকে গ্রেফতার করো।’

কড়া চোখে রানাকে দেখল জেসিকা। একটু পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ঠিক আছে। আর কী জানতে পেরেছ?’

‘পিটার পেয়েছিল রবার্টের অন্তত একটা কয়েন। কপালের জোরে বোধহয় পেয়ে যায়। আমার মনে হয় না রবার্ট ওর বন্ধুকে সোনার কয়েনের হদিস দিয়েছিল। এটাও বলেনি যে গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবছে সে। তবে পিটারের ওপর হামলা করল যারা, তারা জানত না যে কিছুই জানে না সে। তথ্যের জন্যে পেটানো হলো ওকে। অথবা, হয়তো ওর কাছ থেকে জেনে নিয়েছে কোথায় আছে গুপ্তধন। রবার্ট খুনের সময় ঘটনাটা দেখে ফেলে স্যামন মাছ-শিকারি এক পোচার। সে যে খুনের সাক্ষী, সেটা তারা জানত না। পিটারও চিনতে পারেনি তাকে। চাচার কাছে সাহায্য চেয়েছিল সে। আর সেজন্যেই স্কটল্যাণ্ডে পা রাখে বেন হ্যানন।’

চুপ করে আছে জেসিকা। রানা বুঝতে পা গভীরভাবে ভাবছে মেয়েটা। অবশ্য মুখ খুলল না।

‘ওই সাক্ষীকে পেলে উন্মোচিত হবে এই রহস্য,’ বলল · রানা। ‘তখন জানা যাবে আসলেই রবার্ট খুন হয়েছে কি না। মিথ্যাও বলে থাকতে পারে সে। হয়তো পানিতে ডুবেই মরেছে রবার্ট। আত্মহত্যাও করে থাকতে পারে।’

কী যেন ভাবছে জেসিকা।

‘এটা ধরে নাও, পিটারের ভ্যান নিয়ে ওই সাক্ষীর খোঁজেই গেছে বেন,’ বলল রানা, ‘ওই লোককে পেলে, জানবে অনেক কিছুই। পুলিশেরও একই পথে তদন্ত করা উচিত ছিল। তারা কি সেটা করছে?’

মাথা নাড়ল জেসিকা। ‘আগেই বলেছি, তদন্তের ব্যাপারে কিছুই বলব না।’

‘তার মানে, তুমি বহু কিছু জানলেও তদন্ত থেকে তোমাকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে,’ বলল রানা। ‘সেটা করেছে ইন্সপেক্টর মুরে আর সার্জেন্ট রিড।’

‘তা ঠিক।’

‘সেজন্যে দোষ দিচ্ছি না তাদেরকে। নিয়ম নিয়মই। এ ব্যাপারে আমার কোনও অভিযোগ নেই। এই দুই কেস বা বেন হ্যাননের ব্যাপারে আরও কোনও প্রশ্ন আছে তোমার?’

‘কৌতূহল হচ্ছে। এবার কী করবে তুমি।’

‘আপাতত কোথাও যাচ্ছি না। আগে খুঁজে বের করব বেন হ্যাননকে। সেজন্যে চারপাশে চোখ রাখব।’

‘গ্রামে থাকার মত কোনও জায়গা আছে তোমার?’

‘নেই,’ বলল রানা। ‘দরকারে একটা তাঁবু কিনে নেব।’

‘ডিসেম্বরের শীতে তাঁবু?’

রানা জানাল না, এর চেয়ে ঢের খারাপ পরিবেশে মাসের পর মাস থাকার অভিজ্ঞতা আছে ওর। সহজ সুরে বলল, ‘দেখি কোথায় ওঠা যায়।’

‘কিনলোকার্ড গ্রামে ক্যাম্পিং সাপ্লাইয়ের দোকান নেই,’ বলল জেসিকা, ‘হোটেল বা গেস্টহাউসও নেই যে ওখানে উঠবে।’

‘তা হলে ঘুমাব গাড়িতে।’

‘গ্রামের ধারে মিসেস ক্লার্কের খালি কটেজ আছে। ওটা ভাড়া নিতে পারো।’

‘মিসেস ক্লার্ক?’

‘গ্রামের সবচেয়ে বয়স্কা মহিলা। আমি যখন ছোট ছিলাম, তখনও তিনি এতটাই বুড়ি ছিলেন। মিলিয়নখানেক বছর হবে তাঁর বয়স। ঝুনো নারকেলের মত। তবে মাথা খেলে খুব ভাল। ক’দিন আগেও কথা বলেছি। খুশি মনেই তোমাকে কটেজ দেবেন। অবশ্য আগেই আদায় করবেন এক সপ্তাহের ভাড়া। টাকা পেলে খুব খুশি হন। ‘

রানার ধারণা: ওর ওপর চোখ রাখতেই সাহায্য করতে চাইছে জেসিকা। তা হোক। আপাতত তার সঙ্গে একই পথে হাঁটতে ওর আপত্তি নেই। তা ছাড়া, গাড়ির বদলে কটেজে ঘুমাতে পারলে ভালমত বিশ্রাম নিতে পারবে। প্রয়োজনে যে- কোনও সময়ে জেসিকার চোখ এড়িয়ে উধাও হবে। খুশি মনেই বলল রানা, ‘সমস্যা নেই, কটেজটা তা হলে কোথায়?’

‘আমিই ড্রাইভ করে নিয়ে যাচ্ছি। বুড়ির সঙ্গে পরিচয়ও করিয়ে দেব।’

‘আমার ভাড়া করা গাড়িটা আছে পিটারের বাড়ির সামনে,’ বলল রানা।

‘গ্রামের কিনারায় বুড়ির কটেজ। ওখান থেকে বেশি দূরে নয় পিটারের বাড়ি। বুড়ির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর সহজেই গাড়িটা সংগ্রহ করে নিতে পারবে। দশ মিনিটের হাঁটা পথ।

পাব ছেড়ে তুষারপাতে বেরোল রানা ও জেসিকা। উঠানের একটু দূরে আছে পুরনো ল্যাণ্ড রোভার। গাড়িটা দেখে মৃদু হেসেছে রানা, সেটা খেয়াল করেছে জেসিকা। তাই বলল, ‘ভেবেছিলে লাল, ছোট কোনও ফিয়াট চালাই? হেডলাইটের ওপরে থাকবে চোখের পাপড়ি?’

‘গাড়িটা ভাল লেগেছে আমার,’ বলল রানা।

‘বেন হ্যাননেরও ভাল লেগেছিল।’

গাড়িতে উঠল ওরা। ঢং শব্দে বন্ধ হলো দরজা। ইঞ্জিন চালু করে হেডলাইট অন করল জেসিকা। সুইচ টিপে দেয়ায় উইণ্ডস্ক্রিনের ওপর থেকে তুষার ঝেড়ে ফেলল শক্তিশালী ওয়াইপার। হিটার ভেণ্ট থেকে বেরোল বরফ-ঠাণ্ডা হাওয়া। গিয়ার ফেলে ফাঁকা রাস্তায় উঠল মেয়েটা। গ্রামের মাঝ দিয়ে চলেছে ল্যাণ্ড রোভার। রানা বলল, ‘তো কিনলোকার্ড গ্রামেই থাকে তোমার স্বামী?’

নিস্পৃহ চোখে ওকে দেখল জেসিকা।

অপ্রস্তুত হয়ে রানা বলল, ‘সরি। স্বামী বলা বোধহয় ঠিক হলো না। পার্টনার? পাবে ঢোকার সময় দেখেছি তোমরা

একই টেবিলে বসে ছিলে।’

‘মাইক?’ হেসে ফেলল জেসিকা। ‘না তো! আমরা তো বিবাহিত বা পার্টনার নই।

‘তা হলে ভুল ভেবেছি।’

‘তাতে কোনও ক্ষতি হয়নি। আগে আমার সঙ্গে তাকে জড়িয়ে গল্প ফাঁদত গ্রামের অনেকে। পরে জানল, সে আসলে সমকামী। গ্রামে পার্টনার নেই। প্রতি সপ্তাহে দু’বার ইনভার্নেস শহরে ঘুরতে যায়।’ রানা চুপ করে আছে বলে আলাপটা আরেকটু এগিয়ে নিল জেসিকা, ‘এ গ্রামের মানুষগুলোর ভেতর নিজেদের ব্যক্তিগত বলে কোনও কথা নেই। পর্দার আড়াল থেকে সবাই চোখ রাখছে সবার ওপর। আমি নিজে অবিবাহিতা… সেটা যদি জানতে চেয়ে থাকো।

‘না, তা বলছিলাম না,’ অস্বস্তি কাটয়ে বলল রানা।

অন্য প্রসঙ্গে গেল জেসিকা। ‘তোমার ড্রাইভিং লাইসেন্স থেকে জানলাম তুমি লণ্ডনে থাকো।’

মাথা দোলাল রানা।

‘ওখানে কী করো?’

‘প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটরের কাজ।’

‘আগে বেন হ্যাননের সঙ্গে আর্মিতে ছিলে?’

‘এ-কথা বলেছে বেন?’ অবাক হলো রানা। বুড়ো কখনোই মিলিটারিতে তার অতীত জীবন নিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলে না।

‘এখন টমেটো চাষ করে ইতালির খামারে। অনেকেই তাদের মনের কথা আমাকে বলে। কেন বলে, জানি না। বোধহয় আমার নিরীহ চেহারার জন্যেই।’

‘আমি নিজের ব্যাপারে কিছু বলিনি।’

‘না, বলোনি। ফলে কৌতূহলী হয়ে গেছি। নিজ চোখে দেখেছি, মার খেয়ে ভূত হয়েছে গ্রামের পাকা হারামি তিনটা খাটাশ। অথচ, একটা ঘুষিও দাওনি। যেভাবে কথা বলো, বা ভাবো, তাতে আমার মনে হয়েছে, আগে ছিলে মিলিটারিতে। তবে জানি না কত দিন আগে চাকরি ছেড়েছ।’

‘যেভাবে আন্দাজে সব জেনে যাচ্ছ, তাতে তো তোমার এতদিনে ডিটেকটিভ সার্জেন্ট হয়ে যাওয়ার কথা।’

‘সে চেষ্টাতেই আছি,’ বলল জেসিকা, ‘আমি কি ভুল বলেছি?’

‘বেশ কয়েক বছর আগেই অবসর নিয়েছি,’ বলল রানা।

‘মিলিটারিতেই বেন হ্যাননের সঙ্গে তোমার পরিচয়?’

‘হুঁ, আমার ট্রেইনার ছিল। এত সৎ মানুষ খুব কম‍ই দেখছি।’

‘বন্ধুর জন্যে এত দূরে এসেছ বলে তোমার প্রশংসা না করে পারছি না। বন্ধুদের এমনই হওয়া উচিত। একে অপরের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাহায্য করবে।’

কথাটা অন্তর থেকে বলেছে জেসিকা, নাকি খুঁড়তে চাইছে আরও তথ্য, ভাবল রানা। ‘পারতপক্ষে মিথ্যা বলি না। এখানে এসেছি বেনকে খুঁজতে। জেনে নেব ওর কী হয়েছে। পথে কেউ বাধা দিলে সাধ্যমত চেষ্টা করব তাকে সরিয়ে এগিয়ে যেতে। এর বেশি কিছু বলার নেই আমার।’

‘পুলিশ স্টেশনে আমার ঊর্ধ্বতন অফিসারকে বেন যা বলেছিলেন, সেটার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে তোমার কথা,’ বলল জেসিকা। ও নকল করল বৃদ্ধ যোদ্ধার গলা: ‘তোমরা বরং আমার পথ থেকে দূরে থেকো। নইলে বিপদে পড়বে।’ আমি আসলে মানুষটার জন্যে দুশ্চিন্তায় পড়েছি। নিজে তদন্ত না করলেই হয়তো ভাল হতো। আশা করি তুমিও তাঁর মত ওই একই ভুল করবে না?’

‘আমি ঝামেলা করতে এখানে আসিনি,’ বলল রানা। ‘অথচ, গ্রামে এসেই হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছ এদিকের সবচেয়ে বদমাশ দু’তিনজনকে।’

‘ঝামেলা কিন্তু ওরাই করেছে, আমি না। মাত্র একটা কাজেই এখানে এসেছি। আমার বন্ধুকে যেন নিরাপদ আর সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি।’

‘শুনে খুশি হলাম। আশা করি ভালই আছেন মানুষটা।’

ওরা পৌঁছে গেছে বুড়ির বাড়ির সামনে। গাড়ি পার্ক করে নেমে পড়ল মেয়েটা। তার পিছু নিল রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *