1 of 2

স্বর্ণলিপ্সা – ৫০

পঞ্চাশ

দুর্গে একের পর এক ঘরে ঝড়ের মত হানা দিচ্ছে বাক ওয়াকি, হতাশ। বিরক্ত হচ্ছে রন স্টুয়ার্টের ওপর। শালার আক্কেল নেই যে এতবড় বাড়ি বানিয়ে বসে আছে! ফোন বেজে উঠতেই কল রিসিভ করল সে।

‘কী, বাক, অন্যরা কই?’ ভারী গলায় জানতে চাইল মৌরেন লরি। ‘কই, কেউ তো আমাদেরকে বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছে না! সব শালা কি ভুলেই গেল যে আমরা পুরনো বন্ধু?’

‘তুমি কোথায়?’

‘শালার দরজার সামনে। ওটা তো অন্তত খুলবে, নাকি? বরফের ভেতর ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছি!’

নাকে ক্রিস্টাল মেথ গুঁজে দুর্গের লবির দিকে ছুটল বাক ওয়াকি। একতলায় নেমে বুঝল, আশপাশে নেই রন স্টুয়ার্ট। মাত্র তিনমিনিটের মাথায় বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলো তার। নবাগত দলের সবার পরনে ভারী কোট এবং কমব্যাট বুট। পাঁচজনের সঙ্গে পেটমোটা মিলিটারি হোল্ডঅল। ওগুলোর ভেতরে কী আছে সেটা ভাল করেই জানে বাক ওয়াকি।

মৌরেন লরি ষাঁড়ের মত তাগড়া লোক। বলা হয় কখনও হাতাহাতি লড়াইয়ে হার হয়নি তার। লরির দোস্ত ক্রিস কোল তার উল্টো। ঝাড়ুর শলার মত সরু হলেও ম্যাচের কাঠির মত বেঁটে। দু’চোখ পিটপিট করে পাখির মত করে।

এ ছাড়া, দলে আছে মিলিটারি থেকে ঘাড় ধরে বের করে দেয়া আরও আট ডিযঅনারেবল: ইয়ান, লরেন্ট, ওয়ার্নার, এরিক, ম্যাড, লুই, আলী ও ডগলাস।

মৌরেন দানব হলে ইয়ান হচ্ছে দানবের বাপ—দৈর্ঘ্যে সাত ফুট এক ইঞ্চি। পেশিভরা মোটা ঘাড় মাথার চেয়ে চওড়া।

ওয়ার্নারের রয়েছে শুধু ডানদিকের কান।

আর লরেন্টের আছে মাত্র একটা চোখ। মুখের বামদিক কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখে সে।

খোঁচা-খোঁচা চুল থেকে তুষারকণা ঝাড়তে গিয়ে মাথায় হাত বোলাল মৌরেন লরি। বিস্ময় নিয়ে দেখছে বাজেভাবে আহত হয়েছে পুরনো বন্ধু বাক ওয়াকি। ‘হায়, যিশু! কী ব্যাপার, বাক? তোমাকে তো ঝাঁঝরা করে দিয়েছে!’

‘আরে, না!’ ড্রাগসের কারণে মগজে রক্ত টগবগ করছে বাক ওয়াকির। আগের চেয়েও সতর্ক। ক’বার মনে হয়েছে, দরকারই নেই ডাক্তার বা হাসপাতালের! এমনিতেই ভাল আছে। ‘যাক, ভাল লাগছে যে তোমরা পৌঁছে গেছ।’

‘হ্যাঁ, কপাল ভাল শেষমেশ পৌঁছুতে পেরেছি,’ বলল দানব। ‘যা আবহাওয়া, পাইলট শালা তো ভাবছিল নামতেই পারবে না। এয়ারফিল্ড ছেয়ে গেছে বরফে। পথের হালও ভাল না। আমরা অবশ্য এসব পাত্তা দিইনি। আর এখানে এসে দেখছি বড় ঝামেলায় পড়ে গেছ তোমরা। কোয়ার্ট কোথায়? বা বেল আর বেনেট?’

‘ওরা সবাই মারা গেছে, মৌরেন।’

সাইকোপ্যাথ দানব মৌরেন লরি। সংবাদটা শুনে ও চোখের পাতা পড়ল না তার। শান্ত, নিচু গলায় বলল, ‘বলেছিলে হ্যারি শেষ। তা হলে বলছ, আমাদের চারজনকে খতম করে দিয়েছে মাত্র একজন লোক?’

ড্রাগসের জন্যে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হচ্ছে বাক ওয়াকির মগজে। তাই বলে হারিয়ে বসেনি যৌক্তিক চিন্তা। স্টুয়ার্ট ওদের দলের কাউকে খুন করেছে বললে মৌরেন আর অন্যরা সঙ্গে সঙ্গে লোকটাকে খুন করতে চাইবে। তাতে যে আপত্তি আছে ওয়াকির, তা-ও নয়। তবে আগে লোকটার কাছ থেকে পেতে হবে মিলিয়ন মিলিয়ন পাউণ্ড। এদিকে এ-ও বলা যাবে না, ওরা বোকা বনেছে এক মেয়ের কাছে। কয়েক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলল সে, ‘হ্যাঁ, ওরা খুন হয়েছে তার হাতেই।’

‘তুমি যদি বলো এই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে সে, তো আমরা খুব হতাশ হব,’ চাপা স্বরে বলল মৌরেন।

‘না, এদিকেই আছে। তোমরা পৌঁছে গেছ, এবার সবাই মিলে গেঁথে ফেলব ওকে।’

‘তো ঠিক সময়েই পার্টিতে যোগ দিয়েছি,’ বলল মৌরেন। দলের পাঁচজনের ব্যাগের দিকে হাতের ইশারা করল সে। ‘ব্যাগ খোলো। বাক ওয়াকি দেখুক মজা করার জন্যে সঙ্গে করে কী এনেছি।’

নিয়মিত নানান দেশে মার্সেনারি হিসেবে কাজ করে সে। এ ছাড়া আছে অস্ত্র স্মাগলিঙের ব্যবসা। লণ্ডন ও ম্যানচেস্টারের অর্গানাইড্ ক্রাইম গ্যাংগুলোকে আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করে। এখন রন স্টুয়ার্টের কাছে বিক্রি করছে রোমানিয়ান ফুল অটোমেটিক একে-৪৭ ব্যাটল রাইফেল। সঙ্গে আছে ফোল্ডিং স্টক, ট্যাকটিকাল লাইট, লাইট, লেযার, স্পেয়ার ম্যাগাযিন আর হাজার হাজার গুলি।

অস্ত্র দেখে মাথা দোলাল বাক ওয়াকি। ‘এতেই হবে। ঠিক আছে, এবার কাজে নেমে পড়ব। গোলমাল শুরু হওয়ার একটু আগেও নিচের ডানজনে ছিল মাসুদ রানা। তবে আমার ধারণা, এতক্ষণে ওখান থেকে বেরিয়ে দুর্গের বাইরে চলে গেছে।’

‘তাই যদি হয়, সে কি আর বসে আছে?’ বলল ক্রিস কোল। ‘নিশ্চয়ই এতক্ষণে হাওয়া হয়ে গেছে।’

‘তা করবে না, কারণ দুর্গেই রয়ে গেছে মেয়েটা,’ বলল বাক ওয়াকি। ‘তাই তাকে আবারও ফিরতে হবে।’

‘কীসের মেয়ে?’ জানতে চাইল মৌরেন।

‘পুলিশের এক মহিলা অফিসার,’ বলল বাক ওয়াকি। ‘তার সঙ্গে মাখামাখি আছে মাসুদ রানার। মেয়েটা এখন দুর্গে লুকিয়ে আছে। আগে তাকে খুঁজে বের করতে হবে।

আরও তথ্যের দরকার নেই মৌরেনের দলের কারও। পুলিশের প্রতি এমনিতেই শ্রদ্ধা নেই তাদের মনে। আর সেই পুলিশ যদি মেয়ে হয়, তা হলে তো কথাই নেই।

‘চিবিয়ে খেয়ে নেব ওকে,’ বলল মৌরেন।

মাথা দোলাল বাক ওয়াকি। ‘তাতে সমস্যা নেই। তবে মাসুদ রানা যেন জীবিত থাকে, সেটা চাইছেন আমার বস্। কাজটা কঠিন হবে।’

‘বাঁচিয়ে রাখতে হবে কেন?’

‘কারণ বসের ধারণা, কোথাও টনকে টন সোনার কয়েন লুকিয়ে রেখেছে রানা।

‘কথা কি সত্যি?’ আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল মৌরেন। বন্ধুর দুই চোখ চকচক করতে দেখল বাক ওয়াকি। দানব ভাবছে, স্টুয়ার্টকে কাঁচকলা দেখিয়ে কয়েন লোপাট করবে। ওয়াকির ধারণা বাস্তবে ওগুলো নেই, নইলে নিজেই রানা আর স্টুয়ার্টকে যমের বাড়িতে পাঠিয়ে সব দখল করত।

‘আরেকটা কথা,’ বলল সে, ‘রানার পরিচিত এক বুড়োও আছে। আগে চাকরি করত এসএএস ফোর্সে। হয় দুর্গের ভেতরে, নয়তো বাইরে কোথাও আছে। দু’জন মিলে হয়তো ঘোঁট পাকাতে চাইছে।’

‘তাতে সমস্যা নেই। তাকেও কি জীবিত ধরতে হবে?’

মাথা নাড়ল ওয়াকি। ‘ওকে শেষ করলেও ক্ষতি নেই।’

‘ঠিক আছে, একটু পর শিকারে বেরোব,’ বলল মৌরেন। ‘এখন আগে চাই এক মগ গরম কফি।’

মুহূর্তের জন্যে বাক ওয়াকি ভাবল, বোধহয় বেশি মেথের কারণে ভুল শুনেছে কানে। পরক্ষণে বলল, ‘সময়মত এখান থেকে বেরোতে হবে। হাতে সময় নেই, মৌরেন।’

চেহারা গম্ভীর করে মাথা নাড়ল দানব। ‘এক মগ করে কফি না পেলে লড়তে পারব না, বাক। সেই সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। আগে কিছু খেয়ে নেব। বয়েয, তোমরা কী বলো?’

‘ঠিক,’ বিড়বিড় করে সায় দিল ক্রিস কোল এবং অন্যরা।

‘বেশ,’ হাল ছেড়ে দিল রাক ওয়াকি। ‘তো এসো।’

কিছুক্ষণ পর দুর্গের মস্ত কিচেনে পৌঁছল তারা। চুলায় চাপিয়ে দেয়া হলো পানিভরা বড় কেতলি। কেবিনেট থেকে কয়েক প্যাকেট দামি বিস্কুট নিয়ে টেবিল ঘিরে বসল সবাই। ‘তোমার বসের রুচি আছে,’ মন্তব্য করল মৌরেন। ‘যেমন দুর্গ, তেমনই কিচেন। রাজকীয়।’

‘টাকার অভাব নেই তার।’

‘কারও কারও কপাল ভাল থাকে, তাই না?’ বিরক্ত হয়ে বলল মৌরেন।

একটু পর মগে কড়া কফি ঢেলে নিল সবাই। কালো তরলে চুমুক দেয়ার ফাঁকে নিজেদের মাঝে বাটোয়ারা করল একে-৪৭। অস্ত্রগুলো কক করার সময় কিচেন ভরে উঠল ধাতব আওয়াজে। রাইফেল নিল না শুধু বাক ওয়াকি। এক হাতে ওটা ব্যবহার করতে পারবে না। আপাতত পিস্তল হাতেই লড়তে হবে তাকে।

রাইফেল মাথার উপর তুলে জটিল হাসি দিল ক্রিস কোল। ‘এবার রক-অ্যান-রোল শুরু হবে। এতক্ষণ কপালের জোরে বেঁচে গেছে মাসুদ রানা। কিন্তু দশজনের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না। আমরা ওকে ন্যাংটো করে…’

ঠিক তখনই প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজে চুপ হয়ে গেল সে। থরথর করে কেঁপে উঠল গোটা দুর্গ।

‘আরেহ্…’

ভীষণ দুলুনি আর আওয়াজে থমকে গেছে সবাই। পায়ের নিচে থরথর করে কাঁপছে মেঝে। বাক ওয়াকির মনে হলো চারপাশে শুরু হয়েছে জোরালো ভূমিকম্প। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ হচ্ছে দুর্গের ওপর। নানাদিকে বিকট আওয়াজ। এদিক-ওদিক দুলছে ঘরের দেয়াল। ঝরঝর করে ঝরছে শুকনো রঙ ও সিমেন্টের চাপড়া। যখন-তখন ছাত ধসে পড়বে ভেবে মাথা নিচু করে নিল ডিযঅনারেবলরা।

‘হামলা করেছে!’ চেঁচিয়ে উঠল লরেন্ট। বিস্ফারিত হয়েছে তার একমাত্র চোখটা।

বিস্ময় নিয়ে বাক ওয়াকির দিকে চেয়ে আছে অন্যরা।

আসলে কী ঘটছে জানা নেই ওয়াকির। তবে একটা ব্যাপারে মনে কোনও সন্দেহ নেই। চাপা স্বরে বলল সে, ‘মাসুদ রানা! সবই ওই শালার কুকীর্তি!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *